ষষ্ঠ মূলনীতি: সিফাত (গুণাগুণ) সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে বড় দুটি নিষিদ্ধ বিষয় থেকে মুক্ত থাকা খুবই জরুরি। এর একটি হলো ‘তামছীল’ (সাদৃশ্য নির্ধারণ) আর অপরটি হলো ‘তাকয়ীফ’ (ধরণ নির্ধারণ)।

‘তামছীল’ হলো, গুণাগুণ সাব্যস্তকারী ব্যক্তির এ বিশ্বাস আসা যে, আল্লাহর জন্য সে যে গুণাগুণ সাব্যস্ত করছে তা সৃষ্টিজীবের গুণাগুণের অনুরূপ (সৃষ্টিজীবের গুণাগুণের মতো)। এ ধরনের বিশ্বাস বাতিল বিশ্বাস। এর প্রমাণ ওহী ও মানববুদ্ধি।

ওহী থেকে এর প্রমাণ হলো আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ﴾ [الشورى: ١١]

তার মত কিছু নেই। (সূরা আশ-শূরা: ৪২: ১১)

তিনি আরো বলেন:

﴿ أَفَمَن يَخۡلُقُ كَمَن لَّا يَخۡلُقُۚ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ ١٧ ﴾ [النحل: ١٧]

সুতরাং যে সৃষ্টি করে, সে কি তার মত, যে সৃষ্টি করে না? অতএব তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না? (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ১৭)

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন:

﴿هَلۡ تَعۡلَمُ لَهُۥ سَمِيّٗا ٦٥ ﴾ [مريم: ٦٥]

তুমি কি তাঁর সমতুল্য কাউকে জান? (মারয়াম: ১৯: ৬৫)

আরো বলেন:

﴿ وَلَمۡ يَكُن لَّهُۥ كُفُوًا أَحَدُۢ ٤ ﴾ [الاخلاص: ٤]

আর তাঁর কোনো সমকক্ষও নেই। (সূরা আল ইখলাস: ১১২: ৪)

মানববুদ্ধির দলিল

প্রথমত: এটা স্বতসিদ্ধভাবে জানা যে সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টিবস্তুর মধ্যে সত্তাগতভাবে পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্যের দাবি হলো এ উভয়ের মধ্যে গুণের ক্ষেত্রেও পার্থক্য হবে। কেননা প্রত্যেক গুণান্বিতের তার উপযুক্ত গুণ বা সিফাত থাকে। এটা ভিন্ন ভিন্ন সৃষ্টবস্তুর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন গুণ থাকার মধ্যে স্পষ্ট। উদাহরণত উটের ক্ষমতা ও পরমাণুর ক্ষমতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। অতএব যদি সৃষ্টিবস্তুর গুণের মধ্যে পরস্পরে পার্থক্য থাকে যদিও তারা সৃষ্টিবস্তু হওয়া হিসেবে সমতুল্য, তাহলে সৃষ্টবস্তু ও সৃষ্টিকর্তার মধ্যে পার্থক্যের বিষয়টি তো আরো স্পষ্ট এবং অধিক শক্তিশালী।

দ্বিতীয়ত: যিনি সৃষ্টকর্তা রব, যিনি সকল দিক থেকে পূর্ণাঙ্গ তিনি গুণের ক্ষেত্রে কীভাবে সৃষ্টিবস্তুর সমতুল্য হবেন যে নাকি অপূর্ণাঙ্গ ও মুখাপেক্ষী। অতএব যদি কেউ সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টিবস্তু সমতুল্য বলে বিশ্বাস করে তবে তার এ বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তার অধিকারকে খর্ব করবে; কেননা যিনি পূর্ণাঙ্গ তাকে অপূর্ণাঙ্গের সঙ্গে উদাহরণ দেওয়া পূর্ণাঙ্গকে অপূর্ণাঙ্গ করে দেওয়া।

তৃতীয়ত: সৃষ্টিবস্তুর মধ্যেও এ বিষয়টি লক্ষ্যণীয় যে নামের ক্ষেত্রে অভিন্নতা থাকলেও প্রকৃতি ও ধরন-ধারণের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকে। যেমন মানুষের যে হাত রয়েছে তা হাতির হাতের মত নয়। মানুষের শক্তি উটের শক্তির মত নয়। যদিও নাম অভিন্ন। অর্থাৎ এটাও হাত এবং ওটাও হাত। এটাও শক্তি আর ওটাও শক্তি। তবে ধরন-ধারণ ও গুণবৈশিষ্ট্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। এর দ্বারা বুঝা গেল যে নাম এক হলেও প্রকৃতিগতভাবে সমতুল্য হওয়া জরুরি নয়।

আর ‘তাশবীহ’ অর্থাৎ সাদৃশ্য নির্ণয় করা ‘তামছীল’ তথা সমতুল্য বলে ধারণা করার মতই। তবে এ দুটির মধ্যে এভাবে পার্থক্য করা যেতে পারে যে, ‘তামছীল’ হলো সকল সিফাতের ক্ষেত্রে সমতুল্য বলে ধারণা করা। আর তাশবীহ হলো অধিকাংশ গুণের ক্ষেত্রে সমতুল্য বলে ধারণা করা। তবে ‘তামছীল’ শব্দটি ব্যবহার করাই হবে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ। কেননা এ ক্ষেত্রে আল কুরআনে একই ধাতুর শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন:

﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ﴾ [الشورى: ١١]

তার মত কিছু নেই। (সূরা আশ্শুরা: ৪২: ১১)

‘তাকয়ীফ’: তাকয়ীফ হলো সুনির্দিষ্ট কোনো উদাহরণযুক্ত না করেই আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের ব্যাপারে ধারণা করা যে তার ধরন এই এই। যেমন কেউ বলল, আল্লাহ তা‘আলার চেহারা আছে আর তার আকার-আকৃতি হলো এই এই। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো মাখলুকের চেহারার উদাহরণ উল্লেখ করল না। এ ধরনের বিশ্বাসও বাতিল বিশ্বাস। এর প্রমাণ ওহী ও মানববুদ্ধির যুক্তি।

ওহী থেকে প্রমাণ হলো আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿وَلَا يُحِيطُونَ بِهِۦ عِلۡمٗا ١١٠ ﴾ [طه: ١١٠]

কিন্তু তারা জ্ঞান দিয়ে তাঁকে বেষ্টন করতে পারবে না। (সূরা তাহা: ২০: ১১০)

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন:

﴿ وَلَا تَقۡفُ مَا لَيۡسَ لَكَ بِهِۦ عِلۡمٌۚ إِنَّ ٱلسَّمۡعَ وَٱلۡبَصَرَ وَٱلۡفُؤَادَ كُلُّ أُوْلَٰٓئِكَ كَانَ عَنۡهُ مَسۡ‍ُٔولٗا ٣٦ ﴾ [الاسراء: ٣٦]

আর যে বিষয় তোমার জানা নেই তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তকরণ - এদের প্রতিটির ব্যাপারে সে জিজ্ঞাসিত হবে। (সূরা আল ইসরা: ১৭: ৩৬)

এটা স্পষ্ট যে আমাদের রব তা‘আলার সিফাতের ধরন-ধারণ কি তা আমাদের জানা নেই। কেননা তিনি সিফাত সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন, কিন্তু সিফাতের আকার-প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের জানাননি। অতএব সিফাতের আকার-প্রকৃতি বর্ণনা করার অর্থ এমন বিষয়ে কথা বলা যে বিষয়ে আমাদের আদৌ কোনো জ্ঞান নেই।

মানববুদ্ধির দলিল হলো: কোনো একটি জিনিসের গুণবৈশিষ্ট্যের আকার-প্রকৃতি ওই জিনিসটির সত্তার আকার-প্রকৃতির ব্যাপারে জ্ঞান লাভের পর অথবা ওই জিনিসটির সমতুল্য কোনো জিনিসের জ্ঞান লাভের পর অথবা ওই জিনিস সম্পর্কে সত্যবাদী কোনো ব্যক্তির সংবাদের পরই সম্ভব।

আর আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের ক্ষেত্রে উল্লিখিত এ তিনটি পন্থার কোনোটিই প্রযোজ্য নয়। অতএব ‘তাকয়ীফ’ প্রক্রিয়াকে বাতিল বলে বিশ্বাস করা ওয়াজিব। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের আকার-প্রকৃতি কি তা জানা আমাদের পক্ষে অসম্ভব।

উপরন্তু আমরা এ প্রশ্ন করতে পারি যে, আপনি আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের জন্যে কি ধরনের আকার-প্রকৃতি নির্ধারণ করবেন?

কারণ আপনি আপনার বুদ্ধি-বিচার দ্বারা যে ধরনের আকার-প্রকৃতিই নির্ধারণ করুন না কেন আল্লাহ তা‘আলা তার থেকেও বড় ও সম্মানিত।

আর আপনি যে ধরনের আকার-প্রকৃতি নির্ধারিত করবেন তাতে আপনি নিশ্চিতরূপেই মিথ্যাবাদী হবেন; কেননা এ ব্যাপারে আপনার কোনো ইলম নেই।

অতএব আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের ব্যাপারে সকল প্রকার ‘তাকয়ীফ’ তথা আকার-প্রকৃতি নির্ধারণ থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। হোক তা অন্তরের কল্পনা দ্বারা অথবা জিহ্বার কথা দ্বারা অথবা হাত দ্বারা লিখার মাধ্যমে।

এ ব্যাপারে আমাদের বিশ্বাস কি হবে তার ব্যাখ্যা খোঁজে পাওয়া যায় ইমাম মালিক র. এর প্রসিদ্ধ উক্তিতে, যা তিনি নিম্নোক্ত আয়াতের ব্যাপারে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন। আয়াতটি হলো:

﴿ ٱلرَّحۡمَٰنُ عَلَى ٱلۡعَرۡشِ ٱسۡتَوَىٰ ٥ ﴾ [طه: ٥]

দয়াময় (আল্লাহ) আরশের উপর উঠেছেন। (সূরা তাহা: ২০: ৫)

উক্ত আয়াতের নিরিখে প্রশ্নকারী প্রশ্ন করে বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা আরশের ওপরে কীভাবে উঠেছেন?’ প্রশ্নটি শোনে ইমাম মালিক র. মাথা নিচু করলেন, এমনকি তাঁর কপাল থেকে ঘাম বেরুতে শুরু করল। এরপর তিনি বললেন:

الاستواء غير مجهول، والكيف غير معقول، والإيمان به واجب، والسؤال عنه بدعة

অর্থাৎ (ইস্তিওয়া তথা ‘ওপরে ওঠা’ অজানা নয়, আর আকার-প্রকৃতি বোধগম্য নয় [অর্থাৎ আল্লাহর ক্ষেত্রে ইস্তিওয়া শব্দের অর্থের আকার-প্রকৃতি কি তা বোধগম্য নয়] তবে এর প্রতি ঈমান আনা ওয়াজিব এবং এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা বিদ‘আত।) ইমাম মালিক র. এর উস্তাদ রাবিয়া র. এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন: (‘ইস্তিওয়া’ (উপরে উঠা) অজানা নয়, আর এর ধরন-ধারণ বোধগম্য নয়।)

তাদের দুজনের পর আলেমগণ উল্লিখিত নীতির উপরই চলেছেন। আর যদি আকার-প্রকৃতি বোধগম্য বিষয় না হয়ে থাকে এবং এ ব্যাপারে শরীয়তেও কোনো স্পষ্ট বক্তব্য উল্লিখিত না হয়ে থাকে তাহলে এর অর্থ হলো যে যুক্তি ও শরীয়ত উভয়টিই আকার-প্রকৃতি নির্ধারণমূলক সকল দলিল থেকে মুক্ত। অতএব এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব।

সুতরাং খুব সাবধান হোন আকার-প্রকৃতি নির্ধারণ এবং এ জাতীয় যেকোনো প্রয়াস থেকে; কেননা যদি এরূপ কাজে আপনি নিপতিত হন তবে তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া কঠিন হবে। আর যদি আপনার অন্তরে এ জাতীয় কোনো কিছু উদিত হয়, তবে নিশ্চিতরূপে জানুন যে তা শয়তানের কুমন্ত্রণা। এ ক্ষেত্রে আপনি আল্লাহ তা‘আলার আশ্রয় প্রার্থনা করুন; কেননা একমাত্র তিনিই আশ্রয় দাতা। ইরশাদ হয়েছে:

﴿ وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ ٱلشَّيۡطَٰنِ نَزۡغٞ فَٱسۡتَعِذۡ بِٱللَّهِۖ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ٣٦ ﴾ [فصلت: ٣٦]

আর যদি শয়তানের পক্ষ থেকে কোন কুমন্ত্রণা কখনো তোমাকে প্ররোচিত করে, তাহলে তুমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করবে। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা। (সূরা ফুসসিলাত: ৪১: ৩৬)