যে কোন বৈধ অসিলার মাধ্যমে ইসলামী দাওয়াত পৌঁছানো সম্ভব হয়, সেই অসিলায় ব্যবহার করা বৈধ। রেডিও, টিভি, ইন্টারনেটে শরিয়ত বিরোধী কর্মকাণ্ড থাকলেও তা সম্পূর্ণ বিধর্মী ও পাপাচারীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিৎ নয়। যে অস্ত্র দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা হচ্ছে, সেই অস্ত্র দিয়েই মোকাবেলা করা আমাদের উচিৎ। (ইবনে জিবরিন)
ভুল সংশোধনে ইখলাস থাকা উচিৎ। উচিৎ গঠনমূলক সমালোচনা করা। সমালোচনায় কোন ব্যক্তি বা জামায়াতের নাম না নেওয়া। এর ফলে শয়তান মুসলিমদের মাঝে বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করার সুযোগ পাবে না এবং সমালোচিত ব্যক্তি ভুল শুধরে নেওয়ার প্রয়াস পাবে।
ভ্রম সংশোধনে মহানবী (সঃ) এই পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, নবী (সঃ) এর নিকট কোন ব্যক্তির ব্যাপারে কোন অভিযোগ এলে তিনি (নাম নিয়ে) বলতেন না যে, “অমুকের কি হয়েছে?” বরং তিনি বলতেন, “লোকেদের কি হয়েছে যে, তারা এই এই বলে।” (আবু দাউদ)
আনাস (রঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “লোকেদের কি হয়েছে যে, তারা নামাজের মধ্যে আকাশের দিকে দৃষ্টি তুলছে? এ ব্যাপারে তিনি কঠোর বক্তব্য রাখলেন, এমনকি তিনি বললেন, তারা যেন অবশ্যই এ কাজ থেকে বিরত থাকে, নচেৎ অবশ্যই তাদের দৃষ্টি শক্তি ছিনিয়ে নেওয়া হবে। (বুখারি)
“লোকেদের কি হয়েছে যে, তারা এই এই বলে। শোন! আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের চেয়ে বেশি আল্লাহকে ভয় করি, তার ভয় অন্তরে তোমাদের চেয়ে বেশী রাখি। কিন্তু আমি (নফল) রোযা রাখি এবং রোযা ছেড়েও দিই, নামায পড়ি এবং নিদ্রাও যায়। আর নারীদের বিয়েও করি। সুতরাং যে আমার সুন্নত হতে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সে আমার দলভুক্ত নয়। (বুখারি- মুসলিম প্রমুখ)
অবশ্যই। বরং অনেক ক্ষেত্রে দাওয়াতের কাজ ওয়াজেব। সৎকাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ যথাস্থানে জরুরী। ক্ষমতায় না পারলে মুখে উপদেশ দেওয়া নারী পুরুষ সকলের কর্তব্য। তবে মহিলা মহলে মহিলা দাঈ দাওয়াতের কাজে বেশি উপযুক্ত। বিশেষ করে মহিলা বিষয়ক সমস্যাবলীতে মহিলা বিশেষজ্ঞই বেশি উপকারী। তবে সর্বপ্রথম তার ইলম ও আমল সঠিক হতে হবে এবং দাওয়াতের কাজ করতে গিয়ে শরই কোন ওয়াজেব ত্যাগ অথবা কোন হারাম কাজ করে বসলে হবে না। দাওয়াতের জন্য স্বামী সন্তানের প্রতি কর্তব্য অবহেলা বাঞ্ছনীয় নয়। যেমন দাওয়াতের জন্য তার মাহরাম ছাড়া সফর এবং পর পুরুষের সাথে মেলামেশা বৈধ নয়।
মুসলিম যখন প্রয়োজনীয় ইলম সঞ্চয় করে নেবে, যে বিষয়ের দাওয়াত দেবে, সে বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করে নেবে, তখন সে মানুষকে দাওয়াত দিতে পারবে। তার জন্য সর্ব বিষয়ে আলেম হওয়া জরুরী নয়। যেহেতু মহানবী (সঃ) বলেছেন,
“একটি আয়াত হলেও তা আমার নিকট থেকে (মানুষের কাছে) পৌঁছে দাও।” (বুখারি ৩৪৬১ নং)
বলা বাহুল্য, দাঈ হওয়ার জন্য আলেম হওয়া জরুরী নয়। বরং যে বিষয়ের দাওয়াত দেবে, সে বিষয়ে পরিপক্বতা থাকা জরুরী। পক্ষান্তরে যথেষ্ট ইলম সঞ্চয় না করে আবেগের বসে অথবা বক্তিতার ঢং আছে বলে অর্থ সঞ্চয়ের খাতিরে দাওয়াতের কাজ করতে লাগা অবশ্যই বৈধ নয়। নচেৎ এমন হতে পারে যে, সেই দাঈর দাওয়াতে লাভের চাইতে ক্ষতিই বেশি হবে। যেহেতু ‘নিম হাকিমে খতরায়ে জান, নিম মোল্লা খতরায়ে ঈমান।’ আবেগের বশে বিনা ইলমে হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল করবে এবং সন্মান বাঁচাতে গিয়ে ভুল ফতোয়া দিয়ে সমাজে ফিতনা সৃষ্টি করবে। অথচ মহান আল্লাহ বলেছেন,
“তোমাদের জিহ্বা মিথ্যা আরোপ করে বলে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করার জন্য তোমরা বলো না, ‘এটা হালাল এবং এটা হারাম।’ যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করবে তারা সফলকাম হবে না।” (নাহলঃ ১১৬)
তাতে হয়তো ওই শ্রেণীর বক্তার লাভ আছে। কিন্তু সে লাভ অতি নগণ্য, অতি তুচ্ছ। উক্ত আয়াতের পরপরই মহান আল্লাহ বলেছেন,
“(ইহকালে) তাদের সামান্য সুখ সম্ভোগ রয়েছে এবং (পরকালে) তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।” (নাহলঃ ১১৭)
যাকে দাওয়াত দেওয়া হবে, তার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় বিষয়ের দাওয়াত দিতে হবে। যেমন কাফের বা মুশরিক মুসলিমকে সর্বপ্রথম তাওহীদের দাওয়াত দিতে হবে। দাওয়াতের এ মূলনীতি বর্ণনা করে গেছেন মহানবী (সঃ)। মুয়াজ (রঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) আমাকে (ইয়ামানের শাসক রূপে) পাঠাবার সময় বলেছিলেন, “তুমি আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের নিকট যাচ্ছ। সুতরাং তুমি তাদেরকে সর্বপ্রথম ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহর রাসুল’ এ কথার সাক্ষ্যদানের প্রতি দাওয়াত দেবে। যদি তারা এ কথা মেনে নেয়, তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দেবে, আল্লাহ তাদের উপর প্রতি দ্বীন ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ করেছেন। তারা যদি এ কথা মেনে নেয়, তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দেবে, আল্লাহ তাদের সম্পদের উপর সাদকাহ (যাকাত) ফরজ করেছেন। তাদের মধ্যে যারা সম্পদশালী তাদের থেকে যাকাত উসুল করে যারা দরিদ্র তাদের মাঝে বিতরণ করা হবে। যদি তারা এ কথা মেনে নেয়, তাহলে তুমি (যাকাত নেওয়ার সময়) তাদের উৎকৃষ্ট মাল নেওয়া থেকে দুরে থাকবে। আর অত্যাচারিতের বদ দুয়া থেকে বাঁচবে। কারন তার বদ দুয়া আর আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা নেই (অর্থাৎ, শীঘ্র কবুল হয়ে যায়)।” (বুখারি ও মুসলিম)
শিরক ও বিদআতকে দৃষ্টিচ্যুত করে অন্য কিছু দাওয়াত দেওয়া নববী নীতি নয়। জাল জইফ হাদিসের তমীয না করে দাওয়াত দেওয়া সালাফি নীতি নয়। দাওয়াতের দলীল হবে হক, আদর্শ হবে সলফে সালেহিন, সর্বপ্রথম যত্নযোগ্য হবে সহিহ আকিদাহ, অতঃপর নির্ভেজাল আমল। সর্বপ্রথম নামায বা রচনা আখলাখের দাওয়াতও যথার্থ দাওয়াত নয় এবং সর্বপ্রথম ইসলামী রাষ্ট্র রচনার দাওয়াতও সফল দাওয়াত নয়।
না। তাদের এ কথা ঠিক না। কারণ আল্লাহর শরয়ী ইচ্ছা, দ্বীনের দাওয়াত দিতে হবে। তিনি দ্বীনের দাওয়াতের মাধ্যমেই দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত রাখবেন। আর আয়াতের অর্থ এই নয় যে, ‘আপন বাঁচলে বাপের নাম।’ অর্থাৎ সৎকাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দানের কাজ করতে হবে না। আবু বকর সিদ্দীকি (রঃ) বলেন, ‘হে লোক সকল! তোমরা এই আয়াত পড়ছ, “হে মুমিনগণ! তোমাদের আত্নরক্ষা করাই কর্তব্য। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও, তবে যে পথ ভ্রষ্ট হয়েছে, সে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।” (সূরা মায়েদাহঃ ১০৫) কিন্তু আমি রাসুলুল্লাহ (সঃ) কে বলতে শুনেছি, “যখন লোকেরা অত্যাচারীকে (অত্যাচার করতে ) দেখবে এবং তার হাত ধরে না নেবে, তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের সকল কে (আমভাবে) তার শাস্তির কবলে নিয়ে নেবেন। (আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসাঈ )
তাছাড়া সৎ পথে পরিচালিত হওয়ার একটি দাবীই হল, সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দান করা। (ইবনে উসাইমিন)
মন্দ কাজে বাধা দানের তিনটি ধাপ পার হলে তাঁর সাথে পথ চলা বর্জন করতে হবে, যদি মনে হয় যে, তাকে বর্জন করলে সে শিক্ষা ও উপদেশ নেবে। পক্ষান্তরে যদি মনে হয় যে, তাকে বর্জন করলে সে আরও খারাপ হয়ে যাবে, তাহলে বর্জন না করে যথাসাধ্য সংশোধনের চেষ্টা করে যেতে হবে এবং তাকে উপদেশ দেয়ার জন্য এমন দাঈ নির্বাচন করতে হবে, যিনি সম্ভবতঃ কৌশলে তার মনে পরিবর্তন আনতে পারবেন। আর হিদায়াত তো আল্লাহর হাতে। অবশ্য সে সময় তার সাথে বন্ধুত্ব বা আত্মীয়তা বজায় রাখা চলবে না। (ইবনে বাজ)
অবশ্যই না। ফতোয়া দেওয়ার কাজ সকলের নয়। একমাত্র সঠিকার্থের মুফতী ছাড়া অন্য কেউ ফতোয়া দিতে পারেন না। অবশ্য ফতোয়া নকল করতে পারেন। এছাড়া যে বিষয়ে পূর্বেকার কোন ইমাম বা মুফতীর ফতোয়া নেই, সে বিষয়ে নিজের বুঝ অনুযায়ী হালাল হারাম বলার জন্য মুখ না খোলাই কর্তব্য। মহান আল্লাহ বলেছেন,
“তোমাদের জিহ্বা মিথ্যা আরোপ করে বলে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করবার জন্য তোমরা বলো না, ‘এটা হালাল এবং এটা হারাম।’ যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করবে তারা সফলকাম হবে না। (নাহলঃ ১১৬)
মহানবী (সঃ) বলেছেন, “যাকে বিনা ইলমে ফতোয়া দেওয়া হয়, তার গোনাহ বর্তায় মুফতির উপর।” (আবু দাউদ ৩৬৫৭, হাকেম, সঃ জামে ৬০৬৮ নং )
দ্বীনী ইলম ও আমলের কোন কাজ দুনিয়া লাভের জন্য করা বৈধ নয়। যেহেতু আল্লাহর রাসুল (সঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি এমন কোন ইলম অনুসন্ধান করে যার দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়, ওই ইলম যদি কোন পার্থিব বিষয় লাভের উদ্দেশ্যেই শিক্ষা করে থাকে, তবে সে কিয়ামতের দিন বেহেশতর সুগন্ধ টুকুও পাবে না।” (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, ইবনে হিব্বান, হাকেম, সহিহ তারগিব ৯৯ নং)
তবুও পেটের জন্য অর্থের প্রয়োজন আছে। সুতরাং আসল নিয়ত দাওয়াতের রেখে প্রয়োজন মতো অর্থ নেওয়া দূষণীয় নয়। সত্য কথা এই যে, আল্লাহর তওফিকের পর যদি অর্থ না হত, তাহলে দাওয়াতের কাজে অগ্রগতি সহজ ছিল না। সুতরাং দ্বীনের দাঈ অর্থের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারলে দাওয়াতের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারবে। দাওয়াতের পথে অর্থ ব্যয় করতে পারলে দাওয়াত বড় ফলপ্রসূ হবে। তবে নিজ থেকে রেট বাঁধা ঠিক নয়।
উমার (রঃ) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সঃ) আমাকে দান দিতেন। কিন্তু আমি বলতাম, ‘আমার থেকে বেশী অভাবী মানুষকে দিন।’ তিনি বলতে, “তুমি তা নিয়ে নাও। যখন তোমার কাছে এই মাল আসে, আর তোমার মনে লোভ না থাকে এবং তুমি তা যাচ্ঞা না করে থাক, তাহলে তা গ্রহণ কর এবং তা নিজের মালের সাথে মিলিয়ে নাও। অতঃপর তোমরা ইচ্ছা হলে তা খাও, নতুবা দান করে দাও। এ ছাড়া তোমার মনকে তাতে ফেলে রেখো না।”
সালেম বিন আব্দুল্লাহ বিন উমার বলেন, ‘এ কারণেই (আমার আব্বা) আব্দুল্লাহ কারো কাছে কিছু চাইতেন না এবং তাঁকে কেউ কিছু দিতে চাইলে তা প্রত্যাখ্যান করতেন না। (বরং গ্রহণ করে নিতেন) (বুখারি, মুসলিম, নাসাই, সহিহ তারগিব ৫১০ পৃঃ )
তার রুজূ করা উচিৎ এবং তাতে তার প্রেস্টিজ যাওয়ার ভয় করা অনুচিত। যেহেতু হক প্রকাশ পেলে হকের দিকে রুজূ করা মহান মানুষদের কাজ। সাধারণের কাছে ওজন হাল্কা হয়ে যাওয়ার ভয়ে ভুলের উপর অটল থাকা উদার মানুষের কাজ নয়। মহানবী (সঃ) হক বুঝতে পেরে হকের দিকে রুজূ করেছেন। একদা তিনি সাহাবাদেরকে দেখলেন, তারা খেজুর মোচার পরাগ-মিলন সাধন করেছেন, অর্থাৎ মাদা গাছের মোচা নিয়ে মাদী গাছের মোছার সাথে বেঁধে দিচ্ছেন। তিনি বললেন, “আমার মনে হয় ঐরূপ করাতে কোন লাভ নেই। ঐরূপ না করলেও খেজুর ফলবে।” তার মন্তব্য শুনে সাহাবাগন তা ত্যাগ করলেন। কিন্তু খেজুর ফলার সময় দেখা গেল, খেজুর পরিপুষ্ট হয়নি। ফলে তার ফলনও ভালো হয়নি। তিনি তা দেখে বললেন, “কি ব্যাপারে, তোমাদের খেজুরের ফলন নেই কেন?” তারা বললেন, যেহেতু আপনি পরাগ মিলন ঘটাতে নিষেধ করেছিলেন, সেহেতু তা না করার ফলে ফলন কম হয়েছে। তিনি বললেন, “আমি ওটা ধারনা করে বলেছিলাম। তোমরা তোমাদের পার্থব বিষয় সম্পর্কে অধিক জ্ঞান রাখ। অতএব তা ভালো হলে, তোমরা তা করতে পার।” (মুসলিম ২৩৬১-২৩৬৩ নং)
সাহাবা, তাবেঈন ও ইমামগণ হকের দিকে রুজূ করেছেন। দলীল বলিষ্ঠ দেখে নিজের রায় বদলে দিয়েছেন। তাতে তাদের কোন মানহানি হয়নি। কোন আলেমের হওয়ারও কথা নয়। (ইবনে বাজ)