আসলে আল্লাহর সাথে শর্তভিত্তিক চুক্তির নযর মাকরূহ অথবা হারাম। যেমন, ‘আল্লাহ! যদি আমার ছেলে পাশ করে, তাহলে তোমার রাহে হাজার টাকা দেব। আমার রোগী সেরে উঠলে এত টাকা দান করব’ ইত্যাদি। এতে কোন লাভ হয় না, তা আল্লাহর ইচ্ছা ও তকদীরে হয়। নযর না মানলেও তাই হয়। মহানবী (সঃ) বলেছেন, “নযর কোন মঙ্গল আনায়ন করে না। তার মাধ্যমে কেবল বখিলের মাল বের করে নেওয়া হয়।” (বুখারি ৬৬০৮-৬৬০৯, মুসলিম ১৬৩৯-১৬৪০)
তবে ইবাদতের নযর মানলে তা পুরা করা জরুরী। রাসুল (সঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর অনুগত্য করার নযর মানে, সে যেন (তা পুরা করে) তার অনুগত্য করে এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যতা করার নযর মানে, সে যেন (তা পূরণ না করে এবং) তার অবাধ্যতা না করে।” ( বুখারি, সহিহুল জামে ৬৪৪১)
ইবনে আব্বাস (রঃ) বলেন, ‘এক মহিলা সমুদ্র সফরে বের হলে সে নযর মানল যে, যদি আল্লাহ তাআলা তাকে সমুদ্র থেকে পরিত্রাণ দান করেন, তাহলে সে একমাস রোজা রাখবে। অতঃপর সে সমুদ্র থেকে পরিত্রাণ পেয়ে ফিরে এল। কিন্তু রোজা না রেখেই মারা গেল। তার এক কন্যা নবী (সঃ) এর নিকট এসে সে ঘটনা উল্লেখ করলে তিনি বললেন, “মনে কর, তার যদি কোন ঋণ বাকি থাকত, তাহলে তুমি তা পরিশোধ করতে কি না?” বলল, ‘হ্যাঁ’। তিনি বললেন, “তাহলে আল্লাহর ঋণ অধিকরূপে পরিশোধযোগ্য। সুতরাং তুমি তোমার মায়ের তরফ থেকে রোজা কাযা করে দাও।” (আবু দাউদ ৩৩০৮, আহমাদ ২/২১৬ প্রমুখ)
অবৈধ বা শিরক নযর পালন করা অবৈধ। তাকে তওবা করতে হবে এবং কসমের কাফফারা আদায় করতে হবে। দশটি মিসকিনকে খাদ্য অথবা বস্ত্র দান করতে হবে অথবা একটি গোলাম আজাদ করতে হবে। এ সবে অক্ষম হলে ৩টি রোজা রাখতে হবে। (ইবনে জিবরিন)
যে নামে নযর মানা হয়, সেই নামেই নযর পালন করতে হবে। অবশ্য যে নামে নযর মেনেছে, সেখানে পালন করা যদি দুঃসাধ্য হয়, অথবা অপর জায়গায় পালন করলে সওয়াব বেশি হয়, তাহলে নযর এর স্থান পরিবর্তন করা যায়। যেমন এক ব্যক্তি নযর মেনেছিল, মক্কা বিজয় হলে বায়তুল মাকদিসে গিয়ে নামাজ পড়বে। নবী (সঃ) তাকে বললেন, “তুমি এখানে (কাবার মসজিদে) নামাজ পড়।” (আবু দাউদ ৩৩০৫)
না। খাদ্য বা বস্ত্রই দিতে হবে। না থাকলে কিনে দিতে হবে। মূল্য আদায় করলে কাফফারা আদায় হবে না। কারণ তা কুরআনের স্পষ্ট উক্তির বিরোধিতা হবে। (ইবনে জিবরীন)
দশজন মিসকিনের মাধ্যম ধরনের খাবার তৈরি করে অথবা রাত্রে তাদেরকে ডেকে খাইয়ে দিন। অথবা তাদের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দিন। অথবা মাথাপিছু সওয়া এক কিলো করে (সর্বমোট সাড়ে বার কিলো) চাল তাদের মাঝে বণ্টন করে দিন। দশজন মিসকিন না পাওয়া গেলে পাঁচ জন মিসকিনকে দু'বেলা খাওয়ান অথবা আড়াই কিলো করে চাল দিয়ে দিন। কাপড় দিলে মহিলাকে মধ্যম দামের শাড়ী দিন, পুরুষকে মধ্যম দামের লুঙ্গি গেঞ্জি দিন। খাদ্য ও বস্ত্র দানে অক্ষম হলে তবেই তিনদিন রোজা রাখুন। খাদ্য দেওয়ার ক্ষমতা ও উপায় থাকলে রোজা রাখলে কাফফারা আদায় হবে না।
একই কাজের জন্য একাধিকবার কসম খেয়ে তা ভঙ্গ করলে একবার কাফফারা দিলেই হবে। কিন্তু পৃথক পৃথক কাজের জন্য কসম খেয়ে ভঙ্গ করলে পৃথক পৃথক কাফফারা দিতে হবে। (ইবনে বাজ)
যেমনঃ কেউ রবিবারে বলল, ‘আল্লাহর কসম আমি মামার বাড়ী যাব না।’ সোমবার বলল, ‘আল্লাহর কসম আমি মামার বাড়ী যাব না।’ মঙ্গলবারেও বলল, ‘আল্লাহর কসম আমি মামার বাড়ী যাব না।’ অতঃপর বুধবারে কসম ভঙ্গ করে সে মামার বাড়ী গেল। তাকে একটি কাফফারা দিতে হবে।
কিন্তু রবিবারে বলল, ‘আল্লাহর কসম আমি মামার বাড়ী যাব না।’ সোমবারে বলল, ‘আল্লাহর কসম আমি চাচার বাড়ী যাব না।’ মঙ্গলবারে বলল, ‘আলাহর কসম আমি খালার বাড়ী যাব না।’ অতঃপর বুধবারে কসম ভঙ্গ করে সে সকলের বাড়ী চলে গেল। তবে প্রত্যেক কসমের বিনিময়ে পৃথক পৃথক কাফফারা আদায় করতে হবে।
অনুরূপ কেউ রবিবারে বলল, ‘আল্লাহর কসম আমি মামার বাড়ী যাব না।’ সোমবারে বলল, ‘আল্লাহর কসম আমি চাচার বাড়ী খাব না।’ মঙ্গলবারে বলল, ‘আল্লাহর কসম আমি খালার বাড়ী শোব না।’ অতঃপর বুধবারে সে কসম ভঙ্গ করে সেই সব কাজ করল। তাকে প্রত্যেক কসমের বিনিময়ে পৃথক পৃথক কাফফারা আদায় করতে হবে।
গায়রুল্লাহ নামে কসম খাওয়া, বাপ, মা, ছেলে, পীর, কাবা, নবী, মসজিদ, কিবলা, বই, দেশমাতা ইত্যাদির নামে কসম খাওয়া শিরক। কসম হবে কেবল আল্লাহর নামে অথবা তার কোন গুনের নাম নিয়ে অথবা কুরআন স্পর্শ করে। ইবনে উমার (রঃ) একটি লোককে বলতে শুনলেন ‘না, কাবার কসম!’ তিনি তাকে বললেন, ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে কসম খেও না। কেননা, আমি রাসুলুল্লাহ (সঃ) কে বলতে শুনেছি, “যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহ নামে কসম করে, সে কুফরি অথবা শিরক করে।” (আবু দাউদ ৩২৫১, তিরমিজি ১৫৩৫ নং)
নবী (সঃ) বলেছেন, “ নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে তোমাদের বাপ দাদার নামে শপথ করতে নিষেধ করেছেন। সুতরাং যে শপথ করতে চায় সে যেন আল্লাহর নামে শপথ করে, নচেৎ চুপ থাকে।” (বুখারি ৩৮৩৬, মুসলিম ১৬৪৬ নং)
কুরআন হল আল্লাহর কালাম। আর আল্লাহর কালাম হল তার সিফাত (গুন)। আর তার সিফাতের শপথ করা যায়। যেমন তার ইজ্জত, আজমত, কুদরত, কবরীয়া, জালাল ইত্যাদির কসম খাওয়া যায় এবং তার অসিলায় দুয়া ও আশ্রয় প্রার্থনা করা যায়।
নদী (সঃ) বলেছেন, “একদা আইয়ুব (আঃ) উলঙ্গ হয়ে গোসল করছিলেন। অতঃপর তার উপর সোনার পঙ্গপাল পড়তে লাগল। আইয়ুব (আঃ) তা আঁজলা ভরে ভরে বস্ত্রে রাখতে আরম্ভ করলেন। সুতরাং তার প্রতিপালক আযযা অজাল্ল তাকে ডাক দিলেন, ‘ হে আইয়ুব! তুমি যা দেখছ, তা হতে কি আমি তোমাকে অমুখাপেক্ষী করে দেইনি?’ তিনি বললেন, ‘অবশ্যই, তোমার ইজ্জতের কসম! কিন্তু আমি আমার বরকত হতে অমুখাপেক্ষী নই।’ (বুখারি)
মহানবী (সঃ) বললেন, “জাহান্নাম ‘আরও আছে কি’ বলতেই থাকবে। পরিশেষে রাব্বুল ইজ্জত তাবারাকা তায়ালা তাতে নিজ পায়ের পাতা (পা) রেখে দেবেন। তখন সে বলবে, ‘যথেষ্ট, যথেষ্ট, তোমার ইজ্জতের কসম!’ আর তার পরস্পর অংশগুলো সংকীর্ণ হয়ে যাবে।” (বুখারি ৭৩৮৪, মুসলিম ২৮২৮ নং, আবু আওয়ানাহ )
রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “ কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মধ্য হতে এমন এক ব্যক্তি কে নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ায় সবচেয়ে সুখী ও বিলাসী ছিল। অতঃপর তাকে জাহান্নামে একবার (মাত্র) চুবানো হবে, তারপর তাকে বলে হবে, ‘হে আদম সন্তান! তুমি কি কখন ভাল জিনিস দেখেছ? তোমার নিকটে কি কখন সুখ সামগ্রী এসেছে?’ সে বলবে, ‘না। তোমার ইজ্জতের কসম ! হে প্রভু।’ আর জান্নাতিদের মধ্য থেকে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ায় সবচেয়ে দুঃখী ও অভাবী ছিল। তাকে জানাতে (মাত্র) একবার চুবানোর পর বলা হবে, ‘হে আদম সন্তান! তুমি কি (দুনিয়াতে) কখনো দুঃখ কষ্ট দেখেছ? তোমার উপরে কি কখনো বিপদ গেছে?’ সে বলবে, ‘না। তোমার ইজ্জতের কসম! আমার উপর কোনদিন কষ্ট আসে নি এবং আমি কখনো কন বিপদও দেখিনি।’ (আহমাদ ১৩৬৬০ নং, বাইহাকি ১০/৪১)
মহানবী (সঃ) এই বলে দুয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন,
“আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ বানীর অসিলায় তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার মন্দ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।”
“অর্থাৎ আমি আল্লাহর মর্যাদা ও কুদরতের অসিলায় সেই জিনিসের অনিষ্ট হতে আশ্রয় চাচ্ছি, যা আমি পাচ্ছি ও ভয় করছি।”
চুক্তিগত নযর মাকরুহ বা হারাম। কিন্তু যে নযরে চুক্তিহীন ইবাদত থাকে, তা মাকরুহ বা হারাম নয়। তার কথাই কুরআনে বলা হয়েছে,
“নিশ্চয় সৎকর্মশীলরা পান করবে এমন পানীয় যার মিশ্রণ হবে কর্পূর। এমন একটি ঝরনা, যা হতে আল্লাহর দাসরা পান করবে, তারা এ (ঝরনা ইচ্ছামত) প্রবাহিত করবে। তারা মানত পূর্ণ করে এবং সেদিনের ভয় করে, যেদিনের বিপত্তি হবে ব্যাপক। (দাহরঃ ৫-৭)
এ নযর বা মানত যারা পালন করে, তারা ওয়াজেব পালনের সওয়াব পায় এবং মহান আল্লাহ তাদেরকে ‘সৎকর্মশীল ও আল্লাহর দাস’ বলে অভিহিত করেছেন। (আলবানী)
কোন অবৈধ মানত পূর্ণ করা বৈধ নয়। তার বদলে কসমের কাফফারা দেওয়া জরুরী। অর্থাৎ একটি দাস মুক্তি করা অথবা দশ মিসকিন কে খাদ্য বা বস্ত্র দান করা। যদি এ সবের শক্তি না থাকে, তাহলে তিনটি রোজা রাখা। রাসুল (সঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর অনুগত্য করার নযর মানে, সে যেন (তা পূরণ করে) তার অনুগত্য করে এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যতা করার নযর মানে, সে যেন (তা পূরণ না করে এবং ) তার অবাধ্যতা না করে।” (বুখারি, সহিহুল জামে ৬৪৪১) তিনি বলেছেন, “নযরের কাফফারা কসমের কাফফারার মতো।”(মুসলিম)