সূরাঃ ৯/ আত-তাওবা | At-Tawba | سورة التوبة আয়াতঃ ১২৯ মাদানী
৯:১ بَرَآءَۃٌ مِّنَ اللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهٖۤ اِلَی الَّذِیۡنَ عٰهَدۡتُّمۡ مِّنَ الۡمُشۡرِكِیۡنَ ؕ﴿۱﴾
برآءۃ من الله و رسولهٖ الی الذین عهدتم من المشركین ﴿۱﴾

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা সে সব লোকের প্রতি মুশরিকদের মধ্য থেকে যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলে। আল-বায়ান

মুশরিকদের মধ্যেকার যাদের সঙ্গে তোমরা সন্ধিচুক্তি করেছিলে তাদের সাথে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ হতে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেয়া হল। তাইসিরুল

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ হতে অব্যাহতি (ঘোষণা করা) হচ্ছে ঐ মুশরিকদের প্রতি যাদের সাথে তোমরা সন্ধি করেছিলে।* মুজিবুর রহমান

[This is a declaration of] disassociation, from Allah and His Messenger, to those with whom you had made a treaty among the polytheists. Sahih International

১. এটা সম্পর্কচ্ছেদ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে, সে সব মুশরিকদের সাথে, যাদের সাথে তোমরা পারস্পারিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলে।(১)

(১) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবম হিজরীতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে হজের আমীর করে পাঠানোর পরে এ আয়াতসমূহ নিয়ে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে পাঠালেন। তিনি কুরবানীর দিন এগুলোকে মানুষের মধ্যে ঘোষণা করলেন। এর সাথে আরও ঘোষণা ছিল যে, এরপর আর কোন লোক উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ করবে না। কোন মুশরিক হজ করবে না। মুমিন ছাড়া কেউ জান্নাতে যাবে না। এভাবে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু সেটা বলতেন, যখন অপারগ হতেন, তখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন। [ইবন কাসীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১) তোমরা যে অংশীবাদীদের সাথে সন্ধি স্থাপন করেছিলে, আল্লাহ ও রসূলের পক্ষ হতে তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা হল। [1]

[1] মক্কা বিজয়ের পর ৯ হিজরীতে রসূল (সাঃ) আবু বাকর, আলী এবং অন্যান্য সাহাবা (রাঃ)গণকে কুরআনের এই আয়াতসমূহ ও বিধান দিয়ে মক্কা পাঠালেন, যাতে তাঁরা তা প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করে দেন। তাঁরা নবীর আদেশ মোতাবেক ঘোষণা করলেন যে, কোন ব্যক্তি উলঙ্গ হয়ে কা’বা ঘরের তাওয়াফ করবে না। বরং আগামী বছর থেকে কোন মুশরিককে বাইতুল্লাহর হজ্জের জন্য অনুমতি দেওয়া হবে না। (বুখারীঃ নামায ও হজ্জ অধ্যায়, মুসলিমঃ হজ্জ অধ্যায়)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯:২ فَسِیۡحُوۡا فِی الۡاَرۡضِ اَرۡبَعَۃَ اَشۡهُرٍ وَّ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّكُمۡ غَیۡرُ مُعۡجِزِی اللّٰهِ ۙ وَ اَنَّ اللّٰهَ مُخۡزِی الۡكٰفِرِیۡنَ ﴿۲﴾
فسیحوا فی الارض اربعۃ اشهر و اعلموا انكم غیر معجزی الله و ان الله مخزی الكفرین ﴿۲﴾

সুতরাং তোমরা যমীনে বিচরণ কর চার মাস, আর জেনে রাখ, তোমরা আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবে না, আর নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদেরকে অপদস্থকারী। আল-বায়ান

অতঃপর (হে কাফিরগণ!) চার মাস তোমরা যমীনে (ইচ্ছে মত) চলাফেরা করে নাও; আর জেনে রেখ যে, তোমরা আল্লাহকে নত করতে পারবে না, আল্লাহ্ই সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে লাঞ্ছিত করবেন। তাইসিরুল

সুতরাং (হে মুশরিকরা!) তোমরা এই ভূ-মন্ডলে চার মাস বিচরণ করে নাও এবং জেনে রেখ যে, তোমরা আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবেনা, আর নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফিরদেরকে অপদস্থ করবেন। মুজিবুর রহমান

So travel freely, [O disbelievers], throughout the land [during] four months but know that you cannot cause failure to Allah and that Allah will disgrace the disbelievers. Sahih International

২. অতঃপর তোমরা যমীনে চারমাস সময় পরিভ্রমণ কর(১) এবং জেনে রাখ যে, তোমরা আল্লাহকে হীনবল করতে পারবে না। আর নিশ্চয় আল্লাহ্‌ কাফেরদেরকে অপদস্থকারী।(২)

(১) এ চার মাস সময় কাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল এ ব্যাপারে বিভিন্ন মত থাকলেও সবচেয়ে প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত হলো, এ চারমাস সময় ঐ সমস্ত কাফেরদেরকে দেয়া হয়েছে যাদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন মেয়াদী চুক্তি ছিল না অথবা যাদের সাথে চারমাসের কম চুক্তি ছিল। কিন্তু যাদের সাথে মেয়াদী চুক্তি ছিল আর তারা সে চুক্তি বিরোধী কোন কাজ করে নি, তাদেরকে তাদের সুনির্দিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ করতে দেয়া হয়েছিল। সে অনুসারে এ মেয়াদপূর্তির পর তাদের সাথে আর কোন নতুন চুক্তি করা হয়নি। [সা'দী]

(২) এখানে বলা হচ্ছে যে, যদিও তাদেরকে চারমাসের সময় দেয়া হয়েছে, তাতে তাদেরকে শুধু আল্লাহর দ্বীন বোঝা ও জানার জন্য সে সময়টুকু দেয়া হচ্ছে। যদি তারা এ সময়টুকু সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারে এবং ইসলাম গ্রহণ না করে তাহলে তারা যেন ভাল করেই জেনে নেয় যে, যমীনের কোথাও পালিয়ে থাকলেও আল্লাহর হাত থেকে তাদের নিস্তার নেই। [সা'দী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(২) সুতরাং (হে অংশীবাদীরা!) তোমরা দেশে চার মাসকাল (নিরাপদে) চলাফেরা কর।[1] আর জেনে রাখ যে, তোমরা আল্লাহকে হীনবল করতে পারবে না এবং আল্লাহ অবিশ্বাসীদেরকে লাঞ্ছিত করবেন। [2]

[1] এই সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা সেই মুশরিকদের জন্য ছিল, যাদের সাথে স্থায়ী চুক্তি ছিল। অথবা চার মাস থেকে কম ছিল। অথবা চার মাস থেকে বেশী একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ছিল। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে চুক্তি রক্ষার কোন আগ্রহ ছিল না। তাদেরকে চার মাস মক্কায় থাকার অনুমতি দেওয়া হল। এর মানে হল যে, সেই সময়ের মধ্যে যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে নেয়, তাহলে তাদের জন্য এখানে থাকার অনুমতি হবে। অন্যথা তাদের জন্য জরুরী হবে যে, তারা চার মাস পর আরব উপদ্বীপ থেকে বের হয়ে যাবে। অতঃপর যদি উভয় এখতিয়ারের মধ্যে কোন একটা গ্রহণ না করে, তাহলে তাদেরকে জঙ্গী কাফের বলে গণ্য করা হবে। তাদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের জন্য লড়াই জরুরী হবে; যাতে আরব দেশ কুফর ও শিরকমুক্ত হতে পারে।

[2] অর্থাৎ, এই অবকাশ এই জন্য দেওয়া হয়নি যে, এখন তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ স‎ম্ভব নয়; বরং এতে তোমাদের কল্যাণই উদ্দেশ্য। যে ব্যক্তি এর মধ্যে তাওবাহ করে মুসলিম হতে চাইবে, সে মুসলিম হয়ে যাবে। নতুবা জেনে রাখ তোমাদের ব্যাপারে আল্লাহর যে সিদ্ধান্ত ও ইচ্ছা রয়েছে তা তোমরা কোনক্রমেই ব্যর্থ করতে পারবে না এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে অবধারিত লাঞ্ছনা ও অপমান থেকে পরিত্রাণ পেতে পারবে না।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯:৩ وَ اَذَانٌ مِّنَ اللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهٖۤ اِلَی النَّاسِ یَوۡمَ الۡحَجِّ الۡاَكۡبَرِ اَنَّ اللّٰهَ بَرِیۡٓءٌ مِّنَ الۡمُشۡرِكِیۡنَ ۬ۙ وَ رَسُوۡلُهٗ ؕ فَاِنۡ تُبۡتُمۡ فَهُوَ خَیۡرٌ لَّكُمۡ ۚ وَ اِنۡ تَوَلَّیۡتُمۡ فَاعۡلَمُوۡۤا اَنَّكُمۡ غَیۡرُ مُعۡجِزِی اللّٰهِ ؕ وَ بَشِّرِ الَّذِیۡنَ كَفَرُوۡا بِعَذَابٍ اَلِیۡمٍ ۙ﴿۳﴾
و اذان من الله و رسولهٖ الی الناس یوم الحج الاكبر ان الله بریٓء من المشركین و رسولهٗ فان تبتم فهو خیر لكم و ان تولیتم فاعلموا انكم غیر معجزی الله و بشر الذین كفروا بعذاب الیم ﴿۳﴾

আর মহান হজ্জের দিন* মানুষের প্রতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে ঘোষণা, নিশ্চয় আল্লাহ মুশরিকদের থেকে দায়মুক্ত এবং তাঁর রাসূলও। অতএব, যদি তোমরা তাওবা কর, তাহলে তা তোমাদের জন্য উত্তম। আর যদি তোমরা ফিরে যাও, তাহলে জেনে রাখ, তোমরা আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবে না। আর যারা কুফরী করেছে, তাদের তুমি যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও। আল-বায়ান

আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ হতে বড় হাজ্জের দিনে মানুষদের কাছে ঘোষণা দেয়া হল যে আল্লাহ মুশরিকদের সাথে সম্পর্কহীন এবং তাঁর রসূলও। কাজেই এখন যদি তোমরা তাওবাহ কর, তাতে তোমাদেরই ভাল হবে, আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে জেনে রেখ যে, তোমরা আল্লাহকে হীন-দুর্বল করতে পারবে না, আর যারা কুফরী করে চলেছে তাদেরকে ভয়াবহ শাস্তির সুসংবাদ শুনিয়ে দাও। তাইসিরুল

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে বড় হাজ্জের তারিখসমূহে জনগণের সামনে ঘোষণা করা হচ্ছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল উভয়ই এই মুশরিকদের (নিরাপত্তা প্রদান করা) হতে নিঃসম্পর্ক হচ্ছেন; তবে যদি তোমরা তাওবাহ কর তাহলে তা তোমাদের জন্য উত্তম, আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে জেনে রেখ যে, তোমরা আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবেনা, আর (হে নাবী!) এই কাফিরদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। মুজিবুর রহমান

And [it is] an announcement from Allah and His Messenger to the people on the day of the greater pilgrimage that Allah is disassociated from the disbelievers, and [so is] His Messenger. So if you repent, that is best for you; but if you turn away - then know that you will not cause failure to Allah. And give tidings to those who disbelieve of a painful punishment. Sahih International

* অর্থাৎ যিলহজ্জের ১০ তারিখ কুরবানীর দিন।

৩. আর মহান হজের দিনে(১) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি এটা এক ঘোষণা যে, নিশ্চয় মুশরিকদের সম্পর্কে আল্লাহ দায়মুক্ত এবং তার রাসূলও। অতএব, তোমরা যদি তাওবাহ কর তবে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর তোমরা যদি মুখ ফিরাও তবে জেনে রাখ যে, তোমরা আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবে না এবং কাফেরদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন।

(১) এখানে মহান হজের দিনে বলতে কি বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে মুফাসসিরগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস, উমর, আবদুল্লাহ ইবন ওমর এবং আবদুল্লাহ ইবন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ সাহাবা বলেনঃ এর অর্থ আরাফাতের দিন। [ইবন কাসীর] কারণ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে এরশাদ করেছেন “হজ হল আরাফাতের দিন”। [তিরমিযী: ৮৮৯] পক্ষান্তরে আলী, আবদুল্লাহ ইবন আবি আওফা, মুগীরা ইবন শুবাহ, ইবন আব্বাসসহ সাহাবায়ে কিরামের এক বড় দল এবং অনেক মুফাসসির বলেন, এর অর্থ কোরবানীর দিন বা দশই যিলহজ। [ইবন কাসীর] এর সপক্ষে বেশ কিছু সহীহ হাদীস রয়েছে। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানীর দিন প্রশ্ন করেছিলেন, “এটা কোন দিন? লোকেরা চুপ ছিল এমনকি মনে করেছিল যে, তিনি হয়ত: অন্য কোন নামে এটাকে নাম দিবেন, শেষ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটা কি বড় হজের দিন নয়?” [বুখারী ৪৪০৬; মুসলিম: ১৬৭৯] ইমাম সুফিয়ান সওরী রাহিমাহুল্লাহ এবং অপরাপর ইমামগণ এ সকল উক্তির সমস্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে বলেন, হজের দিনগুলো হজ্জে আকবরের দিন। এতে আরাফাত ও কোরবানীর দিনগুলোও রয়েছে। [ইবন কাসীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৩) মহান হজ্জের দিনে[1] আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ হতে মানুষের প্রতি এ এক ঘোষণা যে, আল্লাহর সাথে অংশীবাদীদের কোন সম্পর্ক নেই এবং তাঁর রসূলের সাথেও নয়। যদি তওবা কর, তাহলে তোমাদের কল্যাণ হবে, আর তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে জেনে রাখ যে, তোমরা আল্লাহকে হীনবল করতে পারবে না। আর অবিশ্বাসীদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সুসংবাদ দাও।

[1] সহীহায়ন (বুখারী, মুসলিম) ও অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে প্রমাণিত যে, মহান বা বড় হজ্জ বলতে কুরবানীর (১০ই যিলহজ্জ) দিনকে বোঝানো হয়েছে। (বুখারী ৪৬৫৫, মুসলিম ৯৮২, তিরমিযী ৯৫৭নং) এই দিনে মিনাতে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা শুনানো হয়। ১০ই যুলহজ্জকে বড় হজ্জের দিন এই জন্য বলা হয় যে, এই দিনে হজ্জের সব থেকে অধিক ও গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী আদায় করা হয়ে থাকে। আর সাধারণতঃ লোকেরা উমরাহকে ‘হাজ্জে আসগার’ (ছোট হজ্জ) বলত। এই জন্য উমরাহ থেকে পৃথক করার জন্য হজ্জকে ‘হাজ্জে আকবার’ (বড় হজ্জ) বলা হয়। পক্ষান্তরে জনসাধারণের মাঝে এই কথা প্রসিদ্ধ আছে যে, জুমআর দিনে হজ্জের (আরাফাতের) দিন পড়লে তা বড় হজ্জ (বা আকবরী হজ্জ) হয়। কিন্তু এ কথার কোন দলীল নেই, এ হল ভিত্তিহীন কথা।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯:৪ اِلَّا الَّذِیۡنَ عٰهَدۡتُّمۡ مِّنَ الۡمُشۡرِكِیۡنَ ثُمَّ لَمۡ یَنۡقُصُوۡكُمۡ شَیۡئًا وَّ لَمۡ یُظَاهِرُوۡا عَلَیۡكُمۡ اَحَدًا فَاَتِمُّوۡۤا اِلَیۡهِمۡ عَهۡدَهُمۡ اِلٰی مُدَّتِهِمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ یُحِبُّ الۡمُتَّقِیۡنَ ﴿۴﴾
الا الذین عهدتم من المشركین ثم لم ینقصوكم شیئا و لم یظاهروا علیكم احدا فاتموا الیهم عهدهم الی مدتهم ان الله یحب المتقین ﴿۴﴾

তবে মুশরিকদের মধ্য থেকে যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছ, অতঃপর তারা তোমাদের সাথে কোন ত্রুটি করেনি এবং তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করেনি, তোমরা তাদেরকে দেয়া চুক্তি তাদের নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত পূর্ণ কর। নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালবাসেন। আল-বায়ান

কিন্তু মুশরিকদের মধ্যে যারা তোমাদের সঙ্গে চুক্তি রক্ষার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেনি, আর তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্যও করেনি, তাদের সাথে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চুক্তি পূর্ণ কর। অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালবাসেন। তাইসিরুল

কিন্তু হ্যাঁ ঐ সব মুশরিক হচ্ছে স্বতন্ত্র যাদের নিকট থেকে তোমরা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছ, অতঃপর তারা তোমাদের বিরুদ্ধে কেহকেও সাহায্য করেনি। সুতরাং তাদের সন্ধি চুক্তিতে তাদের নির্ধারিত সময় পর্যন্ত পূর্ণ কর; নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের পছন্দ করেন । মুজিবুর রহমান

Excepted are those with whom you made a treaty among the polytheists and then they have not been deficient toward you in anything or supported anyone against you; so complete for them their treaty until their term [has ended]. Indeed, Allah loves the righteous [who fear Him]. Sahih International

৪. তবে মুশরিকদের মধ্যে যাদের সাথে তোমরা চুক্তিতে আবদ্ধ ও পরে তোমাদের চুক্তি রক্ষায় কোন ক্রটি করেনি এবং তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকেও সাহায্য করেনি(১), তোমরা তাদের সাথে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পূর্ণ কর; নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে পছন্দ করেন।(২)

(১) এ আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, মুশরিকরা যদি অঙ্গীকার ভঙ্গ করে তবে তাদেরকে হত্যা করা জায়েয। [আদওয়াউল বায়ান] অন্য আয়াতেও অনুরূপ বলা হয়েছে। যেমন, “যতক্ষন তারা তোমাদের চুক্তিতে স্থির থাকবে তোমরাও তাদের চুক্তিতে স্থির থাকবে।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৭] অন্য আয়াতে আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, “আর যদি তারা তাদের চুক্তির পর তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং তোমাদের দ্বীন সম্বন্ধে কটুক্তি করে, তবে কুফরের নেতাদের সাথে যুদ্ধ কর; এরা এমন লোক যাদের কোন প্রতিশ্রুতি নেই; যেন তারা নিবৃত্ত হয়।” [সূরা আত-তাওবাহঃ ১২] তবে এর বিপরীত কাউকে হত্যা করা জায়েয নেই। হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে কেউ কোন অঙ্গীকারবদ্ধ অমুসলিমকে হত্যা করবে সে জান্নাতের গন্ধও পাবে না। অথচ এর গন্ধ চল্লিশ বছরের পথের দুরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।” [বুখারী ৬৯১৪]

(২) কাতাদা বলেন, এরা হচ্ছে কুরাইশ মুশরিক, যাদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুদায়বিয়ার সন্ধি করেছিলেন। ঐ বছর কুরবানীর দিনের পর তাদের সুনির্দিষ্ট মেয়াদের তখনও চারমাস বাকী ছিল। তাই আল্লাহ তার নবীকে এ সময়টুকু পূর্ণ করার নির্দেশ দিলেন। আর যাদের সাথে কোন চুক্তি ছিল না তাদেরকে অবকাশ দিলেন মুহাররাম মাস শেষ হওয়া পর্যন্ত। আর যাদের সাথে চুক্তি ছিল সে চুক্তি শেষ হওয়ার পর আর কোন চুক্তি করা হবে না ঘোষণা দিলেন, সুতরাং তারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ সাক্ষ্য দেয়া পর্যন্ত তাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাদের কাছ থেকে অন্য কিছু গ্রহণ করা হবে না। [তাবারী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৪) তবে অংশীবাদীদের মধ্যে যাদের সাথে তোমরা চুক্তিতে আবদ্ধ ও পরে যারা তোমাদের চুক্তি রক্ষায় কোন ত্রুটি করেনি এবং তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকেও সাহায্য করেনি, তোমরা তাদের সাথে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পালন কর। [1] নিশ্চয় আল্লাহ সাবধানীদেরকে ভালোবাসেন।

[1] এটা হল মুশরিকদের চতুর্থ দল। তাদের সাথে যত দিনের চুক্তি ছিল সেই সময় পর্যন্ত তাদেরকে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কেননা, তারা চুক্তি পালন করেছিল এবং তার পরিপন্থী কোন আচরণ প্রদর্শন করেনি। এই জন্য মুসলিমদের পক্ষেও চুক্তি পালনকে জরুরী করা হয়েছিল।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯:৫ فَاِذَا انۡسَلَخَ الۡاَشۡهُرُ الۡحُرُمُ فَاقۡتُلُوا الۡمُشۡرِكِیۡنَ حَیۡثُ وَجَدۡتُّمُوۡهُمۡ وَ خُذُوۡهُمۡ وَ احۡصُرُوۡهُمۡ وَ اقۡعُدُوۡا لَهُمۡ كُلَّ مَرۡصَدٍ ۚ فَاِنۡ تَابُوۡا وَ اَقَامُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتَوُا الزَّكٰوۃَ فَخَلُّوۡا سَبِیۡلَهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۵﴾
فاذا انسلخ الاشهر الحرم فاقتلوا المشركین حیث وجدتموهم و خذوهم و احصروهم و اقعدوا لهم كل مرصد فان تابوا و اقاموا الصلوۃ و اتوا الزكوۃ فخلوا سبیلهم ان الله غفور رحیم ﴿۵﴾

অতঃপর যখন নিষিদ্ধ মাসগুলো অতিবাহিত হয়ে যাবে, তখন তোমরা মুশরিকদেরকে যেখানেই পাও হত্যা কর এবং তাদেরকে পাকড়াও কর, তাদেরকে অবরোধ কর এবং তাদের জন্য প্রতিটি ঘাঁটিতে বসে থাক। তবে যদি তারা তাওবা করে এবং সালাত কায়েম করে, আর যাকাত দেয়, তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয় আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আল-বায়ান

তারপর (এই) নিষিদ্ধ মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলে মুশরিকদেরকে যেখানে পাও হত্যা কর, তাদেরকে পাকড়াও কর, তাদেরকে ঘেরাও কর, তাদের অপেক্ষায় প্রত্যেক ঘাঁটিতে ওৎ পেতে বসে থাক। কিন্তু তারা যদি তাওবাহ করে, নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে, তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও, নিশ্চয়ই আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু। তাইসিরুল

অতঃপর যখন নিষিদ্ধ মাসগুলি অতীত হয়ে যায় তখন ঐ মুশরিকদেরকে যেখানে পাবে তাদের সাথে যুদ্ধ কর এবং হত্যা কর, তাদেরকে ধরে ফেল, তাদেরকে অবরোধ করে রাখো এবং তাদের সন্ধানে ঘাঁটিসমূহে অবস্থান কর। অতঃপর যদি তারা তাওবাহ করে, সালাত আদায় করে এবং যাকাত প্রদান করে তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাপরায়ণ, পরম করুণাময়। মুজিবুর রহমান

And when the sacred months have passed, then kill the polytheists wherever you find them and capture them and besiege them and sit in wait for them at every place of ambush. But if they should repent, establish prayer, and give zakah, let them [go] on their way. Indeed, Allah is Forgiving and Merciful. Sahih International

৫. অতঃপর নিষিদ্ধ মাস(১) অতিবাহিত হলে মুশরিকদেরকে যেখানে পাবে হত্যা কর(২), তাদেরকে পাকড়াও কর(৩), অবরোধ কর এবং প্রত্যেক ঘাটিতে তাদের জন্য ওঁৎ পেতে থাক; কিন্তু যদি তারা তাওবাহ করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয়(৪) তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও(৫); নিশ্চয় আল্লাহ্‌ অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।(৬)

(১) এখানে “আশহরে হুরুম” বলতে কি বুঝানো হয়েছে এ ব্যাপারে দুটি মত রয়েছে। ১) বিখ্যাত চারটি মাস যা হারাম হওয়া শরীআতের স্বীকৃত সে চারটি মাস বুঝানো হয়েছে, অর্থাৎ রজব, জিলকদ, জিলহজ্জ ও মুহাররাম ৷ ২) এখানে মূলতঃ পূর্ববর্তী আয়াতে অবকাশ দেয়া চার মাসকেই বুঝানো হয়েছে। আর এটাই প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত। অর্থাৎ পূর্ববর্তী আয়াতে কাফেরদেরকে যে চারমাসের অবকাশ দেয়া হয়েছে তা যখনি শেষ হয়ে যাবে তখনি তাদের সাথে আর কোন চুক্তি করা হবে না। তাদের হয় ইসলাম গ্রহণ করতে হবে নয় তো মক্কা ছেড়ে যেতে হবে। এর জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন হলে তা ও করতে হবে। [ফাতহুল কাদীর]

(২) সুফইয়ান ইবন উয়াইনাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ্ তা'আলা চার তরবারী নিয়ে পাঠিয়েছেন। তন্মধ্যে একটি কাফের মুশরিকদের বিরুদ্ধে। যার প্রমাণ আলোচ্য আয়াত। দ্বিতীয়টি আহলে কিতাবদের বিরুদ্ধে। তার প্রমাণ সূরা আত-তাওবার ২৯ নং আয়াত। তৃতীয়টি মুনাফিকদের বিরুদ্ধে যা সূরা আত-তাওবার ৭৩ ও সূরা আত-তাহরীমের ৯ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। চতুর্থটি বিদ্রোহী, সীমালংঘনকারীদের বিরুদ্ধে। যার আলোচনা সূরা আল-হুজুরাত এর ৯ নং আয়াতে এসেছে। [ইবন কাসীর]

(৩) চাই তা হত্যার মাধ্যমে হোক বা বন্দী করার মাধ্যমে হোক, যে প্রকারেই হোক তাদের পাকড়াও করবে। তবে বন্দীকেই أخِيْذ বলা হয়। তাই এর অর্থ হচ্ছে, তাদের বন্দী কর। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] ইবন কাসীর আরও বলেন, এ আয়াতে যেখানে পাও পাকড়াও করার সাধারণ কথা বলা হলেও তা অন্য আয়াত দ্বারা বিশেষিত। অন্য আয়াতে হারাম এলাকায় হত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “আর মসজিদুল হারামের কাছে তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবে না যে পর্যন্ত না তারা সেখানে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে।” [সূরা আল-বাকারাহঃ ১৯১]

(৪) ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমাকে ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যতক্ষণ না তারা বলবে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং সালাত কায়েম করবে আর যাকাত প্রদান করবে। অতঃপর যদি তারা তা করে, তবে তাদের জান ও মাল আমার হাত থেকে নিরাপদ হবে, কিন্তু যদি ইসলামের অধিকার আদায় করতে হয়, তবে তা ভিন্ন কথা। আর তাদের হিসাব নেয়ার ভার তো আল্লাহর উপর।” [বুখারী: ২৫; মুসলিম: ২২]

(৫) আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু এ আয়াত দ্বারা যাকাত প্রদানে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পক্ষে দলীল পেশ করেছেন। [দেখুন, বুখারীঃ ২৫; মুসলিমঃ ২২] কেননা এখানে কুফরী ও শির্কী থেকে মুক্তির আলামত হিসাবে সালাত আদায়ের সাথে সাথে যাকাত প্রদানের কথাও বলা হয়েছে। [ইবন কাসীর] বর্তমানেও যারা যাকাত দিতে অস্বীকার করবে তাদের ব্যাপারে একই বিধান প্রযোজ্য হবে। [সা'দী] কাতাদা বলেন, আল্লাহ যাদেরকে ছেড়ে দেয়ার কথা বলেছেন তাদেরকে ছেড়ে দাও। মানুষ তো তিন ধরনের। এক. মুসলিম, যার উপর যাকাত ফরয। দুই. মুশরিক, তার উপর জিযইয়া ধার্য। তিন. কাফের যোদ্ধা যে মুসলিমদের সাথে ব্যবসা করতে চায়, তার উপর কর ধার্য। [তাবারী]

(৬) সুতরাং তিনি যারা তাওবাহ করবে তাদের শির্কসহ যাবতীয় গোনাহ ক্ষমা করবেন। তাদেরকে তাওফীক দেয়ার মাধ্যমে দয়া করবেন। তারপর তাদের থেকে তা কবুল করবেন। [সা'দী] সূরা তাওবাহর প্রথম পাঁচ আয়াতে মক্কাবিজয়ের পর মক্কা ও তার আশ-পাশের সকল কাফের-মুশরিকের জান মালের সার্বিক নিরাপত্তা দানের বিষয়টি উল্লেখিত হয়। তবে তাদের চুক্তিভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতার তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে তাদের সাথে আর কোন চুক্তি না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ সত্বেও ইতিপূর্বে যাদের সাথে চুক্তি করা হয় এবং যারা চুক্তিভঙ্গ করেনি, তাদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়া অবধি চুক্তি রক্ষার জন্য এ আয়াতসমূহে মুসলিমদের আদেশ দেয়া হয়।

আর যাদের সাথে কোন চুক্তি হয়নি, কিংবা যাদের সাথে কোন মেয়াদী চুক্তি হয়নি, তাদের প্রতি এই অনুকম্পা করা হয় যে, তড়িৎ মক্কা ত্যাগের আদেশের স্থলে চার মাসের সময় দেয়া হয়। যাতে এ অবসরে যেদিকে সুবিধা চলে যেতে পারে, অথবা এ সময়ে ইসলামের সত্যতা উপলব্ধি করে মুসলিম হতে পারে। আল্লাহর এ সকল আদেশের উদ্দেশ্য হল, আগামী সাল নাগাদ যেন মক্কা শরীফ সকল বিশ্বাসঘাতক মুশরিকদের থেকে পবিত্র হয়ে যায়। অধিকাংশ আলেম এ সর্বশেষ আয়াতকে আয়াতুস সাইফ বা তরবারীর আয়াত আখ্যা দিয়েছেন। এর অর্থ হলো, এর মাধ্যমে যাবতীয় চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। এখন হয় ইসলাম না হয় তরবারীই তাদের মধ্যে মীমাংসা করতে পারে। [বাগভী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৫) অতঃপর নিষিদ্ধ মাসগুলি[1] অতিবাহিত হলে অংশীবাদীদেরকে যেখানে পাও হত্যা কর,[2] তাদেরকে বন্দী কর,[3] অবরোধ কর এবং প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের জন্য ওঁৎ পেতে থাক।[4] কিন্তু যদি তারা তওবা করে, যথাযথ নামায পড়ে ও যাকাত প্রদান করে, তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও।[5] নিশ্চয় আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

[1] সেই ‘নিষিদ্ধ মাসগুলি’ বলতে কোন্ কোন্ মাস উদ্দেশ্য তাতে মতভেদ রয়েছে। একটি রায় হল যে, তা থেকে উদ্দেশ্য হল ঐ চার মাস, যা হারাম (বা নিষিদ্ধ) বলে প্রসিদ্ধ; অর্থাৎ, রজব, যুলক্বাদ্, যুলহাজ্জ ও মুহাররাম মাস। আর সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা ১০ই যুলহজ্জ তারীখে করা হয়েছিল। এই হিসাবে তাদেরকে ঘোষণার পর ৫০ দিন অবকাশ দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, নিষিদ্ধ মাসগুলি অতিবাহিত হওয়ার পর মুশরিকদেরকে গ্রেপ্তার ও হত্যা করার আদেশ জারী করা হয়। কিন্তু ইমাম ইবনে কাসীর বলেছেন যে, এখানে ‘নিষিদ্ধ মাসগুলি’ বলতে হারামকৃত ঐ চার মাস নয়; বরং এখানে ১০ই যিলহজ্জ থেকে ১০ই রবীউস সানী পর্যন্ত চার মাসকে বুঝানো হয়েছে। আর এই চার মাসকে নিষিদ্ধ মাস এই জন্য বলা হয়েছে যে, সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা হিসাবে এই চার মাসে সেই সব মুশরিকদের সাথে লড়াই ও তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুমতি ছিল না। সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা হিসাবে এই ব্যাখ্যা যথোপযুক্ত বলে মনে হয়। আর এ ব্যাপারে আল্লাহই অধিক জানেন।

[2] কোন কোন মুফাসসিরগণ এই আদেশকে ব্যাপক বলে মনে করেছেন। অর্থাৎ, বৈধ ও নিষিদ্ধ যে জায়গাতেই পাও তাদেরকে হত্যা কর। আর কোন কোন মুফাসসিরগণ বলেন, উক্ত আদেশকে {وَلاَ تُقَاتِلُوهُمْ عِندَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ حَتَّى يُقَاتِلُوكُمْ فِيهِ فَإِن قَاتَلُوكُمْ فَاقْتُلُوهُمْ} ‘‘আর মাসজিদুল হারামের (কা’বা শরীফের) নিকট তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করো না; যতক্ষণ না তারা সেখানে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে। যদি তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তাহলে তোমরা তাদেরকে হত্যা কর।’’ (সূরা বাকারাহ ১৯১ আয়াত) এই আয়াত দ্বারা সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ, কেবল হারাম শরীফের সীমানার বাইরে হত্যা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। (ইবনে কাসীর)

[3] অর্থাৎ, তাদেরকে বন্দী কর অথবা হত্যা কর।

[4] অর্থাৎ এটাই যথেষ্ট মনে করো না যে, তাদের সাথে তোমাদের সাক্ষাৎ হলে তোমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। বরং যেখানে যেখানে তাদের আশ্রয়স্থল, দুর্গ ও ঘাঁটি আছে সেখানে তাদের প্রতীক্ষায় থাকো; এমনকি তোমাদের অনুমতি ছাড়া তাদের যেন কোথাও যাওয়া-আসা পর্যন্ত সম্ভব না হয়।

[5] অর্থাৎ, তাদের বিরুদ্ধে কোন রকমের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে না। কেননা, তারা মুসলমান হয়ে গেছে। বুঝা গেল যে, ইসলাম গ্রহণ করার পর নামায কায়েম করা ও যাকাত প্রদান করা জরুরী। যদি কোন ব্যক্তি তার মধ্যে কোন একটি ত্যাগ করে, তাহলে তাকে মুসলিম ভাবা যাবে না। যেমন আবু বাকর সিদ্দীক (রাঃ) এই আয়াত থেকে দলীল গ্রহণ করে যাকাত আদায়ে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। আর বলেছিলেন যে, ‘আল্লাহর কসম! আমি সেই সব লোকদের বিরুদ্ধে অবশ্যই লড়ব, যারা নামায ও যাকাতের মাঝে পার্থক্য করবে।’ (বুখারী, মুসলিম) অর্থাৎ, নামায তো পড়ে; কিন্তু যাকাত প্রদান করে না।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯:৬ وَ اِنۡ اَحَدٌ مِّنَ الۡمُشۡرِكِیۡنَ اسۡتَجَارَكَ فَاَجِرۡهُ حَتّٰی یَسۡمَعَ كَلٰمَ اللّٰهِ ثُمَّ اَبۡلِغۡهُ مَاۡمَنَهٗ ؕ ذٰلِكَ بِاَنَّهُمۡ قَوۡمٌ لَّا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۶﴾
و ان احد من المشركین استجارك فاجره حتی یسمع كلم الله ثم ابلغه مامنهٗ ذلك بانهم قوم لا یعلمون ﴿۶﴾

আর যদি মুশরিকদের কেউ তোমার কাছে আশ্রয় চায়, তাহলে তাকে আশ্রয় দাও, যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনে, অতঃপর তাকে পৌঁছিয়ে দাও তার নিরাপদ স্থানে। তা এই জন্য যে, তারা এমন এক কওম, যারা জানে না। আল-বায়ান

মুশরিকদের কেউ যদি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে তবে তাকে আশ্রয় দাও যাতে সে আল্লাহর বাণী শোনার সুযোগ পায়; তারপর তাকে তার নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দাও। এটা এজন্য করতে হবে যে, এরা এমন এক সম্প্রদায় যারা (ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা সম্পর্কে) অজ্ঞ। তাইসিরুল

মুশরিকদের মধ্য হতে যদি কেহ তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে তাহলে তুমি তাকে আশ্রয় দান কর, যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পায়; অতঃপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দাও, এই আদেশ এ জন্য যে, এরা এমন লোক যারা জ্ঞান রাখেনা। মুজিবুর রহমান

And if any one of the polytheists seeks your protection, then grant him protection so that he may hear the words of Allah. Then deliver him to his place of safety. That is because they are a people who do not know. Sahih International

৬. আর মুশরিকদের মধ্যে কেউ আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে আপনি তাকে আশ্রয় দিন; যাতে সে আল্লাহর বাণী শুনতে পায়(১) তারপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌছিয়ে দিন(২); কারণ তারা এমন এক সম্প্রদায় যারা জানে না।

(১) আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, কোন বিধর্মী যদি ইসলামের সত্যতার দলীল জানতে চায়, তবে প্রমাণপঞ্জী সহকারে তার সামনে ইসলামকে পেশ করা মুসলিমদের কর্তব্য। অনুরূপভাবে কোন বিধর্মী ইসলামের সম্যক তথ্য ও তত্ত্বাবলী হাসিলের জন্যে যদি আমাদের কাছে আসে, তবে এর অনুমতি দান ও তার নিরাপত্তা বিধান আমাদের পক্ষে ওয়াজিব। তাকে বিব্রত করা বা তার ক্ষতিসাধন অবৈধ। তারপর তাকে তার নিরাপদ স্থান যেখান থেকে সে এসেছে সেখানে পৌছে দেয়াও মুসলিমের দায়িত্ব। [তাবারী] এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, কুরআন আল্লাহর কালাম, তিনি স্বয়ং এ বাণীর প্রবক্তা। সুতরাং কুরআন সৃষ্ট নয়, যেমনটি কোনও কোনও বিদআতপন্থীরা মনে করে থাকে।

(২) এ সহনশীলতা প্রদর্শনের কারণ হলো, কাফের মুশরিকদেরকে আল্লাহর কালাম শুনে এবং মুসলিমদের বাস্তব অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ দেয়া। হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় মুশরিকগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যাবতীয় কর্মকাণ্ড ও রাসূলের প্রতি সাহাবাদের ভালবাসা দেখার পরে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড ভাবান্তর সৃষ্টি হয়েছিল যা তাদের ঈমান গ্রহণে সহযোগিতা করেছিল। [ইবন কাসীর] তাছাড়া এমনও হতে পারে যে, তারা মূর্খতা বা অজ্ঞতা বশত: বিরোধিতায় লিপ্ত। আল্লাহর কালাম শোনার পর তাদের মধ্যে ভাবান্তর হবে এবং ইসলাম গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ হবে। [সা'দী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৬) আর অংশীবাদীদের মধ্যে কেউ তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে, তুমি তাকে আশ্রয় দাও যাতে সে আল্লাহর বাণী শুনতে পায়। অতঃপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দাও।[1] তা এ জন্য যে, তারা অজ্ঞ লোক। [2]

[1] এই আয়াতে পূর্বোক্ত জঙ্গী কাফেরদের ব্যাপারে এক অনুমতি দেওয়া হয়েছে যে, যদি কোন কাফের আশ্রয় প্রার্থনা করে, তাহলে তাকে আশ্রয় দাও। অর্থাৎ, তাকে নিজেদের হিফাযত ও নিরাপত্তায় রাখ; যাতে কোন মুসলিম তাকে হত্যা করতে না পারে। আর যাতে সে আল্লাহর বাণী শোনা ও ইসলাম সম্পর্কে জানার অবকাশ পায়। স‎ম্ভবতঃ এইভাবে তার তাওবাহ ও ইসলাম কবুল করার পথ বেরিয়ে আসবে। অতঃপর যদি সে আল্লাহর বাণী শোনা সত্ত্বেও ইসলাম গ্রহণ না করে, তাহলে তাকে তার নিজ নিরাপদ জায়গায় পৌঁঁছে দাও। উদ্দেশ্য এই যে, নিজেদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত পালন করতে হবে; যতক্ষণ না সে নিজের গন্তব্যস্থলে নির্বিঘ্নে পৌঁছে যায়। যেহেতু তার প্রাণ রক্ষা করা তোমাদের দায়িত্ব।

[2] অর্থাৎ, আশ্রয়প্রার্থী (শরণার্থী)-দেরকে আশ্রয় দেওয়ার অনুমতি এই জন্য দেওয়া হয়েছে যে, এরা হল অজ্ঞ লোক। স‎ম্ভবতঃ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কথা তাদের কানে এলে এবং মুসলিমদের আখলাক-চরিত্র দেখলে সে ইসলামের সত্যতার বিশ্বাসী হয়ে যাবে এবং ইসলাম গ্রহণ করে আখেরাতের আযাব থেকে বেঁচে যাবে। যেমন হুদাইবিয়ার চুক্তির পর বহু সংখ্যক কাফের নিরাপত্তা চেয়ে মদীনায় আসা-যাওয়া করত। যার ফলে মুসলিমদের চরিত্র ও আচরণ প্রত্যক্ষ করে ইসলাম বুঝা তাদের জন্য সহজ হল। অতঃপর তাদের মধ্যে বহু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করল।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯:৭ كَیۡفَ یَكُوۡنُ لِلۡمُشۡرِكِیۡنَ عَهۡدٌ عِنۡدَ اللّٰهِ وَ عِنۡدَ رَسُوۡلِهٖۤ اِلَّا الَّذِیۡنَ عٰهَدۡتُّمۡ عِنۡدَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ ۚ فَمَا اسۡتَقَامُوۡا لَكُمۡ فَاسۡتَقِیۡمُوۡا لَهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ یُحِبُّ الۡمُتَّقِیۡنَ ﴿۷﴾
كیف یكون للمشركین عهد عند الله و عند رسولهٖ الا الذین عهدتم عند المسجد الحرام فما استقاموا لكم فاستقیموا لهم ان الله یحب المتقین ﴿۷﴾

কীভাবে মুশরিকদের জন্য অঙ্গীকার থাকবে আল্লাহর কাছে ও তাঁর রাসূলের কাছে? অবশ্য যাদের সাথে মসজিদে হারামে তোমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছ তাদের কথা আলাদা। অতএব যতক্ষণ তারা তোমাদের জন্য ঠিক থাকে, ততক্ষণ তোমরাও তাদের জন্য ঠিক থাক। নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালবাসেন। আল-বায়ান

আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সঙ্গে মুশরিকদের চুক্তি কী করে কার্যকর থাকতে পারে? অবশ্য ঐসব লোক ছাড়া যাদের সঙ্গে তোমরা মাসজিদুল হারামের নিকট চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলে; তারা যদ্দিন তোমাদের সঙ্গে চুক্তি ঠিক রাখে, তোমরাও তাদের সঙ্গে কৃত চুক্তিতে দৃঢ় থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালবাসেন। তাইসিরুল

এই (কুরাইশ) মুশরিকদের অঙ্গীকার আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট কি রূপে (বলবৎ) থাকবে যদি না তাদের সাথে তোমরা মাসজিদুল হারামের সন্নিকটে অঙ্গীকার নিয়ে থাক? অতএব যে পর্যন্ত তারা তোমাদের সাথে সরলভাবে থাকে, তোমরাও তাদের সাথে সরলভাবে থাকবে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ সংযমশীলদের পছন্দ করেন। মুজিবুর রহমান

How can there be for the polytheists a treaty in the sight of Allah and with His Messenger, except for those with whom you made a treaty at al-Masjid al-Haram? So as long as they are upright toward you, be upright toward them. Indeed, Allah loves the righteous [who fear Him]. Sahih International

৭. আল্লাহ ও তার রাসূলের কাছে মুশরিকদের চুক্তি কি করে বলবৎ থাকবে? তবে যাদের সাথে মসজিদুল হারামের সন্নিকটে(১) তোমরা পারস্পারিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলে, যতক্ষণ তারা তোমাদের চুক্তিতে স্থির থাকবে তোমরাও তাদের চুক্তিতে স্থির থাকবে(২); নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে পছন্দ করেন।

(১) অর্থাৎ হুদায়বিয়ার দিন যে চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল এখানে তাই উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। [ইবন কাসীর] এখানে মাসজিদুল হারাম বলে পুরো হারাম এলাকা বুঝানো হয়েছে। কুরআনের সুরা আল-ফাত্হ এর ২৫ নং আয়াতেও মাসজিদুল হারাম বলে মক্কার পুরো হারাম এলাকা বুঝানো হয়েছে। আর হুদায়বিয়ার একাংশ হারাম এলাকার ভিতরে, যা সবচেয়ে নিকটতম হারাম এলাকা।

(২) কুরআন মজীদ মুসলিমদের তাকিদ করে যে, শক্রদের বেলায়ও ইনসাফ থেকে কোন অবস্থায় যেন বিচ্যুত না হয়। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যেমন, নগণ্যসংখ্যক মুশরিক ছাড়া বাকী সবাই চুক্তিভংগ করেছে। সাধারণতঃ এমতাবস্থায় বাছ-বিচার তেমন থাকে না। নির্দোষ ক্ষুদ্র দলকেও সংখ্যা গুরু অপরাধী দলের ভাগ্যই বরণ করতে হয়। কিন্তু আল্লাহ্ তা'আলা “তবে যাদের সাথে তোমরা মসজিদুল হারামের পাশে চুক্তি সম্পাদন করেছ” বলে ওদের পৃথক করে দেয়, যারা চুক্তিভংগ করেনি এবং আদেশ দেয়া হয় যে, সংখ্যাগুরু চুক্তিভংগকারী মুশরিকদের প্রতি রাগ করে এদের সাথে তোমরা চুক্তিভংগ করোনা; বরং এরা যতদিন তোমাদের প্রতি সরল ও চুক্তির উপর অবিচল থাকে, তোমরাও তাদের প্রতি সরল থাক। ওদের প্রতি আক্রোশ বশতঃ এদের কষ্ট দেবে না। আল্লাহ্ তা'আলা এ বিষয়টি অন্যত্র পরিষ্কার ব্যক্ত করেছেন, “কোন জাতির শক্রতা যেন বে-ইনসাফ হতে তোমাদের উদ্বুদ্ধ না করে। [সূরা আল-মায়েদাহঃ ৮]

অনুরূপভাবে আলোচ্য সূরা আত-তাওবাহ এর ৮ নং আয়াতের শেষে বলা হয়েছেঃ “এদের অধিকাংশই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী।” অর্থাৎ এদের মধ্যে কিছুসংখ্যক ভদ্র চিত্ত লোক চুক্তির উপর অবিচল থাকতে চায়। কিন্তু সংখ্যাগুরুর ভয়ে তারাও জড়সড়। যারা চুক্তি ভঙ্গ করেনি তারা কারা এটা নির্ধারণে কয়েকটি মত রয়েছে। ইমাম তাবারী বলেন, তারা হচ্ছে, কিনানা এর বনী বকরের কোন কোন গোষ্ঠী। যারা তাদের অঙ্গীকারে অটল ছিল। কুরাইশ ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে যা সংঘটিত হয়েছিল তাতে তাদের কোন ভূমিকা ছিল না। কারণ নবম হিজরীতে যে সময় এ ঘোষণা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রদান করেছিলেন, তখন মক্কাতে কুরাইশ বা খুযাআতে কোন কাফের অবশিষ্ট ছিল না, আর কুরাইশ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাঝেও আর কোন চুক্তি অবশিষ্ট ছিল না। সুতরাং বুঝা গেল যে, তারা ছিল কিনানার বনী বকরের কিছু লোক। [তাবারী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৭) আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নিকট অংশীবাদীদের চুক্তি কিরূপে বলবৎ থাকবে?[1] তবে যাদের সাথে তোমরা মাসজিদুল হারামের সন্নিকটে পারস্পরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছ, তারা যতদিন তোমাদের চুক্তিতে স্থির থাকবে, তোমরা তাদের চুক্তিতে স্থির থাক। নিশ্চয় আল্লাহ সাবধানীদেরকে পছন্দ করেন। [2]

[1] এই প্রশ্নবাচক শব্দটি নেতিবাচক। অর্থাৎ, যে সকল মুশরিকদের সাথে তোমাদের চুক্তি আছে তাদের ছাড়া আর কারো চুক্তি বলবৎ থাকবে না।

[2] অর্থাৎ, চুক্তি বজায় রাখা আল্লাহর নিকট বড় পছন্দনীয় কাজ। অতএব তার প্রতি যত্ন রাখা জরুরী।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯:৮ كَیۡفَ وَ اِنۡ یَّظۡهَرُوۡا عَلَیۡكُمۡ لَا یَرۡقُبُوۡا فِیۡكُمۡ اِلًّا وَّ لَا ذِمَّۃً ؕ یُرۡضُوۡنَكُمۡ بِاَفۡوَاهِهِمۡ وَ تَاۡبٰی قُلُوۡبُهُمۡ ۚ وَ اَكۡثَرُهُمۡ فٰسِقُوۡنَ ۚ﴿۸﴾
كیف و ان یظهروا علیكم لا یرقبوا فیكم الا و لا ذمۃ یرضونكم بافواههم و تابی قلوبهم و اكثرهم فسقون ﴿۸﴾

কীভাবে থাকবে (মুশরিকদের জন্য অঙ্গীকার)? অথচ তারা যদি তোমাদের উপর জয়ী হয়, তাহলে তারা তোমাদের আত্মীয়তা ও অঙ্গীকারের ব্যাপারে লক্ষ্য রাখে না। তারা তাদের মুখের (কথা) দ্বারা তোমাদেরকে সন্তুষ্ট করে, কিন্তু তাদের অন্তর তা অস্বীকার করে। আর তাদের অধিকাংশ ফাসিক। আল-বায়ান

কীভাবে (চুক্তি থাকতে পারে) যদি তারা তোমাদেরকে পরাজিত করতে পারে তাহলে তারা তোমাদের সঙ্গে না আত্মীয়তার মর্যাদা দেয়, আর না ওয়াদা-অঙ্গীকারের; তারা তাদের মুখের কথায় তোমাদেরকে সন্তুষ্ট রাখতে চায় কিন্তু তাদের অন্তর তা অস্বীকার করে, তাদের অধিকাংশই সত্যত্যাগী অপরাধী। তাইসিরুল

কি করে চুক্তি রক্ষা হবে, যদি অবস্থা এই হয় যে, তারা যদি তোমাদের উপর প্রাধান্য লাভ করে তাহলে তোমাদের আত্মীয়তার মর্যাদাও রক্ষা করবেনা এবং অঙ্গীকারেরও না। তারা তোমাদেরকে নিজেদের মুখের কথায় সন্তুষ্ট রাখে, কিন্তু তাদের অন্তরসমূহ অস্বীকার করে, আর তাদের অধিকাংশ লোকই ফাসিক । মুজিবুর রহমান

How [can there be a treaty] while, if they gain dominance over you, they do not observe concerning you any pact of kinship or covenant of protection? They satisfy you with their mouths, but their hearts refuse [compliance], and most of them are defiantly disobedient. Sahih International

৮. কেমন করে চুক্তি বলবৎ থাকবে? অথচ তারা যদি তোমাদের উপর জয়ী হয়, তবে তারা তোমাদের আত্মীয়তার ও অঙ্গীকারের কোন মর্যাদা দেবে না; তারা মুখে তোমাদেরকে সন্তুষ্ট রাখে; কিন্তু তাদের হৃদয় তা অস্বীকার করে; আর তাদের অধিকাংশই ফাসেক।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(৮) কেমন করে (তাদের চুক্তি বলবৎ থাকবে)? অথচ অবস্থা এই যে, তারা যদি তোমাদের উপর বিজয় লাভ করে, তাহলে তোমাদের আত্মীয়তা ও অঙ্গীকারের কোন মর্যাদা দেবে না, [1] তারা মুখে তোমাদেরকে সন্তুষ্ট করে, কিন্তু তাদের হৃদয় তা অস্বীকার করে। বস্তুতঃ তাদের অধিকাংশই সত্যত্যাগী।

[1] كَيف (কেমন করে?) শব্দটি পুনরায় তাকীদের জন্য নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার হয়েছে। إِلّ অর্থ হল আত্মীয়তা এবং ذِمَّة শব্দের অর্থ হল অঙ্গীকার। অর্থাৎ, সেই মুশরিকদের মুখের কথার কি দাম আছে, যাদের অবস্থা এই যে, যদি তারা তোমাদের উপর বিজয় লাভ করে, তাহলে কোন আত্মীয়তা ও অঙ্গীকার রক্ষা করবে না। কোন কোন মুফাসসিরগণের নিকট প্রথম كَيف (বাক্য) মুশরিকদের এবং দ্বিতীয় كَيف (বাক্য) ইয়াহুদীদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে। কেননা, পরবর্তী আয়াতে গুণ বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে সামান্য মূল্যের বিনিময়ে বিক্রি করে। আর এই অভ্যাস ইয়াহুদীদেরই ছিল।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯:৯ اِشۡتَرَوۡا بِاٰیٰتِ اللّٰهِ ثَمَنًا قَلِیۡلًا فَصَدُّوۡا عَنۡ سَبِیۡلِهٖ ؕ اِنَّهُمۡ سَآءَ مَا كَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ ﴿۹﴾
اشتروا بایت الله ثمنا قلیلا فصدوا عن سبیلهٖ انهم سآء ما كانوا یعملون ﴿۹﴾

তারা আল্লাহর আয়াতসমূহের বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য খরিদ করে নিয়েছে। ফলত তারা তাঁর পথে বাধা দিয়েছে, নিশ্চয় তারা যে কাজ করত তা কতই না মন্দ! আল-বায়ান

আল্লাহর আয়াতকে তারা (দুনিয়াবী স্বার্থে) অতি তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করে দিয়েছে, আল্লাহর পথে (মানুষদের চলার ক্ষেত্রে) প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। তারা যা করে কতই না জঘন্য সে কাজ। তাইসিরুল

তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে নগণ্য মূল্যে বিক্রি করেছে এবং তারা আল্লাহর পথ থেকে (মু’মিনদেরকে) সরিয়ে রেখেছে। নিশ্চয়ই তাদের কাজ অতি মন্দ। মুজিবুর রহমান

They have exchanged the signs of Allah for a small price and averted [people] from His way. Indeed, it was evil that they were doing. Sahih International

৯. তারা আল্লাহর আয়াতকে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করে দিয়েছে ফলে তারা লোকদেরকে তাঁর পথ থেকে নিবৃত্ত করেছে; নিশ্চয় তারা যা করেছে তা অতি নিকৃষ্ট।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(৯) তারা আল্লাহর আয়াতকে নগণ্য মূল্যে বিক্রয় করে ও তারা লোকদেরকে তাঁর পথ হতে নিবৃত্ত করে। নিশ্চয় তারা যা করে থাকে, তা অতি জঘন্য।

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৯:১০ لَا یَرۡقُبُوۡنَ فِیۡ مُؤۡمِنٍ اِلًّا وَّ لَا ذِمَّۃً ؕ وَ اُولٰٓئِكَ هُمُ الۡمُعۡتَدُوۡنَ ﴿۱۰﴾
لا یرقبون فی مؤمن الا و لا ذمۃ و اولٓئك هم المعتدون ﴿۱۰﴾

তারা কোন মুমিনের ব্যাপারে আত্মীয়তা ও অঙ্গীকারের খেয়াল রাখে না। আর তারাই হল সীমালঙ্ঘনকারী। আল-বায়ান

কোন ঈমানদার ব্যক্তির ব্যাপারে তারা না কোন আত্মীয়তার মর্যাদা দেয়, আর না কোন ওয়াদা-অঙ্গীকারের। এরা হল সেই লোক যারা সীমালঙ্ঘনকারী। তাইসিরুল

তারা কোন মু’মিনের সাথে আত্মীয়তার মর্যাদা রক্ষা করেনা এবং না অঙ্গীকারের; আর তারাই সীমালংঘনকারী। মুজিবুর রহমান

They do not observe toward a believer any pact of kinship or covenant of protection. And it is they who are the transgressors. Sahih International

১০. তারা কোন মুমিনের সাথে আত্মীয়তার ও অঙ্গীকারের মর্যাদা রক্ষা করে না, আর তারাই সীমালংঘনকারী।(১)

(১) এ আয়াতে তাদের চরম হঠকারিতার বর্ণনা দিয়ে বলা হয় যে, এরা চুক্তিবদ্ধ মুসলিমদের সাথেই যে বিশ্বাসঘাতকতা ও আত্মীয়তার মর্যাদা ক্ষুন্ন করে তা নয় বরং তারা যে কোন মুসলিমের সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করবে, আত্মীয়তাকেও জলাঞ্জলি দেবে। সুতরাং যে কারণে তারা তোমাদের বিরোধিতা করছে তা হচ্ছে, ঈমান। সেটাই তাদের কাছে কঠোর হয়েছে। সুতরাং তোমরা তোমাদের দ্বীনের পক্ষ থেকে প্রতিরোধ কর। তোমাদের দ্বীনের শক্রদেরকে শক্র হিসেবেই গ্রহণ কর। [সা’দী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১০) তারা কোন বিশ্বাসীর সাথে আত্মীয়তা ও অঙ্গীকারের মর্যাদা রক্ষা করে না, তারাই সীমালংঘনকারী।[1]

[1] বারবার এ কথা পুনরুক্তির উদ্দেশ্য হল, মুশরিক ও ইয়াহুদীদের হৃদয়ে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ এবং অন্তরের গোপন শত্রুতার জ্বালাকে মুসলিমদের জন্য প্রকাশ করে দেওয়া।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১২৯ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 · · · 10 11 12 13 পরের পাতা »