بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
সূরাঃ ৫৭/ আল-হাদীদ | Al-Hadid | سورة الحديد আয়াতঃ ২৯ মাদানী
৫৭:১ سَبَّحَ لِلّٰهِ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۚ وَ هُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَكِیۡمُ ﴿۱﴾
سبح لله ما فی السموت و الارض و هو العزیز الحكیم ﴿۱﴾

আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করে। আর তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আল-বায়ান

আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর গৌরব ও মহিমা ঘোষণা করে, তিনি প্রবল পরাক্রান্ত, মহা প্রজ্ঞাবান। তাইসিরুল

আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। মুজিবুর রহমান

Whatever is in the heavens and earth exalts Allah, and He is the Exalted in Might, the Wise. Sahih International

১. আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে।(১) আর তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।(২)

(১) অর্থাৎ বিশ্ব-জাহানের প্রত্যেকটি বস্তু সদা সর্বদা এ সত্য প্রকাশ এবং ঘোষণা করে চলেছে যে, এ বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা ও পালনকর্তা সব রকম দোষ-ত্রুটি, অপূর্ণতা, দুর্বলতা, ভুল ভ্রান্তি ও অকল্যাণ থেকে পবিত্র। তাঁর ব্যক্তি সত্তা পবিত্র, তাঁর গুণাবলী পবিত্র, তাঁর কাজকর্ম পবিত্র এবং তাঁর সমস্ত সৃষ্টিমূলক বা শরীয়াতের বিধান সম্পর্কিত নির্দেশাবলীও পবিত্র। [কুরতুবী; সা’দী]

(২) আয়াতে وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ বলা হয়েছে। عَزِيز শব্দের অর্থ পরাক্রমশালী, শক্তিমান ও অপ্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী, যাঁর সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন পৃথিবীর কোন শক্তিই রোধ করতে পারে না, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যাঁর আনুগত্য সবাইকে করতে হয়, যাঁর অমান্যকারী কোনভাবেই তাঁর পাকড়াও থেকে রক্ষা পায় না। আর حَكِيم শব্দের অর্থ হচ্ছে, তিনি যা-ই করেন, জ্ঞান ও যুক্তি বুদ্ধির সাহায্যে করেন। তাঁর সৃষ্টি, তাঁর ব্যবস্থাপনা, তার শাসন, তার আদেশ নিষেধ, তার নির্দেশনা সব কিছুই জ্ঞান ও যুক্তি নির্ভর। তাঁর কোন কাজেই অজ্ঞতা, বোকামি ও মূর্খতার লেশমাত্র নেই। [দেখুন: ফাতহুল কাদীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১) আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে।[1] তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

[1] এই তসবীহ পাঠ ‘যবানে হাল’ (অবস্থার ভাষা) দ্বারা নয়, বরং ‘যবানে ক্বাল’ মুখের ভাষা দ্বারা। আর এই জন্যই বলা হয়েছে, {وَلَكِنْ لاَ تَفْقَهُوْنَ تَسْبِيْحَهُمْ} ‘‘তোমরা তাদের তসবীহ পাঠ অনুধাবন করতে পার না।’’ (বানী ইস্রাঈল ৪৪ আয়াত) দাউদ (আঃ) সম্পর্কে এসেছে যে, তাঁর সাথে পাহাড়ও তসবীহ পাঠ করত। (সূরা আম্বিয়া ৭৯ আয়াত) যদি এই তসবীহ পাঠ অবস্থাগত বা ভাবগত হত, তাহলে দাউদ (আঃ)-এর সাথে এটাকে নির্দিষ্ট করার কোন প্রয়োজনই ছিল না।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৫৭:২ لَهٗ مُلۡكُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۚ یُحۡیٖ وَ یُمِیۡتُ ۚ وَ هُوَ عَلٰی كُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿۲﴾
لهٗ ملك السموت و الارض یحیٖ و یمیت و هو علی كل شیء قدیر ﴿۲﴾

আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব তাঁরই। তিনিই জীবন দেন এবং তিনিই মৃত্যু দেন। আর তিনি সকল কিছুর উপর সর্বশক্তিমান। আল-বায়ান

আসমান ও যমীনের রাজত্ব তাঁরই, তিনিই জীবন দেন, আর তিনিই মৃত্যু দেন, তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। তাইসিরুল

আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব তাঁরই। তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান; তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। মুজিবুর রহমান

His is the dominion of the heavens and earth. He gives life and causes death, and He is over all things competent. Sahih International

২. আসমানসমূহ ও যমীনের সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁরই; তিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান; আর তিনিই সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(২) আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব তাঁরই;[1] তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান; তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।

[1] তাই তিনি যেভাবে চান এগুলোর মধ্যে কর্তৃত্ব চালান। তিনি ব্যতীত এগুলোতে অন্য কারো নির্দেশ ও কর্তৃত্ব চলে না। অথবা অর্থ হল, বৃষ্টি, উদ্ভিদ ও রুযীর সমস্ত ভান্ডার তাঁরই মালিকানাধীন।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৫৭:৩ هُوَ الۡاَوَّلُ وَ الۡاٰخِرُ وَ الظَّاهِرُ وَ الۡبَاطِنُ ۚ وَ هُوَ بِكُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ﴿۳﴾
هو الاول و الاخر و الظاهر و الباطن و هو بكل شیء علیم ﴿۳﴾

তিনিই প্রথম ও শেষ এবং প্রকাশ্য ও গোপন; আর তিনি সকল বিষয়ে সম্যক অবগত। আল-বায়ান

তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ, তিনি প্রকাশিত আবার গুপ্ত, তিনি সকল বিষয় পূর্ণরূপে জ্ঞাত। তাইসিরুল

তিনিই আদি, তিনিই অন্ত, তিনিই ব্যক্ত, তিনিই গুপ্ত এবং তিনি সর্ব বিষয়ে সম্যক অবহিত। মুজিবুর রহমান

He is the First and the Last, the Ascendant and the Intimate, and He is, of all things, Knowing. Sahih International

৩. তিনিই প্রথম ও শেষ; প্রকাশ্য (উপরে) ও গোপন (নিকটে) আর তিনি সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত।(১)

(১) ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ কোন সময় তোমার অন্তরে আল্লাহ তাআলা ও ইসলাম সম্পর্কে শয়তানী কুমন্ত্রণা দেখা দিলে (هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ) আয়াতখানি আস্তে পাঠ করে নাও। [আবু দাউদ: ৫১১০] এই আয়াতের তাফসীর এবং “আউয়াল”, “আখের”, “যাহের” ও “বাতেন” এ শব্দ চারটির অর্থ সম্পর্কে তফসীরবিদগণের বহু উক্তি বৰ্ণিত আছে। তন্মধ্যে “আউয়াল” শব্দের অর্থ তো প্ৰায় নির্দিষ্ট; অর্থাৎ অস্তিত্বের দিক দিয়ে সকল সৃষ্টজগতের অগ্রে ও আদি। কারণ, তিনি ব্যতীত সবকিছু তাঁরই সৃজিত। তাই তিনি সবার আদি। “আখের” এর অর্থ কারও কারও মতে এই যে, সবকিছু বিলীন হয়ে যাওয়ার পরও তিনি বিদ্যমান থাকবেন। [সা’দী] যেমন (كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ) [সূরা আল-কাসাস: ৮৮] আয়াতে এর পরিষ্কার উল্লেখ আছে।

ইমাম বুখারী বলেন, ‘যাহের’ অর্থ জ্ঞানে তিনি সবকিছুর উপর, অনুরূপ তিনি ‘বাতেন’ অৰ্থাৎ জ্ঞানে সবকিছুর নিকটে। বিভিন্ন হাদীসে এ আয়াতের তাফসীর এসেছে, এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘুমানোর সময় বলতেন, “হে আল্লাহ! সাত আসমানের রব, মহান আরশের রব, আমাদের রব এবং সবকিছুর রব, তাওরাত, ইঞ্জীল ও ফুরকান নাযিলকারী, দানা ও আঁটি চিরে বৃক্ষের উদ্ভাবকারী, আপনি ব্যতীত কোন হক্ক মা’বুদ নেই, যাদের কপাল আপনার নিয়ন্ত্রণে এমন প্ৰত্যেক বস্তুর অনিষ্ট হতে আমি আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি, আপনি অনাদি, আপনার আগে কিছু নেই, আপনি অনন্ত আপনার পরে কিছুই থাকবে না। আপনি সবকিছুর উপরে, আপনার উপরে কিছুই নেই, আপনি নিকটবর্তী, আপনার চেয়ে নিকটবর্তী কেউ নেই, আমার পক্ষ থেকে আপনি আমার ঋণ পরিশোধ করে দিন এবং আমাকে দারিদ্রতা থেকে মুক্তি দিন। [মুসলিম: ২৭১৩, মুসনাদে আহমাদ ২/৪০৪]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৩) তিনিই আদি, অন্ত, ব্যক্ত ও গুপ্ত[1] এবং তিনি সর্ববিষয়ে সম্যক অবহিত।

[1] তিনিই আদি বা প্রথম; তাঁর পূর্বে কিছু ছিল না। তিনিই অন্ত বা সর্বশেষ; তাঁরপর কিছু থাকবে না। তিনি ব্যক্ত বা প্রকাশমান। অর্থাৎ, তিনি সবার উপর জয়ী, তাঁর উপর কেউ জয়ী নয়। তিনি গুপ্ত বা অপ্রকাশমান। অর্থাৎ, যাবতীয় গোপন খবর একমাত্র তিনিই জানেন। অথবা তিনি মানুষের দৃষ্টি ও জ্ঞানের অন্তরালে। (ফাতহুল ক্বাদীর) নবী করীম (সাঃ) তাঁর কন্যা ফাতিমা (রাঃ) কে এই দু’আটি পাঠ করতে তাকীদ করেছিলেনঃ

اَللَّهُمَّ رَبَّ السَّمَوَاتِ السَّبْعِ وَرَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ، رَبَّنَا وَرَبَّ كُلِّ شَيْءٍ، مُنْزِلَ التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ وَالْفُرْقَانِ، فَالِقَ الْحَبِّ وَالنَّوَى، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ شَيْءٍ أَنْتَ آخِذٌ بِنَاصِيَتِهِ، أَنْتَ الْأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الْآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيْءٌ، اقْضِ عَنِّا الدَّيْنَ وَأَغْنِنِا مِنْ الْفَقْرِ

অর্থাৎ, হে আল্লাহ! হে আকাশ মন্ডলী, পৃথিবী ও মহা আরশের অধিপতি। হে আমাদের ও সকল বস্তুর  প্রতিপালক!  হে  শস্যবীজ  ও  আঁটির  অঙ্কুরোদয়কারী!  হে তাওরাত,  ইনজীল  ও  ফুরকানের অবতারণকারী! আমি তোমার নিকট প্রত্যেক অনিষ্টকারীর অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি- যার ললাটের কেশগুচ্ছ তুমি ধারণ করে আছ। হে আল্লাহ! তুমিই আদি তোমার পূর্বে কিছু নেই। তুমিই অন্ত তোমার পরে কিছু নেই। তুমিই ব্যক্ত (অপরাজেয়), তোমার ঊর্ধ্বে কিছু নেই এবং তুমিই (সৃষ্টির গোচরে) অব্যক্ত, তোমার নিকট অব্যক্ত কিছু নেই। আমাদের তরফ থেকে আমাদের ঋণ পরিশোধ করে দাও এবং আমাদেরকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিয়ে সচ্ছল (অভাবশূন্য) করে দাও। (মুসলিমঃ যিকর ও দু’আ অধ্যায়) ঋণ পরিশোধের জন্য পঠনীয় এই দু’আর মধ্যে ‘আওয়াল’, ‘আখির’ এবং ‘যাহির’ ও ‘বাতিন’এর ব্যাখ্যা করে দেওয়া হয়েছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৫৭:৪ هُوَ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ فِیۡ سِتَّۃِ اَیَّامٍ ثُمَّ اسۡتَوٰی عَلَی الۡعَرۡشِ ؕ یَعۡلَمُ مَا یَلِجُ فِی الۡاَرۡضِ وَ مَا یَخۡرُجُ مِنۡهَا وَ مَا یَنۡزِلُ مِنَ السَّمَآءِ وَ مَا یَعۡرُجُ فِیۡهَا ؕ وَ هُوَ مَعَكُمۡ اَیۡنَ مَا كُنۡتُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ ﴿۴﴾
هو الذی خلق السموت و الارض فی ستۃ ایام ثم استوی علی العرش یعلم ما یلج فی الارض و ما یخرج منها و ما ینزل من السمآء و ما یعرج فیها و هو معكم این ما كنتم و الله بما تعملون بصیر ﴿۴﴾

তিনিই আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি আরশে উঠেছেন। তিনি জানেন যমীনে যা কিছু প্রবেশ করে এবং তা থেকে যা কিছু বের হয়; আর আসমান থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয় এবং তাতে যা কিছু উত্থিত হয়। আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা। আল-বায়ান

তিনি আসমান ও যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন অতঃপর আরশে সমুন্নত হয়েছেন। তিনি জানেন যা যমীনে প্রবেশ করে, আর যা তাত্থেকে বের হয়, আর যা আকাশ থেকে অবতীর্ণ হয়, আর যা তাতে উঠে যায়, তোমরা যেখানেই থাক তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন, তোমরা যে কাজই কর না কেন, আল্লাহ তা দেখেন। তাইসিরুল

তিনিই ছয় দিনে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আরশে সমাসীন হয়েছেন। তিনি জানেন যা কিছু ভূমিতে প্রবেশ করে এবং যা কিছু তা হতে বের হয় এবং আকাশ হতে যা কিছু নামে ও আকাশে যা কিছু উত্থিত হয়। তোমরা যেখানেই থাক না কেন তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন, তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তা দেখেন। মুজিবুর রহমান

It is He who created the heavens and earth in six days and then established Himself above the Throne. He knows what penetrates into the earth and what emerges from it and what descends from the heaven and what ascends therein; and He is with you wherever you are. And Allah, of what you do, is Seeing. Sahih International

৪. তিনি ছয় দিনে আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন; তারপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন। তিনি জানেন যা কিছু যমীনে প্রবেশ করে এবং যা কিছু তা থেকে বের হয়, আর আসমান থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয় এবং তাতে যা কিছু উত্থিত হয়।(১) আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন—তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন, আর তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ্ তার সম্যক দ্রষ্টা।(২)

(১) অন্য কথায় তিনি শুধু সামগ্রিক জ্ঞানের অধিকারী নন, খুঁটি-নাটি বিষয়েও জ্ঞানের অধিকারী। এক একটি শস্যদানা ও বীজ যা মাটির গভীরে প্রবিষ্ট হয়, এক একটি ছোট পাতা ও অংকুর যা মাটি ফুড়ে বের হয়, বৃষ্টির এক একটি বিন্দু যা আসমান থেকে পতিত হয় এবং সমুদ্র ও খাল-বিল থেকে যে বাষ্পরাশি আকাশের দিকে উত্থিত হয়, তার প্রতিটি মাত্ৰা তার জানা আছে। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]

(২) অর্থাৎ তোমরা কোন জায়গায়ই তাঁর জ্ঞান, তাঁর অসীম ক্ষমতা, তাঁর শাসন কর্তৃত্ব এবং তাঁর ব্যবস্থাপনার আওতা বহির্ভূত নও। মাটিতে, বায়ুতে, পানিতে অথবা কোন নিভৃত কোণে যেখানেই তোমরা থাক না কেন সর্বাবস্থায়ই আল্লাহ জানেন তোমরা কোথায় আছো। [ইবন কাসীর] ইমাম আহমাদ রাহেমাহুল্লাহ বলেন, এ আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, ‘সম্যক দ্রষ্টা’ যা প্রমাণ করছে যে, আল্লাহ সৃষ্টিজগতের বাইরে থেকেও সবকিছু দেখছেন। তাই এখানে সঙ্গে থাকার অর্থ, সৃষ্টির সাথে লেগে থাকার অর্থ নয়, বরং এর অর্থ হচ্ছে, তোমরা তাঁর দৃষ্টি ও শক্তির অধীন। তাঁর দৃষ্টি ও শক্তি তোমাদের সঙ্গে আছে। [দেখুন: আর-রাদ্দু আলাল জাহমিয়্যাহ ওয়ায যানাদিকাহ: ১৫৪–১৫৮]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৪) তিনিই ছয় দিনে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আরশে সমাসীন হয়েছেন।[1] তিনি জানেন যা কিছু ভূমিতে প্রবেশ করে[2] ও যা কিছু তা হতে বের হয়[3] এবং আকাশ হতে যা কিছু নামে[4] ও আকাশে যা কিছু উত্থিত হয়।[5] তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন,[6] তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ তা দেখেন।

[1] এই অর্থেরই কিছু আয়াত সূরা আ’রাফ ৫৪, সূরা ইউনুস ৩ এবং সূরা আলিফ লা-ম মীম সাজদাহ ৪ প্রভৃতি স্থানে রয়েছে। সেগুলোর টীকা দ্রষ্টব্য।

[2] অর্থাৎ, যমীনে বৃষ্টির যে ফোঁটাগুলো এবং শস্য ও ফল-মূলের যে বীজগুলো প্রবেশ করে, তার পরিমাণ-মাত্রা এবং ধরণ-গঠন তিনিই জানেন।

[3] যে গাছ-পালা, চাহে তা ফলের হোক বা শস্যাদির হোক কিংবা সৌন্দর্য ও সাজের গাছ বা সুগন্ধ ফুলের গাছ হোক, এগুলো যত পারিমাণে ও যেভাবে বের হয়ে আসে, সব কিছুই আল্লাহর জ্ঞানে থাকে। যেমন, অন্যত্র বলেছেন,

{وَعِندَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لاَ يَعْلَمُهَا إِلاَّ هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلاَّ يَعْلَمُهَا وَلاَ حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الأَرْضِ وَلاَ رَطْبٍ وَلاَ يَابِسٍ إِلاَّ فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ}

অর্থাৎ, তাঁরই নিকট অদৃশ্যের চাবি রয়েছে; তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা জানে না। জলে-স্থলে যা কিছু আছে তা তিনিই অবগত। তাঁর অজ্ঞাতসারে (বৃক্ষের) একটি পাতাও পড়ে না, মৃত্তিকার অন্ধকারে এমন কোন শস্যকণা অথবা রসযুক্ত কিম্বা শুষ্ক এমন কোন বস্তু পড়ে না, যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই। (সূরা আনআমঃ ৫৯)

[4] বজ্র, বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, বরফ, বরকত, ভাগ্য এবং সেই সব বিধানাবলী, যা ফিরিশতাগণ নিয়ে অবতরণ করেন।

[5] অর্থাৎ, ফিরিশতাগণ মানুষের যে আমল নিয়ে ওপরে ওঠেন। যেমন হাদীসে আছে যে, ‘‘রাতের আমল দিনের পূর্বে এবং দিনের আমল রাতের পূর্বে আল্লাহর নিকট উঠে যায়।’’

(মুসলিম, কিতাবুল ঈমান)

[6] অর্থাৎ, তোমরা স্থলে থাক বা জলে, রাত হোক অথবা দিন, গৃহে থাক অথবা মরুভূমিতে, প্রত্যেক স্থানে সদা-সর্বদা তিনি তাঁর জ্ঞান ও দর্শন দ্বারা তোমাদের সঙ্গে থাকেন। অর্থাৎ, তোমাদের প্রতিটি কাজকে তিনি দেখেন। তোমাদের প্রতিটি কথা তিনি জানেন ও শোনেন। এ­ই বিষয়টা সূরা হূদের ৫নং এবং সূরা রা’দের ১০নং আয়াত সহ অন্যান্য আয়াতেও বর্ণনা করা হয়েছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৫৭:৫ لَهٗ مُلۡكُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ وَ اِلَی اللّٰهِ تُرۡجَعُ الۡاُمُوۡرُ ﴿۵﴾
لهٗ ملك السموت و الارض و الی الله ترجع الامور ﴿۵﴾

আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব তাঁরই এবং আল্লাহরই দিকে সকল বিষয় প্রত্যাবর্তিত হবে। আল-বায়ান

আসমান ও যমীনের রাজত্ব তাঁরই, যাবতীয় বিষয় তাঁরই দিকে ফিরে যায় (চূড়ান্ত ফয়সালার জন্য)। তাইসিরুল

আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব তাঁরই, এবং আল্লাহরই দিকে সব বিষয় প্রত্যাবর্তিত হবে। মুজিবুর রহমান

His is the dominion of the heavens and earth. And to Allah are returned [all] matters. Sahih International

৫. আসমানসমূহ ও যমীনের সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁরই এবং আল্লাহরই দিকে সব বিষয় প্রত্যাবর্তিত হবে।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(৫) আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব তাঁরই, আর আল্লাহরই দিকে সব বিষয় প্রত্যাবর্তিত হবে।

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৫৭:৬ یُوۡلِجُ الَّیۡلَ فِی النَّهَارِ وَ یُوۡلِجُ النَّهَارَ فِی الَّیۡلِ ؕ وَ هُوَ عَلِیۡمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوۡرِ ﴿۶﴾
یولج الیل فی النهار و یولج النهار فی الیل و هو علیم بذات الصدور ﴿۶﴾

তিনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান। আর তিনি অন্তরসমূহের বিষয়াদি সম্পর্কে সম্যক অবগত। আল-বায়ান

তিনিই রাতকে প্রবেশ করান দিনের ভিতর, আর দিনকে ঢুকিয়ে দেন রাতের ভিতর, অন্তরের গোপনতত্ত্ব সম্পর্কে তিনি পূর্ণরূপে অবগত। তাইসিরুল

তিনিই রাতকে প্রবেশ করান দিনে এবং দিনকে প্রবেশ করান রাতে, এবং তিনি অর্ন্তযামী। মুজিবুর রহমান

He causes the night to enter the day and causes the day to enter the night, and he is Knowing of that within the breasts. Sahih International

৬. তিনিই রাতকে প্রবেশ করান দিনে আর দিনকে প্ৰবেশ করান রাতে এবং তিনি অন্তরের বিষয়াদি সম্পর্কে সম্যক অবগত।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(৬) তিনিই রাত্রিকে প্রবেশ করান দিনে এবং দিনকে প্রবেশ করান রাত্রিতে।[1] আর তিনি অন্তর্যামী।

[1] অর্থাৎ, সমস্ত জিনিসের মালিক তিনিই। তিনি যেভাবে চান তাতে কর্তৃত্ব করেন। তাঁর নির্দেশে কখনো রাত বড় ও দিন ছোট হয়। আবার কখনো এর বিপরীত দিন বড় ও রাত ছোট হয়। কখনো রাত ও দিন সমান সমান হয়। অনুরূপ কখনো শীত, কখনো গ্রীষ্ম, কখনো বসন্ত ও কখনো হেমন্তকাল, নানা অবস্থার রূপান্তর ও ঋতুর পরিবর্তনও তাঁর নির্দেশ ও ইচ্ছায় ঘটে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৫৭:৭ اٰمِنُوۡا بِاللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهٖ وَ اَنۡفِقُوۡا مِمَّا جَعَلَكُمۡ مُّسۡتَخۡلَفِیۡنَ فِیۡهِ ؕ فَالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مِنۡكُمۡ وَ اَنۡفَقُوۡا لَهُمۡ اَجۡرٌ كَبِیۡرٌ ﴿۷﴾
امنوا بالله و رسولهٖ و انفقوا مما جعلكم مستخلفین فیه فالذین امنوا منكم و انفقوا لهم اجر كبیر ﴿۷﴾

তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং তিনি তোমাদেরকে যা কিছুর উত্তরাধিকারী করেছেন, তা থেকে ব্যয় কর। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে তাদের জন্য রয়েছে বিরাট প্রতিফল। আল-বায়ান

তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনো, আর তিনি তোমাদেরকে যার উত্তরাধিকারী করেছেন তাত্থেকে (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর । কারণ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে আর ব্যয় করে, তাদের জন্য আছে বিরাট প্রতিফল। তাইসিরুল

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যা কিছুর উত্তরাধিকারী করেছেন তা হতে ব্যয় কর। তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও ব্যয় করে তাদের জন্য আছে মহা পুরস্কার। মুজিবুর রহমান

Believe in Allah and His Messenger and spend out of that in which He has made you successors. For those who have believed among you and spent, there will be a great reward. Sahih International

৭. তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যা কিছুর উত্তরাধিকারী করেছেন তা হতে ব্যয় কর। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও ব্যয় করে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(৭) আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যা কিছুর উত্তরাধিকারী[1] করেছেন তা হতে ব্যয় কর। তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস করে ও ব্যয় করে, তাদের জন্য আছে মহাপুরস্কার।

[1] অর্থাৎ, এই ধন এর পূর্বে অন্য কারো নিকটে ছিল। এতে এ কথার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে, এ ধন তোমার নিকটেও থাকবে না। অপর কেউ এর উত্তরাধিকারী হবে। তোমরা যদি এ মালগুলো আল্লাহর পথে ব্যয় না কর, তবে পরে যারা এগুলোর মালিক হবে, তারা আল্লাহর পথে সেগুলো ব্যয় করে তোমাদের চাইতেও বেশী সৌভাগ্য লাভ করতে পারবে। আর তারা যদি এগুলোকে আল্লাহর অবাধ্যতার পথে ব্যয় করে, তবে তোমরাও অসৎকার্যে সাহায্য করার অপরাধে ধরা খেতে পার। (ইবনে কাসীর) হাদীসে এসেছে যে, ‘‘মানুষ বলে আমার মাল, আমার মাল। অথচ তোমার মাল প্রথমতঃ সেটা, যেটা তুমি খেয়ে শেষ করেছ। দ্বিতীয়তঃ সেটা, যেটা তুমি পরিধান করে নষ্ট করেছ এবং তৃতীয়তঃ সেটা, যেটা তুমি আল্লাহর পথে ব্যয় করে পরকালের জন্য সঞ্চয় করেছ। এ ছাড়া যা কিছু থাকবে, তা সবই অন্যদের ভাগে আসবে।’’ (মুসলিমঃ যুহুদ অধ্যায়, মুসনাদ আহমাদ ৪/২৪)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৫৭:৮ وَ مَا لَكُمۡ لَا تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ ۚ وَ الرَّسُوۡلُ یَدۡعُوۡكُمۡ لِتُؤۡمِنُوۡا بِرَبِّكُمۡ وَ قَدۡ اَخَذَ مِیۡثَاقَكُمۡ اِنۡ كُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ﴿۸﴾
و ما لكم لا تؤمنون بالله و الرسول یدعوكم لتؤمنوا بربكم و قد اخذ میثاقكم ان كنتم مؤمنین ﴿۸﴾

আর তোমাদের কী হলো যে, তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনছ না? অথচ রাসূল তোমাদেরকে তোমাদের রবের প্রতি ঈমান আনতে আহবান করছে। আর তিনি তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন, যদি তোমরা মুমিন হও। আল-বায়ান

তোমাদের কী হল যে, তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে না যখন রসূল তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিপালকের উপর ঈমান আনার জন্য ডাকছে আর তিনি তোমাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন, যদি তোমরা বিশ্বাসী হয়েই থাক। তাইসিরুল

তোমাদের কি হল যে, তোমরা আল্লাহতে ঈমান আনছনা? অথচ রাসূল তোমাদেরকে তোমাদের রবের প্রতি আহবান করছে এবং আল্লাহ তোমাদের নিকট হতে অংগীকার গ্রহণ করেছেন, অবশ্য তোমরা যদি তাতে বিশ্বাসী হও। মুজিবুর রহমান

And why do you not believe in Allah while the Messenger invites you to believe in your Lord and He has taken your covenant, if you should [truly] be believers? Sahih International

৮. আর তোমাদের কি হল যে, তোমরা আল্লাহর উপর ঈমান আন না? অথচ রাসূল তোমাদেরকে তোমাদের রবের প্রতি ঈমান আনার জন্য ডাকছেন অথচ আল্লাহ তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন(১), যদি তোমরা ঈমানদার হও।(২)

(১) কিছু সংখ্যক মুফাস্‌সির এ প্রতিশ্রুতি বলতে অর্থ করেছেন আল্লাহর দাসত্ব করার সে প্রতিশ্রুতি যা সৃষ্টির সূচনা পর্বে আদম আলাইহিস সালামের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাঁর সমস্ত সন্তানকে বের করে তাদের সবার নিকট থেকে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু অপর কিছু সংখ্যক তাফসীরকারক এর অর্থ করেছেন ‘সে প্রতিশ্রুতি যা প্রত্যেক মানুষের প্রকৃতি ও প্রকৃতিগত বিবেক-বুদ্ধিতে আল্লাহর দাসত্বের জন্য বর্তমান। [কুরতুবী] কিন্তু সঠিক কথা হলো, এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের সচেতন প্রতিশ্রুতি, ঈমান গ্ৰহণ করার মাধ্যমে প্রত্যেক মুসলিম আল্লাহর সাথে যে প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হয়। কুরআন মজীদের অন্য এক স্থানে যে ভাষায় এ প্রতিশ্রুতির উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে, “আল্লাহ তোমাদের যেসব নিয়ামত দান করেছেন সেসব নিয়ামতের কথা মনে কর এবং তোমাদের কাছ থেকে যে প্রতিশ্রুতি গ্ৰহণ করেছেন তার কথাও মনে কর। সে সময় তোমরা বলেছিলে, আমরা শুনলাম এবং আনুগত্য করলাম। আর আল্লাহকে ভয় কর আল্লাহ মনের কথাও জানেন।” [সূরা আল-মায়েদাহ: ৭]

উবাদা ইবনে সামেত থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের থেকে এই মর্মে বাইয়াত গ্ৰহণ করেছিলেন যে, আমরা যেন সক্রিয়তা ও নিস্ক্রিয়তা উভয় অবস্থায় শুনি ও আনুগত্য করে যাই এবং স্বচ্ছলতা ও অস্বচ্ছলতা উভয় অবস্থায় আল্লাহর পথে খরচ করি, ভাল কাজের আদেশ করি এবং মন্দ কাজে নিষেধ করি, আল্লাহ সম্পর্কে সত্য কথা বলি এবং সেজন্য কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারকে ভয় না করি।” [মুসলিম: ১৭০৯, মুসনাদে আহমদ: ৫/৩১৬]।

(২) অর্থাৎ যদি তোমরা মুমিন হও। এখানে প্রশ্ন হয় যে, এ কথাটি সেই কাফেরদেরকে বলা হয়েছে, যাদেরকে মুমিন না হওয়ার কারণে ইতিপূর্বে (وَمَا لَكُمْ لَا تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ) বলে সতর্ক করা হয়েছে। এমতাবস্থায় ‘তাদেরকে তোমরা যদি মুমিন হও’ বলা কিরূপে সঙ্গত হতে পারে? জওয়াব এই যে, কাফের ও মুশরিকরাও আল্লাহর প্রতি ঈমানের দাবি করত। প্রতিমাদের ব্যাপারে তাদের বক্তব্য ছিল এই যে, (مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَىٰ) “তাদের ইবাদত তো আমরা কেবল এজন্যই করি যে, এরা আমাদেরকে সুপারিশ করে আল্লাহর নৈকট্যের অধিকারী করে দিবে”। [সূরা আয-যুমার: ৩] অতএব, আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহর প্রতি ঈমানের দাবি যদি সত্য হয়, তবে তার বিশুদ্ধ ও ধর্তব্য পথ অবলম্বন কর। [দেখুন: আত-তাহরীর ওয়াত তানভীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৮) তোমাদের কি হল যে, তোমরা আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন কর না? অথচ রসূল তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে আহবান করছে এবং তিনি (আল্লাহ) তোমাদের নিকট হতে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন; তোমরা যদি বিশ্বাসী হও।[1]

[1] ইবনে কাসীর (রঃ) أخذ ক্রিয়ার ‘ফা-য়েল’ (কর্তৃপদ বা তিনি বলতে) রসূলকে বুঝিয়েছেন এবং অর্থ নিয়েছেন, সেই বায়আত বা অঙ্গীকার, যা রসূল (সাঃ) সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-দের নিকট থেকে নিতেন। আর তা হল, সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় তাঁর কথা শুনতে ও মানতে হবে। ইমাম ইবনে জারীরের নিকট এর ‘ফা-য়েল’ হল আল্লাহ। অর্থ হল, সেই অঙ্গীকার, যা মহান আল্লাহ সকল মানুষের কাছ থেকে তখন নিয়েছিলেন, যখন তাদেরকে আদম (আঃ)-এর পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করেছিলেন। যেটাকে عهد أَلَسْتُ বলা হয়; যার আলোচনা সূরা আ’রাফের ১৭২নং আয়াতে রয়েছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৫৭:৯ هُوَ الَّذِیۡ یُنَزِّلُ عَلٰی عَبۡدِهٖۤ اٰیٰتٍۭ بَیِّنٰتٍ لِّیُخۡرِجَكُمۡ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوۡرِ ؕ وَ اِنَّ اللّٰهَ بِكُمۡ لَرَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۹﴾
هو الذی ینزل علی عبدهٖ ایت بینت لیخرجكم من الظلمت الی النور و ان الله بكم لرءوف رحیم ﴿۹﴾

তিনিই তাঁর বান্দার প্রতি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ নাযিল করেন, যাতে তিনি তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনতে পারেন। আর নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু, পরম করুণাময়। আল-বায়ান

তিনিই তাঁর বান্দাহর উপর সুস্পষ্ট আয়াত অবতীর্ণ করেন তোমাদেরকে ঘোর অন্ধকার থেকে আলোতে আনার জন্য, আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের প্রতি বড়ই করুণাশীল, অতি দয়ালু। তাইসিরুল

তিনিই তাঁর বান্দার প্রতি সুস্পষ্ট আয়াত অবতীর্ণ করেন, তোমাদেরকে অন্ধকার হতে আলোতে নিয়ে আসার জন্য; আল্লাহতো তোমাদের প্রতি করুণাময়, পরম দয়ালু। মুজিবুর রহমান

It is He who sends down upon His Servant [Muhammad] verses of clear evidence that He may bring you out from darknesses into the light. And indeed, Allah is to you Kind and Merciful. Sahih International

৯. তিনিই তাঁর বান্দার প্রতি সুস্পষ্ট আয়াত নাযিল করেন, তোমাদেরকে অন্ধকার হতে আলোতে আনার জন্য। আর নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি করুণাময়, পরম দয়ালু।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(৯) তিনিই তাঁর বান্দাদের প্রতি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ অবতীর্ণ করেন, তোমাদেরকে সমস্ত প্রকার অন্ধকার হতে আলোকে আনার জন্য। আর নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি করুণাময়; পরম দয়ালু।

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৫৭:১০ وَ مَا لَكُمۡ اَلَّا تُنۡفِقُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ وَ لِلّٰهِ مِیۡرَاثُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ لَا یَسۡتَوِیۡ مِنۡكُمۡ مَّنۡ اَنۡفَقَ مِنۡ قَبۡلِ الۡفَتۡحِ وَ قٰتَلَ ؕ اُولٰٓئِكَ اَعۡظَمُ دَرَجَۃً مِّنَ الَّذِیۡنَ اَنۡفَقُوۡا مِنۡۢ بَعۡدُ وَ قٰتَلُوۡا ؕ وَ كُلًّا وَّعَدَ اللّٰهُ الۡحُسۡنٰی ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرٌ ﴿۱۰﴾
و ما لكم الا تنفقوا فی سبیل الله و لله میراث السموت و الارض لا یستوی منكم من انفق من قبل الفتح و قتل اولٓئك اعظم درجۃ من الذین انفقوا من بعد و قتلوا و كلا وعد الله الحسنی و الله بما تعملون خبیر ﴿۱۰﴾

তোমাদের কী হলো যে, তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করছ না ? অথচ আসমানসমূহ ও যমীনের উত্তরাধিকারতো আল্লাহরই? তোমাদের মধ্যে যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে এবং যুদ্ধ করেছে তারা সমান নয়। তারা মর্যাদায় তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, যারা পরে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে। তবে আল্লাহ প্রত্যেকের জন্যই কল্যাণের ওয়াদা করেছেন। আর তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে আল্লাহ সবিশেষ অবগত। আল-বায়ান

তোমাদের হল কী যে তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করবে না! আকাশ ও পৃথিবীর উত্তরাধিকার তো আল্লাহরই জন্য (কাজেই তাঁর পথে ব্যয় করলে তোমরা গরীব হয়ে যাবে এ আশঙ্কার কোন কারণ নেই)। তোমাদের মধ্যে যারা (মক্কা) বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে আর যুদ্ধ করেছে তারা সমান নয় (তাদের, যারা তা বিজয়ের পরে করেছে); তাদের মর্যাদা অনেক বড় তাদের তুলনায় যারা পরে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে। উভয়ের জন্যই আল্লাহ কল্যাণের ও‘য়াদা দিয়েছেন। তোমরা যা কিছু কর সে সম্পর্কে আল্লাহ পূর্ণভাবে অবগত। তাইসিরুল

তোমরা আল্লাহর পথে কেন ব্যয় করবেনা? আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মালিকানাতো আল্লাহরই। তোমাদের মধ্যে যারা মাক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে এবং সংগ্রাম করেছে তারা এবং পরবর্তীরা সমান নয়; তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ তাদের অপেক্ষা যারা পরবর্তীকালে ব্যয় করেছে ও সংগ্রাম করেছে। তবে আল্লাহ উভয়ের কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তোমরা যা কর আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত। মুজিবুর রহমান

And why do you not spend in the cause of Allah while to Allah belongs the heritage of the heavens and the earth? Not equal among you are those who spent before the conquest [of Makkah] and fought [and those who did so after it]. Those are greater in degree than they who spent afterwards and fought. But to all Allah has promised the best [reward]. And Allah, with what you do, is Acquainted. Sahih International

১০. আর তোমাদের কি হলো যে, তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করছ না? অথচ আসমানসমূহ ও যমীনের মীরাস(১) তো আল্লাহরই। তোমাদের মধ্যে যারা বিজয়ের আগে ব্যয় করেছে(২) ও যুদ্ধ করেছে, তারা (এবং পরবর্তীরা) সমান নয়।(৩) তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ তাদের চেয়ে যারা পরবর্তী কালে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে। তবে আল্লাহ্‌ উভয়ের জন্যই কল্যাণের প্ৰতিশ্রুতি দিয়েছেন।(৪) আর তোমরা যা করা আল্লাহ্ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত।

(১) ميراث অভিধানে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মালিকানাকে বলা হয়ে থাকে। এই মালিকানা বাধ্যতামূলক মৃত ব্যক্তি ইচ্ছা করুক বা না করুক, ওয়ারিশ ব্যক্তি আপনাআপনি মালিক হয়ে যায়। এখানে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের উপর আল্লাহ তা'আলার সার্বভৌম মালিকানাকে ميراث শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করার রহস্য এই যে, তোমরা ইচ্ছা কর বা না কর, তোমরা আজ যে যে জিনিসের মালিক বলে গণ্য হও, সেগুলো অবশেষে আল্লাহ তা'আলার বিশেষ মালিকানায় চলে যাবে। [সা’দী, কুরতুবী]

এক হাদীসে এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, একদিন আমরা একটি ছাগল যাবাই করে তার অধিকাংশ গোশত বন্টন করে দিলাম, শুধু একটি হাত নিজেদের জন্যে রাখলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ বন্টনের পর এই ছাগলের গোশত কতটুকু রয়ে গেছে? আমি আরয করলামঃ শুধু একটি হাত রয়ে গেছে। তিনি বললেনঃ গোটা ছাগলই রয়ে গেছে। তোমার ধারণা অনুযায়ী কেবল হাতই রয়ে যায়নি। [তিরমিযী: ২৪৭০]

কেননা, গোটা ছাগলই আল্লাহর পথে ব্যয় হয়েছে। এটা আল্লাহর কাছে তোমার জন্যে থেকে যাবে। যে হাতটি নিজের খাওয়ার জন্যে রেখেছ, আখেরাতে এর কোন প্রতিদান পাবে না। কেননা, এটা এখানেই বিলীন হয়ে যাবে। আয়াতের আরেকটি অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর পথে অর্থ খরচ করতে গিয়ে তোমাদের কোন রকম দারিদ্র বা অস্বচ্ছলতার আশংকা করা উচিত নয়। কেননা, যে আল্লাহর উদ্দেশ্যে তা খরচ করবে তিনি যমীন ও ঊর্ধ্ব জগতের সমস্ত ভাণ্ডারের মালিক। আজ তিনি তোমাদেরকে যা দান করে রেখেছেন তার কাছে দেয়ার শুধু ঐ টুকুই ছিল না। কাল তিনি তোমাদেরকে তার চেয়েও অনেক বেশী দিতে পারেন। [ইবন কাসীর]

একথাটাই অন্য একটি স্থানে এভাবে বলা হয়েছে, “হে নবী, তাদের বলুন, আমার রব তার বান্দাদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা অঢেল রিযিক দান করেন এবং যার জন্য ইচ্ছা তা সংকীর্ণ করে দেন। আর তোমরা যা খরচ কর তার পরিবর্তে তিনিই তোমাদেরকে আরও রিযিক দান করেন। তিনি সর্বোত্তম রিযিক দাতা।” [সূরা সাবা: ৩৯]

(২) অধিকাংশ মুফাস্‌সিরের মতে, এখানে মক্কা বিজয় উদ্দেশ্য। [তাবারী; ইবন কাসীর; জালালাইন; মুয়াসসার] তবে কারও কারও মতে, এর দ্বারা হুদায়বিয়ার যুদ্ধ বোঝানো হয়েছে। [সা’দী]

(৩) আল্লাহর পথে ব্যয় করার প্রতি জোর দেয়ার পর পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর পথে যা কিছু যে কোন সময় ব্যয় করলে সওয়াব পাওয়া যাবে; কিন্তু ঈমান, আন্তরিকতা ও অগ্ৰগামিতার পার্থক্যবশত সওয়াবেও পার্থক্য হবে। বলা হয়েছেঃ (لَا يَسْتَوِي مِنْكُمْ مَنْ أَنْفَقَ مِنْ قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ) অর্থাৎ যারা আল্লাহর পথে ধনসম্পদ ব্যয় করে তারা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। (এক) যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে বিশ্বাস স্থাপন করত আল্লাহর পথে ব্যয় করেছে। (দুই) যারা মক্কা বিজয়ের পর মুমিন হয়ে আল্লাহর পথে ব্যয় করেছে।

এই দুই শ্রেণীর লোক আল্লাহর কাছে সমান নয়; বরং মর্যাদায় একশ্রেণী অপর শ্রেণী থেকে শ্রেষ্ঠ। মক্কা বিজয়ের পূর্বে বিশ্বাস স্থাপনকারী, জেহাদকারী ও ব্যয়কারীর মর্যাদা অপর শ্রেণী অপেক্ষা বেশী। কারণ, অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে তারা আল্লাহ তা'আলার জন্য এমন সব বিপদাপদের সম্মুখীন হয়েছিলো যার সম্মুখীন অন্য গোষ্ঠীকে হতে হয়নি। মুফাসসিরদের মধ্যে মুজাহিদ, কাতাদা এবং যায়েদ ইবনে আসলাম বলেনঃ এ আয়াতে বিজয় শব্দটি যে ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে সেটি হচ্ছে মক্কা বিজয়। আমের শা'বী বলেনঃ এর দ্বারা হুদায়বিয়ার সন্ধিকে বুঝানো হয়েছে। অধিকাংশ মুফাসসির প্রথম মতটি গ্রহণ করেছেন। [কুরতুবী; ইবন কাসীর]

(৪) অর্থাৎ পারস্পরিক তারতম্য সত্বেও আল্লাহ তা'আলা কল্যাণ অর্থাৎ জান্নাত ও মাগফিরাতের ওয়াদা সবার জন্যেই করেছেন। এই ওয়াদা সাহাবায়ে-কেরামের সেই শ্রেণীদ্বয়ের জন্যে, যারা মক্কাবিজয়ের পূর্বে ও পরে আল্লাহর পথে ব্যয় করেছেন এবং ইসলামের শক্ৰদের মোকাবিলা করেছেন। এতে সাহাবায়ে-কেরামের প্রায় সমগ্র দলই শামিল আছে। তাই মাগফিরাত ও রহমতের এই কুরআনী ঘোষণা প্রত্যেক সাহাবীকে শামিল করেছে। [সা'দী] শুধু মাগফিরাতই নয়; (رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ) [সূরা আত-তাওবাহঃ ১০০] বলে তাঁর সন্তুষ্টিরও নিশ্চিত আশ্বাস দান করেছেন।

তাফসীরে জাকারিয়া

(১০) তোমরা আল্লাহর পথে কেন ব্যয় করবে না? অথচ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মালিকানা তো আল্লাহরই। তোমাদের মধ্যে যারা (মক্কা) বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও সংগ্রাম করেছে (তারা এবং পরবর্তীরা) সমান নয়।[1] তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ তাদের অপেক্ষা, যারা পরবর্তীকালে ব্যয় করেছে ও সংগ্রাম করেছে।[2] তবে আল্লাহ সকলকেই কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। [3] আর তোমরা যা কর, আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত।

[1] فَتْحٌ (বিজয়) থেকে অধিকাংশ মুফাসসির বুঝিয়েছেন মক্কা বিজয়। কারো কারো মতে হুদাইবিয়ার সন্ধিই যেহেতু সুস্পষ্ট বিজয়, তাই এ থেকে হুদাইবিয়ার সন্ধি বুঝিয়েছেন। যাই হোক হুদাইবিয়ার সন্ধি বা মক্কা বিজয়ের পূর্বকালে মুসলিমরা সংখ্যা ও ক্ষমতার দিক থেকেও কম ছিলেন এবং মুসলিমদের আর্থিক অবস্থাও অনেক দুর্বল ছিল। এই প্রতিকূল অবস্থায় আল্লাহর পথে ব্যয় করা ও জিহাদে অংশ গ্রহণ করা উভয় কাজই ছিল অতীব কঠিন এবং বড়ই দুঃসাধ্য। কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে যায়। মুসলিমদের শক্তি ও সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তাঁদের আর্থিক অবস্থাও আগের তুলনায় অনেক ভাল হয়ে যায়। তাই আল্লাহ এই আয়াতে উভয় কালের মুসলিমদের সম্পর্কে বললেন যে, এরা পুণ্যে সমান হতে পারে না।

[2] কেননা, পূর্বের লোকদের ব্যয় ও যুদ্ধ দু’টোই অতীব কঠিন অবস্থায় হয়েছে। এ থেকে বুঝা গেল যে, মর্যাদাসম্পন্ন ও কৃতী লোকদেরকে অন্যদের তুলনায় অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এই জন্যই আহলে সুন্নাহর নিকট সম্মান ও মর্যাদায় আবু বাকার (রাঃ) সবার ঊর্ধ্বে। কেননা, প্রথম মু’মিন তিনিই, প্রথম আল্লাহর পথে ব্যয়কারীও তিনিই এবং প্রথম মুজাহিদও তিনিই। আর এই জন্য রসূল (সাঃ) স্বীয় জীবদ্দশায় ও উপস্থিতিতে সিদ্দীকে আকবার (রাঃ) কে নামাযের জন্য আগে বাড়ান এবং এরই ভিত্তিতে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) তাঁকে প্রথম খলীফা হওয়ার যোগ্যরূপে প্রাধান্য দেন। رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ।

[3] এতে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে যে, সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-দের মধ্যে মান-মর্যাদায় পার্থক্য তো অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু মান-মর্যাদায় পার্থ্যকের অর্থ এই নয় যে, পরে ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) ঈমান ও চারিত্রিক দিক থেকে একেবারে নিম্নস্তরের ছিলেন। যেমন, অনেকে মুআবিয়া (রাঃ) ও তাঁর পিতা আবূ সুফিয়ান (রাঃ) এবং আরো অনেক মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবাদের ব্যাপারে আজে-বাজে কথা বলে অথবা তাঁদেরকে (মক্কাবিজয়ের দিন ঘোষিত) ‘মুক্ত’ মানুষ বলে তাঁদেরকে হেয় প্রতিপন্ন ও তুচ্ছজ্ঞান করে থাকে। নবী করীম (সাঃ) সমস্ত সাহাবা (রাঃ) সম্পর্কে বলেছেন যে, (لاَ تَسُبُّوْا أَصْحَابِيْ) ‘‘তোমরা আমার সাহাবাদের গালি দিও না। সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে! তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহর পথে উহুদ পাহাড় সমপরিমাণ সোনা ব্যয় করে, তবুও তা আমার সাহাবাদের ব্যয়কৃত এক ‘মুদ্দ্’ (প্রায় ৬২৫ গ্রাম) বরং অর্ধ ‘মুদ্দ্’ এর সমানও হবে না।’’ (বুখারী, মুসলিমঃ সাহাবাদের ফযীলত অধ্যায়)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২৯ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 পরের পাতা »