রাসূল, রিসালাত ও ওহী বিষয়ক আয়াতসমূহ ২৪৮ টি
আল-বাকারা
২:২ ذٰلِکَ الۡکِتٰبُ لَا رَیۡبَ ۚۖۛ فِیۡهِ ۚۛ هُدًی لِّلۡمُتَّقِیۡنَ ۙ﴿۲﴾

এই সেই কিতাব, যাতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াত। আল-বায়ান

এটা ঐ (মহান) কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তাকীদের জন্য পথ নির্দেশ। তাইসিরুল

ইহা ঐ গ্রন্থ যার মধ্যে কোন সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ নেই; ধর্ম-ভীরুদের জন্য এ গ্রন্থ পথনির্দেশ। মুজিবুর রহমান

This is the Book about which there is no doubt, a guidance for those conscious of Allah - Sahih International

২. এটা(১) সে কিতাব; যাতে কোন সন্দেহ নেই(২), মুত্তাকীদের জন্য(৩) হেদায়াত,

১. ذَٰلِكَ শব্দের অর্থ- ঐটা, সাধারণতঃ কোন দূরবতী বস্তুকে ইশারা করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এখানে ذَٰلِكَ দ্বারা কি উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে এ ব্যাপারে আলেমগণ থেকে কয়েকটি মত বর্ণিত হয়েছেঃ

১) ذَٰلِكَ শব্দের অর্থ তাওরাত ও ইঞ্জিল বুঝানো হয়েছে, তখন তার অর্থ হবেঃ হে মুহাম্মাদ (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঐ কিতাব যা আমি তাওরাত ও ইঞ্জিলে উল্লেখ করেছিলাম, তা-ই আপনার উপর নাযিল করেছি। অথবা, হে ইয়াহুদী ও নাসারা সম্প্রদায়! তোমাদেরকে যে কিতাবের ওয়াদা আমি তোমাদের কিতাবে করেছি সেটা এই কিতাব যা আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর নাযিল করেছি।

২) এখানে ذَٰلِكَ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, এ আয়াতসমূহের পূর্বে মক্কা ও মদীনায় নাযিল কুরআনের অন্যান্য সূরা ও আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করা। আর যেহেতু সেগুলো আগেই গত হয়েছে, সেহেতু এ দ্বারা সম্বোধন শুদ্ধ হয়েছে।

৩) কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ এখানে কিতাব বলতে ঐ কিতাবকে বুঝিয়েছেন, যা আল্লাহ তা'আলা তাঁর কাছে রেখে দিয়েছেন। যা লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত।

৪) এখানে কিতাব দ্বারা ঐ কিতাব উদ্দেশ্য, যাতে আল্লাহ্ তা'আলা বান্দার ভাল-মন্দ, রিযক, আয়ু ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।

৫) এখানে ঐ কিতাব বুঝানো হয়েছে যা তিনি নিজে লিখে রেখেছেন তাঁর কাছে আরশের উপর, যেখানে লেখা আছে, “আমার রহমত আমার ক্রোধের উপর প্রাধান্য পাবে"। [বুখারী: ৭৫৫৩, মুসলিম: ২৭৫১]

৬) الم দ্বারা যদি পবিত্র কুরআন বুঝানো হয়ে থাকে, অর্থাৎ কুরআনের নাম হয়ে থাকে, তাহলে ذَٰلِكَ الْكِتَاب দ্বারা الم বুঝানো হয়েছে।

৭) এখানে ذلك দ্বারা هذا বুঝানো হয়েছে। [আত-তাফসীরুস সহীহ] অর্থাৎ এই কিতাব যার আলোচনা হচ্ছে, বা সামনে আসছে। সুতরাং এর দ্বারা কুরআনকেই বুঝানো হয়েছে। আর এ শেষোক্ত মতই সবচেয়ে বেশী বিশুদ্ধ। সুতরাং الْكِتَاب দ্বারা কুরআন মাজীদকে বোঝানো হয়েছে।

২.  এ আয়াতে উল্লেখিত ريب শব্দের অর্থ এমন সন্দেহ যা অস্বস্তিকর। এ আয়াতের বর্ণনায় মুফাসসিরগণ বিভিন্ন মত পোষন করেছেনঃ

১) এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এ কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়েছে।
২) তোমরা এ কুরআনের মধ্যে কোন সন্দেহ করো না। [ইবনে কাসীর]
৩) কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ এর অর্থ তোমরা এ কুরআনের মধ্যে কোন সন্দেহে নিপতিত হবে না। অর্থাৎ এর সবকিছু স্পষ্ট।
৪) কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ যদি কিতাব দ্বারা ঐ কিতাব উদ্দেশ্য হয়, যাতে আল্লাহ্ তা'আলা সবকিছুর ভালমন্দ হওয়া লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন, তাহলে لَا رَيْبَ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, এতে কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন নেই।

৩. ‘মুত্তাকীন’ শব্দটি ‘মুত্তাকী’-এর বহুবচন। মুত্তাকী শব্দের মূল ধাতু তাকওয়া। তাকওয়া হলো, নিরাপদ থাকা, নিরাপত্তা বিধান করা। শরীআতের পরিভাষায় তাকওয়া হলো, বান্দা যেন আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে, আর তা করতে হলে যা করতে হবে তা হলো, তাঁর নির্দেশকে পুরোপুরি মেনে নেয়া, এবং তাঁর নিষেধকৃত বস্তুকে পুরোপুরি ত্যাগ করা। আর মুত্তাকী হলেন, যিনি আল্লাহর আদেশকে পুরোপুরি মেনে নিয়ে এবং তার নিষেধ থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থেকে তাঁর অসন্তুষ্টি ও শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। [ইবনে কাসীর]

বর্ণিত আছে যে, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তাকওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আপনি কি কখনো কাঁটাযুক্ত পথে চলেছেন? তিনি বললেন, অবশ্যই। উবাই বললেন, কিভাবে চলেছেন? উমর বললেন, কাপড় গুটিয়ে অত্যন্ত সাবধানে চলেছি। উবাই বললেনঃ এটাই হলো, তাকওয়া। [ইবনে কাসীর] তবে প্রশ্ন হতে পারে যে, মুত্তাকীগণকে কেন হেদায়াত প্রাপ্তির জন্য নির্দিষ্ট করেছেন? এ ব্যাপারে আলেমগণ বলেন, মূলতঃ মুত্তাকীরাই আল্লাহর কুরআন থেকে হেদায়াত লাভ করতে পারেন, অন্যান্য যারা মুত্তাকী নন তারা হেদায়াত লাভ করতে পারেন না। যদিও কুরআন তাদেরকে সঠিক পথের দিশা দেন। আর পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এ অর্থের উপর প্রমাণবহ। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় এ কুরআন হিদায়াত করে সে পথের দিকে যা আকওয়াম তথা সুদৃঢ় এবং সৎকর্মপরায়ণ মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার”। [সূরা আল-ইসরা ৯]

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এ আয়াতের তাফসীরে বলেন, এ কুরআন তাদের জন্য হিদায়াত যারা হেদায়াত চেনার পর তা গ্রহণ না করার শাস্তির ভয়ে সদা কম্পমান। আর তারা তাঁর কাছ থেকে যা এসেছে তার সত্যায়নের মাধ্যমে রহমতের আশাবাদী। [তাফসীরে ইবনে কাসীর ও আত-তাফসীরুস সহীহ] তাছাড়া হিদায়াতের কোন শেষ নেই, মুত্তাকীরা সর্বদা আল্লাহর নাযিল করা হেদায়াতের মুখাপেক্ষী বিধায় হেদায়াতকে তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। তবে অন্যান্য আয়াতে কুরআনকে সমস্ত মানবজাতির জন্য হেদায়াতকারী বলে উল্লেখ করেছেন, সেখানে এর অর্থ হলো, হিদায়াতের পথ তাদের দেখাতে পারে যদি তারা তা থেকে হিদায়াত নিতে চায়।

তাফসীরে জাকারিয়া

২। এ গ্রন্থ; (কুরআন) এতে কোন সন্দেহ নেই, [1] সাবধানীদের জন্য এ (গ্রন্থ) পথ-নির্দেশক।[2]

[1] এ কিতাবের অবতরণ যে আল্লাহর নিকট থেকে এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। যেমন অন্য আয়াতে এসেছে, ;এ কিতাবের অবতরণ বিশ্বপালনকর্তার নিকট থেকে এতে কোন সন্দেহ নেই।’’ (সূরা সাজদা ২) কোন কোন আলেমগণ বলেছেন, বাক্যটি ঘোষণামূলক হলেও তার অর্থ নিষেধমূলক। অর্থাৎ, لاَ تَرتَابُوا فِيهِ (এতে সন্দেহ করো না)। এ ছাড়াও এতে যেসব ঘটনাবলী উল্লেখ করা হয়েছে তার সত্যতা সম্পর্কে, যেসব বিধি-বিধান ও মসলা-মাসায়েল বর্ণিত হয়েছে সে সবের উপর মানবতার কল্যাণ ও মুক্তি যে নির্ভরশীল সে ব্যাপারে এবং যেসব আক্বীদা (তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত) সংক্রান্ত বিষয় আলোচিত হয়েছে তার সত্য হওয়ার ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহ নেই।

[2] এই ঐশী গ্রন্থ আসলে তো সমস্ত মানুষের হিদায়াত এবং পথ প্রদর্শনের জন্যই অবতীর্ণ হয়েছে, কিন্তু এই নির্ঝরের পানি দ্বারা কেবল তারাই সিক্ত হবে, যারা ‘আবে হায়াত’ (সঞ্জীবনী পানি)-এর সন্ধানী এবং আল্লাহর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হবে। আর যাদের অন্তরে মৃত্যুর পর আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করার অনুভূতি এবং চিন্তা নেই, যাদের মধ্যে সুপথ সন্ধানের অথবা ভ্রষ্টতা থেকে বাঁচার কোনই উৎসাহ ও আগ্রহ নেই, তারা সুপথ কোথা থেকে এবং কেনই বা পাবে? (সকাল তো তাদের জন্য, যারা ঘুম ছেড়ে চোখের পাতা মেলে জেগে ওঠে।)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আল-বাকারা
২:৩ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡغَیۡبِ وَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ مِمَّا رَزَقۡنٰهُمۡ یُنۡفِقُوۡنَ ۙ﴿۳﴾

গায়েবের প্রতি ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিয্ক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। আল-বায়ান

যারা গায়বের প্রতি ঈমান আনে, নামায কায়িম করে এবং আমি যে জীবনোপকরণ তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় করে। তাইসিরুল

যারা অদৃশ্য বিষয়গুলিতে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যে উপজীবিকা প্রদান করেছি তা হতে দান করে থাকে । মুজিবুর রহমান

Who believe in the unseen, establish prayer, and spend out of what We have provided for them, Sahih International

৩. যারা গায়েবের(১) প্রতি ঈমান আনে (২), সালাত কায়েম করে(৩) এবং তাদেরকে আমরা যা দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে।(৪)

১. غيب এর অর্থ হচ্ছে এমনসব বস্তু যা বাহ্যিকভাবে মানবকুলের জ্ঞানের ঊর্ধ্বে এবং যা মানুষ পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব করতে পারে না, চক্ষু দ্বারা দেখতে পায় না, কান দ্বারা শুনতে পায় না, নাসিকা দ্বারা ঘ্রাণ নিতে পারে না, জিহবা দ্বারা স্বাদ গ্রহণ করতে পারে না, হাত দ্বারা স্পর্শ করতে পারে না, ফলে সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভও করতে পারে না। কুরআনে غيب শব্দ দ্বারা সে সমস্ত বিষয়কেই বোঝানো হয়েছে যেগুলোর সংবাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছেন এবং মানুষ যে সমস্ত বিষয়ে স্বীয় বুদ্ধিবলে ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জ্ঞান লাভে সম্পূর্ণ অক্ষম। এখানে غيب শব্দ দ্বারা ঈমানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্ব ও সত্তা, সিফাত বা গুণাবলী এবং তাকদীর সম্পর্কিত বিষয়সমূহ, জান্নাত-জাহান্নামের অবস্থা, কেয়ামত এবং কেয়ামতে অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘটনাসমূহ, ফেরেশতাকুল, সমস্ত আসমানী কিতাব, পূর্ববর্তী সকল নবী ও রাসূলগণের বিস্তারিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত যা সূরা আল-বাকারাহর (آمَنَ الرَّسُولُ) আয়াতে দেয়া হয়েছে। এখানে ঈমানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আর এ সূরারই শেষে ২৮৫ নং আয়াতে ঈমানের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।

২. ঈমান এবং গায়েব। শব্দ দুটির অর্থ যথার্থভাবে অনুধাবন করলেই ঈমানের পুরোপুরি তাৎপর্য ও সংজ্ঞা হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব হবে। ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, কোন বিষয়ে মুখের স্বীকৃতির মাধ্যমে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা এবং তা কাজে পরিণত করা। এখানে ঈমানের তিনটি দিক তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমতঃ অন্তরে অকপট চিত্তে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা। দ্বিতীয়তঃ সে বিষয়ের স্বীকৃতি মুখে দেয়া। তৃতীয়তঃ কর্মকাণ্ডে তার বাস্তাবায়ন করা। শুধু বিশ্বাসের নামই ঈমান নয়। কেননা খোদ ইবলিস, ফিরআউন এবং অনেক কাফেরও মনে মনে বিশ্বাস করত। কিন্তু না মানার কারণে তারা ঈমানদারদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। তদ্রুপ শুধু মুখে স্বীকৃতির নামও ঈমান নয়। কারণ মুনাফেকরা মুখে স্বীকৃতি দিত। বরং ঈমান হচ্ছে জানা ও মানার নাম। বিশ্বাস করা, মুখে স্বীকৃতি দেয়া এবং কার্যে পরিণত করা -এ তিনটির সমষ্টির নাম ঈমান। তাছাড়া ঈমান বাড়ে ও কমে। উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে ঈমান বিল-গায়েব অর্থ এই দাঁড়ায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে হেদায়াত এবং শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন, সে সবগুলোকে আন্তরিকভাবে মেনে নেয়া। তবে শর্ত হচ্ছে যে, সেগুলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিক্ষা হিসেবে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হতে হবে। আহলে-ইসলামের সংখ্যাগরিষ্ট দল ঈমানের এ সংজ্ঞাই দিয়েছেন। [ইবনে কাসীর]

‘ঈমান বিল-গায়েব’ সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘গায়েবের বিষয়াদির উপর ঈমান আনার চেয়ে উত্তম ঈমান আর কারও হতে পারে না। তারপর তিনি এ সূরার প্রথম পাঁচটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন। [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/২৬০] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি, আপনার সাথে জিহাদ করেছি, আমাদের থেকে উত্তম কি কেউ আছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ, তারা তোমাদের পরে এমন একটি জাতি, যারা আমাকে না দেখে আমার উপর ঈমান আনবে [সুনান দারমী: ২/৩০৮, মুস্তাদরাকে হাকিম: ৪/৮৫] মূলত: এটি ঈমান বিল গায়েব এর একটি উদাহরণ। সাহাবা, তাবেয়ীনদের থেকে বিভিন্ন বর্ণনায় ঈমান বিল গায়েবের বিভিন্ন উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। কেউ বলেছেন, কুরআন। আবার কেউ বলেছেন, জান্নাত ও জাহান্নাম। [আত-তাফসীরুস সহীহ: ৯৯] এ সবগুলোই ঈমান বিল গায়েবের উদাহরণ। ঈমানের ছয়টি রুকন সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াদি ঈমান বিল গায়েবের মূল অংশ।

৩. সালাত’-এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে প্রার্থনা বা দো'আ। শরীআতের পরিভাষায় সে বিশেষ ইবাদাত, যা আমাদের নিকট ‘নামায’ হিসেবে পরিচিত। কুরআনুল কারীমে যতবার সালাতের তাকীদ দেয়া হয়েছে - সাধারণতঃ ‘ইকামত’ শব্দের দ্বারাই দেয়া হয়েছে। সালাত আদায়ের কথা শুধু দু'এক জায়গায় বলা হয়েছে। এ জন্য ইকামাতুস সালাত (সালাত প্রতিষ্ঠা)-এর মর্ম অনুধাবন করা উচিত। ‘ইকামত’ এর শাব্দিক অর্থ সোজা করা, স্থায়ী রাখা। সাধারণতঃ যেসব খুঁটি, দেয়াল বা গাছ প্রভৃতির আশ্রয়ে সোজাভাবে দাঁড়ানো থাকে, সেগুলো স্থায়ী থাকে এবং পড়ে যাওয়ার আশংকা কম থাকে। এজন্য ‘ইকামত’ স্থায়ী ও স্থিতিশীল অর্থেও ব্যবহৃত হয়।

কুরআন ও সুন্নাহর পরিভাষায় ইকামাতুস সালাত অর্থ, নির্ধারিত সময় অনুসারে যাবতীয় শর্তাদি ও নিয়মাবলী রক্ষা করে সালাত আদায় করা। শুধু সালাত আদায় করাকে ‘ইকামাতুস সালাত বলা হয় না। সালাতের যত গুণাবলী, ফলাফল, লাভ ও বরকতের কথা কুরআন হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে, তা সবই ‘ইকামাতুস সালাত’ (সালাত প্রতিষ্ঠা)-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। যেমন, কুরআনুল কারীমে আছে - নিশ্চয়ই সালাত মানুষকে যাবতীয় অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে। [সূরা আল-আনকাবুত: ৪৫] বস্তুত: সালাতের এ ফল ও ক্রিয়ার তখনই প্রকাশ ঘটবে, যখন সালাত উপরে বর্ণিত অর্থে প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ জন্য অনেক সালাত আদায়কারীকে অশ্লীল ও নক্ক্যারজনক কাজে জড়িত দেখে এ আয়াতের মৰ্ম সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা ঠিক হবে না। কেননা, তারা সালাত আদায় করেছে বটে, কিন্তু প্রতিষ্ঠা করেনি। সুতরাং সালাতকে সকল দিক দিয়ে ঠিক করাকে প্রতিষ্ঠা করা বলা হবে। ইকামত অর্থে সালাতে সকল ফরয-ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব পরিপূর্ণভাবে আদায় করা, এতে সব সময় সুদৃঢ় থাকা এবং এর ব্যবস্থাপনা সুদৃঢ় করা সবই বোঝায়।

তাছাড়া সময়মত আদায় করা। সালাতের রুকু, সাজদাহ, তিলাওয়াত, খুশু, খুযু ঠিক রাখাও এর অন্তর্ভুক্ত। [ইবনে কাসীর] ফরয-ওয়াজিব, সুন্নাত ও নফল প্রভৃতি সকল সালাতের জন্য একই শর্ত। এক কথায় সালাতে অভ্যস্ত হওয়া ও তা শরীআতের নিয়মানুযায়ী আদায় করা এবং এর সকল নিয়ম-পদ্ধতি যথার্থভাবে পালন করাই ইকামতে সালাত। তন্মধ্যে রয়েছে - জামা'আতের মাধ্যমে সালাত আদায়ের ব্যবস্থা করা। আর তা বাস্তাবায়নের জন্য সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করা। প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয়ভাবে তার তদারকির ব্যবস্থা করা। আল্লাহ তা'আলা ইসলামী কল্যাণ-রাষ্ট্রের যে রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন তার মধ্যে সালাত কায়েম করাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনদের অন্যতম কর্ম বলে ঘোষণা করে বলেনঃ “যাদেরকে আমরা যমীনের বুকে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে, সৎকাজের নির্দেশ দিবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে”।[সূরা আল-হাজ্জঃ ৪১]

৪. আল্লাহর পথে ব্যয় অর্থে এখানে ফরয যাকাত, ওয়াজিব সদকা এবং নফল দানসদকা প্রভৃতি যা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা হয় সে সবকিছুকেই বোঝানো হয়েছে। [তাফসীর তাবারী] কুরআনে সাধারণত ইনফাক নফল দান-সদকার জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে। যেখানে ফরয যাকাত উদ্দেশ্য সেসব ক্ষেত্রে 'যাকাত' শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। মুত্তাকীদের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথমে গায়েবের উপর ঈমান, এরপর সালাত প্রতিষ্ঠা এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

তাফসীরে জাকারিয়া

৩। যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, [1] যথাযথভাবে নামায পড়ে[2] ও তাদেরকে যা দান করেছি তা হতে ব্যয় করে। [3]

[1] গায়েবী, অদৃশ্য তথা অদেখা বিষয়সমূহ হল এমন সব জিনিস যার উপলব্ধি জ্ঞান ও ইন্দ্রিয় দ্বারা সম্ভব নয়। যেমন মহান আল্লাহর সত্তা, তাঁর অহী (প্রত্যাদেশ), জান্নাত ও জাহান্নাম, ফিরিশতা, কবরের আযাব এবং মৃত দেহের পুনরুত্থান ইত্যাদি। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সাঃ) কর্তৃক বর্ণিত এমন কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করাও ঈমানের অংশ যা জ্ঞান ও ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করা যায় না। আর তা অস্বীকার করা কুফরী ও ভ্রষ্টতা।

[2] যথাযথভাবে নামায পড়া বা নামায কায়েম করার অর্থ হল, নিয়মিতভাবে রসূল (সাঃ)-এর তরীকা অনুযায়ী নামায আদায়ের প্রতি যত্ন নেওয়া। নচেৎ নামায তো মুনাফিকরাও পড়তো।

[3] ব্যয় করা’ কথাটি ব্যাপক; যাতে ফরয ও নফল উভয় প্রকার (ব্যয়, খরচ, দান বা সদকা)ই শামিল। ঈমানদাররা তাদের সামর্থ্যানুযায়ী উভয় প্রকার সদকার ব্যাপারে কোন প্রকার কৃপণতা করে না। এমনকি পিতা-মাতা এবং পরিবার ও সন্তান-সন্ততির উপর ব্যয় করাও এই ‘ব্যয় করা’র মধ্যে শামিল এবং তাও নেকী লাভের মাধ্যম।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আল-বাকারা
২:৪ وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ وَ بِالۡاٰخِرَۃِ هُمۡ یُوۡقِنُوۡنَ ؕ﴿۴﴾

আর যারা ঈমান আনে তাতে, যা তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং যা তোমার পূর্বে নাযিল করা হয়েছে। আর আখিরাতের প্রতি তারা ইয়াকীন রাখে। আল-বায়ান

আর তোমার প্রতি যা নাযিল হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং পরকালের প্রতিও তারা নিশ্চিত বিশ্বাসী। তাইসিরুল

এবং তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছিল, যারা তদ্বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আখিরাতের প্রতি যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে। মুজিবুর রহমান

And who believe in what has been revealed to you, [O Muhammad], and what was revealed before you, and of the Hereafter they are certain [in faith]. Sahih International

৪. আর যারা ঈমান আনে তাতে, যা আপনার উপর নাযিল করা হয়েছে এবং যা আপনার পূর্বে নাযিল করা হয়েছে(১), আর যারা আখেরাতে নিশ্চিত বিশ্বাসী(২)।

১. এখানে মুত্তাকীদের এমন আরও কতিপয় গুণাবলীর বর্ণনা রয়েছে, যাতে ঈমান বিল গায়েব এবং আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসের প্রসঙ্গটা আরও একটু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে মুমিন ও মুত্তাকী দুই শ্রেণীর লোক বিদ্যমান ছিলেন, এক শ্রেণী তারা যারা প্রথমে মুশরিক ছিলেন এবং পরে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। অন্য শ্রেণী হলেন যারা প্রথমে আহলে-কিতাব ইয়াহুদী-নাসারা ছিলেন এবং পরে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। পূর্ববতী আয়াতে প্রথম শ্রেণীর বর্ণনা ছিল। এ আয়াতে দ্বিতীয় শ্রেণীর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তাই এ আয়াতে কুরআনের প্রতি ঈমান আনার সাথে সাথে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহে বিশ্বাস করার কথাও বলা হয়েছে। হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী এ দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা যারা ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কোন না কোন আসমানী কিতাবের অনুসারী ছিলেন, তারা দ্বিগুণ পুণ্যের অধিকারী হবেন। [দেখুন, বুখারী ৩০১১, মুসলিম ১৫৪]

প্রথমতঃ কুরআনের প্রতি ঈমান এবং আমলের জন্য, দ্বিতীয়তঃ পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে ঈমান আনার জন্য। তবে পার্থক্য এই যে, সেগুলো সম্পর্কে বিশ্বাসের বিষয় হবে, কুরআনের পূর্বে আল্লাহ্‌ তা’আলা যেসব কিতাব নাযিল করেছেন, সেগুলো সত্য ও হক এবং সে যুগে এর উপর আমল করা ওয়াজিব ছিল। আর এ যুগে কুরআন নাযিল হবার পর যেহেতু অন্যান্য আসমানী কিতাবের হুকুম-আহকাম এবং পূর্ববর্তী শরীআতসমূহ মনসুখ হয়ে গেছে, তাই এখন আমল একমাত্র কুরআনের আদেশানুযায়ীই করতে হবে। [ইবনে কাসীর থেকে সংক্ষেপিত]

২. এ আয়াতে মুত্তাকীগণের আরেকটি গুণ বর্ণনা করা হচ্ছে যে, তারা আখেরাতে নিশ্চিত বিশ্বাস বা দৃঢ় প্রত্যয় রাখে। যেসব বিষয়ের প্রতি ঈমান আনা অপরিহার্য সেগুলোর মধ্যে এ বিষয়টি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া ঈমান অনুযায়ী আমল করার প্রকৃত প্রেরণা এখান থেকেই সৃষ্টি হয়। ইসলামী বিশ্বাসগুলোর মধ্যে আখেরাতের প্রতি ঈমান আনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাস, যা দুনিয়ার রূপই পাল্টে দিয়েছে। এ বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়েই ওহীর অনুসারীগণ প্রথমে নৈতিকতা ও কর্মে এবং পরবর্তীতে মোকাবেলায় একটি অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আসনে উত্তীর্ণ হতে সমর্থ হয়েছে। পরন্তু তাওহীদ ও রিসালাতের ন্যায় এ আকীদাও সমস্ত নবী-রাসূলের শিক্ষা ও সর্বপ্রকার ধর্ম-বিশ্বাসের মধ্যেই সর্বসম্মত বিশ্বাসরূপে চলে আসছে।

যেসব লোক জীবন ও এর ভোগ-বিলাসকেই জীবনের চরম লক্ষ্য বলে গণ্য করে, জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে যে তিক্ত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, সে তিক্ততাকেই সর্বাপেক্ষা কষ্ট বলে মনে করে, আখেরাতের জীবন, সেখানকার হিসাব-নিকাশ, শাস্তি ও পুরস্কার প্রভৃতি সম্পর্কে যাদের এতটুকুও আস্থা নেই, তারা যখন সত্য-মিথ্যা কিংবা হালাল-হারামের মধ্যে পার্থক্য করাকে তাদের জীবনের সহজ-স্বাচ্ছন্দ্যের পথে বাধারূপে দেখতে পায়, তখন সামান্য একটু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিনিময়ে সকল মূল্যবোধকে বিসর্জন দিতে এতটুকুও কুণ্ঠাবোধ করে না, এমতাবস্থায় এ সমস্ত লোককে যে কোন দুস্কর্ম থেকে বিরত রাখার মত আর কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।

যা কিছু অন্যায়, অসুন্দর বা অসামাজিক জীবনের শান্তি-শৃংখলার পক্ষে ক্ষতিকর, সেসব অনাচার কার্যকরভাবে উৎখাত করার কোন শক্তি কোন আইনেরও নেই, এ কথা পরীক্ষিত সত্য। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কোন দুরাচারের চরিত্রশুদ্ধি ঘটানোও সম্ভব হয় না। অপরাধ যাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়, আইনের শাস্তি সাধারণত তাদের দাত-সওয়া হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত আর তাদের মধ্যে শাস্তিকে যারা ভয় করে, তাদের সে ভয়ের আওতাও শুধুমাত্র ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকে, যকটুকুতে ধরা পড়ার ভয় বিদ্যমান। কিন্তু গোপনে লোকচক্ষুর অন্তরালে যেখানে ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকে না, সেরূপ পরিবেশে এ সমস্ত লোকের পক্ষেও যে কোন গৰ্হিত কাজে লিপ্ত হওয়ার পথে কোন বাধাই থাকে না।

প্রকারান্তরে আখেরাতের প্রতি ঈমানই এমন এক কার্যকর নিয়ন্ত্রণবিধি, যা মানুষকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সর্বত্রই যে কোন গৰ্হিত আচরণ থেকে অত্যন্ত কার্যকারভাবে বিরত রাখে। তার অন্তরে এমন এক প্রত্যয়ের অম্লান শিখা অবিরাম সমুজ্জ্বল করে দেয় যে, আমি প্রকাশ্যেই থাকি আর গভীর নির্জনেই থাকি, রাজপথে থাকি কিংবা কোন বদ্ধঘরে লুকিয়েই থাকি, মুখে বা ভাব-ভঙ্গিতে প্রকাশ করি আর নাই করি, আমার সকল আচরণ, আমার সকল অভিব্যক্তি, এমনকি অন্তরে লুকায়িত প্রতিটি আকাংখা পর্যন্ত এক মহাসত্তার সামনে রয়েছে। তার সদাজাগ্রত দৃষ্টির সামনে কোন কিছুই আড়াল করার সাধ্য আমার নেই। আমার সংগে রয়েছে এমনসব প্রহরী, যারা আমার প্রতিটি আচরণ এবং অভিব্যক্তি প্রতিমুহুর্তেই লিপিবদ্ধ করছেন।

উপরোক্ত বিশ্বাসের মাধ্যমেই প্রাথমিক যুগে এমন মহোত্তম চরিত্রের অগণিত লোক সৃষ্টি হয়েছিলেন, যাদের চাল-চলন এবং আচার-আচরণ দেখেই মানুষ ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে পড়ত। এখন লক্ষণীয় আর একটি বিষয় হচ্ছে, আয়াতের শেষে يُؤْمِنُون শব্দ ব্যবহার না করে يُوقِنُونَ ব্যবহার করা হয়েছে। ইয়াকীন অর্থ দৃঢ় প্রত্যয় যার দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আখেরাতের প্রতি এমন দৃঢ় প্রত্যয় রাখতে হবে, যে প্রত্যয় স্বচক্ষে দেখা কোন বস্তু সম্পর্কেই হতে পারে। এ দৃঢ় প্রত্যয়ের গুরুত্ব নির্ধারণে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “সবর হচ্ছে ঈমানের অর্ধেক, আর ইয়াকীন হচ্ছে পূর্ণ ঈমান” [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/৪৪৬]

মুত্তাকীদের এই গুণ আখেরাতে আল্লাহ তা'আলার সম্মুখে উপস্থিতি এবং হিসাবনিকাশ, প্রতিদান এবং সবকিছুরই একটি পরিপূর্ণ নকশা তার সামনে দৃশ্যমান করে রাখবে। যে ব্যক্তি অন্যের হক নষ্ট করার জন্য মিথ্যা মামলা করে বা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহর আদেশের বিপরীত পথে হারাম ধন-দৌলত উপার্জন করে এবং দুনিয়ার হীন উদ্দেশ্য সফল করার জন্য শরীআত বিরোধী কাজ করে, সে ব্যক্তি আখেরাতে বিশ্বাসী হয়ে, প্রকাশ্যে ঈমানের কথা যদি স্বীকার করে এবং শরীআতের বিচারে তাকে মুমিনও বলা হয়, কিন্তু কুরআন যে ইয়াকীনের কথা ঘোষণা করেছে, এমন লোকের মধ্যে সে ইয়াকীন থাকতে পারে না। আর সে কুরআনী ইয়াকীনই মানবজীবনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে দিতে পারে। আর এর পরিণামেই মুত্তাকীগণকে হেদায়াত এবং সফলতার সে পুরস্কার দেয়া হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে যে, তারাই সরল-সঠিক পথের পথিক, যা তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে দান করা হয়েছে আর তারাই সম্পূর্ণ সফলকাম হয়েছে।

তাফসীরে জাকারিয়া

৪। এবং তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতে যারা বিশ্বাস করে[1] ও পরলোকে যারা নিশ্চিত বিশ্বাসী।

[1] পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতে বিশ্বাস করা’র অর্থ হল এই যে, যে গ্রন্থসমূহ পূর্ববর্তী নবীগণের উপর অবতীর্ণ করা হয়েছিল, তা সবই সত্য। যদিও সেই কিতাব বা গ্রন্থাবলী বর্তমানে আসল (অপরিবর্তিত) অবস্থায় পাওয়া যায় না। তাই সেগুলির উপর আমল করাও যাবে না। এখন শুধু ক্বুরআন ও তার ব্যাখ্যা হাদীসের উপরেই আমল করতে হবে। এ থেকে এ কথাও জানা গেল যে, অহী ও রিসালাতের ধারাবাহিকতা রসূল (সাঃ) পর্যন্তই শেষ। তা না হলে তার (পরে আগত কোন রিসালাতের) উপর ঈমান আনার কথাও মহান আল্লাহ অবশ্যই উল্লেখ করতেন।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আল-বাকারা
২:৫ اُولٰٓئِکَ عَلٰی هُدًی مِّنۡ رَّبِّهِمۡ ٭ وَ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ ﴿۵﴾

তারা তাদের রবের পক্ষ থেকে হিদায়াতের উপর রয়েছে এবং তারাই সফলকাম। আল-বায়ান

তারাই তাদের প্রতিপালকের হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত আছে, আর তারাই সফলকাম। তাইসিরুল

এরাই তাদের রবের পক্ষ হতে প্রাপ্ত হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং এরাই পূর্ণ সফলকাম। মুজিবুর রহমান

Those are upon [right] guidance from their Lord, and it is those who are the successful. Sahih International

৫. তারাই তাদের রব-এর নির্দেশিত হেদায়াতের উপর রয়েছে এবং তারাই সফলকাম।(১)

১. যারা মুত্তাকী তারাই সফলকাম। এখানে মুত্তাকীদের গুণাগুণ বর্ণনা করার পরে হিদায়াতের জন্য তাদেরকে সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে যে, তারাই তাদের রব-এর দেয়া হিদায়াত পাবে এবং তারাই সফলকাম হবে। আল্লাহর এ ঘোষণার প্রেক্ষিতে সৎলোকেরা জান্নাতে স্থান পাবে। বর্তমান জীবনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও অসমৃদ্ধি, সাফল্য ও ব্যর্থতা আসল মানদণ্ড নয়। বরং আল্লাহর শেষ বিচারে যে ব্যক্তি উত্‌রে যাবে, সে-ই হচ্ছে সফলকাম। আর সেখানে যে উতরোবে না, সে ব্যর্থ।

সূরা আল-বাকারার প্রথম পাঁচটি আয়াতে কুরআনকে হিদায়াত বা পথপ্রদর্শনের গ্রন্থরূপে ঘোষণা করে সকল সন্দেহ ও সংশয়ের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়ার পর সে সমস্ত ভাগ্যবান ব্যক্তিদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা এ গ্রন্থের হিদায়াতে পরিপূর্ণভাবে উপকৃত ও লাভবান হয়েছেন এবং যাদেরকে কুরআনের পরিভাষায় মুমিন ও মুত্তাকী উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। তাদের বৈশিষ্ট্য, গুণাবলী এবং পরিচয়ও বর্ণনা করা হয়েছে। পরবর্তী পনেরটি আয়াতে সে সমস্ত লোকের বিষয় আলোচিত হয়েছে, যারা এ হিদায়াতকে অগ্রাহ্য ও অস্বীকার করে বিরুদ্ধাচরণ করেছে। এরা দুটি দলে বিভক্ত। একদল প্রকাশ্যে কুরআনকে অস্বীকার করে বিরুদ্ধাচারণের পথ অবলম্বন করেছে। কুরআন তাদেরকে কাফের বলে আখ্যায়িত করেছে। অপর দল হচ্ছে, যারা হীন পার্থিব উদ্দেশ্যে অন্তরের ভাব ও বিশ্বাসের কথাটি খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করতে সাহস পায়নি, বরং প্রতারণার পথ অবলম্বন করেছে; মুসলিমদের নিকট বলে, আমরা মুসলিম; কুরআনের হিদায়াত মানি এবং আমরা তোমাদের সাথে আছি। অথচ তাদের অন্তরে লুক্কায়িত থাকে কুফর বা অস্বীকৃতি। আবার কাফেরদের নিকট গিয়ে বলে, আমরা তোমাদের দলভুক্ত, তোমাদের সাথেই রয়েছি।

মুসলিমদের ধোঁকা দেয়ার জন্য এবং তাদের গোপন কথা জানার জন্যই তাদের সাথে মেলামেশা করি। কুরআন তাদেরকে ‘মুনাফিক’ বলে আখ্যায়িত করেছে। এ পনরটি আয়াত যারা কুরআন অমান্য করে তাদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। তন্মধ্যে ৬ ও ৭নং আয়াতে যারা প্রকাশ্যে অস্বীকার করে তাদের কথা ও স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে। আর পরবর্তী তেরটি আয়াতই মুনাফেকদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এ আয়াতগুলোর বিস্তারিত আলোচনায় মনোনিবেশ করলে বোঝা যায় যে, আল্লাহ্ তা'আলা সূরা আল-বাকারার প্রথম বিশটি আয়াতে একদিকে হিদায়াতের উৎসের সন্ধান দিয়ে বলেছেন যে, এর উৎস হচ্ছে তার কিতাব এই কুরআন; অপরদিকে সৃষ্টিজগতকে এ হিদায়াত গ্রহণ করা ও না করার নিরিখে দু’টি ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছেন। যারা গ্রহণ করেছে, তাদেরকে মুমিন-মুত্তাকী বলেছেন, আর যারা অগ্রাহ্য করেছে তাদেরকে কাফের ও মুনাফেক বলেছেন। কুরআনের এ শিক্ষা থেকে একটি মৌলিক জ্ঞাতব্য বিষয় এও প্রমাণিত হয় যে, বিশ্ববাসীকে এমনভাবে দুটি ভাগ করা যায়, যা হবে আদর্শভিত্তিক। বংশ, গোত্র, দেশ, ভাষা ও বর্ণ এবং ভৌগলিক বিভক্তি এমন কোন ভেদরেখা নয়, যার ভিত্তিতে মানবজাতিকে বিভক্ত করা যেতে পারে।

তাফসীরে জাকারিয়া

৫। তারাই তাদের প্রতিপালকের নির্দেশিত পথে রয়েছে এবং তারাই সফলকাম।

এখানে সেই ঈমানদার বা বিশ্বাসীদের পরিণামের কথা বলা হয়েছে, যারা ঈমান আনার পর আল্লাহভীরু ও আমল করা সহ সঠিক আক্বীদার উপর কায়েম থাকার প্রতি যত্ন নেয়; কেবল মৌখিক ঈমান প্রকাশকে যথেষ্ট মনে করে না। আর সফলকাম হওয়ার অর্থ, আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাঁর রহমত ও ক্ষমা লাভ। এর সাথে যদি দুনিয়াতেও সুখ-সাছন্দ্য ও সফলতা লাভ হয়ে যায় তাহলে তো ‘সুবহানাল্লাহ’ (বিরাট সৌভাগ্য)। নচেৎ আখেরাতের সফলতাই হল প্রকৃত সফলতা।

এর পর মহান আল্লাহ অন্য এক দলের কথা বলছেন যারা কেবল কাফেরই নয়, বরং তাদের কুফরী ও অবাধ্যতা এমন অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এর পর তাদের কোন মঙ্গল বা ইসলাম কবুল করার কোন আশাই নেই।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আল-বাকারা
২:২৩ وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ فِیۡ رَیۡبٍ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلٰی عَبۡدِنَا فَاۡتُوۡا بِسُوۡرَۃٍ مِّنۡ مِّثۡلِهٖ ۪ وَ ادۡعُوۡا شُهَدَآءَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۲۳﴾

আর আমি আমার বান্দার উপর যা নাযিল করেছি, যদি তোমরা সে সম্পর্কে সন্দেহে থাক, তবে তোমরা তার মত একটি সূরা নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সাক্ষীসমূহকে ডাক; যদি তোমরা সত্যবাদী হও। আল-বায়ান

আমি আমার বান্দাহর প্রতি যা নাযিল করেছি তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা তার মত কোন সূরাহ এনে দাও আর তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তবে আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সকল সাহায্যকারীকে আহবান কর। তাইসিরুল

এবং আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি, যদি তোমরা তাতে সন্দিহান হও তাহলে তৎসদৃশ একটি ‘‘সূরা’’ আনয়ন কর এবং তোমাদের সেই সাহায্যকারীদেরকে ডেকে নাও যারা আল্লাহ হতে পৃথক, যদি তোমরা সত্যবাদী হও! মুজিবুর রহমান

And if you are in doubt about what We have sent down upon Our Servant [Muhammad], then produce a surah the like thereof and call upon your witnesses other than Allah, if you should be truthful. Sahih International

২৩. আর আমরা আমাদের বান্দার প্রতি যা নাযিল করেছি তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা এর অনুরূপ কোন সূরা আনয়ন কর(১) এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সকল সাক্ষী সাহায্যকারীকে(২) আহবান কর, যদি তোমরা সত্যবাদী হও(৩)।

১. পূর্ববর্তী আয়াতে তাওহীদ প্রমাণ করা হয়েছিল। আর এ আয়াত ও পরবর্তী আয়াতে নবুওয়ত ও রিসালাতের সত্যতা সাব্যস্ত করা হচ্ছে। [ইবনে কাসীর]

২. شُهَدَاء শব্দের ব্যাখ্যা ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার মতে, أعْوَنُكُمْ বা সাহায্যকারীগণ। অর্থাৎ এমন সম্প্রদায় আহবান কর যারা তোমাদেরকে এ ব্যপারে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারবে। আবু মালেক বলেন, এর অর্থ, شُرَكَاءَكُمْ তোমাদের অংশীদারদেরকে বা যাদেরকে তোমরা আমার সাথে শরীক করছ সে শরীকদেরকে আহবান করে দেখ তারা কি এর অনুরূপ কোন সূরা আনতে পারে কি না? মুজাহিদ বলেন, شُهَدَاء শব্দটি এখানে সাধারণ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ এমন লোকদের আহবান করে নিয়ে আস যারা এ ব্যাপারে সাক্ষ্য হবে যে, আল্লাহর কালামের বিপরীতে যা নিয়ে আসবে তা আল্লাহর কালামের মত হয়েছে। ভাষাবিদদের সাক্ষ্য এর সাথে যোগ করে দাও।

পবিত্র কুরআনে এ চ্যালেঞ্জ বিভিন্ন স্থানে এসেছে। মক্কী সূরায়ও এমন চ্যালেঞ্জ এসেছিল। বলা হয়েছে, “এ কুরআন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো রচনা হওয়া সম্ভব নয়। বরং এর আগে যা নাযিল হয়েছে এটা তার সমর্থক এবং আল কিতাবের বিশদ ব্যাখ্যা। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটা জগতসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে। তারা কি বলে, তিনি এটা রচনা করেছেন? বলুন, তবে তোমরা এর অনুরূপ একটি সূরা নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য যাকে পার ডাক, যদি তোমরা সত্যবাদী হও [সূরা ইউনুস ৩৭-৩৮) তারপর মদীনায় নাযিল হওয়া সূরাসমূহেও এ ধরনের চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। যেমন, সূরা আল বাকারাহ এর আলোচ্য আয়াত। [ইবনে কাসীর]

৩. কুরআন নিয়ে যারাই গবেষণা করেছেন, তারা একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, এর ভাষাগত বাহ্যিক রূপ ও মর্মগত আত্মিক স্বরূপ উভয় দিক দিয়েই এটা অতুলনীয়। মহান আল্লাহ বলেন, “আলিফ-লাম-রা, এ কিতাব প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞের কাছ থেকে; এর আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট, সুবিন্যস্ত ও পরে বিশদভাবে বিবৃত।” [সূরা হুদঃ ১] সুতরাং কুরআনের ভাষা অত্যন্ত সুসংবদ্ধ ও তার মর্ম সূদুরপ্রসারী ও ব্যাপক। ভাব ও ভাষা উভয় ক্ষেত্রেই তা অতুলনীয় ও বিস্ময়কর। সব সৃষ্টিজগত তার সমকক্ষতার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অক্ষমতার স্বীকৃতি প্রদান করেছে। তাতে একদিকে যেমন অতীতের ইতিহাস উপযুক্তভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তেমনি ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিতব্য ঘটনাবলীও সুস্পষ্টভাবে বিধৃত হয়েছে। ন্যায় অন্যায় ও ভালো মন্দ সম্পর্কিত সব কিছুই সুনিপুণভাবে তাতে উল্লেখ করা হয়েছে।

তাই আল্লাহ তা'আলা ঘোষণা করলেন, “সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে আপনার রব-এর বাণী পরিপূর্ণ। তার বাক্য পরিবর্তন করার কেউ নেই। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ”। [সূরা আল-আন’আম: ১১৫] অর্থাৎ যে সমস্ত সংবাদ দিয়েছেন সেগুলোর সত্যতা প্রমাণিত| আর যে সমস্ত বিধান দিয়েছেন বিধানদাতা হিসেবে সেগুলোর ন্যায়পরায়ণতা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে। এর প্রতিটি বিষয়ই সত্য ও ন্যায়ের মাপকাঠি ও পথের দিশারী। এতে কোন ধারণাপ্রসূত কথা, রূপকথা কিংবা কাল্পনিক গালগল্প ও মিথ্যাচার যা সাধারণত কবিদের কাব্যে পাওয়া যায়, এতে এর বিন্দুমাত্র ছোয়াও নেই।

কুরআনের মজীদের পুরোটাই হচ্ছে উচ্চাঙ্গের কথামালা। অনন্য ভাষাশৈলীতা এবং হৃদয়স্পশী উপমায় ভরপুর। আরবী ভাষায় সুপণ্ডিত ও গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন মনীষীরাই কেবল কুরআনের ভাষারীতি ও ভাব সম্পদের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম। কুরআন যখন কোন খবর প্রকাশ করে, হোক তা বিস্তারিত বা সংক্ষিপ্ত, আবার তা যদি একবারের জায়গায় বারবারও বলা হয়, তথাপি তার স্বাদ ও মাধুর্যে বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় ঘটে না। যতই পাঠ করবে ততই যেন অজানা এক স্বাদে মন উত্তরোত্তর উদ্বেলিত হয়েই চলবে। তার বারবার পাঠ করলে যেমন সাধারণ পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে না। তেমনি অসাধারণ পাঠকরাও অনাগ্রহ প্রকাশ করেন না।

আল-কুরআনের ভীতি প্রদর্শনমূলক আয়াত ও কঠোর সতর্কবাণী ভালো করে অনুধাবন করলে কঠিন মানুষ তো দূরের কথা পাহাড় পর্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে কাঁপতে থাকে। অনুরূপভাবে তার আশ্বাসবাণী ও পুরস্কার বিবরণ দেখলে ও হৃদয়ঙ্গম করলে অন্ধ মনের বন্ধ দুয়ার উন্মুক্ত হয়ে যায়, অবরুদ্ধ শ্রবণশক্তি প্রত্যাশার পদ-ধ্বনি শুনতে পায়। আর মৃত মন ইসলামের অমিত শরবত পানের জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠে। এসব কিছু মিলে অজান্তে হৃদয়ে শান্তিধাম জান্নাতের প্রতি আগ্রহ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। আর মহান আল্লাহর আরশের কাছে থাকার তীব্র আকাংখা জাগ্রত হয়।

এ কুরআনের বিষয় বৈচিত্র আশ্চর্যজনক। ভাষার অলংকারের ঔজ্জ্বল্য, নসীহতের প্রাচুর্য, হাজারো যুক্তি প্রমাণ ও তত্ত্বজ্ঞানের আধিক্য কুরআনকে গ্রন্থ জগতে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে। বিধিনিষেধের বাণীসমূহকে অত্যন্ত ন্যায়ানুগ, কল্যাণকর, আকর্ষণীয় ও প্রভাবময় করা হয়েছে। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু সহ অনেক প্রাচীন মনীষী বলেছেন (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا) শোনার সাথে সাথে মনোযোগের সাথে কান পেতে পরবর্তী বক্তব্য শোন। কারণ, তারপর হয়ত কোন কল্যাণের পথে আহবান থাকবে, না হয় কোন অকল্যাণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ ঘোষিত হবে। [ইবন কাসীর]

আর যদি আল-কুরানে কিয়ামতের মাঠের ভয়াবহ চিত্র, চির সুখের জান্নাতের নেয়ামতরাজি, জাহান্নামের চিরন্তন দুর্ভোগের বিবরন, নেককারদের লোভনীয় পুরস্কার আর গুনাহগারদের নানা রকম ভয়াবহ শাস্তি, দুনিয়ার সম্পদ ও সুখ সম্ভোগের অসারতা ও পারলৌকিক জীবনের সুখ সম্ভোগের অবিনশ্বরতা সংক্রান্ত আলোচনার দিকে দৃষ্টি দেয়া যায় তবে তা বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা ও কল্যাণমূলক আলোচনায় সমৃদ্ধ। এসব বর্ণনা মানুষকে বার বার ন্যায়ের পথে উদ্বুদ্ধ করে, মনকে ভয়ে বিগলিত করে এবং শয়তানের প্ররোচণায় জমানো অন্তরের কালি ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয়।

 আল-কুরআনের এ ধরনের অবিস্মরণীয় ও আশ্চর্যজনক মু'জিযার কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মানুষের ঈমান আনার জন্য প্রত্যেক নবীকে কিছু কিছু মু'জিযা প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত ওহী হচ্ছে আমার মু'জিযা। আমি আশা করি কিয়ামতের দিন অন্যান্য নবীর তুলনায় আমার উম্মতের সংখ্যা অধিক হবে।” [বুখারী ৪৯৮১, মুসলিম: ১৫২] কারণ, প্রত্যেক নবীর মু'জিযা তাদের ইন্তেকালের সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কুরআনুল করীম কেয়ামত পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় বর্তমান থাকবে। সৰ্বকালের মানুষের কাছে অবিসংবাদিত হিসেবে থাকবে। [ইবনে কাসীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

২৩। আমি আমার দাসের প্রতি (মুহাম্মাদের প্রতি) যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা তার অনুরূপ কোন সূরা আনয়ন কর, এবং তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সকল সাক্ষী (এ কাজে সহযোগী উপাস্যদের)কে আহবান কর।

তাওহীদের পর এবারে রিসালাতের প্রমাণ পেশ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আমি আমার বান্দার প্রতি যে কিতাব অবতীর্ণ করেছি, সেটা যে আল্লাহরই পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এ ব্যাপারে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে, তবে তোমরা তোমাদের সকল সহযোগীদের সাথে নিয়ে এই ধরনের কোন একটি সূরা রচনা করে দেখিয়ে দাও! আর যদি এ রকম করতে না পার, তাহলে জেনে নিও যে, বস্ত্ততঃ এ বাণী কোন মানুষের প্রচেষ্টার ফল নয়, বরং তা আল্লাহর বাণী। তোমাদের উচিত, আল্লাহর কালাম এবং রসূলের রিসালাতের উপর ঈমান এনে সেই জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে চেষ্টা করা, যা কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আল-বাকারা
২:২৪ فَاِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلُوۡا وَ لَنۡ تَفۡعَلُوۡا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِیۡ وَقُوۡدُهَا النَّاسُ وَ الۡحِجَارَۃُ ۚۖ اُعِدَّتۡ لِلۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۲۴﴾

অতএব যদি তোমরা তা না কর- আর কখনো তোমরা তা করবে না- তাহলে আগুনকে ভয় কর যার জ্বালানী হবে মানুষ ও পাথর, যা প্রস্তুত করা হয়েছে কাফিরদের জন্য। আল-বায়ান

যদি তোমরা না পার এবং কক্ষনো পারবেও না, তাহলে সেই আগুনকে ভয় কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর, যা প্রস্তুত রয়েছে কাফেরদের জন্য। তাইসিরুল

অতঃপর যদি তোমরা তা করতে না পার এবং তোমরা তা কখনও করতে পারবেনা, তাহলে তোমরা সেই জাহান্নামের ভয় কর যার খোরাক মনুষ্য ও প্রস্তর খন্ড - যা অবিশ্বাসীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। মুজিবুর রহমান

But if you do not - and you will never be able to - then fear the Fire, whose fuel is men and stones, prepared for the disbelievers. Sahih International

২৪. অতএব যদি তোমরা তা করতে না পার আর কখনই তা করতে পারবে না(১), তাহলে তোমরা সে আগুন থেকে বাঁচার ব্যবস্থা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর(২), যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে(৩) কাফেরদের জন্য।

১. এটা কুরআনের বিশেষ মু'জিযা। একমাত্র কুরআনই নিঃসংকোচে সর্বকালের জন্য নিজ স্বীকৃত সত্তার এভাবে ঘোষণা দিতে পারে। যেভাবে রাসূলের যুগে কেউ এ কুরআনের মত আনতে পারে নি। তেমনি কুরআন এ ঘোষণাও নিঃশঙ্ক ও নিঃসংকোচে দিতে পেরেছে যে, যুগের পর যুগের জন্য, কালের পর কালের জন্য এই চ্যলেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হচ্ছে যে, এ কুরআনের মত কোন কিতাব কেউ কোন দিন আনতে পারবে না। অনুরূপই ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে। রাসূলের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত কেউ এ কুরআনের মত কিছু আনার দুঃসাহস দেখাতে পারে নি। আর কোনদিন পারবেও না। গোটা বিশ্বের যিনি সৃষ্টিকর্তা তার কথার সমকক্ষ কোন কথা কি কোন সৃষ্টির পক্ষে আনা সম্ভব?

২. ইবনে কাসীর বলেন, এখানে পাথর দ্বারা কালো গন্ধক পাথর বোঝানো হয়েছে। গন্ধক দিয়ে আগুন জ্বালালে তার তাপ ভীষণ ও স্থায়ী হয়। আসমান যমীন সৃষ্টির সময়ই আল্লাহ্ তা'আলা কাফেরদের জন্য তা সৃষ্টি করে প্রথম আসমানে রেখে দিয়েছেন। কোন কোন মুফাসসির বলেন, এখানে ঐ সমস্ত পাথর উদ্দেশ্য, যেগুলোর ইবাদাত করা হয়েছে। [ইবনে কাসীর] আর জাহান্নামের আগুন সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, “তোমাদের এ আগুন জাহান্নামের আগুনের সত্তর ভাগের এক ভাগ। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ এক ভাগ দিয়ে শাস্তি দিলেই তো যথেষ্ট হতো। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, জাহান্নামের আগুন তোমাদের আগুনের তুলনায় উনসত্তর গুণ বেশী উত্তপ্ত [বুখারী ৩২৬৫, মুসলিম: ২৪৮৩]

৩. এ আয়াতাংশের ব্যাখ্যা হচ্ছে, জাহান্নাম কাফেরদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এখানে أُعِدَّتْ এর সর্বনামটির ইঙ্গিত সুস্পষ্টতই মানুষ ও পাথর দ্বারা প্রজ্জ্বলিত জাহান্নামের দিকে। অবশ্য এ সর্বনামটি পাথরের ক্ষেত্রেও হতে পারে। তখন অর্থ দাঁড়ায়, পাথরগুলো কাফেরদের শাস্তি প্রদানের জন্য তৈরী করে রাখা হয়েছে। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে অনুরূপ তাফসীর বর্ণিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে উভয় অর্থের মধ্যে বড় ধরনের কোন তফাৎ নেই। একটি অপরটির পরিপূরক ও পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আগুন বিহীন যেমন পাথর জ্বলে না, তেমনি পাথর বিহীন আগুনের দাহ্য ক্ষমতাও বাড়ে না। সুতরাং উভয় উপাদানই কাফেরদের কঠোর শাস্তি দেয়ার জন্যে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

আয়াতের এ অংশ দ্বারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ইমামগণ দলীল নেন যে, জাহান্নাম বর্তমানে তৈরী করা অবস্থায় আছে। জাহান্নাম যে বাস্তবিকই বর্তমানে রয়েছে তার প্রমাণ অনেক হাদীস দ্বারা পাওয়া যায়। যেমন, জাহান্নাম ও জান্নাতের বিবাদের বর্ণনা সংক্রান্ত হাদীস [বুখারী ৪৮৪৯, মুসলিম: ২৮৪৬] , জাহান্নামের প্রার্থনা মোতাবেক তাকে বছরে শীত ও গ্রীষ্মে দুই বার শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণের অনুমতি প্রদানের বর্ণনা [বুখারী ৫৩৭, মুসলিম: ৬৩৭] ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এক হাদীসে আছে, “আমরা একটি বিকট শব্দ শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তার কারণ জানতে চাওয়ায় তিনি বললেন, এটা সত্তর বছর পূর্বে জাহান্নামের উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত পাথর জাহান্নামে পতিত হওয়ার আওয়ায। (মুসলিম: ২৮৪৪, মুসনাদে আহমাদ ২/৪৭১] তাছাড়া সূর্যগ্রহণের সালাত এবং মিরাজের রাত্রির ঘটনাবলীও প্রমাণ করে যে, জান্নাত ও জাহান্নাম উভয়টিই তৈরী করে রাখা হয়েছে। [ইবনে কাসীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

২৪। যদি তোমরা তা (আনয়ন) না কর, এবং কখনই তা করতে পারবে না, (1) তাহলে সেই আগুনকে ভয় কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর, (2) অবিশ্বাসীদের জন্য যা প্রস্তুত রয়েছে। (3)

(1) ক্বুরআন কারীমের সত্যতার এটি আর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যে, আরব (আরবী ভাষা-ভাষী) ও অনারব (যাদের ভাষা আরবী নয়) সকল কাফেরদেরকে চ্যালেঞ্জ্ করা হয়েছে। কিন্তু তারা আজ পর্যন্ত এই চ্যালেঞ্জের জওয়াব দিতে অপারগ সাব্যস্ত হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত অপারগই থাকবে।

(2) ইবনে আববাস (রাঃ)-এর উক্তি অনুযায়ী পাথর বলতে এখানে গন্ধক জাতীয় পাথরকে বুঝানো হয়েছে। অন্যদের নিকট পাথরের সেই মূর্তিগুলোও জাহান্নামের ইন্ধন হবে, দুনিয়াতে পৌত্তলিকরা যাদের পূজা করত। যেমন ক্বুরআন মাজীদে আছে,

{إِنَّكُمْ وَمَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ حَصَبُ جَهَنَّمَ} & তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের পূজা করো, সেগুলো দোযখের ইন্ধন। (আম্বিয়া ৯৮ আয়াত)

(3) এ থেকে প্রথমতঃ জানা গেল যে, প্রকৃতপক্ষে জাহান্নাম কাফের (অবিশ্বাসী) এবং মুশরিক (অংশীবাদী)-দের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। আর দ্বিতীয়তঃ জানা গেল যে, জান্নাত ও জাহান্নামের অস্তিত্ব আছে এবং এখনোও তা বিদ্যমান রয়েছে। সালফে-সালেহীনদের এটাই আক্বীদা (বিশ্বাস)। এটা কেবল উপমা বা দৃষ্টান্তমূলক কোন জিনিস নয়; যেমন অনেক আধুনিকতাবাদী ও হাদীস অস্বীকারকারীরা বোঝাতে চায়।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আল-বাকারা
২:৮৭ وَ لَقَدۡ اٰتَیۡنَا مُوۡسَی الۡکِتٰبَ وَ قَفَّیۡنَا مِنۡۢ بَعۡدِهٖ بِالرُّسُلِ ۫ وَ اٰتَیۡنَا عِیۡسَی ابۡنَ مَرۡیَمَ الۡبَیِّنٰتِ وَ اَیَّدۡنٰهُ بِرُوۡحِ الۡقُدُسِ ؕ اَفَکُلَّمَا جَآءَکُمۡ رَسُوۡلٌۢ بِمَا لَا تَهۡوٰۤی اَنۡفُسُکُمُ اسۡتَکۡبَرۡتُمۡ ۚ فَفَرِیۡقًا کَذَّبۡتُمۡ ۫ وَ فَرِیۡقًا تَقۡتُلُوۡنَ ﴿۸۷﴾

আর আমি নিশ্চয় মূসাকে কিতাব দিয়েছি এবং তার পরে একের পর এক রাসূল প্রেরণ করেছি এবং মারইয়াম পুত্র ঈসাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ। আর তাকে শক্তিশালী করেছি ‘পবিত্র আত্মা’র* মাধ্যমে। তবে কি তোমাদের নিকট যখনই কোন রাসূল এমন কিছু নিয়ে এসেছে, যা তোমাদের মনঃপূত নয়, তখন তোমরা অহঙ্কার করেছ, অতঃপর (নবীদের) একদলকে তোমরা মিথ্যাবাদী বলেছ আর একদলকে হত্যা করেছ। আল-বায়ান

এবং নিশ্চয়ই আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছি এবং তার পরে ক্রমান্বয়ে রসূলদেরকে প্রেরণ করেছি, মারইয়াম পুত্র ঈসাকে সুস্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছি এবং ‘পবিত্র আত্মা’যোগে (জিবরাঈলের মাধ্যমে) তাকে শক্তিশালী করেছি, অতঃপর যখনই কোন রসূল এমন কিছু এনেছে যা তোমাদের মনঃপুত নয়, তখনই তোমরা অহংকার করেছ এবং কিছু সংখ্যককে অস্বীকার করেছ এবং কিছু সংখ্যককে হত্যা করেছ। তাইসিরুল

এবং অবশ্যই আমি মূসাকে কিতাব প্রদান করেছি ও তৎপরে ক্রমান্বয়ে রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি, এবং আমি মারইয়াম নন্দন ঈসাকে নিদর্শনসমূহ প্রদান করেছিলাম এবং পবিত্র আত্মাযোগে তাকে শক্তি সম্পন্ন করেছিলাম; কিন্তু পরে যখন তোমাদের নিকট কোন রাসূল - তোমাদের প্রবৃত্তি যা ইচ্ছা করতনা তা নিয়ে উপস্থিত হল তখন তোমরা অহংকার করলে, অবশেষে এক দলকে মিথ্যাবাদী বললে এবং একদলকে হত্যা করলে। মুজিবুর রহমান

And We did certainly give Moses the Torah and followed up after him with messengers. And We gave Jesus, the son of Mary, clear proofs and supported him with the Pure Spirit. But is it [not] that every time a messenger came to you, [O Children of Israel], with what your souls did not desire, you were arrogant? And a party [of messengers] you denied and another party you killed. Sahih International

*পবিত্র আত্মা অর্থ জিবরীল (আ.)

৮৭. অবশ্যই আমরা মূসাকে কিতাব দিয়েছি এবং তার পরে পর্যায়ক্রমে রাসূলগণকে পাঠিয়েছি এবং আমরা মারইয়াম-পুত্র ‘ঈসাকে স্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছি(১) এবং রূহুল কুদুস"(২) দ্বারা তাকে শক্তিশালী করেছি। তবে কি যখনি কোন রাসূল তোমাদের কাছে এমন কিছু এনেছে যা তোমাদের মনঃপূত নয় তখনি তোমরা অহংকার করেছ? অতঃপর (নবীদের) একদলের উপর মিথ্যারোপ করেছ এবং একদলকে করেছ হত্যা?

১. এ আয়াতে স্পষ্ট প্রমাণ' কি তা ব্যাখ্যা করে বলা হয়নি। তবে অন্য জায়গায় সেটা বলা হয়েছে, যেমন, “আর তাকে বনী ইসরাঈলের জন্য রাসূলরুপে (তিনি বলবেন) নিশ্চয় আমি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি যে, অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য কাদামাটি দ্বারা একটি পাখিসদৃশ আকৃতি গঠন করব; তারপর তাতে আমি ফুঁ দেব; ফলে আল্লাহর হুকুমে সেটা পাখি হয়ে যাবে। আর আমি আল্লাহর হুকুমে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্থকে নিরাময় করব এবং মৃতকে জীবিত করব। আর তোমরা তোমাদের ঘরে যা খাও এবং মজুদ কর তা আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব।” [সূরা আলে ইমরান। ৪৯]

২. কুরআন-হাদীসের বিভিন্ন জায়গায় জিবরীল আলাইহিস সালাম-কে ‘রূহুল কুদুস’ বলা হয়েছে। যেমন, সূরা আশ-শু'আরা: ১৯৩, সূরা মারইয়াম: ১৭।

তাফসীরে জাকারিয়া

৮৭। অবশ্যই আমি মূসাকে কিতাব (তওরাত গ্রন্থ) দিয়েছি এবং তার পরে পর্যায়ক্রমে রসূলগণকে প্রেরণ করেছি, মারয়্যাম-তনয় ঈসাকে সুস্পষ্ট প্রমাণ (মু’জিযা) দিয়েছি এবং পবিত্র আত্মা (বা জিবরীল ফিরিশ্তা) দ্বারা তার শক্তি বৃদ্ধি করেছি। [1] অতঃপর যখনই কোন রসূল এমন কিছু নির্দেশ নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছে যা তোমাদের মনঃপূত নয়, তখনই তোমরা অহংকার করেছ। পরিশেষে একদলকে মিথ্যাজ্ঞান করেছ এবং একদলকে করেছ হত্যা। [2]

[1] {وَقَفَّيْنَا مِنْ بَعْدِهِ بِالرُّسُلِ} এর অর্থ হল, মূসা (আঃ)-এর পর ক্রমাগতভাবে নবী ও রসূল এসেছিলেন। বানী-ইস্রাঈলের মধ্যে নবী আসার এই ধরাবাহিকতা ঈসা (আঃ) পর্যন্ত শেষ হয়। (بيِّنَاتٌ) বলতে সেই মুজিযাসমূহকে বুঝানো হয়েছে যা ঈসা (আঃ)-কে দান করা হয়েছিল। যেমন, মৃতকে জীবিত করা এবং কুষ্ঠরোগী ও জন্মান্ধকে সুস্থ করে তোলা ইত্যাদি, যা সূরা আলে-ইমরানের ৪৯ নং আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে। (رُوْحُ الْقُدُسِ) (রূহুল ক্বুদুস বা পবিত্রের আত্মা) বলে জিবরীল (আঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। তাঁকে 'পবিত্রের আত্মা' এই জন্য বলা হয়েছে যে, তিনি আল্লাহর ('কুন' শব্দের মাধ্যমে) নির্দেশক্রমে অস্তিত্বে এসেছিলেন। অনুরূপ ঈসা (আঃ)-কেও 'রূহ' বলা হয়েছে। আর 'ক্বুদুস'; থেকে আল্লাহকে বুঝানো হয়েছে। আর আল্লাহর সাথে উক্ত 'রূহ'বা আত্মার সম্বন্ধ সম্মানসূচক। ইবনে জারীর এ (রূহুল ক্বুদুস বলতে জিবরীল উদ্দিষ্ট হওয়ার) মতটাকেই সর্বাধিক সঠিক বলেছেন। কারণ সূরা মায়েদার ১১০নং আয়াতে 'রূহুল ক্বুদুস' এবং ইঞ্জীল পৃথক পৃথক উল্লিখিত হয়েছে। (কাজেই রূহুল ক্বুদুস অর্থ ইঞ্জীল হতে পারে না।) অন্য আর এক আয়াতে জিবরীল (আঃ)-কে 'রূহুল আমীন' বলা হয়েছে। অনুরূপ রসূল (সাঃ) হাসসান (রাঃ) সম্পর্কে বলেছিলেন, اللَّهُمَّ أَيِّدْهُ برُوْحِ الْقُدُسِ 'হে আল্লাহ! 'রূহুল ক্বুদুস' দ্বারা ওকে শক্তিশালী কর। অপর আর এক হাদীসে এসেছে, وَجِبْرِيْلُ مَعَكَ জিবরীল তোমার সাথে রয়েছেন। জানা গেল যে, 'রূহুল ক্বুদুস' বলে জিবরীল (আঃ)-কেই বুঝানো হয়েছে। (ফাতহুল বায়ান, ইবনে কাসীর, বরাতে আশরাফুল হাওয়াশী)

[2] যেমন, মুহাম্মাদ (সাঃ) ও ঈসা (আঃ)-কে মিথ্যাবাদী বলেছে এবং যাকারিয়া ও ইয়াহ্ইয়া (আলাইহিমাস্ সালাম)-কে হত্যা করেছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আল-বাকারা
২:৯৮ مَنۡ کَانَ عَدُوًّا لِّلّٰهِ وَ مَلٰٓئِکَتِهٖ وَ رُسُلِهٖ وَ جِبۡرِیۡلَ وَ مِیۡکٰىلَ فَاِنَّ اللّٰهَ عَدُوٌّ لِّلۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۹۸﴾

‘যে শত্রু হবে আল্লাহর, তাঁর ফেরেশতাদের, তাঁর রাসূলগণের, জিবরীলের ও মীকাঈলের তবে নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদের শত্রু’। আল-বায়ান

যে ব্যক্তি আল্লাহর, তাঁর ফেরেশতাদের ও তাঁর রসূলগণের এবং জিবরাঈলের ও মীকাইলের শত্রু সাজবে, নিশ্চয়ই আল্লাহও (এসব) কাফিরদের শত্রু। তাইসিরুল

যে ব্যক্তি আল্লাহর, তাঁর মালাইকা/ফেরেশতাগণের, তাঁর রাসূলগণের, জিবরাঈলের এবং মিকাঈলের শত্রু, নিশ্চয়ই আল্লাহ এরূপ কাফিরদের শত্রু। মুজিবুর রহমান

Whoever is an enemy to Allah and His angels and His messengers and Gabriel and Michael - then indeed, Allah is an enemy to the disbelievers. Sahih International

৯৮. যে কেউ আল্লাহ, তার ফেরেশতাগণ, তার রাসূলগণ এবং জিবরীল ও মীকাঈলের শত্রু হবে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদের শক্র।(১)

(১) এ আয়াত দ্বারা বুঝা গেল যে, যারা ফেরেশতাদের উপর ঈমান আনবে না তারা কাফের। ফেরেশতারা হলো নূরের তৈরী। যারা কোন অপরাধ করে না। তারা আগবাড়িয়ে কিছু করে না। তাদেরকে যে নির্দেশ দেয়া হয়, তাই শুধু তারা পালন করে। সুতরাং যারা ফেরেশতাদের সাথে শক্রতা করে, তারা মূলতঃ আল্লাহর সাথেই শক্ৰতা করল।

তাফসীরে জাকারিয়া

৯৮। যে আল্লাহ, তাঁর ফিরিশতা (দূত)গণের, রসূল (প্রেরিত পুরুষ)গণের, জিবরাীল ও মীকাঈলের শত্রু হবে, সে জেনে রাখুক যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ অবিশ্বাসীদের শত্রু।[1]

1] ইয়াহুদীরা বলত যে, মীকাঈল আমাদের বন্ধু। মহান আল্লাহ বললেন, এরা সবাই আমার অতীব প্রিয় বান্দা। যে এদের সাথে বা এদের কোন একজনের সাথে শত্রুতা পোষণ করবে, সে হবে আল্লাহর শত্রু। হাদীসে বর্ণিত যে, (مَنْ عَادَ لِيْ وَلِيًّا فَقَدْ بَارَزَنِيْ بِالْحَرْبِ) যে আমার কোন বন্ধুর সাথে শত্রুতা পোষণ করল, সে আসলে আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। (সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ আররিক্বাক, পরিচ্ছেদঃ আত্তাওয়াযু অর্থাৎ, আল্লাহর কোন একজন অলীর সাথে দুশমনী রাখলে, তাঁর সকল অলীদের সাথে দুশমনী রাখা হবে; এমনকি তাঁর (আল্লাহর) সাথেও দুশমনী বিবেচিত হবে। এ থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আল্লাহর অলীদের সাথে ভালবাসা পোষণ করা ও তাঁদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা রাখা এত জরুরী এবং তাঁদের সাথে শক্রতা পোষণ করা এত বড় অন্যায় যে, মহান আল্লাহ তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আল্লাহর ওলী কে? এর জন্য দ্রষ্টব্য সূরা ইউনুসের ৬২-৬৩ নং আয়াত। তবে ভালবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করার অর্থ এটা কখনও নয় যে, মৃত্যুর পর তাঁদের কবরে গম্বুজ নির্মাণ করা হবে, বাৎসরিক উরসের নামে তাঁদের কবরে মেলার আয়োজন করা হবে, তাঁদের নামে নযর-মানত করা হবে, তাঁদের কবরকে গোসল দেওয়া হবে, তাঁদের কবরের উপর চাদর চড়ানো হবে, তাঁদেরকে প্রয়োজন পূরণকারী, বিপত্তারণ, ইষ্টানিষ্টের মালিক মনে করা হবে এবং তাঁদের কবরের সামনে হাত বেঁধে দাঁড়ানো ও চৌকাঠে সিজদা করা হবে ইত্যাদি। দুর্ভাগ্যবশতঃ আল্লাহর অলীদের ভালবাসার নামে লাত ও মানাত পূজার এই কার্যকলাপ বড়ই জাঁকজমকের সাথে চলছে। অথচ এটা ভালবাসা নয়, বরং এটা তাঁদের ইবাদত; যা শিরক ও বড় যুলুম। আল্লাহ তাআলা কবর-পূজার ফিতনা থেকে আমাদেরকে হেফাযত করুন! আমীন।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আল-বাকারা
২:১১৯ اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ بِالۡحَقِّ بَشِیۡرًا وَّ نَذِیۡرًا ۙ وَّ لَا تُسۡئَلُ عَنۡ اَصۡحٰبِ الۡجَحِیۡمِ ﴿۱۱۹﴾

নিশ্চয় আমি তোমাকে প্রেরণ করেছি সত্যসহ, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে এবং তোমাকে আগুনের অধিবাসীদের সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না। আল-বায়ান

আমি তোমাকে সত্যদ্বীনসহ সুসংবাদদাতা এবং ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেছি, জাহান্নামীদের সম্বন্ধে তোমাকে কোন প্রশ্ন করা হবে না। তাইসিরুল

নিশ্চয়ই আমি তোমাকে সত্যসহ সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শক রূপে প্রেরণ করেছি এবং তুমি জাহান্নামবাসীদের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হবেনা। মুজিবুর রহমান

Indeed, We have sent you, [O Muhammad], with the truth as a bringer of good tidings and a warner, and you will not be asked about the companions of Hellfire. Sahih International

১১৯. নিশ্চয় আমরা আপনাকে পাঠিয়েছি সত্যসহ সুসংবাদদাতা সতর্ককারীরূপে(১) আর জাহান্নামীদের সম্পর্কে আপনাকে কোন প্রশ্ন করা হবে না।

(১) এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ গুণে ভূষিত করা হয়েছে। প্রথম. ‘আল-মুরসাল বিল হক্ক’ বা যথাযথভাবে প্রেরিত আল্লাহ্ তা'আলা স্বয়ং তার রাসূল প্রেরণের উপর সাক্ষী হচ্ছেন যে, তিনি তাকে যথাযথভাবে হক সহ প্রেরণ করেছেন। দ্বিতীয় গুণ হচ্ছে, তিনি বাশীর বা সুসংবাদ প্রদানকারী। তিনি নেককারদের জন্য জান্নতেরসুসংবাদ প্রদানকারী। তৃতীয় গুণ হচ্ছে, তিনি নাযীর বা ভীতি প্রদর্শনকারী। যারা তার অবাধ্য হবে তারা জাহান্নামবাসী হবে এ ভীতিপ্রদ সংবাদ তিনি সবাইকে প্রদান করেছেন। পবিত্র কুরআনের অন্যত্রও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুরূপ গুণে গুণান্বিত করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, (وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا مُبَشِّرًا وَنَذِيرًا) [সূরা আল-ইসরা: ১০৫, আল-ফুরকান: ৫৬] আরও বলা হয়েছে, (وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا) [সূরা সাবা: ২৮] আরও এসেছে, (إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا) সূরা ফাতির: ২৪] অন্যত্র বলা হয়েছে, (إِنَّا أَرْسَلْنَا إِلَيْكُمْ رَسُولًا شَاهِدًا عَلَيْكُمْ) [সূরা আল-মুযযাম্মিল: ১৫] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ গুণটি শুধু কুরআনে নয়; পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহেও বর্ণিত হয়েছে। [দেখুন, বুখারী: ২১২৫, মুসনাদে আহমাদ: ২/১৭৪]

তাফসীরে জাকারিয়া

১১৯। আমি তোমাকে সত্যসহ শুভ সংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি। জাহান্নামীদের সম্পর্কে তোমাকে কোন প্রশ্ন করা হবে না।

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আল-বাকারা
২:১২৯ رَبَّنَا وَ ابۡعَثۡ فِیۡهِمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡهُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡهِمۡ اٰیٰتِکَ وَ یُعَلِّمُهُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ یُزَکِّیۡهِمۡ ؕ اِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۱۲۹﴾

‘হে আমাদের রব, তাদের মধ্যে তাদের থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যে তাদের প্রতি আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবে আর তাদেরকে পবিত্র করবে। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’। আল-বায়ান

‘হে আমাদের প্রতিপালক! এদের কাছে একজন রসূল এদের মধ্য হতে প্রেরণ কর, যে এদেরকে তোমার আয়াতগুলো পড়ে শুনাবে এবং এদেরকে কিতাব ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেবে এবং এদেরকে বিশুদ্ধ করবে, নিশ্চয় তুমি ক্ষমতাশালী, প্রজ্ঞাময়।’ তাইসিরুল

হে আমাদের রাব্ব! তাদেরই মধ্য হতে এমন একজন রাসূল প্রেরণ করুন যিনি তাদেরকে আপনার নিদর্শনাবলী পাঠ করে শুনাবেন এবং তাদেরকে গ্রন্থ ও বিজ্ঞান শিক্ষা দান করবেন ও তাদেরকে পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রান্ত, বিজ্ঞানময়। মুজিবুর রহমান

Our Lord, and send among them a messenger from themselves who will recite to them Your verses and teach them the Book and wisdom and purify them. Indeed, You are the Exalted in Might, the Wise." Sahih International

১২৯. হে আমাদের রব! আর আপনি তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে এক রাসূল পাঠান(১), যিনি আপনার আয়াতসমূহ তাদের কাছে তিলাওয়াত করবেন(২); তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেবেন(৩) এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন(৪) আপনি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’।

(১) হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমি আমার সূচনা বলে দিচ্ছি, আমার পিতা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর দোআ, ঈসা 'আলাইহিস সালাম-এর সুসংবাদ এবং আমার মা স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, তার থেকে একটি আলো বের হল, যে আলোতে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়েছে। [মুসনাদে আহমাদঃ ৫/২৬২] ঈসা আলাইহিস সালাম-এর সুসংবাদের অর্থ তার এ উক্তি (وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِنْ بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ) “আমি এমন এক নবীর সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আসবেন। তার নাম আহমাদ”। [সূরা আস-সাফঃ ৬] তার জননী গর্ভাবস্থায় স্বপ্নে দেখেন যে, তার পেট থেকে একটি নূর বের হয়ে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকোজ্জ্বল করে তুলেছে। কুরআনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাবের আলোচনা প্রসংগে দু’জায়গায়, সূরা আলে-ইমরানের ১৬৪তম আয়াতে এবং সূরা জুমুআয় ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর দোআয় উল্লেখিত ভাষারই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এভাবে ইংগিত করা হয়েছে যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যে নবীর জন্য দোআ করেছিলেন, তিনি হচ্ছেন শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

(২) ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দোআর কারণে আমাদের রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য তিনটি। তন্মধ্যে প্রথম হচ্ছে, আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা। তিলাওয়াতের আসল অর্থ অনুসরণ করা। কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় এ শব্দটি কুরআন ও অন্যান্য আসমানী কিতাব পাঠ করার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ, যে লোক এসব কালাম পাঠ করে, এর অনুসরণ করাও তার একান্ত কর্তব্য। আসমানী গ্রন্থ ঠিক যেভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়, হুবহু তেমনিভাবে পাঠ করা জরুরী। নিজের পক্ষ থেকে তাতে কোন শব্দ অথবা স্বরচিহ্নটিও পরিবর্তন পরিবর্ধন করার অনুমতি নেই। ইমাম রাগেব বলেন, “আল্লাহর কালাম ছাড়া অন্য কোন গ্রন্থ অথবা কালাম পাঠ করাকে সাধারণ পরিভাষায় তিলাওয়াত বলা যায় না’। [মুফরাদাতুল কুরআন]

(৩) ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দো’আ অনুসারে নবী রাসূলগন বিশেষ করে আমাদের রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দ্বিতীয় কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা দান। এখানে কিতাব বলে আল্লাহর কিতাব বুঝানো হয়েছে। ‘হিকমত’ শব্দটি আরবী অভিধানে একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যথা– সত্যে উপনীত হওয়া, ন্যায় ও সুবিচার, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ইত্যাদি। ইমাম রাগেব বলেন, এ শব্দটি আল্লাহর জন্য ব্যবহৃত হলে এর অর্থ হয় সকল বস্তুর পূর্ণজ্ঞান ও সুদৃঢ় উদ্ভাবন। অন্যের জন্য ব্যবহৃত হলে এর অর্থ হয়, বিদ্যমান বস্তুসমূহের বিশুদ্ধ জ্ঞান, সৎকর্ম, ন্যায়, সুবিচার, সত্য কথা ইত্যাদি। এখন লক্ষ্য করা দরকার যে, আয়াতে হিকমতের অর্থ কি? মূলত: এখানে হিকমত শব্দের অর্থ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ। ইবনে কাসীর ও ইবনে জরীর রাহিমাহুল্লাহ কাতাদাহ থেকে এ ব্যাখ্যাই উদ্ধৃত করেছেন। হিকমত অর্থ কেউ কুরআনের তাফসীর, কেউ দ্বীনের গভীর জ্ঞান, কেউ শরীআতের বিধি-বিধানের জ্ঞান, কেউ এমন বিধিবিধানের জ্ঞান অর্জন বলেছেন, যা শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বর্ণনা থেকেই জানা যায়। নিঃসন্দেহে এসব উক্তির সারমর্ম হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ।

(৪) ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দোআ অনুসারে নবী-রাসূলগণ বিশেষ করে আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তৃতীয় কর্তব্য হচ্ছে পরিশুদ্ধি ও পবিত্রকরণ। আয়াতে উল্লেখিত يُزَكِّيهِمْ শব্দটি زكاة শব্দ থেকে উদ্ভুত। এর অর্থ পবিত্রতা। বাহ্যিক ও আত্মিক সকল প্রকার পবিত্রতার অর্থেই এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বাহ্যিক না-পাকী সম্পর্কে সাধারণ মুসলিমরাও ওয়াকিফহাল। আত্মিক না-পাকী হচ্ছে কুফর, শির্ক, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উপর ভরসা করা, অহংকার, হিংসা, শক্রতা, দুনিয়াপ্রীতি ইত্যাদি। কুরআন ও সুন্নাহতে এসব বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। এ আয়াত থেকে আরও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, হেদায়াত ও সংশোধনের ধারা দুটি, আল্লাহর রাসূল ও আল্লাহর গ্রন্থ। এ দুটি ব্যতীত কারও হেদায়াত লাভ হতে পারে না। এ আয়াতসমূহে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম অনেকগুলো দোআ করেছিলেন,

১) “আপনার নির্দেশে আমি এই জনমানবহীন প্রান্তরে নিজ পরিবার-পরিজনকে রেখে যাচ্ছি। আপনি একে একটি শান্তিপূর্ণ শহর বানিয়েদিন-যাতে এখানে বসবাস করা আতংকজনক না হয় এবং জীবনধারণের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র সহজলভ্য হয়।” আল্লাহ্ তা'আলা কবুল করেছেন এবং সে উষর মরু প্রান্তর মক্কা নগরীতে পরিণত হয়েছে।

২) “হে রব! শহরটিকে শান্তির ভূমি করে দিন”। অর্থাৎ হত্যা, লুন্ঠন, কাফেরদের অধিকার স্থাপন, বিপদাপদ থেকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ রাখুন। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর এই দোআও কবুল হয়েছে। মক্কা মুকাররামা শুধু একটি জনবহুল নগরীই নয়, সারা বিশ্বের প্রত্যাবর্তনস্থলও বটে। বিশ্বের চারদিক থেকে মুসলিমগণ এ নগরীতে পৌছাকে সর্ববৃহৎ সৌভাগ্য মনে করে। নিরাপদ ও সুরক্ষিতও এতটুকু হয়েছে যে, আজ পর্যন্ত কোন শক্রজাতি অথবা শক্রসম্রাট এর উপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। আল্লাহ তা'আলা হারাম শরীফের চতুঃসীমানায় জীব-জন্তুকেও নিরাপত্তা দান করেছেন। এই এলাকায় শিকার করা জায়েয নয়।

৩) ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর তৃতীয় দোআ এই যে, এ শহরের অধিবাসীদের উপজীবিকা হিসেবে যেন ফল-মূল দান করা হয়। মক্কা-মুকাররমা ও পাশ্ববর্তী ভূমি কোনরূপ বাগ-বাগিচার উপযোগী ছিল না। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছিল না পানির নাম -নিশানা। কিন্তু আল্লাহ্ তা'আলা ইবরাহীমের দোআ কবুল করেন। মক্কার কাছেই তায়েফে যাবতীয় ফলমূল প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয় যা মক্কার বাজারেই বেচা-কেনা হয়। এখনো সারা বিশ্ব থেকে ফলমূল মক্কায় নিয়ে আসা হয়।

৪) ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর চতুর্থ দোআ হচ্ছে, “হে আমাদের রব! আমাদের উভয়কে আপনার একান্ত অনুগত করুন এবং আমাদের বংশধর হতে আপনার এক অনুগত জাতি উত্থিত করুন। আমাদেরকে ইবাদাতের নিয়ম-পদ্ধতি দেখিয়ে দিন এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হোন। আপনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। এ দোআটিও ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান ও আল্লাহভীতিরই ফল, আনুগত্যের অদ্বিতীয় কীর্তি স্থাপন করার পরও তিনি এরূপ দো'আ করেন যে, আমাদের উভয়কে আপনার আজ্ঞাবহ করুন। কারণ, আল্লাহ সম্পর্কিত জ্ঞান যার যত বৃদ্ধি পেতে থাকে সে তত বেশী অনুভব করতে থাকে যে, যথার্থ আনুগত্য তার দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না। এ দোআতে স্বীয় সন্তান-সন্ততিকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এতে বুঝা যায় যে, যিনি আল্লাহর পথে নিজের সন্তান-সন্ততিকে বিসর্জন দিতেও এতটুকু কুন্ঠিত নন, তিনিও সন্তানদের প্রতি কতটুকু আন্তরিকতা ও ভালবাসা রাখেন। আল্লাহর প্রিয় বান্দারা শারিরিকের চাইতে আত্মিক ও জাগতিকের চাইতে পরলৌকিক আরামের জন্য চিন্তা করেন বেশী। এ কারণেই ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দোআ করলেন - “আমার সন্তানদের মধ্য থেকে একটি দলকে পূর্ণ আনুগত্যশীল কর”।

৫) ইবরাহীম 'আলাইহিস সালাম ভবিষ্যত বংশধরদের দুনিয়া ও আখেরাতের সার্বিক মংগলের জন্য আল্লাহর কাছে দোআ করেছেন যে, আমার বংশধরের মধ্যে একজন নবী প্রেরণ করুন - যিনি আপনার আয়াতসমূহ তাদের তিলাওয়াত করে শোনাবেন, কুরআন ও সুন্নাহ শিক্ষা দেবেন এবং বাহ্যিক ও আত্মিক অপবিত্রতা থেকে তাদের পবিত্র করবেন। দোআয় নিজের বংশধরের মধ্য থেকেই নবী হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর কারণ প্রথমতঃ এই যে, এটা তার সন্তানদের জন্য গৌরব-এর বিষয়। দ্বিতীয়তঃ এতে তাদের কল্যাণও নিহিত রয়েছে। কারণ স্বগোত্র থেকে নবী হলে তার চাল-চলন ও অভ্যাস-আচরণ সম্পর্কে তারা উত্তমরূপে অবগত থাকবে। ধোঁকাবাজি ও প্রবঞ্চনার সম্ভাবনা থাকবে না।

তাফসীরে জাকারিয়া

১২৯। হে আমাদের প্রতিপালক! আর তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে এক রসূল প্রেরণ কর, [1] যে তোমার আয়াতসমূহ তাদের নিকট আবৃত্তি করবে; তাদেরকে কিতাব (ধর্মগ্রন্থ) ও হিকমত (জ্ঞান ও প্রজ্ঞা) [2] শিক্ষা দেবে এবং তাদেরকে (শিরক থেকে) পবিত্র করবে। [3] নিশ্চয় তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’

[1] এটা ইবরাহীম (আঃ)-এর শেষ দু'আ। তাঁর এ দু'আও আল্লাহ তাআলা কবুল করেন এবং ইসমাঈল (আঃ)-এর সন্তানের মধ্য থেকে মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে প্রেরণ করেন। আর এই জন্যই রসূল (সাঃ) বলেছেন, আমি হলাম আমার পিতা ইবরাহীম (আঃ)-এর দু'আ, ঈসা (আঃ)-এর সুসংবাদ এবং আমার জননীর স্বপ্ন । (ফাতহুররাব্বানী ২০/১৮১-১৮৯)

[2] 'কিতাব' বলতে কুরআন মাজীদ, আর 'হিকমত' বলতে হাদীস। আয়াতসমূহ তেলাঅত বা আবৃত্তি করার পর কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কুরআন মাজীদের কেবল তেলাঅতও উদ্দিষ্ট ও বাঞ্ছিত এবং তা সওয়াব ও নেকী লাভের মাধ্যম। তবে তার অর্থ ও তাৎপর্যও যদি বুঝা যায়, তাহলে তা হবে সোনার উপর সোহাগা। কিন্তু যদি কেউ কুরআনের তরজমা ও অর্থ না জানে, তবুও তার জন্য তেলাঅতের ব্যাপারে উদাসীনতা জায়েয নয়। কারণ, তেলাঅত করাই পৃথক একটি নেকীর কাজ। তবে যথাসম্ভব তার অর্থ ও উদ্দেশ্য বুঝার চেষ্টা করা উচিত।

[3] তেলাঅত এবং কিতাব ও হিকমতের শিক্ষার পর রসূল (সাঃ)-এর আগমনের এটা হল চতুর্থ উদ্দেশ্য। আর তা হল, তাদেরকে শিরক ও কুসংস্কারের আবর্জনা থেকে এবং চরিত্র ও কর্মের সকল ত্রুটি থেকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করা।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আল-বাকারা
২:১৪৩ وَ کَذٰلِکَ جَعَلۡنٰکُمۡ اُمَّۃً وَّسَطًا لِّتَکُوۡنُوۡا شُهَدَآءَ عَلَی النَّاسِ وَ یَکُوۡنَ الرَّسُوۡلُ عَلَیۡکُمۡ شَهِیۡدًا ؕ وَ مَا جَعَلۡنَا الۡقِبۡلَۃَ الَّتِیۡ کُنۡتَ عَلَیۡهَاۤ اِلَّا لِنَعۡلَمَ مَنۡ یَّتَّبِعُ الرَّسُوۡلَ مِمَّنۡ یَّنۡقَلِبُ عَلٰی عَقِبَیۡهِ ؕ وَ اِنۡ کَانَتۡ لَکَبِیۡرَۃً اِلَّا عَلَی الَّذِیۡنَ هَدَی اللّٰهُ ؕ وَ مَا کَانَ اللّٰهُ لِیُضِیۡعَ اِیۡمَانَکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بِالنَّاسِ لَرَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۱۴۳﴾

আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি, যাতে তোমরা মানুষের উপর সাক্ষী হও এবং রাসূল সাক্ষী হন তোমাদের উপর। আর যে কিবলার উপর তুমি ছিলে, তাকে কেবল এ জন্যই নির্ধারণ করেছিলাম, যাতে আমি জেনে নেই যে, কে রাসূলকে অনুসরণ করে এবং কে তার পেছনে ফিরে যায়। যদিও তা অতি কঠিন (অন্যদের কাছে) তাদের ছাড়া যাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত করেছেন এবং আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তোমাদের ঈমানকে বিনষ্ট করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল, পরম দয়ালু। আল-বায়ান

আর এভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মাত করেছি, যাতে তোমরা লোকেদের উপর সাক্ষী হও এবং নাবী তোমাদের উপর সাক্ষী হয়। আর তুমি এ যাবৎ যে ক্বিবলার উপর ছিলে, তাকে এ উদ্দেশ্যে ক্বিবলা করেছিলাম, যাতে আমি জানতে পারি কে রসূলের অনুসরণ করে আর কে পায়ের ভরে উল্টো দিকে ফিরে যায়। আল্লাহ যাদেরকে হিদায়াত দিয়েছেন তারা বাদে অন্যের নিকট এটা বড়ই কষ্টকর ছিল। আর আল্লাহ তোমাদের ঈমান বিনষ্ট করবেন না, নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি করুণাশীল, অতি দয়ালু। তাইসিরুল

এভাবে আমি তোমাদেরকে আদর্শ জাতি করেছি, যেন তোমরা মানবগণের জন্য সাক্ষী হও এবং রাসূলও তোমাদের জন্য সাক্ষী হয়; এবং তুমি যে কিবলার দিকে ছিলে তা আমি এ জন্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম যে, কে রাসূলের অনুসরণ করে, আর কে তা হতে স্বীয় পদদ্বয়ে পশ্চাতে ফিরে যায় আমি তা জেনে নিব এবং আল্লাহ যাদেরকে পথ প্রদর্শন করেছেন তারা ছাড়া অপরের জন্য এটি অবশ্যই কঠোরতর; এবং আল্লাহ এরূপ নন যে, তোমাদের বিশ্বাস বিনষ্ট করেন; নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি স্নেহশীল, করুণাময়। মুজিবুর রহমান

And thus we have made you a just community that you will be witnesses over the people and the Messenger will be a witness over you. And We did not make the qiblah which you used to face except that We might make evident who would follow the Messenger from who would turn back on his heels. And indeed, it is difficult except for those whom Allah has guided. And never would Allah have caused you to lose your faith. Indeed Allah is, to the people, Kind and Merciful. Sahih International

১৪৩. আর এভাবে আমরা তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী(১) জাতিতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির উপর স্বাক্ষী হও(২) এবং রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হতে পারেন।(৩) আর আপনি এ যাবত যে কিবলা অনুসরণ করছিলেন সেটাকে আমরা এ উদ্দেশ্যে কেবলায় পরিণত করেছিলাম যাতে প্রকাশ করে দিতে পারি(৪) কে রাসূলের অনুসরণ করে এবং কে পিছনে ফিরে যায়? আল্লাহ্‌ যাদেরকে হিদায়াত করেছেন তারা ছাড়া অন্যদের উপর এটা নিশ্চিত কঠিন। আল্লাহ এরূপ নন যে, তোমাদের ঈমানকে ব্যর্থ করে দিবেন(৫)। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল, পরম দয়ালু।

(১) وَسَطًا শব্দের অর্থ সর্বোৎকৃষ্ট বিষয়। আবু সায়ীদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম عدل শব্দ দ্বারা وسط এর ব্যাখ্যা করেছেন। [বুখারী: ৭৩৪৯] এর অর্থ সর্বোৎকৃষ্ট। আবার وسط অর্থ হয় মধ্যবর্তী, মধ্যপন্থী। সে হিসাবে এ আয়াতে মুসলিম সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব ও সম্মানের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, এ সম্প্রদায়কে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করা হয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়কে মধ্যপন্থী, ভারসাম্যপূর্ণ সম্প্রদায় বলে অভিহিত করে বলা হয়েছে যে, মানবীয় মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব তাদের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান। যে উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের যাবতীয় কর্মধারা অব্যাহত রয়েছে এবং নবী ও আসমানী গ্রন্থসমূহ প্রেরিত হয়েছে, তাতে এ সম্প্রদায় অপরাপর সম্প্রদায় থেকে স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী ও শ্রেষ্ঠ। কুরআন বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্নভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের এ শ্রেষ্ঠত্বের কথা বর্ণনা করেছে।

বলা হয়েছে, আর আমরা যাদের সৃষ্টি করেছি তাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় রয়েছে, যারা সৎপথ প্রদর্শন করে এবং সে অনুযায়ী ন্যায়বিচার করে। [সূরা আল-আরাফ: ১৮১] এতে মুসলিম সম্প্রদায়ের আত্মিক ও চারিত্রিক ভারসাম্য আলোচিত হয়েছে যে, তারা ব্যক্তিগত স্বার্থ ও কামনা-বাসনা বিসর্জন দিয়ে আসমানী গ্রন্থের নির্দেশ অনুযায়ী নিজেরাও চলে এবং অন্যদেরকেও চালাবার চেষ্টা করে। কোন ব্যাপারে কলহ-বিবাধ সৃষ্টি হলে তার মীমাংসাও তারা গ্রন্থের সাহায্যেই করে, যাতে কোন ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের স্বার্থপরতার কোন আশংকা নেই। অন্য সূরায় মুসলিম সম্প্রদায়ের আত্মিক ভারসাম্য এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ তোমরাই সে কাজের আদেশ করবে, মন্দকাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান রাখবে। [সূরা আলে-ইমরান: ১১০] অর্থাৎ মুসলিমরা যেমন সব নবীর শ্রেষ্ঠতম নবীপ্রাপ্ত হয়েছে, সব গ্রন্থের সর্বাধিক পরিব্যপ্ত ও পূর্ণতর গ্রন্থ লাভ করেছে, তেমনি সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সুস্থ মেজাজ এবং ভারসাম্যও সর্বাধিক পরিমাণে প্রাপ্ত হয়েছে।

ফলে তারাই সকল সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ সম্প্রদায় সাব্যস্ত হয়েছে। তাদের সামনে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তত্ত্ব-রহস্যের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়েছে। ঈমান, আমল ও আল্লাহ ভীতির সমস্ত শাখাপ্রশাখা ত্যাগের বদৌলতে সজীব ও সতেজ হয়ে উঠবে। তারা কোন বিশেষ দেশ ও ভৌগলিক সীমার বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে না। তাদের কর্মক্ষেত্র হবে সমগ্র বিশ্ব এবং জীবনের সকল শাখায় পরিব্যপ্ত। তাদের অস্তিত্বই অন্যের হিতাকাংখা ও তাদেরকে জান্নাতের দ্বারে উপনীত করার কাজে নিবেদিত। এ সম্প্রদায়টি গণমানুষের হিতাকাংখা ও উপকারের নিমিত্তই সৃষ্ট। তাদের অভীষ্ট কর্তব্য ও জাতীয় পরিচয় এই যে, তারা মানুষকে সৎকাজের দিকে পথ দেখাবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকেও মুসলিম জাতি এক ভারসাম্যপূর্ণ সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে রয়েছে, ঈমানের ভারসাম্য। পূর্ববতী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে একদিকে দেখা যায়, তারা নবীগণকে আল্লাহর পুত্ৰ মনে করে তাদের উপাসনা ও আরাধনা করতে শুরু করেছে। যেমন, এক আয়াতে রয়েছেঃ ইয়াহুদীরা বলেছে, ওযায়ের আল্লাহর পুত্র এবং নাসারারা বলেছে, মসীহ আল্লাহর পুত্র। [সূরা আত-তাওবাহঃ ৩০]

অপরদিকে এসব সম্প্রদায়েরই অনেকে নবীর উপর্যুপরি মু'জিযা দেখা সত্বেও তাদের নবী যখন তাদেরকে কোন ন্যায়যুদ্ধে আহবান করেছেন, তখন তারা পরিস্কার বলে দিয়েছে, আপনি এবং আপনার পালনকর্তাই যান এবং শক্রদের সাথে যুদ্ধ করুন। আমরা এখানেই বসে থাকব সূরা আল-মায়েদাহ: ২৪] আবার কোথাও নবীগণকে স্বয়ং তাদের অনুসারীদেরই হাতে নির্যাতিত হতে দেখা গেছে। পক্ষান্তরে মুসলিম সম্প্রদায়ের অবস্থা তা নয়। তারা একদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি এমন আনুগত্য ও ভালবাসা পোষণ করে যে, এর সামনে জান-মাল, সন্তান-সন্ততি, ইজ্জত-আব্রু সবকিছু বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হয় না। অপরদিকে রাসূলকে রাসূল এবং আল্লাহকে আল্লাহই মনে করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তারা আল্লাহর দাস ও রাসূল বলেই বিশ্বাস করে এবং মুখে প্রকাশ করে। তার প্রশংসা এবং গুণগান করতে গিয়েও তারা একটা সীমার ভেতর থাকে।

তাছাড়া মুসলিমদের মধ্যে রয়েছে, কর্ম ও ইবাদাতের ভারসাম্য। পূর্ববর্তী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে একদিকে দেখা যায়, তারা শরীআতের বিধি-বিধানগুলোকে কানাকড়ির বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়, ঘুষ-উৎকোচ নিয়ে আসমানী গ্রন্থকে পরিবর্তন করে অথবা মিথ্যা ফতোয়া দেয়, বাহানা ও অপকৌশলের মাধ্যমে ধর্মীয় বিধান পরিবর্তন করে এবং ইবাদাত থেকে গা বাঁচিয়ে চলে। অপরদিকে তাদের উপাসনালয়সমূহে এমন লোকও দেখা যায়, যারা সংসারধর্ম ত্যাগ করে বৈরাগ্য অবলম্বন করেছে। তারা আল্লাহ প্রদত্ত হালাল নেয়ামত থেকেও নিজেদের বঞ্চিত রাখে এবং কষ্ট সহ্য করাকেই সওয়াব ও ইবাদাত বলে মনে করে। পক্ষান্তরে মুসলিম সম্প্রদায় একদিকে বৈরাগ্যকে মানবতার প্রতি যুলুম বলে মনে করে এবং অপরদিকে আল্লাহ ও রাসূলের বিধি-বিধানের জন্য জীবন বিসর্জন দিতেও কুন্ঠা বোধ করে না। অনুরূপভাবে তাদের মধ্যে রয়েছে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্য।

পূর্ববর্তী উম্মতসমূহের মধ্যে একদিকে দেখা যায়, তারা মানবাধিকারের প্রতি পরোয়াও করেনি; ন্যায়-অন্যায়ের তো কোন কথাই নেই। মহিলাদের অধিকার দান করা তো দূরের কথা, তাদের জীবিত থাকার অনুমতি পর্যন্ত দেয়া হত না। কোথাও প্রচলিত ছিল শৈশবেই তাদের জীবন্ত সমাহিত করার প্রথা এবং কোথাও মৃত স্বামীর সাথে স্ত্রীকে দাহ করার প্রথা। অপরদিকে এমন নির্বোধ দয়াদ্রতারও প্রচলন ছিল যে, পোকামাকড় হত্যা করাকেও অবৈধ জ্ঞান করা হত। কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায় ও তাদের শরীআত এসব ভারসাম্যহীনতার অবসান ঘটিয়েছে। তারা একদিকে মানুষের সামনে মানবাধিকারকে তুলে ধরেছে। শুধু শান্তি ও সন্ধির সময়ই নয়, যুদ্ধ ক্ষেত্রেও শক্রর অধিকার সংরক্ষণে সচেতনতা শিক্ষা দিয়েছে। অপরদিকে প্রত্যেক কাজের একটা সীমা নির্ধারণ করেছে, যা লংঘন করাকে অপরাধ সাব্যস্ত করেছে। তদ্রুপভাবে তাদের মধ্যে রয়েছে, অর্থনৈতিক ভারসাম্য।

অর্থনীতিতে অপরাপর সম্প্রদায়ের মধ্যে বিস্তর ভারসাম্যহীনতা পরিলক্ষিত হয়। একদিকে রয়েছে পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা। এতে হালাল-হারাম এবং অপরের সুখ-শান্তি ও দুঃখদুরাবস্থা থেকে চক্ষু বন্ধ করে অধিকতর ধন-সম্পদ সঞ্চয় করাকেই সর্ববৃহৎ মানবিক সাফল্য গণ্য করা হয়। অপরদিকে রয়েছে সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা। এতে ব্যক্তি মালিকানাকেই অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়। মুসলিম সম্প্রদায় ও তাদের শরীআত এক্ষেত্রেও ভারসাম্যপূর্ণ অভিনব অর্থ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। ইসলামী শরীআত একদিকে ধন-সম্পদকে জীবনের লক্ষ্য মনে করতে বারণ করেছে এবং সম্মান, ইজ্জত ও পদমর্যাদা লাভকে এর উপর নির্ভরশীল রাখেনি; অপরদিকে সম্পদ বন্টনের নিষ্কলুষ নীতিমালা প্রণয়ন করে দিয়েছে যাতে কোন মানুষ জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ থেকে বঞ্চিত না থাকে এবং কেউ সমগ্র সম্পদ কুক্ষিগত করে না বসে। এছাড়া সম্মিলিত মালিকানাভুক্ত বিষয়-সম্পত্তিকে যৌথ ও সাধারণ ওয়াকফের আওতায় রেখেছে। বিশেষ বস্তুর মধ্যে ব্যক্তিমালিকানার প্রতি সম্মান দেখিয়েছে। হালাল মালের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেছে এবং তা রাখার ও ব্যবহার করার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে।

(২) এ আয়াত থেকে কয়েকটি বিষয় জানা গেল, ১. মুসলিম সম্প্রদায়কে ভারসাম্যপূর্ণ তথা ন্যায়ানুগ করা হয়েছে যাতে তারা সাক্ষাদানের যোগ্য হয়। সুতরাং যে ব্যক্তি আদেল বা ন্যায়ানুগ নয়, সে সাক্ষ্যদানেরও যোগ্য নয়। আদেলের অর্থ সাধারণতঃ নির্ভরযোগ্য করা হয়। ২. ইজমা শরীআতের দলীল। ইমাম কুরতুবী বলেনঃ ইজমা (মুসলিম আলেমদের ঐক্যমত) যে শরীআতের একটি দলীল, আলোচ্য আয়াতটি তার প্রমাণ। কারণ, আল্লাহ্ তা'আলা এ সম্প্রদায়কে সাক্ষ্যদাতা সাব্যস্ত করে অপরাপর সম্প্রদায়ের বিপক্ষে তাদের বক্তব্যকে দলীল করে দিয়েছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, এ সম্প্রদায়ের ইজমা বা ঐকমত্যও একটি দলীল এবং তা পালন করা ওয়াজিব।

(৩) এ উম্মাত হাশরের ময়দানে একটি স্বাতন্ত্র্য লাভ করবে। সকল নবীর উম্মতরা তাদের হিদায়াত ও প্রচারকার্য অস্বীকার করে বলতে থাকবে, দুনিয়াতে আমাদের কাছে কোন আসমানী গ্রন্থ পৌছেনি এবং কোন নবীও আমাদের হেদায়াত করেননি। তখন মুসলিম সম্প্রদায় নবীগণের পক্ষে সাক্ষ্যদাতা হিসেবে উপস্থিত হবে এবং সাক্ষ্য দেবে যে, নবীগণ সর্বযুগেই আল্লাহর পক্ষ থেকে আনীত হিদায়াত তাদের কাছে পৌছে দিয়েছেন। একাধিক হাদীসে সংক্ষেপে ও সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা নূহ আলাইহিস সালাম-কে ডেকে বলবেন, হে নূহ আপনি কি আমার বাণী লোকদের কাছে পৌছিয়েছেন? তিনি বলবেন, হ্যাঁ।

তখন তার উম্মতকে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তোমাদের কাছে কি তিনি কিছু পৌছিয়েছেন? তারা বলবে, আমাদের কাছে কোন সাবধানকারী আসেনি। তখন আল্লাহ বলবেনঃ হে নূহ আপনার পক্ষে কে সাক্ষ্য দেবে? তিনি বলবেন, মুহাম্মাদ ও তার উম্মত। তখন তারা সাক্ষ্য দেবে যে, নূহ আলাইহিস সালাম আল্লাহর বাণী লোকদের কাছে পৌছিয়েছেন। আর রাসূল তখন তোমাদের সত্যতার উপর সাক্ষ্য দেবেন। এটাই হলো আল্লাহর বাণীঃ “এভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী জাতিতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির উপর স্বাক্ষী হও এবং রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হতে পারেন।” [বুখারীঃ ৪৪৮৭]

(৪) আয়াতে যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, তা হচ্ছে, لِنَعْلَمَ এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, ‘যাতে আমরা জানতে পারি’। আয়াতের বাহ্যিক অর্থ থেকে কেউ কেউ এটা মনে করতে পারে যে, (নাউযুবিল্লাহ) আল্লাহ বুঝি আগে জানতেন না, ঘটনা ঘটার পরে জানেন। মূলত: এ ধরনের বোঝার কোন অবকাশই ইসলামী শরীআতে নেই। কারণ, আল্লাহ তা'আলা আগে থেকেই সবকিছু জানেন। কিন্তু আল্লাহ্ তা'আলা বান্দাকে পরীক্ষার মাধ্যমে তার জানা বিষয়টি অনুসারে বান্দার কর্মকাণ্ড সংঘটিত হতে দিয়ে বান্দার উপর তার প্রমাণাদি প্রতিষ্ঠা করেন। যাতে করে তার জানার উপর ন্যায় বরং বাস্তব ভিত্তিতে তিনি বান্দাকে সওয়াব বা শাস্তি দিতে পারেন। মূলত: এর মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা বান্দার পরীক্ষা নিয়ে থাকেন।

যেমন অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “এটা এজন্যে যে, আল্লাহ তোমাদের অন্তরে যা আছে তা পরীক্ষা করেন এবং তোমাদের মনে যা আছে তা পরিশোধন করেন। আর অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে আল্লাহ বিশেষভাবে অবহিত।” [সূরা আলে ইমরান ১৫৪] এ আয়াতে পরীক্ষা করার কথা বলার মাধ্যমে এ কথাটি স্পষ্ট হয়েছে যে, আল্লাহ আগে থেকেই জানেন। কিন্তু তার উদ্দেশ্য পরীক্ষা করা। এ অর্থের সমর্থন পাওয়া যায় আয়াতের শেষে ‘আর অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে আল্লাহ বিশেষভাবে অবহিত এ কথা বলার মাধ্যমে। এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেলে পবিত্র কুরআনের অন্যত্র যেমন, সূরা আল-কাহাফ: ১২, সাবা ২১ এ ব্যবহৃত لِنَعْلَمَ শব্দটির অর্থ স্পষ্ট হয়ে যাবে এবং কোন সন্দেহের উদ্রেক হবে না। [আদওয়াউল বায়ান]

(৫) এখানে ঈমান শব্দ দ্বারা ঈমানের প্রচলিত অর্থ নেয়া হলে আয়াতের মর্ম হবে এই যে, কেবলা পরিবর্তনের ফলে নির্বোধেরা মনে করতে থাকে যে, এরা দ্বীন ত্যাগ করেছে কিংবা এদের ঈমান নষ্ট হয়ে গেছে। উত্তরে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা তোমাদের ঈমান নষ্ট করবেন না। কাজেই তোমরা নির্বোধদের কথায় কর্ণপাত করো না। কোন কোন মনীষীদের উক্তিতে এখানে ঈমানের অর্থ করা হয়েছে সালাত। মৰ্মাৰ্থ এই যে, সাবেক কেবলা বায়তুল-মুকাদ্দাসের দিকে মুখ করে যেসব সালাত আদায় করা হয়েছে, আল্লাহ্ তা'আলা সেগুলো নষ্ট করবেন না; বরং তা শুদ্ধ ও মকবুল হয়েছে।

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, কাবাকে কেবলা করার পর অনেকেই প্রশ্ন করে যে, যে সব মুসলিম ইতিমধ্যে ইন্তেকাল করেছেন, তারা বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে সালাত আদায় করে গেছেন- কাবার দিকে সালাত আদায় করার সুযোগ পাননি, তাদের কি হবে? এ প্রশ্নের প্রেক্ষিতেই আলোচ্য আয়াত নাযিল হয় ৷ [বুখারীঃ ৪৪৮৬] এতে সালাতকে ঈমান শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে যে, ১. তাদের সব সালাতই শুদ্ধ ও গ্রহণীয়। তাদের ব্যাপারে কেবলা পরিবর্তনের কোন প্রতিক্রিয়া হবে না। ২. আমল ঈমানের অংগ ৷ ৩. সালাত ঈমানের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যে, সালাতকে বোঝানোর জন্য মহান আল্লাহ তা'আলা ঈমান শব্দ ব্যবহার করেছেন।

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৪৩) এভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি, [1] যাতে তোমরা মানব জাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ হতে পার এবং রসূল তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ হবে। তুমি এ যাবৎ যে ক্বিবলার অনুসরণ করছিলে, তা এই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম, যাতে আমি জানতে পারি[2] যে, কে রসূলের অনুসরণ করে এবং কে ফিরে যায়? আল্লাহ যাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করেছেন, তারা ছাড়া অন্যের কাছে এ (পরিবর্তন) নিশ্চয় কঠিন ব্যাপার।[3] আর আল্লাহ এরূপ নন যে, তিনি তোমাদের বিশ্বাস (ঈমান তথা নামায)কে ব্যর্থ করবেন।[4] নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি অতি দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।

[1] وَسَطٌ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল, মধ্যম। কিন্তু তা শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম অর্থেও ব্যবহার হয়। আর এখানে এই (সর্বোত্তম) অর্থেই ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ, যেমন তোমাদেরকে সর্বোত্তম ক্বিবলা দেওয়া হয়েছে, অনুরূপ তোমাদেরকে সর্বোত্তম উম্মতও করা হয়েছে এবং এর উদ্দেশ্য হল, তোমরা মানুষের জন্য সাক্ষ্য দেবে। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে,

{لِيَكُونَ الرَّسُولُ شَهِيدًا عَلَيْكُمْ وَتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ} যাতে রসূল তোমাদের জন্যে সাক্ষ্যদাতা এবং তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমন্ডলীর জন্যে। (সূরা হাজ্জ ৭৮ আয়াত) কোন কোন হাদীসে এর বিশ্লেষণ এইভাবে এসেছে যে, যখন মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন নবীদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন, তোমরা কি আমার আদেশ মানুষদের নিকট পৌঁছে দিয়েছিলে? তাঁরা বলবেন, 'হ্যাঁ।' আল্লাহ তাআলা বলবেন, তোমাদের কি কোন সাক্ষী আছে? তাঁরা বলবেন, হ্যাঁ, মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং তাঁর উম্মত। তখন এই উম্মত সাক্ষ্য দেবে। আর এই জন্য وَسَط এর অনুবাদ ন্যায়পন্থীও করা হয়। (ইবনে কাসীর) এ শব্দের আর একটি অর্থ, মধ্যপন্থীও করা হয়। অর্থাৎ, উম্মতে মুহাম্মাদী হল মধ্যপন্থী অর্থাৎ, অতিরঞ্জন ও অবজ্ঞা থেকে তারা পবিত্র। আর এটাই হল ইসলামের শিক্ষা। এতে অতিরঞ্জন (কোন কিছুকে নিয়ে বাড়াবাড়ি) এবং অবজ্ঞা (কোন জিনিসকে তার উপযুক্ত মর্যাদা থেকে একেবারে নীচে নামানোরও কোন অবকাশ) নেই।

[2] لِنَعْلَمَ (যাতে আমি জানতে পারি) আল্লাহ তো আগে থেকেই জানেন। আসলে এর অর্থ হল, যাতে আমি দৃঢ় প্রত্যয়ীদেরকে সংশয়ীদের থেকে পৃথক করে দি এবং মানুষের সামনেও যেন উক্ত দুই শ্রেণীর লোক স্পষ্ট হয়ে যায়। (ফাতহুল ক্বাদীর)

[3] এখানে ক্বিবলা পরিবর্তনের একটি উদ্দেশ্যর কথা বলা হচ্ছে। নিষ্ঠাবান মুমিনরা তো কেবল আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর চোখের ইঙ্গিতের অপেক্ষায় থাকতেন। কাজেই তাঁদের জন্য একদিক থেকে অন্য দিকে ফিরে যাওয়া কোন সমস্যার ব্যাপার ছিল না, বরং একটি মসজিদে তো ক্বিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ তখন পৌঁছে, যখন তাঁরা রুকুতে ছিলেন। তাঁরা রুকুর অবস্থাতেই নিজেদের মুখমন্ডল কাবার দিকে ফিরিয়ে নিলেন। এটাকে মসজিদে ক্বিবলাতাইন (অর্থাৎ, সেই মসজিদ যেখানে একটিই নামায দু'টি ক্বিবলার দিকে মুখ করে পড়া হয়েছে।) বলা হয়। অনুরূপ ঘটনা ক্বুবার মসজিদেও ঘটেছে।

[4] কোন কোন সাহাবা (রাঃ)-এর মনে এই সমস্যার উদয় হল যে, যে সাহাবাগণ বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামায পড়ার যুগে মৃত্যুবরণ করেছেন অথবা আমরা যতদিন সেদিকে মুখ করে নামায পড়েছি, সে সবই মনে হয় বিফলে গেছে, তার মনে হয় কোন সওয়াব পাওয়া যাবে না। মহান আল্লাহ বললেন, তোমাদের ঐ নামাযগুলো ব্যর্থ হবে না; বরং তোমরা তার পূর্ণ সওয়াব পাবে। আর এখানে নামাযকে বিশ্বাস বা ঈমান বলে আখ্যায়িত করে এ কথাও পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে যে, নামায ব্যতীত ঈমানের কোন মূল্য নেই। ঈমান তখনই ঈমান বলে গণ্য হবে, যখন নামায ও আল্লাহর অন্যান্য বিধানসমূহের যত্ন নেওয়া হবে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আল-বাকারা
২:১৫১ کَمَاۤ اَرۡسَلۡنَا فِیۡکُمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡکُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡکُمۡ اٰیٰتِنَا وَ یُزَکِّیۡکُمۡ وَ یُعَلِّمُکُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ یُعَلِّمُکُمۡ مَّا لَمۡ تَکُوۡنُوۡا تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۵۱﴾ؕۛ

যেভাবে আমি তোমাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি তোমাদের মধ্য থেকে, যে তোমাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে, তোমাদেরকে পবিত্র করে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়। আর তোমাদেরকে শিক্ষা দেয় এমন কিছু যা তোমরা জানতে না। আল-বায়ান

যেমন (তোমরা আমার একটি অনুগ্রহ লাভ করেছ যে) আমি তোমাদেরই মধ্য হতে তোমাদের কাছে একজন রসূল পাঠিয়েছি, যে আমার আয়াতগুলো তোমাদেরকে পড়ে শুনায়, তোমাদেরকে শুদ্ধ করে, তোমাদেরকে কিতাব ও জ্ঞান-বিজ্ঞান (সুন্নাত) শিক্ষা দেয় এবং তোমাদেরকে এমন সব বিষয় শিক্ষা দেয় যা তোমরা জানতে না। তাইসিরুল

আমি তোমাদের মধ্য হতে এরূপ রাসূল প্রেরণ করেছি যে তোমাদের নিকট আমার নিদর্শনাবলী পাঠ করে এবং তোমাদেরকে পবিত্র করে, তোমাদেরকে গ্রন্থ ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেয় এবং তোমরা যা অবগত ছিলেনা তা শিক্ষা দান করে। মুজিবুর রহমান

Just as We have sent among you a messenger from yourselves reciting to you Our verses and purifying you and teaching you the Book and wisdom and teaching you that which you did not know. Sahih International

১৫১. যেমন আমরা তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে রাসূল পাঠিয়েছি(১) যিনি তোমাদের কাছে আমাদের আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করেন, তোমাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেন। আর তা শিক্ষা দেন যা তোমরা জানতে না।

(১) এ পর্যন্ত কেবলা পরিবর্তন সংক্রান্ত আলোচনা চলে আসছিল। এখানে বিষয়টিকে এমন এক পর্যায়ে এনে সমাপ্ত করা হয়েছে, যাতে বিষয়টির ভূমিকায় কা’বা নির্মাতা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর দো'আর বিষয়টিও প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর বংশধরদের মধ্যে এক বিশেষ মর্যাদায় মহানবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাব। এতে এ বিষয়েও ইংগিত করা হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাবে কা'বা নির্মাতার দো'আরও একটা প্রভাব রয়েছে। কাজেই তার কেবলা যদি কা'বা শরীফকে সাব্যস্ত করা হয়, তাহলে তাতে বিস্ময়ের কিংবা অস্বীকারের কিছু নেই।

(كَمَا أَرْسَلْنَاكَ) বাক্যে উদাহরণসূচক যে ‘কাফ (ك) বর্ণটি ব্যবহার করা হয়েছে, তার একটি ব্যাখ্যা তো উল্লেখিত তাফসীরের মাধ্যমেই বুঝা গেছে। এছাড়াও আরেকটি বিশ্লেষণ রয়েছে, যা কুরতুবী গ্রহণ করেছেন। তা হলো এই যে, ‘কাফ’ এর সম্পর্ক হলো পরবর্তী আয়াত (فَاذْكُرُونِي) এর সাথে। অর্থাৎ আমি যেমন তোমাদের প্রতি কেবলাকে একটি নেয়ামত হিসাবে দান করেছি অতঃপর দ্বিতীয় নেয়ামত দিয়েছি রাসূলের আবির্ভাবের মাধ্যমে, তেমনি আল্লাহর যিকরও আরেকটি নেয়ামত। সুতরাং এসব নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় কর, যাতে এসব নেয়ামতের অধিকতর প্রবৃদ্ধি হতে পারে। [তাফসীরে মা'আরিফুল কুরআন]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৫১) যেভাবে[1] আমি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদেরই একজনকে রসূল করে পাঠিয়েছি, যে আমার আয়াত (বাক্য)সমূহ তোমাদের কাছে পাঠ করে, তোমাদেরকে (শিরক হতে) পবিত্র করে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়।

[1] كَمَا (যেভাবে) এর সম্পর্ক পূর্বের বক্তব্যের সাথে। অর্থাৎ, উক্ত অনুগ্রহের পরিপূর্ণতা এবং হিদায়াতের তওফীক তোমরা ঐভাবেই পেয়েছ, যেভাবে এর আগে তোমাদের মধ্য থেকে একজন রসূল প্রেরণ করা হয়েছে, যে তোমাদেরকে পবিত্র করে, তোমাদেরকে কিতাব ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেয় এবং এমন বিষয়ও শিক্ষা দেয় যা তোমরা জানতে না।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আল-বাকারা
২:২১৩ کَانَ النَّاسُ اُمَّۃً وَّاحِدَۃً ۟ فَبَعَثَ اللّٰهُ النَّبِیّٖنَ مُبَشِّرِیۡنَ وَ مُنۡذِرِیۡنَ ۪ وَ اَنۡزَلَ مَعَهُمُ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ لِیَحۡکُمَ بَیۡنَ النَّاسِ فِیۡمَا اخۡتَلَفُوۡا فِیۡهِ ؕ وَ مَا اخۡتَلَفَ فِیۡهِ اِلَّا الَّذِیۡنَ اُوۡتُوۡهُ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَتۡهُمُ الۡبَیِّنٰتُ بَغۡیًۢا بَیۡنَهُمۡ ۚ فَهَدَی اللّٰهُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لِمَا اخۡتَلَفُوۡا فِیۡهِ مِنَ الۡحَقِّ بِاِذۡنِهٖ ؕ وَ اللّٰهُ یَهۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ ﴿۲۱۳﴾

মানুষ ছিল এক উম্মত। অতঃপর আল্লাহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে নবীদেরকে প্রেরণ করলেন এবং সত্যসহ তাদের সাথে কিতাব নাযিল করলেন, যাতে মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করত। আর তারাই তাতে মতবিরোধ করেছিল, যাদেরকে তা দেয়া হয়েছিল, তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষবশত। অতঃপর আল্লাহ নিজ অনুমতিতে মুমিনদেরকে হিদায়াত দিলেন যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছিল। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন। আল-বায়ান

মানুষ একই দলভুক্ত ছিল। তারপর আল্লাহ তাদের নিকট নাবীগণকে প্রেরণ করেন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে এবং তাদের মাধ্যমে কিতাব নাযিল করেন সত্যভাবে, মানুষদের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য যে বিষয়ে তারা মতপার্থক্য করেছিল। এতদসত্ত্বেও যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল, তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণাদি আসার পর পারস্পরিক জিদের কারণেই তারা মতভেদ সৃষ্টি করল। অতঃপর আল্লাহ বিশ্বাসীদেরকে সেই সত্য পথ নিজের করুণায় দেখিয়ে দিলেন, যে সম্বন্ধে তারা মতভেদ করছিল, আল্লাহ যাকে ইচ্ছে সোজা পথ প্রদর্শন করেন। তাইসিরুল

মানব জাতি একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল; অতঃপর আল্লাহ সুসংবাদ বাহক ও ভয় প্রদর্শক রূপে নাবীগণকে প্রেরণ করলেন এবং তিনি তাদের সাথে সত্যসহ গ্রন্থ অবতীর্ণ করলেন যেন (ঐ কিতাব) তাদের মতভেদের বিষয়গুলি সম্বন্ধে মীমাংসা করে দেয়, অথচ যারা কিতাব প্রাপ্ত হয়েছিল, স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ তাদের নিকট সমাগত হওয়ার পর, পরস্পরের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ বশতঃ তারা সেই কিতাবকে নিয়ে মতভেদ ঘটিয়ে বসলো, বিশ্বাস স্থাপনকারীরা যে বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করত আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে সেই বিষয়ে তাদেরকে সত্য পথে পরিচালিত করেন। আল্লাহর যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে পরিচালিত করেন। মুজিবুর রহমান

Mankind was [of] one religion [before their deviation]; then Allah sent the prophets as bringers of good tidings and warners and sent down with them the Scripture in truth to judge between the people concerning that in which they differed. And none differed over the Scripture except those who were given it - after the clear proofs came to them - out of jealous animosity among themselves. And Allah guided those who believed to the truth concerning that over which they had differed, by His permission. And Allah guides whom He wills to a straight path. Sahih International

২১৩. সমস্ত মানুষ ছিল একই উম্মত(১)। অতঃপর আল্লাহ নবীগণকে প্রেরণ করেন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে এবং তাদের সাথে সত্যসহ কিতাব নাযিল করেন(২) যাতে মানুষেরা যে বিষয়ে মতভেদ করত সেসবের মীমাংসা করতে পারেন। আর যাদেরকে তা দেয়া হয়েছিল, স্পষ্ট নিদর্শন তাদের কাছে আসার পরে শুধু পরস্পর বিদ্বেষবশত সে বিষয়ে তারা বিরোধিতা করত। অতঃপর আল্লাহ তার ইচ্ছাক্রমে ঈমানদারদেরকে হেদায়াত করেছেন সে সত্য বিষয়ে, যে ব্যাপারে তারা মতভেদে লিপ্ত হয়েছিল(৩)। আর আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছে সরল পথের দিকে হেদায়াত করেন।

(১) এ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, কোন এককালে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ একই মতাদর্শের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারা নিঃসন্দেহে তাওহীদের উপর ছিল। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আদম ও নূহ আলাইহিমুস্ সালাম-এর মাঝে দশটি প্রজন্ম গত হয়েছেন, যারা সবাই তাওহীদের উপর ছিলেন। অন্য বর্ণনায় কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আদম ও নূহ আলাইহিমুস্ সালাম-এর মাঝে দশটি প্রজন্ম হিদায়াতের উপর ছিল। [তাফসীরে তাবারী]

অতঃপর তাদের মধ্যে আকীদা, বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার বিভিন্নতা দেখা দেয়। ফলে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করা বা পরিচয় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই আল্লাহ্ তা'আলা সত্য ও সঠিক মতকে প্রকাশ করার জন্য এবং সঠিক পথ দেখাবার লক্ষ্যে নবী ও রাসূলগণকে প্রেরণ করেন, তাদের প্রতি আসমানী কিতাব নাযিল করেন। নবীগণের চেষ্টা পরিশ্রমের ফলে মানুষ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল আল্লাহর প্রেরিত রাসূল এবং তাদের প্রদর্শিত সত্য-সঠিক পথ ও মতকে গ্রহণ করে নেয়। আর একদল তা প্রত্যাখ্যান করে নবীগণকে মিথ্যা বলে। প্রথমোক্ত দল নবীগণের অনুসারী এবং মুমিন বলে পরিচিত, আর শেষোক্ত দলটি নবীগণের অবাধ্য ও অবিশ্বাসী এবং কাফের বলে পরিচিত।

এ আয়াত দ্বারা আরও বুঝা যায় যে, দ্বীনের ভিত্তিতেই জাতীয়তা নির্ধারিত হয়। মুসলিম ও অমুসলিম দুটি জাতি হিসেবে চিহ্নিত করাই এর মূল উদ্দেশ্য। এ প্রসঙ্গে (فَمِنْكُمْ كَافِرٌ وَمِنْكُمْ مُؤْمِنٌ) [সূরা আত-তাগাবুনঃ ২] আয়াতটিও একটি প্রমাণ। এতদসঙ্গে এ কথাও পরিস্কারভাবে বোঝা গেল যে, ইসলামের মধ্যে এ দু'টি জাতীয়তা সৃষ্টির ব্যবস্থাও একটি একক জাতীয়তা সৃষ্টি করার জন্যই, যা সৃষ্টির আদিতে ছিল। যার বুনিয়াদ দেশ ও ভৌগলিক সীমার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল না। বরং একক বিশ্বাস ও একক দ্বীনের অনুসরণের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এরশাদ হয়েছে যে, (كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً) সৃষ্টির আদিতে সঠিক বিশ্বাস এবং সত্য দ্বীনের অনুসারীরূপে একক জাতীয়তা প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু পরে মানুষ বিভেদ সৃষ্টি করেছে। নবীগণ মানুষকে এ প্রকৃত একক জাতীয়তার দিকে আহবান করেছেন। যারা তাদের এ আহবানে সাড়া দেয়নি, তারা একক জাতীয়তা থেকে আলাদা হয়ে পড়েছে এবং বিচ্ছিন্ন জাতীয়তা গঠন করেছে।

(২) আর যেহেতু পূর্ববর্তী কিতাবগুলোতে পরিবর্তন-পরিবর্ধনের মাধ্যমে সেসব নবীরাসূলের শিক্ষাকে নষ্ট করে দেয়া হয়েছিল বলেই আরও নবী-রাসূল এবং কিতাব প্রেরণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, সেহেতু কুরআনকে পরিবর্তন হতে হেফাযত রাখার দায়িত্ব আল্লাহ তা'আলা স্বয়ং গ্রহণ করেছেন এবং কুরআনের শিক্ষাকে কেয়ামত পর্যন্ত এর প্রকৃত রূপে বহাল রাখার জন্য উম্মতে-মুহাম্মাদীর মধ্য থেকে এমন এক দলকে সঠিক পথে কায়েম রাখার ওয়াদা করেছেন, যে দল সব সময় সত্য দ্বীনে অটল থেকে মুসলিমদের মধ্যে কুরআন ও সুন্নাহর সঠিক শিক্ষা প্রচার ও প্রসার করতে থাকবে। কারো শক্রতা বা বিরোধিতা তাদের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। এ জন্যেই তার পরে নবুওয়াত ও ওহীর দ্বার বন্ধ হয়ে যাওয়া ছিল অবশ্যম্ভাবী বিষয়। এ বাস্তবতার প্রেক্ষিতেই সর্বোপরি খতমে-নবুওয়াত ঘোষণা করা হয়েছে। [মাআরিফুল কুরআন]

(৩) অর্থাৎ মন্দ লোকেরা প্রেরিত নবীগণ এবং আল্লাহর কিতাবের বিরুদ্ধাচরণ করাকে পছন্দ করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। সুতরাং ঈমানদারদের পক্ষে তাদের এহেন দুরাচারের জন্য মনোকষ্ট নেয়া উচিত নয়। যেভাবে কাফেররা তাদের পূর্বপুরুষদের পথ অবলম্বন করে নবীগণের বিরুদ্ধাচারণের পথ ধরেছে, তেমনিভাবে মুমিন ও সালেহগণের উচিত নবীগণের শিক্ষা অনুসরণ করা, তাদের অনুসরণে বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করা এবং যুক্তিগ্রাহ্য মনোমুগ্ধকর ওয়াজ এবং নম্রতার মাধ্যমে বিরুদ্ধবাদীদেরকে সত্য দ্বীনের প্রতি আহবান করতে থাকা। [মা'আরিফুল কুরআন]

তাফসীরে জাকারিয়া

(২১৩) মানুষ (আদিতে) ছিল একই জাতিভুক্ত ছিল।[1] (পরে মানুষেরাই বিভেদ সৃষ্টি করে।) অতঃপর আল্লাহ নবীগণকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেন; এবং মানুষের মধ্যে যে বিষয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছিল তার মীমাংসার জন্য তিনি তাদের সাথে সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেন, আসলে যাদেরকে তা দেওয়া হয়েছিল স্পষ্ট নিদর্শনাদি তাদের নিকট আসার পর তারাই শুধু পরস্পর বিদ্বেষবশতঃ মতভেদ সৃষ্টি করেছিল।[2] অতঃপর তারা যে বিষয়ে মতভেদ করত, আল্লাহ বিশ্বাসীদেরকে সে বিষয়ে নিজ ইচ্ছায় সত্য-পথে পরিচালিত করেন।[3] আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করে থাকেন।

[1] অর্থাৎ, তাওহীদের উপর। আদম (আঃ) থেকে নূহ (আঃ) পর্যন্ত দশ শতাব্দী অবধি যে তাওহীদের শিক্ষা নবীরা দিয়েছেন, সেই তাওহীদের উপরেই মানুষ প্রতিষ্ঠিত ছিল। আলোচ্য আয়াতে মুফাসসির সাহাবাগণ فَاخْتَلَفُوْا বাক্য ঊহ্য মেনেছেন। অর্থাৎ, এরপর শয়তানের চক্রান্তে তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিল এবং শিরক ও কবরপূজা ব্যাপক হয়ে গেল। فَبَعَثَ এর সংযোগ فَاخْتَلَفُوْا এর সাথে। অর্থাৎ, মহান আল্লাহ নবীদেরকে কিতাবসহ প্রেরণ করলেন, যাতে তাঁরা তাদের মধ্যেকার মতভেদের ফায়সালা করেন এবং সত্য ও তাওহীদের প্রতিষ্ঠা করেন। (ইবনে কাসীর)

[2] মতভেদ সব সময় সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণেই হয়। আর এই বিচ্যুতির উৎপত্তি হয় শত্রুতা ও বিদ্বেষ থেকে। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যতদিন পর্যন্ত বিচ্যুতি ছিল না, ততদিন পর্যন্ত এই উম্মাহ তার মূলের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং মতভেদের বিভীষিকা থেকে সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু অন্ধ অনুকরণ এবং বিদআত সত্য হতে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার যে পথ বের করল, সেই পথের কারণে মতভেদের গন্ডি প্রসার লাভ করল এবং তা বাড়তেই থাকল। বর্তমানে অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, উম্মতের ঐক্যবদ্ধ হওয়া একটি অসম্ভব বিষয়রূপে পরিণত হয়েছে! সুতরাং আল্লাহই মুসলিমদেরকে সুপথ দেখান। আমীন।

[3] যেমনঃ আহলে-কিতাব তথা কিতাবধারীরা জুমআর ব্যাপারে মতভেদ করল। ইয়াহুদীরা শনিবারের দিনকে এবং খ্রিষ্টানরা রবিবারের দিনকে তাদের পবিত্র দিন হিসেবে নির্বাচিত করল। মহান আল্লাহ মুসলিমদেরকে জুমআর দিনটা নির্বাচন করার নির্দেশ দিলেন। তারা ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে বিরোধিতা করল। ইয়াহুদীরা তাঁকে মিথ্যা জানল এবং (অবৈধ সন্তান বলে) তাঁর মাতা মারিয়াম (আলাইহাস্ সালাম)-এর উপর মিথ্যা অপবাদ দিল। এদিকে খ্রিষ্টানরা তাদের (ইয়াহুদীদের) বিপরীত করে তাঁকে (ঈসাকে) আল্লাহর পুত্র বানিয়ে দিল। মহান আল্লাহ মুসলিমদেরকে তাঁর ব্যাপারে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার তাওফীক দিলেন; তিনি আল্লাহর রসূল এবং তাঁর অনুগত বান্দা ছিলেন। ইবরাহীম (আঃ)-এর ব্যাপারেও তারা মতভেদ করে একদল তাঁকে ইয়াহুদী এবং অপর দল তাঁকে খ্রিষ্টান বলল। মুসলিমদেরকে আল্লাহ সঠিক কথা জানিয়ে দিলেন যে, ‘‘তিনি একনিষ্ঠ মুসলিম ছিলেন।’’ এইভাবে অনেক বিষয়ে মহান আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে মুসলিমদেরকে সরল ও সঠিক পথ দেখিয়েছেন।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আল-বাকারা
২:২৫১ فَهَزَمُوۡهُمۡ بِاِذۡنِ اللّٰهِ ۟ۙ وَ قَتَلَ دَاوٗدُ جَالُوۡتَ وَ اٰتٰىهُ اللّٰهُ الۡمُلۡکَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ عَلَّمَهٗ مِمَّا یَشَآءُ ؕ وَ لَوۡ لَا دَفۡعُ اللّٰهِ النَّاسَ بَعۡضَهُمۡ بِبَعۡضٍ ۙ لَّفَسَدَتِ الۡاَرۡضُ وَ لٰکِنَّ اللّٰهَ ذُوۡ فَضۡلٍ عَلَی الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۲۵۱﴾

অতঃপর তারা আল্লাহর হুকুমে তাদেরকে পরাজিত করল এবং দাঊদ জালূতকে হত্যা করল। আর আল্লাহ দাঊদকে রাজত্ব ও প্রজ্ঞা দান করলেন এবং তাকে যা ইচ্ছা শিক্ষা দিলেন। আর আল্লাহ যদি মানুষের কতককে কতকের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তবে অবশ্যই যমীন ফাসাদপূর্ণ হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ বিশ্ববাসীর উপর অনুগ্রহশীল। আল-বায়ান

অতঃপর তারা আল্লাহর হুকুমে তাদেরকে (শত্রুদেরকে) পরাজিত করল এবং দাঊদ জ্বালুতকে কতল করল এবং আল্লাহ দাঊদকে রাজ্য ও হেকমত দান করলেন এবং তাকে শিক্ষা দিলেন যা ইচ্ছে। যদি আল্লাহ মানবজাতির একদলকে অন্যদল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেত, কিন্তু আল্লাহ সর্বজগতের প্রতি কৃপালু। তাইসিরুল

তখন তারা আল্লাহর হুকুমে জালুতের সৈন্যদেরকে পরাজিত করল এবং দাঊদ জালুতকে হত্যা করল। এবং আল্লাহ দাউদকে রাজ্য ও প্রজ্ঞা দান করলেন এবং তাকে ইচ্ছানুযায়ী শিক্ষা দান করলেন; আর যদি আল্লাহ এক দলকে অপর দলের দ্বারা প্রদমিত না করতেন তাহলে নিশ্চয়ই পৃথিবী অশান্তিপূর্ণ হত, কিন্তু আল্লাহ বিশ্ব জগতের প্রতি অনুগ্রহকারী। মুজিবুর রহমান

So they defeated them by permission of Allah, and David killed Goliath, and Allah gave him the kingship and prophethood and taught him from that which He willed. And if it were not for Allah checking [some] people by means of others, the earth would have been corrupted, but Allah is full of bounty to the worlds. Sahih International

২৫১. অতঃপর তারা আল্লাহর হুকুমে তাদেরকে (কাফেরদেরকে) পরাভূত করল এবং দাউদ জালুতকে হত্যা করলেন। আর আল্লাহ্‌ তাকে রাজত্ব ও হেকমত দান করলেন এবং যা তিনি ইচ্ছে করলেন তা তাকে শিক্ষা দিলেন। আর আল্লাহ্‌ যদি মানুষের এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তবে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ সৃষ্টিকুলের প্রতি অনুগ্রহশীল।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(২৫১) সুতরাং তখন তারা আল্লাহর ইচ্ছায় তাদেরকে পরাজিত করল এবং দাউদ জালূতকে হত্যা করল।[1] আল্লাহ তাকে রাজত্ব ও জ্ঞান-বিজ্ঞান দান করলেন[2] এবং তিনি ইচ্ছানুযায়ী তাকে শিক্ষা দান করলেন। আল্লাহ যদি মানব জাতির একদলকে অন্য দল দ্বারা দমন না করতেন, তাহলে নিশ্চয় পৃথিবী (অশান্তিপূর্ণ ও) ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ বিশ্বজগতের প্রতি অনুগ্রহশীল।[3]

[1] দাঊদ (আঃ) তখন না নবী ছিলেন, না রাজা। বরং ত্বালূতের সৈন্যদলের একজন সাধারণ সৈনিক ছিলেন। তাঁরই হাতে মহান আল্লাহ জালূতকে ধ্বংস করলেন এবং অল্প সংখ্যক ঈমানদার দ্বারা বিশাল এক জাতিকে জঘন্যভাবে পরাজিত করলেন।

[2] এর পর মহান আল্লাহ দাঊদ (আঃ)-কে রাজত্বও দিলেন এবং নবুঅতও। ‘হিকমত’ বলতে কেউ বলেছেন, নবুঅত। কেউ বলেছেন, লোহার কারিগরী এবং কেউ বলেছেন, যুদ্ধ সম্বন্ধীয় বিষয়ের এমন পারদর্শিতা, যা আল্লাহর ইচ্ছায় উক্ত স্থানে বড় নিষ্পত্তিকর সাব্যস্ত হয়েছিল।

[3] এখানে আল্লাহর এক নিয়মের কথা বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি একদল মানুষের মাধ্যমেই অপর একদল মানুষের যুলুম-অত্যাচার ও ক্ষমতা নিশ্চিহ্ন করে থাকেন। তিনি যদি এ রকম না করে কোন একই পক্ষকে সব সময়ের জন্য ক্ষমতা ও এখতিয়ার দিয়ে রাখতেন, তাহলে এ পৃথিবী যুলুম-অত্যাচারে পরিপূর্ণ হয়ে যেত। কাজেই আল্লাহর এই নিয়ম বিশ্ববাসীর জন্য তাঁর বিশেষ অনুগ্রহের একটি দৃষ্টান্ত। মহান আল্লাহ সূরা হজ্জের ৩৮ ও ৪০ নং আয়াতেও এ কথা উল্লেখ করেছেন।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আল-বাকারা
২:২৫২ تِلۡکَ اٰیٰتُ اللّٰهِ نَتۡلُوۡهَا عَلَیۡکَ بِالۡحَقِّ ؕ وَ اِنَّکَ لَمِنَ الۡمُرۡسَلِیۡنَ ﴿۲۵۲﴾

এগুলো আল্লাহর আয়াত, যা আমি তোমার উপর যথাযথভাবে তিলাওয়াত করি। আর নিশ্চয় তুমি রাসূলগণের অন্তর্ভুক্ত। আল-বায়ান

এসব আল্লাহরই আয়াত, যা আমি সঠিকভাবে তোমাকে পড়িয়ে শুনাচ্ছি এবং নিশ্চয়ই তুমি রসূলদের অন্তর্ভুক্ত। তাইসিরুল

এগুলো আল্লাহর নিদর্শন - তোমার নিকট এগুলি সত্যরূপে উপস্থাপন করেছি এবং নিশ্চয়ই তুমি রাসূলগণের অন্তর্ভুক্ত। মুজিবুর রহমান

These are the verses of Allah which We recite to you, [O Muhammad], in truth. And indeed, you are from among the messengers. Sahih International

২৫২. এ সব আল্লাহর আয়াত, আমরা আপনার নিকট তা যথাযথভাবে তিলাওয়াত করছি। আর নিশ্চয়ই আপনি রাসূলগণের অন্তর্ভুক্ত।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(২৫২) এই সমস্ত আল্লাহর নিদর্শন; যা আমি যথাযথভাবেম তোমাকে পড়ে শুনাচ্ছি। আর নিশ্চয় তুমি রসূলগণের অন্যতম।[1]

[1] অতীতের যে ঘটনাগুলো রসূল (সাঃ)-এর উপর অবতীর্ণ কিতাবের মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে পেরেছে, হে মুহাম্মাদ! অবশ্যই সে সমস্ত ঘটনাগুলো তোমার রিসালাত ও সত্যতার দলীল। কারণ, এগুলো না তুমি কোন কিতাবে পড়েছ, আর না কারো কাছ থেকে শুনেছ। আর এ থেকে এ কথাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এগুলো সব অদৃশ্য জগতের (গায়বী) খবরাদি, যা মহান আল্লাহ কর্তৃক অহীর মাধ্যমে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে। কুরআন কারীমের বহু স্থানে অতীত উম্মতের ঘটনাবলী রসূল (সাঃ)-এর সত্যতার প্রমাণস্বরূপ পেশ করা হয়েছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আল-বাকারা
২:২৮৫ اٰمَنَ الرَّسُوۡلُ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡهِ مِنۡ رَّبِّهٖ وَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ؕ کُلٌّ اٰمَنَ بِاللّٰهِ وَ مَلٰٓئِکَتِهٖ وَ کُتُبِهٖ وَ رُسُلِهٖ ۟ لَا نُفَرِّقُ بَیۡنَ اَحَدٍ مِّنۡ رُّسُلِهٖ ۟ وَ قَالُوۡا سَمِعۡنَا وَ اَطَعۡنَا ٭۫ غُفۡرَانَکَ رَبَّنَا وَ اِلَیۡکَ الۡمَصِیۡرُ ﴿۲۸۵﴾

রাসূল তার নিকট তার রবের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছে, আর মুমিনগণও। প্রত্যেকে ঈমান এনেছে আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাকুল, কিতাবসমূহ ও তাঁর রাসূলগণের উপর, আমরা তাঁর রাসূলগণের কারও মধ্যে তারতম্য করি না। আর তারা বলে, আমরা শুনলাম এবং মানলাম। হে আমাদের রব! আমরা আপনারই ক্ষমা প্রার্থনা করি, আর আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তনস্থল। আল-বায়ান

রসূল (সাঃ) তার প্রতিপালকের পক্ষ হতে যা তার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তাতে ঈমান এনেছে এবং মু’মিনগণও। তারা সবাই আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাদের উপর, তাঁর কিতাবসমূহের উপর এবং রসূলগণের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে, (তারা বলে), ‘আমরা রসূলগণের মধ্যে কারও ব্যাপারে তারতম্য করি না’ এবং তারা এ কথাও বলে যে, ‘আমরা শুনেছি এবং মেনে নিয়েছি। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ক্ষমা কর আর প্রত্যাবর্তন তোমারই দিকে’। তাইসিরুল

রাসূল তার রাব্ব হতে তার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা বিশ্বাস করে এবং মু’মিনগণও (বিশ্বাস করে); তারা সবাই আল্লাহকে, তাঁর মালাইকাকে, তাঁর গ্রন্থসমূহকে এবং তাঁর রাসূলগণকে বিশ্বাস করে; (তারা বলে) আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কেহকেও পার্থক্য করিনা। এবং তারা বলে, আমরা শুনলাম এবং স্বীকার করলাম; হে আমাদের রাব্ব! আমরা আপনারই নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আপনারই দিকে শেষ প্রত্যাবর্তন। মুজিবুর রহমান

The Messenger has believed in what was revealed to him from his Lord, and [so have] the believers. All of them have believed in Allah and His angels and His books and His messengers, [saying], "We make no distinction between any of His messengers." And they say, "We hear and we obey. [We seek] Your forgiveness, our Lord, and to You is the [final] destination." Sahih International

২৮৫. রাসূল তার প্রভুর পক্ষ থেকে যা তার কাছে নাযিল করা হয়েছে তার উপর ঈমান এনেছেন এবং মুমিনগণও। প্রত্যেকেই ঈমান এনেছে আল্লাহর উপর, তার ফেরেশতাগণ, তার কিতাবসমূহ এবং তার রাসূলগণের উপর। আমরা তাঁর রাসূলগনের কারও মধ্যে তারতম্য করি না। আর তারা বলেঃ আমরা শুনেছি ও মেনে নিয়েছি। হে আমাদের রব। আপনার ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তনস্থল।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(২৮৫) রসূল তার প্রতি তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতে সে বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং বিশ্বাসিগণও; সকলে আল্লাহতে, তাঁর ফিরিশতাগণে, তাঁর কিতাবসমূহে এবং তাঁর রসূলগণে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। (তারা বলে,) আমরা তাঁর রসূলগণের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না।[1] আর তারা বলে, আমরা শুনলাম ও মান্য করলাম! হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তোমার ক্ষমা চাই, আর তোমারই দিকে (আমাদের) প্রত্যাবর্তন হবে।

[1] এই আয়াতে এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে, যার উপর ঈমানদারদেরকে ঈমান আনতে বলা হয়েছে। এর পরের {لاَ يُكَلِّفُ اللهُ} আয়াতে আল্লাহর রহমত, তাঁর দয়া এবং তাঁর অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তিনি মানুষকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না। হাদীসে এই শেষ দুটি আয়াতের অনেক ফযীলতের কথা এসেছে। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি সূরা বাক্বারার শেষের দু’টি আয়াত রাতে পড়ে নেয়, তার জন্য এই আয়াত দু’টিই যথেষ্ট হয়ে যায়।’’ (বুখারী, ইবনে কাসীর) অর্থাৎ, এই আমলের কারণে মহান আল্লাহ তার হেফাযত করবেন। অপর একটি হাদীসে এসেছে, নবী করীম (সাঃ) মিরাজের রাতে যে তিনটি জিনিস পেয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল, সূরা বাক্বারার শেষের এই দু’টি আয়াত। (সহীহ মুসলিম) অনেক বর্ণনায় এ কথাও এসেছে যে, এই সূরার শেষের আয়াত দু’টি রসূল (সাঃ)-কে আরশের নীচের একটি ভান্ডার থেকে দেওয়া হয় এবং এই আয়াত কেবল তাঁকেই দেওয়া হয়, অন্য কোন নবীকে দেওয়া হয়নি। (আহমদ, নাসায়ী, ত্বাবারানী, বায়হাক্বী, হাকেম এবং দারেমী ইত্যাদি।) মুআয (রাঃ) এই সূরা শেষ করে ‘আমীন’ বলতেন।’’ (ইবনে কাসীর)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আলে-ইমরান
৩:৩২ قُلۡ اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ الرَّسُوۡلَ ۚ فَاِنۡ تَوَلَّوۡا فَاِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۳۲﴾

বল, ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর’। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফিরদেরকে ভালবাসেন না। আল-বায়ান

বল, ‘তোমরা আল্লাহর ও রসূলের আজ্ঞাবহ হও’। অতঃপর যদি তারা না মানে, তবে (জেনে রেখ) আল্লাহ কাফিরদেরকে ভালবাসেন না। তাইসিরুল

তুমি বলঃ তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের অনুসরণ কর; কিন্তু যদি তারা ফিরে যায় তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ অবিশ্বাসীদেরকে ভালবাসেন না। মুজিবুর রহমান

Say, "Obey Allah and the Messenger." But if they turn away - then indeed, Allah does not like the disbelievers. Sahih International

৩২. বলুন, ‘তোমরা আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য কর। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পছন্দ করেন না।(১)

(১) আয়াতের শেষে বলা হয়েছে যে, “নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পছন্দ করেন না”। এ থেকে বুঝা গেল যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা ফরয। আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলের আনুগত্যের মধ্যে তারতম্য করা যাবে না। আল্লাহর নির্দেশ যেমন মানতে হবে, তেমনি রাসূলের নির্দেশও মানতে হবে। কেউ আল্লাহর আনুগত্য করল কিন্তু রাসূলের আনুগত্য করল না, সে কুফরীর গণ্ডি থেকে বের হতে পারল না। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমি যেন কাউকে এ রকম না দেখতে পাই যে, সে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে, তখন তার কাছে আমি যে সমস্ত আদেশ-নিষেধ দিয়েছি সে সমস্ত আদেশ-নিষেধের কোন কিছু এসে পড়ল, তখন সে বললঃ আমরা জানি না, আমরা আল্লাহর কিতাবে যা পেয়েছি তার অনুসরণ করেছি।” [আবু দাউদ ৪৬০৫; তিরমিযী: ২৬৬৩; ইবনে মাজাহ: ১৩] সুতরাং কোন ঈমানদারের পক্ষে রাসূলের আদেশ-নিষেধ পাওয়ার পর সেটা কুরআনে নেই বলে বাহানা করার কোন সুযোগ নেই। যদি তা করা হয় তবে তা হবে সুস্পষ্ট কুফরী।

তাফসীরে জাকারিয়া

(৩২) বল, ‘তোমরা আল্লাহ ও রসূলের অনুগত হও।’ কিন্তু যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রাখ নিশ্চয়ই আল্লাহ অবিশ্বাসীদেরকে ভালবাসেন না। [1]

[1] এই আয়াতে আল্লাহর আনুগত্য করার সাথে সাথে রসূল (সাঃ)-এর অনুসরণ করার প্রতি পুনরায় তাকীদ করে এ কথা পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে যে, এখন মুক্তির পথই হল কেবল মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর অনুসরণ করা। আর এ থেকে বিমুখ হলে, তা হবে কুফরী এবং এমন কুফরীর কাফেরদেরকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। তাতে তারা আল্লাহর ভালবাসা ও তাঁর নৈকট্য লাভের যতই দাবী করুক না কেন। এই আয়াতে তাদের প্রতি বড় তিরস্কার রয়েছে, যারা হাদীসকে হুজ্জত (শরীয়তের দলীল) মানে না এবং রসূল (সাঃ)-এর অনুসরণকেও জরুরী মনে করে না। উভয় শ্রেণীর মানুষই সব সব পদ্ধতিতে এমন মত ও পথ অবলম্বন করে যাকে কুফরী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে এ থেকে পানাহ দিন। আমীন।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আলে-ইমরান
৩:৮১ وَ اِذۡ اَخَذَ اللّٰهُ مِیۡثَاقَ النَّبِیّٖنَ لَمَاۤ اٰتَیۡتُکُمۡ مِّنۡ کِتٰبٍ وَّ حِکۡمَۃٍ ثُمَّ جَآءَکُمۡ رَسُوۡلٌ مُّصَدِّقٌ لِّمَا مَعَکُمۡ لَتُؤۡمِنُنَّ بِهٖ وَ لَتَنۡصُرُنَّهٗ ؕ قَالَ ءَاَقۡرَرۡتُمۡ وَ اَخَذۡتُمۡ عَلٰی ذٰلِکُمۡ اِصۡرِیۡ ؕ قَالُوۡۤا اَقۡرَرۡنَا ؕ قَالَ فَاشۡهَدُوۡا وَ اَنَا مَعَکُمۡ مِّنَ الشّٰهِدِیۡنَ ﴿۸۱﴾

আর স্মরণ কর, যখন আল্লাহ নবীদের অঙ্গীকার নিয়েছেন- আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও হিকমাত দিয়েছি, অতঃপর তোমাদের সাথে যা আছে তা সত্যায়নকারীরূপে একজন রাসূল তোমাদের কাছে আসবে- তখন অবশ্যই তোমরা তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, ‘তোমরা কি স্বীকার করেছ এবং এর উপর আমার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছ’? তারা বলল, ‘আমরা স্বীকার করলাম’। আল্লাহ বললেন, ‘তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম’। আল-বায়ান

(স্মরণ কর) যখন আল্লাহ নাবীদের নিকট হতে এ অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, আমি তোমাদেরকে কিতাব এবং জ্ঞান যা কিছু প্রদান করেছি, অতঃপর তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থক কোন রসূল যখন তোমাদের নিকট আসবে, তখন অবশ্য তোমরা তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা অঙ্গীকার করলে তো? এবং যে বিষয়ে আমি তোমাদের নিকট হতে অঙ্গীকার নিলাম, তোমরা তা মানলে তো?’ তারা বলল, ‘আমরা অঙ্গীকার করলাম’। আল্লাহ বললেন, ‘তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী থাকলাম’। তাইসিরুল

এবং আল্লাহ যখন নাবীগণের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন, আমি তোমাদেরকে গ্রন্থ ও বিজ্ঞান হতে দান করার পর তোমাদের সঙ্গে যা আছে তার সত্যতা প্রত্যায়নকারী একজন রাসূল আগমন করবে, তখন তোমরা অবশ্যই তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং তার সাহায্যকারী হবে; তিনি আরও বলেছিলেনঃ তোমরা কি এতে স্বীকৃত হলে এবং প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করলে? তারা বলেছিল - আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেনঃ তাহলে তোমরা সাক্ষী থেক এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষীগণের অন্তর্ভুক্ত রইলাম। মুজিবুর রহমান

And [recall, O People of the Scripture], when Allah took the covenant of the prophets, [saying], "Whatever I give you of the Scripture and wisdom and then there comes to you a messenger confirming what is with you, you [must] believe in him and support him." [Allah] said, "Have you acknowledged and taken upon that My commitment?" They said, "We have acknowledged it." He said, "Then bear witness, and I am with you among the witnesses." Sahih International

৮১. আর স্মরণ করুন, যখন আল্লাহ নবীদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন(১) যে, আমি তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু দিয়েছি; তারপর তোমাদের কাছে যা আছে তার সত্যায়নকারীরূপে যখন একজন রাসূল আসবে- তখন তোমরা অবশ্যই তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, ‘তোমরা কি স্বীকার করলে? এবং এর উপর আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে? তারা বলল, “আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন, তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম।(২)

(১) আল্লাহ্ তা'আলা বান্দার কাছ থেকে তিনটি অঙ্গীকার নিয়েছেন। একটি সূরা আল-আ’রাফের (أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ) আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। সে অঙ্গীকারের উদ্দেশ্য এই যে, সমগ্র মানবজাতি আল্লাহর অস্তিত্ব ও রবুবিয়াতে বিশ্বাসী হবে। দ্বিতীয় অঙ্গীকার শুধু আহলে-কিতাব পণ্ডিতদের কাছ থেকেই নেয়া হয়েছে, যাতে তারা সত্য গোপন না করে। যার আলোচনা (وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ) আয়াতে ব্যক্ত করা হয়েছে। [সূরা আলে ইমরানঃ ১৮৭] অনুরূপভাবে এ অঙ্গীকারের কথা সূরা আল-বাকারাহর ৮৩ এবং সূরা আল-মায়েদার ১২ ও ৭০ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। তৃতীয় অঙ্গীকার আলোচ্য ৮১ নং আয়াতে (وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ) বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এ مِيثَاق বা অঙ্গীকার কি? এ বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে।

আলী ও ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুম বলেন, আল্লাহ্ তা'আলা সব রাসূলগণের কাছ থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে অঙ্গীকার নেন যে, তারা স্বয়ং যদি তার আমলে জীবিত থাকেন, তবে যেন তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং তাকে সাহায্য করেন। স্বীয় উম্মতকেও যেন এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়ে যান। [তাবারী] পক্ষান্তরে তাউস, হাসান বসরী, কাতাদাহ প্রমুখ তফসীরবিদগণ বলেনঃ রাসূলগণের কাছ থেকে এ অঙ্গীকার নেয়া হয়েছিল- যাতে তারা পরস্পরকে সাহায্য ও সমর্থন দান করেন। [তাবারী] বস্তুত উভয় তাফসীরের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। এ কারণে আয়াতের অর্থ উভয়টিই হতে পারে।

(২) আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা'আলা সব রাসূলের কাছ থেকে এই মর্মে অঙ্গীকার নেন যে, আপনাদের মধ্য থেকে কোন রাসূলের পর যখন অন্য রাসূল আগমন করেন- যিনি অবশ্যই পূর্ববর্তী রাসূল ও আল্লাহর গ্রন্থসমূহের সত্যায়নকারী হবেন, তখন পূর্ববর্তী নবীর জন্যে জরুরী হবে নতুন নবীর সত্যতা ও নবুওয়তের প্রতি নিজে বিশ্বাস স্থাপন করা এবং অন্যকেও বিশ্বাস স্থাপন করার নির্দেশ দিয়ে যাওয়া। কুরআনের এ সামগ্রিক নীতির পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহ তা'আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কেও এমনি ধরনের অঙ্গীকার পূর্ববর্তী রাসূলগণের কাছ থেকে নিয়ে থাকবেন। তাই যখন ঈসা আলাইহিস সালাম পৃথিবীতে পুনরায় নেমে আসবেন, তখন তিনিও কুরআন এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিধি-বিধানই পালন করবেন। এতে বুঝা যায় যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়ত বিশ্বজনীন। তার শরীয়তের মধ্যে পূর্ববর্তী সব শরীয়ত পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই বলেছেন, ‘আমি সমগ্র মানবজাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছি’। [বুখারী: ৪৩৮; অনুরূপ মুসলিম: ৫২১]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৮১) আর যখন আল্লাহ নবীদের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিলেন যে, আমি তোমাদেরকে কিতাব ও প্রজ্ঞা দান করছি, অতঃপর তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থকরূপে যখন একজন রসূল আসবে, তখন নিশ্চয় তোমরা তাকে বিশ্বাস ও সাহায্য করবে।[1] তিনি বললেন, ‘তোমরা কি স্বীকার করলে এবং আমার অঙ্গীকার গ্রহণ করলে?’ তারা বলল, ‘আমরা স্বীকার করলাম।’ তিনি বললেন, ‘তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম।’

[1] অর্থাৎ, প্রত্যেক নবীর কাছ থেকে এই অঙ্গীকার নেওয়া হয়েছে যে, তাঁর জীবদ্দশায় এবং তাঁর নবুঅতকালে যদি অন্য নবীর আবির্ভাব ঘটে, তাহলে এই নবাগত নবীর প্রতি ঈমান আনা এবং তাঁর সহযোগিতা করা অত্যাবশ্যক হবে। যদি নবী বিদ্যমান থাকা অবস্থায় নবাগত নবীর উপর ঈমান এই নবীর উপর জরুরী হয়, তাহলে এই নবীর উম্মতের উপর নবাগত নবীর উপর ঈমান আনা তো আরো বেশী জরুরী হয়ে যায়। কোন কোন মুফাসসির رَسُوْلٌ مُصَدِّقٌ (সমর্থক রসূল) থেকে মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ, মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ব্যাপারে অন্য সমস্ত নবীদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নেওয়া হয়েছে যে, যদি তাঁর যুগে তিনি এসে যান, তাহলে নিজের নবুঅতের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে এই নবীর উপর ঈমান আনতে হবে। কিন্তু আসলে প্রথম অর্থের সাথে এই দ্বিতীয় অর্থ আপনা-আপনিই এসে যায়। সুতরাং কুরআনের শব্দের দিক দিয়ে প্রথম অর্থই সঠিক এবং এই অর্থের দিক থেকে এ কথাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নবুঅতের সূর্য উদিত হওয়ার পর আর কোন নবীর (নবুঅতের) প্রদীপ উজ্জ্বল থাকবে না। যেমন, হাদীসে এসেছে যে, একদা উমার (রাঃ) তাওরাতের কয়েকটি পাতা নিয়ে পড়ছিলেন। তা দেখে নবী করীম (সাঃ) রাগান্বিত হয়ে বললেন, ‘‘সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ! যদি মুসা (আঃ)ও জীবিত হয়ে এসে যান আর তোমরা আমাকে ছেড়ে তাঁর অনুসারী হয়ে যাও, তাহলে অবশ্য অবশ্যই তোমরা ভ্রষ্ট হয়ে যাবে।’’ (মুসনাদ আহমাদ, ইবনে কাসীর) বলা বাহুল্য, এখন কিয়ামত পর্যন্ত অপরিহার্য অনুসরণ কেবল মুহাম্মাদ (সাঃ)-এরই করতে হবে। তাঁর আনুগত্যের মধ্যেই রয়েছে মুক্তি, কোন ইমামের অন্ধ অনুকরণ অথবা কোন বুযুর্গের হাতে বায়াত করার মধ্যে নয়। কোন পয়গম্বরের সিক্কা যদি না চলে, তাহলে অন্য কোন ব্যক্তিত্ব শর্তহীন আনুগত্যের অধিকারী কিভাবে হতে পারে?

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আলে-ইমরান
৩:৮৬ کَیۡفَ یَهۡدِی اللّٰهُ قَوۡمًا کَفَرُوۡا بَعۡدَ اِیۡمَانِهِمۡ وَ شَهِدُوۡۤا اَنَّ الرَّسُوۡلَ حَقٌّ وَّ جَآءَهُمُ الۡبَیِّنٰتُ ؕ وَ اللّٰهُ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۸۶﴾

কেমন করে আল্লাহ সে কওমকে হিদায়াত দেবেন, যারা ঈমান আনার পর কুফরী করেছে, আর তারা সাক্ষ্য দিয়েছে যে, নিশ্চয় রাসূল সত্য এবং তাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণ এসেছে। আর আল্লাহ যালিম কওমকে হিদায়াত দেন না। আল-বায়ান

আল্লাহ কীরূপে সেই সম্প্রদায়কে সুপথ দেখাবেন যারা ঈমান আনার পর, এ রসূলকে সত্য বলে স্বীকার করার পর এবং তাদের নিকট সুস্পষ্ট দলীল আসার পর কুফরী করে? বস্তুতঃ আল্লাহ যালিম কওমকে পথ দেখান না। তাইসিরুল

কিরূপে আল্লাহ সেই সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করবেন যারা বিশ্বাস স্থাপনের পর, রাসূলের সত্যতা বিষয়ে সাক্ষ্যদানের পর এবং তাদের নিকট প্রকাশ্য নিদর্শনসমূহ আসার পরও অবিশ্বাসী হয়েছে? আর আল্লাহ অত্যাচারী সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেননা। মুজিবুর রহমান

How shall Allah guide a people who disbelieved after their belief and had witnessed that the Messenger is true and clear signs had come to them? And Allah does not guide the wrongdoing people. Sahih International

৮৬. আল্লাহ কিভাবে হেদায়াত করবেন সে সম্প্রদায়কে, যারা ঈমান আনার পর ও রাসূলকে সত্য বলে সাক্ষ্য দেয়ার পর এবং তাদের কাছে স্পষ্ট নিদর্শন আসার পর কুফর করে? আর আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না।(১)

(১) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আনসারদের এক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করার পর মুরতাদ হয়ে যায় এবং মুশরিকদের সাথে মিশে যায়। পরে সে লজ্জিত হয় ও তার স্বজাতির কাছে বলে পাঠায় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা কর আমার কি কোন তাওবাহ আছে? তার স্বজাতির লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে জিজ্ঞাসা করলেন যে, অমুক লজ্জিত হয়েছে এবং জানতে চেয়েছে যে, তার জন্য তাওবাহ আছে কি না? তখন এ আয়াতসহ পরবর্তী চারটি আয়াত নাযিল হয়। পরে সে ফিরে আসে এবং পুনরায় ইসলামে প্রবেশ করে। [নাসায়ী: ৭/১০৭; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৪৪৭৭; মুসনাদে আহমাদঃ ১/২৪৮]

হাসান বলেন, এ আয়াত দ্বারা আহলে কিতাবদের উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে তাদের গ্রন্থে স্পষ্ট দেখতে পেত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের পূর্বে তিনি তাদের কাছে আগমন করলে তাকে সাথে নিয়ে কাফেরদের উপর জয়ী হবে ঘোষণা করত। কিন্তু যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে আসলেন, তখন তারা কৃফরী করল। [তাবারী] তবে আয়াত দৃষ্টে মনে হয়; বক্তব্যটি ব্যাপক। যারাই এরকম কাজ করবে তারাই এ খারাপ পরিণতির সম্মুখীন হবে।

তাফসীরে জাকারিয়া

(৮৬) বিশ্বাসের পর ও রসূলকে সত্য বলে সাক্ষ্যদান করার পর এবং তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পর যে সম্প্রদায় সত্য প্রত্যাখ্যান করে, (সে সম্প্রদায়কে) আল্লাহ কিরূপে সৎপথ প্রদর্শন করবেন? আল্লাহ সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
আলে-ইমরান
৩:১৩২ وَ اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ الرَّسُوۡلَ لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ ﴿۱۳۲﴾ۚ

আর তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ ও রাসূলের, যাতে তোমাদেরকে দয়া করা হয়। আল-বায়ান

আল্লাহর ও রসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা কৃপাপ্রাপ্ত হতে পার। তাইসিরুল

আর আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য স্বীকার কর যেন তোমরা করুণা প্রাপ্ত হও। মুজিবুর রহমান

And obey Allah and the Messenger that you may obtain mercy. Sahih International

১৩২. আর তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা কৃপা লাভ করতে পার।(১)

(১) আলোচ্য আয়াতে দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণঃ (এক) আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলার আনুগত্যের সাথে রাসূলের আনুগত্যেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এটা জানা কথা যে, রাসূলের আনুগত্য হুবহু আল্লাহর আনুগত্য বোঝায়। তারপরও এখানে রাসূলের আনুগত্যকে পৃথক করে বর্ণনা করার তাৎপর্য স্বয়ং আল্লাহ্ বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমাদের প্রতি করুণা করা হয়। এতে আল্লাহর করুণালাভের জন্যে আল্লাহ্ তা'আলার আনুগত্যকে যেমন অত্যাবশ্যকীয় ও অপরিহার্যকরা হয়েছে, তেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যকেও জরুরী ও অপরিহার্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু এ আয়াতেই নয়, বরং সমগ্র কুরআনে বার বার এর পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে এবং যেখানেই আল্লাহর আনুগত্যের নির্দেশ বর্ণিত হয়েছে, সেখানেই রাসূলের আনুগত্যকেও স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

কুরআন পাকের এই উপর্যুপরি ও অব্যাহত বাণী ইসলাম ও ঈমানের এ মূলনীতির প্রতিই অঙ্গুলি নির্দেশ করে যে, ঈমানের প্রথম অংশ হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার তাওহীদ তথা অস্তিত্ব, প্রভুত্ব, নাম ও গুণ এবং ইবাদাত তথা দাসত্ব ও আনুগত্য স্বীকার করা এবং দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য করা। (দুই) আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলা মকবুল ও নিষ্ঠাবান পরহেযগার বান্দার গুণাবলী ও লক্ষণাদি বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য শুধু মৌখিক দাবীকে বলা হয় না, বরং গুণাবলী ও লক্ষণাদির দ্বারাই আনুগত্যকারীর পরিচয় হয়। পরবর্তী আয়াতসমূহে এর বর্ণনা আসছে।

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৩২) আর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা কৃপালাভ করতে পার।

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২৪৮ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 · · · 10 11 12 13 পরের পাতা »