আর যারা জানে না, তারা বলে, ‘কেন আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলেন না কিংবা আমাদের কাছে কোন নিদর্শন আসে না’? এভাবেই, যারা তাদের পূর্বে ছিল তারা তাদের কথার মত কথা বলেছে। তাদের অন্তরসমূহ একই রকম হয়ে গিয়েছে। আমি তো আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট করে দিয়েছি এমন কওমের জন্য, যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে। আল-বায়ান
যারা কিছু জানে না তারা বলে, কেন আল্লাহ আমাদের সঙ্গে কথা বলেন না? কিংবা আমাদের নিকট কোন নির্দেশ কেন আসে না? এভাবে আগের লোকেরাও তাদের মতই বলত, এদের অন্তরগুলো একই রকম, আমি দৃঢ় বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শনাবলী পরিষ্কারভাবে বিবৃত করেছি। তাইসিরুল
এবং মূর্খেরা বলেঃ আল্লাহ আমাদের সাথে কেন কথা বলেননা, অথবা কেন আমাদের জন্য কোন নিদর্শন উপস্থিত হয়না? এদের পূর্বে যারা ছিল তারাও এদের অনুরূপ কথা বলত; তাদের সবারই অন্তর পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ; নিশ্চয়ই আমি বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য উজ্জ্বল নিদর্শনাবলী বর্ণনা করি। মুজিবুর রহমান
Those who do not know say, "Why does Allah not speak to us or there come to us a sign?" Thus spoke those before them like their words. Their hearts resemble each other. We have shown clearly the signs to a people who are certain [in faith]. Sahih International
১১৮. আর যারা কিছু জানে না তারা(১) বলে, ‘আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলেন না কেন? অথবা আমাদের কাছে কেন আসে না কোন আয়াত? এভাবে তাদের পূর্ববর্তীরাও তাদের মত কথা বলতো। তাদের অন্তর একই রকম(২)। অবশ্যই আমরা আয়াতসমূহকে স্পষ্টভাবে বিবৃত করেছি, এমন কওমের জন্য, যারা দৃঢ়বিশ্বাস রাখে।
(১) এদের সম্পর্কে তিনটি মত রয়েছে। এক. এরা হচ্ছে, ইয়াহুদী সম্প্রদায়। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত যে, রাফে ইবনে হারীমলাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলল যে, হে মুহাম্মদ যদি তুমি রাসূল হয়ে থাক তবে আল্লাহকে বল আমাদের সাথে কথা বলতে যাতে করে আমরা তার কথা শুনতে পারি। তখন এ আয়াত নাযিল হয়। দুই. মুজাহিদ বলেন, এরা হচ্ছে, নাসারা সম্প্রদায়। তিন. কাতাদাহ ও আবুল আলীয়াহ বলেন, এরা হচ্ছে আরবের কাফের সম্প্রদায়। ইবনে কাসীর এ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। [আত-তাফসীরুস সহীহ]
(২) অর্থাৎ আজকের পথভ্রষ্টরা এমন কোন অভিযোগ ও দাবী উত্থাপন করেনি, যা এর আগের পথভ্রষ্টরা করেনি। প্রাচীন যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত পথভ্রষ্টতার প্রকৃতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বার বার একই ধরণের সন্দেহ-সংশয়, অভিযোগ ও প্রশ্নের পুনরাবৃত্তিই সে করে চলছে।
তাফসীরে জাকারিয়া১১৮। যারা মূর্খ তারা বলে, ‘আল্লাহ আমাদের সঙ্গে কথা বলেন না কেন? কিংবা কোন নিদর্শন আমাদের নিকট আসে না কেন?’[1] এভাবে তাদের পূর্ববর্তীরাও তাদের অনুরূপ কথা বলত। তাদের অন্তরগুলি পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ। [2] নিশ্চয়ই আমি প্রকৃত বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শনাবলী সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করেছি।
[1] এ আয়াতে উদ্দিষ্ট হল আরবের সেই মুশরিকগণ, যারা ইয়াহুদীদের মত দাবী করেছিল যে, আল্লাহ তাআলা আমাদের সাথে সরাসরি কথা বলেন না কেন অথবা কোন বড় নিদর্শন দেখান না কেন? যা দেখে আমরা মুসলিম হয়ে যাব। সূরা বানী-ইসরাঈলের ৯০-৯৩নং আয়াতে এবং অন্যান্য স্থানেও অনুরূপ কথা বর্ণিত হয়েছে।
[2] সূরা যারিয়াতের নং আয়াতে বলা হয়েছে-
{كَذَلِكَ مَا أَتَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا قَالُوا سَاحِرٌ أَوْ مَجْنُونٌ* أَتَوَاصَوْا بِهِ بَلْ هُمْ قَوْمٌ طَاغُونَ}
এমনিভাবে, তাদের পূর্ববর্তীদের কাছে যখনই কোন রসূল আগমন করেছে তারা বলেছে, যাদুকর, না হয় উন্মাদ। তারা কি একে অপরকে এই উপদেশই দিয়ে গেছে? বস্তুতঃ ওরা সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়। অর্থাৎ, কমবেশী এদের সকলের মধ্যে সীমালংঘন করে অবাধ্য হওয়ার প্রবণতা আছে। আর এই জন্য সত্যের প্রতি আহবানকারীদের সামনে নতুন নতুন দাবী রাখতো কিংবা তাঁদেরকে পাগল আখ্যা দিত।
তাফসীরে আহসানুল বায়াননিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে, সে নৌকায় যা সমুদ্রে মানুষের জন্য কল্যাণকর বস্ত্ত নিয়ে চলে এবং আসমান থেকে আল্লাহ যে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন অতঃপর তার মাধ্যমে মরে যাওয়ার পর যমীনকে জীবিত করেছেন এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সকল প্রকার বিচরণশীল প্রাণী ও বাতাসের পরিবর্তনে এবং আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী স্থানে নিয়োজিত মেঘমালায় রয়েছে নিদর্শনসমূহ এমন কওমের জন্য, যারা বিবেকবান। আল-বায়ান
নিশ্চয়ই আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টির মধ্যে, রাত ও দিনের বিবর্তনের মধ্যে, লোকের উপকারী দ্রব্যাদিসহ সমুদ্রে চলাচলকারী জলযানের মধ্যে এবং আকাশ হতে আল্লাহর বর্ষিত সেই পানির মধ্যে যদ্বারা তিনি পৃথিবীকে- মরে যাওয়ার পর আবার জীবিত করেন এবং তাতে সকল প্রকার জীব-জন্তুর বিস্তারণে এবং বাতাসের গতি পরিবর্তনের মধ্যে এবং আকাশ ও ভূমন্ডলের মধ্যস্থলে নিয়ন্ত্রিত মেঘপুঞ্জের মধ্যে বিবেকসম্পন্ন লোকেদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে। তাইসিরুল
নিশ্চয়ই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টিতে, দিন ও রাতের পরিবর্তনে, নৌ-পথে জাহাজসমূহের চলাচলে - যাতে রয়েছে মানুষের জন্য কল্যাণ। মৃত পৃথিবীকে সঞ্জীবিত করণে, তাতে নানাবিধ জীবজন্তু সঞ্চারিত করার জন্য আল্লাহ আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। বায়ুরাশির গতি পরিবর্তনে এবং আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থ সঞ্চিত মেঘের সঞ্চারণে সত্যি সত্যিই জ্ঞানবান সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে। মুজিবুর রহমান
Indeed, in the creation of the heavens and earth, and the alternation of the night and the day, and the [great] ships which sail through the sea with that which benefits people, and what Allah has sent down from the heavens of rain, giving life thereby to the earth after its lifelessness and dispersing therein every [kind of] moving creature, and [His] directing of the winds and the clouds controlled between the heaven and the earth are signs for a people who use reason. Sahih International
১৬৪. নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে(১), রাত ও দিনের পরিবর্তনে(২), মানুষের উপকারী(৩) দ্রব্যবাহী চলমান সামুদ্রিক জাহাজে এবং আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণের মূধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠকে তার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন সকল প্রকার বিচরণশীল প্রাণী এবং বায়ুর দিক পরিবর্তনে, আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত মেঘমালাতে বিবেকবান কওমের জন্য নিদর্শনসমূহ রয়েছে।(৪)
(১) আসমান ও যমীনের সৃষ্টি কিভাবে নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত, তা এ আয়াতে ব্যাখ্যা করে বলা হয় নি। অন্যত্র তা স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে, যেমন “তারা কি তাদের উপরে অবস্থিত আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে না, আমরা কিভাবে তা নির্মাণ করেছি ও তাকে সুশোভিত করেছি এবং তাতে কোন ফাটলও নেই? আর আমরা বিস্তৃত করেছি ভূমিকে ও তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং তাতে উদগত করেছি নয়ন প্রীতিকর সর্বপ্রকার উদ্ভিদ, আল্লাহর অনুরাগী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ।” [সূরা কাফ: ৬-৮] আর আসমান সম্পর্কে বলেছেন “যিনি সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে সাত আসমান। রহমানের সৃষ্টিতে আপনি কোন খুঁত দেখতে পাবেন না; আপনি আবার তাকিয়ে দেখুন, কোন ক্রটি দেখতে পান কি?
তারপর আপনি দ্বিতীয়বার দৃষ্টি ফেরান, সে দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে আপনার দিকে ফিরে আসবে। আমরা নিকটবর্তী আসমানকে সুশোভিত করেছি প্রদীপমালা দ্বারা এবং সেগুলোকে করেছি শয়তানের প্রতি নিক্ষেপের উপকরণ এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি জ্বলন্ত আগুনের শাস্তি [সূরা আল-মুলক ৩-৫] তারপর যমীন সম্পর্কে বলেছেন, “তিনিই তো তোমাদের জন্য যমীনকে সুগম করে দিয়েছেন; অতএব তোমরা এর দিক-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তার দেয়া রিযক থেকে তোমরা আহার কর; আর পুনরুত্থান তো তারই কাছে।” [সূরা আল-মুলক: ১৫]
(২) রাত দিনের পরিবর্তন কিভাবে নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত, তা এ আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয় নি। অন্য আয়াতে তা ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে। যেমন, “বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আল্লাহ্ যদি রাতকে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন, আল্লাহ্ ছাড়া এমন কোন ইলাহ আছে, যে তোমাদেরকে আলো এনে দিতে পারে? তবুও কি তোমরা কর্ণপাত করবে না? বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আল্লাহ যদি দিনকে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন, আল্লাহ ছাড়া এমন কোন ইলাহ আছে, যে তোমাদের জন্য রাতের আবির্ভাব ঘটাবে যাতে বিশ্রাম করতে পার? তবুও কি তোমরা ভেবে দেখবে না?” [সূরা আল-কাসাস: ৭১, ৭২]
(৩) এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, সামুদ্রিক জাহাজের মাধ্যমে এক দেশের মালামাল অন্য দেশে আমদানী-রফতানী করার মাঝেও মানুষের এত বিপুল কল্যাণ নিহিত রয়েছে যা গণনাও করা যায় না। আর এ উপকারিতার ভিত্তিতেই যুগে যুগে, দেশে দেশে নতুন নতুন বাণিজ্যপন্থা উদ্ভাবিত হয়েছে। এমনিভাবে আকাশ থেকে এভাবে পানিকে বিন্দু বিন্দু করে বর্ষণ করা, যাতে কোন কিছুর ক্ষতিসাধিত না হয়। যদি এ পানি প্লাবনের আকারে আসত, তাহলে কোন মানুষ, জীব-জন্তু কিংবা অন্যান্য জিনিসপত্র কিছুই থাকত না।
অতঃপর পানি বর্ষণের পর ভূ-পৃষ্ঠে তাকে সংরক্ষণ করা মানুষের সাধ্যের আওতায় ছিল না। যদি তাদেরকে বলা হত, তোমাদের সবাই নিজ নিজ প্রয়োজনমত ছ'মাসের প্রয়োজনীয় পানি সংরক্ষণ করে রাখ, তাহলে তারা পৃথক পৃথকভাবে কি সে ব্যবস্থা করতে পারত? আর কোনক্রমে রেখে দিলেও সেগুলো পচন অথবা বিনষ্ট হওয়ার হাত থেকে কেমন করে রক্ষা করত? কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই সে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কুরআনে বলা হয়েছেঃ “আমি পানিকে ভূমিতে ধারণ করিয়েছি, যদিও বৃষ্টির পানি পড়ার পর তাকে প্রবাহিত করেই নিঃশেষ করে দেয়ার ক্ষমতা আমার ছিল”। [সূরা আল-মুমিনুন: ১৮]
কিন্তু আল্লাহ্ তা'আলা পানিকে বিশ্ববাসী মানুষ ও জীব-জন্তুর জন্য কোথাও উন্মুক্ত খাদ-খন্দে সংরক্ষিত করেছেন, আবার কোথাও ভূমিতে বিস্তৃত বিভিন্ন স্তরের মাধ্যমে ভূমির অভ্যন্তরে সংরক্ষণ করেছেন। তারপর এমন এক ফল্গুধারা সমগ্র জমীনে বিছিয়ে দিয়েছেন যা পতিত কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে করে নিতে পারে। আবার এ পানিরই একটা অংশকে জমাট বাধা সাগর বানিয়ে তুষার আকারে পাহাড়ের চূড়ায় চাপিয়ে দিয়েছেন যা পতিত কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একান্ত সংরক্ষিত; অথচ ধীরে ধীরে গলে প্রাকৃতিক ঝর্ণাধারার মাধ্যমে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সারকথা, উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলার পরিপূর্ণ ক্ষমতার কয়েকটি বিকাশস্থলের বর্ণনার মাধ্যমে তাওহীদ বা একত্ববাদই প্রমাণ করা হয়েছে।
(৪) এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলার প্রকৃত একত্ববাদ সম্পর্কে বাস্তব লক্ষণ ও প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হয়েছে, যা জ্ঞানী-নিজ্ঞান নির্বিশেষে যে কেউই বুঝতে পারে। আসমান ও যমীনের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের চিরাচরিত বিবর্তন তারই ক্ষমতার পরিপূর্ণতা ও একত্ববাদের প্রকৃত প্রমাণ। অনুরূপভাবে পানির উপর নৌকা ও জাহাজ তথা জলযানসমূহের চলাচলও একটি বিরাট প্রমাণ। পানিকে আল্লাহ্ তা'আলা এমন এক তরল পদার্থ করে সৃষ্টি করেছেন যে, একান্ত তরল ও প্রবাহমান হওয়া সত্বেও তার পিঠের উপর লক্ষ লক্ষ মণ ওজনবিশিষ্ট বিশালাকায় জাহাজ বিরাট ওজনের চাপ নিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলাচল করে।
তদুপরি এগুলোকে গতিশীল করে তোলার জন্য বাতাসের গতি ও নিতান্ত রহস্যপূর্ণভাবে সে গতির পরিবর্তন করতে থাকা প্রভৃতি বিষয়ও এদিকেই ইঙ্গিত করে যে, এগুলোর সৃষ্টি ও পরিচালনার পিছনে এক মহাজ্ঞানী ও মহা বিজ্ঞ সত্তা বিদ্যমান। পানীয় পদার্থগুলো তরল না হলে যেমন এ কাজটি সম্ভব হত না, তেমনি বাতাসের মাঝে গতি সৃষ্টি না হলেও জাহাজ চলতে পারত না; এগুলোর পক্ষে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করাও সম্ভব হত না। মহান আল্লাহ বলেন, “তিনি ইচ্ছে করলে বায়ুকে স্তব্ধ করে দিতে পারেন; ফলে নৌযানসমূহ নিশ্চল হয়ে পড়বে সমুদ্রপৃষ্ঠে। নিশ্চয়ই এতে অনেক নিদর্শন রয়েছে প্রত্যেক চরম ধৈর্যশীল ও একান্ত কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য।” [সূরা আশ-শুরা ৩৩]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৬৪) নিশ্চয় আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টির মধ্যে, রাত ও দিনের পরিবর্তনের মধ্যে, যে সব জাহাজ মানুষের লাভের জন্য সাগরে চলাচল করে তাদের মধ্যে, আল্লাহ আকাশ থেকে যে পানি বর্ষণ করে মৃত ভূমিকে জীবিত করেন[1] এবং সকল প্রকার প্রাণী তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন, আর বায়ুরাশির প্রবাহের মধ্যে (গতি পরিবর্তনে) এবং আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী (আল্লাহর আজ্ঞাধীন ভাসমান) মেঘের মধ্যে জ্ঞানী লোকের জন্য অবশ্যই (আল্লাহর মহিমার) বহু নিদর্শন রয়েছে।
1] এই আয়াতটি বহুল অর্থবিশিষ্ট। কারণ, বিশ্বজাহানের সৃষ্টি এবং তার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কীয় সাতটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে একত্রে উল্লিখিত হয়েছে, যা অন্য কোন আয়াতে নেই। (ক) আসমান ও যমীনের সৃষ্টিঃ যার ব্যাপকতা ও বিশালতা বর্ণনার মুখাপেক্ষী নয়।
(খ) রাত ও দিনের একের পর এক আসা। দিনকে উজ্জ্বল এবং রাতকে অন্ধকার করাঃ যাতে জীবিকার জন্য কাজকর্মও যেন হয় এবং আরামও যেন করা যেতে পারে। আবার রাত বড় ও দিন ছোট হওয়া। অনুরূপ এর বিপরীত দিন বড় ও রাত ছোট হওয়া।
(গ) সমুদ্রে নৌকা ও পানিজাহাজের চলাচলঃ যার সাহায্যে ব্যবসার সফরও হয় এবং জীবিকা নির্বাহের টন টন পণ্যসামগ্রী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছানো হয়।
(ঘ) বৃষ্টিঃ যা যমীনের উর্বরতা ও শ্যামলতার জন্য অতীব প্রয়োজনীয়।
(ঙ) বিভিন্ন প্রকারের পশু-সৃষ্টিঃ যা বহন, চাষাবাদ এবং যুদ্ধেও কাজে আসে। এমন কি মানুষের খাদ্যের একটা বড় পরিমাণ প্রয়োজন এদের দিয়ে পূরণ হয়।
(চ) সব রকমের হাওয়া প্রবাহিতকরণঃ ঠান্ডা ও গরম, উপকারী ও অপকারী। পূর্ব ও পশ্চিমমুখী, আবার উত্তর ও দক্ষিণমুখী; মানুষের জীবন এবং তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী।
(ছ) মেঘের সৃষ্টিঃ যার দ্বারা মহান আল্লাহ যেখানে চান, সেখানেই বৃষ্টি বর্ষণ করেন। এই যাবতীয় বিষয়াদি কি মহান আল্লাহর মহাশক্তি ও তাঁর একত্বকে প্রমাণ করে না? অবশ্যই করে। এই সৃষ্টিসমূহ এবং তার নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় তাঁর কি কোন শরীক আছে? না, অবশ্যই না। তাহলে তাঁকে ছেড়ে অন্যকে উপাস্য এবং প্রয়োজন পূরণকারী মনে করা কি বুদ্ধিমানের কাজ?
ইতঃপূর্বে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ। আর তিনি ফুরকান নাযিল করেছেন। নিশ্চয় যারা অস্বীকার করে আল্লাহর আয়াতসমূহ, তাদের জন্যই রয়েছে কঠিন আযাব। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রতিশোধগ্রহণকারী। আল-বায়ান
ইতোপূর্বে মানবজাতির পথ প্রদর্শনের জন্য; আর তিনি সেই মানদন্ড নাযিল করেছেন যা হাক্ব ও বাতিলের পার্থক্য দেখিয়ে দেয়; নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর আয়াতের সাথে কুফুরী করে, তাদের জন্য কঠিন শাস্তি রয়েছে। আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, দন্ডদাতা। তাইসিরুল
মানবমন্ডলীর জন্য সৎপথ প্রদর্শনের জন্য এবং তিনিই ফুরকান অবতীর্ণ করেছেন। যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি অবিশ্বাস করে নিশ্চয়ই তাদের জন্য কঠোর শাস্তি রয়েছে এবং আল্লাহ পরাক্রান্ত, প্রতিশোধ গ্রহণকারী। মুজিবুর রহমান
Before, as guidance for the people. And He revealed the Qur'an. Indeed, those who disbelieve in the verses of Allah will have a severe punishment, and Allah is exalted in Might, the Owner of Retribution. Sahih International
৪. ইতোপূর্বে মানুষের হেদায়াতস্বরূপ(১) আর তিনি ফুরকান নাযিল করেছেন(২)। নিশ্চয় যারা আল্লাহর আয়াতসমূহে কুফরী করে তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। আর আল্লাহ মহা-পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী।(৩)
(১) কাতাদা বলেন, এ দুটি আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব। এতে রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে বর্ণনা। যে এ দুটি থেকে হিদায়াত গ্রহণ করেছে, সত্য বলে বিশ্বাস করেছে এবং সেটা অনুসারে আমল করেছে সে নিরাপত্তা পেয়েছে। [আত-তাফসীরুস সহীহ] সে হিসেবে এটাকে মানুষের হিদায়াতের জন্য নাযিল করা হয়েছে বলে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে পবিত্র কুরআন নাযিল হওয়ার পর এ দুটি গ্রন্থ রহিত হয়ে গেছে, তা থেকে হিদায়াত লাভের আর কোন উপায় নেই।
(২) ওয়াসিলা ইবন আসকা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সহীফাসমূহ রামাদান মাসের প্রথম রাত্রিতে নাযিল হয়েছিল, তাওরাত নাযিল হয়েছিল রামাদান মাসের ছয়দিন অতিবাহিত হওয়ার পর, ইঞ্জল নাযিল হয়েছিল রামাদান মাসের তের রাত্রি পার হওয়ার পর আর ফুরকান নাযিল হয়েছিল রামাদান মাসের চব্বিশ রাত্রি পার হওয়ার পর।” [মুসনাদে আহমাদ ৪/১০৭] কাতাদাহ বলেন, আয়াতে ফুরকান বলে পবিত্র কুরআনকে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর তা নাযিল করে এর মাধ্যমে হক ও বাতিলের পার্থক্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তাঁর হালালকৃত বস্তুকে হালাল এবং হারামকৃত বস্তুকে এর মাধ্যমে হারাম ঘোষণা করেছেন। তাঁর শরীআতকে প্রবর্তন করেছেন। অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কি কি জিনিস ফরয করেছেন তা বর্ণনা করেছেন। আর তাঁর আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন এবং অবাধ্যতা হতে নিষেধ করেছেন। [আত-তাফসীরুস সহীহ]
(৩) আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলার পরিপূর্ণ শক্তি এবং সর্ববিষয়ে সার্বিক সামর্থ্যের কথা বর্ণনা করা হয়েছে যে, তিনি মানুষকে জননীর উদরে তিনটি অন্ধকার স্তরের মাঝে কিরূপ নিপুণভাবে গঠন করেছেন। তাদের আকার-আকৃতি ও বর্ণ বিন্যাসে এমন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন যে, আকৃতি ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে একজনের আকার-আকৃতি অন্যজনের অনুরূপ নয় বিধায়, স্বতন্ত্র পরিচয় দূরূহ হয়ে পড়ে। এহেন সর্বব্যাপী জ্ঞান ও পরিপূর্ণ শক্তি-সামর্থ্যের যুক্তিসঙ্গত দাবী এই যে, ইবাদাত একমাত্র তারই করতে হবে। তিনি ছাড়া আর কারো জ্ঞান ও শক্তি-সামর্থ্য এরূপ নয়। কাজেই অন্য কেউ ইবাদাতের যোগ্যও নয়। [মাআরিফুল কুরআন]
তাফসীরে জাকারিয়া(৪) পূর্বে তিনি মানবজাতিকে সৎপথ প্রদর্শনের জন্য[1] তাওরাত ও ইঞ্জীল অবতীর্ণ করেছেন এবং তিনি ফুরক্বান (ন্যায়-অন্যায়ের মীমাংসাকারী; কুরআন) অবতীর্ণ করেছেন। [2] নিশ্চয় যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে অমান্য করে তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। বস্তুতঃ আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী।
[1] ইতিপূর্বে নবীদের উপর যে কিতাবসমূহ নাযিল হয়েছে, এই কিতাব সেগুলোর সত্যায়ন করে। অর্থাৎ, সে কিতাবগুলোতে যে কথাগুলো লিপিবদ্ধ ছিল, তার সত্যায়ন করে এবং তাতে যে সব ভবিষ্যদ্বাণী বর্ণিত হয়েছে, তা সত্য বলে স্বীকার করে। আর এর পরিষ্কার অর্থ হল, কুরআন কারীমও সেই সত্তার পক্ষ হতে অবতীর্ণ, যে সত্তা পূর্বেও বহু কিতাব নাযিল করেছেন। এটা যদি কোন অন্য পক্ষ হতে আসত অথবা মানুষের চেষ্টার ফল হত, তাহলে এর এবং উক্ত কিতাবগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মিল থাকার পরিবর্তে অমিলই থাকত।
[2] অর্থাৎ, অবশ্যই তাওরাত এবং ইঞ্জীল সব সব সময়ে মানুষের হিদায়াতের উৎস ছিল। কারণ এগুলোর অবতীর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্যই ছিল এটাই। এরপর ‘তিনি ফুরকান অবতীর্ণ করেছেন’ বলে এ কথা পরিষ্কার করে দিলেন যে, তাওরাত ও ইঞ্জীলের যামানা শেষ হয়ে গেছে। এখন তো কুরআন অবতীর্ণ হয়ে গেছে। আর কুরআনই হল ফুরকান এবং সত্য ও মিথ্যা জানার এটাই হল কষ্টিপাথর। এটাকে সত্য বলে বিশ্বাস না করলে আল্লাহর নিকট কেউ মুসলিম ও মু’মিন হতে পারবে না।
তাফসীরে আহসানুল বায়াননিশ্চয় আল্লাহর নিকট দীন হচ্ছে ইসলাম। আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের নিকট জ্ঞান আসার পরই তারা মতানৈক্য করেছে, পরস্পর বিদ্বেষবশত। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর আয়াতসমূহের সাথে কুফরী করে, নিশ্চয় আল্লাহ হিসাব গ্রহণে দ্রুত। আল-বায়ান
নিশ্চয় আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন হল ইসলাম। বস্তুতঃ যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তারা জ্ঞান লাভের পর একে অন্যের উপর প্রাধান্য লাভের জন্য মতভেদ সৃষ্টি করেছে এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করবে, (সে জেনে নিক) নিশ্চয়ই আল্লাহ হিসাব গ্রহণে অতিশয় তৎপর। তাইসিরুল
নিশ্চয়ই ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র ধর্ম। এবং যাদেরকে গ্রন্থ প্রদত্ত হয়েছে তাদের জ্ঞান আসার পরও তারা মতবিরোধে লিপ্ত রয়েছে শুধুমাত্র পরস্পর বিদ্বেষ বশতঃ; এবং যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করে নিশ্চয়ই আল্লাহ সত্ত্বর হিসাব গ্রহণকারী। মুজিবুর রহমান
Indeed, the religion in the sight of Allah is Islam. And those who were given the Scripture did not differ except after knowledge had come to them - out of jealous animosity between themselves. And whoever disbelieves in the verses of Allah, then indeed, Allah is swift in [taking] account. Sahih International
১৯. নিশ্চয় ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন।(১) আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তারা কেবলমাত্র পরস্পর বিদ্বেষবশতঃ তাদের নিকট জ্ঞান আসার মতানৈক্য ঘটিয়েছিল। আর কেউ আল্লাহ্র আয়াতসমূহে কুফরী করে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ্ দ্রুত হিসাব গ্রহনকারী।
(১) সুদ্দী বলেন, আল্লাহর নিকট মনোনীত দ্বীন হচ্ছে ইসলাম। এটা পূর্ববর্তী আয়াতে বর্ণিত আল্লাহ, তার ফেরেশতা এবং জ্ঞানীদের সাক্ষ্যের বিষয়। অর্থাৎ তারা এ সাক্ষ্যও দিচ্ছেন যে, আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন হচ্ছে ইসলাম। [তাবারী] কাতাদা বলেন, ইসলাম হচ্ছে, আল্লাহ ব্যতীত হক্ক কোন মা’বুদ নেই এ সাক্ষ্য দেয়া, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কাছ থেকে যা নিয়ে এসেছেন তার সত্যতার স্বীকৃতি প্রদান। আর এটাই হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন যা তিনি প্রবর্তন করেছেন, রাসূলদেরকে যা নিয়ে প্রেরণ করেছেন, তাঁর বন্ধুদেরকে যার দিশা দিয়েছেন। এটা ব্যতীত তিনি আর কিছু গ্রহণ করবেন না। এটা অনুপাতে না হলে তিনি কাউকে পুরস্কৃত করবেন না। [তাবারী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৯) নিশ্চয় ইসলাম আল্লাহর নিকট (একমাত্র মনোনীত) ধর্ম।[1] যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল তারা পরস্পর বিদ্বেষবশতঃ তাদের নিকট জ্ঞান আসার পরও তাদের মধ্যে মতানৈক্য ঘটিয়েছিল![2] আর যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে[3] অস্বীকার করে (সে জেনে রাখুক যে), নিশ্চয় আল্লাহ সত্বর হিসাব গ্রহণকারী।
[1] ইসলাম সেই মনোনীত দ্বীন, যার প্রতি সকল নবীগণ সব সব যুগে আহবান করেছেন এবং যার শিক্ষা দিয়েছেন। আর এখন এই ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপ হল সেটাই, যা শেষ নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) বিশ্ববাসীর সামনে পেশ করেছেন। যাতে আছে যে, তাওহীদ, রিসালাত এবং আখেরাতের উপর ঐভাবেই ঈমান আনতে হবে ও বিশ্বাস করতে হবে, যেভাবে নবী করীম (সাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন। এখন কেবল আল্লাহকে এক মনে করে নিলেই অথবা কিছু সৎকর্ম করে নিলেই যে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবে এবং আখেরাতে মুক্তি পাওয়া যাবে তা নয়; বরং ঈমান, ইসলামের দাবী হল, আল্লাহকে এক মনে করে কেবল তাঁরই ইবাদত করা। মুহাম্মাদ (সাঃ) সহ সকল নবীদের উপর ঈমান আনা। নবী করীম (সাঃ)-এর পর আর কোন নবী আসবেন না, এ কথাও স্বীকার করে নেওয়া। আর এই ঈমানের সাথে সাথে সেই আকীদা ও আমলগুলো পালন করতে হবে, যেগুলো কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এখন আল্লাহর নিকট দ্বীনে-ইসলাম ব্যতীত আর কোন দ্বীন গৃহীত হবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম অন্বেষণ করবে, তার পক্ষ হতে তা কখনও গ্রহণ করা হবে না। আর সে হবে পরলোকে ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত।’’ (সূরা আলে ইমরান ৮৫ আয়াত) নবী করীম (সাঃ)-এর নবুঅত ও রিসালাত সমগ্র মানবতার জন্য। [قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا] ‘‘বলে দাও, হে মানবমন্ডলী! তোমাদের সবার প্রতি আমি আল্লাহর প্রেরিত রসূল।’’ (সূরা আ’রাফ ১৫৮ আয়াত) [تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا] ‘‘পরম বরকতময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফুরকান অবতীর্ণ করেছেন, যাতে সে সমগ্র বিশ্বের জন্য সতর্ককারী হয়।’’ (সূরা ফুরকান ১ আয়াত) হাদীসে রসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘‘সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ আছে! ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের যে কেউ আমার উপর ঈমান না এনেই মারা যাবে, সে জাহান্নামী হবে।’’ (সহীহ মুসলিম) তিনি আরো বলেন, ‘‘আমি সাদা-কালো সকলের প্রতি প্রেরিত হয়েছি।’’ (অর্থাৎ, সকল মানুষের জন্য নবী হয়ে প্রেরিত হয়েছি।) আর এই কারণেই তিনি সেই সময়ের সমস্ত বাদশাহদের প্রতি পত্র প্রেরণ করে তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেন। (বুখারী, মুসলিম, ইবনে কাসীর)
[2] ‘মতানৈক্য’ বলতে তাদের পারস্পরিক এমন মতবিরোধ যা একই ধর্মের অনুসারীরা আপোসে বাধিয়ে রেখেছিল। যেমন, ইয়াহুদীদের পারস্পরিক মতবিরোধ এবং আপোসের বিচ্ছিন্নতা ও দলাদলি। অনুরূপ খ্রিষ্টানদের পারস্পরিক বিরোধিতা ও আপোসের বিচ্ছিন্নতা। তাছাড়া আহলে কিতাবদের পারস্পরিক মতবিরোধকেও বুঝানো হয়েছে। যে বিরোধ ও মতানৈক্যের কারণে ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা একে অপরকে বলত, ‘‘কোন কিছুর উপর তোমাদের ভিত্তি নেই।’’ মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং ঈসা (আঃ)-এর নবুঅতকে নিয়ে যে বিরোধ, তাও এর অন্তর্ভুক্ত। আর এই সকল মতবিরোধ কোন দলীলের ভিত্তিতে ছিল না। কেবল হিংসা-বিদ্বেষ এবং শত্রুতার কারণে ছিল। অর্থাৎ, তারা সত্যকে জেনে ও চিনেছিল; কিন্তু তা সত্ত্বেও কেবল দুনিয়ার খেয়ালী স্বার্থের পিছনে পড়ে ভ্রান্তমূলক কথার উপরে কায়েম থাকত এবং সেটাকেই দ্বীন বুঝানোর চেষ্টা করত। যাতে তাদের নাকও যেন উঁচু থাকে এবং জনগণের মাঝে তাদের বিশ্বস্ততাও যেন প্রতিষ্ঠিত থাকে। পরিতাপের বিষয় যে, ইদানীং মুসলিম উলামাদের এক বিরাট সংখ্যক দল ঠিক এই ধরনেরই জঘন্য উদ্দেশ্য সাধনের তাকীদে তাদের মতনই ভ্রান্ত পথ অবলম্বন করে চলেছে। আল্লাহ তাদেরকে ও আমাদেরকে হিদায়াত করুন। আমীন।
[3] এখানে ‘নিদর্শন’ বলতে সেই সব নিদর্শন, যা প্রমাণ করে যে, ইসলাম আল্লাহরই মনোনীত দ্বীন।
তাফসীরে আহসানুল বায়াননিশ্চয় যারা আল্লাহর আয়াতসমূহের সাথে কুফরী করে এবং অন্যায়ভাবে নবীদেরকে হত্যা করে, আর মানুষের মধ্য থেকে যারা ন্যায়-পরায়ণতার নির্দেশ দেয় তাদেরকে হত্যা করে, তুমি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও। আল-বায়ান
যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অমান্য করে, নাবীদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে এবং মানুষদের মধ্যে যারা ন্যায়-নীতি শিক্ষা দেয় তাদেরকে হত্যা করে, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও। তাইসিরুল
নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহ অবিশ্বাস করে ও অন্যায়ভাবে নাবীদেরকে হত্যা করে এবং হত্যা করে তাদের যারা মানবমন্ডলীর মধ্যে ন্যায়ের আদেশকারী, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। মুজিবুর রহমান
Those who disbelieve in the signs of Allah and kill the prophets without right and kill those who order justice from among the people - give them tidings of a painful punishment. Sahih International
২১. নিশ্চয় যারা আল্লাহ্র আয়াতসমূহে কুফরী করে, অন্যায়ভাবে নবীদের হত্যা করে এবং মানুষের মধ্যে যারা ন্যায়পরায়ণতার নির্দেশ দেয় তাদেরকে হত্যা করে, আপনি তাদেরকে মর্মম্ভদ শাস্তির সংবাদ দিন।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(২১) যারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে অবিশ্বাস করে, নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে এবং যে সকল লোক ন্যায়পরায়ণতার নির্দেশ দেয় তাদেরকেও হত্যা করে,[1] তুমি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।
[1] তাদের অবাধ্যতা ও হঠকারিতা এত দূর পর্যন্ত পৌঁছে ছিল যে, কেবল তারা নবীদেরকেই অন্যায়ভাবে হত্যা করেনি, বরং এমন লোকদেরকেও তারা হত্যা করেছিল যারা ন্যায়সংগত ও সুবিচারপূর্ণ কথা বলত। অর্থাৎ, যাঁরা নিষ্ঠাবান মু’মিন, সত্যের প্রতি আহবানকারী এবং ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দানকারী ছিলেন তাঁদেরকে নবীদের পাশাপাশি উল্লেখ করে মহান আল্লাহ তাঁদের মাহাত্ম্য ও ফযীলতের কথাও পরিষ্কার করে দিলেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ানহে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের সর্বনাশ করতে ত্রুটি করবে না। তারা তোমাদের মারাত্মক ক্ষতি কামনা করে। তাদের মুখ থেকে তো শত্রুতা প্রকাশ পেয়ে গিয়েছে। আর তাদের অন্তরসমূহ যা গোপন করে তা অধিক ভয়াবহ। অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ স্পষ্ট বর্ণনা করেছি। যদি তোমরা উপলব্ধি করতে। আল-বায়ান
হে মু’মিনগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদের লোক ছেড়ে অন্য কাউকেও বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, কারণ তারা তোমাদেরকে নষ্ট করতে ত্রুটি করবে না, তারা কেবল তোমাদের দুর্ভোগ কামনা করে, বস্তুতঃ তাদের মুখেও শত্রুতা প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং তাদের অন্তর যা লুকিয়ে রাখে তা আরও ভয়ঙ্কর, আমি তোমাদের কাছে তাদের লক্ষণগুলো স্পষ্ট করে দিলাম, যদি তোমরা অনুধাবন কর। তাইসিরুল
হে বিশ্বাস স্থাপনকারীগণ! তোমরা নিজেদের সম্প্রদায় ব্যতিরেকে অন্য কেহকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করনা, তারা তোমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে সংকুচিত হবেনা; এবং তোমরা যাতে বিপন্ন হও তারা তা’ই কামনা করে; বস্তুতঃ তাদের মুখ হতেই শত্রুতা প্রকাশিত হয়, এবং তাদের অন্তর যা গোপন করে তা আরও গুরুতর; নিশ্চয়ই আমি তোমাদের জন্য নিদর্শনাবলী ব্যক্ত করছি, যেন তোমরা বুঝতে পার। মুজিবুর রহমান
O you who have believed, do not take as intimates those other than yourselves, for they will not spare you [any] ruin. They wish you would have hardship. Hatred has already appeared from their mouths, and what their breasts conceal is greater. We have certainly made clear to you the signs, if you will use reason. Sahih International
১১৮. হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না(১)। তারা তোমাদের অনিষ্ট করতে ক্রটি করবে না; তারা যা তোমাদেরকে বিপন্ন করে তা-ই তারা কামনা করে। তাদের মুখে বিদ্বেষ প্রকাশ পায় এবং তাদের হৃদয় যা গোপন রাখে তা আরো গুরুতর(২)। তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছি, যদি তোমরা অনুধাবন কর(৩)।
(১) অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ মিত্ররূপে গ্রহণ করো না। بطانة শব্দের অর্থ অভিভাবক, বন্ধু, বিশ্বস্ত, রহস্যবিদ। কাপড়ের অভ্যন্তর ভাগকেও بطانة বলা হয়, যা শরীরের সাথে মিশে থাকে। কোন ব্যক্তির অভিভাবক, বিশ্বস্ত বন্ধু এবং যার সাথে পরামর্শ করে কাজ করা হয়, এরূপ ব্যক্তিকে তার بطانة বলা হয়। এখানে بطانة বলে বন্ধু, বিশ্বস্ত, গোপন তথ্যের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য লোককে বোঝানো হয়েছে। অতএব আলোচ্য আয়াতে মুসলিমদের উপদেষ্টারূপে গ্রহণ করে তাদের কাছে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য প্রকাশ করতে যেও না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ্ তাআলা যখনই কোন নবী পাঠিয়েছেন বা কোন খলীফা বা রাষ্ট্রনায়ককে ক্ষমতা প্রদান করেছেন, তখনই তার দু'ধরনের মিত্রের সমাহার ঘটে।
এক ধরনের মিত্র তাকে সৎকাজের আদেশ দেয় এবং সেটার উপর উৎসাহ যোগায়। অপর ধরনের মিত্র তাকে খারাপ কাজের নির্দেশ দেয় এবং সেটার উপর উদ্দীপনা দিতে থাকে। আল্লাহ যাকে হেফাযত করতে ইচ্ছা করেন তিনি ব্যতীত সে মিত্রের অকল্যাণ থেকে বাঁচার কোন পথ থাকে না।” [বুখারী: ৭১৯৮] ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, অন্ধকার যুগে কোন কোন মুসলিমের সাথে কোন কোন ইয়াহুদীর সন্ধিচুক্তি ছিল। সে চুক্তির কারণে ইসলাম গ্রহণের পরও মুসলিমরা তাদের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বজায় রাখত। তখন আল্লাহ্ তা'আলা এ আয়াত নাযিল করে ইয়াহুদী-নাসারা তথা অমুসলিমদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করার জন্য নির্দেশ দেন। [ইবন আবী হাতেম, আততাফসীরুস সহীহ]
(২) অর্থাৎ তারা তোমাদের মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টি করতে কসুর করবে না। তারা তোমাদের বিপদ কামনা করে। এ ধরনের কিছু বিষয় স্বয়ং তাদের মুখেও প্রকাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু অন্তরে যে শক্রতা গোপন রাখে, তা আরও মারাত্নক। আমি তোমাদেরকে সামনে সব আলামত প্রকাশ করে দিয়েছি; এখন তোমরা যদি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পার তবে তা থেকে উপকার পেতে পার।
উদ্দেশ্য এই যে, ইয়াহুদী হোক কিংবা নাসারা, কপট বিশ্বাসী মুনাফেক হোক কিংবা মুশরেক- কেউ তোমাদের সত্যিকার হিতাকাঙ্খী নয়। তারা সর্বদাই তোমাদের বোকা বানিয়ে তোমাদের ক্ষতি সাধনে ব্যাপৃত এবং ধর্মীয় ও পার্থিব অনিষ্ট সাধনে সচেষ্ট থাকে। তোমরা কষ্টে থাক এবং কোন না কোন উপায়ে তোমাদের দ্বীন ও দুনিয়ার ক্ষতি হোক, এটাই হলো তাদের কাম্য। তাদের অন্তরে যে শক্রতা লুক্কায়িত রয়েছে, তা খুবই মারাত্নক। কিন্তু মাঝে মাঝে দুর্দমনীয় জিঘাংসায় উত্তেজিত হয়ে এমন সব কথাবার্তা বলে ফেলে, যা তাদের গভীর শক্ৰতার পরিচায়ক। শক্রতা ও প্রতিহিংসায় তাদের মুখ থেকে অসংলগ্ন কথা বের হয়ে পড়ে। সুতরাং এহেন শক্রদের অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আল্লাহ তা'আলা শত্রু-মিত্রের পরিচয় ও সম্পর্ক স্থাপনের বিধান বলে দিয়েছেন, সুতরাং মুসলিমদের এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া খুবই সমীচীন।
(৩) ইসলাম বিশ্বব্যাপী করুণার ছায়াতলে মুসলিমগণকে অমুসলিমদের সাথে সহানুভুতি, শুভেচ্ছা, মানবতা ও উদারতার অসাধারণ নির্দেশ দিয়েছে। এটা শুধু মৌখিক নির্দেশই নয়; বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ একে কার্যে পরিণত করেও দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মুসলিমদের নিজস্ব রাষ্ট্র ও তার বৈশিষ্ট্যপুর্ণ কার্যাবলী সংরক্ষণের স্বার্থে ইসলাম এ নির্দেশও দিয়েছে যে, ইসলামী আইনে অবিশ্বাসী ও বিদ্রোহীদের সাথে সম্পর্ক একটি বিশেষ সীমার বাইরে এগিয়ে নেয়ার অনুমতি মুসলিমদের দেয়া যায় না। কারণ, এতে ব্যক্তি ও জাতি উভয়েরই সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি যুক্তিপুর্ণ, সঙ্গত ও জরুরী ব্যবস্থা। এতে ব্যক্তি ও জাতি উভয়েরই হেফাজত হয়। যে সব অমুসলিম মুসলিম রাষ্ট্রের বাসিন্দা কিংবা মুসলিমদের সাথে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ, তাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষনের জন্যে জোরদার নির্দেশাবলী ইসলামী আইনের গুরুত্বপুর্ণ অংশ। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “সাবধান! যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের প্রতি অত্যাচার করে কিংবা তার প্রাপ্য হ্ৰাস করে কিংবা তার উপর সামর্থ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেয় অথবা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার কাছ থেকে কোন জিনিস গ্রহণ করে, তবে কেয়ামতের দিন আমি তার পক্ষ থেকে উকিল হবো”। [আবু দাউদঃ ৩০৫২]
কিন্তু এসব উদারতার সাথে সাথে মুসলিমদের নিজস্ব সত্তার হেফাযতের স্বার্থে এ নির্দেশও দেয়া হয়েছে যে, ইসলাম ও মুসলিমদের শক্রদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু কিংবা বিশ্বস্ত মুরুব্বীরূপে গ্রহণ করো না। উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলা হলো যে, এখানে একজন হস্তলিপিতে সুদক্ষ অমুসলিম বালক রয়েছে। আপনি তাকে ব্যক্তিগত মুনশী হিসাবে গ্রহণ করে নিলে ভালই হবে। উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু উত্তরে বলেনঃ এরূপ করলে মুসলিমদের ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীকে বিশ্বস্তরূপে গ্রহণ করা হবে, যা কুরআনে নির্দেশের পরিপন্থী। [ইবন আবী হাতেম; আত-তাফসীরুস সহীহ] ইমাম কুরতুবী হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর বিখ্যাত আলেম ও তফসীরবিদ। তিনি অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার সাথে মুসলিমদের মধ্যে এ শিক্ষার বিরুদ্ধাচরন ও তার অশুভ পরিণাম এভাবে বর্ণনা করেনঃ “আজকাল অবস্থা এমন পাল্টে গেছে যে, ইয়াহুদী ও নাসারাদেরকে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্যরূপে গ্রহণ করা হচ্ছে এবং এভাবে ওরা মুর্খ বিত্তশালী ও শাসকদের ঘাড়ে চেপে বসেছে।” আধুনিক সভ্যতার যুগেও বিশেষ মতাদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে সংশ্লিষ্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী নয়- এমন কোন ব্যক্তিকে উপদেষ্টা ও মুরুব্বীরূপে গ্রহণ করা হয় না। তাই মুসলিম শাসকগণেরও এ ব্যাপারে সাবধান থাকা উচিত।
তাফসীরে জাকারিয়া(১১৮) হে বিশ্বাসিগণ! তোমাদের আপনজন ব্যতীত অন্য (অবিশ্বাসী) কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। [1] তারা তোমাদের অনিষ্ট সাধনে কোন ত্রুটি করবে না। যাতে তোমরা বিপন্ন হও, তাই তারা কামনা করে।[2] তাদের মুখে বিদ্বেষ প্রকাশ পায় এবং যা তাদের অন্তর গোপন রাখে, তা আরও গুরুতর। তোমাদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করছি, যদি তোমরা অনুধাবন কর।
[1] এই বিষয়টা পূর্বেও আলোচিত হয়েছে। বিষয়টা যেহেতু অতীব গুরুত্বপূর্ণ তাই এখানে তার পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে। بِطَانَة বলা হয় অন্তরঙ্গ ও বিশ্বস্ত বন্ধু এবং রহস্যবিদকে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফের ও মুশরিকরা যে সব অসদিচ্ছা ও দুরভিসন্ধি রাখে এবং তার মধ্যে যা তারা প্রকাশ করে আর যা নিজেদের অন্তরে গোপন রাখে, তার সব কিছুকেই মহান আল্লাহ (কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে) চিহ্নিত করে দিয়েছেন। এই আয়াত এবং এই ধরনের অন্য আয়াতসমূহের ভিত্তিতে উলামা ও ফক্বীহগণ লিখেছেন যে, কোন ইসলামী দেশে অমুসলিমদেরকে গুরুত্বপূর্ণ কোন (নেতৃত্ব) পদে নিযুক্ত করা জায়েয নয়। বর্ণিত হয়েছে যে, আবূ মুসা আশআরী (রাঃ) একজন অমুসলিমকে সেক্রেটারী (কর্মসচিব) নিযুক্ত করেন। উমার (রাঃ) এ ব্যাপার জানতে পারলে তাঁকে কঠোর ধমক দিয়ে বলেন, ‘তুমি ওদেরকে তোমার কাছে টেনে নিও না, যখন আল্লাহ ওদেরকে দূর করে দিয়েছেন। তুমি ওদের সম্মান দান করো না, যখন আল্লাহ ওদেরকে লাঞ্ছিত করেছেন। আর তুমি ওদেরকে বিশ্বস্ত ও গোপন তথ্যের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য মনে করো না, কারণ আল্লাহ ওদেরকে বিশ্বাসঘাতক সাব্যস্ত করেছেন।’ উমার (রাঃ) এই আয়াতের ভিত্তিতেই এই ধরনের কথা বলেছেন। ইমাম ক্বুরত্বুবী বলেন, ‘এই যুগে আহলে-কিতাবকে সেক্রেটারী নিযুক্ত এবং বিশ্বস্ত মনে করার কারণে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে এবং এই কারণেই নির্বোধ ও বোকা প্রকৃতির লোকেরা নেতা ও আমীর হয়ে বসে আছে।’ (তাফসীর ক্বুরত্বুবী) দুর্ভাগ্যবশতঃ বর্তমানে বহু মুসলিম দেশেও কুরআন কারীমের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই নির্দেশের কোনই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। তাই তো অমুসলিমরা মুসলিম দেশেও বড় বড় পদে এবং বিশেষ বিশেষ দায়িত্বে বহাল রয়েছে। আর এর অনিষ্টকারিতা যে কত বড় তা সকলের কাছে পরিষ্কার। যদি মুসলিম দেশগুলো স্বীয় দেশের সবরাষ্ট্রীয় ও পররাষ্ট্রীয় নীতির ব্যাপারে কুরআনের নির্দেশকে গুরুত্ব দিত, তাহলে নিঃসন্দেহে তারা বহু ফিতনা-ফাসাদ ও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেত।
[2] لاَ يَألُوْنَ ত্রুটি ও কসুর করবে না। خَبَالًا এর অর্থঃ বিশৃঙ্খলা, অনিষ্ট ও কষ্ট। مَا عَنِتُّمْ (যাতে তোমরা বিপন্ন হও, কষ্টে পতিত হও) عَنَتٌ মানে কষ্ট, বিপদ।
তাফসীরে আহসানুল বায়াননিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের বিবর্তনের মধ্যে রয়েছে বিবেকসম্পন্নদের জন্য বহু নির্দশন। আল-বায়ান
নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে এবং রাত্র ও দিনের আবর্তনে জ্ঞানবানদের জন্য বহু নিদর্শন আছে। তাইসিরুল
নিশ্চয়ই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টিতে এবং দিন ও রাতের পরিবর্তনে জ্ঞানবানদের জন্য স্পষ্ট নিদর্শনাবলী রয়েছে। মুজিবুর রহমান
Indeed, in the creation of the heavens and the earth and the alternation of the night and the day are signs for those of understanding. Sahih International
১৯০. আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে(১), রাত ও দিনের পরিবর্তনে(২) নিদর্শনাবলী রয়েছে(৩) বোধশক্তি সম্পন্ন লোকদের জন্য।
(১) অর্থাৎ আসমান এবং যমীন সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ্ তা'আলার এক বিরাট নিদর্শন বিদ্যমান। এ দুয়ের মধ্যে অবস্থিত আল্লাহ তা'আলার অসংখ্য সৃষ্টিরাজিকেও এ আয়াত দ্বারা বুঝানো হয়েছে। এ বিরাট সৃষ্টজগতের মধ্যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত প্রতিটি সৃষ্ট বস্তুই স্ব স্ব সৃষ্টিকর্তার নিদর্শনরূপে দাঁড়িয়ে আছে।
(২) চিন্তা-ভাবনার দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, দিন-রাত্রির আবর্তন। আয়াতে উল্লেখিত اختلاف শব্দটি আরবী পরিভাষায়, ‘পরে আসা’ এর অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সেমতে বাক্যের অর্থ হবে, রাত্রির গমন এবং দিবসের আগমন। আবার اختلاف শব্দ দ্বারা কম-বেশীও বুঝায়। যেমন, শীতকালে রাত্রি হয় দীর্ঘ এবং দিন হয় খাটো, গরমকালে দিন বড় এবং রাত্রি হয় ছোট। অনুরূপভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে দিবস এবং রাত্রির দৈর্ঘ্যেও তারতম্য হয়ে থাকে। যেমন, উত্তর মেরুর সন্নিকটবর্তী দেশগুলোতে দিবাভাগ উত্তর মেরু থেকে দুরবর্তী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশী দীর্ঘ হয়। এসব বিষয়ই আল্লাহ্ তা'আলার অপার কুদরাতের অতি উজ্জ্বল নিদর্শন।
(৩) آية এর বহুবচন হল آيات। শব্দটি কয়েকটি অর্থেই ব্যবহৃত হয়। যথা- মু'জিযাকে ‘আয়াত’ বলা হয়। অনুরূপভাবে, কুরআনের বাক্যকেও ‘আয়াত’ বলা হয়। তৃতীয় অর্থে দলীল-প্রমাণ ও নিদর্শনাবলীকে বুঝানো হয়ে থাকে। এখানে তৃতীয় অর্থেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ এসব বিষয়ের মধ্যে আল্লাহ্ তা'আলার বিরাট নিদর্শনাবলী রয়েছে।
তাফসীরে জাকারিয়া(১৯০) নিশ্চয় আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের পরিবর্তনে জ্ঞানী লোকেদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। [1]
[1] অর্থাৎ, যাঁরা আসমান ও যমীনের সৃষ্টি এবং বিশ্ব-জাহানের অন্যান্য রহস্য এবং গুপ্তবিষয় সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করেন, তাঁরা বিশ্বের স্রষ্টা এবং তার পরিচালকের পরিচয় অর্জন করতে সক্ষম হন এবং তাঁরা জেনে যান যে, বিশাল এই পৃথিবীর সুনিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খলা ও সুব্যবস্থা --যাতে সামান্য পরিমাণও কোন বিশৃঙ্খলা দেখা যায় না-- অবশ্যই তার পিছনে এমন কোন সত্তা আছে যে তা সূক্ষ্ণভাবে পরিচালনা করছে এবং তা নিয়ন্ত্রণ করছে। আর সে সত্তা হল আল্লাহর সত্তা। পরের আয়াতে এই জ্ঞানীজনদের গুণাবলী উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তাঁরা দাঁড়িয়ে-বসে এবং শয়ন অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করেন।---হাদীসে বর্ণিত যে, ১৯০নং আয়াত থেকে সূরার শেষ পর্যন্ত আয়াতগুলো নবী করীম (সাঃ) যখন রাতে তাহাজ্জুদ নামায পড়ার জন্য উঠতেন, তখন পড়তেন এবং তারপর ওযূ করতেন। (বুখারী ৪৫৬৯-মুসলিম ২৫৬নং)
তাফসীরে আহসানুল বায়ানমাসীহ ইবনে মারইয়াম একজন রাসূল ছাড়া আর কিছুই নয়; তার পূর্বে আরও বহু রাসূল গত হয়েছে, আর তার মা একজন পরম সত্যবাদিনী, তারা উভয়ে খাদ্য আহার করত। লক্ষ্য কর! আমি কিরূপে তাদের নিকট প্রমাণসমূহ বর্ণনা করছি। আবার লক্ষ্য কর! তারা উল্টা কোন দিকে যাচ্ছে? আল-বায়ান
মারইয়াম পুত্র ‘ঈসা রসূল ছাড়া কিছুই ছিল না। তার পূর্বে আরো রসূল অতীত হয়ে গেছে, তার মা ছিল সত্যপন্থী মহিলা, তারা উভয়েই খাবার খেত; লক্ষ্য কর তাদের কাছে (সত্যের) নিদর্শনসমূহ কেমন সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরছি আর এটাও লক্ষ্য কর যে, কীভাবে তারা (সত্য হতে) বিপরীত দিকে চলে যাচ্ছে। তাইসিরুল
মারইয়াম পুত্র মাসীহ কেবল একজন রাসূল। তার পূর্বে অনেক রাসূল বিগত হয়েছে এবং তার মা ছিল অতি সত্যবাদী। তারা উভয়ে খাবার খেত। দেখ, কীভাবে আমি তাদের জন্য আয়াতসমূহ বর্ণনা করছি। অতঃপর দেখ, কীভাবে তাদেরকে সত্যবিমুখ করা হচ্ছে। মুজিবুর রহমান
The Messiah, son of Mary, was not but a messenger; [other] messengers have passed on before him. And his mother was a supporter of truth. They both used to eat food. Look how We make clear to them the signs; then look how they are deluded. Sahih International
৭৫. মারইয়াম-তনয় মসীহ শুধু একজন রাসূল। তার আগে বহু রাসূল গত হয়েছেন(১) এবং তার মা অত্যন্ত সত্য নিষ্ঠা ছিলেন। তারা দুজনেই খাওয়া-দাওয়া করতেন।(২) দেখুন, আমরা তাদের জন্য আয়াতগুলোকে কেমন বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করি; তারপরও দেখুন, তারা কিভাবে সত্যবিমুখ হয়!
(১) অর্থাৎ অন্যান্য নবী যেমন দুনিয়াতে আগমন করার পর কিছুদিন অবস্থান করে চলে গেছেন; কাজেই তিনি উপাস্য হতে পারেন না। তিনি অন্যান্য নবী-রাসূলদের মতই একজন মানুষ। একজন রাসূলের বেশী তো তিনি কিছু নন। তবে আল্লাহ তাকে বনী-ইসরাঈলের জন্য নিদর্শন বানিয়েছেন। আল্লাহ্ বলেন, “তিনি তো কেবল আমারই এক বান্দা, যার উপর আমরা অনুগ্রহ করেছিলাম এবং তাকে বানিয়েছিলাম বনী ইসরাঈলের জন্য দৃষ্টান্ত।” [সূরা আয-যুখরুফ ৫৯] [ইবন কাসীর]
(২) যে ব্যক্তি পানাহারের মুখাপেক্ষী সে পৃথিবীর সবকিছুরই মুখাপেক্ষী। মাটি, বাতাস, পানি, সূর্য এবং জীবজন্তু থেকে সে অমুখাপেক্ষী হতে পারে না। পরমুখাপেক্ষীতার এ দীর্ঘ পরম্পরার প্রতি লক্ষ্য রেখে আমরা মসীহ ও মারইয়ামের উপাস্যতা খণ্ডণকল্পে যুক্তির আকারে এরূপ বলতে পারি, মসীহ ও মারইয়াম পানাহারের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র থেকে মুক্ত ছিলেন না। এ বিষয়টি চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা ও লোক পরম্পরা দ্বারা প্রমাণিত। আর যে পানাহার থেকে মুক্ত নয়, যে সত্তা মানব-মণ্ডলীর মত স্বীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে বস্তুজগতের মুখাপেক্ষী, সে কিভাবে আল্লাহ হতে পারে? এ শক্তিশালী ও সুস্পষ্ট যুক্তিটি জ্ঞানী ও মূর্খ সবাই সমভাবে বুঝতে পারে। অর্থাৎ পানাহার করা উপাস্য হওয়ার পরিপন্থী। [বাগভী, ইবন কাসীর, সা’দী, আইসারুত তাফসীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(৭৫) মারয়্যাম-তনয় মসীহ তো একজন রসূল মাত্র। তার পূর্বে বহু রসূল গত হয়েছে এবং তার মাতা সত্যনিষ্ঠ ছিল।[1] তারা উভয়ে খাদ্যাহার করত।[2] দেখ, ওদের জন্য আয়াত (বাক্য) কিরূপ বিশদভাবে বর্ণনা করি। আরও দেখ, ওরা কিভাবে সত্য-বিমুখ হয়।
[1] صديقة শব্দের অর্থ; মু’মিন ও অলী। অর্থাৎ, তিনিও ঈসা (আঃ)-এর উপর ঈমান আনয়নকারী এবং তাঁকে সত্যজ্ঞানকারীদের একজন ছিলেন। আর তার অর্থ এই যে, তিনি নবী ছিলেন না। যেমনটি কিছু লোকের ধারণা, যাঁরা মারয়্যাম (‘আলাইহাস্ সালাম) সহ (ইসহাক (আঃ)-এর জননী) সারাহ এবং মূসা (আঃ)-এর জননীকে নবী ছিলেন বলে মনে করেন। আর এর প্রমাণে তাঁরা বলেন যে, প্রথমোক্ত দুই জনের সাথে ফিরিশতাগণের কথোপকথন হয়। আর মূসা (আঃ)-এর জননীর সাথে স্বয়ং আল্লাহ অহী করেন। আর এই কথোপকথন ও অহী উভয়ই নবী হওয়ারই প্রমাণ। কিন্তু অধিকাংশ উলামাগণের নিকট এ প্রমাণ বা দলীল এমন নয়, যা কুরআনের স্পষ্ট উক্তির মোকাবেলা করতে পারে। মহান আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে, ‘‘আমি যত রসূল পাঠিয়েছি সকলেই পুরুষ ছিল। (সূরা ইউসুফ ১০৯)
[2] ঈসা (আঃ) এবং মারয়্যাম (‘আলাইহাস্ সালাম) আল্লাহ বা উপাস্য ছিলেন না; বরং তাঁরা উভয়ে মানুষ ছিলেন তার প্রমাণ পেশ করা হচ্ছে। যেহেতু পানাহার করা মানুষের দৈহিক চাহিদা ও প্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে গণ্য। যিনি মা’বুদ বা উপাস্য তিনি এ সবের ঊর্ধ্বে; বরং ঊর্ধ্ব থেকেও ঊর্ধ্বে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ানবল, ‘তোমরা আমাকে জানাও, যদি আল্লাহ তোমাদের শ্রবণ ও দৃষ্টিসমূহ কেড়ে নেন এবং তোমাদের অন্তরসমূহে মোহর এঁটে দেন, কে আছে ইলাহ, আল্লাহ ছাড়া, যে তোমাদের এগুলো নিয়ে আসবে’? দেখ, কীভাবে আমি বিভিন্নরূপে নিদর্শনসমূহ বর্ণনা করি, তারপর তারা এড়িয়ে চলে। আল-বায়ান
(হে রসূল) বল, তোমরা কি ভেবে দেখেছ আল্লাহ যদি তোমাদের শ্রবণশক্তি আর দর্শন শক্তি কেড়ে নেন, আর তোমাদের অন্তরে মোহর লাগিয়ে দেন তাহলে আল্লাহ ছাড়া আর কে ইলাহ আছে সেগুলো তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেবে? লক্ষ্য কর আমি আমার (শক্তি-ক্ষমতার) নিদর্শনগুলোকে কেমন বিশদভাবে বর্ণনা করি কিন্তু তা সত্তেও তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাইসিরুল
তুমি জিজ্ঞেস করঃ আল্লাহ যদি তোমাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেন এবং তোমাদের মনের কপাটে তালা লাগিয়ে মোহর এটে দেন তাহলে এই শক্তি তোমাদেরকে আবার দান করতে পারে এমন কোন সত্তা আল্লাহ ব্যতীত আছে কি? লক্ষ্য করতো! আমি আমার নিদর্শনসমূহ ও দলীল প্রমাণাদী কিভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বর্ণনা করছি। এর পরেও তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়! মুজিবুর রহমান
Say, "Have you considered: if Allah should take away your hearing and your sight and set a seal upon your hearts, which deity other than Allah could bring them [back] to you?" Look how we diversify the verses; then they [still] turn away. Sahih International
৪৬. বলুন, তোমরা কি ভেবে দেখেছ, আল্লাহ যদি তোমাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেন এবং তোমাদের হৃদয়ে মোহর করে দেন তবে আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন ইলাহ আছে যে তোমাদের এগুলো ফিরিয়ে দেবে? দেখুন, আমরা কিরূপে আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ননা করি; এরপরও তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৪৬) বল, ‘তোমরা আমাকে বল, আল্লাহ যদি তোমাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেন এবং তোমাদের হৃদয় মোহর করে দেন, তাহলে আল্লাহ ব্যতীত কোন্ উপাস্য আছে, যে তোমাদের ঐগুলি ফিরিয়ে দেবে?’ লক্ষ্য কর, কিরূপে আয়াতগুলি নানাভাবে বর্ণনা করি। এতদসত্ত্বেও তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। [1]
[1] চোখ, কান এবং অন্তর হল মানুষের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মহান আল্লাহ বলছেন, তিনি ইচ্ছা করলে তাদের সেই বৈশিষ্ট্যগুলো ছিনিয়ে নিতে পারেন, যেগুলো তিনি তাদের দেহে দিয়ে রেখেছেন। অর্থাৎ, দেখার, শোনার এবং অনুধাবন করার বৈশিষ্ট্যসমূহ। যেমন, কাফেরদের ঐ অঙ্গগুলো উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ থেকে বঞ্চিত থাকে। অথবা তিনি চাইলে অঙ্গগুলোকেই নিঃশেষ করে দেবেন। দু’টোই তিনি করতে পারেন। তাঁর পাকড়াও থেকে কেউ বাঁচতে পারে না; কেবল সে ছাড়া যাকে তিনিই বাঁচাতে চান। আয়াতগুলি বিভিন্নভাবে পেশ করার অর্থ হল, কখনো সতর্ক করে, কখনো সুসংবাদ দিয়ে, কখনো লোভ দেখিয়ে, কখনো ভয় দেখিয়ে, আবার কখনো অন্যভাবেও।
তাফসীরে আহসানুল বায়াননিশ্চয় আল্লাহ বীজ ও আঁটি বিদীর্ণকারী। তিনি মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে বেরকারী। তিনিই আল্লাহ, সুতরাং (সৎপথ থেকে) কোথায় তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে? আল-বায়ান
আল্লাহই হচ্ছেন শস্য দানা ও বীজ বিদীর্ণকারী, তিনি মৃত থেকে জীবন্তকে বের করেন এবং জীবন্ত থেকে মৃতকে। এই হচ্ছেন আল্লাহ; সৎপথ থেকে তোমরা কোথায় চলে যাচ্ছ? তাইসিরুল
নিশ্চয়ই দানা ও বীজ দানকারী হচ্ছেন আল্লাহ। তিনিই জীবন্তকে প্রাণহীন থেকে বের করেন এবং তিনিই প্রাণহীনকে জীবন্ত হতে নিগর্তকারী; তিনিইতো আল্লাহ, তাহলে তোমরা কোথায় যাচ্ছো? মুজিবুর রহমান
Indeed, Allah is the cleaver of grain and date seeds. He brings the living out of the dead and brings the dead out of the living. That is Allah; so how are you deluded? Sahih International
৯৫. নিশ্চয় আল্লাহ শস্য-বীজ ও আঁটি বিদীর্ণকারী, তিনিই প্রাণহীন থেকে জীবন্তকে বের করেন এবং জীবন্ত থেকে প্রাণহীন বেরকারী।(১) তিনিই তো আল্লাহ্, কাজেই তোমাদেরকে কোথায় ফিরানো হচ্ছে?(২)
(১) অর্থাৎ আল্লাহ্ তা'আলাই মৃত বস্তু থেকে জীবিত বস্তু সৃষ্টি করেন। মৃত বস্তু যেমন, বীর্য ও ডিম- এগুলো থেকে মানুষ ও জন্তু-জানোয়ার সৃষ্টি হয়, এমনিভাবে তিনি জীবিত বস্তু থেকে মৃত বস্তু বের করে দেন- যেমন, বীর্য ও ডিম জীবিত বস্তু থেকে বের হয়। [জালালাইন; মুয়াসসার]
(২) এগুলো সব এক আল্লাহর কাজ। অতঃপর এ কথা জেনে-শুনে তোমরা কোন দিকে বিভ্রান্ত হয়ে ঘোরাফেরা করছ? তোমরা স্বহস্তে নির্মিত প্রতিমাকে বিপদ-বিদূরণকারী ও অভাব পূরণকারী উপাস্য বলতে শুরু করেছ। [মুয়াসসার]
তাফসীরে জাকারিয়া(৯৫) নিশ্চয় আল্লাহ শস্যবীজ ও আঁটিকে অঙ্কুরিত করেন।[1] তিনিই প্রাণহীন হতে জীবন্তকে নির্গত করেন[2] এবং জীবন্ত হতে প্রাণহীনকে নির্গত করেন।[3] তিনিই তো আল্লাহ। সুতরাং তোমরা কোথায় ফিরে যাবে?
[1] এখান থেকে আল্লাহর অপরিসীম শক্তি এবং তাঁর কর্মক্ষমতার কথা আরম্ভ হচ্ছে। বললেন, আল্লাহ তাআলা বীজ ও আঁটি, -- যেটাকে চাষী জমির নীচে (মাটি) চাপা দেয় -- তা অঙ্কুরিত করে তা থেকে বহু প্রকার বৃক্ষ উদগত করেন। জমি একটাই এবং যে পানি দিয়ে তার সেচ করা হয় তাও একটাই, কিন্তু যে যে জিনিসের সে বীজ বপন করে অথবা আঁটি পুঁতে সেই অনুযায়ী মহান আল্লাহ বিভিন্ন প্রকার শস্যাদি ও ফল-মূলের গাছ সৃষ্টি করেন। আচ্ছা, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ এমন আছে নাকি, যে এ কাজ করে বা করতে পারে?
[2] অর্থাৎ, বীজ এবং আঁটি থেকে বৃক্ষ উদগত করেন; যাতে থাকে জীবন এবং তা বাড়ে, সম্প্রসারিত হয় এবং ফল অথবা শস্য দেয় কিংবা সেই সুগন্ধময় রকমারি ফুল; যা দেখে বা যার ঘ্রাণ নিয়ে মানুষ আনন্দ ও খুশী অনুভব করে। অথবা বীর্য ও ডিম থেকে মানুষ ও জীব-জন্তু সৃষ্টি করেন।
[3] অর্থাৎ, জীব-জন্তু থেকে ডিমকে; যা মৃত জিনিসেরই আওতাভুক্ত। حي এবং ميت ব্যাখ্যা মু’মিন এবং কাফেরও করা হয়েছে। অর্থাৎ, মু’মিনের ঘরে কাফের এবং কাফেরের ঘরে মু’মিন সৃষ্টি করেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান(তিনি) প্রভাত উদ্ভাসক। তিনি বানিয়েছেন রাতকে প্রশান্তি এবং সূর্য ও চন্দ্রকে সময় নিরূপক। এটা সর্বজ্ঞ পরাক্রমশালীর নির্ধারণ। আল-বায়ান
তিনি ঊষার উন্মেষ ঘটান, তিনি রাত সৃষ্টি করেছেন শান্তি ও আরামের জন্য, সূর্য ও চন্দ্র বানিয়েছেন গণনার জন্য। এসব মহাপরাক্রমশালী সর্বজ্ঞাতা কর্তৃক নির্ধারিত। তাইসিরুল
তিনিই রাতের আবরণ বিদীর্ণ করে রঙ্গিন প্রভাতের উন্মেষকারী, তিনিই রাতকে বিশ্রামকাল এবং সূর্য ও চাঁদকে সময়ের নিরূপক করে দিয়েছেন; এটা হচ্ছে সেই পরম পরাক্রান্ত ও সর্ব পরিজ্ঞাতার (আল্লাহর) নির্ধারণ। মুজিবুর রহমান
[He is] the cleaver of daybreak and has made the night for rest and the sun and moon for calculation. That is the determination of the Exalted in Might, the Knowing. Sahih International
৯৬. তিনি প্রভাত উদ্ভাসকৎ(১) আর তিনি রাতকে প্রশান্তি এবং সূর্য ও চাঁদকে সময়ের নিরুপক করেছেন(২); এটা পরাক্রমশালী মহাজ্ঞানী আল্লাহ্র নির্ধারণ।(৩)
(১) فَالِقُ শব্দের অর্থ ফাঁককারী এবং إصباح শব্দের অর্থ এখানে প্রভাতকাল। (فَالِقُ الْإِصْبَاحِ) এর অর্থ প্রভাতের ফাঁককারী; অর্থাৎ গভীর অন্ধকারের চাদর ফাঁক করে প্রভাতের উন্মেষকারী। [জালালাইন] এটিও এমন একটি কাজ, যাতে জ্বিন, মানব ও সমগ্র সৃষ্ট জীবের শক্তিই ব্যর্থ। প্রতিটি চক্ষুষ্মান ব্যক্তি এ কথা বুঝতে বাধ্য যে, রাত্রির অন্ধকারের পর প্রভাতরশ্মির উদ্ভাবক জ্বিন, মানব, ফিরিশতা অথবা অন্য কোন সৃষ্টজীব হতে পারে না, বরং এটি বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ্ তা'আলারই কাজ। তিনি ধীরে ধীরে অন্ধকার চিরে আলোর উন্মেষ ঘটান। সে আলোতে মানুষ তাদের জীবিকার জন্যে বের হতে পারে। [সা’দী]
(২) অর্থাৎ আল্লাহ্ তা'আলা সূর্য ও চন্দ্রের উদয়-অস্ত এবং এদের গতিকে একটি বিশেষ হিসাবের অধীনে রেখেছেন। এর ফলে মানুষ বৎসর, মাস, দিন, ঘন্টা এমনকি মিনিট ও সেকেণ্ডের হিসাবও অতি সহজে করতে পারে। আল্লাহ্ তা'আলার অপার শক্তিই এসব উজ্জ্বল বিশাল গোলক ও এদের গতি-বিধিকে অটল ও অনড় নিয়মের অধীন করে দিয়েছে। হাজার হাজার বছরেও এদের গতি-বিধিতে এক মিনিট বা এক সেকেণ্ডের পার্থক্য হয় না। এ উজ্জ্বল গোলকদ্বয় নিজ নিজ কক্ষপথে নির্দিষ্ট গতিতে বিচরণ করছে। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, “সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় চাদের নাগাল পাওয়া এবং রাতের পক্ষে সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রমকারী হওয়া। আর প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষপথে সাতার কাটে।” [সূরা ইয়াসীন: ৪০]
পরিতাপের বিষয়, প্রকৃতির এ অটল ও অপরিবর্তনীয় ব্যবস্থা থেকেই মানুষ প্রতারিত হয়েছে। তারা এগুলোকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ বরং উপাস্য ও উদ্দিষ্ট মনে করে বসেছে। যদি এ ব্যবস্থা মাঝে মাঝে অচল হয়ে যেত এবং কলকজা মেরামতের জন্য কয়েকদিন বা কয়েক ঘন্টার বিরতি দেখা দিত, তবে মানুষ বুঝতে পারত যে, এসব মেশিন আপনা আপনিই চলে না, বরং এগুলোর পরিচালক ও নির্মাতা আছে। আসমানী কিতাব, নবী ও রাসূলগণ এ সত্য উদঘাটন করার জন্যই প্রেরিত হন। কুরআনুল কারীমের এ বাক্য আরো ইঙ্গিত করেছে যে, বছর ও মাসের সৌর ও চান্দ্র উভয় প্রকার হিসাবই হতে পারে এবং উভয়টিই আল্লাহ্ তা'আলার নেয়ামত। এর মাধ্যমেই সময় ও কাল নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে। এতে এক দিকে যেমন ইবাদতের সময় নির্ধারণ করা যায়, অপরদিকে এর মাধ্যমে লেন-দেনের সময়ও ঠিক রাখা যায়। তাছাড়া কতটুকু সময় পার হয়েছে আর কতটুকু বাকী রয়েছে সেটা জানাও এ দুটোর কারণেই হয়ে থাকে। যদি এগুলো না থাকত, তবে এ সময় নির্ধারণের ব্যাপারটি সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকত না। এর জন্য বিশেষ শ্রেণীর প্রয়োজন পড়ত। যাতে দ্বীন ও দুনিয়ার অনেক স্বার্থ হানি ঘটত। [সা'দী]
(৩) অর্থাৎ এ বিস্ময়কর অটল ব্যবস্থা- যাতে কখনো এক মিনিট ও এক সেকেণ্ড এদিক-ওদিক হয় না- এটি একমাত্র আল্লাহ তা'আলারই দুটি মহান গুণ অপরিসীম শক্তি ও অপার জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ। [মানার] এজন্যেই বাক্যের শেষে আল্লাহর দুটি গুণ বাচক নাম পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী’ উল্লেখ করা হয়েছে। তার অপার শক্তির কারণে সমস্ত কিছু তার অনুগত বাধ্য হয়েছে। আর তার পরিপূর্ণ জ্ঞানের কারণে কোন গোপন বা প্রকাশ্য সবকিছু তার আয়ত্বাধীন রয়েছে। [সা'দী]
তাফসীরে জাকারিয়া(৯৬) তিনিই ঊষার উন্মেষ ঘটান,[1] আর তিনিই বিশ্রামের জন্য রাত[2] এবং গণনার জন্য চন্দ্র ও সূর্যকে সৃষ্টি করেছেন,[3] এ সব পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ কর্তৃক সুবিন্যস্ত।
[1] অন্ধকার ও আলোর স্রষ্টাও তিনিই। তিনি রাতের অন্ধকার থেকে উজ্জ্বল প্রভাত সৃষ্টি করেন। ফলে প্রতিটি জিনিসই আলোকিত হয়ে যায়।
[2] অর্থাৎ, রাতকে অন্ধকার দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন, যাতে মানুষ উজ্জ্বলতার সমস্ত ব্যস্ততাকে দূর করে বিশ্রাম নিতে পারে।
[3] (অথবা হিসাবমত সূর্য ও চন্দ্রকে সৃষ্টি করেছেন।) অর্থাৎ, উভয়ের জন্য একটি হিসাব বাঁধা আছে, যাতে কোন পরিবর্তন ও অনিয়ম ঘটতে পারে না। বরং উভয়ের রয়েছে নিজ নিজ কক্ষপথ, যাতে তারা শীত-গ্রীষ্মে ধাবমান থাকে। আর এরই ভিত্তিতে শীতের সময় দিন ছোট এবং রাত বড় হয়, আর গ্রীষ্ম এর বিপরীত; অর্থাৎ, দিন বড় এবং রাত ছোট হয়। এর বিস্তারিত আলোচনা সূরা ইউনুসের ৫নং আয়াতে, সূরা ইয়াসীনের ৪০নং আয়াতে এবং সূরা আ’রাফের ৫৪ নং আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ানআর তিনিই সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য তারকারাজি, যাতে তোমরা এ দ্বারা পথপ্রাপ্ত হও স্থল ও সমুদ্রের অন্ধকারে। অবশ্যই আমি আয়াতসমূহকে বিস্তারিত বর্ণনা করেছি এমন কওমের জন্য যারা জানে। আল-বায়ান
তিনি তোমাদের জন্য নক্ষত্ররাজি সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা সেগুলোর সাহায্যে জলে স্থলে অন্ধকারে পথের দিশা লাভ করতে পার। আমি আমার নিদর্শনগুলোকে জ্ঞানীদের জন্য বিশদভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি। তাইসিরুল
আর তিনিই তোমাদের জন্য নক্ষত্ররাজিকে সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা ওগুলির সাহায্যে অন্ধকারে পথের সন্ধান পেতে পার স্থল ভাগে এবং সমুদ্রে। নিশ্চয়ই আমি প্রমাণসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি ঐ সমস্ত লোকের জন্য যারা জ্ঞান রাখে। মুজিবুর রহমান
And it is He who placed for you the stars that you may be guided by them through the darknesses of the land and sea. We have detailed the signs for a people who know. Sahih International
৯৭. আর তিনিই তোমাদের জন্য তারকামণ্ডল সৃষ্টিকরেছেন যেন তা দ্বারা তোমরা স্থলের ও সাগরের অন্ধকারে পথ খুঁজে পাও(১)। অবশ্যই আমরা জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আয়াতসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছি।(২)
(১) অর্থাৎ সূর্য ও চন্দ্র ছাড়া অন্যান্য নক্ষত্রও আল্লাহ্ তা'আলার অপরিসীম শক্তির বহিঃপ্রকাশ। এগুলো সৃষ্টি করার পিছনে যে হাজারো রহস্য রয়েছে, তন্মধ্যে একটি এই যে, স্থল ও জলপথে ভ্রমণ করার সময় রাত্রির অন্ধকারে যখন দিক নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে, তখন মানুষ এসব নক্ষত্রের সাহায্যে পথ ঠিক করে নিতে পারে। [মুয়াসসার] অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয় যে, আজ বৈজ্ঞানিক কলকজার যুগেও মানুষ নক্ষত্রপুঞ্জের পথ প্রদর্শনের প্রতি অমুখাপেক্ষী নয়। এ আয়াতেও মানুষকে হুশিয়ার করা হয়েছে যে, এসব নক্ষত্রও কোন একজন নির্মাতা ও নিয়ন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণাধীন বিচরণ করছে। এরা স্বীয় অস্তিত্ব, স্থায়িত্ব ও কর্মে স্বয়ং-সম্পূর্ণ নয়। যারা শুধু এদের প্রতিই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বসে আছে এবং নির্মাতার প্রতি দৃষ্টিপাত করে না, তারা অত্যন্ত সংকীর্ণমনা এবং আত্মপ্রবঞ্চিত।
(২) অর্থাৎ আমি শক্তির প্রমাণাদি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি বিজ্ঞজনদের জন্য। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যারা এসব সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখেও আল্লাহকে চিনে না, তারা বেখবর ও অচেতন। কোন নিদর্শনই তাদের কাজে লাগে না। নবীদের বর্ণনাও তাদের কোন সন্দেহ দূর করতে পারে না। তাদের কাছে এসব বর্ণনা যত স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবেই আসুক না কেন, তারা এর দ্বারা উপকৃত হতে পারে না। [সা’দী]
তাফসীরে জাকারিয়া(৯৭) আর তিনিই তোমাদের জন্য নক্ষত্র সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তা দিয়ে স্থলে ও সমুদ্রের অন্ধকারে পথ পাও।[1] জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছেন।
[1] এখানে তারকারাজির আরো একটি উপকারিতা ও উদ্দেশ্যের কথা বর্ণনা হয়েছে। এর আরো দু’টি উদ্দেশ্য আছে যা অন্যত্র বর্ণনা করা হয়েছে। আসমানের সৌন্দর্য এবং শয়তানকে মেরে তাড়ানোর হাতিয়ার। رُجُوْمًا لِلشَّيَاطِيْن অর্থাৎ, শয়তান যখন আসমানে যাওয়ার প্রচেষ্টা করে, তখন এরা উলকা হয়ে তার উপর পতিত হয়। কোন কোন সালাফদের উক্তি হল, مَنِ اعْتَقَدَ فِيْ هَذِهِ النَّجُوْمِ غَيْرَ ثَلاَثٍ، فَقَدْ أَخْطَأَ وَكَذَبَ عَلَى اللهِ অর্থাৎ, এই তিনটি জিনিস ব্যতীত এই তারাগুলোর ব্যাপারে কেউ যদি অন্য কোন ধারণা পোষণ করে, তবে সে ভুল করবে এবং আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপকারী গণ্য হবে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের দেশে যে জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা রয়েছে যাতে আগামীর অবস্থাসমূহ, মানুষের জীবন অথবা বিশ্বপরিচালনার উপর তারকারাজির প্রভাব-প্রতিক্রিয়া আছে বলে দাবী করা হয়, তার সবই ভিত্তিহীন এবং শরীয়তের পরিপন্থীও। সুতরাং একটি হাদীসে এই বিদ্যাকে যাদুরই একটি অংশ বলা হয়েছে।
مَنِ اقْتَبَسَ عِلْمًا مِّنَ النُّجُوْمِ اقْتَبَسَ شُعْبَةً مِّنَ السِّحْرِ زَادَ مَا زَادَ (حسنه الألباني، صحيح أبي داود ৩৯০৫)
তাফসীরে আহসানুল বায়ানআর তিনিই সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এক নফস থেকে। অতঃপর রয়েছে আবাসস্থল ও সমাধিস্থল। অবশ্যই আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করেছি, এমন কওমের জন্য যারা ভালভাবে বুঝে। আল-বায়ান
তিনি তোমাদেরকে একটি প্রাণ হতে সৃষ্টি করেছেন, তারপর প্রত্যেকের জন্য একটা অবস্থান স্থল আছে আর একটি আছে তাকে গচ্ছিত রাখার জায়গা। জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন লোকেদের জন্য আমি আমার আয়াতগুলোকে বিশদভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি। তাইসিরুল
তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর (প্রত্যেকের জন্য) একটি স্থান অধিক দিন থাকার জন্য এবং একটি স্থান অল্প দিন থাকার জন্য রয়েছে, এই নিদর্শনসমূহ আমি তাদের জন্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করলাম যাদের বুদ্ধি বিবেচনা আছে। মুজিবুর রহমান
And it is He who produced you from one soul and [gave you] a place of dwelling and of storage. We have detailed the signs for a people who understand. Sahih International
৯৮. আর তিনিই তোমাদেরকে একই ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর রয়েছে দীর্ঘ ও স্বল্পকালীন বাসস্থান(১)। অবশ্যই আমরা অনুধাবনকারী সম্প্রদায়ের জন্য আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেছি।
(১) এ আয়াতে দুটি শব্দ বলা হয়েছে, مُسْتَقَرٌّ ও مُسْتَوْدَعٌ তন্মধ্যে مُسْتَقَرٌّ শব্দটি قرار থেকে উদ্ভুত। কোন বস্তুর অবস্থান স্থলকে مستقر বলা হয়। আর مُسْتَوْدَعٌ শব্দটি وديعت থেকে উদ্ভুত। এর অর্থ কারো কাছে কোন বস্তু অস্থায়ীভাবে কয়েক দিন রেখে দেয়া। অতএব, مستودع ঐ জায়গাকে বলা হবে, যেখানে কোন বস্তু অস্থায়ীভাবে কয়েক দিন রাখা হয়। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলাই সে পবিত্র সত্তা যিনি মানুষকে এক সত্তা থেকে অর্থাৎ আদম আলাইহিস সালাম থেকে সৃষ্টি করেছেন। এরপর তার জন্য একটি দীর্ঘকালীন এবং একটি স্বল্পকালীন অবস্থানস্থল নির্ধারণ করে দিয়েছেন। [সা'দী] কুরআনুল কারীমের ভাষা এরূপ হলেও এর ব্যাখ্যায় বহুবিধ সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণেই এ সম্পর্কে মুফাসসিরগণের বিভিন্ন উক্তি রয়েছে। কেউ বলেছেন, مُسْتَوْدَعٌ ও مُسْتَقَرٌّ যথাক্রমে মাতৃগর্ভ ও দুনিয়া। আবার কেউ বলেছেন, কবর ও আখেরাত। [ফাতহুল কাদীর]
আবার কেউ বলেছেন, মায়ের পেট হচ্ছে مُسْتَقَرٌّ আর পিতার পিঠ হচ্ছে مُسْتَوْدَعٌ [আইসারুত তাফসীর, মুয়াসসার] এছাড়া আরো বিভিন্ন উক্তি আছে এবং কুরআনের ভাষায় সবগুলোরই অবকাশ রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেনঃ مُسْتَقَرٌّ হচ্ছে জান্নাত ও জাহান্নাম। আর মানুষের জন্ম থেকে শুরু করে আখেরাত পর্যন্ত সবগুলো স্তর, তা মাতৃগর্ভই হোক কিংবা পৃথিবীতে বসবাসের জায়গাই হোক কিংবা কবর বা বরযখই হোক-সবগুলোই হচ্ছে مُسْتَوْدَعٌ অর্থাৎ সাময়িক অবস্থানস্থল। [সা’দী] কুরআনুল কারীমের এক আয়াত দ্বারাও এ উক্তির অগ্রগণ্যতা বুঝা যায়। যেখানে বলা হয়েছে, (لَتَرْكَبُنَّ طَبَقًا عَنْ طَبَقٍ) অর্থাৎ তোমরা সর্বদা এক স্তর থেকে অন্য স্তরে আরোহণ করতে থাকবে। [সূরা আল-ইনশিকাক: ১৯] এর সারমর্ম এই যে, আখেরাতের পূর্বে মানুষ সমগ্র জীবনে একজন মুসাফিরসদৃশ। বাহ্যিক স্থিরতা ও অবস্থিতির সময়ও প্রকৃতপক্ষে সে জীবন-সফরের বিভিন্ন মনযিল অতিক্রম করতে থাকে।
তাফসীরে জাকারিয়া(৯৮) আর তিনিই তোমাদেরকে একই ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের জন্য স্থায়ী ও অস্থায়ী বাসস্থান রয়েছে।[1] নিশ্চয় আমি অনুধাবনকারী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনাবলী বিশদভাবে বিবৃত করেছি।
[1] অধিকাংশ মুফাসসিরদের নিকট مُسْتَقَرٌّ বলতে মায়ের গর্ভাশয় এবং مُسْتَوْدَعٌ বলতে বাপের পৃষ্ঠদেশকে বুঝানো হয়েছে। (ফাতহুল ক্বাদীর, ইবনে কাসীর)
তাফসীরে আহসানুল বায়ানআর তিনিই আসমান থেকে বর্ষণ করেছেন বৃষ্টি। অতঃপর আমি এ দ্বারা উৎপন্ন করেছি সব জাতের উদ্ভিদ। অতঃপর আমি তা থেকে বের করেছি সবুজ ডাল-পালা। আমি তা থেকে বের করি ঘন সন্নিবিষ্ট শস্যদানা। আর খেজুর বৃক্ষের মাথি থেকে (বের করি) ঝুলন্ত থোকা। আর (উৎপন্ন করি) আঙ্গুরের বাগান এবং সাদৃশ্যপূর্ণ ও সাদৃশ্যহীন যয়তুন ও আনার। দেখ তার ফলের দিকে, যখন সে ফলবান হয় এবং তার পাকার প্রতি। নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে এমন কওমের জন্য যারা ঈমান আনে। আল-বায়ান
তিনিই আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন অতঃপর তা দ্বারা আমি সকল প্রকার উদ্ভিদ উদগত করি, অতঃপর তা থেকে সবুজ পাতা উদ্গত করি, অতঃপর তা থেকে ঘন সন্নিবিষ্ট শস্যদানা উৎপন্ন করি, খেজুর গাছের মোচা থেকে ঝুলন্ত কাঁদি নির্গত করি, আঙ্গুরের বাগান সৃষ্টি করি, আর সৃষ্টি করি জায়তুন ও ডালিম, সেগুলো একই রকম এবং বিভিন্ন রকমও। লক্ষ্য কর তার ফলের প্রতি যখন গাছে ফল আসে আর ফল পাকে। এসবের ভিতরে মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্যই নিদর্শন আছে। তাইসিরুল
আর তিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন, ওর সাহায্যে সব রকমের উদ্ভিদ আমি (আল্লাহ) উৎপন্ন করি; অতঃপর তা থেকে সবুজ শাখা বের করি, ফলতঃ তা থেকে আমি উপর্যুপরি উত্থিত বীজ উৎপন্ন করি। এবং খেজুর বৃক্ষ থেকে অর্থাৎ ওর পুস্পকণিকা থেকে ছড়া হয় যা নিম্ন দিকে ঝুঁকে পড়ে, আর আঙ্গুরসমূহের উদ্যান এবং যাইতূন ও আনার যা পরস্পর সাদৃশ্যযুক্ত। প্রত্যেক ফলের প্রতি লক্ষ্য কর যখন ওটা ফলে এবং ওর পরিপক্ক হওয়ার প্রতি লক্ষ্য কর। এই সমুদয়ের মধ্যে নিদর্শনসমূহ রয়েছে তাদেরই জন্য যারা ঈমান রাখে। মুজিবুর রহমান
And it is He who sends down rain from the sky, and We produce thereby the growth of all things. We produce from it greenery from which We produce grains arranged in layers. And from the palm trees - of its emerging fruit are clusters hanging low. And [We produce] gardens of grapevines and olives and pomegranates, similar yet varied. Look at [each of] its fruit when it yields and [at] its ripening. Indeed in that are signs for a people who believe. Sahih International
৯৯. আর তিনিই আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, তারপর তা দ্বারা আমরা সব রকমের উদ্ভিদের চারা উদগম করি; অতঃপর তা থেকে সবুজ পাতা উদগত করি। যা থেকে আমরা ঘন সন্নিবিষ্ট শস্যদানা উৎপাদন করি। আরও (নির্গত করি) খেজুর গাছের মাথি থেকে ঝুলন্ত কাঁদি, আংগুরের বাগান, যায়তুন ও আনার। একটার সাথে অন্যটার মিল আছে, আবার নেইও। লক্ষ্য করুন, ওগুলোর ফলের দিকে যখন সেগুলো ফলবান হয় এবং সেগুলো পেকে উঠার পদ্ধতির প্রতি। নিশ্চয় মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য এগুলোর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।(১)
(১) উপরোক্ত ৯৫-৯৯ আয়াতসমূহে প্রথমে অধঃজগতের বস্তুসমূহ সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে। কারণ এগুলো আমাদের অধিক নিকটবর্তী। এরপর এগুলোর বর্ণনাকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে, এক. মাটি থেকে উৎপন্ন উদ্ভিদ, বৃক্ষ ও বাগানের বর্ণনা এবং দুই. মানব ও জীবজন্তুর বর্ণনা। এরপর শূন্য জগতের উল্লেখ করা হয়েছে; অর্থাৎ সকাল ও বিকাল। এরপর উর্ধ্ব জগতের সৃষ্ট বস্তু বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজি। অতঃপর অধঃজগতের বস্তুসমূহ অধিক প্রত্যক্ষ হওয়ার কারণে এগুলোর পূর্ণ বর্ণনা দ্বারা আলোচনা সমাপ্ত করা হয়েছে।
তাফসীরে জাকারিয়া(৯৯) তিনিই আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেছেন, অতঃপর তা দিয়ে আমি সর্বপ্রকার উদ্ভিদের চারা উদগম করেছি।[1] অনন্তর তা থেকে আমি সবুজ পাতা উদগত করেছি।[2] অতঃপর তা থেকে ঘন সন্নিবিষ্ট শস্য-দানা সৃষ্টি করি[3] এবং খেজুর বৃক্ষের মাথি থেকে ঝুলন্ত কাঁদি নির্গত করি।[4] আর আঙ্গুরের উদ্যানরাজি সৃষ্টি করি এবং যয়তুন ও ডালিমও,[5] যা একে অন্যের সদৃশ এবং বিসদৃশও।[6] যখন তা ফলবান হয় এবং ফলগুলি পরিপক্ব হয়, তখন সেগুলির প্রতি লক্ষ্য কর। নিশ্চই এগুলিতে বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে। [7]
[1] এখান থেকে তাঁর আরো একটি বিস্ময়কর কারিগরির কথা বর্ণনা করা হচ্ছে। অর্থাৎ, বৃষ্টির পানি। যার দ্বারা তিনি বিভিন্ন প্রকারের বৃক্ষ সৃষ্টি করেন।
[2] অর্থাৎ, সেই সবুজ কচি কিশলয় ও অঙ্কুরিত চারাগাছকে বুঝানো হয়েছে, যেগুলো মাটিতে চাপা দেওয়া বীজ হতে মহান আল্লাহ মাটির উপর প্রকাশ করেন। অতঃপর সে চারাগাছ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
[3] অর্থাৎ, সবুজ এই চারাগাছগুলোর উপর সন্নিবিষ্ট দানা সৃষ্টি করি। যেমন, গম ও ধানের শীষে হয়। উদ্দেশ্য, সকল প্রকার শস্যাদি। যেমন, যব, জোয়ার, বাজরা, ভুট্টা এবং গম ও ধান ইত্যাদি।
[4] قِنْوانٌ হল قِنْوٌ এর বহুবচন; যেমন, صِنْوٌ এবং صِنْوانٌ অর্থঃ গুচ্ছ। طَلْعٌ হল খেজুরের সেই মোচা, যা প্রাথমিক অবস্থায় প্রকাশ পায়। এটাই বড় হয়ে কাঁদির আকার ধারণ করে অতঃপর তা আধপাকা খেজুরে পরিণত হয়। دَانِيَةٌ সেই গুচ্ছকে বলা হয়, যা নুয়ে থাকে। আর কিছু গুচ্ছ অনেক দূরে থাকে যেখানে হাত পৌঁছে না। অনুগ্রহের প্রকাশ স্বরূপ دانية এর কথা উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ, مِنْهَا دَانِيَةٌ ومِنْهَا بَعِيْدَةٌ (কিছু গুচ্ছ নিকটে থাকে এবং কিছু দূরে)। (ফাতহুল ক্বাদীর) بَعِيْدَةٌ শব্দ ঊহ্য আছে।
[5] جنات، الزيتون এবং الرمان শব্দগুলো ‘মানসূব’ (যবর অবস্থায়) এসেছে, কারণ এগুলোর সংযোগ হল পূর্বোক্ত نباتَ এর সাথে। অর্থাৎ, وَأَخْرَجْنَا بِهِ جَنَّاتٍ (আর বৃষ্টির পানির দ্বারা আমি আঙ্গুরের বাগান এবং যয়তুন ও আনার সৃষ্টি করেছি।)
[6] অর্থাৎ, কোন কোন গুণাবলীতে এরা পরস্পর সাদৃশ্যযুক্ত, আবার কোন কোন গুণাবলীতে এদের পারস্পরিক কোন সাদৃশ্য থাকে না। অথবা এদের পাতাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সাদৃশ্য থাকে, কিন্তু ফলের মধ্যে কোন মিল থাকে না। কিংবা আকার-আকৃতিতে এদের মধ্যে সাদৃশ্য থাকে, কিন্তু মজা ও সবাদে এরা একে অপর থেকে ভিন্নতর হয়।
[7] অর্থাৎ, উল্লিখিত সমস্ত জিনিসের মধ্যে বিশ্বজাহানের স্রষ্টার পরিপূর্ণ শক্তি এবং তাঁর হিকমত ও রহমতের বহু প্রমাণ রয়েছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ানকিংবা যেন না বল যে, যদি আমাদের উপর কিতাব অবতীর্ণ করা হত, তবে অবশ্যই আমরা তাদের চেয়ে অধিক হিদায়াতপ্রাপ্ত হতাম। বস্তুত তোমাদের নিকট এসেছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ, হিদায়াত ও রহমত। সুতরাং তার চেয়ে অধিক যালিম কে, যে আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে এবং তা থেকে বিমুখ হয়েছে? অচিরেই আমি তাদেরকে মন্দ আযাব দেব, যারা আমার আয়াতসমূহ থেকে বিমুখ হয়, তাদের বিমুখ হওয়ার কারণে। আল-বায়ান
অথবা তোমরা না বলতে পার যে আমাদের উপর যদি কিতাব অবতীর্ণ হত তাহলে আমরা তাদের চেয়ে বেশি হিদায়াতপ্রাপ্ত হতাম। তাই এখন তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ, হিদায়াত ও রহমত এসেছে। অতঃপর যে ব্যক্তি আল্লাহর (এ সব) আয়াতসমূহকে মিথ্যে মনে ক’রে তাত্থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার চেয়ে বড় যালিম আর কে আছে? আমার আয়াতসমূহ থেকে যারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদেরকে অচিরেই আমি তাদের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কারণে নিকৃষ্টতম শাস্তি প্রদান করব। তাইসিরুল
অথবা তোমরা যেন এ কথাও বলতে না পার, আমাদের প্রতি কিতাব নাযিল করা হলে আমরা তাদের তুলনায় বেশি হিদায়াত লাভ করতাম। এখন তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে এক সুস্পষ্ট দলীল এবং পথ নির্দেশ ও রাহমাত সমাগত হয়েছে। এরপর আল্লাহর আয়াতকে যে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে এবং তা থেকে এড়িয়ে চলবে তার চেয়ে বড় যালিম আর কে হতে পারে? যারা আমার আয়াতসমূহ এড়িয়ে চলে, অতি সত্ত্বর তাদেরকে আমি কঠিন শাস্তি দিব, জঘণ্য শাস্তি-তাদের এড়িয়ে চলার জন্য! মুজিবুর রহমান
Or lest you say, "If only the Scripture had been revealed to us, we would have been better guided than they." So there has [now] come to you a clear evidence from your Lord and a guidance and mercy. Then who is more unjust than one who denies the verses of Allah and turns away from them? We will recompense those who turn away from Our verses with the worst of punishment for their having turned away. Sahih International
১৫৭. কিংবা যেন তোমরা না বল যে, যদি আমাদের প্রতি কিতাব নাযিল হত, তবে আমরা তো তাদের চেয়ে বেশী হিদায়াত প্রাপ্ত হতাম।(১) সুতরাং অবশ্যই তোমাদের কাছে তোমাদের রব-এর পক্ষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ, হিদায়াত ও রহমত এসেছে। অতঃপর যে আল্লাহর আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করবে এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার চেয়ে বড় যালিম আর কে? যারা আমাদের আয়াতসমূহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সত্যবিমুখিতার জন্য অচিরেই আমরা তাদেরকে নিকৃষ্ট শাস্তি দেব।
(১) আল্লামা শানকীতী বলেন, এ আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলা বর্ণনা করছেন যে, কুরআন নাযিল করার একটি গুরুত্বপূর্ণ রহস্য হচ্ছে, মক্কার কাফেরদের কোন ওযর-আপত্তি অবশিষ্ট না রাখা। তারা হয়ত বলতে পারত যে, আমাদের প্রতি যদি কোন কিতাব নাযিল করা হতো যেমনিভাবে ইয়াহুদী ও নাসারাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে, তবে অবশ্যই আমরা বেশী হিদায়াতপ্রাপ্ত হতাম। কুরআন নাযিলের মাধ্যমে আল্লাহ্ তাআলা তাদের এ কথার সুযোগ আর রাখলেন না। অন্য আয়াতে এসেছে যে, তারা শপথ করে সেটা বলত। কিন্তু যখন তাদের কাছে কিতাব নাযিল করা হলো তখন তাদের জন্য শুধু হঠকারিতাই বৃদ্ধি করল।
আল্লাহ বলেন, “আর তারা দৃঢ়তার সাথে আল্লাহর শপথ করে বলত যে, তাদের কাছে কোন সতর্ককারী আসলে তারা অন্য সকল জাতির চেয়ে সৎপথের অধিকতর অনুসারী হবে; তারপর যখন এদের কাছে সতর্ককারী আসল তখন তা শুধু তাদের দূরত্বই বৃদ্ধি করল— যমীনে ঔদ্ধত্য প্রকাশ এবং কূট ষড়যন্ত্রের কারণে। আর কূট ষড়যন্ত্র তার উদ্যোক্তাদেরকেই পরিবেষ্টন করবে।” [সূরা ফাতির: ৪২–৪৩] [আদওয়াউল বায়ান] সু্দ্দী বলেন, আয়াতের অর্থ, তোমাদের কাছে স্পষ্ট আরবী ভাষায় দলীল-প্রমাণাদি এসেছে, যখন তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের কিতাব পড়তে অক্ষম। আর যখন তোমরা বলেছিলে, আমাদের কাছে কিতাব আসলে তো আমরা তাদের থেকেও বেশী হিদায়াতপ্রাপ্ত হতাম। [তাবারী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৭) কিংবা যেন তোমরা না বলতে পার যে, ‘যদি কিতাব আমাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হত, তাহলে আমরা তো তাদের অপেক্ষা অধিক সৎপথপ্রাপ্ত হতাম।’ এখন তো তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে স্পষ্ট প্রমাণ, পথ নির্দেশ ও করুণা এসেছে।[1] অতঃপর যে কেউ আল্লাহর নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করবে এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার চেয়ে বড় যালেম আর কে?[2] যারা আমার নিদর্শনসমূহ হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদের এ আচরণের জন্য আমি তাদেরকে নিকৃষ্ট শাস্তি দেব।
[1] সুতরাং এ বাহানাও তোমরা করতে পারবে না।
[2] অর্থাৎ, হিদায়াত ও রহমতের এই কিতাব অবতীর্ণ হওয়ার পর এখন যে ব্যক্তি হিদায়াতের (ইসলামের) পথ অবলম্বন করে রহমতের অধিকারী হয় না, বরং মিথ্যাজ্ঞান ও বিমুখতার পথ অবলম্বন করে, তার চেয়ে বড় যালিম আর কে? صَدَفَ এর অর্থ মুখ ফিরিয়ে নেওয়া এবং অপরকে বাধা দেওয়াও করা হয়েছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ানতারা কি এরই অপেক্ষা করছে যে, তাদের নিকট ফেরেশতাগণ হাযির হবে, কিংবা তোমার রব উপস্থিত হবে অথবা প্রকাশ পাবে তোমার রবের নিদর্শনসমূহের কিছু? যেদিন তোমার রবের নিদর্শনসমূহের কিছু প্রকাশ পাবে, সেদিন কোন ব্যক্তিরই তার ঈমান উপকারে আসবে না, যে পূর্বে ঈমান আনেনি, কিংবা সে তার ঈমানে কোন কল্যাণ অর্জন করেনি। বল, ‘তোমরা অপেক্ষা কর, আমরাও অপেক্ষা করছি’। আল-বায়ান
তারা কি এই অপেক্ষায় আছে যে, তাদের কাছে ফেরেশতারা আসবে অথবা তোমার প্রতিপালক (স্বয়ং) আসবেন কিংবা তোমার রবেবর কিছু নিদর্শন আসবে (তখন তারা ঈমান আনবে)? যে দিন তোমার রবেবর কতক নিদর্শন এসে যাবে সে দিন ঐ ব্যক্তির ঈমান কোন সুফল দিবে না যে পূর্বে ঈমান আনেনি বা ঈমানের মাধ্যমে কল্যাণ অর্জন করেনি। বল, তোমরা অপেক্ষা কর (তাহলে দেখতে পাবে তোমাদের কুফরীর পরিণাম কী দাঁড়ায়), আমরাও অপেক্ষায় থাকলাম (আমাদের পুরস্কার প্রাপ্তি ও তোমাদের পরিণতি দেখার জন্য)। তাইসিরুল
তারা কি শুধু এ প্রতীক্ষায় রয়েছে যে, তাদের কাছে মালাইকা/ফেরেশতা আসবে? কিংবা স্বয়ং তোমার রাব্ব আসবেন? অথবা তোমার রবের কোন কোন নিদর্শন প্রকাশ হয়ে পড়বে? যেদিন তোমার রবের কতক নিদর্শন প্রকাশ হয়ে পড়বে সেই দিনের পূর্বে যারা ঈমান আনেনি অথবা যারা নিজেদের ঈমান দ্বারা কোন নেক কাজ করেনি তখন তাদের ঈমান আনয়নে কোন উপকার হবেনা, তুমি এসব পাপিষ্ঠকে জানিয়ে দাওঃ তোমরা (এরূপ আশা নিয়ে) প্রতীক্ষা করতে থাক, আমিও প্রতীক্ষা করছি। মুজিবুর রহমান
Do they [then] wait for anything except that the angels should come to them or your Lord should come or that there come some of the signs of your Lord? The Day that some of the signs of your Lord will come no soul will benefit from its faith as long as it had not believed before or had earned through its faith some good. Say, "Wait. Indeed, we [also] are waiting." Sahih International
১৫৮. তারা শুধু এরই তো প্রতীক্ষা করে যে, তাদের কাছে ফিরিশতা আসবে, কিংবা আপনার রব আসবেন, কিংবা আপনার রব-এর কোন নিদর্শন আসবে(১)? যেদিন আপনার রব- এর কোন নিদর্শন আসবে সেদিন তার ঈমান কোন কাজে আসবে না, যে পূর্বে ঈমান আনেনি(২), অথবা যে ব্যক্তি ঈমানের মাধ্যমে কল্যাণ লাভ করেনি(৩)। বলুন, তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমরাও প্রতীক্ষায় রইলাম।
(১) সূরা আল-আন’আমের অধিকাংশই মক্কাবাসী ও আরব-মুশরিকদের বিশ্বাস ও ক্রিয়াকর্মের সংস্কার এবং তাদের সন্দেহ ও প্রশ্নের জবাবে নাযিল হয়েছে। গোটা সূরায় এবং বিশেষভাবে পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে মক্কা ও আরবের অধিবাসীদের সামনে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, হে কাফের সম্প্রদায়! তোমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মু'জিযা ও প্রমাণাদি দেখে নিয়েছ, তার সম্পর্কে পূর্ববর্তী গ্রন্থ ও নবীগণের ভবিষ্যদ্বাণীও শুনে নিয়েছ এবং একজন নিরক্ষরের মুখ থেকে কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াত শোনার মু'জিযাটিও লক্ষ্য করেছ। এখন ন্যায় ও সত্য সমুদয় পথ তোমাদের সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেছে। অতএব, ঈমান আনার জন্য আর কিসের অপেক্ষা? এ বিষয়টি আলোচ্য আয়াতে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে বলা হয়েছেঃ তারা কি বিশ্বাস স্থাপনের ব্যাপারে এ জন্য অপেক্ষা করছে যে, মৃত্যুর ফিরিশতা তাদের কাছে পৌছবে। না কি হাশরের ময়দানের জন্য অপেক্ষা করছে, যেখানে প্রতিদান ও শাস্তির ফয়সালা করার জন্য আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং আগমন করবেন অথবা কেয়ামতের কোন একটি সর্বশেষ নিদর্শন দেখে নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছে?
বিচার-ফয়সালার জন্য কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহ্ তা'আলার উপস্থিতি কুরআনুল কারীমের একাধিক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহ্ তাআলা কিভাবে এবং কি অবস্থায় উপস্থিত হবেন, তা মানবজ্ঞান পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করতে অক্ষম। তাই এ ধরণের আয়াত সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম ও পূর্ববতী মনীষীবৃন্দের অভিমত এই যে, কুরআনে যা উল্লেখ করা হয়েছে, তাই বিশ্বাস করতে হবে। উদাহরণতঃ এ আয়াতে বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ তা'আলা কেয়ামতের ময়দানে প্রতিদান ও শাস্তির মীমাংসা করার জন্য উপস্থিত হবেন। তবে কিভাবে উপস্থিত হবেন, এ আলোচনা নিষিদ্ধ। কোন কোন আয়াতে এসেছে যে, আল্লাহর সাথে ফেরেশতাগণও কাতারে কাতারে উপস্থিত হবেন। “আর যখন আপনার রব আগমন করবেন ও সারিবদ্ধভাবে ফেরেশতাগণও” [আল-ফাজর: ২২] আবার কোথাও এসেছে যে, আল্লাহ তা'আলা মেঘের ছায়া সমেত উপস্থিত হবেন। “তারা কি শুধু এর প্রতীক্ষায় রয়েছে যে, আল্লাহ ও ফেরেশতাগণ মেঘের ছায়ায় তাদের কাছে উপস্থিত হবেন।” [সূরা আল-বাকারাহ: ২১০) এসবগুলোই সত্য। এগুলোর উপর ঈমান আনয়ন করা ফরয। তবে কোন প্রকার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ধারণ করা যাবে না। [আদওয়াউল বায়ান]
(২) এতে হুঁশিয়ার করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলার কোন কোন নিদর্শন প্রকাশিত হওয়ার পর তাওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি ইতোপূর্বে বিশ্বাস স্থাপন করেনি, তখন বিশ্বাস স্থাপন করলে তা কবুল করা হবে না এবং যে ব্যক্তি পূর্বেই বিশ্বাস স্থাপন করেছে; কিন্তু কোন সৎকর্ম করেনি, সে তখন তওবা করে ভবিষ্যতে সৎকর্ম করার ইচ্ছা করলে তার তাওবাও কবুল করা হবে না। মোটকথা, কাফের স্বীয় কুফর থেকে এবং পাপাচারী স্বীয় পাপাচার থেকে যদি তখন তাওবা করতে চায়, তবে তা কবুল হবে না। কারণ, বিশ্বাস স্থাপন ও তাওবা যতক্ষণ মানুষের ইচ্ছাধীন থাকে, ততক্ষণই তা কবুল হতে পারে। আল্লাহর শাস্তি ও আখেরাতের স্বরূপ ফুটে উঠার পর প্রত্যেক মানুষ বিশ্বাস স্থাপন ও তাওবা করতে আপনা থেকেই বাধ্য হবে। বলাবাহুল্য, এরূপ ঈমান ও তাওবা গ্রহণযোগ্য নয়।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যখন কেয়ামতের সর্বশেষ নিদর্শনটি প্রকাশিত হবে, অর্থাৎ সূর্য পূর্বদিকের পরিবর্তে পশ্চিম দিক থেকে উদয় হবে, তখন এ নিদর্শনটি দেখা মাত্রই সারা বিশ্বের মানুষ ঈমানের কালেমা পাঠ করতে শুরু করবে এবং সব অবাধ্য লোকও অনুগত হয়ে যাবে। কিন্তু তখনকার ঈমান ও তাওবা গ্রহণীয় হবে না। [বুখারীঃ ৪৬৩৬] এ আয়াত থেকে এ কথা জানা গেল যে, কেয়ামতের কোন কোন নিদর্শন প্রকাশিত হওয়ার পর তাওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আর কোন কাফের কিংবা ফাসেকের তাওবা কবুল হবে না। হুযায়ফা ইবনে আসীদ রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, একবার সাহাবায়ে কেরাম পরস্পর কেয়ামতের লক্ষণাদি সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে উপস্থিত হয়ে বললেনঃ দশটি নিদর্শন না দেখা পর্যন্ত কেয়ামত হবে না।
(এক) পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়, (দুই) বিশেষ এক প্রকার ধোয়া, (তিন) দাব্বাতুল-আরদ (চার) ইয়াজুয-মাজুযের আবির্ভাব, (পাঁচ) ঈসা আলাইহিস সালাম-এর অবতরণ, (ছয়) দাজ্জালের অভ্যুদয়, (সাত, আট, নয়) প্রাচ্য, প্রাশ্চাত্য ও আরব উপদ্বীপ-এ তিন জায়গায় মাটি ধ্বসে যাওয়া এবং (দশ) আদনগর্ত থেকে একটি আগুন বের হয়ে মানুষকে সামনের দিকে হাকিয়ে নিয়ে যাওয়া। [মুসলিমঃ ২৯০১] ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর রেওয়ায়েতক্রমে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘এসব নিদর্শনের মধ্যে সর্বপ্রথম নিদর্শনটি হলো পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় ও দাব্বাতুল আরদের আবির্ভাব। [মুসলিমঃ ২৯৪১]
(৩) সুদ্দী বলেন, তারা ঈমান আনার পরে কোন কল্যাণকর কাজ তথা সৎকাজ করেনি। এটা দ্বারা সেসব কিবলার অনুসারী মুমিন লোকদের বোঝানো হয়েছে যারা ঈমান এনেছে সত্য কিন্তু কোন সৎকাজ করে নি। যখনই তারা আল্লাহর কোন বৃহৎ নিদর্শনপশ্চিম দিকে সূর্য উদিত হওয়া- দেখবে, তখনই সৎকাজের জন্য তৎপর হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের তখনকার আমল কোন কাজে আসবে না। কিন্তু যদি তারা এ নিদর্শন দেখার পূর্বে সৎকাজ করে থাকে, তবে এ নিদর্শন দেখার পরে সৎকাজ করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে। [তাবারী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৮) তারা কি এরই প্রতীক্ষা করে যে, তাদের নিকট ফিরিশতা আসবে কিংবা তোমার প্রতিপালক আসবেন কিংবা তোমার প্রতিপালকের কিছু নিদর্শন আসবে?[1] যেদিন তোমার প্রতিপালকের কিছু নিদর্শন আসবে, সেদিন সে ব্যক্তির বিশ্বাস কোন কাজে আসবে না, যে ব্যক্তি পূর্বে বিশ্বাস স্থাপন করেনি[2] কিংবা স্বীয় বিশ্বাস সহ কল্যাণ অর্জন (সৎকর্ম) করেনি।[3] বল, ‘তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমরাও প্রতীক্ষা করছি।’ [4]
[1] কুরআন কারীম অবতীর্ণ করে এবং মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে রসূল হিসাবে প্রেরণ করে আমি হুজ্জত (অকাট্য প্রমাণ) কায়েম করে দিয়েছি। এখনও যদি তারা ভ্রষ্টতা থেকে ফিরে না আসে, তবে কি তারা এই অপেক্ষায় আছে যে, তাদের কাছে ফিরিশতা আসুক, অর্থাৎ, তাদের জান কবজ করার জন্য, তখন তারা ঈমান আনবে? অথবা তোমার প্রতিপালক তাদের কাছে আসুক অর্থাৎ, কিয়ামত সংঘটিত হোক এবং তাদেরকে আল্লাহর সামনে হাজির করা হোক, তখন তারা ঈমান আনবে? কিংবা তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে কোন বৃহৎ নিদর্শন আসুক, যেমন কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার পূর্বে সূর্যের পশ্চিম দিক থেকে উদয় হওয়া, এই ধরনের বড় নিদর্শন দেখে তারা ঈমান আনবে? পরের বাক্যে এ কথা পরিষ্কার করে দেওয়া হচ্ছে যে, যদি তারা এই অপেক্ষায় থেকে থাকে, তাহলে তারা বিরাট মূর্খতা প্রদর্শন করছে। কেননা, মহা নিদর্শন প্রকাশ হওয়ার পর কাফেরের ঈমান এবং পাপী ও অবাধ্যজনদের তওবা কবুল করা হবে না। সহীহ হাদীসে নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘‘ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সূর্য (পূর্ব দিকের পরিবর্তে) পশ্চিম দিক হতে উদয় হবে। আর যখন এ রকম হবে এবং মানুষ তাকে পশ্চিম দিক থেকে উদিত হতে দেখবে, তখন সকলে ঈমান নিয়ে আসবে।’’ অতঃপর তিনি (সাঃ) এই আয়াত তেলাঅত করলেন, {لا يَنْفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ} অর্থাৎ, তখন ঈমান আনা কারো উপকারে আসবে না, যে পূর্ব থেকে ঈমান আনেনি। (বুখারী, তাফসীর সূরা আনআম)
[2] অর্থাৎ, কাফেরের ঈমান ফলপ্রসূ অর্থাৎ, গৃহীত হবে না।
[3] এর অর্থ হল, কোন পাপী মু’মিন পাপসমূহ থেকে তওবা করলে তখন তার তওবা কবুল করা হবে না এবং এরপর নেক আমলও গৃহীত হবে না। যেমন, বহু হাদীস দ্বারাও এ কথা প্রমাণিত।
[4] এটা তাদের জন্য ধমক, যারা ঈমান আনে না এবং তওবা করে না। এই বিষয়টি কুরআন কারীমের সূরা মুহাম্মাদের ১৮ এবং সূরা মু’মিনের ৮৪-৮৫নং আয়াতেও বর্ণিত হয়েছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ানহে বনী আদম, আমি তো তোমাদের জন্য পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকবে এবং যা সৌন্দর্যস্বরূপ। আর তাকওয়ার পোশাক, তা উত্তম। এগুলো আল্লাহর আয়াতসমূহের অন্তর্ভুক্ত। যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। আল-বায়ান
হে আদাম সন্তান! আমি তোমাদেরকে পোষাক-পরিচ্ছদ দিয়েছি তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করার জন্য এবং শোভা বর্ধনের জন্য। আর তাকওয়ার পোশাক হচ্ছে সর্বোত্তম পোশাক। ওটা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। তাইসিরুল
হে বানী আদম! আমি তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করার ও বেশভূষার জন্য তোমাদের পোশাক পরিচ্ছদের উপকরণ অবতীর্ণ করেছি। (বেশ-ভূষার তুলনায়) আল্লাহভীতির পরিচ্ছদই হচ্ছে সর্বোত্তম পরিচ্ছদ। এটা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম নিদর্শন, সম্ভবতঃ মানুষ এটা হতে উপদেশ গ্রহণ করবে। মুজিবুর রহমান
O children of Adam, We have bestowed upon you clothing to conceal your private parts and as adornment. But the clothing of righteousness - that is best. That is from the signs of Allah that perhaps they will remember. Sahih International
২৬. হে বনী আদম! অবশ্যই আমরা তোমাদের জন্য পোষাক নাযিল করেছি, তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকা ও বেশ-ভূষার জন্য। আর তাকওয়ার পোষাক(১), এটাই সর্বোত্তম।(২) এটা আল্লাহ্র নিদর্শনসমূহের অন্যতম, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।(৩)
(১) لِبَاسُ التَّقْوَىٰ শব্দ থেকে এদিকেও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, বাহ্যিক পোষাক দ্বারা গুপ্ত-অঙ্গ আবৃত করা ও সাজ-সজ্জা করার আসল উদ্দেশ্য তাকওয়া ও আল্লাহভীতি। এ আল্লাহভীতি পোষাকের মধ্যেও এভাবে প্রকাশ পায়। তাই পোষাকে যেন গুপ্তাঙ্গগুলি পুরোপুরি আবৃত হয়। উলঙ্গের মত দৃষ্টিগোচর না হয়। অহংকার ও গর্বের ভঙ্গিও না থাকা চাই। অপব্যয় না থাকা চাই। মহিলাদের জন্য পুরুষের পোষাকের মত আর পুরুষের জন্য মহিলাদের পোষাকের মত না হওয়া চাই। পোষাকে বিজাতির অনুকরণ না হওয়া চাই। এর প্রত্যেকটির ব্যাপারেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীসে বিস্তারিত দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
(২) এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা সমস্ত আদম সন্তানকে সম্বোধন করে বলেছেনঃ তোমাদের পোষাক আল্লাহ তা'আলার একটি মহান নেয়ামত। একে যথার্থ মূল্য দাও। এখানে মুসলিমদেরকে সম্বোধন করা হয়নি- সমগ্র বনী-আদমকে করা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, গুপ্তাঙ্গ আচ্ছাদন ও পোষাক মানব জাতির একটি সহজাত প্রবৃত্তি ও প্রয়োজন। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এ নিয়ম পালন করে। অতঃপর এর বিশদ বিবরণে তিন প্রকার পোশাকের উল্লেখ করা হয়েছে।
(এক) (لِبَاسًا يُوَارِي سَوْآتِكُمْ) এখানে يُوَارِي শব্দটি موارة থেকে উদ্ভুত, এর অর্থ আবৃত করা। আর سَوْآت শব্দটি سوءة এর বহুবচন, এর অর্থ মানুষের ঐসব অঙ্গ, যেগুলো খোলা রাখাকে মানুষ স্বভাবতই খারাপ ও লজ্জাকর মনে করে। উদ্দেশ্য এই যে, আমি তোমাদের মঙ্গলার্থে এমন একটি পোষাক সৃষ্টি করেছি, যা দ্বারা তোমরা গুপ্তাঙ্গ আবৃত করতে পার। মুজাহিদ বলেন, আরবের কিছু লোক আল্লাহ্র ঘরের তাওয়াফ উলঙ্গ হয়ে সম্পাদন করত। আবার কোন কোন লোক যে পোষাক পরিধান করে তাওয়াফ করেছে সে পোষাক আর পরিধান করত না। এ আয়াতে তাদেরকেও উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। [তাবারী]
(দুই) وَرِيشًا অৰ্থাৎ সাজ-সজ্জার জন্য মানুষ যে পোষাক পরিধান করে, তাকে ريش বলা হয়। অর্থ এই যে, গুপ্তাঙ্গ আবৃত করার জন্য তো সংক্ষিপ্ত পোষাকই যথেষ্ট হয়; কিন্তু আমি তোমাদেরকে আরো পোষাক দিয়েছি, যাতে তোমরা তা দ্বারা সাজ-সজ্জা করে বাহ্যিক দেহাবয়বকে সুশোভিত করতে পার। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এখানে ‘রীশ’ বলে ‘সম্পদ' বোঝানো হয়েছে। [তাবারী] বাস্তবিকই পোষাক একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সম্পদ।
(তিন) আয়াতে আল্লাহ তা'আলা তৃতীয় এক প্রকার পোশাকের কথা উল্লেখ করে বলেছেনঃ (وَلِبَاسُ التَّقْوَىٰ ذَٰلِكَ خَيْرٌ) অর্থাৎ তা হচ্ছে তাকওয়ার পোষাক আর এটিই সর্বোত্তম পোষাক। ইবন আব্বাস ও উরওয়া ইবন যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুমের তাফসীর অনুযায়ী তাকওয়ার পোষাক বলে সৎকর্ম ও আল্লাহভীতি বুঝানো হয়েছে। এটি মানুষের চারিত্রিক দোষ ও দুর্বলতার আবরণ এবং স্থায়ী কষ্ট ও বিপদাপদ থেকে মুক্তিলাভের উপায়। এ কারণেই এটি সর্বোত্তম পোষাক। কাতাদা বলেন, তাকওয়ার পোষাক বলে ঈমানকে বোঝানো হয়েছে। [তাবারী]
(৩) অর্থাৎ মানুষকে এ তিন প্রকার পোষাক দান করা আল্লাহ্ তা'আলার শক্তির নিদর্শনসমূহের অন্যতম- যাতে মানুষ এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।
তাফসীরে জাকারিয়া(২৬) হে বনী আদম (হে মানবজাতি)! তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকার ও বেশভূষার উদ্দেশ্যে আমি তোমাদের জন্য পরিচ্ছদ অবতীর্ণ করেছি।[1] আর সংযমশীলতার পরিচ্ছদই[2] সর্বোৎকৃষ্ট।[3] এ হল আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম; যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ানবল, ‘কে হারাম করেছে আল্লাহর সৌন্দর্যোপকরণ, যা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র রিয্ক’? বল, ‘তা দুনিয়ার জীবনে মুমিনদের জন্য, বিশেষভাবে কিয়ামত দিবসে’। এভাবে আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করি এমন কওমের জন্য, যারা জানে। আল-বায়ান
বল, ‘যে সব সৌন্দর্য-শোভামন্ডিত বস্তু ও পবিত্র জীবিকা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন কে তা হারাম করল’? বল, ‘সে সব হচ্ছে ঈমানদারদের জন্য দুনিয়ার জীবনে বিশেষতঃ ক্বিয়ামাতের দিনে। এভাবে আমি জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করি।’ তাইসিরুল
তুমি জিজ্ঞেস করঃ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যে সব শোভনীয় বস্তু ও পবিত্র জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে নিষিদ্ধ করেছে? তুমি ঘোষণা করে দাও - এই সমস্ততো তাদের জন্যই যারা পার্থিব জীবনে এবং বিশেষ করে কিয়ামাত দিবসে বিশ্বাস করে। এমনিভাবে আমি জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করে থাকি। মুজিবুর রহমান
Say, "Who has forbidden the adornment of Allah which He has produced for His servants and the good [lawful] things of provision?" Say, "They are for those who believe during the worldly life [but] exclusively for them on the Day of Resurrection." Thus do We detail the verses for a people who know. Sahih International
৩২. বলুন, আল্লাহ্ নিজের বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছে(১)? বলুন, ‘পার্থিব জীবনে, বিশেষ করে কেয়ামতের দিনে এ সব তাদের জন্য, যারা ঈমান আনে।(২) এভাবে আমরা জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আয়াতসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করি।
(১) কোন বস্তু হালাল অথবা হারাম করা একমাত্র সে সত্তারই কাজ যিনি এসব বস্তু সৃষ্টি করেছেন। এতে অন্যের হস্তক্ষেপ বৈধ নয়। কাজেই সেসব লোক দণ্ডনীয়, যারা আল্লাহর হালালকৃত উৎকৃষ্ট পোষাক অথবা পবিত্র ও সুস্বাদু খাদ্যকে হারাম মনে করে। সংগতি থাকা সত্ত্বেও জীর্ণাবস্থায় থাকা ইসলামের শিক্ষা নয় এবং ইসলামের দৃষ্টিতে পছন্দনীয়ও নয়। খোরাক ও পোষাক সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবী ও তাবেয়ীগণের সুন্নাতের সারকথা এই যে, এসব ব্যাপারে লৌকিকতা পরিহার করতে হবে। যেরূপ পোষাক ও খোরাক সহজলভ্য তাই কৃতজ্ঞতা সহকারে ব্যবহার করতে হবে। আয়াতের তাফসীরে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত আছে যে, আরবরা জাহিলিয়াতে কাপড়-চোপড় সহ বেশ কিছু জিনিস হারাম করত।
অথচ এগুলো আল্লাহ হারাম করেননি। যেমন অন্য আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন, বলুন তোমরা আমাকে জানাও, আল্লাহ্ তোমাদের যে রিযক দিয়েছেন তারপর তোমরা তার কিছু হালাল ও কিছু হারাম করেছ, বলুন, আল্লাহ কি তোমাদেরকে এটার অনুমতি দিয়েছেন, নাকি তোমরা আল্লাহর উপর মিথ্যা রটনা করছ? [সূরা ইউনুস: ৫৯] তখন আল্লাহ্ তা'আলা আলোচ্য এ আয়াত নাযিল করেন। [তাবারী] কাতাদা বলেন, এ আয়াত দ্বারা জাহেলিয়াতের কাফেররা বাহীরা, সায়েবা, ওসীলা, হাম ইত্যাদি নামে যে সমস্ত প্রাণী হারাম করত সেগুলোকে উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। [তাবারী]
(২) আয়াতের এ বাক্যে একটি বিশেষ তাৎপর্য বর্ণনা করা হয়েছে যে, দুনিয়ার সব নেয়ামত; উৎকৃষ্ট পোষাক ও সুস্বাদু খাদ্য প্রকৃতপক্ষে আনুগত্যশীল মুমিনদের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাদের কল্যাণেই অন্যেরা ভোগ করতে পারছে। কিন্তু আখেরাতে সমস্ত নেয়ামত ও সুখ কেবলমাত্র আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য নির্দিষ্ট থাকবে। আয়াতের এ বাক্যে বলা হয়েছে, “আপনি বলে দিনঃ সব পার্থিব নেয়ামত প্রকৃতপক্ষে পার্থিব জীবনেও মুমিনদেরই প্রাপ্য এবং কেয়ামতের দিন তো এককভাবে তাদের জন্যই নির্দিষ্ট হবে।” [তাবারী ইবন আব্বাস হতে] আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার অপর মতে এ বাক্যটির অর্থ এই যে, পার্থিব সব নেয়ামত ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আখেরাতে শাস্তির কারণ হবে না- এ বিশেষ অবস্থাসহ তা একমাত্র অনুগত মুমিন বান্দাদেরই প্রাপ্য। কাফের ও পাপাচারীর অবস্থা এরূপ নয়। পার্থিব নেয়ামত তারাও পায় বরং আরো বেশী পায়; কিন্তু এসব নেয়ামত আখেরাতে তাদের জন্য শাস্তি ও স্থায়ী আযাবের কারণ হবে।
কাজেই পরিণামের দিক দিয়ে এসব নেয়ামত তাদের জন্য সম্মান ও সুখের বস্তু নয়। [কুরতুবী] কোন কোন তাফসীরবিদের মতে এর অর্থ এই যে, পার্থিব সব নেয়ামতের সাথে পরিশ্রম, কষ্ট, হস্তচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা ও নানারকম দুঃখ-কষ্ট লেগে থাকে, নির্ভেজাল নেয়ামত ও অনাবিল সুখের অস্তিত্ব এখানে নেই। তবে কেয়ামতে যারা এসব নেয়ামত লাভ করবে, তারা নির্ভেজাল অবস্থায় লাভ করবে। এগুলোর সাথে কোনরূপ পরিশ্রম, কষ্ট, হস্তচ্যুযত হওয়ার আশংকা এবং কোন চিন্তা-ভাবনা থাকবে না [বাগভী] উপরোক্ত তিন প্রকার অর্থই আয়াতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তাই সাহাবী ও তাবেয়ী তাফসীরবিদগণ এসব অর্থই গ্রহণ করেছেন।
তাফসীরে জাকারিয়া(৩২) বল, ‘আল্লাহ স্বীয় দাসদের জন্য যে সব সুশোভন বস্তু ও পবিত্র জীবিকা সৃষ্টি করেছেন, তা কে নিষিদ্ধ করেছে?’ বল, ‘পার্থিব জীবনে বিশেষ করে কিয়ামতের দিনে এ সমস্ত তাদের জন্য, যারা বিশ্বাস করে।’[1] এরূপে আমি জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করি।
[1] মুশরিকরা যেভাবে তাওয়াফ করার সময় পোশাক পরিধান করাকে অপছন্দনীয় মনে করেছিল, অনুরূপ কিছু হালাল জিনিসকেও আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে হারাম করে নিয়েছিল। (যেমন, অনেক সূফীবাদে বিশ্বাসী ব্যক্তিরাও করে থাকে)। আর অনেক হালাল জিনিসকে নিজেদের প্রতিমাদের নামে উৎসর্গ করার কারণে সেগুলোকেও হারাম মনে করত। মহান আল্লাহ বললেন, মানুষের সাজ-সজ্জার জন্য (যেমন, পোশাক ইত্যাদি) এবং পানাহারের জন্য অনেক উৎকৃষ্ট জিনিস বানিয়েছি, সেগুলোকে কে হারাম করেছে? অর্থ হল, মানুষের হারাম করে নেওয়ার কারণে আল্লাহর হালাল করা জিনিস হারাম হয়ে যাবে না। বরং সেগুলো হালালই থাকবে। এই হালাল ও পবিত্র জিনিসগুলো আসলে আল্লাহ ঈমানদারদের জন্য সৃষ্টি করেছেন, যদিও কাফেররাও তা থেকে উপকারিতা এবং তৃপ্তি লাভ করে থাকে। বরং অনেক সময় পার্থিব সম্পদ এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করার ব্যাপারে তাদেরকে মুসলিমদের চেয়েও বেশী সফল দেখা যায়। তবে তা অপরের অসীলায় এবং সাময়িকভাবে। এতে আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিগত ইচ্ছা ও হিকমতও আছে। কিয়ামতের দিন এ নিয়ামতসমূহ কেবল ঈমানদারদের জন্য হবে। কেননা, কাফেরদের উপর যেভাবে জান্নাত হারাম হবে, অনুরূপভাবে জান্নাতের যাবতীয় খাদ্য-পানিও তাদের জন্য হারাম হবে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ানহে বনী আদম, যদি তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকে রাসূলগণ আসে যারা তোমাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ বর্ণনা করবে, তবে যারা তাকওয়া অবলম্বন করবে এবং (আমল) সংশোধন করবে, তাদের উপর কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। আল-বায়ান
হে আদাম সন্তান! তোমাদের কাছে তোমাদেরই মধ্যে থেকে যখন রসূলগণ আসে যারা তোমাদের কাছে আমার আয়াতগুলোকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে, তখন যারা তাকওয়া অবলম্বন করে আর নিজেদেরকে সংশোধন করে নেয়, তাদের কোন ভয় নেই, তারা চিন্তিত হবে না। তাইসিরুল
হে আদম সন্তান! তোমাদের মধ্য হতে যদি কোন রাসূল তোমাদের নিকট আগমন করে এবং আমার বাণী ও নিদর্শন তোমাদের কাছে বিবৃত করে; তখন যারা সতর্ক হবে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করে নিবে এবং সৎ কাজ করবে, তাদের কোন ভয়-ভীতি থাকবেনা। মুজিবুর রহমান
O children of Adam, if there come to you messengers from among you relating to you My verses, then whoever fears Allah and reforms - there will be no fear concerning them, nor will they grieve. Sahih International
৩৫. হে বনী আদম! যদি তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকে রাসূলগণ আসেন, যারা আমার আয়াতসমূহ তোমাদের কাছে বিবৃত করবেন, তখন যারা তাকওয়া অবলম্বন করবে এবং নিজেদের সংশোধন করবে, তাদের কোন ভয় থাকবে না এবং তারা চিন্তিতও হবে না।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৩৫) হে মানবজাতি! যখন তোমাদের মধ্য হতে কোন রসূল তোমাদের নিকট এসে আমার নিদর্শনসমূহ বিবৃত করে, তখন যারা সাবধান হবে এবং নিজেকে সংশোধন করবে, তাদের কোন ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না। [1]
[1] এ আয়াতে সেই ঈমানদারদের সুন্দর পরিণামের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, যাঁরা আল্লাহভীরুতা এবং নেক আমলের সাজে সজ্জিত হন। কুরআন ঈমানের সাথে সাথে অধিকাংশ স্থানে নেক আমলের কথা অবশ্যই উল্লেখ করেছে। যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর নিকট সেই ঈমানই গ্রহণযোগ্য যার সাথে নেক আমলও থাকে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ানআর যারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে এবং তার ব্যাপারে অহঙ্কার করেছে, তারাই আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে হবে স্থায়ী। আল-বায়ান
আর যারা আমার আয়াতগুলোকে অস্বীকার করবে আর সেগুলোর ব্যাপারে ঔদ্ধত্য দেখাবে, তারাই হল জাহান্নামের বাসিন্দা, তাতে তারা চিরকাল থাকবে। তাইসিরুল
আর যারা আমার নিদর্শন ও বিধানকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে এবং অহংকার করে ওটা হতে দূরে সরে থাকে তারাই হবে জাহান্নামী, সেখানে তারা চিরকাল অবস্থান করবে। মুজিবুর রহমান
But the ones who deny Our verses and are arrogant toward them - those are the companions of the Fire; they will abide therein eternally. Sahih International
৩৬. আর যারা আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করেছে এবং তার ব্যাপারে অহঙ্কার করেছে, তারাই অগ্নিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৩৬) আর যারা আমার নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা মনে করেছে এবং অহংকারে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তারাই দোযখবাসী; সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। [1]
[1] এতে ঈমানদারদের বিপরীত সেই লোকদের মন্দ পরিণামের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, যারা আল্লাহর বিধানসমূহকে মিথ্যাজ্ঞান করে এবং তার সামনে অহংকার প্রদর্শন করে। ঈমানদার ও কাফের উভয়ের পরিণাম বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হল, যাতে মানুষ এমন আচরণকে অবলম্বন করে, যার পরিণাম সুন্দর এবং এমন আচরণ থেকে বেঁচে থাকে, যার পরিণাম মন্দ।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান