৫৩ সূরাঃ আন-নাজম | An-Najm | سورة النجم - আয়াতঃ ৩২
৫৩:৩২ اَلَّذِیۡنَ یَجۡتَنِبُوۡنَ كَبٰٓئِرَ الۡاِثۡمِ وَ الۡفَوَاحِشَ اِلَّا اللَّمَمَ ؕ اِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الۡمَغۡفِرَۃِ ؕ هُوَ اَعۡلَمُ بِكُمۡ اِذۡ اَنۡشَاَكُمۡ مِّنَ الۡاَرۡضِ وَ اِذۡ اَنۡتُمۡ اَجِنَّۃٌ فِیۡ بُطُوۡنِ اُمَّهٰتِكُمۡ ۚ فَلَا تُزَكُّوۡۤا اَنۡفُسَكُمۡ ؕ هُوَ اَعۡلَمُ بِمَنِ اتَّقٰی ﴿۳۲﴾
الذین یجتنبون كبٓئر الاثم و الفواحش الا اللمم ان ربك واسع المغفرۃ هو اعلم بكم اذ انشاكم من الارض و اذ انتم اجنۃ فی بطون امهتكم فلا تزكوا انفسكم هو اعلم بمن اتقی ﴿۳۲﴾

যারা ছোট খাট দোষ-ত্রুটি ছাড়া বড় বড় পাপ ও অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকে, নিশ্চয় তোমার রব ক্ষমার ব্যাপারে উদার, তিনি তোমাদের ব্যাপারে সম্যক অবগত। যখন তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যখন তোমরা তোমাদের মাতৃগর্ভে ভ্রূণরূপে ছিলে। কাজেই তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না। কে তাকওয়া অবলম্বন করেছে, সে সম্পর্কে তিনিই সম্যক অবগত। আল-বায়ান

যারা বিরত থাকে বড় বড় পাপ আর অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে ছোট খাট দোষ-ত্রুটি ছাড়া; বস্তুতঃ তোমার প্রতিপালক ক্ষমা করার ব্যাপারে অতি প্রশস্ত। তিনি তোমাদের সম্পর্কে খুব ভালভাবেই জানেন যখন তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন আর যখন তোমরা তোমাদের মায়েদের পেটে ভ্রুণ অবস্থায় ছিলে। কাজেই নিজেদেরকে খুব পবিত্র মনে করো না। কে তাক্বওয়া অবলম্বন করে তা তিনি ভালভাবেই জানেন। তাইসিরুল

যারা বিরত থাকে গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কার্য হতে, ছোট- খাট অপরাধ করলেও তোমার রবের ক্ষমা অপরিসীম; তিনি (আল্লাহ) তোমাদের সম্পর্কে সম্যক অবগত, যখন তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলেন মাটি হতে এবং যখন তোমরা মাতৃগর্ভে ভ্রুণরূপে অবস্থান কর। অতএব তোমরা আত্মপ্রশংসা করনা, তিনিই সম্যক জানেন মুত্তাকী কে। মুজিবুর রহমান

Those who avoid the major sins and immoralities, only [committing] slight ones. Indeed, your Lord is vast in forgiveness. He was most knowing of you when He produced you from the earth and when you were fetuses in the wombs of your mothers. So do not claim yourselves to be pure; He is most knowing of who fears Him. Sahih International

৩২. যারা বিরত থাকে গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে, ছোটখাট অপরাধ ব্যতীত(১)৷ নিশ্চয় আপনার রবের ক্ষমা অপরিসীম; তিনি তোমাদের সম্পর্কে সম্যক অবগত—যখন তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলেন মাটি হতে এবং যখন তোমরা মাতৃগর্ভে ভ্ৰূণরূপে ছিলে। অতএব তোমরা আত্মপ্ৰশংসা করো না, তিনিই সম্যক জানেন তার সম্পর্কে যে তাকওয়া অবলম্বন করেছে।(২)

(১) এতে اللمم শব্দের মাধ্যমে ব্যতিক্রম প্রকাশ করা হয়েছে। এই ব্যতিক্রমের সারমর্ম হচ্ছে, ছোটখাট গোনাহে লিপ্ত হওয়া তাদেরকে সৎকর্মর উপাধি থেকে বঞ্চিত করে না। اللمم শব্দের তাফসীর প্রসঙ্গে সাহাবী ও তাবেয়ীগণের কাছ থেকে দু'রকম উক্তি বর্ণিত আছে। (এক) এর অর্থ সগীরা অর্থাৎ ছোটখাট গোনাহ। সূরা আন-নিসার ৩১ নং আয়াতে একে سيئات বলা হয়েছে। এই উক্তি ইবনে আব্বাস ও আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম থেকে ইবনে-কাসীর বর্ণনা করেছেন। (দুই) এর অর্থ সেসব গোনাহ, যা কদাচিৎ সংঘটিত হয়, অতঃপর তা থেকে তওবা করত চিরতরে বর্জন করা হয়। [ইবন কাসীর] এই উক্তিও ইবনে-কাসীর প্রথমে মুজাহিদ থেকে এবং পরে ইবনে আব্বাস ও আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকেও বর্ণনা করেছেন। [দেখুন: বুখারী: ৬৬১২]

(২) أجنة শব্দটি جنين এর বহুবচন। এর অর্থ গর্ভস্থত ভ্ৰূণ। [কুরতুবী] আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, “তোমরা নিজেদের পবিত্ৰতা দাবি করো না। কারণ, আল্লাহ-ই ভাল জানেন কে কতটুকু মুত্তাকী”। শ্রেষ্ঠত্ব তাকওয়ার ওপর নির্ভরশীল, বাহ্যিক কাজ-কর্মের ওপর নয়। তাকওয়াও তা-ই ধর্তব্য যা মৃত্যু পর্যন্ত কায়েম থাকে। যয়নব বিনতে আবু সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহা-এর পিতামাতা তার নাম রেখেছিলেন ‘বাররা’ যার অর্থ সৎকর্মপরায়ণ। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলোচ্য আয়াত তেলাওয়াত করে এই নাম রাখতে নিষেধ করেন। কারণ, এতে সৎ হওয়ার দাবি রয়েছে। অতঃপর তার নাম পরিবর্তন করে যায়নব রাখা হয়। [মুসলিম: ১৮, ১৯]। অনরূপভাবে, জনৈক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সামনে অন্য এক ব্যক্তির প্রশংসা করলে তিনি নিষেধ করে বললেনঃ তুমি যদি কারও প্রশংসা করতেই চাও, তবে এ কথা বলে করঃ আমার জানা মতে এই ব্যক্তি সৎ আল্লাহভীরু। সে আল্লাহর কাছেও পাক পবিত্র কিনা আমি জানি না। [বুখারী: ২৬৬২, মুসলিম: ৬৫, মুসনাদে আহমাদ: ৫/৪১, ৪৫]

এ আয়াতের শানে নুযুল সম্পর্কে একটি বর্ণনা এসেছে, সাবেত ইবনুল হারিস আনসারী বলেন, ইয়াহূদীদের কোন সন্তান ছোট অবস্থায় মারা গেলে তারা তাকে বলত, সে সিদ্দীকীনের মর্যাদায় পৌছে গেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এ কথা পৌছলে তিনি বললেন, ইয়াহুদীরা মিথ্যা বলেছে। কোন সন্তান তার মায়ের পেটে থাকতেই তার সৌভাগ্যবান হওয়া বা দূৰ্ভাগা হওয়া লিখে নেয়া হয়েছে। তারপর আল্লাহ্ তা'আলা উপরোক্ত আয়াত নাযিল করেন। [মুজামুল কাবীর লিত তাবরানী: ২/৮১, ৮২ হাদীস নং ১৩৬৮]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৩২) যারা ছোট-খাট অপরাধ ছাড়া[1] গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কার্য হতে বিরত থাকে।[2] নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক অপরিসীম ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের সম্পর্কে সম্যক অবগত যখন তিনি তোমাদেরকে মাটি হতে সৃষ্টি করেছিলেন এবং যখন তোমরা মাতৃগর্ভে ভ্রূণরূপে অবস্থান কর।[3] অতএব তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না।[4] তিনিই সম্যক জানেন আল্লাহভীরু কে।

[1] لَمَمٌ এর আভিধানিক অর্থ অল্প ও ছোট হওয়া। আর এ থেকেই বলা হয়, أَلَمَّ بالمكان অর্থাৎ, গৃহে অল্পক্ষণ ছিল। ألَمَّ بالطَّعَام অল্প একটু খেয়েছে। অনুরূপ কোন জিনিসকে কেবল স্পর্শ করা বা তার নিকটবর্তী হওয়া অথবা কোন কাজকে লাগাতার নয়; বরং কেবল এক বা দু’বার করা কিংবা অন্তরে কেবল খেয়ালের উদয় হওয়া, এ সবকেই لمم বলা হয়। (ফাতহুল ক্বাদীর) لمم এর এই ভাষাগত প্রয়োগ ও তার অর্থের দিকে লক্ষ্য করেই তার অর্থ করা হয় ‘সাগীরা গুনাহ’ (ছোট-খাট পাপ)। অর্থাৎ, কোন বড় পাপের প্রাথমিক পর্যায়ের জিনিস করে ফেলা। তবে বড় পাপ থেকে বিরত থাকা অথবা কোন পাপ এক-দু’বার করে ফেলা অতঃপর চিরতরে তা বর্জন করা কিংবা কোন পাপ করার কথা কেবল মনে ভেবে নেওয়া; কিন্তু কার্যতঃ তার ধারে-পাশেও না যাওয়া। এগুলো ছোট গুনাহ বলে গণ্য হবে। যেগুলো মহান আল্লাহ বড় পাপ থেকে বিরত থাকার কারণে ক্ষমা করে দিবেন।

[2] كَبَائِر হল كَبِيْرَةٌ এর বহুবচন। কাবীরা গোনাহ, গুরুতর পাপ তথা মহাপাপের সংজ্ঞায় মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশ উলামাদের মতে এমন সব পাপকে কাবীরা তথা মহাপাপ বলা হয়, যার উপর জাহান্নামের হুমকি এসেছে অথবা যে পাপে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিন্দাবাদ কুরআন ও হাদীসে আলোচিত হয়েছে (অথবা যে পাপের কারণে পাপীকে অভিশাপ করা হয়েছে)। অনুরূপ উলামাগণ এ কথাও বলেছেন যে, অব্যাহতভাবে কোন ছোট পাপ করতে থাকলে তা মহাপাপে পরিণত হয়ে যায়। এ ছাড়া ‘কাবীরা’ গুনাহের অর্থ ও তার প্রকৃতত্বে যেমন মতভেদ রয়েছে, অনুরূপ মতভেদ তার সংখ্যার ব্যাপারেও রয়েছে। কোন কোন আলেম ঐ মহাপাপসমূহকে একটি পুস্তিকার মধ্যে একত্রিতও করেছেন। যেমন, ইমাম যাহাবী (রঃ) রচিত ‘কিতাবুল কাবাইর’ এবং ফকীহ হাইতামী রচিত ‘আয্-যাওয়াজির’ প্রভৃতি। فَوَاحِشُ হল فَاحِشَةٌ এর বহুবচন। অশ্লীল কাজ। যেমন, ব্যভিচার, সমলিঙ্গী ব্যভিচার ­ইত্যাদি। কেউ কেউ বলেছেন, যেসব পাপের জন্য দন্ডবিধি আছে, সেগুলো সব فواحش এর অন্তর্ভুক্ত। সম্প্রতি অশ্লীলতার দৃশ্যাদি যেহেতু ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, সেহেতু আধুনিক সভ্যতায় এটাকেই সভ্যতা ও ফ্যাশন মনে করা হচ্ছে। এমন কি মুসলিমরাও ঐ অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতার এই সভ্যতাকে লাফ দিয়ে লুফে নিয়েছে। তাই দেখা যায়, আজ তাদের ঘরে ঘরে টিভি, ভিসিআর, ভিসিপি, ভিসিডি ইত্যাদি ব্যাপক হয়ে পড়েছে। মহিলারা কেবল পর্দা ত্যাগ করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, বরং সুন্দরভাবে সাজগোজ করে (অর্ধনগ্নাবস্থায়) রূপ-সৌন্দর্য বিতরণ করতে করতে বাইরে বেড়ানোটাকে নিজেদের একটা ফ্যাশন ও অভ্যাসে পরিণত করে নিয়েছে। ছেলে-মেয়েদের যৌথ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যৌথ অফিস-আদালত, যৌথ সভাসমিতি এবং (পার্ক, সমুদ্র-সৈকত প্রভৃতি) আরো বিভিন্ন স্থানে নর-নারীর অবাধ মেলামেশা ও দ্বিধা-সংকোচহীন সংলাপ দিনের দিন বেড়ে চলেছে। (বেড়ে চলেছে অবৈধ ভালবাসা ও তথাকথিত পছন্দ করে বিয়ে করার নামে ‘লাভম্যারেজ’ ও ‘লিভ টুগ্যাদার’।) অথচ এ সবই ‘ফাওয়াহিশ’ (অশ্লীলতা)এর অন্তর্ভুক্ত। আয়াতে যাদের ক্ষমা করার কথা আলোচনা করা হচ্ছে, তারা মহাপাপ ও অশ্লীলতা থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে; তাতে তারা লিপ্ত থাকবে না।

[3]  أ جِنَّةٌহল جَنِيْنٌ এর বহুবচন। (এর মূল অর্থঃ গুপ্ত) গর্ভস্থ ভ্রূণকে جَنِيْنٌ বলা হয়। কারণ, তা লোক চক্ষু থেকে গোপনে থাকে।

[4] অর্থাৎ, তাঁর নিকট যখন তোমাদের কোন অবস্থা ও আচরণ লুক্কায়িত নেই; এমনকি তোমরা যখন মাতৃগর্ভে ছিলে, যেখানে তোমাদেরকে দেখার কারো সাধ্য ছিল না, সেখানেও তিনি তোমাদের যাবতীয় অবস্থা ও খবরাখবর সম্পর্কে অবগত ছিলেন, তখন আত্মপ্রশংসা করার এবং নিজেদের মুখে নিজেদের সততার বর্ণনা দেওয়ার দরকার কি? অর্থাৎ, এ রকম করো না। যাতে লোক দেখানো কাজ থেকে তোমরা বাঁচতে পার।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান