৪৯ সূরাঃ আল-হুজুরাত | Al-Hujurat | سورة الحجرات - আয়াত নং - ১২ মাদানী
হে মুমিনগণ, তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাক। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ অধিক তাওবা কবূলকারী, অসীম দয়ালু। আল-বায়ান
হে মু’মিনগণ! তোমরা অধিক ধারণা হতে বিরত থাক। কতক ধারণা পাপের অন্তর্ভুক্ত। তোমরা অন্যের দোষ খোঁজাখুঁজি করো না, একে অন্যের অনুপস্থিতিতে দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো সেটাকে ঘৃণাই করে থাক। আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহ খুব বেশি তাওবাহ ক্ববূলকারী, অতি দয়ালু। তাইসিরুল
হে মু’মিনগণ! তোমরা বহুবিধ অনুমান হতে দূরে থাক; কারণ অনুমান কোন কোন ক্ষেত্রে পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করনা এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করনা। তোমাদের মধ্যে কি কেহ তার মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করতে চায়? বস্তুতঃ তোমরাতো এটাকে ঘৃণাই মনে কর। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ তাওবাহ গ্রহণকারী, পরম দয়ালু। মুজিবুর রহমান
O you who have believed, avoid much [negative] assumption. Indeed, some assumption is sin. And do not spy or backbite each other. Would one of you like to eat the flesh of his brother when dead? You would detest it. And fear Allah; indeed, Allah is Accepting of repentance and Merciful. Sahih International
১২. হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিকাংশ অনুমান হতে দূরে থাক; কারণ কোন কোন অনুমান পাপ এবং তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং একে অন্যের গীবত করো না।(১) তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে চাইবে?(২) বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণ্যই মনে কর। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; নিশ্চয় আল্লাহ্ তওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু।
(১) এই আয়াতে পারস্পরিক হক ও সামাজিক রীতি-নীতি ব্যক্ত হয়েছে এবং এতে তিনটি বিষয় হারাম করা হয়েছে। (এক) ধারণা, (দুই) কোন গোপন দোষ সন্ধান করা এবং (তিন) গীবত অর্থাৎ, কোন ব্যক্তি সম্পর্কে এমন কথা বলা যা সে শুনলে অসহনীয় মনে করত।
তন্মধ্যে প্রথম বিষয় হচ্ছে, الظن বা প্ৰবল ধারণা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমাদের কারও আল্লাহর প্রতি সু-ধারণা পোষণ ব্যতীত মৃত্যুবরণ করা উচিত নয়।” [মুসলিম: ৫১২৫, আবু দাউদ: ২৭০৬, ইবনে মাজাহ: ৪১৫৭] অন্য এক হাদীসে আছে ‘আমি আমার বান্দার সাথে তেমনি ব্যবহার করি, যেমন সে আমার সম্বন্ধে ধারণা রাখে। এখন সে আমার প্রতি যা ইচ্ছা ধারণা রাখুক। [মুসনাদে আহমাদ: ১৫৪৪২] এ থেকে জানা যায় যে, আল্লাহর প্রতি ভাল ধারণা পোষণ করা ফরয এবং কু-ধারণা পোষন করা হারাম। এমনিভাবে যেসব মুসলিম বাহ্যিক অবস্থার দিক দিয়ে সৎকর্মপরায়ণ দৃষ্টিগোচর হয়, তাদের সম্পর্কে প্রমাণ ব্যতিরেকে কু-ধারণা পোষণ করা হারাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে থাক। কেননা, ধারণা মিথ্যা কথার নামান্তর।’ [বুখারী: ৪০৬৬, মুসলিম: ২৫৬৩]
আয়াতে দ্বিতীয় নিষিদ্ধ বিষয় হচ্ছে, কারও দোষ সন্ধান করা। এর দ্বারা নানা রকম ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি হয়। এ কারণে একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার খোতবার দোষ অন্বেষণকারীদের সম্পর্কে বলেছেনঃ “হে সেই সব লোকজন, যারা মুখে ঈমান এনেছো কিন্তু এখনো ঈমান তোমাদের অন্তরে প্ৰবেশ করেনি, তোমরা মুসলিমদের গোপনীয় বিষয় খোঁজে বেড়িও না। যে ব্যক্তি মুসলিমদের দোষ-ত্রুটি তালাশ করে বেড়াবে আল্লাহ্ তার দোষ-ত্রুটির অন্বেষণে লেগে যাবেন। আর আল্লাহ যার ত্রুটি তালাশ করেন তাকে তার ঘরের মধ্যে লাঞ্ছিত করে ছাড়েন।” [আবু দাউদ: ৪৮৮০]
মু'আবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আমি নিজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ “তুমি যদি মানুষের গোপনীয় বিষয় জানার জন্য পেছনে লাগো। তাদের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করবে কিংবা অন্তত বিপর্যয়ের দ্বার প্রান্তে পৌছে দেবে।” [আবু দাউদ: ৪৮৮৮] অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “মুসলিমদের গীবত করো না এবং তাদের দোষ অনুসন্ধান করো না। কেননা, যে ব্যক্তি মুসলিমদের দোষ অনুসন্ধান করে, আল্লাহ তার দোষ অনুসন্ধান করেন। আল্লাহ যার দোষ অনুসন্ধান করেন, তাকে স্ব-গৃহেও লাঞ্ছিত করে দেন।” [আবু দাউদ: ৪৮৮০]
দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান না করার এ নির্দেশ শুধু ব্যক্তির জন্যই নয়, বরং ইসলামী সরকারের জন্যেও। এ ক্ষেত্রে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ ঘটনা অতীব শিক্ষাপ্ৰদ। একবার রাতের বেলা তিনি এক ব্যক্তির কণ্ঠ শুনতে পেলেন। সে গান গাইতেছিল। তাঁর সন্দেহ হলো। তিনি তার সাথী আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেনঃ এ ঘরটি কার? বলা হল, এটা রবী’আ ইবন উমাইয়া ইবন খালফ এর ঘর। তারা এখন শরাব খাচ্ছে। আপনার কি অভিমত? অতঃপর আব্দুর রাহমান ইবন আওফ বললেন, আমার অভিমত হচ্ছে যে, আমরা আল্লাহ যা নিষেধ করেছে তা-ই করে ফেলছি। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তা করতে নিষেধ করে বলেছেনঃ “তোমরা গোপন বিষয়ে অন্বেষণ করো না”। [সূরা আল হুজুরাত: ১২] তখন উমর ফিরে আসলেন এবং তাকে ছেড়ে গেলেন। [মুস্তাদরাকে হাকিম: ৮২৪৯, মাকারিমূল আখলাক: আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে জাফর আল খারায়েতী: ৩৯৮, ৪২০, মুসান্নাফে আব্দির রাজ্জাক; ১০/২২১]
এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, খুঁজে খুঁজে মানুষের গোপন দোষ-ত্রুটি বের করা এবং তারপর তাদেরকে পাকড়াও করা শুধু ব্যক্তির জন্যই নয়, ইসলামী সরকারের জন্যও জায়েয নয়। একটি হাদীসেও একথা উল্লেখিত হয়েছে উক্ত হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “শাসকরা যখন সন্দেহের বশে মানুষের দোষ অনুসন্ধান করতে শুরু করে তখন তাদের চরিত্র নষ্ট করে দেয়।” [আবু দাউদ: ৪৮৮৯]
আয়াতে নিষিদ্ধ তৃতীয় বিষয় হচ্ছে গীবত। গীবতের সংজ্ঞায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “কোন ব্যক্তি সম্পর্কে কারো এমন কথা বলা যা শুনলে সে অপছন্দ করবে। প্রশ্ন হলো, আমি যা বলছি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে সত্যিই থেকে থাকে তাহলে আপনার মত কি? তিনি বললেনঃ তুমি যা বলছো তা যদি তার মধ্যে থাকে তাহলেই তো তুমি তার গীবত করলে। আর তা যদি না থাকে তাহলে অপবাদ আরোপ করলে।” [মুসলিম: ২৫৮৯, আবু দাউদ: ৪৮৭৪, তিরমিযীঃ ১৯৩৪]
(২) এই আয়াতে তিনটি বিষয় নিষিদ্ধ করতে গিয়ে গীবতের নিষিদ্ধতাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং একে মৃত মুসলিমের মাংস ভক্ষণের সমতুল্য প্রকাশ করে এর নিষিদ্ধতা ও নীচতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মি'রাজের রাত্রির হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তারপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হল, আমি এমন এক সম্প্রদায়ের কাছ দিয়ে গেলাম যাদের নখ ছিল তামার। তারা তাদের মুখমণ্ডল ও দেহের মাংস আচড়াচ্ছিল। আমি জিবরীল আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তিনি বললেনঃ এরা তাদের ভাইয়ের গীবত করত এবং তাদের ইজ্জতিহানি করত। [মুসনাদে আহমাদ: ৩/২২৪, আবু দাউদ: ৪৮৭৮]
তাফসীরে জাকারিয়া(১২) হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা বহুবিধ ধারণা হতে দূরে থাক; কারণ কোন কোন ধারণা পাপ[1] এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না[2] এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা (গীবত) করো না।[3] তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভায়ের গোশত ভক্ষণ করতে চাইবে? বস্তুতঃ তোমরা তো এটাকে ঘৃণ্যই মনে কর।[4] তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ তাওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু।
[1] ظَنٌّ এর অর্থ ধারণা করা। অর্থাৎ, সৎ ও আল্লাহভীরু ভালো লোকদের ব্যাপারে এমন ধারণা পোষণ করা, যা মন্দ অথচ ভিত্তিহীন এবং যা মিথ্যা অপবাদের আওতায় পড়ে। তাই এর অনুবাদ করা হয়, কুধারণা। হাদীসে এটাকে أَكْذَبُ الْحَدِيْثِ (সব চাইতে বড় মিথ্যা) গণ্য করে এ থেকে বিরত থাকার প্রতি তাকীদ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, (إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ) অর্থাৎ, তোমরা কুধারণা থেকে দূরে থাক। (বুখারী, মুসলিম) পক্ষান্তরে পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তিদের পাপের কারণে তাদের পাপের উপর কুধারণা পোষণ করা সেই কুধারণা নয়, যেটাকে এখানে পাপ বলা হয়েছে এবং যা থেকে বিরত থাকতে তাকীদ করা হয়েছে। উলামাগণ বলেন, বাহ্যতঃ ভালো লোকের প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করা বৈধ নয়। তবে বাহ্যতঃ মন্দ লোক পাপাচারীর প্রতি মন্দ ধারণা করা অবৈধ নয়। (কুরত্বুবী)
[2] অর্থাৎ, এই সন্ধানে থাকা যে, কোন গোপন দোষ-ত্রুটি পেলে বদনাম করা যাবে। এটাকেই تجسّس (জাসুসী) বলে, যা নিষেধ। হাদীসেও এ কাজ থেকে নিষেধ করা হয়েছে এবং নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, যদি কারো কোন দোষ-ত্রুটি তোমরা জানতে পার, তবে তা গোপন কর। না সেটাকে মানুষের সামনে বলে বেড়াও, আর না খুঁজে খুঁজে দোষ বের কর। বর্তমানে ব্যক্তি-স্বাধীনতার বড় চর্চা করা হয়। ইসলামও দোষ অনুসন্ধান করা থেকে নিষেধ করে মানুষের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু তা ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ পর্যন্ত সে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা সম্পাদন না করে অথবা যতক্ষণ পর্যন্ত সে অপরের কষ্টের কারণ না হয়। পাশ্চাত্যের দেশগুলো অবাধ স্বাধীনতার শিক্ষা দিয়ে সকল মানুষকে ব্যাপক ফ্যাসাদের অনুমতি দিয়ে রেখেছে। যার ফলে সমাজের সকল প্রকার নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে গেছে।
[3] গীবতের অর্থ হল, অন্য লোকের কাছে কোন ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা (নিন্দা বা সমালোচনা করা), যা সে অপছন্দ করে। আর যদি তার প্রতি এমন দোষের কথা সম্পৃক্ত করা হয়, যা তার মধ্যে নেই, তাহলে তা মিথ্যা অপবাদ হবে। স্ব-স্ব স্থানে দু’টোই বড় অপরাধ ও মহাপাপ।
[4] অর্থাৎ, অপরের কাছে কোন মুসলিম ভাইয়ের নিন্দা গাওয়া ঐ রকমই, যেমন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া। মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে তো কেউ পছন্দ করে না, কিন্তু গীবত হল মানুষের অতি প্রিয় খাদ্য।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান