কুরআনের আয়াতের অনুবাদ/তাফসীর 'টি ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code

২৪ সূরাঃ আন-নূর | An-Nur | سورة النور - আয়াত নং - ২ মাদানী

২৪ : ২ اَلزَّانِیَۃُ وَ الزَّانِیۡ فَاجۡلِدُوۡا کُلَّ وَاحِدٍ مِّنۡهُمَا مِائَۃَ جَلۡدَۃٍ ۪ وَّ لَا تَاۡخُذۡکُمۡ بِهِمَا رَاۡفَۃٌ فِیۡ دِیۡنِ اللّٰهِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ۚ وَ لۡیَشۡهَدۡ عَذَابَهُمَا طَآئِفَۃٌ مِّنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۲﴾

ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী তাদের প্রত্যেককে একশ’টি করে বেত্রাঘাত কর। আর যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান এনে থাক তবে আল্লাহর দীনের ব্যাপারে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে পেয়ে না বসে। আর মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। আল-বায়ান

ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী তাদের প্রত্যেককে একশত করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর আইন কার্যকর করার ব্যাপারে তাদের প্রতি দয়ামায়া তোমাদেরকে যেন প্রভাবিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাত দিনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাক। একদল মু’মিন যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। তাইসিরুল

ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী - নারী ও পুরুষ প্রত্যেককে একশ’ কশাঘাত করবে, আল্লাহর বিধান কার্যকরী করতে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে প্রভাবান্বিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাসী হও; মু’মিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। মুজিবুর রহমান

The [unmarried] woman or [unmarried] man found guilty of sexual intercourse - lash each one of them with a hundred lashes, and do not be taken by pity for them in the religion of Allah, if you should believe in Allah and the Last Day. And let a group of the believers witness their punishment. Sahih International

২. ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী— তাদের প্ৰত্যেককে একশত বেত্ৰাঘাত করবে(১), আল্লাহর বিধান কার্যকরীকরণে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে প্রভাবান্বিত না করে(২), যদি তোমরা আল্লাহ্‌ এবং আখেরাতের উপর ঈমানদার হও; আর মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্ৰত্যক্ষ করে।(৩)

(১) جلد শব্দের অর্থ মারা। [ফাতহুল কাদীর] جلد শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করার মধ্যে ইঙ্গিত আছে যে, এই বেত্ৰাঘাতের প্রতিক্রিয়া চামড়া পর্যন্তই সীমিত থাকা চাই এবং মাংস পর্যন্ত না পৌছা চাই। [বাগভী] একশ বোত্রাঘাতের উল্লেখিত শাস্তি শুধু অবিবাহিত পুরুষ ও নারীর জন্য নির্দিষ্ট; বিবাহিতদের শাস্তি প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা। [সা’দী] হাদীসে এসেছে, দু’জন লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বিবাদে লিপ্ত হলো। তাদের একজন বললঃ আপনি আমাদের মাঝে আল্লাহর কিতাব দিয়ে ফয়সালা করে দিন। অপরজন (যে তাদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে জ্ঞানী ছিল সে) বললো: হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাদের মাঝে ফয়সালা করে দিন এবং আমাকে কথা বলার অনুমতি দিন। তিনি বললেনঃ বল।

লোকটি বললঃ আমার ছেলে এ লোকের কাজ করতো। তারপর সে তার স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করে বসে। লোকেরা আমাকে বললো যে, আমার ছেলের উপর পাথর মেরে হত্যা করার হুকুম রয়েছে। তখন আমি একশত ছাগল এবং একটি দাসীর বিনিময়ে আমার ছেলেকে ছাড়িয়ে আনি। তারপর আমি জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করলে তারা বললো যে, আমার সন্তানের উপর ১০০ বেত্ৰাঘাত এবং একবছরের দেশান্তর। পাথর মেরে হত্যা তো তার স্ত্রীর উপরই। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমার ছাগল ও দাসী তোমার কাছে ফেরৎ যাবে। তারপর তিনি তার ছেলেকে ১০০ বেত্ৰাঘাত এবং এক বছরের দেশান্তরের শাস্তি দিলেন এবং উনাইস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেনঃ এ দ্বিতীয় ব্যক্তির স্ত্রীর নিকট যাও। যদি সে স্বীকারোক্তি দেয় তবে তাকে পাথর মেরে হত্যা কর। পরে মহিলা স্বীকারোক্তি করলে তাকে পাথর মেরে হত্যা করা হয়। [বুখারী: ৬৬৩৩, ৬৬৩৪, মুসলিম: ১৬৯৭, ১৬৯৮]

অনুরূপভাবে উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিম্বরে উপবিষ্ট অবস্থায় বললেনঃ আল্লাহ্ তা'আলা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সত্যসহ প্রেরণ করেন এবং তার প্রতি কিতাব নাযিল করেন। কিতাবে যেসব বিষয় নাযিল করা হয়, তন্মধ্যে প্রস্তরাঘাতে হত্যার বিধানও ছিল, যা আমরা পাঠ করেছি, স্মরণ রেখেছি এবং হৃদয়ঙ্গম করেছি। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও প্রস্তরাঘাতে হত্যা করেছেন এবং তার পরে আমরাও করেছি। এখন আমি আশংকা করছি যে, সময়ের চাকা আবর্তিত হওয়ার পর কেউ একথা বলতে না শুরু করে যে, আমরা প্রস্তরাঘাতে হত্যার বিধান আল্লাহর কিতাবে পাই না। ফলে সে একটি দ্বীনী কর্তব্য পরিত্যাগ করার কারণে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে, যা আল্লাহ তা'আলা নাযিল করেছেন। মনে রেখো, প্রস্তরাঘাতে হত্যার বিধান আল্লাহর কিতাবে সত্য এবং বিবাহিত পুরুষ ও নারীর প্রতি প্রযোজ্য- যদি ব্যভিচারের শরীয়তসম্মত সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থিত হয় অথবা গর্ভ ও স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়৷ [বুখারীঃ ৬৮২৯, মুসলিমঃ ১৬৯১]

(২) ব্যভিচারের শাস্তি অত্যন্ত কঠোর বিধায় শাস্তি প্রয়োগকারীদের তরফ থেকে দয়াপরবশ হয়ে শাস্তি ছেড়ে দেয়ার কিংবা হ্রাস করার সম্ভাবনা আছে। [সা’দী] তাই সাথে সাথে আদেশ দেয়া হয়েছে যে, দ্বীনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিধান কার্যকর কারণে অপরাধীদের প্রতি দয়াপরবশ হওয়া বৈধ নয়। [দেখুন: ইবন কাসীর, বাগভী, তাবারী]

(৩) অর্থাৎ ঘোষণা দিয়ে সাধারণ লোকের সামনে শাস্তি দিতে হবে। এর ফলে একদিকে অপরাধী অপদস্ত হবে এবং অন্যদিকে সাধারণ মানুষ শিক্ষা লাভ করবে। [ফাতহুল কাদীর, কুরতুবী সা’দী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(২) ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী -- ওদের প্রত্যেককে একশো কশাঘাত কর।[1] আল্লাহর বিধান কার্যকরীকরণে ওদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে অভিভূত না করে; যদি তোমরা আল্লাহতে এবং পরকালে বিশ্বাসী হও।[2] আর বিশ্বাসীদের একটি দল যেন ওদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। [3]

[1] ব্যভিচারের প্রারম্ভিক শাস্তি; যা ইসলামে অস্থায়ীভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল তা সূরা নিসার ১৫নং আয়াতে আলোচিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, যতক্ষণ এ ব্যাপারে কোন স্থায়ী শাস্তি নির্ধারিত করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই সমস্ত ব্যভিচারিণী মহিলাদেরকে ঘরে আবদ্ধ রাখা হোক। কিন্তু যখন সূরা নূরের এই আয়াত অবতীর্ণ হল, তখন নবী (সাঃ) বললেন যে, ‘আল্লাহ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেই মত ব্যভিচারী পুরুষ ও নারীর স্থায়ী শাস্তি নির্ধারিত করে দিয়েছেন, তা তোমরা আমার কাছ হতে শিখে নাও। আর তা হল, অবিবাহিত পুরুষ ও নারীর জন্য একশত বেত্রাঘাত ও বিবাহিত নারী-পুরুষের জন্য একশত বেত ও পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা।’ (সহীহ মুসলিম, দন্ডবিধি অধ্যায়) অতঃপর বাস্তবে তিনি বিবাহিত (ব্যভিচারী)-দের শাস্তি দিয়েছেন পাথর মেরে, আর একশত বেত্রাঘাত (যা ছোট শাস্তি) বড় শাস্তির সাথে একত্রীভূত করে বিলুপ্ত করেছেন। অতএব এখন বিবাহিত নারী-পুরুষের ব্যভিচারের একমাত্র শাস্তি পাথর মেরে শেষ করে ফেলা। নবী (সাঃ)-এর যুগের পর খোলাফায়ে রাশেদীন তথা সাহাবাদের যুগেও উক্ত শাস্তিই দেওয়া হত। পরবর্তীকালের ফকীহগণ ও উলামাবৃন্দ এ ব্যাপারে একমত ছিলেন এবং এখনো একমত আছেন। শুধুমাত্র খাওয়ারিজ সম্প্রদায় পাথর ছুঁড়ে মারার এই শাস্তিকে অস্বীকার করে। ভারত উপমহাদেশেও আজকাল এমন কিছু মানুষ আছে, যারা উক্ত শাস্তির কথা মানতে অস্বীকার করে থাকে। এই অস্বীকার করার মূল কারণ হাদীস অস্বীকার করা। কারণ পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলার শাস্তি সহীহ ও শক্তিশালী হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এবং সেই সমস্ত হাদীসের বর্ণনাকারীর সংখ্যাও এত বেশি যে, উলামাবৃন্দ সেগুলোকে ‘মুতাওয়াতির’ (বর্ণনা-পরম্পরা-বহুল) হাদীস বলে গণ্য করেছেন। বলা বাহুল্য, হাদীসের প্রামাণিকতা ও তা শরীয়তের একটি উৎস হওয়ার কথা যাঁরা স্বীকার করেন, তাঁরা উক্ত শাস্তির বিধানকে অস্বীকার করতে পারেন না।

[2] এর অর্থ এই যে, দয়ার উদ্রেক হওয়ার কারণে শাস্তির বিধান কার্যকর করতে বিরত থেকো না। তবে প্রাকৃতিকভাবে দয়ার উদ্রেক হওয়া ঈমানের প্রতিকুল নয়। দয়া মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব।

[3] যাতে মানুষের শিক্ষা গ্রহণ যা শাস্তিদানের আসল উদ্দেশ্য তা ব্যাপকতা লাভ করে। (শাস্তি দেখে অন্যরা উপদেশ নিতে পারে এবং এমন কাজে পা বাড়াতে ভয় পায়।) ভাগ্যচক্রে আজকাল জন-সমক্ষে শাস্তি দেওয়াকে মানবাধিকার বিরোধী বলে প্রচার করা হচ্ছে। এটি সম্পূর্ণ মূর্খতা, আল্লাহর আদেশের প্রতি বিদ্রোহ এবং তাদের ধারণা মতে তারা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর থেকে বেশি মানুষের হিতাকাঙ্ক্ষী ও মঙ্গলকামী হতে চাওয়া। অথচ প্রকৃত প্রস্তাবে আল্লাহ অপেক্ষা অধিক করুণাময় ও দয়াবান আর কেউ নেই।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান