২২ সূরাঃ আল-হজ্জ | Al-Hajj | سورة الحج - আয়াত নং - ২৫ মাদানী
নিশ্চয় যারা কুফরী করে এবং আল্লাহর পথ থেকে ও মসজিদে হারাম থেকে বাধা দেয়, যাকে আমি স্থানীয় ও বহিরাগত সকলের জন্য সমান করেছি। আর যে ব্যক্তি সীমালঙ্ঘন করে সেখানে পাপকাজ করতে চায়, তাকে আমি যন্ত্রণাদায়ক আযাব আস্বাদন করাব। আল-বায়ান
যারা কুফুরী করে আর আল্লাহর পথে (মানুষের চলার ক্ষেত্রে) বাধা সৃষ্টি করে আর মাসজিদে হারামে যেতেও- যাকে আমি করেছি স্থানীয় বাসিন্দা ও অন্যদেশবাসী সকলের জন্য সমান। যে তাতে অন্যায়ভাবে কোন ধর্মদ্রোহী কাজ করার ইচ্ছে করে তাকে আমি আস্বাদন করাব ভয়াবহ শাস্তি। তাইসিরুল
যারা কুফরী করে এবং মানুষকে নিবৃত্ত করে আল্লাহর পথ হতে ও মাসজিদুল হারাম হতে, যা আমি করেছি স্থানীয় ও বহিরাগত সবারই জন্য সমান, আর যে ইচ্ছা করে ওতে পাপ কাজের সীমা লংঘন করে তাকে আমি আস্বাদন করাব মর্মন্তদ শাস্তি। মুজিবুর রহমান
Indeed, those who have disbelieved and avert [people] from the way of Allah and [from] al-Masjid al-Haram, which We made for the people - equal are the resident therein and one from outside; and [also] whoever intends [a deed] therein of deviation [in religion] or wrongdoing - We will make him taste of a painful punishment. Sahih International
২৫. নিশ্চয় যারা কুফরী করেছে ও মানুষকে বাধা দিয়েছে আল্লাহর পথ(১) থেকে ও মসজিদুল হারাম থেকে(২), যা আমরা করেছি স্থানীয় ও বহিরাগত সব মানুষের জন্য সমান(৩), আর যে সেখানে অন্যায়ভাবে ইলহাদ(৪) তথা দ্বীনবিরোধী পাপ কাজের ইচ্ছে করে, তাকে আমরা আস্বাদন করাব যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
(১) আল্লাহর পথ বলে ইসলামকে বোঝানো হয়েছে। আয়াতের অর্থ এই যে, তারা নিজেরা তো ইসলাম থেকে দূরে সরে আছেই; অন্যদেরকেও ইসলাম থেকে বাধা দেয়। [ফাতহুল কাদীর]
(২) এটা তাদের দ্বিতীয় গোনাহ। তারা মুসলিমদেরকে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। মসজিদুল হারাম ঐ মসজিদকে বলা হয়, যা বায়তুল্লাহর চতুষ্পার্শ্বে নির্মিত হয়েছে। এটা মক্কার হারাম শরীফের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু কোন কোন সময় ‘মসজিদুল হারাম’ বলে মক্কার সম্পূর্ণ হারাম শরীফ বোঝানো হয়; যেমন হুদায়বিয়ার ঘটনাতে মক্কার কাফেররা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে শুধু মসজিদে হারামে প্রবেশে বাধা দেয়নি; বরং হারামের সীমানায় প্রবেশ করতে বাধা দান করেছিল। সহীহ হাদীস দ্বারা তা-ই প্রমাণিত রয়েছে। কুরআনুল করীম এ ঘটনায় মসজিদুল হারাম শব্দটি সাধারণ হারাম অর্থে ব্যবহার করেছে এবং বলেছেঃ (وَصَدُّوكُمْ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ) [সূরা আল-ফাত্হঃ ২৫] তাফসীরে দুররে-মানসূরে এ স্থানে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে রেওয়ায়েত বৰ্ণনা করা হয়েছে যে, আয়াতে মসজিদে হারাম বলে হারাম এলাকা বোঝানো হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর]
(৩) এখানে যারা কুফরি করেছে, আল্লাহর পথ থেকে বাধা দিচ্ছে এবং মাসজিদুল হারাম থেকে বাধা দেয় তাদের কি অবস্থা হবে সেটা উল্লেখ করা হয় নি। তবে আয়াত থেকে সেটা বুঝা যায়, আর তা হচ্ছে, তারা ক্ষতিগ্ৰস্ত হবে বা ধ্বংস হবে। [ফাতহুল কাদীর]
আয়াতে বর্ণিত ‘সব মানুষের জন্য সমান’ বলে বুঝানো হয়েছে যে, হারাম কোন ব্যক্তি, পরিবার বা গোত্রের নিজস্ব সম্পত্তি নয়। বরং সর্বসাধারণের জন্য ওয়াকফকৃত, যার যিয়ারত থেকে বাধা দেবার অধিকার কারো নেই। মাসজিদুল হারাম ও হারাম শরীফের যে যে অংশে হজের ক্রিয়াকর্ম পালন করা হয়; যেমন- ছাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থান, মীনার সমগ্র ময়দান, আরাফাতের সম্পূর্ণ ময়দান এবং মুযদালফার গোটা ময়দান, এসব ভূখণ্ড সারা বিশ্বের মুসলিমদের জন্য সাধারণ ওয়াকফ। কোন ব্যক্তি বিশেষের ব্যক্তিগত মালিকানা এগুলোর উপর কখনো হয়নি এবং হতেও পারে না।
এ বিষয়ে সমগ্র উম্মত ও ফেকাহবিদগণ একমত। এগুলো ছাড়া মক্কা মুকাররমার সাধারণ বাসগৃহ এবং হারামের অবশিষ্ট ভূখণ্ড সম্পর্কেও কোন কোন ফেকাহবিদ বলেন যে, এগুলোও সাধারণ ওয়াকফ সম্পত্তি। এগুলো বিক্রয় করা ও ভাড়া দেয়া হারাম। প্রত্যেক মুসলিম যে কোন স্থানে অবস্থান করতে পারে। তবে অধিকসংখ্যক ফেকাহবিদগণের উক্তি এই যে, মক্কার বাসগৃহসমূহের উপর ব্যক্তিবিশেষের মালিকানা হতে পারে। কারণ, ওমর ফারুদ্ধক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে প্রমাণিত আছে যে, তিনি সফওয়ান ইবনে উমাইয়ার বাসগৃহ ক্রয় করে কয়েদীদের জন্য জেলখানা নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু আলোচ্য আয়াতে হারামের যে যে অংশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো সর্বাবস্থায় সাধারণ ওয়াকফ। এগুলোতে প্রবেশে বাধা দেয়া হারাম। আলোচ্য আয়াত থেকে এই অবৈধতা প্রমাণিত হয়। [দেখুন, কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর]
(৪) অভিধানে إلحاد এর অর্থ সরল পথ থেকে সরে যাওয়া, ঝুঁকে পড়া। অর্থাৎ কোন বড় মারাত্মক গোনাহ করার ইচ্ছা পোষণ করাই ইলাহাদ। [ইবন কাসীর] তবে এখানে আল্লাহ তা’আলা যুলুমের সাথে ইলহাদের কথা বলেছেন। ইবন আব্বাস এর অর্থ করেছেন, ইচ্ছাকৃতভাবে এ অপরাধ করা। ইবন আব্বাস থেকে অপর বর্ণনায় এসেছে, হারাম শরীফে আল্লাহ যা হারাম করেছেন যেমন, হত্যা, খারাপ আচরণ, এসবের কোন কিছুকে হালাল মনে করা। ফলে যে যুলুম করেনি তার উপর যুলুম করা, যে হত্যা করেনি তাকে হত্যা করা। সুতরাং কেউ যদি এ ধরনের কোন আচরণ করে তবে আল্লাহ তার জন্য মর্মম্ভদ শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন। অপর কারও কারও মতে, এখানে যুলুম অর্থ শির্ক।
মুজাহিদ বলেন, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করা। মুজাহিদ থেকে অপর বর্ণনায় এসেছে যে, কোন খারাপ করাই যুলুম শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য। [ইবন কাসীর] মোটকথা: যাবতীয় খারাপ কাজই এর মধ্যে শামিল হবে। যদিও সকল অবস্থায় খারাপ কাজ করা পাপ কিন্তু হারাম শরীফে একাজ করা আরো অনেক বেশী মারাত্মক পাপ। মুফাসসিরগণ বিনা প্রয়োজনে কসম খাওয়া কিংবা চাকরীদেরকে গালি দেয়াকে পর্যন্ত হারাম শরীফের মধ্যে বৌদ্বীনী গণ্য করেছেন এবং একে এ আয়াতের ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এই আয়াতের তাফসীর এরূপও বর্ণিত আছে যে, হারাম শরীফ ছাড়া অন্যত্ৰ পাপ কাজের ইচ্ছা করলেই পাপ লেখা হয় না, যতক্ষণ না তা কার্যে পরিণত করা হয়। কিন্তু হারামে শুধু পাকাপোক্ত ইচ্ছা করলেই গোনাহ লেখা হয়। [ইবন কাসীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(২৫) যারা অবিশ্বাস করে এবং মানুষকে নিবৃত্ত করে[1] আল্লাহর পথ হতে ও ‘মাসজিদুল হারাম’ হতে; যাকে আমি করেছি স্থানীয় ও বহিরাগত সবারই জন্য সমান।[2] আর যে ওতে সীমালংঘন করে পাপকার্যের ইচ্ছা করে,[3] তাকে আমি আস্বাদন করাব মর্মন্তুদ শাস্তি।[4]
[1] নিবৃত্ত করে বলতে বাধা দেয়; এরা হল, মক্কার কাফেররা যারা সন ৬ হিজরীতে মুসলিমদেরকে মক্কায় গিয়ে উমরাহ করতে বাধা দিয়েছিল এবং মুসলিমদেরকে হুদাইবিয়া থেকে ফিরে যেতে বাধ্য করেছিল।
[2] এতে মতভেদ রয়েছে যে, ‘মাসজিদুল হারাম’ বলতে শুধু কা’বা-ঘরকে বুঝানো হয়েছে, নাকি পুরো হারাম এলাকাকে বুঝানো হয়েছে? কারণ কুরআনে কোথাও কোথাও পূর্ণ হারাম এলাকার জন্যও ‘মাসজিদুল হারাম’ শব্দ ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ খন্ডের নাম উল্লেখ করে সমগ্র বুঝানো হয়েছে। এবারে বিশেষভাবে মাসজিদুল হারামের কথা সম্পর্কে সকলেই একমত যে, সেখানে স্থানীয় বাসিন্দা, মুসাফির, স্বদেশী ও প্রবাসী সকলের অধিকার সমান। অর্থাৎ বিনা কোন পার্থক্যে দিবারাত্রির যে কোন সময় সেখানে সকলেই ইবাদত করতে পারে। সেখানে কারো জন্য কোন মুসলিমকে ইবাদত করতে বাধা দেওয়ার অনুমতি নেই। তবে যে সব উলামাগণ ‘মাসজিদুল হারাম’ বলতে পূর্ণ হারাম এলাকা বুঝেছেন, তাঁদের মধ্যে এক দলের মত হল, মক্কার পূর্ণ হারাম এলাকা সকল মুসলিমদের জন্য সমান; এর ঘর-বাড়ি ও জমি-জায়গার কেউ মালিক নয়। সেই জন্য এ সবের কেনা-বেচা ও ভাড়ায় দেওয়া তাঁদের নিকট অবৈধ। যে কোন ব্যক্তি যে কোন জায়গা থেকে হজ্জ বা উমরাহ করতে মক্কায় যাবে, তার অধিকার রয়েছে সে যেখানে ইচ্ছা সেখানে অবস্থান করতে পারে। মক্কার বাসিন্দাদের দায়িত্ব হল, তারা যেন কাউকেও নিজেদের বাড়িতে থাকতে বাধা না দেয়। দ্বিতীয় মত হল, ঘর-বাড়ী ও জায়গা বিশেষ মালিকের হতে পারে এবং মালিকানা হস্তান্তর তথা বেচা-কেনা ও ভাড়ায় দেওয়া বৈধ। তবে ঐ সমস্ত জায়গা, যার সম্পর্ক হজ্জের সঙ্গে; যেমন মিনা, মুযদালিফা ও আরাফার ময়দান --তা সাধারণী ওয়াকফ। এ সবের কারো মালিক হওয়া বৈধ নয়। এই মাসআলাটি পূর্ববর্তী ফুকহাদের নিকট বেশ বিতর্কিত। তবে অধুনা যুগের সমস্ত উলামাই বিশেষ মালিকানা ও স্বত্বাধিকারের কথা স্বীকার করেন। এখন এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী (রঃ)ও এটাকেই ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) তথা ফুকহাগণের পছন্দনীয় মত বলে উল্লেখ করেছেন। (দেখুনঃ মাআরিফুল কুরআন ৬/২৫৩)
[3] إلحاد এর অর্থঃ বাঁকা পথ বা টেরামি অবলম্বন করা। এখানে কুফর ও শিরক সহ সমস্ত পাপকেই বুঝানো হয়েছে। এমন কি কিছু উলামা কুরআনের শব্দ থেকে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, যদি কেউ হারামের মধ্যে পাপের ইচ্ছা পোষণ করে (কার্যে পরিণত না করলেও) সে এই সতর্কবাণীর আওতায় পড়বে। কেউ কেউ বলেন, পাপের শুধু ইচ্ছা করলেই তার পাকড়াও হবে না; যেমন অন্যান্য স্পষ্ট দলীল দ্বারা পরিষ্কার। তবে ইচ্ছা যদি কাজে পরিণত করার কাছাকাছি (সংকল্পে) পৌঁছে যায়, তাহলে সে অবশ্যই শাস্তিযোগ্য হবে।
[4] এ শাস্তি ঐ সমস্ত লোকেদের জন্য যারা উক্ত পাপকার্যে লিপ্ত হবে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান