পরিচ্ছেদঃ তৃতীয় অনুচ্ছেদ - রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর ওফাতের পর সাহাবীদের মক্কাহ্ হতে হিজরত করা সম্পর্কে
৫৯৬৬-[১১] ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর ইন্তিকালের সময় কাছাকাছি হয়, তখন তার ঘরে অনেক লোকে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় নবী (সা.) বললেন, আসো, আমি তোমাদের জন্য একটি (স্মরণ) লিপি লিখে দিয়ে যাই, যাতে তোমরা এরপর কখনো গোমরাহ না হও। তখন ’উমার (রাঃ) বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর ওপর এখন রোগ-যন্ত্রণা কঠিন হয়ে পড়েছে। আর তোমাদের কাছে কুরআন মাজীদ রয়েছে, অতএব আল্লাহর কিতাবই তোমাদের জন্য যথেষ্ট। এই নিয়ে গৃহে উপস্থিত লোকেদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিল এবং তারা বিতর্কে লিপ্ত হয়ে পড়লেন। তাদের মাঝে কেউ কেউ বললেন, কাগজ-কলম নিয়ে আসো, যেন রাসূলুল্লাহ (সা.) তোমাদের জন্য কিছু লিখে দেন। আবার কেউ সে কথাই বললেন, যা ’উমার (রাঃ) বলেছেন। অতঃপর যখন হৈ চৈ এবং মতবিরোধ চরমে পৌছল, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমরা আমার কাছ থেকে উঠে যাও। (অধস্তন বর্ণনাকারী) উবায়দুল্লাহ বলেন, ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) অত্যন্ত দুঃখ ও ক্ষোভের সাথে বলতেন, এটা একটি বিপদ, মারাত্মক বিপদ, যা লোকেদের মতবিরোধ ও শোরগোলের আকৃতিতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং তার ওয়াসিয়্যাত লিখে দেয়ার ইচ্ছার মধ্যে অন্তরাল হয়ে দাড়াল।
আর সুলায়মান ইবনু আবূ মুসলিম আহওয়াল-এর বর্ণনাতে আছে, ইবনু আব্বাস (রাঃ) বললেন, হায় বৃহস্পতিবার! কতই বেদনাদায়ক বৃহস্পতিবার। এ কথা বলে তিনি এমনভাবে কাঁদতে লাগলেন যে, তাঁর অশ্রুতে নিচের বালু-কঙ্কর পর্যন্ত ভিজে গেছে। (সুলায়মান বলেন,) আমি প্রশ্ন করলাম, হে ইবনু আব্বাস! বৃহস্পতিবার দিনের বিষয়টি কি? তিনি বললেন, এদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর রোগ-যন্ত্রণা খুব বেড়ে গিয়েছিল তখন তিনি বলেছিলেন, অস্থিখণ্ড (লেখার উপকরণ) নিয়ে আসো, আমি তোমাদের জন্য এমন লিখে দেব, যার পর তোমরা কখনো গোমরাহ হবে না। তখন লোকেরা তর্কে লিপ্ত হলো। অথচ নবীর সম্মুখে তর্ক করা সমীচীন ছিল না। এ সময় কেউ কেউ বললেন, তাঁর অবস্থা কেমন? তবে কি তিনি প্রলাপ করছেন? তাঁকে প্রশ্ন কর। কেউ কেউ তাঁকে বারবার প্রশ্ন করতে লাগল। সে সময় তিনি বললেন, আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে আমার অবস্থায় থাকতে দাও। আমি যে অবস্থায় আছি, আমাকে ঐ অবস্থায় থাকতে দাও। আমি যে অবস্থায় আছি, ঐ অবস্থায় থাকতে দাও। আমি যে অবস্থায় আছি, তা ঐ অবস্থা হতে অনেক ভালো, যেদিকে তোমরা আমাকে আহ্বান করছ। অতঃপর তিনি তাদেরকে তিনটি বিষয়ে নির্দেশ দিলেন। ১. মুশরিকদেরকে ’আরব উপদ্বীপ হতে বহিষ্কার করবে। ২. আমি যেভাবে প্রতিনিধিদলকে স্বসম্মানে পুরস্কৃত করতাম, (আমার পরে) সেভাবে তাদেরকে পুরস্কৃত করবে। আর ইবনু আব্বাস (রাঃ) তৃতীয়টি হতে নীরব থাকেন, অথবা তিনি বলেছেন, কিন্তু আমি (সুলায়মান) তা ভুলে গেছি। সুফইয়ান বলেন, এটা সুলায়মানের কথা। (বুখারী ও মুসলিম)
اَلْفصْلُ الثَّالِثُ (بَاب هِجْرَة أَصْحَابه صلى الله عَلَيْهِ وَسلم من مَكَّة ووفاته)
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: لَمَّا حُضِرَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَفِي الْبَيْتِ رِجَالٌ فِيهِمْ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «هَلُمُّوا أَكْتُبْ لَكُمْ كِتَابًا لَنْ تَضِلُّوا بَعْدَهُ» . فَقَالَ عُمَرَ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَدْ غَلَبَ عَلَيْهِ الْوَجَعُ وَعِنْدَكُمُ الْقُرْآنُ حَسْبُكُمْ كِتَابُ اللَّهِ فَاخْتَلَفَ أَهْلُ الْبَيْتِ وَاخْتَصَمُوا فَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ: قَرِّبُوا يَكْتُبْ لَكُمْ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم. وَمِنْهُم يَقُولُ مَا قَالَ عُمَرُ. فَلَمَّا أَكْثَرُوا اللَّغَطَ وَالِاخْتِلَافَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «قُومُوا عَنِّي» . قَالَ عُبَيْدُ اللَّهِ: فَكَانَ ابنُ عباسٍ يَقُول: إِن الرزيئة كل الرزيئة مَا حَالَ بَيْنَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَبَيَّنَ أَنْ يَكْتُبَ لَهُمْ ذَلِكَ الْكِتَابَ لِاخْتِلَافِهِمْ وَلَغَطِهِمْ وَفِي رِوَايَةِ سُلَيْمَانَ بْنِ أَبِي مُسْلِمٍ الْأَحْوَلِ قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: يَوْمُ الْخَمِيسِ وَمَا يَوْمُ الْخَمِيسِ؟ ثُمَّ بَكَى حَتَّى بَلَّ دَمْعُهُ الْحَصَى. قُلْتُ: يَا ابْنَ عَبَّاسٍ وَمَا يَوْمُ الْخَمِيسِ؟ قَالَ: اشْتَدَّ بِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَجَعُهُ فَقَالَ: «ائْتُونِي بِكَتِفٍ أَكْتُبْ لَكُمْ كِتَابًا لَا تَضِلُّوا بَعْدَهُ أَبَدًا» . فَتَنَازَعُوا وَلَا يَنْبَغِي عِنْدَ نَبِيٍّ تَنَازُعٌ. فَقَالُوا: مَا شَأْنُهُ أَهَجَرَ؟ اسْتَفْهِمُوهُ فَذَهَبُوا يَرُدُّونَ عَلَيْهِ. فَقَالَ: «دَعُونِي ذَرُونِي فَالَّذِي أَنَا فِيهِ خَيْرٌ مِمَّا تَدْعُونَنِي إِلَيْهِ» . فَأَمَرَهُمْ بِثَلَاثٍ: فَقَالَ: «أَخْرِجُوا الْمُشْرِكِينَ مِنْ جَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَأَجِيزُوا الْوَفْدَ بِنَحْوِ مَا كُنْتُ أُجِيزُهُمْ» . وَسَكَتَ عَنِ الثَّالِثَةِ أَوْ قَالَهَا فَنَسِيتُهَا قَالَ سُفْيَانُ: هَذَا مِنْ قَول سُلَيْمَان. مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (114) و مسلم (22 / 1637) الروایۃ الثانیۃ : البخاری (4431) و مسلم (20 / 1637)، (4232 و 4234) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: (هَلُمُّوا أَكْتُبْ لَكُمْ كِتَابًا لَنْ تَضِلُّوا بَعْدَهُ) “আসো তোমাদের জন্য আমি একটি পত্র লিখে দেই।” এ সময় ‘উমার (রাঃ) বললেন, তার ব্যথা বেশি হয়ে গেছে। আর তোমাদের কাছে তো কুরআন মাজীদ আছে। তোমাদের জন্য আল্লাহর কিতাবই যথেষ্ট জীবনে পথ চলার জন্য। (এ অবস্থায় তোমরা আর নবী (সা.) -কে বিরক্ত করো না)। অতএব এ বিষয়টি নিয়ে আহলে বায়তদের মাঝেই দ্বন্দ ও কথা কাটাকাটি শুরু হলে কেউ কেউ বলেন, তোমরা একটা খাতা তার নিকট নিয়ে যাও তিনি তোমাদের জন্য লিখে দিবেন। আর তাদের কেউ ‘উমার (রাঃ)-এর মতো কথা বলল। যখন এরূপ কথা কাটাকাটি ও দ্বন্দ্ব বেশি হয়ে গেল তখন নবী (সা.) বললেন, তোমরা আমার কাছ থেকে চলে যাও।
শারহে মুসলিমের মধ্যে ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, জেনে রাখ যে, নবী (সা.) মিথ্যা থেকে পবিত্র। তিনি আরো পবিত্র তার সুস্থতার সময় বা তার অসুস্থতার সময়ে তার দ্বারা শারী'আতের কোন বিষয় পরিবর্তন হওয়া থেকে। আর আল্লাহ তাকে যা প্রচারের কথা বলেছেন তা প্রচার করার ক্ষেত্রে কোন বিষয় ছেড়ে দেয়া থেকেও তিনি পবিত্র। তার সুস্থ অবস্থায় হোক বা তার অসুস্থ অবস্থায় হোক তার মর্যাদা হানিকর, কোন কাজ হওয়া থেকেও তিনি মা'সূম বা পবিত্র। তিনি তার শারী'আতে যা গুরুত্বারোপ করেছেন তাতে কোন দ্বন্দ্ব নেই।
একবার নবী (সা.) -কে যাদু করা হয়েছিল আর তখন তিনি কোন কাজ না করেই করেছি বলে মনে করতেন। তবে এ অবস্থায়ও তার থেকে শারী'আতের মধ্যে কোন ভুল সিদ্ধান্ত আসেনি। অতএব তারা যে বিষয়ে ইখতিলাফ বা মতভেদ করল যা তিনি লিখে দিতে চাইলেন। এ বিষয়ে বলা হয়ে থাকে, তিনি খিলাফাতের জন্য একজনের নাম নির্দিষ্ট করে দিতে চেয়েছিলেন, যাতে এ বিষয়ে কোন দ্বন্দ্ব না হয়।
মিরকাতুল মাফাতীহ গ্রন্থকার বলেন, এ বিষয়টি দলীল থেকে যা প্রমাণিত তা হতে অনেক দূরে চলে গেল। অর্থাৎ ইমাম নবাবী (রহিমাহুল্লাহ)-এর ব্যাখ্যাটি দলীল সঙ্গত নয়। কারণ এ ব্যাপারে যোগ্য ছিলেন আবূ বাকর (রাঃ), ‘উমার (রাঃ), ‘আব্বাস (রাঃ) অথবা ‘আলী (রাঃ), আর এ বিষয়টি লেখার কোন দরকার ছিল না। এটা শুধু মুখে বললেই যথেষ্ট ছিল। বরং তিনি আবূ বাকর (রাঃ) -এর খিলাফাতের ব্যাপারে আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি খিলাফাতের বিষয়টি লিখতে চাননি। কারণ এটা করলে ইমাম মাহদী ও ঈসা আলায়হিস সালাম পর্যন্ত লেখার প্রয়োজন হত। আর তিনি খিলাফাতের বিষয়টি গোপন রাখতে চেয়েছিলেন। বরং তিনি সামনে আগত কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। যেখানে এমন কথা লেখা থাকত যা অনুসরণ করলে মুক্তিপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়া যেত। আর সেখানে লেখা থাকত ভ্রান্তদের পরিচয়। যেমন মু'তাযিলাহ, খারিজী ও রাফিযীসহ সকল বিদআতীদের নামের তালিকা। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
(قُومُوا عَنِّي) “তোমরা আমার নিকট থেকে চলে যাও।” অর্থাৎ তোমাদের কাছে যে কিতাব ও সুন্নাহ্ আছে তার উপর নির্ভর করে আমি আমার লেখার ইচ্ছাকে পরিহার করলাম।
ইমাম নবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, নবী (সা.) তাদেরকে কিছু লিখে দেয়ার ইচ্ছা করেছিল যখন তিনি তা কল্যাণকর মনে করেছিলেন অথবা তাকে ওয়াহী করা হয়েছিল। আর তিনি মনে করলেন তা না লিখে দেয়ার মাঝেই কল্যাণ আছে বা তাকে ওয়াহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাই তিনি তা লেখার সিদ্ধান্তকে প্রত্যাহার করে নেন। আর ‘উমার (রাঃ) এর কথা যে, তোমাদের কাছে আল্লাহর কিতাব আছে যা তোমাদের জন্য যথেষ্ট হবে। এ কথার উপর সকলেই একমত যে, এটি তার সূক্ষ্ম বুঝ ও মর্যাদা, তার বুঝ ও তার জ্ঞানের গভীরতার কারণে। কারণ তিনি ভয় করছিলেন যে, হয়তো নবী (সা.) এমন কিছু লিখে দিবেন যা পালন করতে অনেকেই অক্ষম হবেন। আর তাতে অক্ষম হওয়ার কারণে শাস্তি চলে আসবে, কারণ তাতে তো কোন ইজতিহাদের সুযোগ থাকবে না। আর তার কথা, তোমাদের জন্য আল্লাহর কিতাব যথেষ্ট। এ বিষয়ে মহান আল্লাহর বাণী- “আমি কিতাবে কোন কিছুই ছাড়িনি”। (সূরা আল আ'আম ৬: ৩৮)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, “আজ আমি তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি”- (সূরাহ্ আল মায়িদাহ ৫: ৩)। (মিরকাতুল মাফাতীহ)