পরিচ্ছেদঃ ১৮. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - শিশুর বালেগ হওয়া ও ছোট বেলায় তাদের প্রতিপালন প্রসঙ্গে
৩৩৮১-[৬] হিলাল ইবনু উসামাহ্ (রহঃ) মদীনার এক ক্রীতদাস আবূ মায়মূনাহ্ সুলায়মান (রহঃ) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, একদিন আমি আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)-এর নিকটে বসেছিলাম, এমতাবস্থায় একটি ছেলে (কোলে করে) এক অনারবীয় রমণী আসলেন, যাকে তার স্বামী তালাক দিয়েছে। কিন্তু উভয়ে ছেলেটির প্রতিপালনের দাবি করছে। রমণীটি ফারসীতে বলল, হে আবূ হুরায়রাহ্! আমার (তালাকদাতা) স্বামী আমার ছেলেকে নিয়ে যেতে চায়। আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) ফারসী ভাষাতেই তাদেরকে বললেন, তোমরা এ ব্যাপারে লটারী কর। তখন স্বামী এসে বলল, আমার ছেলের ব্যাপারে আমার সাথে কে টানাটানি করতে চায়? আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহ! আমি এ ফায়সালা এজন্যই দিয়েছি যে, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বসা ছিলাম।
এমন সময়ে তাঁর নিকটে এক স্ত্রীলোক এসে বলল, হে আল্লাহর রসূল! আমার স্বামী আমার এ ছেলেকে নিয়ে যেতে চায়। অথচ সে আমার যাবতীয় কাজকর্মের মাধ্যমে উপকার করে এবং নাসায়ীর বর্ণনায় আবূ ’ইনাবার কূপ হতে মিষ্টি পানি এনে আমাকে পান করায়। এটা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা উভয়ে লটারী কর। এতে তার স্বামী বলল, আমার ছেলের ব্যাপারে আমার সাথে কে টানাটানি করে? এ কথায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ তোমার পিতা, এ তোমার মা, তুমি যার কাছে ইচ্ছা যেতে পার। অতঃপর সে মায়ের হাত ধরে চলে গেল। (আবূ দাঊদ, নাসায়ী)[1]
মুসনাদ গ্রন্থকার এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন এবং দারিমী হিলাল ইবনু উসামাহ্ (রহঃ) হতে বর্ণনা করেছেন।
عَنْ هِلَالِ بْنِ أُسَامَةَ عَنْ أَبِي مَيْمُونَةَ سُلَيْمَانَ مَوْلًى لِأَهْلِ الْمَدِينَةِ قَالَ: بَيْنَمَا أَنَا جَالِسٌ مَعَ أَبِي هُرَيْرَةَ جَاءَتْهُ امْرَأَةٌ فَارِسِيَّةٌ مَعَهَا ابْنٌ لَهَا وَقَدْ طَلَّقَهَا زَوْجُهَا فَادَّعَيَاهُ فَرَطَنَتْ لَهُ تَقُولُ: يَا أَبَا هُرَيْرَةَ زَوْجِي يُرِيدُ أَنْ يَذْهَبَ بِابْنِي. فَقَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ: اسْتهمَا رَطَنَ لَهَا بِذَلِكَ. فَجَاءَ زَوْجُهَا وَقَالَ: مَنْ يُحَاقُّنِي فِي ابْنِي؟ فَقَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ: اللَّهُمَّ إِنِّي لَا أَقُولُ هَذَا إِلَّا أَنِّي كُنْتُ قَاعِدًا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَتَتْهُ امْرَأَةٌ فَقَالَتْ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ زَوْجِي يُرِيدُ أَنْ يَذْهَبَ بِابْنِي وَقَدْ نَفَعَنِي وَسَقَانِي مِنْ بِئْرِ أَبِي عِنَبَةَ وَعِنْدَ النَّسَائِيِّ: مِنْ عَذْبِ الْمَاءُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «اسْتَهِمَا عَلَيْهِ» . فَقَالَ زَوْجُهَا مَنْ يُحَاقُّنِي فِي وَلَدِي؟ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «هَذَا أَبُوكَ وَهَذِهِ أُمُّكَ فَخُذْ بِيَدِ أَيِّهِمَا شِئْتَ» فَأَخَذَ بيد أمه. رَوَاهُ أَبُو دَاوُد. وَالنَّسَائِيّ لكنه ذكر الْمسند. وَرَوَاهُ الدَّارمِيّ عَن هِلَال بن أُسَامَة
ব্যাখ্যা: (فَقَالَ أَبُوْ هُرَيْرَةَ : اِسْتَهِمَا) অর্থাৎ স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ে বাচ্চার দাবী করায় আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) লটারী করার নির্দেশ দিলেন। লটারীতে যার নাম আসবে সে ছেলেকে পাওয়ার অধিকারী হবে।
(مَنْ يُّحَاقُّنِىْ فِى ابْنِىْ) অর্থ : আমার ছেলেকে নিয়ে কে টানাটানি করে। অর্থাৎ বাচ্চাটির পিতার কাছে আবূ হুরায়রাহ্ -এর এই নির্দেশ পছন্দ হয়নি। কেননা তার খেয়াল মতে সেই ছেলেকে লালনের অধিকার রাখে। আর বর্ণিত পন্থা অবলম্বন করলে ছেলে মায়ের কাছে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই লোকটি আবূ হুরায়রাহ্ -এর এ ফায়সালার উপর আপত্তির সুরে এ কথা বলে। লোকটি আপত্তি তুললে আবূ হুরায়রাহ্ হুবহু এ ধরনের ফায়সালার একটি ঘটনা শুনান যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে ঘটেছিল। এ ধরনের বিষয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লটারীর ফায়সালা দেন। আবূ হুরায়রাহ্ -এর এই হাদীস শুনানোর উদ্দেশ্য হলো, তিনি যে ফায়সালা দিচ্ছেন তা তার নিজের পক্ষ থেকে নয়। বরং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এই একই ফায়সালা দিয়েছেন।
বাচ্চা লালনের ক্ষেত্রে লটারীর ভিত্তিতে অগ্রাধিকার : এই হাদীসে আমরা দেখছি যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে পিতা মাতার মাঝে লটারীর ফায়সালা করেন। কিন্তু সন্তানের পিতা এই ফায়সালায় এই বলে আপত্তি জানায় যে, (مَنْ يُّحَاقُّنِىْ فِىْ وَلَدِىْ) অর্থাৎ আমার সন্তানকে নিয়ে কে টানাটানি করে? লটারীর ফায়সালা না মানার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাচ্চাকে যে কোনো একজন গ্রহণের অবকাশ দেন। তাই অনেকে মনে করেন, প্রথমে লটারীর ফায়সালা হবে। লটারী না মানলে বাচ্চাকে বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে। যেহেতু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে লটারীর নির্দেশ দেন। কিন্তু একই ঘটনায় উপরের হাদীসে আমরা দেখেছি যে, লটারীর কথার উল্লেখ নেই। অর্থাৎ এই ঘটনার সকল বর্ণনায় বাচ্চার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়ার কথা থাকলেও লটারীর কথা সব বর্ণনায় নেই। তাই সকল বর্ণনার আলোকে বাচ্চার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়াই উত্তম মনে করেন অনেক ‘আলিম এবং এটাই খুলাফায়ে রাশিদীনের ‘আমল। কেউ কেউ উভয়ের যে কোনো একটি গ্রহণ করার অবকাশ দেন।
হাদীস থেকে আরেকটি মাস্আলাহ্ বের হয় যে, দু’টি বিষয় সমান হলে তার একটি নির্বাচনের জন্য লটারী একটি শারী‘আত পদ্ধতি। সন্তানের লালন পালনের অধিকারের হাদীসে আমরা দেখেছি যে, বাচ্চা লালনের ক্ষেত্রে পিতা-মাতা উভয়ে দাবী করলে বাচ্চা মোটামুটি বুঝদার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মায়ের অগ্রাধিকার দিয়েছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এর হিকমাত বা রহস্য হলো, এই বয়সে বাচ্চা মায়ের স্নেহ পাওয়ার অধিক উপযুক্ত। মায়ের মাঝে সেণহের যে পরিমাণ রয়েছে তা পিতার মাঝে নেই। তাই এই সময় পিতার কামনাকে অগ্রাহ্য করে মাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
বাচ্চা বুঝদার হওয়ার পর দুই ধরনের হুকুম পাওয়া যায়। এক : লটারী, দুই : বাচ্চার নিজের বাছাই। লটারীর ব্যাপার সম্পূর্ণ ভাগ্য নির্ভর এবং একই ঘটনার অনেক বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়নি। তাই এ ক্ষেত্রে বাচ্চা কার কাছে যাওয়া অধিক উপযুক্ত বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত বাচ্চার হাতে কোনো একজনকে গ্রহণ করে নেয়ার অধিকার দেয়া হলে এই সময় তার জন্য সঠিক উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করা সম্ভব নয়। বাচ্চা যার কাছে বেশি সোহাগ পেয়েছে তার কাছেই যাবে। কিন্তু এই সময় তার থাকার উপযুক্ত স্থান নির্বাচন না করতে পারার কারণে তার যে ক্ষতি হবে সে বুঝতে পারবে না। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই অধিকার কেন দিলেন। বর্ণিত হাদীস ছাড়া বাচ্চাকে অধিকার দেয়ার তথা পিতা মাতার কোনো একজনকে বেছে নেয়ার অধিকার সম্বলিত আরো হাদীস রয়েছে। যেখানে দেখা যায় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাচ্চাকে বেছে নিতে দিয়ে তার জন্য দু‘আ করে দিয়েছেন। এক ঘটনায় পিতা মুসলিম এবং মা অমুসলিম অবস্থায় বাচ্চা নিয়ে টানাটানি হলে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাচ্চাকে মা বাবার যার কাছে ভালো লাগে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে দু‘আ করেন, ‘‘হে আল্লাহ! তুমি তাকে পিতার দিকে পথপ্রদর্শন করো’’। তখন বাচ্চা পিতার দিকে যায়।
এসব হাদীসের আলোকে ইমাম আবূ হানীফাহ্ (রহঃ) মনে করেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাচ্চাকে অবকাশ দেয়ার হুকুম ভিন্ন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দু‘আর বারাকাতে ছেলে সঠিক স্থান বেছে নিতে পারে। কিন্তু অন্যের জন্য এই হুকুম নয়। ইমাম আবূ হানীফাহ্ (রহঃ) মত পোষণ করেন যে, শিশু অবস্থায় বাচ্চার ক্ষেত্রে মায়ের অধিকার; কেননা এই সময় সে সেণহের মুখাপেক্ষী এবং কাজকর্মে অন্যের মুখাপেক্ষী, তাই মা তার যে চাহিদা মিটাতে পারবে পিতা বা অন্য কেউ পারবে না। এর আলোকে শারী‘আত মাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। তারপর ছেলে যখন একটু বড় হবে এবং তার মাঝে ভালো-মন্দ পার্থক্যে বুঝ চলে আসবে, সে তার একান্ত ব্যক্তিগত কাজ যেমন প্রস্রাব-পায়খানা, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক পরিধান ইত্যাদি একাকি করতে পারবে তখন সে সেণহের মুখাপেক্ষী নয়, বরং শিক্ষা-দীক্ষার মুখাপেক্ষী। আর এই শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থাপনা মায়ের তুলনায় পিতা অধিক যোগ্য এবং পিতার দায়িত্ব। তাই এই সময় লালন পালনের অধিকার পিতার হবে। মোটকথা, হানাফী ‘আলিমদের মতে বাচ্চার মাঝে সবকিছুতে পরমুখাপেক্ষী থাকার মতো বয়সে লালনের অধিকার মায়ের। এই বয়স অতিক্রম করার পর লালনের অধিকার পিতার। বাচ্চাকে বেছে নেয়ার অধিকার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য বিশেষিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দু‘আর মাধ্যমে বাচ্চা সঠিক বেছে নিতে পারতো। [আল্লাহ অধিক জ্ঞাত] (‘আওনুল মা‘বূদ ৪র্থ খন্ড, হাঃ ২২৭৪; মিরকাতুল মাফাতীহ)