৩২০২

পরিচ্ছেদঃ ৭. প্রথম অনুচ্ছেদ - মোহর

صَدَاقٌ শব্দটি كِتَابٌ এবং سَحَابٌ এর ওযনে এসেছে, এর অর্থ ’মোহর’; ص বর্ণে যের যোগে পাঠ সবচেয়ে বেশী স্পষ্ট এবং বেশী ব্যবহৃত হয়। একে ’মোহর’ বা ’মুহরানা’ বলা হয় এজন্য যে, এর মাধ্যমে পুরুষের নারীর দিকে উদ্গত হওয়ার সত্যতা ও অধিকার প্রকাশ করা হয়।


৩২০২-[১] সাহল ইবনু সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জনৈকা রমণী এসে বলল, হে আল্লাহর রসূল! আমি নিজেকে আপনার নিকট (বিবাহের উদ্দেশে) অর্পণ করলাম- এ কথা বলে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। (কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীরব রইলেন) এমতাবস্থায় জনৈক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রসূল! আপনার যদি (বিয়ের) প্রয়োজন না থাকে, তবে তাকে আমার সাথে বিয়ে দিন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নিকট মোহর হিসেবে এমন কিছু আছে কি যা তুমি দিতে পার? সে বলল, আমার এ লুঙ্গি (জাতীয় পোশাক) ছাড়া আর কিছুই নেই।

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, লোহার একটি আংটি হলেও সন্ধান কর। কিন্তু সে কিছুই খুঁজে পেল না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি কুরআনের কিয়দংশ (মুখস্থ) আছে? সে বলল, হ্যাঁ, অমুক সূরা, অমুক সূরা আমার জানা আছে। এতে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমার যতটুকু কুরআন (মুখস্থ) আছে তার বিনিময়ে তোমাকে তার সাথে বিবাহ সম্পাদন করলাম।

অন্য বর্ণনায় আছে- ’’যাও, তোমার সাথে তাকে বিয়ে দিলাম, তুমি তাকে কুরআন শিখাও।’’ (বুখারী ও মুসলিম)[1]

بَابُ الصَّدَاقِ

عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَاءَتْهُ امْرَأَةٌ فَقَالَتْ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي وَهَبْتُ نَفْسِي لَكَ فَقَامَتْ طَوِيلًا فَقَامَ رَجُلٌ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ زَوِّجْنِيهَا إِنْ لَمْ تَكُنْ لَكَ فِيهَا حَاجَةٌ فَقَالَ: «هَلْ عِنْدَكَ مِنْ شَيْءٍ تُصْدِقُهَا؟» قَالَ: مَا عِنْدِي إِلَّا إِزَارِي هَذَا. قَالَ: «فَالْتَمِسْ وَلَوْ خَاتَمًا مِنْ حَدِيدٍ» فَالْتَمَسَ فَلَمْ يَجِدْ شَيْئًا فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «هَلْ مَعَكَ مِنَ الْقُرْآنِ شَيْءٌ» قَالَ: نَعَمْ سُورَةُ كَذَا وَسُورَةُ كَذَا فَقَالَ: «زَوَّجْتُكَهَا بِمَا مَعَكَ مِنَ الْقُرْآنِ» . وَفِي رِوَايَةٍ: قَالَ: «انْطَلِقْ فَقَدْ زَوَّجْتُكَهَا فَعَلِّمْهَا مِنَ الْقُرْآنِ»

عن سهل بن سعد: ان رسول الله صلى الله عليه وسلم جاءته امراة فقالت: يا رسول الله اني وهبت نفسي لك فقامت طويلا فقام رجل فقال: يا رسول الله زوجنيها ان لم تكن لك فيها حاجة فقال: «هل عندك من شيء تصدقها؟» قال: ما عندي الا ازاري هذا. قال: «فالتمس ولو خاتما من حديد» فالتمس فلم يجد شيىا فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «هل معك من القران شيء» قال: نعم سورة كذا وسورة كذا فقال: «زوجتكها بما معك من القران» . وفي رواية: قال: «انطلق فقد زوجتكها فعلمها من القران»

ব্যাখ্যা: হাদীসের বর্ণনাকারী সাহল ইবনু সা‘দ আস্ সা‘ইদী ছিলেন আনসারী। তার পূর্ব নাম ছিল ‘হুযন’ অর্থ বিষণ্ণ-চিন্তিত-দুঃখিত ইত্যাদি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এ নাম পরিবর্তন করে ‘সাহল’ ‘কোমল’ নাম রেখে দেন। তিনি ছিলেন মদীনায় মৃত্যুবরণকারী সর্বশেষ সাহাবী।

মহিলাটি যখন নিজেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বিবাহের জন্য পেশ করেন, দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো উত্তর দেননি; এর কারণ হলো মহিলাটির নির্লজ্জতা, অথবা এ ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ না পাওয়া। কিন্তু নির্লজ্জতা কথাটি যথার্থ নয় কারণ আল্লাহর বাণীতে বলা হয়েছে, ‘‘আর কোনো মু’মিনাহ্ মহিলা যদি নিজেকে নাবীর নিকট হেবা করে দেয় এবং নাবীও যদি তাকে বিয়ে করার ইচ্ছা পোষণ করেন .....’’- (সূরা আল আহযাব ৩৩ : ৫০)।

এতে বুঝা যায়, কোনো নারী নিজেকে বিয়ের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে পেশ করা নির্লজ্জ কাজ নয়। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় সাহিবুল মুদারিক বলেনঃ আল্লাহ যেন বলেছেন, ‘‘হে নাবী! কোনো মু’মিনাহ্ নারীর অন্তরে যদি আপনার বিবাহ বন্ধনে থাকার বাসনা সৃষ্টি হয় আর সে নিজেকে নাবীর কাছে হেবা হিসেবে পেশ করে এবং কোনো প্রকার মোহর দাবী না করে আর আপনিও যদি তাকে বিবাহ করতে ইচ্ছা করেন তাহলে বিনা মোহরে তাকে বিবাহ করতে পারবেন, এটা আপনার জন্যই কেবল খাস, অন্য কোনো মু’মিনের জন্য নয়।’’

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহর ঐ বাণীর হুকুম ভবিষ্যতের জন্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট হেবা হিসেবে দেয়া কোনো স্ত্রী ছিলেন না। কেউ কেউ বলেছন, যে সকল নারী নিজকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট হেবা হিসেবে পেশ করেছিলেন তারা হলেন, মায়মূনাহ্ বিনতু হারিস অথবা যায়নাব বিনতু খুযায়মাহ্, অথবা উম্মু শরীক বিনতু জাবির অথবা খাওলাহ্ বিনতু হাকিম।

মোহর প্রদান প্রত্যেক পুরুষের জন্য আবশ্যক। এমনকি মোহর যদি নির্ধারণ নাও করা হয় কিংবা কোনো পুরুষ এটাকে অস্বীকারও করে তবুও তার ওপর এটা আবশ্যক। ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, নাবীর নিকট কেউ নিজকে সমর্পণ করলে এবং নাবী তাকে বিয়ে করলে মোহর গুণতে হবে না, এমনকি দৈহিক মিলন হলেও নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপারে হেবা শব্দ দ্বারা বিবাহ সম্পাদিত হবে কিনা- এ নিয়ে ফুকাহাদের মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য পরিলক্ষেত হয়। কুরআন ও হাদীসের প্রকাশ্য অর্থের ভিত্তিতে বিশুদ্ধ মত হলো বিবাহ সম্পাদিত হবে। অনির্ভরযাগ্য অন্য একটি মত হলো ‘নিকাহ’ ও ‘বিবাহ’ শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ দ্বারা অর্থাৎ হেবা শব্দ দ্বারা অন্যের যেমন বিবাহ শুদ্ধ হবে না নাবীর বেলায়ও শুদ্ধ হবে না। ইমাম আবূ হানীফাহ্ (রহঃ) বলেন, যে সকল শব্দ (বিবাহের মাধ্যমে) মালিকানা দৃঢ়তা প্রকাশ করে তা দিয়েই বিবাহ সম্পাদিত হবে। ইমাম মালিক-এর দু’টি মতের একটি হলো হেবা, সাদাকা, বাই ইত্যাদি শব্দ দ্বারা যদি বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ কর হয় তবে বিবাহ শুদ্ধ হবে।

এ হাদীসে কোনো মহিলার নিজকে কোনো নেককার ব্যক্তির নিকট বিবাহের জন্য পেশ করা মুস্তাহাব প্রমাণিত। আরো প্রমাণিত যে, যার কাছে প্রস্তাব পেশ করা হবে তার যদি তা পালন বা গ্রহণ সম্ভব না হয় তাহলে সে পূর্ণ নিরবতা অবলম্বন করবে যাতে প্রশ্নকারী বা প্রস্তাবকারী বুঝে নিতে পারেন যে, তার প্রয়োজন নেই। তিনি তাকে না বলে অপমানিত করবেন না।

মহিলাটির প্রস্তাব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গ্রহণ না করলে পাশের দাঁড়ানো ব্যক্তি যখন নিজের সাথে বিয়ের আবেদন জানালেন তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে মোহর দেয়ার মতো তোমার কাছে কিছু আছে কি? লোকটি বললেন, এই লুঙ্গি ছাড়া আমার কাছে আর কিছুই নেই; এর দ্বারা বুঝা যায় তার চাদরও ছিল না এবং ভিন্ন আরেকটি লুঙ্গিও ছিল না।

হাদীস থেকে প্রমাণিত মহিলাদের মোহর না চাওয়াও জায়িয। বিবাহে মোহর নির্ধারণ করাই মুস্তাহাব, কেননা এতে ঝগড়া নিপাত যায়, আর মহিলারও হয় অধিক উপকার। এতে আরো প্রমাণিত যে, উভয়ের সম্মতির ভিত্তিতে মোহর অতি সামান্য হওয়াও বৈধ, কেননা একটা লোহার আংটি অতীব নগণ্য মূল্যের বস্তুই বটে। এটাই ইমাম শাফি‘ঈ এবং জুমহূর ‘উলামাদের মাযহাব। পক্ষান্তরে ইমাম মালিক (রহঃ) বলেন, মোহরের ন্যূনতম পরিমাণ হতে হবে এক-চতুর্থাংশ দীনার যেটা চুরির নিসাব অর্থাৎ ন্যূনতম এক-চতুর্থাংশ দীনার চুরি করলেই কেবল চোরের হাত কাটা যাবে অন্যথায় নয়। ইমাম আবূ হানীফাহ্ এবং তার অনুসারীরা বলেন, মোহরের ন্যূনতম পরিমাণ হতে হবে দশ দিরহাম। ইমাম শাফি‘ঈ এবং জুমহূরের মাযহাব বা মতটিই অধিক সহীহ, কেননা প্রামাণ্য হাদীসটি সহীহ এবং সরীহ অর্থাৎ সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন।

ইমাম আবূ হানীফাহ্ ও তার অনুসারীরা বলেন, দশ দিরহামের কম মোহর চলবে না। তাদের দলীল হলো বায়হাক্বী, দারাকুত্বনী ইত্যাদি বর্ণিত হাদীস : ‘‘..... দশ দিরহামের কমে কোনো মোহর হবে না।’’

কিন্তু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, এ হাদীস য‘ঈফ এবং তা সর্বসম্মতভাবেই য‘ঈফ, এমনকি কেউ কেউ এটাকে মাওযূ‘ বা জাল বলেও উল্লেখ করেছেন। সুতরাং মোহরের বিষয়টি স্বামীর সামর্থ্যের উপর এবং স্ত্রীর স্বীকৃতির ভিত্তিতেই সাব্যস্ত হয়, এর সুনির্দ্দিষ্ট কোনো পরিমাণ নেই।

ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, এ হাদীসের ভিত্তিতে লোহার আংটি পরিধান করা বৈধ এবং মোহর নগদ পরিশোধ করা মুস্তাহাব প্রমাণিত।

লোকটির কাছে কোনো কিছুই যখন নেই তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে কুরআনের কিছু মুখস্থ আছে কি? লোকটি বললেন হ্যাঁ, অমুক সূরা মুখস্থ আছে। ইমাম মালিক-এর বর্ণনায় ঐগুলোর নাম উল্লেখ রয়েছে। সুনানু আবী দাঊদে আবূ হুরায়রাহ্ প্রমুখাৎ বর্ণিত, সূরা আল বাকারা এবং তৎসংশ্লিষ্ট সূরার কথা উল্লেখ হয়েছে। এছাড়া দারাকুত্বনীতে মুফাসসাল সূরাসমূহের কথা এবং আবিশ্ শায়খে ইন্না আ‘ত্বয়নাকাল কাওসার-এর কথা এসেছে।

ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, কুরআন শিক্ষা দেয়া যে মোহর হতে পারে এবং কুরআন শিক্ষার বিনিময় নেয়া জায়িয- এ হাদীস তার দলীল। একদল অবশ্য এটা নিষেধ করেন, তাদের মধ্যে ইমাম আবূ হানীফাহ্ও রয়েছেন।

এ হাদীসে আরো প্রমাণিত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কুফু বা সমতাও ধর্তব্য বিষয় নয়।

(ফাতহুল বারী ৯ম খন্ড, হাঃ ৫১৩৫; শারহে মুসলিম ৯/১০ম খন্ড, হাঃ ১৪২৫; মিরকাতুল মাফাতীহ)


হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ সাহল বিন সা'দ (রাঃ)
পুনঃনিরীক্ষণঃ
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-১৩: বিবাহ (كتاب النكاح)