পরিচ্ছেদঃ ৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - আল্লাহ তা‘আলার রহমতের ব্যাপকতা
২৩৭৪-[১১] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা সৎ-অসৎ চিহ্নিত করে রেখেছেন। যে ব্যক্তি সৎ কাজের সংকল্প করে, কিন্তু তা করেনি আল্লাহ তা’আলা তার জন্য একটি পূর্ণ নেকী লিখে নেন। আর যদি সৎ কাজের সংকল্প করার পর তা বাস্তবায়ন করে, তাহলে আল্লাহ তা’আলা তাকে এই একটি সৎ কাজের জন্য দশ গুণ হতে সাতশ’ গুণ, বরং বহুগুণ পর্যন্ত সৎ কাজ হিসেবে লিখে রাখেন। আর যে ব্যক্তি অসৎ কাজের সংকল্প করে, কিন্তু বাস্তবে তা না করে, আল্লাহ তা’আলা তার জন্য একে একটি পূর্ণ নেক কাজ হিসেবে লিখে নেন। আর যদি অসৎ কাজের সংকল্প করার পর তা বাস্তবে করে, তাহলে আল্লাহ এর জন্য তার একটি মাত্র গুনাহ লিখে রাখেন। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ سَعْةِ رَحْمَةِ اللهِ
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللَّهَ كَتَبَ الحسناتِ والسيِّئاتِ: فَمَنْ هَمَّ بِحَسَنَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَهَا اللَّهُ لهُ عندَهُ حَسَنَة كَامِلَة فَإِن هم بعملها كَتَبَهَا اللَّهُ لَهُ عِنْدَهُ عَشْرَ حَسَنَاتٍ إِلَى سَبْعِمِائَةِ ضِعْفٍ إِلَى أَضْعَافٍ كَثِيرَةٍ وَمَنْ هَمَّ بسيئة فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَهَا اللَّهُ عِنْدَهُ حَسَنَةً كَامِلَةً فَإِن هُوَ هم بعملها كتبهَا الله لَهُ سَيِّئَة وَاحِدَة
ব্যাখ্যা: (وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ؓ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ) আহমাদ ১ম খণ্ডে ৩১০ পৃষ্ঠাতে ‘আবদুল্লাহ বিন ‘আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন। তিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। হাফেয বলেন, আমি এ হাদীসটি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ইবনু ‘আব্বাস-এর শ্রবণ সম্পর্কে স্পষ্টতা কোন সানাদে দেখিনি।
বুখারী, মুসলিম এবং মুসনাদে (فيما يروى عن ربه عزوجل) এভাবে এসেছে। অর্থাৎ- এটি হাদীসে কুদসীর আওতাভুক্ত। অতঃপর এটি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রব থেকে বিনা মধ্যস্থতায় বর্ণনা করেছেন বলে সম্ভাবনা রয়েছে এবং তা মালাকের (ফেরেশতার) মধ্যস্থতায় গ্রহণ করেছেন বলে সম্ভাবনা রয়েছে। হাফেয বলেন, এটিই প্রণিধানযোগ্য। কিরমানী বলেন, এটা মূলত ঐ কথা বর্ণনা করে দেয়ার জন্য যে, তা হাদীসে কুদসীসমূহের অন্তর্ভুক্ত।
অথবা যাতে আল্লাহ তা‘আলা পর্যন্ত স্পষ্ট সানাদ আছে তা বর্ণনা করে দেয়ার জন্য। যেমন তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ লিখে রেখেছেন এবং তা বর্ণনা করে দেয়ার জন্য হতে পারে বলে সম্ভাবনা আছে। তাতে এমন কিছু নেই যে, তিনি ছাড়া অন্য কেউ এমন নন। কেননা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহী ছাড়া কথা বলতেন না, তিনি যা বলতেন তা তাঁর কাছে ওহী মারফতই অবতীর্ণ হত।
(إِنَّ اللّٰهَ كَتَبَ الْحَسَنَاتِ وَالسَّيِّئاتِ) বুখারীতে আছে, যা তিনি তার পরাক্রমশালী ও মর্যাদাবান প্রভূ থেকে বর্ণনা করেন নিশ্চয়ই তিনি বলেন, তিনি বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ লিখে রেখেছেন... শেষ পর্যন্ত। হাফেয বলেন, (ان الله كتب الخ) এটি আল্লাহ তা‘আলার কথা হওয়ার সম্ভাবনা আছে তখন উহ্য বাক্য (রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ বলেছেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ লিখে রেখেছেন) এরূপ হবে এবং তা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উক্তি হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে যাতে তিনি আল্লাহর কাজ সম্পর্কে বর্ণনা করেন। তখন উহ্য বাক্য (ইবনু ‘আব্বাস বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ লিখে রেখেছেন)। আহমাদ ১ম খণ্ডে ২৭৯ পৃষ্ঠাতে
عن ابن عباس عن رسول الله صلى الله عليه وسلم فيما روى عن ربه قال : قال رسول الله ان ربكم تبارك وتعالى رحيم من هم بحسنة
অর্থাৎ- রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রব থেকে যা বর্ণনা করেন সে সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ইবনু ‘আব্বাস কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিশ্চয়ই তোমাদের প্রভু বারাকাতময়, সুউচ্চ যে পুণ্যের ইচ্ছা করেছে তার প্রতি দয়ালু) এ শব্দে এসেছে। বুখারীতে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে
عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : يقول الله عزوجل اذا اراد عبدى ان يعمل
অর্থাৎ- ‘‘রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত। নিশ্চয়ই তিনি বলেন, পরাক্রমশালী ও মর্যাদাবান আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা যখন ‘আমল করার ইচ্ছা করবে’’ এ শব্দে এসেছে। মুসলিম-এর এক বর্ণনাতে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পরাক্রমশালী ও মর্যাদাবান আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা যখন ইচ্ছা করবে।
(كتب الخ) অর্থাৎ- ঘটনা অনুপাতে তিনি পাপ ও পুণ্যকে ‘ইল্মে আযালীতে প্রমাণ করে রেখেছেন। অথবা كتب এর অর্থ হল আল্লাহ পাপ ও পুণ্য লাওহে মাহফূযে লিখে রাখার ব্যাপারে মালায়িকাহর (ফেরেশতাগণের) নির্দেশ করেছেন অথবা পুণ্যসমূহ লিখে রেখেছেন, অর্থাৎ- পুণ্যের ব্যাপারটি ফায়সালা করে রেখেছেন, পুণ্য হিসেবে নির্ধারণ করে রেখেছেন। এভাবে পাপের বিষয়টিও পাপ হিসেবে নির্ধারণ করে রেখেছেন। অথবা উভয়কে লিখার মাধ্যমে সংরক্ষণ করতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে পাপ, পুণ্যকে বা তাদের খাতাগুলোকে কিয়ামতের দিন ওযন করা যায়। আর বুখারী, মুসলিমে এবং মুসনাদে ১ম খণ্ডে ৩৬১ পৃষ্ঠাতে এরপরে (ثم بين ذلك) আছে। অর্থাৎ- অতঃপর আল্লাহ তাঁর (كتب الحسنات والسيئات) এ উক্তি যা সংক্ষিপ্তভাবে বলেছেন তা তাঁর (فمن هم) এ উক্তির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন।
(فَمَنْ هَمَّ) ত্বীবী বলেন, এখানে الفاء বর্ণটি বিশ্লেষণের জন্য, কেননা كتب الحسنات উক্তিটি অস্পষ্ট এ অংশ থেকে লিখনীর পদ্ধতি জানা যায়নি। আর الهم বলতে কাজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া। সুতরাং هممت بكذا অর্থাৎ- আমি হিম্মাতের সাথে ইচ্ছা করেছি আর তা অন্তরে হঠাৎ কোন কিছু জাগ্রত হয়ে চলে যাওয়ার উপর পর্যায়ের। আর মুসলিমে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস (من هم) এসেছে। বুখারীতে তাওহীদ পর্বে اذا اراد এসেছে। পক্ষান্তরে মুসলিমে اذا هم এসেছে। এ শব্দগুলো একই অর্থে ব্যবহৃত। অর্থাৎ- পুণ্য কাজের উপর তার ইচ্ছা দৃঢ় হল। এমন বর্ণনা এসেছে যা ঐ কথার উপর প্রমাণ বহন করে যে, সাধারণ ইচ্ছা যথেষ্ট নয়।
(كَتَبَهَا اللّٰهُ) অর্থাৎ- আল্লাহ তা নির্ধারণ করে ফায়সালা করে রেখেছেন অথবা বুখারীতে কিতাবুত্ তাওহীদে
(اذا اراد عبدى ان يعمل سيئة فلا تكتبوها عليه حتى يعملها)
অর্থাৎ- ‘‘আমার বান্দা যখন মন্দ কর্ম করার ইচ্ছা করবে তখন তার ওপর তোমরা ঐ পাপ কাজটি লিখবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তার ওপর সে ‘আমল না করে।’’
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) এর বর্ণিত হাদীস দ্বারা বুঝা যায় আল্লাহ হিফাযাতকারী মালায়িকাহকে (ফেরেশতাদেরকে) তা লিখার ব্যাপারে নির্দেশ করেছেন। মুসলিমও এরূপ বর্ণনা করেছেন। আর তাতে ঐ ব্যাপারে দলীল আছে যে, মানুষের হৃদয়ে যা আছে মালাক সে ব্যাপারে অবগত। হয়ত আল্লাহ তাকে জানিয়ে দেয়ার মাধ্যমে অথবা তার কোন চিহ্ন তৈরির মাধ্যমে যার মাধ্যমে তা বুঝা যেতে পারে। প্রথমটিকে সমর্থন করেছেন ইবনু আবিদ্ দুন্ইয়া আবূ ‘ইমরান আল জাওনী থেকে যা বর্ণনা করেছেন। তাতে আছে, তিনি বলেছেন, আল্লাহ মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা)’কে ডাক দিয়ে বলেন, তুমি অমুকের জন্য এরূপ এরূপ লিখ তখন মালাক বলেন, হে আমার পালনকর্তা! নিশ্চয়ই সে তা ‘আমল করেনি। তখন আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই সে তার নিয়্যাত করেছে। একমতে বলা হয়েছে, বরং মন্দ কর্মের ইচ্ছার সময় মালাক পঁচা গন্ধ পেয়ে থাকে, পক্ষান্তরে ভালো কর্মের ইচ্ছার সময় ভালো গন্ধ পেয়ে থাকেন। ত্ববারী এটিকে আবূ মা‘শার আল মাদানী থেকে সংকলন করেছেন।
(عِنَدَه) অর্থাৎ- আল্লাহর নিকট, এতে মর্যাদার দিকে ইঙ্গিত আছে।
(حَسَنَةً) আর এটা এ কারণে যে, ‘আমল নিয়্যাতের উপর নির্ভরশীল, আর মু’মিন ব্যক্তির নিয়্যাত তার ‘আমল অপেক্ষা উত্তম। নিয়্যাতের উপর নির্ভর করেই তার সাওয়াব দেয়া হয়, ‘আমলের কারণে নয়। আর নিয়্যাত ছাড়া ‘আমলের উপর সাওয়াব দেয়া হয় না। কিন্তু শুধু নিয়্যাতের কারণে পুণ্যের সাওয়াব বৃদ্ধি করা হয় না। এভাবে মিরকাতে এসেছে, ত্বওফী বলেনঃ কেবল ইচ্ছার কারণে পুণ্য লিখা হয়, কেননা পুণ্যের ইচ্ছা ‘আমলের কারণ। আর কল্যাণের ইচ্ছা করাও কল্যাণ, কেননা কল্যাণের ইচ্ছা করা অন্তরের ‘আমলের অন্তর্গত। জটিল হয়ে পড়েছে যে, অন্তরের ‘আমল যখন পুণ্য অর্জনের ব্যাপারে বিবেচনা করা হবে তখন কি করে পাপ অর্জনের ব্যাপারে চিন্তা করা হবে না? উত্তরঃ যে পাপের ব্যাপারে ইচ্ছা সৃষ্টি হয়েছে ঐ পাপ বর্জন করা অর্জিত পাপকে মিটিয়ে দিবে। কেননা এতে পাপের ক্ষেত্রে তা বিবেচনা রহিত হয়ে যায় এবং প্রবৃত্তির বিরোধিতা করা হয়।
(كَامِلَةً) অর্থাৎ- তাতে কোন কমতি নেই। যদিও তা কেবল ইচ্ছা থেকে সৃষ্টি হয়। সুতরাং হাদীসে পুণ্যের ঘাতটির প্রতি ধারণাকে দূর করে দেয়ার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে, কেননা ঐ পাপে ইচ্ছা কেবল ইচ্ছার মাধ্যমে সৃষ্ট এবং বহুগুণ সাওয়াব দেয়ার সম্ভাবনাকেও দূর করে দেয়ার দিকে ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা তা কাজের সাওয়াবের মতো না। যে কাজে বহুগুণ সাওয়াব দেয়ার কথা আছে যার সর্বনিম্ন পরিমাণ দশগুণ।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, তিনি তার عنده উক্তি দ্বারা তার উক্তির প্রতি অধিক মনোযোগের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন এবং كاملة উক্তি দ্বারা পুণ্যের মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন ও তার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। সুতরাং كمال দ্বারা মহা মর্যাদা উদ্দেশ্য দশগুণে গুণান্বিত করা উদ্দেশ্য নয়। যেমন তাদের কতকে ধারণা করেছে যে, كاملة ঐ কথার উপর প্রমাণ বহন করছে যে, পুণ্যের বদলা তার দশগুণ দেয়া হবে, কেননা এটিই হল পূর্ণাঙ্গ। এটি ঠিক নয়, কেননা এতে কল্যাণের ইচ্ছাকারী ও কর্তার মাঝে সমতা আবশ্যক হয়ে যাচ্ছে। অথচ বহুগুণ শুধু ‘আমলকারীর সাথে নির্দিষ্ট। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, অর্থাৎ- ‘‘যে ব্যক্তি পুণ্য কাজ করবে তাকে সে পুণ্য কাজের দশগুণ সাওয়াব দেয়া হবে।’’ (সূরা আল আন্‘আম ৬ : ১৬)
বহুগুণ সাওয়াবের জন্য শর্ত হল কাজটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে সম্পাদন হওয়া। পক্ষান্তরে নিয়্যাতকারীর ব্যাপারে কেবল পুণ্য লিপিবদ্ধের কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ হল, তার জন্য পুণ্য কর্মের সাওয়াবের মতো সাওয়াব লিখা। আর تضعيف বলতে বহুগুণ, অর্থাৎ- পুণ্যকর্মের মূল সাওয়াবের উপর অতিরিক্ত পরিমাণ।
হাফেয বলেন, হাদীসের বাহ্যিক দিক হল, শুধু পাপের ইচ্ছা বর্জনের কারণেই সাওয়াব অর্জন হয়। চাই পাপ বর্জনের ব্যাপারটি কোন প্রতিবন্ধকতার কারণে হোক বা প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই হোক। এ কথা বলারও দিক রয়েছে যে, প্রতিবন্ধক অনুপাতে পুণ্যের মর্যাদাও বিভিন্ন হয়ে থাকে। অতঃপর যে ব্যক্তি পুণ্য কাজের প্রতি ইচ্ছা করেছে তার ইচ্ছার অবশিষ্টতার সাথে সাথে তার প্রতিবন্ধকটি বাহ্যিক হয় তাহলে সে পুণ্য মহামর্যাদাকর। আর বিশেষ করে পুণ্য কাজের বিচ্যুতি ঘটার কারণে ব্যক্তির পুণ্যের সাথে যদি লজ্জা শামিল হয় এবং ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যদি নিয়্যাত স্থির হয়, আর কল্যাণকর কাজের বর্জন যদি ইচ্ছাকারীর তরফ থেকে হয় তাহলে তা মহামর্যাদার কিছুটা নিম্নের পর্যায়ের। তবে পুণ্যকর কাজের ক্ষেত্রে যদি পুণ্যকর কাজ থেকে সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে নেয়া উদ্দেশ্য হয় তাহলে আলাদা কথা। আর কল্যাণকর কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া বিশেষ করে ‘আমল যদি কল্যাণের বিপরীতে সংঘটিত হয় উদাহরণস্বরূপ কেউ একটি দিরহাম দান করার ইচ্ছা করল, অতঃপর স্বচক্ষে তা অবাধ্য কাজে ব্যয় করল শেষ মতানুযায়ী যা প্রকাশ পাচ্ছে তা হল মূলত তার জন্য কোন পুণ্য লেখা হবে না। পক্ষান্তরে এর পূর্বের মতানুযায়ী পুণ্য লিখার বিষয়টি সম্ভাবনার উপর নির্ভরশীল।
(عَشْرَ حَسَنَاتٍ) ‘‘দশটি সাওয়াব’’। আল্লাহ বলেনঃ ‘‘যে ব্যক্তি ভাল কাজ করবে তার জন্য সে ভাল কাজের দশগুণ সাওয়াব থাকবে’’- (সূরা আল আন্‘আম ৬ : ১৬০)। আল্লাহ পুণ্যের বহুগুণ সাওয়াবের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার মাঝে এটা সর্বনিম্ন সংখ্যা। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উক্তি অতঃপর ব্যক্তি পুণ্যের প্রতি ইচ্ছা করে যদি ‘আমল করে আল্লাহ তার জন্য দশগুণ নেকি লেখবেন। আল্লাহ মূলত পুণ্যকাজের ইচ্ছাকারীর সাওয়াবকে দশগুণে গুনান্বিত করবেন। সুতরাং সব মিলে এগারো সংখ্যায় পরিণত হবে। অতঃপর নিশ্চয়ই এ ব্যাখ্যাটি এ হাদীসের বাহ্যিকতার বিপরীত।
(إِلٰى أَضْعَافٍ كَثِيرَةٍ) অর্থাৎ- নিষ্ঠা, ইচ্ছার সততা, আন্তরিক উপস্থিতি, উপকার ছড়িয়ে পড়া, যেমন- সদাকায়ে জারিয়াহ্, উপকারী বিদ্যা, উত্তম সুন্নাত, উত্তম ‘আমল ইত্যাদি ক্ষেত্রে আধিক্যতা অনুপাতে।
(وَمَنْ هَمَّ بِسَيِّئَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا) ‘‘যে ব্যক্তি পাপ করার ইচ্ছা করল, অতঃপর তা বাস্তবে করল না।’’ অর্থাৎ- পাপের উপর ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর তদারকির কারণে ও তাঁর ভয়ে। যা বুখারীতে কিতাবুত্ তাওহীদে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) -এর হাদীসে এসেছে। আর বান্দা যদি তা আমার কারণে বর্জন করে তাহলে তার জন্য একটি পুণ্য লিখ। আর মুসলিমে আছে, আর সে যদি তা বর্জন করে থাকে তাহলে তার জন্য একটি পুণ্য লিখ সে কেবল তা আমার কারণেই ছেড়ে দিয়েছে।
হাফেয বলেন, অবাধ্যতার ইচ্ছায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালনের কারণে পাকড়াও করা হবে না যখন ইচ্ছাকৃত বিষয়ের প্রতি ‘আমল না করা হবে। এটা করা হবে ইচ্ছা ও মধ্যস্ততার মাঝে পার্থক্য সাধনের জন্য। কতকে অন্তরে পতিত হওয়া বিষয়কে কয়েক প্রকারে বিভক্ত করেছেন যা তার থেকে প্রকাশ পায়। অবাধ্যতার ইচ্ছাসমূহের মাঝে যা। হঠাৎ জাগ্রত হয়ে মুহূর্তের মাঝে চলে যায়। এটা কুমন্ত্রণা বা ওয়াস্ওয়াসার অন্তর্ভুক্ত। আর ক্ষমা করে দেয়া হবে। এটা সিদ্ধান্তহীনতার নিম্নের পর্যায়ে। আর তা এর উপরে হল কোন বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় থাকা, অতঃপর সে ব্যাপারে ইচ্ছা করা পুনরায় সে ইচ্ছা দূর হয়ে যাওয়াতে ঐ কাজ বর্জন করা। অতঃপর আবার ইচ্ছা করে আবার এভাবে বর্জন করা, তার ইচ্ছার উপর স্থির না হওয়া। এটিই হল, تردد বা সিদ্ধান্তহীনতা, এটিও ক্ষমা করে দেয়া হবে। এর উপর পর্যায় হল, ব্যক্তি অবাধ্যতার ইচ্ছার প্রতি ঝুঁকবে তা এড়িয়ে যাবে না তবে কাজের ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করবে না এটাই হল الهم (হাম্) এ ক্ষেত্রেও ক্ষমা করা হবে। এর উপর পর্যায় হল, ব্যক্তি মন্দের প্রতি ঝুঁকবে, তা এড়িয়ে চলবে না বরং সে মন্দ কাজের প্রতি দৃঢ় সংকল্প করবে এটাই হল العزم (‘আযম), এটাই হল الهم এর চূড়ান্ত পর্যায়। العزم আবার দু’ প্রকার প্রথম প্রকার হলঃ এটি কেবল অন্তরের ‘আমলসমূহের অন্তর্ভুক্ত। যেমন একত্ববাদ, নবূওয়্যাত ও পুনরুত্থানে সন্দেহ করা। এটি কুফর। এ কারণেই তাকে নিশ্চিতভাবে শাস্তি দেয়া হবে। এর নিম্নে হল ঐ অবাধ্যতা যা কুফর পর্যন্ত পৌঁছে না যেমন ঐ ব্যক্তি আল্লাহর বিদ্বেষ পোষণ করা জিনিসকে ভালবাসে, পক্ষান্তরে আল্লাহ যা ভালবাসেন তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, অন্যায়ভাবে মুসলিম ব্যক্তিকে কষ্ট দেয়া পছন্দ করে এ ব্যক্তি এর মাধ্যমে গুনাহ করবে। এর সাথে আরো শামিল হবে অহংকার, বড়াই, অবিচার, চক্রান্ত ও হিংসা।
দ্বিতীয় প্রকারঃ তা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ‘আমলসমূহের অন্তর্ভুক্ত। যেমন- যিনা, চুরি করা, আর এটি এমন যাতে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে। অতঃপর এক দল মত পেশ করেছেন এ কারণে মূলত পাকড়াও করা হবে না। এটি ইমাম শাফি‘ঈর ভাষ্য কর্তৃক বর্ণিত। খারীম বিন ফাতিক-এর হাদীসে যা এসেছে তা একে সমর্থন করছে। যেখানে তিনি পুণ্য কাজের প্রতি ইচ্ছার কথা উল্লেখ সেখানে তিনি (খারীম) বলেছেন, আল্লাহ জানেন তিনি বান্দার অন্তরের পুণ্যের ব্যাপারে অবহিত করেছেন ও সে ব্যাপারে তাকে লালায়িত করেছেন, পক্ষান্তরে যেখানে পাপ কাজের প্রতি ইচ্ছার কথা বর্ণনা করেছেন সেখানে ইচ্ছাকে কোন শর্তের সাথে জোড়ে দেননি। বরং সেখানে বলেছেন, যে ব্যক্তি পাপ কাজের প্রতি ইচ্ছা করবে তার উপর কিছুই লিখা হবে না। স্থানটি কৃপা প্রদর্শনের স্থান, সুতরাং এ ক্ষেত্রে সংকীর্ণতা প্রদর্শন মানানসই নয়। পাপ কাজের প্রতি দৃঢ় সংকল্পের কারণে ব্যক্তিকে শাস্তির মুখোমুখী করা হবে অনেক বিদ্বানগণ এ মত পোষণ করেছেন।
ইবনুল মুবারক সুফ্ইয়ান সাওরীকে প্রশ্ন করল বান্দা যে পাপ কাজের প্রতি ইচ্ছা করে সে কারণে কি তাকে পাকড়াও করা হবে? উত্তরে তিনি বলেন, যখন বান্দা সে ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করবে। আর তাদের অনেকে আল্লাহর [অর্থাৎ- ‘‘তবে তোমাদের অন্তর যা অর্জন করেছে সে কারণে তোমাদেরকে পাকড়াও করা হবে’’- (সূরা আল বাকারাহ্ ২ : ২২৫)] এ বাণী দ্বারা দলীল গ্রহণ করেছে আর তারা আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) এর
(ان الله تجاوز لأمتى عما حدثت به انفسها مالم تعمل به او تتكلم) অর্থাৎ- ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মাতের অন্তরে যা সৃষ্টি হয় তা থেকে তিনি পাশ কেটে চলেন যতক্ষণ পর্যন্ত সে ঐ ব্যাপারে ‘আমল না করে অথবা কথা না বলে।’’ এ সহীহ মারফূ‘ হাদীসটিকে কুমন্ত্রণাসমূহের উপর চাপিয়ে দিয়েছে।
(كَتَبَهَا اللهُ لَه سَيِّئَةً وَاحِدَةً) ‘‘আল্লাহ একটি পাপ লিখবেন’’। এটি বুখারীর বর্ণনা, মুসলিম আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) এর হাদীসে আছে (فاكتبوها له بمثلها) অর্থাৎ- তোমরা তার জন্য তার অনুরূপ পাপ লিখ। আর মুসলিমে আবূ যার-এর হাদীসে আছে (فجزاءه بمثلها او اغفرله) অর্থাৎ- তার বদলা তার অনুরূপ অথবা তাকে আমি ক্ষমা করে দিব।
মুসলিমে ইবনু ‘আব্বাস-এর হাদীসের শেষে (او محاها الله) অথবা গুনাহ মুছতে পারে এমন পুণ্য ‘আমল দ্বারা তার গুনাহ মুছে দিবেন।