পরিচ্ছেদঃ ১. প্রথম অনুচ্ছেদ - নতুন চাঁদ দেখার বর্ণনা
আযহারী বলেনঃ চন্দ্র মাসের প্রথম দু’ দিনের চাঁদকে হিলাল বলে। অনুরূপভাবে ২৬ ও ২৭ তারিখের চাঁদকেও হিলাল বলা হয়।
জাওহারী বলেনঃ মাসের প্রথম তিন রাতের চাঁদকে হিলাল বলা হয়, এর পরের বাকী দিনগুলোর চাঁদকে কমার বলা হয়।
১৯৬৯-[১] ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা চাঁদ না দেখা পর্যন্ত সওম (রোযা) পালন করবে না এবং তা না দেখা পর্যন্ত সওম শেষ (ভঙ্গ) করবে না। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় তোমরা যদি চাঁদ না দেখতে পাও তাহলে (শা’বান) মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ করো (অর্থাৎ- এ মাসকে ত্রিশ দিন হিসেবে গণ্য করো)।
অপর বর্ণনায় আছেঃ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ মাস ঊনত্রিশ রাতেও হয়। তাই চাঁদ না দেখা পর্যন্ত সওম পালন করবে না। যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে মাসের ত্রিশ দিন পূর্ণ করো। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ رُؤْيَةِ الْهِلَالِ
عَنْ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا تَصُومُوا حَتَّى تَرَوُا الْهِلَالَ وَلَا تُفْطِرُوا حَتَّى تَرَوْهُ فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَاقْدِرُوا لَهُ» . وَفِي رِوَايَةٍ قَالَ: «الشَّهْرُ تِسْعٌ وَعِشْرُونَ لَيْلَةً فَلَا تَصُومُوا حَتَّى تَرَوْهُ فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوا الْعِدَّةَ ثَلَاثِينَ»
ব্যাখ্যা: (لَا تَصُوْمُوْا) ‘‘তোমরা সওম পালন করবে না’’ অর্থাৎ- শা‘বান মাসের ঊনত্রিশ তারিখ শেষে ত্রিশ তারিখের রাতে রমাযানের চাঁদ দেখা না গেলে রমাযানের সওম পালন শুরু করবে না।
(حَتّٰى تَرَوُا الْهِلَالَ) ‘‘রমাযানের চাঁদ দেখার আগেই’’ অর্থাৎ- শা‘বান মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ হওয়ার আগেই রমাযানের চাঁদ না দেখে রমাযানের সিয়াম পালন করবে না। তবে শা‘বান মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর রমাযানের চাঁদ দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। হাদীসের প্রকাশমান অর্থ এই যে, সিয়াম পালন করার জন্য প্রত্যেকেরই চাঁদ দেখা শর্ত। কিন্তু এক্ষেত্রে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, এটা ওয়াজিব নয়। বরং কতক লোকের চাঁদ দেখাই যথেষ্ট। অতএব হাদীসের অর্থ এই যে, তোমাদের নিকট চাঁদ দেখা সাব্যস্ত হলে তোমরা সিয়াম পালন শুরু করবে।
হাদীস থেকে এটাও বুঝা যায় যে, চাঁদ দেখা সাব্যস্ত হওয়ার সময় থেকেই সিয়াম শুরু করতে হবে। কিন্তু ‘আমলে তা উদ্দেশ্য নয়। বরং চাঁদ দেখা সাব্যস্ত হওয়ার পর সিয়াম শুরুর সময় অর্থাৎ- ফজরের সময় থেকে সিয়াম পালন শুরু হবে।
এ হাদীস দ্বারা প্রমাণ উপস্থাপন করা হয় যে, পৃথিবীর কোন এক অঞ্চলে চাঁদ দেখা গেলে সকল অঞ্চলের লোকের ওপর সিয়াম পালন করা আবশ্যক। কেননা সিয়াম পালনের জন্য সকলের চাঁদ দেখা শর্ত নয়। অতএব কোন এক অঞ্চলে চাঁদ দেখা সাব্যস্ত হলেই সকল মুসলিমের ওপর সিয়াম পালন আবশ্যক সে যে অঞ্চলেরই হোক না কেন।
এ বিষয়ে ‘উলামাগণের মতভেদ রয়েছে।
১. প্রত্যেক অঞ্চলের লোকদের জন্য পৃথকভাবে চাঁদ দেখা জরুরী। সহীহ মুসলিমে কুরায়ব সূত্রে ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীস, এ অভিমতের সাক্ষ্য বহন করে। ‘ইকরিমাহ্, কাসিম, সালিম, ইসহাক এবং শাফি‘ঈদের একটি অভিমত এ রকম।
২. কোন এক অঞ্চলে চাঁদ দেখা সাব্যস্ত হলেই সব অঞ্চলের লোকের ওপর সিয়াম পালন করা আবশ্যক। মালিকী মাযহাবের প্রসিদ্ধ মত এটিই। ইমাম কুরতুবী বলেনঃ আমাদের শায়খগণ বলেন যে, কোন জায়গায় যদি অকাট্যভাবে চাঁদ দেখা সাব্যস্ত হয়, অতঃপর এ সংবাদ দু’জন সাক্ষীর মাধ্যমে অন্যত্র পৌঁছে যায় যেখানে চাঁদ দেখা যায়নি তাদের বেলায়ও সিয়াম পালন আবশ্যক।
ইবনু মাজিশূন বলেন, যে অঞ্চলের লোকেরা চাঁদ দেখেছে তাদের জন্য তো সিয়াম আবশ্যক, কিন্তু যারা চাঁদ দেখতে পারেনি তাদের অঞ্চলে সাক্ষীর মাধ্যমে চাঁদ দেখার সংবাদ পৌঁছলেও তাদের জন্য সিয়াম পালন আবশ্যক নয়। তবে যদি ইমামে আ‘যম তথা খলীফার নিকট চাঁদ দেখা সাব্যস্ত হয় তাহলে সকলের জন্যই সিয়াম পালন আবশ্যক। কেননা খলীফার ক্ষেত্রে সকল দেশই একটি বলে গণ্য যেহেতু তাঁর নির্দেশ সকলের জন্যই প্রযোজ্য।
৩. কিছু শাফি‘ঈদের মতে যদি দেশসমূহ পরস্পর নিকটবর্তী হয়, তাহলে এক দেশের চাঁদ দেখা পার্শ্ববর্তী দেশের জন্য প্রযোজ্য হবে আর দূরবর্তী দেশের জন্য তা প্রযোজ্য নয়।
৪. মুহাক্কিক হানাফী, মালিকী ও অধিকাংশ শাফি‘ঈদের অভিমতে যদি দুই দেশের দূরত্ব এত নিকটবর্তী হয় যে, যাতে উদয়স্থলের কোন ভিন্নতা না থাকে যেমন বাগদাদ ও বাসরা- তাহলে এমন দুই দেশের মধ্যে একদেশে চাঁদ দেখা গেলে তা অন্য দেশের জন্যও প্রযোজ্য হবে। আর যদি দুই দেশের মধ্যে এত দূরত্ব হয় যাতে উদয়স্থলের ভিন্নতা থাকে তাহলে একদেশে চাঁদ দেখা গেলে অন্য দেশের জন্য তা প্রযোজ্য নয়; যেমন- ইরাক ও হিজায। এক্ষেত্রে তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ দেশের জন্য চাঁদ দেখা যাওয়া আবশ্যক। আর উদয়স্থলের ভিন্নতার জন্য কমপক্ষে এক মাসের দূরত্ব হওয়া প্রয়োজন। ইমাম যায়লা‘ঈ কানয-এর ভাষ্য গ্রন্থে বলেন, অধিকাংশ শায়খদের নিকট উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়। তবে তা ধর্তব্যে আনা অধিক যুক্তিযুক্ত। কেননা চাঁদ থেকে সূর্যের আলো পৃথক হওয়া দেশের ভিন্নতার কারণেই ভিন্ন হয়ে থাকে। মুসলিমে বর্ণিত কুরায়ব বর্ণিত হাদীস এর পক্ষে দলীল।
আমি (মুবারকপূরী) বলছিঃ সওম শুরু ও শেষ করার ক্ষেত্রে উদয়স্থলের ভিন্নতাকে গ্রহণ না করে কোন উপায় নেই। কেননা প্রতিদিনের সিয়াম ও সালাতের ক্ষেত্রে তা সকলের ঐকমত্যে তা প্রযোজ্য। প্রতিদিনের ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য, মাস শুরু ও শেষ হওয়ার ক্ষেত্রেও তা আবশ্যিকভাবেই প্রযোজ্য। এ থেকে পালাবার কোন জায়গা বা উপায় নেই।
পশ্চিমের কোন দেশের চাঁদ দেখা গেলে পূর্বদেশের কত দূরত্বের জন্য তা প্রযোজ্য এ নিয়ে ‘আলিমদের মাঝে মতভেদ রয়েছে।
১. অধিকাংশ ফুকাহাদের মতে একমাসের দূরত্বের পূর্ব দেশের জন্য তা প্রযোজ্য। যেমনটি পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে।
২. পাঁচশত ষাট মাইল পূর্ব পর্যন্ত তা প্রযোজ্য, কেননা আকাশে চাঁদ দেখা যাওয়ার পর তা যদি বত্রিশ মিনিট স্থায়ী হয়, অর্থাৎ- চাঁদ উদয় হওয়ার বত্রিশ মিনিট পরে যদি তা অস্ত যায় তাহলে চাঁদ দিগন্তে এতটুকু উপরে থাকে যে, তা পাঁচশত ষাট মাইল পূর্বে অবস্থিত এলাকা দেখে তা দেখা যাবে যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন না থাকে। অতএব এটা সাব্যস্ত হল যে, পশ্চিমের কোন দেশে চাঁদ দেখা গেলে তা পাঁচশত ষাট মাইল পূর্বে অবস্থিত দেশের জন্য তা প্রযোজ্য হবে। আর পূর্বে অবস্থিত কোন দেশে চাঁদ দেখা গেলে পশ্চিমে অবস্থিত সকলের জন্য তা প্রযোজ্য হবে।
(وَلَا تُفْطِرُوْا حَتّٰى تَرَوْهُ) আর তা না দেখে সিয়াম ভঙ্গ করো না, অর্থাৎ- শাওয়ালের চাঁদ না দেখে রমাযানের সিয়াম পালন করা পরিত্যাগ করবে না।
(فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ) চাঁদ যদি ঢাকা পরে যায় অর্থাৎ আকাশে মেঘ থাকার কারণে যদি ত্রিশ তারিখের রাতে শাওয়ালের চাঁদ দেখা না যায়। (فَاقْدِرُوْا لَه) তাহলে তা নির্ধারণ করে নাও। অর্থাৎ তাহলে রমাযান (রমজান) মাস ত্রিশ দিন নির্ধারণ কর। অতঃপর চাঁদ দেখা যাক অথবা দেখা না যাক সিয়াম পালন পরিত্যাগ কর।
কেননা চন্দ্রমাস ত্রিশ দিনের বেশী হয় না।