সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) (হাদিস একাডেমি)
আমাদের কথা

সকল প্রশংসা একমাত্র মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এবং লক্ষ কোটি দুরূদ পাঠ করছি মানবতার মুক্তির দূত, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রসূল এবং সকলের অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় একমাত্র আদর্শ নেতা মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি।
মুসলিম জাহানের সকল প্রকার দিক-নির্দেশনা লাভের প্রধান উৎস দুনিয়ার বুকে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের পর সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমের স্থান। এ গ্রন্থসমূহ পরিপূর্ণ সহীহ ও নির্ভুল। আর হাদীস গ্রন্থসমূহের মধ্যে কোন বিষয়ে হাদীস সন্ধানে সহজলভ্য এ সহীহ মুসলিমের গুরুত্ব অপরিসীম।

আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অশেষ মেহেরবানীতে আহলে হাদীস লাইব্রেরী ঢাকা কর্তৃক ‘সহীহ মুসলিম সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদের পূর্বেই দ্বিতীয় খণ্ডের সংস্করণের পর এবার প্রথম খণ্ডের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হলো। ইনশা-আল্লাহ, ষষ্ঠ খণ্ডটিও অতি শীঘ্রই প্রকাশের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করবে। বিশ্ববিখ্যাত মুহাক্কিক ‘আলিম মুহাম্মাদ ফু'আদ আবদুল বাকী-এর শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী সাজানো মুদ্রণে বাংলার বুকে এটাই প্রথম।
সহীহ মুসলিম-এর বাংলা অনুবাদ সহজ ও প্রাঞ্জল এবং সাধারণ পাঠকদের উপযোগী করার লক্ষ্যে আমাদের প্রকাশিত এ গ্রন্থে মূল হাদীস পূর্ণ সনদ সহকারে মুদ্রিত হয়েছে। আর বাংলা অনুবাদে শুধু মূল রাবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মূল ইবারত পাঠ সহজ হওয়ার লক্ষ্যে হরকত সন্নিবেশ করা হয়েছে। গ্রন্থখানায় বিশুদ্ধ অনুবাদ ও যথার্থ টীকা সন্নিবিষ্ট করণে ইমাম নববী (রহঃ)-এর সর্বশেষ তা'লীক থেকে নেয়া হয়েছে।
গ্রন্থটিতে প্রধানতঃ বিশ্ববিখ্যাত ‘আলিম মুহাম্মাদ ফু'আদ আবদুল বাকী সম্পাদিত মিসরের বৈরুত সংস্করণ “দার ইবনু হাযম” এবং “দারুল হাদীস” প্রকাশনীর অনুসরণ করা হয়েছে। “মাকতাবাতুল শামিলাহ” থেকেও সহযোগিতা নেয়া হয়েছে। অনুবাদে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। বাংলায় ব্যবহৃত ‘আরবী শব্দগুলো সঠিক ‘আরবী উচ্চারণের সাথে মিল রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছে।
হাদীস বর্ণনা ক্ষেত্রে একাধিক রাবীর নাম একত্রে আসলে সর্বশেষ নামের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্মানসূচক পাঠ সংকেত উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- আবু হুরাইরাহ্, আবূ বাকর (রাযিঃ)।

কুরআন মাজীদের আয়াতের ক্ষেত্রে প্রথমে সূরার নাম, তারপর সূরার নম্বর, শেষে আয়াত নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- (সূরাহ্ আল বাকারাহ্ ২: ২৮৬)।

পূর্বের খণ্ডটিতে বাজারে প্রকাশিত প্রচলিত ধারা অনুসারে ক্রমিক নম্বর সংযুক্ত ছিল না। অর্থাৎ প্রকাশিত খণ্ডগুলোতে প্রথম নম্বরটি কুতুবুত তিস’আর তারীখুল আলামী-কে অনুসরণ করা হয়েছিল। কিন্তু পাঠক মহলের নিকট উল্লেখিত নম্বরটি বুঝার দুর্বোধ্যতা এবং কুতুবুত তিস’আর তারীখুল আলামী-এর কিতাব সহজলভ্য নয় বিধায় নতুন করে সাধারণ ক্রমিক নম্বর দেয়া হয়েছে।
যেমন অত্র গ্রন্থের প্রথম হাদীসের নম্বর এসেছে ১-(১/৮)। ড্যাস-এর পূর্বে প্রথম নম্বরটি নতুন ক্রমিক নম্বর দেয়া হয়েছে। আর ড্যাস-এর পরে প্রথম বন্ধনীর প্রথম নম্বরটি পর্বের হাদীসের ক্রমধারা অনুযায়ী এবং দ্বিতীয় বা সর্বশেষ যে নম্বরটি রয়েছে সেটি হচ্ছে ফু’আদ ‘আবদুল বাকী সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হাদীসগুলোকে বিষয়ভিত্তিকভাবে সাজানো নিয়মে।
বিশ্ববিখ্যাত মুহাক্কিক ফু'আদ আবদুল বাকী' কোন হাদীসের নম্বরে (পর্বের ক্রমিক নম্বর/হাদীস নম্বর) (পর্বের ক্রমিক নম্বর/...) (.../হাদীস নম্বর) (.../...) দিয়ে শ্রেণীবিন্যাস করে হাদীস সাজিয়েছেন। যে সকল হাদীসের সনদে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মতন একই রকম সে হাদীসগুলোকে ফু'আদ আবদুল বাকী' একই নম্বরের অধীনে এনেছেন। একই হাদীস যখন একাধিক জায়গায় বর্ণিত হয়েছে সেখানে নম্বর ঠিক থাকার কারণে কোথাও বা হঠাৎ ক্রমধারার তারতম্য দেখা দিয়েছে। তাই ফু’আদ আবদুল বাকী'-এর প্রত্যেকটি শ্রেণীবিন্যাসের নম্বরগুলোকে ঠিক রেখে প্রথমে একটি করে নতুন সাধারণ ক্রমিক নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। যার ফলে পাঠক মহল সহজেই বুঝতে পারবে মোট কতটি হাদীস আছে এবং সকল পর্বে বর্ণিত হাদীসের ক্রমধারা অনুযায়ী মোট হাদীসের সংখ্যাও সহজেই জানা যাবে। এছাড়াও প্রতিটি হাদীসের বাংলা অনুবাদের শেষে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার-এর নম্বরও সংযোজিত হয়েছে। আশা করি ইনশা-আল্লাহ সর্বসাধারণের জন্য এটিও খুব কল্যাণকর হবে।

মানবীয় প্রচেষ্টায় ত্রুটি থাকাই স্বাভাবিক। তাই সুহৃদ পাঠকগণ! বিশেষত হাদীস চর্চায় নিয়োজিত ‘আলিমগণ ত্রুটি নির্দেশ করলে সংশোধনের প্রতিশ্রুতি রইল ।
পরিশেষে এ কাজটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যে সকল ‘আলিম ও দীনী ভাই-বোন বিভিন্নভাবে মেধা, শ্রম, অর্থ, অনুপ্রেরণা, পরামর্শ দিয়ে নিরলসভাবে সহযোগিতা করেছেন তাঁদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পাশাপাশি দু'আ করছি।
হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সকলকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ দান কর। আমীন!

আহলে হাদীস লাইব্রেরী ঢাকা
(গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগ)

ইমাম মুসলিম (রহঃ) ও তাঁর গ্রন্থ সহীহ মুসলিম

যারা হাদীস শাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন, হাদীস সংগ্রহের উদ্দেশ্য যারা শত শত মাইল দুর্গম পথ পদব্রজে গমন করেছিলেন, নির্ভুল হাদীসসমূহকে কষ্টিপাথরে যাচাই-বাছাই করে গ্রন্থাকারে একত্র করার মত অসাধ্য কাজ যারা সাধন করেছিলেন, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাধনার বিনিময়ে মুসলিম জাতি রসূলুল্লাহ (সা.) -এর নির্ভুল হাদীসসমূহ গ্রন্থাকারে পেয়ে সত্যের সন্ধান লাভ করতে পেরেছে ইমাম মুসলিম (রহঃ) তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। ইমাম মুসলিম (রহঃ)-এর পূর্ণনাম মুসলিম বিন আল-হাজ্জাজ আল কুশাইরী আন্ নীসাপূরী। তার উপনাম আবুল হুসায়ন এবং উপাধি ছিল আসাকিরুদ্দীন।
আরবের বিখ্যাত গোত্র বানু কুশাইর বংশে খুরাসানের প্রসিদ্ধ শহর নীসাপূরে ২০০ বা ২০৪ বা ২০৬ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের সঠিক সাল সম্পর্কে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। তবে ঐতিহাসিকগণের নিরীক্ষণে প্রমাণিত হয় যে, তিনি ২০৬ হিজরী সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যেদিন জন্মগ্রহণ করেন সেদিনই ইমাম শাফিঈ (রহঃ) মৃত্যুবরণ করেন।

ইমাম মুসলিম (রহঃ) স্বীয় পিতা-মাতার তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত হন এবং উত্তম শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল শাইখ আল-হাজ্জাজ। ইমাম মুসলিম ছোট থেকেই তাক্বওয়া, পরহেযগারী ও নির্মল চরিত্রের অধিকারী হন। জীবনে তিনি কখনও কারও গীবত করেননি। নীসাপূরেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। অসাধারণ মেধা ও ধী-শক্তির অধিকারী হওয়ায় মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই তিনি তৎকালীন হাদীস বিশারদগণের নিকট ইলমে হাদীস অধ্যয়ন শুরু করেন। তাদের মধ্যে ইয়াহ্ইয়া বিন ইয়াহইয়া আত্ তামীমী, আল কানবী মুহাম্মাদ বিন ইয়াহ্ইয়া নিসাপূরী, আহমাদ বিন ইউনুস, ইসমাঈল বিন আবু উয়াইস প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অল্পদিনেই ইমাম মুসলিম (রহঃ) হাদীস শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করে ইমামদের পর্যায়ে উন্নীত হন!

ইমাম মুসলিম (রহঃ) ইলমে হাদীস শিক্ষা করার উদ্দেশ্য তৎকালীন মুসলিম জাহানের প্রায় সকল কেন্দ্রেই গমন করেছেন। হিজায, সিরিয়া, মিসর, ইয়ামেন, বাগদাদ প্রভৃতি স্থানে শহরে উপস্থিত হয়ে সে স্থানে অবস্থানকারী প্রসিদ্ধ ‘ইলমে হাদীসের উস্তায ও মুহাদ্দিসগণের নিকট হতে হাদীস সংগ্রহ করেছেন। ইলমে হাদীসের উপর বিশেষ দক্ষতা অর্জনের পর তিনি শিক্ষা দানের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তার নিকট হতে অসংখ্য শিস্য হাদীস শিক্ষা লাভ করেছেন। অধিকন্তু সে যুগের বড় বড় মুহাদ্দিসগণ তার নিকট হতে হাদীস শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রহঃ)-ও তাঁর নিকট হতে হাদীস শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।

ইমাম মুসলিম (রহঃ)-এর শ্রেষ্ঠ অবদান হল তার সংকলিত মুসলিম। তিনি বিভিন্ন মুসলিম জ্ঞান কেন্দ্র সফল করে সুদীর্ঘ পনের বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে অবিশ্রান্ত সাধনা ও গবেষণার মাধ্যমে চার লক্ষ হাদীস সংকলন করেন এবং সেগুলো হতে পুনরাবৃত্তি বাদ দিয়ে তিন লক্ষ হাদীস সংকলন করেছেন- (তাজকিরাতুল হুফফাজ ২/৫৮৯)। আবার এ তিন লক্ষ হাদীস হতে যাচাই-বাছাই করে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য পুনঃ পুনঃ উদ্ধৃত হাদীসসহ মোট বারো হাজার হাদীস সহীহ মুসলিমে অন্তর্ভুক্ত করেন। আর পুনঃ পুনঃ উল্লিখিত হাদীসসমূহ বাদে প্রায় চার হাজার হাদীস সহীহ মুসলিমে রয়েছে- (তাদরীব আর রাবী ৩০)।

রসূলুল্লাহ (সা.) -এর পবিত্র হাদীসের উপর সংকলিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে বিশুদ্ধতার মাপকাঠিতে সহীহাইন বা বুখারী ও মুসলিম হচ্ছে পূর্ণমাত্রায় উত্তীর্ণ। বিশুদ্ধতার দিক দিয়ে পবিত্র কুরআনের পরই এ হাদীসগ্রন্থদ্বয়ের স্থান। আর মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামী শারী'আতের বিশেষজ্ঞগণের মধ্যে এ বিষয়ে কোন মতবিরোধ নেই যে, হাদীস গ্রন্থসমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে ইমাম বুখারী (রহঃ) সংকলিত সহীহুল বুখারী। আর এরপরই সহীহ মুসলিমের স্থান।
তবে কেউ কেউ আবার মুসলিমকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। কেননা, ইমাম মুসলিম কোন বিষয়ের উপর বর্ণিত সকল মতন যা বিভিন্ন শব্দে বর্ণিত হয়েছে একই স্থানে একত্রিত করে লিপিবদ্ধ করেছেন। তাদেরকে বিভিন্ন অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করেননি। হাদীসের শিরোনাম খণ্ড খণ্ড ভাবে লিখেননি যা সহীহুল বুখারীতে করা হয়েছে। হাদীসের শব্দ হুবহু রেখেছেন সামঞ্জস্য রেখে বর্ণনা করেননি। প্রত্যেক রাবী কর্তৃক বর্ণিত শব্দ স্বতন্ত্রভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি হাদীসের সাথে সাহাবাগণের কথা, তাবিঈন এবং অন্যদের কথা অধ্যায় ও শিরোনামেও মিশ্রণ করেননি।
সহীহ মুসলিম ও সহীহুল বুখারীর মধ্যে কোন্‌টির অগ্রাধিকার বেশি বা নির্ভরযোগ্য এ বিষয়ের মতভেদের ক্ষেত্রে বলা যায়, কোন কোন দিক দিয়ে সহীহ মুসলিমের স্থান উর্ধ্বে। যেমন বিশুদ্ধতার দিক দিয়ে বুখারী উত্তম এবং সাজানো দিক দিয়ে সহীহ মুসলিম অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য। তবে সার্বিক বিচারে বুখারীর পর সহীহ মুসলিম-এর স্থান।

ইমাম মুসলিম (রহঃ) শুধুমাত্র নিজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বিবেচনার উপর ভিত্তি করে কোন হাদীসকে এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেননি বরং প্রত্যেকটি হাদীসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সমসাময়িক অন্যান্য হাদীস বিশারদগণের পরামর্শ গ্রহণ করেছেন এবং তারা যে সকল হাদীস সম্পর্কে পূর্ণ একমত পোষণ করেছেন কেবল সে সব হাদীসগুলোকে তিনি সহীহ মুসলিমে সংকলন করেছেন- (শারহিন্ নাবাবী ১/১৭৪)। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন, কেবলমাত্র আমার বিবেচনায় সহীহ হাদীসসমূহই আমি এ কিতাবে সন্নিবেশিত করিনি, বরং কিতাবে কেবল সে সকল হাদীসই সন্নিবেশিত করেছি যার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে হাদীস বিশারদগণ একমত। তিনি তার সংকলিত হাদীস গ্রন্থে বিশুদ্ধতা সম্পর্কে দাবী করেছেন পৃথিবীর মুহাদ্দিসগণ যদি দু’শত বৎসর পর্যন্ত হাদীস লিপিবদ্ধ করতে থাকেন, তথাপি তাদেরকে অবশ্যই এ সনদযুক্ত বিশুদ্ধ কিতাবের উপর নির্ভর করতে হবে। তার এ দাবী মিথ্যা নয়; বরং এক বাস্তব সত্যরূপেই পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে। ইতিহাসও এর যথার্থতা প্রমাণিত করেছে যে, আজ প্রায় এগারশত বছরের অধিককাল অতিক্রান্ত হওয়ার পরও সমপর্যায়ের গ্রন্থ রচিত হয়নি। আল্লাহ তা'আলা ইমাম মুসলিম (রহঃ)-এর সহীহ মুসলিম-কে কবুল করেছেন। এর ফলশ্রুতিতেই আজ কেন অদূর ভবিষ্যতেও এর সৌন্দর্য ও বিশুদ্ধতা বিশ্বমানবকে বিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন আলো দান করবে।

ইমাম মুসলিম (রহঃ) ওফাত সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ এক কৌতুহলী ঘটনা বর্ণনা করেছেন। একবার জনৈক ব্যক্তি ইমাম মুসলিম (রহঃ)-এর নিকট হাদীস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। উক্ত হাদীস সম্পর্কে ইমাম মুসলিমের তাৎক্ষণিক কোন ধারণা ছিল না। এজন্য তিনি কোন উত্তর না দিয়ে নিজ গৃহে ফিরে আসেন এবং স্বীয় পান্ডুলিপিসমূহ অনুসন্ধান করতে থাকেন। এ সময়ে তার নিকট খুরমা খেজুরের টুকরী রাখা ছিল। তিনি এতই মগ্ন ছিলেন যে, একটা করে খেজুর খাচ্ছিলেন আর খুঁজছিলেন। এভাবে খেজুরের ঝুড়ি খালি হয়ে যায় এবং তিনি হাদীসটিও খুঁজে পান। অতিরিক্ত খেজুর খাওয়ার ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সে রোগেই ২৬১ হিজরী সালে ২৪ রজব রবিবার সন্ধ্যায় কমবেশী ৫৫ বছর বয়সে তিনি ইহকাল ত্যাগ করেন। নীসাপুরে তার দাফন সম্পন্ন হয়।

ইমাম মুসলিম (রহঃ) আজ আর নেই, কিন্তু হাদীস শাস্ত্রে তিনি যে সুবিশাল গ্রন্থ ‘সহীহ মুসলিম’ লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাতে তিনি মুসলিম বিশ্বের স্বচ্ছ আকাশে চিরভাস্বর হয়ে আছেন ও থাকবেন। আল্লাহ তাঁর এ সুমহান খিদমাতকে কবুল করে তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। আমীন।

বিশ্ববিখ্যাত মুহাক্কিক ফু’আদ আবদুল বাকীর কথা

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য যিনি সারা বিশ্বের প্রতিপালক। শান্তি বর্ষিত হোক আমাদের নেতা মুহাম্মাদ (সা.) -এর উপর যিনি আল্লাহর রসূল এবং শেষ নবী। অতঃপর এ কিতাবটি উসূলে সুন্নাহর ৮টি কিতাবের মধ্যে তৃতীয়। যা আল্লাহ আমাদের জন্য নির্বাচন করেছেন যেন আমরা কিছু পর্ব, অধ্যায় ও হাদীস বের করতে পরিসংখ্যার মাধ্যমে। এটা সাজানো হয়েছে যেভাবে উসূলের কিতাব “মিফতাহুল কুনূয আস্ সুন্নাহ” এবং মু'জামুল মুফাহরাস লি আলফা-যিল হাদীস আন্ নাবাবী”-এর মধ্যে লেখক যে মূলনীতি গ্রহণ করেছেন সে অনুযায়ী।

আমরা ১৯৫১ খৃষ্টাব্দে মুওয়াত্তা ইমাম মালিক (রহ.) প্রকাশ করেছি এবং ১৯৫৩ সালে সুনানুল ইমাম ইবনু মাজাহ বের করেছি। আর এখন তার সাথে তৃতীয়টি সংযুক্ত করছি। আর এ কিতাবটি হলো সহীহ ইমাম মুসলিম বিন হাজ্জাজ (রহ.)।
‘আলিমগণ এ দুই কিতাবকে তাদের কাজের মূলনীতি হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। কাসতালিয়াহ প্রকাশনা অনুযায়ী ১২৮৩ হিজরীতে সহীহ মুসলিমের নুসখার উপর ইমাম নববী’র শারাহ তৈরি করেছেন।
আর সেটকে প্রচার করেছেন শায়খ হাসান আল আদবী আর এর সংশোধনের কাজে আত্মনিয়োগ করেছে। শায়খ মুহাম্মাদ আস্ সামলূতী ও শায়খ নাসর আবুল ওয়াফা আল্ হাওরানী এবং শায়খ যাইনুল মুরসাফী এবং শায়খ মাহমুদুল আলম। আর মিফতাহ কুনূযিস্ সুন্নাহ এর হাদীসগুলো এখানে পথনির্দেশ করছে। অধ্যায় এবং হাদীসের নম্বর বসানোর ক্ষেত্রে “মু'জাম আল্ মুফাহরাস লি আল্ ফা-যিল হাদীসিন নাবাবী” পর্বের নামের দিকনির্দেশনা দিয়েছে আর তাতে রয়েছে হাদীসের নম্বর। আর আমি এখানে দু'টি বিষয় অতিরিক্ত করেছি। একটি হচ্ছে প্রত্যেক পর্বের সংখ্যা গণনা এবং তার ধারাবাহিক নম্বর বসানো। দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রত্যেক মূল সহীহ হাদীসের নম্বর বসানো। বিভিন্ন সনদে যে হাদীসগুলো এসেছে সে অনুযায়ী নয়। আর সে নম্বর হচ্ছে যেটা দুই বন্ধনীর মধ্যে রয়েছে। এর মাধ্যমেই দক্ষতার সাথে সহীহ মুসলিম-এর হাদীসগুলোর সংখ্যা নির্ণয় করা হয়েছে। আর এ হাদীসের মূল ইবারতগুলো যাচাই করার ক্ষেত্রে কাসতালিয়াহ্ থেকে প্রকাশিত শারাহ-এর উপর নির্ভর করা হয়ে থাকে। আরো নির্ভর করা হয়েছে বুখারীর উপর কাসতুল্লানী’র করা ব্যাখ্যার হামিশের (ব্যাখ্যার ব্যাখ্যা) উপর। যা ১৩০৪ হিজরীতে প্রকাশিত হয়েছে।
আর ১৩২৯ হিজরীতে আসতানা’র দা-রুত্ তাবা’আতে যে নুসখাটি ছাপা হয়েছিল সেটি সবচেয়ে নিখুঁত এবং পূর্ণাঙ্গরূপে সাজানো।
এ নুসখাটি সংশোধন করতে ‘আলিমগণ চেষ্টার ত্রুটি করেননি। এটা সংশোধনের কাজে যারা সবচেয়ে বেশী শ্রম দিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন

১. আল্লামা আল-হাজ্জ মুহাম্মাদ যাহনী আফান্দি
২. শায়খ ইসমাঈল ইবনু 'আবদুল হামীদ
৩. আল্লামা আবু নি'মাতুল্লাহ আলহাজ্জ মুহাম্মাদ শুকরী ইবনু হাসান।
৪. আহমাদ রিফআত ইবনু উসমান হিলমী আল-কুরা হাসারী
৫. আল-হাজ্জ মুহাম্মাদ ইজ্জত ইবনু আল-হাজ্জ ‘উসমান আয যাফরানবুলিও।
আল্লাহ তাদের সকলের উপর সন্তুষ্ট হোন।

আর মূল ইবারতের সাথে ইমাম নাবাবীর শারাহ’র (ব্যাখ্যার) সারাংশ সম্পৃক্ত করা হয়েছে, এমনকি ভাষাবিদ ইমামদের অতিরিক্ত ব্যাখ্যাও সংযুক্ত করা হয়েছে। আর কিতাবের খণ্ড বিন্যাসের ক্ষেত্রে আসতানা’র প্রকাশনার উপর নির্ভর করা হয়েছে। এ কিতাব মোট ৮ খণ্ডে সমাপ্ত হয়েছে। প্রতি দুই খণ্ডকে আবার এক খণ্ডে রূপান্তর করা হয়েছে। এতে করে সম্পূর্ণ কিতাব আল্লাহর ইচ্ছায় মোট ৪ খণ্ডে সম্পন্ন হয়েছে।

আর পঞ্চম খণ্ডটি কেবল সূচীপত্রের জন্য নির্ধারিত। এ খণ্ডের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো
১। এটা সহীহ এর চাবিকাঠি যাতে নবী (সা.)-এর কাওলী হাদীসসমূহ সংযোজন করা হয়েছে এবং প্রত্যেক শব্দের প্রথম অক্ষর অনুযায়ী ‘আলিফ - বা’ - এ ধারায় সাজানো হয়েছে।
২। ইমাম মুসলিম (রহঃ) যে সকল সাহাবা থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন (আলিফ-বা) -এ ধারা অনুযায়ী তাদের নামের সূচী দেয়া হয়েছে।
৩। ইমাম মুসলিম যে সকল হাদীস বর্ণনায় ইমাম বুখারীর আর ইমাম বুখারী যে সকল হাদীসের ক্ষেত্রে ইমাম মুসলিমের সাথে একমত হয়েছেন সে সকল হাদীসের নম্বরও সংযোজন করা হয়েছে।
৪। যে সকল হাদীস শুধু ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন সে হাদীসগুলোর নম্বরও পৃথকভাবে দেয়া হয়েছে।
৫। কিতাবের প্রতিটি পর্বের জন্য একটি সাধারণ সূচী রয়েছে যাতে প্রত্যেক পর্বের নম্বর দেয়া হয়েছে এবং প্রতিটি পর্বের অধীনে যতগুলো পর্ব বা অধ্যায় রয়েছে সেগুলোরও নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। সাথে সাথে আরো একটি বিষয় আর তা হচ্ছে ইমাম মুসলিমের পূর্ণাঙ্গ জীবনী এবং সহীহ মুসলিমের ব্যাপারে বিভিন্ন উক্তি আর অন্যান্য হাদীসের কিতাবসমূহের মধ্যে মুসলিমের অবস্থানও বর্ণনা করা হয়েছে।
পরিশেষে আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। তিনি ছাড়া প্রকৃতপক্ষে আর কোন উপাস্য নেই। আল্লাহ সবচেয়ে বড়। সুমহান আল্লাহ ব্যতীত কোন আশ্রয় ও শক্তি নেই।

কুরআন সুন্নাহর খাদিম
মুহাম্মাদ ফু’আদ আবদুল বাকী
২২ রবিউল আউয়াল ১৩৭৪ হিজরী
১৯ নভেম্বর ১৯৫৪ ঈসায়ী

ইমাম মুসলিম ও তার সহীহ গ্রন্থ সম্পর্কে দু’টি কথা এবং সহীহ মুসলিম-এ ফু’আদ আবদুল বাকীর খিদমাত

সকল প্রশংসা সর্বজগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহরই জন্য এবং মুত্তাকীদের জন্য রয়েছে উত্তম প্রতিফল যা তারা করে থাকে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর উপর এবং সকল নবী ও রসূলের উপর রহমত বর্ষণ করুন।
হামদ ও সানার পর।
‘ইলমে হাদীসের দু’জন আমীরুল মু'মিনীন ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম। এ দু’জনের দ্বিতীয় জন ইমাম মুসলিম বিন হাজ্জাজ। অনুরূপ তার গ্রন্থও চূড়ান্ত বিশুদ্ধতম গ্রন্থসমূহের মধ্যে দ্বিতীয়। এ দু'টি বিষয় ব্যক্তি ও তার গ্রন্থ সম্পর্কে কথা বলার অর্থ হচ্ছে এমন জলাধার সিঞ্চন করার তুল্য যা কখনও শুকিয়ে যায় না অথবা এমন ঝর্ণাধারার মতো যা প্রশস্ত ও বিশাল। যাতে কোন প্রকার বক্রতা সন্ধান করার অর্থ হচ্ছে নিজেকে ধিক্কার দেয়া তা যতদিন বা যতরাত অতিবাহিত হোক না কেন।
যে কারণে আমরা তাঁর সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত তথ্যপূর্ণ আলোচনা করব। আর এ ব্যাপারে আমাকে সহযোগিতা করেছে বর্তমান যুগের বিশিষ্ট বিশ্লেষক, ঐতিহাসিক, ‘আলিম সাইয়্যিদ খাইরুদ্দীন আয যারকালীর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ “আল আ'লাম” [উক্ত গ্রন্থটি আরো বহুবার মুদ্রণ করা হয়েছে (ড. মুস্তফা মুহাম্মাদ আয যাহাবী)।] যাকে জীবনী গ্রন্থসমূহের মা অথবা মূলগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উক্ত গ্রন্থের দ্বিতীয় মুদ্রণ, অষ্টম খণ্ডের ১১৭ পৃষ্ঠা হতে আমি সংকলন করেছি। যে গ্রন্থটি অদূর ভবিষ্যতে আরব বিশ্বে স্বীয় মর্যাদায় ভূষিত হবে এবং আরব বিশ্বের পণ্ডিতগণ তার প্রমাণপঞ্জিকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করবেন ইনশাআল্লাহ। আরও আশা করি, যে গ্রন্থ হতে আমি সংকলন করেছি তা তারা প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে গণ্য করবেন।

ইমাম মুসলিম
(২০৪-২৬১ হিজরী মতান্তরে ৮২০-৮৭৫ ঈসায়ী)

নাম: মুসলিম বিন হাজ্জাজ বিন মুসলিম আল কুশায়রী। উপনাম: আবুল হুসায়ন। হাদীসের বিশেষজ্ঞ, শীর্ষস্থানীয় মুহাদ্দিসগণের অন্যতম। নীসাপূরে জন্ম। তার বংশ পদবী আল কুশায়রীর পরিচিতিতে বলা হয়, এ বংশ কুশায়র ইবনু কা'ব এর নামে পরিচিত। যা সে সময়ের এক বিরাট বংশ হিসেবে পরিচিত ছিল। ইমাম মুসলিম এর পূর্ণ নাম মুসলিম বিন হাজ্জাজ বিন মুসলিম আল কুশায়রী। উপনাম: আবুল হুসায়ন। বংশধারা: আরবের প্রসিদ্ধ বংশ আল কুশায়র বংশ। যা তৎকালে নীসাপূরে বসবাস করতো। উপাধি: আহলে হাদীসগণের ইমাম।

বিভিন্ন সময়ে ইরাক, সিরিয়া ও হিজায অঞ্চলে সফর করেছেন। খোরাসান শহরের যে সকল সম্মানিত উলামাবৃন্দের নিকট হতে তিনি হাদীস সংগ্রহ করেছেন। তম্মধ্যে ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া, ইসহাক ইবনু রাহওয়াইহ্ ও সমপর্যায়ভুক্ত ‘আলিমবৃন্দ।

রাই শহরের উল্লেখযোগ্য উলামাবৃন্দ: মুহাম্মাদ বিন মিহরান, আবু গাসসান ও সমপর্যায়ভুক্ত উলামাগণ।
ইরাক: ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল, আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামাহ্ ও অন্যান্যগণ।
হিজায: সাঈদ ইবনু মানসুর, আবু মুস’আব ও অন্যান্য।
মিসর: ‘আমর বিন সুওয়াদ, হারমালাহ্ ইবনু ইয়াহইয়া ও অন্যান্য।
তার শিক্ষকগণ যথা: কুতাইবাহ্ ইবনু সাঈদ, কা’নাবী, ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল, ইসমাঈল ইবনু আবূ উয়াইস, ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহ্ইয়া, আবূ বাকর ইবনু শাইবাহ ও উসমান ইবনু আবূ শাইবাহ্, আবদুল্লাহ ইবনু আসমা, শাইবান ইবনু ফাররুখ, হারমালাহ্ ইবনু ইয়াহইয়া (তিনি ইমাম শাফিঈর ছাত্র ছিলেন) মুহাম্মাদ ইবনুল মুসান্না, মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াসার, মুহাম্মাদ ইবনু মিহরান, মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহইয়া ইবনু আবূ উমার, মুহাম্মাদ ইবনু সালামাহ্ আল মুরাদী, মুহাম্মাদ ইবনু উমার, রুবাইহা, মুহাম্মাদ ইবনু রামহ এবং তৎকালীন বহু বিদগ্ধ হাদীস বিশারদ পণ্ডিতব্যক্তিগণের নিকট হতে তিনি হাদীসের শিক্ষা গ্রহণ করেন।
তার যুগের প্রখ্যাত ‘আলিমবৃন্দ তাঁর নিকট হতে হাদীস শ্রবণ করেছেন যাদের অনেকের নাম ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। যে সকল ব্যক্তিগণ তাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ কার্যক্ষেত্রে উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায়। যথা: আবূ হাতিম আর রাযী, মূসা ইবনু হারূন, আহমাদ ইবনু সালামাহ ও ইমাম তিরমিযী (রহিমাহুল্লাহুম আজমাঈন)

তার ছাত্রবৃন্দ যথা: ইমাম তিরমিযী, ইয়াহইয়া ইবনু সাইদ, মুহাম্মাদ ইবনু মুখাল্লাদ, ইবরাহীম ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু সুফইয়ান আল ফক্বীহ (তিনি সহীহ মুসলিমের বর্ণনাকারীগণের অন্যতম), মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক্‌ ইবনু খুযাইমাহ্, মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল ওয়াহ্হাব আল ফাররা, ‘আলী ইবনুল হুসায়ন, মাক্কী ইবনু 'আবদান, আবু হামিদ আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ আশ শারকী ও তাঁর ভাই আবদুল্লাহ আশ শারকী, হাতিম ইবনু আহমাদ আল কিন্দী, হুসায়ন ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু যিয়াদ আল কুব্বানী, ইবরাহীম ইবনু আবী তালিব, আবু বাকর মুহাম্মাদ বিন নাযর আল জারূদী, আহমাদ ইবনু সালামাহ্, আবু আওয়ানাহ্ ইয়াকূব ইবনু ইসহাক্ আল ইসফারায়িনী, আবু ‘আমর আহমাদ ইবনুল মুবারক আল মুসতামালী, আবু হামিদ আহমাদ ইবনু হামদুন আল আ'মাশ, আবুল ‘আব্বাস মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক ইবনু সিরাজ, যাকারিয়া ইবনু দাউদ আল খাফ্ফাফ এবং নাসর ইবনু আহমাদ আল হাফিয ইত্যাদি।
এরা সকলেই তাদের শিক্ষকের চরিত্রের মহানুভবতা, উৎকর্ষতা ও সুউচ্চ মর্যাদার ব্যাপারে একমত পোষণ করতেন।

তার লিখিত প্রসিদ্ধ গ্রন্থ “সহীহ মুসলিম”। এ গ্রন্থটিতে তিনি বারো হাজার হাদীস সংকলন করেছেন। আর এতে সময় লেগেছে পনের বছর। আহলে হাদীসের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রন্থের দু’টি গ্রন্থের একটি। বহু মনীষী এ গ্রন্থটির অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করেছেন।
ইমাম মুসলিম ‘ইলমে হাদীসের ক্ষেত্রে সহীহ মুসলিম ছাড়াও আরো বহু হাদীস গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি যে সকল গ্রন্থ মুসলিম জাতির জন্য এক বিশাল খিদমাত হিসেবে রেখে গেছেন তা আল্লাহর বিশেষ রহমত ও মুসলিম জাতির প্রতি তাঁর দয়া ও বারাকাত হিসেবে।
তম্মধ্যে আল মুসনাদুল কাবীর। বইটি রিজালশাস্ত্রের উপর লিখিত গ্রন্থ।
আল জামিউল কাবীর। বইটি হাদীসের বিভিন্ন অধ্যায়ের উপর লিখিত গ্রন্থ।
কিতাবুল ইলাল, কিতাবু আওহা-মুল মুহাদ্দিসীন, কিতাবুত্ তাময়ীয, কিতাবু মান লাইসা লাহু ইল্লা র-বিন ওয়াহিদ, কিতাবু তবাকা-তুত্ তা-বি’ঈন ও কিতাবুল মুখযারামীন ইত্যাদি।
তম্মধ্যে উল্লেখযোগ্য আল্ মুসনাদুল কাবীর- যা সহীহ মুসলিমের বর্ণাকারীদের উপর লেখা হয়েছে। “আল জামি” এ গ্রন্থটি বহু অধ্যায়ে সাজানো হয়েছে। “আল্ আসমাউল কুনা” চার খণ্ডে সমাপ্ত একটি ব্যাখ্যা গ্রন্থ।

“আল্ ইফরাদ ওয়াল ওয়াহদান”, “আল আকরান”, “মাশায়িখুশ শূরা”, “তাসমিয়্যাতু শুয়ূখি মা-লিকিন ওয়া সুফইয়া-না ওয়া শু’বাহ্”, “কিতাবুল মুখযারামীন”, “কিতাবু আওলা-দিস্ সহা-বাহ্”, “আওহা-মুল মুহাদ্দিসীন, “আত্ তবাকা-ত” এবং “ইফরা-দুশ শা-মিয়ীন” অন্যতম। (তাযকিরাতুল হা-ফিয ২: ১৫, তাহযীব ১০: ১২৬, ইবনু খাল্লাকা-ন ২: ৯১, ফিহরিসতে ইবনু খালীফাহ ২১২, তা-রীখে বাগদাদ ১৩: ১০০ (এতে আরো উল্লেখ রয়েছে ইমাম মুসলিম তার সহীহ লেখার সময় ইমাম বুখারীর অনুসরণ করেন। এমনকি যখন তার কিতাব লেখা শেষের দিকে তখন নীসাপূরে ইমাম বুখারী আগমন করলে ইমাম মুসলিম ইমাম বুখারীর সংস্পর্শে আসেন এবং তাকে অনুসরণ করতে থাকেন।) তবাকা-তুল হানাবিলাহ ১: ৩৩৭, Princeton 412-13 ওয়াল্ বিদায়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ ১১: ৩৩, মু'জামুল মাতবূ'আ-ত ১৭৪৫, হা-দিউল মুসতারশিদীন ইলা ইত্তিসা-লিল মুসনিদীন পৃষ্ঠা ৩৩৭। আরো লক্ষ্য করুন “ফিহরিসিল। মুআল্লিফীন ২৯৯ এবং Brock. 1: 166 (160), s.1: 265। )

আর উপরোক্ত গুণাবলীর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে তার লিখিত গ্রন্থ “সহীহ মুসলিম”। হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা সম্পন্ন ও একই হাদীসের বহু সূত্র কোন রূপ দোষ ব্যতীত বর্ণনা করার মতো আর কোন গ্রন্থ এ যাবৎ পাওয়া যায় না। না এ কিতাবের পূর্বে কোন কিতাব ছিল, আর না এ কিতাবের পরে এরূপ কোন কিতাব সংকলিত বা লিখিত হয়েছে। এ ছাড়াও একই সনদের অপর সনদসমূহ যা সনদে তাহবীল বলে পরিচিত তা বর্ণনার ক্ষেত্রে অধিক সংরক্ষণশীলতা ও সনদ ও মতনের ক্ষেত্রে বর্ণনাকারীদের শাব্দিক পরিবর্তনসমূহের ব্যাপারে সতর্কীকরণের ক্ষেত্রে, যদিও একটি শব্দ হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে রাবীদের মধ্যে হাদীস শ্রবণের ক্ষেত্রে কোনরূপ দোষ-ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে তা সুস্পষ্ট বর্ণনারীতির মাধ্যমে সুস্পষ্ট করে তোলার রীতিও তার এ গ্রন্থটি অন্য সকল হাদীস গ্রন্থ হতে আলাদা পরিচয় দিয়ে থাকে।
এতদসত্ত্বেও সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম-এর মধ্যে তুলনা করতে গেলে সহীহুল বুখারী অধিকতর বিশুদ্ধ ও অধিকতর উপকার প্রদানকারী হাদীসগ্রন্থ। এটাই জমহুর উলামাগণের মত। আর এটাই বিশুদ্ধ গ্রহণযোগ্য মন্তব্য। তবে সহীহ মুসলিম-এরও সনদ বর্ণনার গভীরতা ও সনদ সম্পর্কীয় অন্যান্য গুণাবলী তাকে বিশেষত্ব প্রদান করেছে। যা উপরে আলোচনা করা হয়েছে।
এ কারণে ‘ইলমে হাদীসের প্রতি আকর্ষণবোধকারী প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত এ বিষয়টি মেনে নেয়া এবং উপরোক্ত বিশ্লেষণ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ধীরতা অবলম্বন করতঃ বুঝে নেয়া। কোনরূপ তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত যেন না নেয়া হয়, তাহলে সহীহ মুসলিম-এর ব্যাপক আকর্ষণীয় বিষয়সমূহ তাকে আশ্চর্যান্বিত করবে। যদি সে এরূপ স্বাদ গ্রহণে অক্ষম হয় তবে সে যেন এ গ্রন্থের সহায়ক ব্যাখ্যাগ্রন্থের সহায়তা নেয়। তাহলে সে ইনশাআল্লাহ আল্লাহর তাওফীকে পরিপূর্ণ স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে।

আমার রচিত সহীহ মুসলিম-এর ব্যাখ্যাগ্রন্থের ভূমিকাতে আমি এ প্রকারের প্রয়োজনীয় আলোচনা সন্নিবেশ করেছি যাতে আগ্রহী পাঠকগণ এ গ্রন্থের প্রতি আকর্ষিত হয়, এর সাথে সাথে আমি ইমাম মুসলিম (রহঃ)-এর জীবনীও এ গ্রন্থে বর্ণিত হাদীসসমূহের বর্ণনাকারীগণের জীবনীও আলোচনা করেছি।
সম্মানিত পাঠক! আপনার জেনে থাকা প্রয়োজন যে, ইমাম মুসলিম হাদীস শাস্ত্রের একজন উচু স্তরের ‘আলিম, এক উজ্জ্বল নক্ষত্রতুল্য ব্যক্তি, সকল দেশে ও জাতির নিকট হাদীস শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্যতা, বিশুদ্ধতা ও সংরক্ষণের ব্যাপারে তার অবদান অস্বীকার্য। যাতে কোন ব্যক্তির বিন্দুমাত্র সন্দেহ, সংশয় এ গ্রন্থের ও তাঁর রচিত অন্যান্য গ্রন্থের প্রতি দোষারূপ করারই নামান্তর।
এ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, যে ব্যক্তি সহীহ মুসলিম-এর প্রতি তার পূর্ণ দৃষ্টি সহকারে লক্ষ্য করবে সে অবশ্যই এ হাদীস গ্রন্থের তাঁর অবদান, হাদীস বর্ণনার সনদসমূহ ও হাদীসের অধ্যায়ের ধারাবাহিক সজ্জিতকরণ, হাদীস বর্ণনার পারঙ্গমতা, বিশ্লেষণ ক্ষেত্রে অসাধারণ নৈপূণ্যতা, মতামতের গভীরতা, বহুসূত্রের সংক্ষিপ্তকরণের ক্ষেত্রে অতুলনীয় দক্ষতা ইত্যাদি তাকে অভিভূত করবে। এছাড়াও কোন কোন হাদীসের সংক্ষিপ্ততা সত্ত্বেও একাধিক সূত্রের ক্লান্তিহীন সামঞ্জস্যতাও বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে।
ইমাম আবু আবদুল্লাহ হাকিম বলেন: আমাদের হাদীস বর্ণনা করেছেন মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম। তিনি বলেন, আমি আহমদ ইবনু সালামাহ্ হতে শুনেছি। তিনি বলেন, আমি আবূ যুর'আহ্ ও আবু হাতিম (দু’জন বিশিষ্ট মুহাদ্দিস)-কে তাদের সময়ের অন্যান্য হাদীস বিশারদগণের তুলনায় সহীহ হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে ইমাম মুসলিমকে প্রাধান্য দিতেন।

বিশুদ্ধতম গ্রন্থ হিসেবে সকল যুগে সকল মুহাদ্দিসগণের নিকট নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে যে দু'টি গ্রন্থ পরিচিত এবং বিশ্বস্ত সে দু’টির দ্বিতীয়টি হচ্ছে সহীহ মুসলিম। এ বিশুদ্ধ গ্রন্থটি সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষী তাদের সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন। তম্মধ্যে কয়েকটি নির্ভরযোগ্য মন্তব্য নিম্নরূপ। যেমন:
ইমাম মুহাম্মাদ আল মাসারজাসী বলেন: “ইলমে হাদীসে আকাশের নীচে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে সহীহ মুসলিম।
 প্রখ্যাত ঐতিহাসিক খতীব আল বাগদাদী বলেন: ইমাম মুসলিম হাদীসের ক্ষেত্রে ইমাম বুখারীর পক্ষে লড়াই করতে থাকেন। এমনকি জনগণ তার এবং ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহইয়ার মধ্যে ইমাম বুখারীর সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হতোদ্যম হয়ে পড়তো।
বিশিষ্ট হাদীস বিশেষজ্ঞ হাফিয আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াকূব উপরোক্ত বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন: ইমাম বুখারী যখন নীসাপূরে আগমন করলেন, ইমাম মুসলিম তখন তার নিকট মতবিরোধপূর্ণ মাসআলাসমূহ অধিক হারে পেশ করতে লাগলেন। কিন্তু যখন মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহইয়া ও ইমাম বুখারীর মধ্যে হাদীসের পরিভাষাগত বিষয়ে মতবিরোধ ঘটে এবং মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াহইয়া এ বিষয়টি জটিল করে তুলে তখন সে পরিস্থিতিতে ইমাম বুখারী নীসাপূর হতে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন। এ অবস্থায় লোকজন ইমাম বুখারীর সঙ্গ ত্যাগ করেন কিন্তু ইমাম মুসলিম তার আগমনে কোনরূপ বিরূপ মনোভাব পোষণ করেননি।
এ সময় মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহইয়াকে জানানো হয় যে, ইমাম মুসলিম ইমাম বুখারীর আগে ও পরের সকল সিদ্ধান্তের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন এবং এ কারণে ইরাক ও হিজাযে তাকে ভৎসনা করা হয়েছে, তদুপরি তিনি তার সিদ্ধান্ত থেকে প্রত্যাবর্তন করেননি। এমতাবস্থায় একদিন ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহইয়া তার হাদীসের দারসের শেষে বললেন, যে ব্যক্তি ইমাম বুখারীর মত সমর্থন করে থাকেন সে যেন আমাদের মাজলিসে অংশগ্রহণ না করে।
ইমাম মুসলিম তৎক্ষণাৎ উঠে তার পাগড়ীর উপর চাদর জড়িয়ে সকল লোকের সম্মুখে দাঁড়িয়ে গেলেন। বাড়ী ফিরে তাঁর শিক্ষক মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহ্ইয়ার নিকট হতে যে সব হাদীস তিনি সংগ্রহ করেছিলেন তা সব একত্রে করে একজন বাহকের মারফত তার শিক্ষক মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহ্ইয়ার বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলেন। এ ধরনের (সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে হতোদ্যমতা) সমস্যা সৃষ্টি হলো। ইমাম মুসলিম তার উস্তাযের নিকট হতে সরে আসলেন এবং তার মসজিদে যাতায়াত হতে বিরত থাকলেন।
ইমাম মুসলিম রবিবার রাতে ইন্তিকাল করেন তাকে নীসাপূরের প্রাণকেন্দ্র নাসরাবাদ নামক স্থানে দাফন করা হয়। কারো মতে দু’শত একষট্টি হিজরীতে নীসাপূরে পঞ্চান্ন বছর বয়সে তিনি ইন্তিকাল করেন।
এ রকম তথ্যই আমি পেয়েছি। তবে কোন বিশ্লেষকই তার জন্ম তারিখ ও বয়স সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেননি। তবে সকলেই একমত যে, তিনি হিজরী দ্বিতীয় শতকের পরেই জন্মগ্রহণ করেছেন। সে কালের মনীষী তাকিউদ্দীন, আবূ ‘আমর ‘উসমান ইবনু সালাহ নামে যিনি অধিক পরিচিত তিনি তার জন্ম সন উল্লেখ করেন দু'শত দুই হিজরী সন। তবে আমার নিবিড় পর্যালোচনায় যা প্রকাশিত হয়েছে তা হচ্ছে তিনি দু’শত ছয় হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেছেন। এ মতটি হাকিম আবদুল্লাহ ইবনু বাইয়ি' নীসাপূরীর লিখিত গ্রন্থ “উলামাউল আমসার” এও পাওয়া যায়। যে কারণে আমি আমার গ্রন্থে এ তারিখটিই লিপিবদ্ধ করি। সে হিসেবে তাঁর মৃত্যু সন দু'শত একষট্টি হলে এবং সে সময় তার বয়স পঞ্চান্ন হলে তার জন্ম সন দু’শত ছয় হওয়াই অধিক যুক্তিযুক্ত।
একজন অসাধারণ ব্যক্তির যে প্রকারের আলোচনা করতে হয় ইমাম মুসলিমের ক্ষেত্রে এবং তার কৃতিত্ব ও জীবনী সম্পর্কে আমি খুব কমই আলোচনা করেছি। আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট থাকুন এবং তিনিও আল্লাহর বিচারে সন্তুষ্ট থাকুন। আমীন।(উপরোক্ত বক্তব্যগুলো দু’জন বিখ্যাত মনীষী কাযী ইবনু খাল্লাকান রচিত “ওয়াফায়াতুল আ'য়ান” নামক গ্রন্থের ৬৮৮ পৃষ্ঠা হতে এবং 'সহীহ মুসলিম' গ্রন্থের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা গ্রন্থ রচয়িতা ইমাম নববী এর অপর গ্রন্থ “তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত” এর ১৩১ পৃষ্ঠা হতে উৎকলিত।)

অত্র গ্রন্থে আমি (ফুআদ আবদুল বাকী) যা কিছু করেছি।

প্রথমতঃ
আমি সব সময় এ কথাটি বারংবার বলেছি এবং পুনরাবৃত্তি করেছি যে, আমার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে আটটি গ্রন্থ যা হাদীসের মূল বলে বিবেচিত তা একটি পৃথক নির্মাণশৈলীতে এবং ভিন্নধারাতে প্রকাশ করা। যে সকল পাঠক অপর দু’টি গ্রন্থ “মিফতা-হু কুনূযিস্ সুন্নাহ” এবং “আল মু'জামুল মুফাহরিস লি আল্ ফা-যিল হাদীসিন নাবাবী” এর মধ্যেই নিজেদের জ্ঞানের পরিধিকে সীমাবদ্ধ করে রাখতে চান তাদেরকে আরো বেশি উপকৃত করা।
এ দু'টি গ্রন্থের সম্পাদকগণ প্রতিটি কিতাবের ধারাবাহিক স্বতন্ত্র ক্রমিক নম্বর দিয়েছেন, অতঃপর প্রতিটি কিতাবকে বহু অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন এবং প্রতিটি অধ্যায়ের জন্য আলাদা ক্রমিক নং দিয়েছেন।
ব্যতিক্রম শুধু সহীহ মুসলিম ও মুওয়াত্তা মালিক-এর ক্ষেত্রে। তারা উভয়ে এ দু'টি গ্রন্থের প্রতিটি কিতাবকে ভাগ করেছেন মূল হাদীসের ভিত্তিতে এবং প্রতিটি হাদীসের ধারাবাহিক ক্রমিক নং দিয়েছেন। অতঃপর পর্ব, অধ্যায় এবং হাদীসের নম্বর উল্লেখ করে “মিফতাহু কুনূযিস্ সুন্নাহ” গ্রন্থের হাদীসগুলো চিহ্নিত করেছেন।
আর “আল মু'জামুল মুফাহরিস লি আল ফা-যিল হাদীসিন্ নাবাবী” নামক গ্রন্থের হাদীসগুলোও চিহ্নিত করেছেন কিতাবের নাম উল্লেখের পাশাপাশি অধ্যায় ও হাদীসের নং উল্লেখের মাধ্যমে।
এ বিষয়ের বহু পুস্তক লেখকগণ যে সকল গ্রন্থের উপর নির্ভর করে থাকেন সে সমস্ত মূল গ্রন্থের হাদীস, অধ্যায় এবং পর্বের ধারাবাহিক ক্রমিক নম্বরের অনুসরণে এ গ্রন্থের কিতাব, অধ্যায় ও হাদীসের ধারাবাহিক নম্বর দেয়া হয়েছে। যাতে উদ্দিষ্ট হাদীস খুঁজে বের করা সহজতর হয়।
অনুরূপভাবে আমি এর পূর্বে মুওয়াত্তা মালিক অতঃপর সুনানু ইবনু মাজাহ প্রকাশ করেছি। আর এখন সহীহ মুসলিম প্রকাশ করছি। এরপর আল্লাহর ইচ্ছায় সহীহুল বুখারীতে হাত দিব এবং এভাবে অবশিষ্ট আটটি মূলগ্রন্থের সব ক’টি সম্পাদনা করে যাব।

দ্বিতীয়তঃ
ইমাম মুসলিম যখন হাদীস সংকলন করেন তখন একটি সূত্রের দ্বারা একটি হাদীস সংকলন করেননি বরং একটি হাদীসের একাধিক সূত্রের অনুসরণ করেছেন। কিন্তু আমি শুধুমাত্র মূল হাদীসের মধ্যেই ক্রমিক নং সংক্ষেপে দিয়েছি। এর সমার্থক সূত্র বা পথের দিকে আমি দৃষ্টিপাত করিনি। যার ফলে সহীহ মুসলিমের সর্বমোট বার হাজার হাদীসের ক্রমিক নং আমি ধারাবাহিকভাবে মাত্র ৩০৩৩ পর্যন্ত ক্রম নম্বর দিয়েছি।
এ কাজটি এর পূর্বে আর কোন ব্যাখ্যাকার করেননি। যদিও তাদের অমূল্য শ্রম প্রতিটি সংখ্যায় ও গণনাকে সম্মানিত করেছে। কিন্তু আমার এ সংক্ষিপ্তকরণ করার উদ্দেশ্য হল যেন প্রতিটি হাদীসের একাধিক সূত্রের বিভিন্নমুখীতার ফলে অধিক দুশ্চিন্তা ও বিক্ষিপ্ততা হতে রক্ষা করে একটি নির্দিষ্ট সীমা তৈরি করা। তারপরও সকল ভাল কাজের প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রাপ্য।
আর যারা দু’টি সহীহ গ্রন্থ সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম-এর মধ্যে তুলনা করতে চান বা সহিহুল বখারীর উপর সহীহ মুসলিমের মর্যাদা দিতে চান তারা এ কারণটিকে গ্রহণ করেন। তারা বলেন, বুখারী ও মুসলিমের মধ্যে তুলনীয় পার্থক্য এই যে, ইমাম মুসলিম তার গ্রন্থের একটি হাদীসের সকল সূত্র উল্লেখ করেছেন যা ইমাম বুখারী তার সহীহ গ্রন্থে করেননি। বরং ইমাম বুখারী একটি হাদীসের বহু সূত্রকে অর্থের দিকে লক্ষ্য করে অনেকগুলো অধ্যায়ে ভাগ করেছেন যা দ্বারা মাসআলা সংগ্রহ করা যায়।
এ দিক লক্ষ্য করে আমি এ গ্রন্থের হাদীসের ক্রমিক নং নির্ধারণে আমার কর্মপন্থা নির্ধারণ করি এবং হাদীসসমূহের অনুসরণ করতে থাকি। ইমাম মুসলিম তার গ্রন্থে বহু স্থানে হাদীসসমূহ বারংবার উল্লেখ করেছেন যার সংখ্যা প্রায় ১৩৭টি হবে।

তৃতীয়তঃ
যখন আমি এ গ্রন্থের পঞ্চম খণ্ডের সমাপনীতে গ্রন্থটির সূচীপত্র তৈরি করি তখন আমি মূল গ্রন্থের চেয়ে বিস্তারিত সূচীপত্র তৈরি করি। যাতে হাদীস অনুসন্ধানকারী দ্রুত সময়ে সে হাদীসটি খোঁজ করে পেয়ে যায়।
সে হিসেবে আমি বিষয়সমূহের সূচী কিতাবসমূহের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী তৈরি করতে থাকি। সেখানে আমি কিতাবের নাম তার নংয়ের দ্বারা উল্লেখ করি। তারপর তার মধ্যকার অধ্যায়গুলোকে প্রতিটি অধ্যায়ের আলাদা ক্রমিক নংসহ বিন্যস্ত করি। অতঃপর অধ্যায়ের মধ্যে যে সকল হাদীসসমূহ রয়েছে সেগুলোকেও ক্রম অনুসারে সাজাই। যখন কোন অধ্যায়ে একটি হাদীস একাধিক বার আসে তখন সেটিকে মূল নংয়ের সাথে যুক্ত করে দিয়েছি। এভাবে যখন মুসলিমের কোন হাদীস বুখারীর কোন হাদীসের সাথে ঐকমত্য হয়েছে তখন সেখানে আমি বুখারীর মূল হাদীসের উপর নির্ভর করে মুসলিমের হাদীসের ধারাবাহিক নং দিয়েছি এবং মুসলিমের ধারাবাহিক নংয়ের সাথে যুক্ত করেছি। প্রতিটি হাদীসের প্রথমে কিতাবের নংসহ হাদীসের নং উল্লেখ করা এ কাজের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। অতঃপর হাদীসের বর্ণনাকারী সাহাবার নামসহ যে হাদীসে ইমাম মুসলিমের হাদীসের সাথে ইমাম বুখারীর হাদীসের ঐকমত্য হয়েছে তার আলাদা নং যুক্ত করেছি। তবে যে হাদীসসমূহ একাকি ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন সেগুলোর সম্মুখে বুখারীর হাদীসের নম্বর যুক্ত করা হয়নি।
পরিশেষে মহান আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা এবং নবী (সা.)-এর প্রতি দুরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক এবং যারা এ মহান কাজে আমার দ্বারা উপকৃত হচ্ছেন এবং আমি যাদের দ্বারা উপকৃত হয়েছি সকলকে আল্লাহ ক্ষমা করুন, তাদের সৎ ‘আমলসমূহ কবুল করুন এবং তাদের আখিরাতে নাযাতের মাধ্যম বানিয়ে দিন। আমীন।
মহান আল্লাহর বাণী স্মরণ করে আলোচনার সমাপ্তি করলাম।


(الۡحَمۡدُ لِلّٰهِ الَّذِیۡ هَدٰىنَا لِهٰذَا ۟ وَ مَا کُنَّا لِنَهۡتَدِیَ لَوۡ لَاۤ اَنۡ هَدٰىنَا اللّٰهُ)

“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে এ পথ দেখিয়েছেন। আমরা কখনও পথ পেতাম না, যদি আল্লাহ আমাদেরকে পথ না দেখাতেন।” (সূরাহ্ আল্ আ'রাফ ৭: ৪৩)

খাদিমুস সুন্নাহ (সুন্নাতের সেবক)
মুহাম্মাদ ফু’আদ ‘আবদুল বাকী’
জাযিরাতুর রাওযাহ, ১৭ই সফর ১৩৭৬ হিজরী মোতাবেক ২২শে সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ ঈসায়ী ।

সহীহ মুসলিম-এর হাদীস বর্ণনা করার কতিপয় পরিভাষা

ইমাম মুসলিম (রহঃ) তাঁর সহীহ মুসলিমে সনদ বর্ণনা করেছেন। বাংলা অনুবাদ করতে গিয়ে শুধু প্রথম ও শেষ রাবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ অনুবাদ পড়ে উপকৃত হবেন সাধারণ মুসলিম সমাজ আর সনদ হলো হাদীসবেত্তা ও হাদীস বিশারদগণের জন্য, তাই সংক্ষেপ করা হয়েছে।
হাদীসের রাবী পরম্পরাকে সনদ বলে। ইমাম মুসলিম কোন স্থানে হাদ্দাসানী’ আর কোন স্থানে ‘হাদ্দাসানা’ উল্লেখ করেছেন। এতে ইমাম মুসলিমের অতীব সাবধানতার পরিচয় পাওয়া যায়। বিষয় হলো: হাদ্দাসানা ও আখবারানা, হাদ্দাসানী ও আখবারানী এক জিনিস নয়।

(হাদ্দাসানী) ঐ সময় বলা হয় যখন ছাত্র উসতাযের নিকট হতে এককভাবে হাদীস শ্রবণ করেন।
(হাদ্দাসানা) ঐ সময় বলা হয় যখন ছাত্র সঙ্গী-সাথীদের সাথে উসতাযের নিকট হাদীস শ্রবণ করেন।
(আখবারানী) ঐ সময়ে বলা হয় যখন ছাত্র সঙ্গী-সাথীদের সাথে উসতাযের সামনে হাদীস পড়েন। “আখবারানা” ঐ সময় বলা হয় যখন ছাত্র সঙ্গী-সাথীদের সাথে উসতাযের সামনে হাদীস পাঠ করেন।

হাদীসের সংকলন ও তার প্রচার

সাহাবা কিরাম (রাযি.) মহানবী (সা.) -এর প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং তাঁর প্রতিটি কাজ ও আচরণ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতেন। রসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবাগণকে ইসলামের আদর্শ ও এর যাবতীয় নির্দেশ যেমন মেনে চলার হুকুম দিতেন, তেমনি তা স্মরণ রাখতে এবং অনাগত মানব জাতির কাছে পৌছে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। হাদীস চর্চাকারীর জন্য তিনি নিম্নোক্ত দু'আ করেছেন:
“আল্লাহ সে ব্যক্তিকে সজীব ও আলোকোজ্জ্বল করে রাখুন, যে আমার কথা শুনে স্মৃতিতে ধরে রাখল, তার পূর্ণ হিফাযাত করল এবং এমন লোকের কাছে পৌছে দিল, যে তা শুনতে পায়নি।” (তিরমিযী ২য় খণ্ড, ৯০ পৃষ্ঠা)।

মহানবী (সা.) ‘আবদুল কায়স গোত্রের প্রতিনিধি দলকে প্রয়োজনীয় উপদেশ দান করে বললেন: ‘এ কথাগুলো তোমরা পুরোপুরি স্মরণ রাখবে এবং যারা তোমাদের পেছনে রয়েছে তাদের কাছে পৌছে দিবে”(বুখারী)। তিনি সাহাবাগণকে সম্বোধন করে বলেছেন: “আজ তোমরা (আমার নিকট দীনের কথা) শুনছ, তোমাদের নিকট থেকেও (তা) শুনা হবে”- (মুসতাক হাকিম ১ম খণ্ড, ৯৫ পৃষ্ঠা)।
তিনি আরো বলেন: “আমার পরে লোকেরা তোমাদের নিকট হাদীস শুনতে চাইবে। তারা এ উদ্দেশ্য তোমাদের নিকট এলে তাদের প্রতি সদয় হয়ো এবং তাঁদের নিকট হাদীস বর্ণনা করো”- (মুসনাদ আহমাদ)।
তিনি অন্যত্র বলেছেন: “আমার নিকট থেকে একটি বাক্য হলেও তা অন্যের কাছে পৌছে দাও”- (বুখারী)। অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পরের দিন এবং দশম হিজরীতে বিদায় হজ্জের ভাষণে মহানবী (সা.) বলেন: “উপস্থিত লোকেরা যেন অনুপস্থিতদের নিকট আমার এ কথাগুলো পৌছে দেয়”- (বুখারী)।
রসূলুল্লাহ (সা.) -এর উল্লেখিত বাণীর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তাঁর সাহাবাগণ হাদীস সংরক্ষণে উদ্যোগী হন। প্রধানতঃ তিনটি শক্তিশালী উপায়ে মহানবী (সা.) -এর হাদীস সংরক্ষিত হয়: (১) উম্মাতের নিয়মিত 'আমল, (২) রসূলুল্লাহ (সা.) -এর লিখিত ফরমান, সাহাবাদের নিকট লিখিত আকারে সংরক্ষিত হাদীস ও পুস্তিকা এবং (৩) হাদীস মুখস্থ করে স্মৃতি ভাণ্ডারে সঞ্চিত রাখা, অতঃপর বর্ণনা ও শিক্ষাদানের মাধ্যমে লোক পরম্পরায় তাঁর প্রচার।

তদানীন্তন আরবদের স্মরণশক্তি অসাধারণভাবে প্রখর ছিল। কোন কিছু স্মৃতিতে ধরে রাখার জন্য একবার শ্রবণই তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। স্মরণশক্তির সাহায্যে আরববাসীরা হাজার বছর ধরে তাদের জাতীয় ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করে আসছিল। হাদীস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রাথমিক উপায় হিসেবে এ মাধ্যমটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মহানবী (সা.) যখনই কোন কথা বলতেন, উপস্থিত সাহাবাগণ পূর্ণ আগ্রহ ও আন্তরিকতা সহকারে তা শুনতেন, অতঃপর মুখস্থ করে নিতেন। তদানীন্তন মুসলিম সমাজে প্রায় এক লক্ষ লোক রসূলুল্লাহ (সা.) -এর বাণী ও কাজের বিবরণ সংরক্ষণ করেছেন এবং স্মৃতিপটে ধরে রেখেছেন। আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিঃ) বলেন, “আমরা রসূলুল্লাহ (সা.) -এর হাদীস মুখস্থ করতাম।” (সহীহ মুসলিম- ভূমিকা, ১০ পৃষ্ঠা)।

উম্মাতের নীরবিচ্ছিন্ন ‘আমল, পাস্পরিক পর্যালোচনা, শিক্ষাদানের মাধ্যমেও হাদীস সংরক্ষিত হয়। রসূলুল্লাহ (সা.) যে নির্দেশই দিতেন, সাহাবাগণ সাথে সাথে তা কার্যে পরিণত করতেন। তাঁরা মসজিদ অথবা কোন নির্দিষ্ট স্থানে একত্রে হতেন এবং হাদীস আলোচনা করতেন। আনাস ইবনু মালিক (রাযিঃ) বলেন, “আমরা মহানবী (সা.) -এর নিকট হাদীস শুনতাম। তিনি যখন মাজলিস থেকে উঠে চলে যেতেন, আমরা শোনা হাদীসগুলো পরস্পর পুনরাবৃত্তি ও পর্যালোচনা করতাম। আমাদের এক একজন করে সবাই হাদীসগুলো মুখস্থ শুনিয়ে দিতেন। এ ধরনের প্রায় বৈঠকেই অন্তত ষাট-সত্তরজন লোক উপস্থিত থাকতেন। বৈঠক থেকে আমরা যখন উঠে যেতাম তখন আমাদের প্রত্যেকেরই সবকিছু মুখস্থ হয়ে যেত। (আল-মাজমাউয যাওয়ায়িদ ১ম খণ্ড, ১৬১ পৃষ্ঠা)

মসজিদে নববীকে কেন্দ্র করে স্বয়ং নবী (সা.) -এর জীবদ্দশায় যে শিক্ষায়তন গড়ে উঠেছিল সেখানে একদল বিশিষ্ট সাহাবা (আহলুস সুফফাহ) সার্বক্ষণিকভাবে কুরআন-হাদীস শিক্ষায় রত থাকতেন।
হাদীস সংরক্ষণের জন্য যথাসময়ে যথেষ্ট পরিমাণে লেখনী শক্তিরও সাহায্য নেয়া হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে কুরআন মাজীদ ব্যতীত সাধারণতঃ অন্য কিছু লিখে রাখা হতো না। পরবর্তীকালে হাদীসের বিরাট সম্পদ লিপিবদ্ধ হতে থাকে। হাদীস নবী (সা.) -এর জীবদ্দশায় লিপিবদ্ধ হয়নি, বরং তার ইন্তিকালের শতাব্দীকাল পর লিপিবদ্ধ হয়েছে বলে যে ভুল ধারণা প্রচলিত আছে তার আদৌ কোন ভিত্তি নেই। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, কুরআনের সঙ্গে হাদীস মিশ্রিত হয়ে জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে কেবল এ আশঙ্কায় ইসলামী দাওয়াতের প্রাথমিক পর্যায়ে রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন: “আমার কোন কথাই লিখ না। কুরআন ব্যতীত আমার নিকট কেউ অন্য কিছু লিখে থাকলে তা যেন মুছে ফেলে”- (মুসলিম)। কিন্তু যেখানে এরূপ বিভ্রান্তির আশঙ্কা ছিল না মহানবী (সা.) সে সকল ক্ষেত্রে হাদীস লিপিবদ্ধ করে রাখতে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেন। আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাযি.) রসূলুল্লাহ (সা.) -এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, “হে আল্লাহর রসূল! আমি হাদীস বর্ণনা করতে চাই। তাই যদি আপনি অনুমতি দেন, তাহলে আমি স্মরণশক্তির ব্যবহারের সাথে সাথে লেখনীরও সাহায্য গ্রহণ করতে ইচ্ছুক”। তিনি বললেন: আমার হাদীস কণ্ঠস্থ করার সাথে লিখেও রাখতে পার”- (দারিমী)। আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাযি.) আরও বলেন, “আমি রসূলুল্লাহ (সা.) -এর নিকট যা কিছু শুনতাম, মনে রাখার জন্য তা লিখে নিতাম। কতিপয় সাহাবা আমাকে তা লিখে রাখতে নিষেধ করলেন এবং বললেন, রসূলুল্লাহ (সা.) একজন মানুষ, কখনও স্বাভাবিক অবস্থায় আবার কখনও রাগান্বিত অবস্থায় কথা বলেন। এ কথা বলার পর আমি হাদীস লেখা থেকে বিরত থাকলাম অতঃপর তা রসূলুল্লাহ (সা.) -কে জানালাম। তিনি নিজ হাতের আঙ্গুলের সাহায্যে স্বীয় মুখের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন: “তুমি লিখে রাখ। সে সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, এ মুখ দিয়ে সত্য ছাড়া অন্য কিছু বের হয় না”- (আবু দাউদ, মুসনাদ আহমাদ, দারিমী, হাকিম, বাইহাকী)। তাঁর সংকলনের নাম ছিল ‘সহীফাহ্ সাদিকাহ। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “সাদিকাহ্ হাদীসের একটি সংকলন- যা আমি নবী (সা.) -এর নিকট শুনেছি”- (উলূমুল হাদীস ৪৫ পৃষ্ঠা)। এ সংকলনে এক হাজার হাদীস লিপিবদ্ধ ছিল।।

আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) বলেন, এক আনসারী সাহাবা রসূলুল্লাহ (সা.) -এর কাছে আরয করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনি যা কিছু বলেন, আমার কাছে খুবই ভালো লাগে, কিছু মনে রাখতে পারি না। নবী (সা.) বললেন: “তুমি ডান হাতের সাহায্য নাও”। তারপর তিনি হাতের ইশারায় লিখে রাখার প্রতি ইঙ্গিত করলেন- (তিরমিযী)।

আবু হুরাইরাহ্ (রাযি.) বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন রসূলুল্লাহ (সা.) ভাষণ দিলেন। আবূ শাহ ইয়ামানী (রাযিঃ) আরয করলেন, হে আল্লাহর রসূল! এ ভাষণ আমাকে লিখে দিন। নবী (সা.) ভাষণটি তাকে লিখে দেয়ার নির্দেশ দেন- (বুখারী, তিরমিযী, মুসনাদ আহমাদ)। হাসান ইবনু মুনাব্বিহ (রহঃ) বলেন, আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) আমাকে বিপুল সংখ্যক কিতাব (পাণ্ডুলিপি) দেখালেন তাতে রসূলুল্লাহ (সা.) -এর হাদীস লিপিবদ্ধ ছিল- (ফাতহুল বারী)। আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ)-এর সংকলনের একটি কপি (ইমাম ইবনু তাইমিয়ার হস্তলিখিত) দামিশক এবং বার্লিনের লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে।

আনাস ইবনু মালিক (রাযিঃ) তাঁর (স্বহস্তে লিখিত) সংকলন বের করে ছাত্রদের দেখিয়ে বলেন, আমি এসব হাদীস নবী (সা.) -এর নিকট শুনে তা লিখে নিয়েছি। পরে তাঁকে তা পড়ে শুনিয়েছি- (মুসতাদরাক হাকিম ৩য় খন্ড, ৫৭৩ পৃষ্ঠা)। রাফি' ইবনু খাদীজ (রাযিঃ)-কে স্বয়ং রসূলুল্লাহ (সা.) হাদীস লিখে রাখার অনুমতি দেন। তিনি প্রচুর হাদীস লিখে রাখেন- (মুসনাদ আহমাদ)।

‘আলী ইবনু আবু তালিব (রাযিঃ)-ও হাদীস লিখে রাখতেন। চামড়ার থলের মধ্যে রক্ষিত সংকলনটি তাঁর সঙ্গেই থাকত। তিনি বলতেন, আমি রসূলুল্লাহ (সা.) -এর নিকট থেকে এ সহীফাহ্ ও কুরআন মাজীদ ব্যতীত আর কিছু লিখিনি। সংকলনটি স্বয়ং রসূলুল্লাহ (সা.) লেখিয়ে ছিলেন। এতে যাকাত, রক্তপণ (দিয়াত) বন্দীমুক্ত, মাদীনার হেরেম এবং আরও অনেক বিষয় সম্পর্কিত বিধান উল্লেখ ছিল- (বুখারীর ফাতহুল বারী)। আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাযিঃ)-এর পুত্র ‘আবদুর রহমান একটি পাণ্ডুলিপি নিয়ে এসে শপথ করে বললেন, এটা ইবনু মাসউদ (রাযি.)এর স্বহস্তে লিখিত- (জামি' বায়ানিল ‘ইলম ১ম খণ্ড, ১৭ পৃষ্ঠা)।

স্বয়ং নবী (সা.) হিজরাত করে মাদীনায় পৌঁছে বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে যে চুক্তিপত্র সম্পাদন করেন (যা মদীনার সনদ নামে খ্যাত), হুদাইবিয়ার প্রান্তরে মক্কার মুশরিকদের সাথে যে সন্ধি করেন, বিভিন্ন সময়ে যে ফরমান জারি করে, বিভিন্ন গোত্রপ্রধান ও রাজন্যবর্গের কাছে ইসলামের যে দা'ওয়াতনামা প্রেরণ করেন এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোত্রকে যেসব জমি, খনি ও কূপ দান করেন তা সবই লিপিবদ্ধ আকারে ছিল এবং তা সবই হাদীসরূপে গণ্য।

এসব ঘটনা থেকে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয় যে, নবী (সা.) -এর সময় থেকেই হাদীস লেখার কাজ শুরু হয়। তাঁর দরবারে বহু সংখ্যক সাহাবা সব সময় উপস্থিত থাকতেন এবং তাঁর মুখে যে কথাই শুনতেন, তা লিখে নিতেন। রসূলুল্লাহ (সা.) -এর আমলে অনেক সাহাবার নিকট স্বহস্তে লিখিত সংকলন বর্তমান ছিল। উদাহরণ স্বরূপ ‘আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিঃ)-এর সহীফায়ে সাদিকাহ্ আবু হুরাইরাহ্ (রাযিঃ)-এর সংকলন সমধিক খ্যাত।
সাহাবাগণ যেভাবেই রসূলুল্লাহ (সা.) -এর নিকট থেকে হাদীসের জ্ঞান লাভ করেন তেমনিভাবে হাজার হাজার তাবিঈ সাহাবাগণের কাছে হাদীসের শিক্ষা লাভ করেন। একমাত্র আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ)-এর নিকট আটশত তাবিঈ হাদীস শিক্ষা করেন। সা'ঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব, উরওয়াহ্ ইবনু যুবায়র, ইমাম যুহরী, হাসান বাসরী, ইবনু সিরীন, নাফি', ইমাম যাইনুল আবিদীন, মুজাহিদ, কাযী শুরায়হ, মাসরূক, মাকহুল, ইকরিমাহ, ‘আতা, কাতাদাহ্, ইমাম শা'বী, ‘আলকামাহ্, ইবরাহীম নাখঈ (রহ.) প্রমুখ প্রবীণ তাবিঈর প্রায় সকলে দশম হিজরীর পর জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৪৮ হিজরীর মধ্যে ইন্তিকাল করেন। অন্যদিকে সাহাবাগণ ১১০ হিজরীর মধ্যে ইন্তিকাল করেন। এদিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, তাবিঈগণ সাহাবাগণের দীর্ঘ সাহচর্য লাভ করেন। একজন তাবিঈ
বহু সংখ্যাক সাহাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নবী (সা.) -এর জীবনের ঘটনাবলী, তার বাণী, কাজ ও সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহন করেন এবং তা তাদের পরবর্তীগণ অর্থাৎ তাবি তাবিঈনের নিকট পৌছে দেন।

হিজরী দ্বিতীয় শতকের শুরু থেকে কনিষ্ঠ তাবিঈ ও তাবিঈ-তাবিঈনের এক বিরাট দল সাহাবা ও প্রবীণ তাবিঈদের বর্ণিত ও লিখিত হাদীসগুলোর ব্যাপকভাবে একত্র করতে থাকেন। তারা গোটা মুসলিম জাহানে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র উম্মতের মধ্যে হাদীসের জ্ঞান পরিব্যাপ্ত করে দেন। এ সময় ইসলামী বিশ্বের খলীফাহ্ উমার ইবনু 'আবদুল আযীয (রহঃ) দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রশাসকদের নিকট হাদীস সংগ্রহ করার জন্য রাজকীয় ফরমান প্রেরণ করেন। ফলে সরকারী উদ্যোগে সংগৃহীত হাদীসের বিভিন্ন সংকলন রাজধানী দামিশকে পৌছতে থাকে। খলীফাহ্ সেগুলোর একাধিক পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দেশের সর্বত্র পাঠিয়ে দেন। এ যুগের আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হাদীস সংকলন হচ্ছে: জামি' সুফইয়ান সাওরী, জামি ইবনুল মুবারক, জামি' ইমাম আওযাঈ, জামি ইবনু জুরায়জ ইত্যাদি।

হিজরী দ্বিতীয় শতকের শেষার্ধ থেকে চতুর্থ শতকের শেষে পর্যন্ত হাদীসের চর্চা আরও ব্যাপকতর হয়। এ সময়কালেই হাদীসের প্রসিদ্ধ- ইমাম বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ সিজিস্তানী, আবু ঈসা তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনু মাজাহ (রহঃ)-এর আবির্ভাব হয় এবং তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও দীর্ঘ অধ্যবসায়ের ফলশ্রুতিতে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ছয়খানি হাদীস গ্রন্থ (কুতুবে সিত্তাহ) সংরক্ষিত হয়। এ যুগেই ইমাম শাফি'ঈ (রহঃ) তাঁর কিতাবুল উম্ম ও ইমাম আহমাদ (রহঃ) তাঁর আল-মুসনাদ গ্রন্থ সংকলন করেন। হিজরী চতুর্থ শতকে মুসতাদরাক হাকিম, সুনানু দারাকুতনী, সহীহ ইবনু হিব্বান, সহীহ ইবনু খুযাইমাহ, তাবারানীর আল মু'জাম, মুসান্নাফুত্ তাহাবী এবং আরও কতিপয় হাদীস গ্রন্থ সংকলিত হয়। ইমাম বাইহাকীর সুনানু কুবরা ৫ম হিজরী শতকে সংরক্ষিত হয়।
চতুর্থ শতকের পর থেকে এ পর্যন্ত সংকলিত হাদীসের মৌলিক গ্রন্থগুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের সংকলন ও হাদীসের ভাষ্য গ্রন্থ এবং এ শাস্ত্রের শাখা-প্রশাখার উপর ব্যাপক গবেষণা ও বিভিন্ন গ্রন্থ রচিত হয়। বর্তমান কাল পর্যন্ত এ কাজ অব্যাহত রয়েছে। এসব সংকলনের মধ্যে তাজরীদুল সিহাহ ওয়াস সুনান, আত তারগীব ওয়াত তারহীব, আল মুহাল্লা, মাসাহীবুস সুন্নাহ, নাইলুল আওতার প্রভৃতি সমধিক প্রসিদ্ধ।