লগইন করুন
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - কুরবানীর দিনের ভাষণ, আইয়্যামে তাশরীক্বে পাথর মারা ও বিদায়ী তাওয়াফ করা
২৬৭০-[১২] ’আমর ইবনুল আহ্ওয়াস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বলতে শুনেছি, বিদায় হজে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হে লোকেরা! এটা কোন্ দিন? (সমস্বরে) লোকেরা বললো, এটা হজে আকবারের (বড় হজের) দিন। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, (মনে রাখবে) তোমাদের জীবন, সম্পদ, ইজ্জত পরস্পরের মধ্যে যেমন হারাম বা পবিত্র। তেমনি আজকের এ দিন এ শহরে হারাম বা পবিত্র। সাবধান! কোন অপরাধকারী যেন তার জীবনের ওপর যুলুম না করে। সাবধান! কোন অপরাধী যেন নিজের সন্তানের ওপর যুলুম না করে। কোন সন্তান যেন তার পিতার ওপর যুলুম না করে। সাবধান! শয়তান চিরদিনের জন্যে নিরাশ হয়ে গেছে এ শহরে তার কোন পূজা হবে (না এ প্রসঙ্গে)। কিন্তু তোমাদের যে সব কাজের মধ্য দিয়ে তার অনুসারী হবে, অথচ সেসব কাজ তোমরা তুচ্ছ মনে করবে। আর এতেই সে খুশী হবে। (ইবনু মাজাহ, তিরমিযী; তিরমিযী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)[1]
عَنْ عَمْرِو بْنِ الْأَحْوَصِ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ فِي حَجَّةِ الْوَدَاعِ: «أَيُّ يَوْمٍ هَذَا؟» قَالُوا: يَوْمُ النَّحْر الْأَكْبَرِ. قَالَ: «فَإِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ بَيْنَكُمْ حَرَامٌ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِي بَلَدِكُمْ هَذَا أَلا لَا يجني جانٍ عَلَى نَفْسِهِ وَلَا يَجْنِي جَانٍ عَلَى وَلَدِهِ وَلَا مَوْلُودٌ عَلَى وَالِدِهِ أَلَا وَإِنَّ الشَّيْطَانَ قد أَيسَ أَنْ يُعْبَدَ فِي بَلَدِكُمْ هَذَا أَبَدًا وَلَكِنْ ستكونُ لهُ طاعةٌ فِيمَا تحتقرونَ مِنْ أَعْمَالِكُمْ فَسَيَرْضَى بِهِ» . رَوَاهُ ابْنُ مَاجَهْ وَالتِّرْمِذِيّ وَصَححهُ
ব্যাখ্যা: (عَنْ عَمْرِو بْنِ الْأَحْوَصِ) তিনি হচ্ছেন ‘আমর ইবনুল আহওয়াস আল জাশমী তিনি বানী জাশম বিন সা‘দ-এর বংশধর। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) তাকে ‘‘আত্ তাকরীব’’ নামক কিতাবে সাহাবী বলেছেন বিদায় হজ্জ/হজ সম্পর্কে তার বর্ণিত হাদীস রয়েছে। ‘আল্লামা ইবনু ‘আবদুল বার (রহঃ) তার বংশ পরম্পরা বর্ণনা করেছেন এভাবে যে, তিনি হলেন, ‘আমর ইবনুল আহ্ওয়াস বিন জা‘ফার বিন কিলাব আল জাশমী আল কিলাবী। তবে তার বংশ পরস্পর সম্পর্কে সামান্য মতপার্থক্য রয়েছে। তার কাছ থেকে তার ছেলে সুলায়মান হাদীস বর্ণনা করেছেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি স্ত্রী-মাতা সহকারে বিদায় হজ্জ/হজ পালন করেছেন আর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খুৎবা সম্পর্কে তার থেকে বর্ণিত হাদীস সহীহ।
হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, তিনি ইয়ারমূকের যুদ্ধে শাহীদ হন। তখন ‘উমার (রাঃ)-এর খিলাফাতকাল চলছিল।
(يَقُولُ فِىْ حَجَّةِ الْوَدَاعِ) অর্থাৎ- يوم النحر তথা কুরবানীর দিন।
(أَىُّ يَوْمٍ هٰذَا؟» قَالُوا: يَوْمُ النَّحْر الْأَكْبَرِ) অন্য এক বর্ণনা রয়েছে اى يوم احرم অর্থাৎ- কোন দিনটি সবচেয়ে বেশি সম্মানিত? উত্তরে সমবেত সকল মানুষ বললেন, يوم الحج الاكبر তথা বড় হজ্জের দিন। যারা বড় হজ্জ/হজ দ্বারা ইয়াওমুন্ নাহর তথা কুরবানীর দিন উদ্দেশ্য নেন এ হাদীস তাদের স্বপক্ষে দলীল। এ ব্যাপারে অনেকগুলো হাদীস বর্ণিত হয়েছে, ইমাম সুয়ূত্বী তার ‘‘আদ দুররুল মানসূর’’ এবং হাফিয ইবনু কাসীর তার তাফসীরে সেগুলো উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে একটি হাদীস যা ইমাম বুখারী (রহঃ) (باب الخطبة)-তে ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে তা‘লীকান বর্ণনা করেছেন সেটা হল, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াওমুন্ নাহরে জামারায়ে ‘আক্বাবার মাঝে অবস্থান করে বলেছিলেন (যে সময় তিনি হজ্জ/হজ করছিলেন) এবং বলছিলেন এটাই হল বড় হজ্জের দিন এবং নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতে থাকলেন, (اللهم الشهد) হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক। মানুষদেরকে তিনি বিদায় জানালেন এবং পরক্ষণে মানুষেরা বলতে থাকলো এটাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর حجة الوداع তথা বিদায় হজ্জ/হজ। এ হাদীসটি ইমাম আবূ দাঊদ, ইমাম ইবনু মাজাহ ও ইমাম ত্ববারানী (রহঃ) মুত্তাসিল সনদে বর্ণনা করেছেন। এটাকে বিদায় হজ্জে নামকরণ করা হলো تمام الحج তথা হজ্জের পূর্ণতা ও معظم افعاله হজ্জের অধিকাংশ কার্যাবলী এখানে সম্পাদন করা হয়েছিল। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, (لان فيه تتكمل المناسك) কেননা এ দিনে হজ্জের বাকী কর্মগুলোকে পূর্ণাঙ্গরূপ দেয়া হয়।
তবে ‘উলামায়ে কিরামের অপর একদল বলেন, হজ্জে আকবার তথা বড় হজ্জ/হজ দ্বারা ‘‘ইয়াওমুন্ নাহর’’ তথা কুরবানীর দিন উদ্দেশ্য নয় বরং ইয়াওমু ‘আরাফাহ্ তথা ‘আরাফার দিন উদ্দেশ্য। কেননা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, الحج عرفة হজ্জ/হজই ‘আরাফাহ্। ‘উমার ইবনু ‘আব্বাস ও ত্বাউস (রাঃ) তারা এ মতপোষণ করেছেন। এ বিষয়ে আরো অনেকগুলো কথা রয়েছে যা ‘আল্লামা ‘আয়নী ও হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) তাঁর ফাতহুল বারীতে সূরা বারাআতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন। তবে প্রথম কথাটি সর্বাধিক সহীহ।
(فان دماءكم واموالكم واعراضكم بينكم حرام كحرمة يومكم هذا فى بلدكم هذا)
এখানে بلد তথা শহর দ্বারা মক্কা নগরী উদ্দেশ্য ইবনু মাজাহ ও ইমাম তিরমিযী (রহঃ) তার كتاب التفسير একটু বর্ধিত করে বলেছেন, (فى شهركم هذا) তথা তোমাদের এ মাস। উপরোক্ত কথাটি দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আত্মহত্যা করা অথবা অপর কোন মুসলিমকে হত্যা করা হারাম। অপরদিকে সম্পদের ক্ষেত্রে অপরের সম্পদ ভক্ষণ করা হারাম এমনকি নিজের সম্পদও হারাম তবে যদি হালাল পথে হয় তাহলে কোন অসুবিধা নেই। ‘আল্লামা সিন্দী (রহঃ) এ রকমই ব্যাখ্যা করেছেন।
(لَا يَجْنِىْ جانٍ عَلٰى نَفْسِه) ‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেন, এ অংশটুকু খবর হিসেবে ধরা হবে যদি বাহ্যিক দৃষ্টিতে না-বোধকের শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কথাটির অর্থ হল, কেউ যেন তার নিজের ওপর আক্রমণ না করে। অর্থাৎ- অপর কেউ হত্যা না করে কারণ অপর কাউকে হত্যা করলে তা ক্বিসাস তথা হত্যার বদলা হত্যা হিসেবে তাকেও হত্যার সম্মুখীন হতে হবে। বস্ত্ততঃ এখানে আত্মপক্ষের কথা বলে অপরের ক্ষেত্রে বিষয়টিকে আরো শক্তভাবে বলাই উদ্দেশ্য। কারণ সেখানে নিজেরই ক্ষতি করা নিষেধ সেখানে অপরের ক্ষতি করার তো কোন প্রশ্নই উঠে না।
(أَلَا وَإِنَّ الشَّيْطَانَ) এখানে শয়তান দ্বারা শয়তান প্রধান ইবলীস উদ্দেশ্য।
(أَنْ يُعْبَدَ) ‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ) বলেন, এর অর্থ হলো শয়তান নিরাশ হয়ে গেছে যে, তার অনুগত করতে গিয়ে মানুষ গায়রুল্লাহর ‘ইবাদাত করবে। আর কেউ কেউ বলেছেন, এর অর্থ হলো শয়তান নিরাশ হয়ে গেছে যে, কোন মু’মিনীন মূর্তিপূজার দিকে ফিরে আসবে না। তাইতো দেখা গেছে মুসায়লামাহ্ কাযযাব ও তার সাথীরা এবং যাকাত অস্বীকারকারীরাসহ অন্যান্য যারা মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল তারা আর যাই করুক কিন্তু তারা মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয়নি। সুতরাং হাদীসটির অর্থ হলো দীন ইসলাম পরিবর্তন হয়ে আবার পূর্বে যেমন গোটা দুনিয়া শির্কের উপর চলছিল সেটা হওয়া থেকে শয়তান নিরাশ হয়ে গেছে।