পরিচ্ছেদঃ ১৭. প্রথম অনুচ্ছেদ - স্ত্রীর খোরপোষ ও দাস-দাসীর অধিকার
৩৩৪২-[১] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। হিন্দা বিনতু ’উতবাহ্ (আবূ সুফ্ইয়ান-এর স্ত্রী ও মু’আবিয়াহ্ (রাঃ)-এর মা) বলেন, হে আল্লাহর রসূল! আবূ সুফ্ইয়ান একজন কৃপণ মানুষ। আমার এবং আমার সন্তান-সন্ততির জন্য প্রয়োজনানুযায়ী খাদ্য নির্বাহ করে না, ফলে আমি তার অগোচরে কিছু ব্যবস্থা করি। উত্তরে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমার এবং তোমার সন্তান-সন্ততির জন্য প্রয়োজনানুপাতে ন্যায়সঙ্গতভাবে গ্রহণ কর। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ النَّفَقَاتِ وَحَقِّ الْمَمْلُوْكِ
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: إِنَّ هندا بنت عتبَة قَالَت: يَا رَسُول الله إِن أَبَا سُفْيَان رجل شحيح وَلَيْسَ يعطيني مَا يَكْفِينِي وَوَلَدي إِلَّا مَا أخذت مِنْهُ وَهُوَ يعلم فَقَالَ: «خذي مَا يَكْفِيك وولدك بِالْمَعْرُوفِ»
ব্যাখ্যা: (إِنَّ أَبَا سُفْيَانَ رَجُلٌ شَحِيْحٌ) অর্থাৎ আবূ সুফ্ইয়ান একজন কৃপণ ব্যক্তি। আবূ সুফ্ইয়ান -এর স্ত্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তথা বিচারকের সামনে তার সমস্যার বাস্তব অবস্থা তুলে ধরেছেন। তাই এটা হারাম গীবাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। ফাতহুল বারীতে লিখেন, কুরতুবী বলেনঃ এখানে আবূ সুফ্ইয়ান-এর স্ত্রী তার সব সময়ের অবস্থা কৃপণতা বলছেন না, আর তার কথায় এটা জরুরীও হয় না। কেননা তিনি বলছেন, সে আমার ও আমার বাচ্চার খরচ দিতে কৃপণ। আর এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যারা অপরিচিতদের জন্য অনায়াসে খরচ করলেও পরিবারের জন্য খরচ করতে অনেকটা সঙ্কীর্ণতা করেন।
(إِلَّا مَا أَخَذْتُ مِنْهُ وَهُوَ لَا يَعْلَمُ) তবে আমি যা নেই তার থেকে অথচ সে জানে না। অর্থাৎ সে খরচে কৃপণতা করায় যা দেয় তাতে আমার ও বাচ্চার হয় না, বরং আমি তাকে না জানিয়ে কিছু নিলে তখন আমাদের জন্য যথেষ্ট হয়।
ইমাম শাফি‘ঈ এ হাদীসের বর্ণনায় এই অংশটুকু বৃদ্ধি করেন : (سرا، فهل على في ذلك من شيء) অর্থাৎ আমি গোপনে কিছু নিয়ে নেই, এতে কি আমার কোনো অসুবিধা আছে?
ইমাম যুহরীর বর্ণনায় : (فهل على حرج أن اطعم من الذي في له عيالنا) অর্থাৎ আমাদের পরিবারে তার যে সন্তান রয়েছে আমি তাকে খাওয়ালে আমার কোনো সমস্যা আছে কি?
(خُذِىْ مَا يَكْفِيْكَ وَوَلَدِكِ بِالْمَعْرُوْفِ) আবূ সুফ্ইয়ান -এর স্ত্রীর কথার উত্তরে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি স্বাভাবিক নিয়ম মোতাবেক তোমার ও তোমার সন্তানের খরচ নিয়ে নিতে পার। অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিবে না। সামাজিকভাবে যতটুকুতে তোমার ও সন্তানের প্রয়োজন বুঝায় এবং যা শারী‘আত কর্তৃক স্বামীর ওপর অর্পিত হয়, সেই পরিমাণ নিবে।
কোনো কোনো বর্ণনায় : (لاحرج عليكِ أن تطعميهم بالمعروف) অর্থাৎ স্বাভাবিক নিয়ম মোতাবেক তাদেরকে খাওয়ালে কোনো সমস্যা নেই। (ফাতহুল বারী ৯ম খন্ড, হাঃ ৫৩৬৪)
এ হাদীস থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, স্ত্রী ও সন্তানের প্রয়োজনীয় খরচ স্বামীর ওপর ওয়াজিব। কুরআনেও এর বিবরণ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ
‘‘বিত্তশালী ব্যক্তি তার বিত্ত অনুযায়ী ব্যয় করবে। যে ব্যক্তি সীমিত পরিমাণে রিযকপ্রাপ্ত, সে আল্লাহ যা দিয়েছেন, তা থেকে ব্যয় করবে।’’ (সূরা আত্ব তালাক ৬৫ : ৭)
বর্ণিত হাদীস থেকে ‘উলামায়ে কিরাম বিভিন্ন মাস্আলাহ্ উদঘাটন করেন। ইমাম নববী বলেনঃ এ হাদীস থেকে যে বিষয়গুলো জানা যায়:
• স্ত্রীর খরচ স্বামীর ওপর ওয়াজিব।
• ছোট দরিদ্র সন্তানের খরচ পিতার ওপর ওয়াজিব।
• খরচের পরিমাণ নির্ধারিত নয় বরং যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু।
• ফতোয়া বা ফায়সালা দেয়ার সময় বে-গানা নারীর কথা শুনা বৈধ।
• ফতোয়া জিজ্ঞাসার জন্য এমন কথা বলা যায় যা শুনলে যার সম্পর্কে কথা হচ্ছে সে অপছন্দ করবে।
• কারো কাছে যার পাওনা অধিকার রয়েছে এবং এই অধিকার আদায়ে সে অক্ষম, তবে তার জন্য সেই ব্যক্তির সম্পদ থেকে তার অনুমোদন ছাড়া নেয়া বৈধ আছে। তবে ইমাম মালিক ও আবূ হানীফাহ্ (রহঃ) তা নিষেধ করেন।
• সন্তানের লালন পালনের দায়িত্ব আদায়ে মায়ের জন্য তাদের পিতার সম্পদ থেকে খরচের অধিকার রয়েছে।
• যে বিষয়ে শারী‘আতে কোনো পরিমাণ নির্ধারিত নেই সেখানে সামাজিক রীতির উপর নির্ভর করা জায়িয।
• স্বামীর অনুমতি বা তার বাধা না থাকলে স্ত্রীর জন্য প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া জায়িয আছে। (মিরকাতুল মাফাতীহ; শারহে মুসলিম ১১/১২ খন্ড, হাঃ ১৭১৪)
কেউ কেউ এ হাদীস থেকে ব্যক্তির অনুপস্থিতে তার ওপর বিচারের ফায়সালা কার্যকর জায়িযের ফতোয়া দেন। কিন্তু এ হাদীস থেকে অনুপস্থিত ব্যক্তির ওপর বিচারের ফায়সালা বৈধ প্রমাণ হয় না। কেননা এটা আবূ সুফ্ইয়ান-এর ওপর কোনো ফায়সালা কার্যকর নয়। বরং তার স্ত্রীর জিজ্ঞাসিত মাসআলার ফতোয়া প্রদান করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
শারহুস্ সুন্নাহ্ কিতাবে রয়েছে, এই হাদীস থেকে এটাও বুঝা যায় যে, কাযী তার জানা মোতাবেক কোনো কিছুর ফায়সালা দিতে পারেন; কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ সুফ্ইয়ান-এর স্ত্রীকে দলীল পেশ করতে বাধ্য করেননি।
ব্যক্তির ওপর তার পিতা-মাতা ও সন্তানাদির ভরণ-পোষণ জরুরী। কেননা যখন তার ওপর সন্তানের ভরণ পোষণ জরুরী তখন পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ জরুরী হওয়া অধিক বাঞ্ছনীয় পিতা-মাতার সম্মানের কারণে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)