পরিচ্ছেদঃ ১১৯. রুকু‘র সময় হাত না উঠানোর বর্ণনা
৭৪৮। ’আলকামাহ (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, ’আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি কি তোমাদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সালাত কিরূপ ছিল তা শিক্ষা দেব না? বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর তিনি সালাত আদায় করলেন এবং তাতে কেবলমাত্র একবার হাত উত্তোলন করলেন।
ইমাম আবূ দাউদ (রহঃ) বলেন, এই হাদীসটি একটি দীর্ঘ হাদীসের সারসংক্ষেপ। উপরোক্ত শব্দে হাদীসটি সহীহ নয়।[1]
সহীহ।
[1] তিরমিযী (অধ্যায়ঃ সালাত, হাঃ ২৫৭, অনুঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল প্রথমবারই হাত উঠিয়েছেন), নাসায়ী (অধ্যায়ঃ তাত্ববীক, অনুঃ ঐরূপ না করার অনুমতি প্রসঙ্গে, হাঃ ১০৫৭) উভয়ে ওয়াকী থেকে। হাদীসটিকে ইমাম তিরমিযী হাসান বলেছেন এবং ইবনু হাযাম বলেছেন সহীহ। পক্ষান্তরে অন্যান্য ইমামগণ এটিকে দুর্বল আখ্যায়িত করেছেন। যেমন ইমাম বুখারী, ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল, ইমাম নাববী, ইমাম শাওকানী (রহঃ) প্রমুখ ইমামগণ হাদীসটিকে দুর্বল বলেছেন। (আল-মাজমু‘আহ ফী আহাদীসিল মাওযু‘আহ, ২০ পৃঃ)।
ইমাম ইবনু হিব্বান বলেন, রফ‘উল ইয়াদাইন না করার পক্ষে কূফাবাসীদের এটিই সবচেয়ে বড় দলীল হলেও এটিই সবচেয়ে দুর্বলতম দলীল। কেননা এর মধ্যে এমন সব বিষয় রয়েছে যা একে বাতিল গণ্য করে। (নায়লুল আওত্বার ৩/১৪, ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১০৪, ‘আওনুল মা‘বূদ)।
হাফিয ইবনু হাজার (রহঃ) ‘আত-তালখীস’ গ্রন্থে বলেন, ইবনুল মুবারক বলেছেন, হাদীসটি আমার নিকট প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত নয়। ইবনু আবূ হাতিম বলেন, এ হাদীসটি ভুল ও ত্রুটিযুক্ত। ইমাম আহমাদ ও তাঁর শায়খ ইয়াহইয়া ইবনু আদম বলেন, হাদীসটি দুর্বল। ইমাম আবূ দাঊদ বলেন, হাদীসটি সহীহ নয়। ইমাম দারাকুতনী বলেন, হাদীসটি প্রমাণিত নয়। ইমাম বায়হাক্বী এবং ইমাম দারিমী (রহঃ)ও হাদীসটিকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান বললেও তিনি নিজেই আবার ‘আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহঃ)-এর সূত্রে উল্লেখ করেছেন যে, এ হাদীসটি প্রমাণিত নয় এবং প্রতিষ্ঠিতও নয়। (আওনুল মা‘বূদ, নায়লুল আওত্বার, জামি আ-তিরমিযী ও অন্যান্য)।
আল্লামা শামসুল হাক্ব ‘আযীমাবদী (রহঃ) বলেন, তাকবীরে তাহরীমাহ ব্যতীত অন্যত্র রফ‘উল ইয়াদাইন না করার পক্ষে এ হাদীসটিকে দলীল হিসেবে পেশ করা হয়। কিন্তু হাদীসটি দলীলযেগ্য নয়। কেননা হাদীসটি দুর্বল ও অপ্রমাণিত।
আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ইবনু মাসঊদের সূত্র চাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে রফ‘উল ইয়াদাইন ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে সহীহ সুন্নাহ সাব্যস্ত হয়নি। আর ইবনু মাসঊদের এ হাদীসটিকে সহীহ মেনে নিলেও তা রফ‘উল ইয়াদাইন এর পক্ষে বর্ণিত সহীহ হাদীসসমূহের বিপরীতে পেশ করা যাবে না এবং ইবনু মাসঊদের এ হাদীসের উপর ‘আমঅল করা উচিত হবে না। কেননা এটি না বোধক আর ঐগুলি হাঁ বোধক।
ইলমে হাদীসের মূলনীতি অনুযায়ী হাঁ বোধক হাদীস না বোধক হাদীসের উপর অগ্রাধিকারযোগ্য।
মাযহাবী থিওরীতেও বলা হয়েছে, হানাফী ও অন্যদের নিকট যখন হাঁ সূচক ও না সূচকের সাথে দ্বন্দ্ব দেখা দিবে তখন না সূচকের উপর হাঁ সূচক অগ্রাধিকার পাবে। এরূপ নীতি বলবৎ হয় যদি হাঁ সূচকের পক্ষে একজনও হয় তবুও। সুতরাং সেখানে বিরাট এক জামা‘আত হা সূচকের পক্ষে সেখানে অন্য কোনো প্রশ্নই আসতে পারে না। যেমনটি এ মাসআলার ক্ষেত্রে। সুতরাং দলীল সাব্যস্ত হওয়ার পর গোড়ামী না করাটাই উচিত....। (হাশিয়া মিশকাত: আলবানী ১/১৫৪, ও যঈফাহ ৫৬৮)।
ইমাম খাত্তাবী (রহঃ) বলেন, রুকু‘র সময় এবং রুকু‘ থেকে মাথা উঠানোর পর রফ‘উল ইয়াদাইন করার পক্ষে যে সমস্ত সহীহ হাদীসাবলী বর্ণিত হয়েছে তা ইবনু মাসঊদের হাদীসের চেয়ে অগ্রগণ্য। প্রমাণ্যযোগ্য হাঁ বোধক হাদীস না বোধকের উপর প্রাধাণ্যযোগ্য।
* ইবনু মাস‘উদের হাদীস সম্পর্কে ইবরাহীম নাখায়ীল ধারণামূলক উক্তিঃ ইবনু মাসঊদের হাদীস সম্পর্কে ইবরাহীম নাখায়ীর এক বিতর্কের কথা কতিপয় গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। যেমন আমর ইবনু মুররাহ বলেন, আমি মসজিদে হাযরামাউতে প্রবেশ করে দেখি, আলকামাহ ইবনু ওয়ায়িল তাঁর পিতা সূত্রে বর্ণনা করেছেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকু‘র পূর্বে ও পরে রফ‘উল ইয়াদাইন করেছেন। অতঃপর আমি ইবরাহীম নাখায়ীর নিকট বিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি রাগান্বিত হয়ে বলেন, তিনিই শুধু দেখেছেন আর ইবনু মাসঊদ ও তার ছাত্ররা দেখেনি? (ত্বাহাভী ১/২২৪)। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ইবরাহীম নাখায়ী বলেন, ওয়ায়িল ইবনু হুজর (রাঃ) একজন গ্রাম্য লোক। তিনি ইসলামের বিধি বিধান জানেন না। তিনি যদি রফ‘উল ইয়াদাইন করতে একবার দেখে থাকেন তাহলে ইবনু মাসঊদ পঞ্চাশবার না করতে দেখেছেন, ইত্যাদি। (আবূ ইউসূফের আসার ২১ পৃঃ, জামি‘উল মাসানিদ ১/৩৫৮, ত্বাহাভী ১/১২০)।
কিন্তু ইবরাহীম নাখায়ীর এ মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ কেবল ওয়ায়িল ইবনু হুজর (রাঃ) নন বরং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অসংখ্য সাহাবায়ি কিরাম রফ‘উল ইয়াদাইনের হাদীস বর্ণনা করেছেন। যাঁদের সংখ্যা মুতাওয়াতির পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। সুতরাং ‘‘ইবনু মাসঊদ পঞ্চাশবার রফ‘উল ইয়াদাইন না করতে দেখেছেন’’- এটা ইবরাহীম নাখায়ীর শুধু দাবীমাত্র। তাই তো হাদীস সম্রাট ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেনঃ এটা ইবরাহীম নাখায়ীর শুধু ধারণা যে, ওয়ায়িল ইবনু হুজর ‘‘একবার রফ‘উল ইয়াদাইন করতে দেখেছেন।’’ অথচ ওয়ায়িল ইবনু হুজর (রাঃ) নিজে বর্ণনা করেছেন যে, ‘তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবীগণকে বহুবার রফ‘উল ইয়াদাইন করতে দেখেছেন’ এবং ওয়ায়িল ঐরূপ ধারণার মুখাপেক্ষী নন। কারণ তাঁর চোখে দেখা এবং গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা অন্যের (ইবরাহীম নাখায়ীর) ধারণার চেয়ে অনেক উত্তম। (দেখুন, জুযউল ক্বিরাআত, পৃঃ ২৩)।
ইমাম বায়হাক্বী ‘আলমা‘রিফাহ গ্রন্থে বলেনঃ ইমাম শাফিঈ (রহঃ) বলেনঃ উচিত হচ্ছে, ওয়ায়িলের বক্তব্যকে গ্রহণ করা। কেননা তিনি একজন জলীলুল কদর সাহাবী (রাঃ)। এমতাবস্থায় তাঁর হাদীসকে কিভাবে প্রত্যাখ্যান করা যায় এমন লোকের কথায় যিনি সাহাবী নন? বিশেষ করে ওয়ায়িলের পাশাপাশি অসংখ্য সাহাবায়ি কিরাম (রাঃ)-ও রফ‘উল ইয়াদাইনের হাদীস বর্ণনা করেছেন। (দেখুন, নাসবুর রায়াহ)।
ফাক্বীহ আবূ বাকর ইবনু ইসহাক্ব (রহঃ) বলেনঃ (ইবরাহীম নাখায়ীর) এ উক্তি দোষণীয়, এর উপর নির্ভর করা যায় না। কেননা রফ‘উল ইয়াদাইন করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহ সূত্রে সাব্যস্ত হয়েছে, অতঃপর খুলাফায়ি রাশিদীন থেকে, অতঃপর সাহাবীগণ ও তাবিঈগণ থেকে। আর ইবনু মাসঊদের রফ‘উল ইয়াদাইন ভুলে যাওয়া এটা ওয়াজিব করে না যে, এ সমস্ত সাহাবায়ি কিরামগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে রফ‘উল ইয়াদাইন করতে দেখেননি।
ইমাম বায়হাক্বী, শায়খ আবূল হাসান সিন্দী হানাফী ও ফাক্বীহ আবূ বাকর ইবনু ইসহাক্ব (রহঃ) প্রমুখগণ বলেনঃ বরং ইবনু মাসঊদ এমন কিছু বিষয় ভুলে গেছেন যে ব্যাপারে মুসলিমগণ মতভেদ করেননি। যেমনঃ (১) তিনি সমস্ত সাহাবায়ি কিরাম ও মুসলিম উম্মাহর বিপরীতে সূরাহ নাস ও সূরাহ ফালাক্বকে কুরআনের অংশ মনে করতেন না। (২) তিনি তাতবীক অর্থাৎ রুকু‘র সময় দু’ হাঁটুর মাঝখানে দু’ হাত জড়ো করে হাঁট দ্বারা চেপে রাখতে বলতেন। অথচ এরূপ ‘আমল রহিত হয়ে যাওয়া এবং তা বর্জন করার উপর সকল ‘আলিমগণ যে একমত হয়েছেন তাও তিনি ভুলে গেছেন। (৩) ইমামের সাথে দু’ জন মুক্তাদী হলে মুক্তাদীদ্বয় কোথায় কিভাবে দাঁড়াবেন তাও তিনি ভুলে গেছেন। তিনি বলতেন, ইমামের বরাবর দাঁড়াতে হবে। অথচ এটা হাদীসের সম্পূর্ণ খেলাফ। (৪) তিনি ভুলে গিয়েছিলেন বিধায় এরূপ বলতেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল আযহার দিন ফজরের সালাত সঠিক সময়ে পড়তেন না বরং ঈদের সালাতের পূর্বে পড়তেন। অথচ এটা সমস্ত মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধ মত। এ ব্যাপারে সমস্ত ‘আলিমগণের ঐক্যমতের কথাও তিনি ভুলে গেছেন। (৫) তিনি ভুলে গেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আরাফা ময়দানে কী নিয়মে দু’ ওয়াক্ত সালাত একত্রে আদায় করেছেন। (৬) তিনি সিজদার সময় মাটিতে হাত বিছিয়ে রাখতে বলতেন। অথচ এটি হাদীসের পরিপন্থি হওয়ার ব্যাপারে ‘আলিমগণ মতভেদ করেননি বরং একমত পোষণ করেছেন, তাও ইবনু মাসঊদ ভুলে গেছেন। (৭) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম وما خلق الذكر والأنثى আয়াতটি কিভাবে পড়তেন তাও তিনি ভুলে গেছেন।
অতএব এ সমস্ত ভুল যাঁর হয়েছে, তাঁর সালাতে রফ‘উল ইয়াদাইন না করা এবং সে বিষয়ে হাদীস না জানা বা না বলাও ভুলের অন্তর্ভুক্ত। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া মুহাদ্দিসীনে কিরামের নিকট এ কথা প্রসিদ্ধ যে, ইবনু মাসঊদের শেষ বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে স্মৃতি ভ্রম ঘটে। সুতরাং রফ‘উল ইয়াদাইন না করার হাদীসটিও সে সবের অন্তর্ভুক্ত হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়। (দেখুন, মাওয়াহিবু লাতীফা ১/২৬০, ইমাম বুখারী জুযউ রফ‘উল ইয়াদাইন, ইমাম যায়লায়ী’ হানাফীর নাসবুর রায়াহ ৩৯৭-৪০১ পৃঃ, ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৩৪, শারহু মুসনাদে ইমাম আবূ হানিফা ১৪১ পৃঃ, বালাগুল মুবীন ১/২২৯, ও অন্যান্য)।
* ইবনু মাসঊদ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত আরো কয়েকটি হাদীসঃ
(ক) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেনঃ ‘‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ বাকর ও উমার (রাঃ)-এর সাথে সালাত আদায় করেছি। তাঁরা সালাতে রফ‘উল ইয়াদাইন করেননি। সালাতের শুরুতে ছাড়া।’’ (বায়হাক্বী ‘সুনানুল কুবরা’ ২/১১৩, ১১৪, দারাকুতনী ১/২৯৫, ইবনু আদী কামিল ফিয যু‘আফা ৬/১৫২, উক্বাইলী ২/৪২৯, ইবনু হিববান ‘আল-মাজরুহীন ২/২৭০)।
এ হাদীসকে ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রহঃ), আল্লামা সুয়ূতী (রহঃ), ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রহঃ) ও ইমাম শাওকানী (রহঃ) বানোয়াট (মাওযু) বলেছেন- (দেখুন, তাসহীলুল ক্বারী, আল-ফাওয়ায়িদুল মাওযু‘আহ, আল-লাআ-লিল মাসনু‘আহ ফিল আহাদীসিল মাওযু‘আহ ২/১৯, এবং অন্যান্য)। ইবনুল জাওযী (রহঃ) হাদীসটিকে তার ‘আল-মাওযু’আত’ কিতাবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং তিনি ইমাম আহমাদ সূত্রে বলেছেনঃ এর বর্ণনাকারী মুহাম্মাদ ইবনু জাবির কিছুই না। তার থেকে কেবল এমন লোকই হাদীস বর্ণনা করে থাকেন যিনি তার চেয়েও নিকৃষ্ট। হাফিয ‘আত-তাক্বরীব’ (২/১৪৯) গ্রন্থে তাকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম দারাকুতনী বলেনঃ এতে মুহাম্মাদ ইবনু জাবির একক হয়ে গেছেন। তিনি দুর্বল। হাম্মাদ থেকে ইবরাহীম সূত্রে। হাদীসটি হাম্মাদ ছাড়াও ইবরাহীম থেকে মুরসালভাবে ইবনু মাসঊদ সূত্রে মাওকূফভাবে বর্ণিত হয়েছে, মারফূভাবে নয়। আর এটাই সঠিক অর্থাৎ মাওকূফ। বায়হাক্বী তার ‘সুনান’ গ্রন্থে বলেনঃ অনুরূপ বর্ণনা করেছেন হাম্মাদ ইবনু সালামাহ, হাম্মাদ ইবনু আবূ সুলায়মান থেকে, তিনি ইবরাহীম থেকে ইবনু মাসঊদ সূত্রে মুরসালভাবে।
(খ) উক্ত রিওয়ায়াতটিই বর্ণনা করেছেন বায়হাক্বী তার ‘খুলাফিয়াত’ গ্রন্থে তারই সনদে ইবরাহীম সূত্রে এভাবেঃ ‘‘ইবনু মাসঊদ (রাঃ) সালাত আরম্ভকালে তাকবীর দিয়ে রফ‘উল ইয়াদাইন করতেন কেবল একবার। এরপর আর রফ‘উল ইয়াদাইন করতেন না।’’ ইমাম হাকিম বলেনঃ এটাই সঠিক অর্থাৎ মাওকূফ। ইবরাহীম ইবনু মাসঊদের সাক্ষাৎ পাননি। সুতরাং বর্ণনাটি মুনকাতি (বিচ্ছিন্ন)। এছাড়া সনদের মুহাম্মাদ ইবনু জাবির সম্পর্কে হাদীসবিশারদ ইমামগণ সমালোচনা করেছেন। তার ব্যাপারে উত্তম কথা হচ্ছেঃ তিনি হাদীস চুরি করতেন। তার হাদীসে মুনকার ও মাওযু‘আতের আধিক্য রয়েছে। ইবনু ‘আদী বলেন, ইসহাক্ব ইবনু আবূ ইসরাঈল মুহাম্মাদ ইবনু জাবিরকে তার একদল শায়খের উপর মর্যাদা দিতেন। তার থেকে আইয়ূব, ইবনু ‘আওন, হিশাম ইবনু হাসসান, সাওরী, শু‘বাহ, ইবনু উ‘আইনাহ ও অন্যরা বর্ণনা করেছেন। তিনি সমালোচিত। তথাপি তার হাদীস লিখে রাখা হতো। তার ব্যাপারে ইমাম বুখারী বলেনঃ তিনি শক্তিশালী নন। ইবনু মাঈন বলেনঃ তিনি দুর্বল। (দেখুন, নাসবুর রায়াও অন্যান্য)।
(গ) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেনঃ ‘‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিছনে,আবূ বাকর ও উমার (রাঃ)-এর পিছনে ১২ বছর এবং ‘আলীর পিছনে কুফায় ৫ বছর সালাত আদায় করেছি। এরা কেউ রফ‘উল ইয়াদাইন করেননি।’’ এটাও বানানো হাদীস। এর বর্ণনাকারী আসবাগ ইবনু খালীল মালিকী মাযহাবের মুফতি ছিলেন। হাদীসের জ্ঞান ছিলো না। ইলমে হাদীস ও আসহাবে হাদীসের দুশমন ছিলেন। তিনি মালিকী মাযহাবের পক্ষে এ হাদীস তৈরী করেন। ইবনু মাসঊদের মৃত্যু হয় উসমানের খিলাফাতকালে। সুতরাং তার উক্তি ‘‘আমি আলীর পিছনে ৫ বছর সালাত আদায় করেছি’’ কত হাস্যকর। এ থেকে বুঝা যায় আসবাগ ইতিহাসের জ্ঞানে দুর্বল ছিলেন। তা না হলে এমন অপ্রয়োজনীয় ভুল করতেন না। (দেখুন, তাযকিরাতুল মাওযু‘আত, পৃঃ ৩৯)।
(ঘ) ইবনু মাসঊদ বলেনঃ ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত উঠাতেন আমরাও হাত উঠাতাম। তিনি হাত উঠানো ছেড়ে দিলেন আমরাও ছেড়ে দিলাম।’’ এ বর্ণনা বানানো এবং সনদ বিহীন।
(ঙ) ত্বাহাবী শারহু মাআনীতে বর্ণনা করেন যে, ইবরাহীম নাখায়ী বলেনঃ ‘‘ইবনু মাসঊদ কেবল সালাতের শুরুতে হাত উঠাতেন, এছাড়া অন্যত্র হাত উঠাতেন না।’’ এর সনদ মুনকাতি। ইমাম ত্বাহাবী বলেনঃ ইবরাহীম নাখায়ী ইবনু মাসঊদ সূত্রে সেই হাদীসকেই মুরসালভাবে বর্ণনা করেন, যা তার নিকট সহীহ ও একাধিকসূত্রে পৌঁছেছে।
রফ‘উল ইয়াদাইন না করার অন্যান্য দুর্বল ও ভিত্তিহীন বর্ণনাঃ
একঃ বারা‘আ ইবনু ‘আযিব (রাঃ) বর্ণিত হাদীস। যা সহীহ নয় বরং ভিত্তিহীন। সামনে ৭৪৯ ও ৭৫২ নং হাদীসের টিকায় এর আলোচনা আসবে।
দুইঃ ইবনু যুবায়র (রাঃ) বলেনঃ ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রফ‘উল ইয়াদাইন করতেন, পরে ছেড়ে দিয়েছেন।’’- এর কোনই ভিত্তি নেই। বরং ইবনু যুবায়র (রাঃ) সূত্রে রফ‘উল ইয়াদাইনের পক্ষেই সহীহ হাদীস বর্ণিত আছে।
তিনঃ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত হাদীসঃ
(ক) ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকু‘র সময় ও রুকু‘ থেকে উঠার সময় দু’ হাত তুলতেন। পরবর্তীতে তিনি সালাত শুরুর সময় বাদে অন্যত্র দু’ হাত তুলেননি।’’ এটিও ভিত্তিহীন হাদীস। বরং ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) সূত্রে সহীহভাবে রুকু‘ কালে ও রুকু থেকে উঠার সময় দু’ হাত তোলার হাদীস বর্ণিত আছে।
ইবনুল জাওযী (রহঃ) ‘আত-তাহক্বীক্ব’ গ্রন্থে বলেনঃ হানাফীদের ধারণা, ইবনু আব্বাস ও ইবনু যুবায়র বর্ণিত উপরোক্ত হাদীসদ্বয় দ্বারা রফ‘উল ইয়াদাইন মানসূখ হয়ে গেছে। অথচ হাদীস দু’টির কোনো ভিত্তিই নেই। বরং ইবনু আব্বাস ও ইবনু যুবায়র (রাঃ) সূত্রে এর বিপরীতে রফ‘উল ইয়াদাইনের পক্ষেই সুরক্ষিত (মাহফূয) বর্ণনা রয়েছে। তা হলোঃ একদা ইবনু আব্বাস (রাঃ)-কে মায়মূন আল-মাক্বী বললেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনু জুবায়র (রাঃ)-কে সালাতের শুরুতে, রুকু‘র সময়, সিজদার প্রাক্কালে এবং তৃতীয় রাক‘আতের জন্য দাঁড়ানোর সময় দু’ হাতে ইশারা (রফ‘উল ইয়াদাইন) করতে দেখেছি। এ কথা শুনে ইবনু আব্বাস (রাঃ) বললেন, তুমি যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সালাত দেখতে পছন্দ করো তাহলে ইবনু জুবায়রের সালাতের অনুকরণ করো। (হাদীস সহীহ, দেখুন, আবূ দাঊদ, ত্বাবারানী ‘কাবীর’ ১১/১৩৩, আহমাদ ১/২৫৫, ২৮৯)।
ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেনঃ যদি উক্ত বর্ণনাদ্বয় সহীহ হতো, তথাপি মানসুখ হওয়ার দাবী করা সঠিক হতো না। কেননা (কোনো হাদীস) নাসিখ হওয়ার জন্য সেটি মানসুখের চেয়ে অধিক মজবুত হওয়া শর্ত। (দেখুন, নাসবুর রায়াহ ও অন্যান্য)।
(খ) ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বানানো আরেকটি বর্ণনা। তিনি বলেনঃ ‘‘দশজন সুসংবাদ প্রাপ্ত সাহাবী রফ‘উল ইয়াদাইন করতেন না।’’ হাদীসটি বানানো। মৌলভী ‘আব্দুল হাই ফিরিংগী বলেনঃ এটার সনদ না পাওয়া পর্যন্ত এর কোনো মূল্য নেই। (দেখুন, আত-তা‘লিকুল মুমাজ্জাদ, পৃঃ ৭১)
(গ) ‘‘সাতটি স্থান ব্যতীত অন্যত্র হাত উঠানো যাবে না, যথাঃ সালাত আরম্ভকালে, মাসজিদুল হারামে প্রবেশের সময় বাইতুল্লাহ দেখাকালে, মারওয়াতে দাঁড়িয়ে, লোকদের সাথে আরাফায় অবস্থানকালে, জাম‘আতে এবং জামরাতে পাথর নিক্ষেপের সময় উভয় মাকামে।’’ (ত্বাবারানী কাবীর)
উপরোক্ত শব্দে হাদীসটি বাতিল। এর কয়েকটি দোষণীয় দিক রয়েছে। যেমনঃ
১. হাদীসটি বর্ণনায় ইবনু আবূ লায়লাহ একক হয়ে গেছেন। তার দ্বারা দলীল গ্রহণযোগ্য নয়। ইমাম বায়হাক্বী বলেন, তিনি মজবুত নন। বাযযার বলেন, তিনি হাফিয নন। তিনি এটি কখনো মারফূ আবার কখনো মাওকূফভাবে বর্ণনা করেছেন। ‘আবদুল হাক্ব ইশাবিলী ‘আল-আহকাম’ (১/১০২) গ্রন্থে বলেনঃ একাধিক সূত্রে এটি মাওকূফভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং ইবনু আবূ লায়লাহ হাফিয নন। হাফিয ‘আত-তাক্ববীর’ গ্রন্থে বলেন, একাধিক সূত্রে এটি মাওকূফভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং ইবনু আবূ লায়লাহ হাফিয নন। হাফিয ‘আত-তাক্ববীর’ গ্রন্থে বলেন, তিনি সত্যবাদী কিন্তু স্মরণশক্তি খারাপ। ইমাম যাহাবী ‘যুআফা’ গ্রন্থে বলেন, তার স্মরণশক্তি খারাপ। এজন্য তার বর্ণিত হাদীস সাধারণ দুর্বলের অন্তর্ভুক্ত না করে কঠিন দুর্বল হাদীসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
২. এ হাদীস যারা ইবনু আবূ লায়লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে ওয়াকী‘ সবচেয়ে প্রমাণযোগ্য। তিনি এটি ইবনু আব্বাস ও ইবনু উমারের মাওকূফ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
৩. তাবেঈনদের একদল সহীহ সনদসমূহ দ্বারা বর্ণনা করেছেন যে, ইবনু আব্বাস ও ইবনু উমার রুকু‘র সময় ও রুকু‘ থেকে উঠে রফ‘উল ইয়াদাইন করতেন।
৪. শু‘বাহ বলেন, মুকসিম থেকে হাকাম শুধুমাত্র চারটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাতে এ হাদীসটি নেই।
৫. হাদীসটির শব্দগত গড়মিল রয়েছে। কখনো এটি ‘লা তারফাউ’ শব্দে আবার কখনো কেবল ‘তারফাউ’ শব্দে বর্ণিত হয়েছে। সঠিক হচ্ছে ‘লা’ শব্দযোগে।
৬. হাদীসটি অন্যান্য সহীহ হাদীসসমূহের পরিপন্থি। কেননা মুতাওয়াতিরভাবে সহীহ হাদীসসমূহে উক্ত সাতটি স্থান ছাড়াও অন্যত্র রফ‘উল ইয়াদাইন করার কথা বর্ণিত হয়েছে। যেমনঃ দু‘আ করার সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাত উত্তোলন, সালাতে হাত উঠিয়ে দু‘আ করা এবং এ জন্য নির্দেশ প্রদান করা, কুনুতে নাজিলা ও বিতরের কুনুতে হাত উত্তোলন, জানাযার সালাতে প্রতি তাক্ববীরে হাত উত্তোলন, ইসতিসকার সালাতে হাত উত্তোলন, রুকু‘র আগে রুকু‘র পরে এবং দু’ রাক‘আত শেষে তৃতীয় রাক‘আতে দাঁড়ানোর সময় হাত উত্তোলন ইত্যাদি।
জ্ঞাতব্যঃ ‘মাযমাউয জাওয়ায়িদ’ গ্রন্থে হাইসামীর বক্তব্যঃ ‘এর সনদে ইবনু আবূ লায়লাহ রয়েছে। তার স্মরণশক্তি খারাপ এবং তার হাদীস হাসান ইনশাআল্লাহ।’ শায়খ আলবানী বলেনঃ কিন্তু তার এ বক্তব্য মুসতাকিম নয়। কেননা যে বর্ণনাকারীর স্মরণশক্তি খারাপ হয় তার বর্ণনা মারদূদ (প্রত্যাখ্যাত বর্ণনার) অন্তর্ভুক্ত হয়। যা উসলুল হাদীসে স্বীকৃত বিষয়। তিনি যদি এ কথার দ্বারা তার (মুতলাক) সাধারণ বর্ণনাকে বুঝান যা প্রকাশ্য (তবে সে কথা ভিন্ন)। কিন্তু তিনি যদি তার এ হাদীসকে হাসান বুঝান তাহলে তা কিভাবে সম্ভব? এর কোনো শাহিদ বর্ণনা নেই যা একে শক্তিশালী করবে যার দ্বারা এটি হাসান রূপান্তরিত হবে। অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মুতাওয়াতিরভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকু‘র সময়, রুকু‘র পরে, ইসতিসকার দু‘আ ও অন্যত্র দু’ হাত উঠিয়েছেন। আমাদের জন্য হাদীসটি প্রত্যাখ্যানের জন্য এ কথা উল্লেখ করা যথেষ্ট হবে যা ইমাম জায়লায়ী হানাফী ‘নাসবুর রায়াহ’ গ্রন্থে বলেছেন। ইমাম যায়লায়ী হানাফী (রহঃ) ‘নাসবুর রায়াহ’ গ্রন্থে বলেনঃ স্পষ্ট কথা এই যে, হাদীসটি মারফূ‘ ও মাওকুফ কোনোভাবেই সহীহ নয়।
অতঃপর তাবারানীর সনদে মুহাম্মাদ ইবনু ‘উসমান ইবনু আবূ শায়বাহ রয়েছে। তার সম্পর্কে বহু সমালোচনা আছে। অন্তত পক্ষে বিরোধপূর্ণ বিষয়ে তার হাদীস দলীলযোগ্য নয়। এই বৈশিষ্ট্য এখানে বিদ্যমান।
‘‘লা তারফাউ...’’ হাদীসটি ‘‘ওয়া ‘আলাল মাইয়্যিত’’ শব্দযোগে বর্ণিত হয়েছে। সেটির সনদও দুর্বল। সনদে ইবনু যুরাইজ এবং মুকসিমের মাঝে ইনকিতা (বিচ্ছিন্নতা) ঘটেছে। সম্ভবতঃ তাদের মাঝে ইবনু আবূ লায়লাহ ছিলো। এছাড়া সনদে সাঈদ ইবনু সালিমের স্মরণশক্তি খারাপ। (বিস্তারিত দেখুন, নাসবুর রায়াহ, সিলসিলাতুল আহদিসিস যঈফাহ, হা- ১০৫৪ ও অন্যান্য)।
(ঘ) ‘‘সিজদা দিতে হয় সাতটি অঙ্গে। যথাঃ দু’ হাত, দু’ পা, দু’ হাটু ও কপাল। আর হাত উত্তোলন করতে হয় কা‘বা দেখাকালে। সাফা ও মারওয়াতে, আরাফায়, জামা‘আতে, পাথর নিক্ষেপের সময় এবং সালাত ক্বায়িমের সময়।’’ (ত্বাবারানী কাবীর)
উল্লেখিত হাদীসে ‘হাত উত্তোলন করতে হয়...’ কথাগুলো মুনকার। হাদীসের এ দ্বিতীয় অংশটি বর্ণনাকারী ‘আত্বা ইবনু সায়িব একা বর্ণনা করেছেন। তার কারণে সনদটি দুর্বল। ‘আত্বা সংমিশ্রণ করতেন। যেমনটি হায়সামী, ইবনু হিব্বান ও অন্যান্যরা বলেছেন। (বিস্তারিত দেখুন, সিলসিলাহ যঈফাহ হাঃ/১০৫৩)।
চারঃ জাবির ইবনু সামুরাহ থেকে বর্ণিত, একদা আমাদের সালাতের হাত উত্তোলন অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে বললেনঃ ‘‘কি ব্যাপার! দুষ্ট ঘোড়ার লেজের ন্যায় হাত উত্তোলন করছো? সালাতে স্থিরতা অবলম্বন করো।’’
এ হাদীসের সাথে রুকু‘র আগে ও পরে রফ‘উল ইয়াদাইনের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। হাদীসটি সমস্ত মুহাদ্দিসগণই সালাম ও তাশাহুদ পরিচ্ছেদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যেমন, সহীহ মুসলিমে অনুচ্ছেদঃ সালাতে স্থিরতার নির্দেশ ও হাত দ্বারা ইশারা করা নিষেধ এবং সালামের সময় হাত উঁচু করা নিষেধ।’’, সহীহ ইবনু খুযাইমাহর অনুচ্ছেদঃ ‘‘সালাতরত অবস্থায় ডান ও বাম হাতের ইশারা করার ব্যাপারে তিরস্কার।’’, ইমাম নাসায়ী অনুচ্ছেদ বেঁধেছেন এভাবেঃ ‘‘সালাতরত অবস্থায় হাত দিয়ে সালাম দেয়া’’ ইত্যাদি। ইবনু হিব্বান, আবূ ‘আওয়ানাহ, ইমাম বায়হাক্বী এবং অন্যান্য মুরশিদগণও অনুরূপ পরিচ্ছেদ বেঁধেছেন।
তাই তো ইমাম নাববী (রহঃ) বলেন, জাবির ইবনু সামুরাহর হাদীস দ্বারা তারা অতি আশ্চর্য বস্তুর ন্যায় দলীল গ্রহণ করে এবং সুন্নাত দ্বারা অধিক নিন্দনীয় অজ্ঞতাপূর্ণ দলীল গ্রহণ করে। কেননা রুকু‘র আগে ও রুকু‘র পরে রফ‘উল ইয়াদাইন সম্পর্কে ঐ হাদীসটি বর্ণিত হয়নি। (দেখুন, সারাহ্ সহীহ মুসলিম ৩/৪০৩)।
ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, ঘটনাটি ছিলো তাশাহুদের অবস্থায় ক্বিয়ামের অবস্থায় নয়। তাঁদের (সাহাবীগণ) কেউ কেউ একে অন্যকে সালাতের মধ্যে সালাম দিতেন। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশাহুদে হাত উঠাতে নিষেধ করলেন। যাদের সামান্যতম জ্ঞান আছে তারা এ ধরণের হাদীস দ্বারা দলীল গ্রহণ করেননি। আর এটা সুপরিচিত, প্রসিদ্ধ, এতে কোনো মতভেদ নেই। আর যদি ব্যাপারটি ঐরূপ হয় তাহলে তো তাক্ববীরে তাহরীমায় হাত উত্তোলন, ঈদের সালাতে হাত উত্তোলনও নিষেধ হয়ে যাবে। কেননা এতে এক রফ‘উল ইয়াদাইন থেকে আরেক রফ‘উল ইয়াদাইনকে পার্থক্য করা হয়নি। জাবির ইবনু সামুরাহ বর্ণিত আরেক হাদীস বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট করেছে। তা হলোঃ জাবির ইবনু সামুরাহ বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিছনে সালাত আদায়কালে বলতাম, আসসালামু আলাইকুম, আসসালামু আলাইকুম। মিস‘আর তার দু’ হাত দিয়ে ইশারা করে দেখালেন। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কি হলো! এরা তাদের হাত দ্বারা ইশারা করছে, যেন দুষ্ট ঘোড়ার লেজের ন্যায়? তাদের জন্য যথেষ্ট হচ্ছে তারা তাদের হাতকে রানের উপর রাখবে, অতঃপর ডান দিকেও বাম দিকের ভাইকে সালাম করবে। (দেখুন, বুখারী জুযউ রফ‘উল ইয়াদাইন)।
পাঁচঃ ‘‘ইবনু উমার (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত হাদীসঃ তিনি যখন সালাত শুরু করতেন তখন দু’ হাত উত্তোলন করতেন। অতঃপর এরূপ আর করতেন না।’’ এ হাদীসটি বাতিল ও বানোয়াট। এটি বায়হাক্বী তার ‘খুলাফিয়াত’ গ্রন্থে মুহাম্মাদ ইবনু গালিব থেকে তিনি আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ আল বারতি থেকে তিনি ‘আবদুল্লাহ ইবনু আওন আল-খাররায থেকে তিনি মালিক থেকে তিনি যুহরী থেকে তিনি সালিম থেকে তিনি ইবনু উমার (রাঃ) থেকে মারফূ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
আমি (আলবানী) বলছিঃ বাহ্যিকভাবে সনদটি ভালো। এর দ্বারা কোনো কোনো হানাফী মতাবলম্বী ধোঁকায় পড়েছেন। হাফিয মুগলাতাই বলেনঃ তার সনদে সমস্যা নেই।
জানি না কিভাবে এ ধরণের হাফিয ব্যক্তি এমন কথা বলেন। অথচ বুখারী, মুসলিম, সুনানুল আরবাআহ ও মাসানীদ গ্রন্থসমূহ মালিক থেকে উক্ত সনদে ইবনু উমার থেকে রুকু‘তেও (যাওয়ার ও উঠার সময়) দু’ হাত উঠানোর প্রসিদ্ধ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বিশেষ করে হাদীসটি বর্ণনাকারী বায়হাক্বী ও তার শায়খ হাকিম উভয়ে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেনঃ ‘হাদীসটি বাতিল, বানোয়াট। আশ্চর্য হবার ও তার ত্রুটি বর্ণনা করার উদ্দেশ্য ছাড়া এটিকে উল্লেখ করাই জায়িয নয়। আমরা মালিক থেকে সুস্পষ্ট বহু সনদে এর বিপরীত হাদীস বর্ণনা করেছি।
হাদীসের অনুসারীদের বিপক্ষে হানাফী মাযহাবের চরম ভক্ত শায়খ মুহাম্মাদ আব্দুর রশীদ আন নুমানী ‘মাতামুসসু ইলাইহিল হাজাতু লিমান ইউতালিউ সুনান ইবনু মাজাহ’ (পৃঃ ৪৮-৪৯) গ্রন্থে বায়হাক্বী ও হাকিমের সমালোচনা করে বলেনঃ ‘ত্রুটির বিবরণ না দিয়ে শুধুমাত্র হাদীসটির দুর্বল হুকুম লাগানোর দ্বারা দুর্বলতা সাব্যস্ত হয় না। ইবনু উমারের এ হাদীসটি বর্ণনাকারীগণ সহীহ বর্ণনাকারী। এরপরে হাদীসটির দুর্বলতার কোনো কারণ দেখছি না।... এ হাদীসটি আমার নিকট সহীহ’!
আমি (আলবানী) বলছিঃ তার এ বক্তব্য দু’টি বস্তুর একটি প্রমাণ বহন করেঃ হয় এ ব্যক্তি মুহাদ্দিসগণের নিকট নির্ধারিত নিয়মনীতির পরোয়া করেন না, না হয় তিনি সেই বিষয়ে অজ্ঞ। অধিকাংশ ধারণা প্রথমটাই তার কাছে বিদ্যমান। কারণ আমি এমন ধারণা রাখি না যে, অজ্ঞতা হেতু তিনি সহীহ হাদীসের সংজ্ঞাই জানেন না। যে হাদীস সনদে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে ন্যায়পরায়ণ (নির্ভরযোগ্য) এবং পূর্ণাঙ্গ আয়ত্তশক্তি ও হিফযের গুণাবলী সম্মলিত বর্ণনাকারীর মাধ্যমে শায এবং ত্রুটিহীনভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাকেই বলা হয় সহীহ হাদীস।
যখন অবস্থা এই তখন বলতে হচ্ছে যে, মুহাদ্দিসগণের নিকট সহীহ হাদীস কাকে বলে সে সম্পর্কে তিনি হয় অজ্ঞ, না হয় তিনি সহীহ হাদীসের কোনো একটি শর্তের বিষয়ে অজ্ঞ। আর সেটি হচ্ছে হাদীসটি শায না হওয়া। ইমাম হাকিম ও বায়হাক্বী ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, হাদীসটি শায থেকে নিরাপদ নয়। তাদের উভয়ের এ কথা ‘আমরা মালিক থেকে সুস্পষ্ট বহু সনদে এর বিপরীত হাদীস বর্ণনা করেছি।’ তারই প্রমাণ বহন করেছে।
আমি (আলবানী) বলছিঃ হাকিম ও বায়হাক্বী শুধু দাবীর দ্বারা হাদীসটি বাতিল হওয়ার হুকুম লাগাননি। যেমন আন-নুমানী শাহেব বর্ণনা করেছেন। বরং যিনি বুঝাবেন তার জন্য তার সঙ্গে দলীলও নিয়ে এসেছেন। সেটি হচ্ছে শায হওয়া। (গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি তার মতই একাধিক বা তার চেয়ে উত্তম ব্যক্তির বিরোধিতা করে যে, হাদীসটি বর্ণনা করেন সেটিকে বলা হয় শায হাদীস)। এছাড়া হাদীসটির উপর যে হুকুম লাগানো হয়েছে তাকে শক্তিশালী করবে এরূপ আরো দলীল সামনের আলোচনায় আসবে।
যদি হাদীসটি বাতিল হওয়ার জন্য অন্য কোনো দলীল নাও থাকতো তাহলে ইমাম মালিকের ‘আল-মুয়াত্তা’ (১/৯৭) গ্রন্থে এর বিপক্ষে হাদীস বর্ণিত হওয়ায় তাই তা বাতিলের জন্য যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু আমরা দেখছি বহু গ্রন্থ রচনাকারী ও বর্ণনাকারী ইমাম মালিক থেকে আলোচ্য হাদীসটির বিপরীত হাদীস বর্ণনা করেছেন।
ইমাম বুখারী (২/১৭৪), আবূ আওয়ানাহ (২/৯১), নাসায়ী (১/১৪০, ১৬১-১৬২), দারিমী (১/২৮৫), শাফিঈ (১৯৯), ত্বাহাবী ‘শারহু মা‘আনিল আসার’ (১/১৩১) ও আহমাদ (৪৬৭৪, ৫২৭৯) বিভিন্ন সূত্রে ইমাম মালিক থেকে তিনি ইবনু শিহাব থেকে তিনি সালিম ইবনু ‘আব্দুল্লাহ থেকে তিনি তার পিতা আব্দুল্লাহ ইবনু উমার থেকে বর্ণনা করেছেনঃ ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দু’ হাত তাঁর কাঁধ বরাবর উঠাতেন যখন সালাত আরম্ভ করতেন, যখন রুকু‘র জন্য তাকবীর দিতেন এবং যখন রুকু‘ থেকে তাঁর মাথা উঠাতেন।’’ (আল-হাদীস) ভাষাটি ইমাম মালিক থেকে ইমাম বুখারীর।
বাস্তবতা এই যে, বাতিল হাদীসটির বিপরীতে এ হাদীসটি এ বাক্যে ইমাম মালিক থেকে মুতাওয়াতির বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে। ইবনু ‘আবদুল বার ইমাম মালিক থেকে বর্ণনাকারীগণের নাম উল্লেখ করেছেন। যারা সংখ্যায় ত্রিশজনের মতো।
তাছাড়া একদল নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী ইবনু শিহাব থেকে সহীহ হাদীসটি বর্ণনার ক্ষেত্রে তার (মালিকের) সাথে ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন।
এ হাদীসটিও ইমাম বুখারী, মুসলিম, আবূ আওয়ানাহ, আবূ দাঊদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, ত্বাহাবী, দারাকুতনী, ইমাম শাফিঈ, ইমাম আহমাদ বিভিন্ন সূত্রে ইবনু শিহাব থেকে বর্ণনা করেছেন।
‘‘... তাতে বলা হয়েছে ইবনু উমার (রাঃ) বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দেখেছি সালাত শুরু করার সময়, রুকু‘রেত যাওয়ার সময়, রুকু‘ থেকে উঠার সময় দু’ হাত উঠাতেন।’’
ইবনু উমারের দাস নাফি‘ বর্ণনাকারী সালিমের মুতাবা‘আত করেছেন। তাতে চার স্থানে হাত উঠানোর কথা বলা হয়েছে। চতুর্থ স্থানটি হচ্ছে দু’রাক‘আত শেষ করে তৃতীয় রাক‘আতের জন্য দাঁড়িয়ে।
এটি ইমাম বুখারী, আবূ দাঊদ, বায়হাক্বী বর্ণনা করেছেন্ ইবনু উমার (রাঃ) থেকে এরূপ আরো বর্ণনা এসেছে। আমরা যখন এটি বুঝলাম, তখন ইবনু উমার (রাঃ) থেকে এ সব বর্ণনা ও সহীহ সূত্রগুলো আলোচ্য হাদীসটি। বিভিন্নভাবে বাতিল হওয়ার প্রমাণ বহন করেঃ
১। আলোচ্য হাদীসে একজন বর্ণনাকারী ইমাম মালিক থেকে সকল বর্ণনাকারীর বিপরীত বর্ণনা করেছেন। যে দিকে ইমাম হাকিম ও বায়হাক্বী ইঙ্গিত করেছেন। বিশেষকরে যাদের বিরোধীতা করে বর্ণনা করা হয়েছে তারা সংখ্যায় মুতাওয়াতির পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন। একজন ব্যক্তি কর্তৃক এর চেয়ে কম সংখ্যক বর্ণনাকারীর বিরোধীতা করাতেই তার হাদীসটি শায ও পরিত্যক্ত হিসেবে গণ্য হয়।
২। ইমাম মালিকের নিকট যদি জানা থাকতো যে, এ আলোচ্য হাদীসটি তার থেকেই বর্ণনাকৃত, তাহলে তিনি সেটি অবশ্যই ‘আল-মুয়াত্তা’ গ্রন্থে বর্ণনা করতেন এবং তার উপর আমল করতেন। কিন্তু উভয়টি তার থেকে সংঘটিত হয়নি। কারণ তিনি আলোচ্য হাদীসের বিপরীত বর্ণনা করেছেন এবং তার উল্টা আমল করেছেন। ইমাম খাত্তাবী ও কুরতুবী বলেনঃ ইমাম মালিকের এটিই হচ্ছে শেষ মত।
৩। ইবনু উমার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যৃর পরে উল্লেখিত সময়গুলোতে হাত উঠানোর উপরেই আমল করেছেন। যেমনটি পূর্বের হাদীস উল্লেখ করার সময় বুঝা গেছে। তাছাড়া তার নিকট যদি আলোচ্য হাদীসটি সাব্যস্ত হতো তাহলে তিনি অবশ্যই তার উপর আমল করতেন। কিন্তু তার থেকে তা না হয়ে উল্টাটি সাব্যস্ত হয়েছে। ‘‘তিনি যখন কোনো ব্যক্তিকে দেখতেন যে, সে রুক‘ করার সময় এবং রুকু‘ থেকে উঠার সময় দু’ হাত উঠাচ্ছেন না তখন তিনি তাকে পাথর ছুঁড়ে মারতেন।’’ এটি ইমাম বুখারীর ‘জুযউ রফ‘উল ইয়াদাইন’ (পৃঃ ৮) গ্রন্থে আবদুল্লাহ ইবনু ইমাম আহমাদ ‘মাসায়িল আন আবীহ’ গ্রন্থে এবং দারাকুতনী (১০৮) তা থেকে সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। ইমাম ত্বাহাবী যে তার থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি শুধু মাত্র প্রথম তাক্ববীরের সময় হাত উঠিয়েছেন, সেটিও শায।
৪। ইবনু উমার (রাঃ) থেকে যিনি আলোচ্য হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাদের ধারণামতে তিনি হচ্ছেন তারই ছেলে সালিম। অথচ সালিম থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি উল্লিখিত সময়গুলোতে সালাতে দু’ হাত উঠাতেন। যেমনটি তিরমিযী তার থেকে বর্ণনা করেছেন। যে হাদীসটি সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে, তিনি (সালিম) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন সেটি যদি সত্য হতো তাহলে অবশ্যই তিনি তার বিরোধীতা করে উল্টা আমল করতেন না।
অতএব এ সব কিছু প্রমাণ করছে যে, হাকিম ও বায়হাক্বী হাদীসটি বাতিল বলে যে হুকুম লাগিয়েছেন তাই সঠিক।
শায়খ আন-নু‘মানি যে বলেছেনঃ এটি আমার নিকট সহীহ। তা অসম্ভব কথা।
উক্ত শায়খ যে বলেছেনঃ সর্বোচ্চ বলা যেতে পারে যে, ইবনু উমার (রাঃ) কখনো কখনো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হাত উঠাতে দেখেছেন। ফলে তিনি সেই অবস্থার সংবাদ দিয়েছেন। আর কখনো কখনো তাঁকে হাত উঠাতে দেখেননি। তখন তিনি সেই অবস্থার সংবাদ দিয়েছেন। তার প্রত্যেকটি হাদীস এরূপ প্রমাণ বহন করে না যে, নির্দিষ্ট করে তিনি একটি উপর সর্বদা আমল করেছেন। এছাড়া ‘কানা শব্দটি স্থায়িত্বের প্রমাণ বহন করে না।’ অধিকাংশ সময়ের প্রমাণ বহন করে।
আমি (আলবানী) বলছিঃ দু’টি বর্ণনাকে এভাবে একত্রিত করাও বাতিল। কারণ দু’টি বর্ণনাকে একত্রিত করার শর্ত হচ্ছে এই যে, উভয়টি সাব্যস্ত হতে হবে। এখানে একটি সহীহ আর অপরটি বাতিল। অতএব এরূপ দু’ মেরুর বর্ণনাকে একত্রিত করা জায়িয নয়। কিভাবে এটি সম্ভব যে, একই বর্ণনাকারী একবার বললেনঃ তিনি হাত উঠাতেন না আবার বললেন যে, তিনি হাত উঠাতেন। বর্ণনাকারী নিজেও কি একবারের জন্য উভয় ভাষাকে একত্রিত করেছেন? করেননি। এরূপ একত্রিত করণের দৃষ্টান্ত হাদীসের মধ্যে রয়েছে বলে আমরা জানি না! দু’টি সহীহ বর্ণনার ক্ষেত্রে একত্রিত করণের দৃষ্টান্ত রয়েছে। যদি কেউ প্রশ্ন করেন যে, বুঝলাম হাদীসটি বাতিল। তবে এ সমস্যাটি কার থেকে সৃষ্টি হয়েছে? এ সমস্যা ইমাম মালিক থেকে বর্ণনাকারী আবদুল্লাহ ইবনু আওন আল-খাররায থেকে, নাকি তার নীচের বর্ণনাকারী থেকে সৃষ্টি হয়েছে।
উত্তরঃ মুহাম্মাদ ইবনু গালিব ছাড়া অন্য কারো ক্ষেত্রে এরূপ ভুলের সন্দেহ করা যায় না। তার উপাধি হচ্ছে তামতাম। যদিও তাকে দারাকুতনী নির্ভরযোগ্য আখ্যা দিয়েছেন। তবে তিনি এ কথাও বলেছেনঃ তিনি ভুল করতেন। তিনি কতিপয় হাদীসের সন্দেহ করেছেন। ইবনুল মানাবী বলেনঃ তার থেকে লোকেরা লিখেছেন। অতঃপর হাদীস ও অন্য বস্ত্তর ক্ষেত্রে তার মন্দ খাসলতের কারণে তার থেকে অধিকাংশই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
বাহ্যিকতা প্রমাণ করেছে যে, আলোচ্য হাদীসটির ক্ষেত্রে তিনি ভুল করেছেন। সম্ভবতঃ তার এ হাদীসটি সেই সবগুলোর একটি যেগুলোর দিকে দারাকুতনী ইঙ্গিত করেছেন। (দেখুন, শায়খ আলবানীর যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ, হাঃ- ৯৪৩)।
* ইবনু উমার সূত্রে আরো কয়েকটি ভিত্তিহীন মাওকূফ বর্ণনাঃ
(ক) মুজাহিদ বলেনঃ ‘‘আমি ইবনু উমারের সাথে দশ বছর ছিলাম কিন্তু আমি তাকে রফ‘উল ইয়াদাইন করতে দেখিনি।’’ এটি সনদহীন এবং মিথ্যা বর্ণনা।
(খ) সিওয়ার ইবনু মুসআব থেকে আতিয়্যাহ আল-আওফী সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আবূ সাঈদ খুদরী ও ইবনু উমার (রাঃ) কেবল তাকবীরে তাহরীমাহর সময় হাত উঠাতেন এরপর হাত উঠাতেন না। (বায়হাক্বী)।
ইমাম বায়হাক্বী (রহঃ) বলেনঃ ‘ইমাম হাকিম বলেছেনঃ বর্ণনাকারী আতিয়্যাহর অবস্থা মন্দ, এবং তার সূত্রে বর্ণনাকারী সিওয়ারের অবস্থা তার চেয়েও খারাপ।’ ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেনঃ সিওয়ার ইবনু মুসআব মুনকারুল হাদীস। ইবনু মাঈন বলেনঃ তিনি দলীলের অযোগ্য। (দেখুন, নাসবুর রায়াহ ও অন্যান্য)।
ছয়ঃ ইমাম আবূ হানিফা (রহঃ)-এর নামে বাতিল ও মিথ্যা বর্ণনাঃ
(ক) ‘‘যে ব্যক্তি সালাতে তার দু’ হাত উঠাবে তার সালাত নষ্ট হয়ে যাবে।’’ বর্ণনাটি বাতিল ও ভিত্তিহীন। শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, এ বর্ণনার কারণে আমির কাতিবুন ইতকানী অজ্ঞাতভাবে তার উপর ভিত্তি করে রফ‘উল ইয়াদাইন দ্বারা সালাত বাতিল হওয়ার বিবরণ দিয়ে একটি কিতাব রচনা করেছেন। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি তার কথায় চলেছে সে এ বর্ণনার দ্বারা অতর্কিত আক্রমণ করে কোনো হানাফী ব্যক্তির শাফিঈর পিছনে সালাতে ইকতিদা করা নাজায়িয হওয়ার ফায়সালা দিয়েছেন। কারণ তারা সালাতে রফ‘উল ইয়াদাইন করেন! (নাউযুবিল্লাহ)। যদিও ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) থেকে এ বর্ণনাটি বাতিল, যেমনটি আল্লামা আবূল হাসনাত লাখনৌভী (রহঃ) ‘আল-ফাওয়ায়িদুল বাহিয়্যাহ ফী তারাজিমিল হানাফীয়্যাহ’ গ্রন্থে তাহক্বীক্ব করেছেন। (দেখুন, আলবানীর ‘যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ’ ২য় খ, ৫৬৮৯ হাদীসের নীচে)।
(খ) মিথ্যা মুযারা তৈরীঃ একদা ইমাম আওযায়ী (রহঃ) ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-কে বললেনঃ এ কি ব্যাপার! আপনি রুকু‘র পূর্বে ও পরে রফ‘উল ইয়াদাইন করেন না? ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) বললেনঃ কারণ এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোনো হাদীস নেই। ইমাম আওযায়ী (রহঃ) বলেনঃ কিভাবে সহীহ নয়? আমার কাছে ইমাম যুহরী, সালিম এবং আবদুল্লাহ ইবনু উমারের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন যে, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের শুরুতে, রুকু‘র পূর্বে ও রুকু‘র পরে রফ‘উল ইয়াদাইন করতেন।’ ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) বললেনঃ আমাকে হাম্মাদ বলেছেন ইবরাহীম ও আলকামার মাধ্যমে, ইবনু মাসঊদ বলেছেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের শুরুতে হাদ উঠিয়েছেন এরপর আর হাত উঠাননি। (ফাতহুল কাদীর ১/২১৯, কাবীরী ১১৬ পৃঃ)।
উক্ত ঘটনার সনদ ও মাতান উভয়ই মিথ্যা সাজানো। যেমনঃ
১। মুনাযারার সালাত বিশ্লেষণঃ এ বির্তকের বর্ণনাসূত্রে তিনজন বর্ণনাকারী অর্থাৎ সুলাইমান শাযকূনী, হারিসী ও মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম হাদীস জালকারী। (দেখুন, আত-তাহক্বীকুল রাসিখ ১৭৫ পৃঃ আবূ যুহরা রচিত হায়াতে আবূ হানীফা গ্রন্থে ৪৩৯ পৃঃ টিকা, সালাতুল মুসলিমীন ৪৬১ পৃঃ, সালাতে মুস্তাফা ১২১ পৃঃ)।
২। মুনাযারার মাতান বিশ্লেষণঃ ‘মাসায়েলে রফ‘উল ইয়াদাইন’ গ্রন্থে এর মাতান বিশ্লেষণে যে আলোচনা করা হয়েছে তা নিম্নরূপঃ
একঃ ইমাম আবূ হানীফার উক্তিঃ ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে রফ‘উল ইয়াদাইনের কোনো সহীহ হাদীস নেই।’’- ইমাম ইবনু আবূ হানীফা (রহঃ) এর দিকে এ কথা সম্পৃক্ত করা কত বড় হাস্যকর ব্যাপার। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রফ‘উল ইয়াদাইনের হাদীস সহীহুল বুখারী, সহীহ মুসলিম, মুয়াত্তা ইমাম মালিকের শ্রেষ্ঠতম সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। এ সময় হাদীসের সনদে রাবী দীনের বড় বড় ইমাম ছিলেন। যেমন, ইমাম যুহরী (রহঃ), ইমাম সালিম (রহঃ), ‘আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ)। বলুন তো, এদের মধ্যে কোনো যঈফ রাবী আছেন কি? আবূ দাঊদের সনদের রাবীগণ হলেন- ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রহঃ), ইমাম সুফয়ান (রহঃ), ইমাম যুহরী (রহঃ), ইমাম সালিম (রহঃ), ‘আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ)। কত বড় উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ইমামগণ এই হাদীসের সনদে আছেন। এছাড়া অসংখ্য সাহাবীদের অসংখ্য সহীহ সনদে রফ‘উল ইয়াদাইন প্রমাণিত আছে। কেবল পক্ষের লোকই নয় বরং বিপক্ষের লোকেরাও এর সহীহ হওয়ার স্বীকৃতি দিয়েছেন।
ইমাম আবূ হানীফাহর (রহঃ)-এর নিকট নিশ্চয়ই এ হাদীস পৌঁছেছে। এ হাদীসগুলোর রাবীগণ ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর উস্তাদও ছিলেন এবং এরা সকলেই রফ‘উল ইয়াদাইন করতেন। যেমন, ইমাম মালিক (রহঃ), ইমাম ‘আত্বা ইবনু আবূ রিবাহ (রহঃ), ইমাম আওযায়ী (রহঃ), ইমাম মাকহূল (রহঃ), ইমাম আমর ইবনু মুররাহ (রহঃ), ইমাম তাউস (রহঃ), ইমাম আবদুল্লাহ বিন দীনার (রহঃ), ইমাম যুহরী (রহঃ), ইমাম উবাইদুল্লাহ ইবনু উমার (রহঃ), ইমাম সালিম (রহঃ), ইমাম মুহাররব (রহঃ), ইমাম কাতাদাহ (রহঃ), ইমাম শু‘বাহ (রহঃ), ইমাম আসিম (রহঃ), ইমাম আবদুর রাহমান ইবনু আরায (রহঃ), ও অন্যান্য ইমামগণ। এটা কি করে সম্ভব যে, এই ইমামগণের ছাত্র হওয়ার পরও ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) রফ‘উল ইয়াদাইনের হাদীস জানতেন না? এ সমস্ত ইমামগণ কি তাহলে স্বীয় ছাত্রের কাছে রফ‘উল ইয়াদাইনের হাদীস গোপন করেছেন? স্বীয় ছাত্রকে এ সমস্ত হাদীস পড়াননি?
এবার ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর ছাত্রদের দিকে তাকানো যাক। দেখা যাবে তারাও রফ‘উল ইয়াদাইনের হাদীস বর্ণনা করেছেন। যেমন, ইমাম মুহাম্মাদ (রহঃ), ইমাম ‘আফিয়াহ (রহঃ), ইমাম ফাযল ইবনু দাকীন (রহঃ), ইমাম ইবরাহীম ইবনু ত্বাহমান (রহঃ) এবং আরো অনেকে। এরা সকলেই রফ‘উল ইয়াদাইনের হাদীসের রাবী। এরপর ইয়াহইয়াহ ইবনু সাঈদ আল-কাত্তান, ইমাম ‘আবদুল্লাহ ইবনু মুবারাক, ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (রহঃ) ও ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর ছাত্র। এরা রফ‘উল ইয়াদাইনের হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং সালাতে রফ‘উল ইয়াদাইনও করেছেন। তারপর তাদের ছাত্ররাও দ্বীনের বড় বড় ইমাম ছিলেন। তারাও রফ‘উল ইয়াদাইনের হাদীসের রাবী এবং আমলকারী। অর্থাৎ ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর উপরে ও নীচের মুহাদ্দিসগণ রফ‘উল ইয়াদাইন করতেন। মাঝখান থেকে ইমাম আবূ হানীফা বাদ থেকে যাচ্ছেন। এই আলোচনার মূল দাবী হলো- ‘‘ রফ‘উল ইয়াদাইনের কোনো সহীহ হাদীস নেই’’- এ কথাটি ইমাম আবূ হানীফার প্রতি ভুল ও মিথ্যা আরোপ।
দুইঃ যদি মেনে নেয়া হয় তথা কথিত উক্ত ঘটনা ইমাম আবূ হানীফাহ (রহঃ)-এর দাবী সত্য ছিলো অর্থাৎ রফ‘উল ইয়াদাইনের কোনো সহীহ হাদীস নেই, তাহলে ইমাম আওযায়ী যখন সনদসহ হাদীস বর্ণনা করলেন, তখন স্বীয় দাবী অনুযায়ী ঐ হাদীসের সনদকে যঈফ প্রমাণ করার দরকার ছিলো। কিন্তু তিনি তা করেননি। ফলে প্রকারন্তে তিনি হাদীসটিকে সহীহ প্রমাণ করলেন।
তিনঃ ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) এক সহীহ হাদীসের মুকাবিলায় আর এক সহীহ হাদীস পেশ করলেন। এটা হাদীস উপস্থাপনের উত্তম পন্থা নয়। এর মাধ্যমে তো হাদীসের মধ্যে দন্দ্ব সৃষ্টি করা হলো। যদি দু’টোই সহীহ হয়, তাহলে দু’টোকেই মানতে হবে। তাছাড়া ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর বর্ণিত হাদীসের রুকু‘র সময় হাত উঠানোর সুস্পষ্ট বর্ণনা নেই। (দেখুন, মাসায়িলের রফ‘উল ইয়াদাইন)
অতএব প্রমাণিত হলো, ‘‘ রফ‘উল ইয়াদাইনের কোনো সহীহ হাদীস নেই।’’- এটা ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর উক্তি নয়। বরং উক্ত ঘটনা তাঁর নামে সাজানো মিথ্যামাত্র।
উল্লেখ্য, ইমাম বুখারী, ইমাম বায়হাক্বী এবং আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ (রহঃ) ইমাম আবূ হানীফার সাথে ইবনুল মুবারাকের এক বির্তকের বর্ণনা দিয়েছেন। তা এরূপঃ ওয়াকি (রহঃ) বলেন, ‘‘একদা আমি কুফার মসজিদে সালাত আদায় করি। তখন সেখানে আবূ হানীফা ও আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (রহঃ) পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাকত (রহঃ) রুকু‘র সময় ও রুকু‘ থেকে উঠার সময় দু’ হাত তুলছিলেন কিন্তু আবূ হানীফাত তুলছিলেন না। সালাত শেষে আবূ হানীফা (রহঃ) ইবনুল মুবারাক (রহঃ)-কে বললেন, কি ব্যাপার! তুমি অধিক হস্তদ্বয় উত্তোলন করছো, তুমি কি পাখি হয়ে উড়ে যেতে চাচ্ছো নাকি? অতঃপর ইবনুল মুবারাক বললেন, হে আবূ হানীফা! তোমাকে দেখলাম সালাত আরম্ভের সময় দু’ হাত উত্তোলন করছো, অতএব তুমি কি পাখি হয়ে উড়ে যেতে চাচ্ছো? জবাব শুনে আবূ হানীফা চুপ হয়ে গেলেন।’’ ‘জুযউ রফ‘উল ইয়াদাইন’ গ্রন্থে রয়েছেঃ ইবনুল মুবারাক বললেন, আমি যদি প্রথমবারে উড়ে না যাই, তাহলে দ্বিতীয়বারেও উড়বো না।’’ আর আবদুল্লাহ বিন আহমাদের বর্ণনায় রয়েছেঃ ‘‘ইবনুল মুবারাক বললেন, হে আবূ হানীফা! তুমি যদি প্রথমবারে উড়ে যেয়ে থাকো তাহলে আমি প্রথমবার ছাড়াও উড়ে থাকি।’’
ওয়াকী (রহঃ) বলেন, ইবনুল মুবারাকের উপর আল্লাহ রহম করুন! এটা ছিলো উপস্থিতি উত্তর। ইমাম আবূ হানীফাকে আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারাক একবার বা দু’ বার যে উত্তর দিয়েছেন তা ছিলো অতি উত্তম উত্তর। তাকে এর চেয়ে আর অধিক উপস্থিত উত্তর দিতে দেখিনি। (দেখুন, বুখারীর জুযউ রফ‘উল ইয়াদাইন, বায়হাক্বী ২/৮২, কিতাবুস সুন্নাহ ১/২৭২)।
সাতঃ আর একটি বানোয়াট হাদীসঃ ‘‘যে ব্যক্তি সালাতে তার দু’ হাত উঠাবে তার সালাতই হবে না।’’
হাদীসটি ইবনু ত্বাহীর তাজকিরাতুল মাউযু‘আত গ্রন্থে উল্লেখ করে বলেন, এর সনদে মামূন ইবনু আহমাদ আল-হারাবী রয়েছে। সে হাদীস জালকারী। ইমাম যাহাবী বলেন, সে মহাবিপদ ও অপদস্থমূলক বস্তু নিয়ে এসেছে। সে নির্ভরযোগ্যদের সূত্র দিয়ে হাদীস জাল করে, এটি সেগুলোর একটি। আবূ নুয়াইন বলেন, সে জালকারী খবীস, সে নির্ভরযোগ্যদের সূত্র দিয়ে জাল হাদীস বর্ণনা করে।
সহীহুল বুখারীর ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘তাসহীলুল ক্বারী‘তে রয়েছেঃ রফ‘উল ইয়াদাইন করলে সালাত হবে না’ এ মর্মে আনাস সূত্রে মুহাম্মাদ ইবনু ‘উকাশাহ এবং আবূ হুরাইরাহ সূত্রে মামূন ইবনু আহমাদ মিথ্যা হাদীস বানিয়েছেন। (দেখুন, তাসহীলুল ক্বারী শারহে বুখারী)।
আনাস বর্ণিত হাদীসটি হাকিম ‘মুদখাল’ গ্রন্থে বর্ণনার পর বলেন, হাদীসটি মাওযু (বানোয়াট) তিনি ‘বাদরুল মুনীর’ গ্রন্থে বলেনঃ এর সনদে মুহাম্মাদ ইবনু উকাশাহ রয়েছে। তার সম্পর্কে ইমাম দারাকুতনী বলেন, সে হাদীস বানাতো। আর ইবনু জাওযী আবূ হুরাইরাহর হাদীসকে বানোয়াট হাদীসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। (দেখুন, নায়লুল আওতার)
আটঃ আসওয়াদ বলেনঃ আমি দেখেছি, ‘উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) প্রথমবার তাক্ববীরে তাহরীমার সময় হাত উঠিয়েছেন। এরপর আর উঠাননি।’ তিনি আরো বলেন, আমি ইবরাহীম ও শা‘বীকেও দেখেছি। (ত্বাহাবী)
ইমাম ত্বাহাবী বলেন, ‘উমার (রাঃ) কেবল প্রথমবার হাত উঠিয়েছেন মর্মে আসারটি সহীহ। কিন্তু ইমাম হাকিম তার বিরোধীতা করে বলেনঃ এ বর্ণনাটি শায। এর দ্বারা দলীল প্রতিষ্ঠিত হবে না। বিশুদ্ধ হাদীসসমূহ এর বিরোধীতা করছে। যেমন, তাউস ইবনু কায়সান থেকে ইবনু উমার (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ ‘‘‘উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) রুকু‘র সময় এবং রুকু‘ থেকে উঠার সময় রফ‘উল ইয়াদাইন করতেন।’’ (দেখুন, নাসবুর রায়াহ ও অন্যান্য)।
নয়ঃ বায়হাক্বী ‘আল-খিলাফিয়াত’ গ্রন্তে বর্ণিত আছে যে, ‘উব্বাদ ইবনু যুবায়র (রাঃ) বলেনঃ ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত আরম্ভের সময় রফ‘উল ইয়াদাইন করতেন। এরপর সালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত রফ‘উল ইয়াদাইন করতেন না।’’- এ বর্ণনাটিও দলীলের অযোগ্য। প্রথমতঃ এটি মুরসাল বর্ণনা। কারণ বর্ণনাকারী উব্বাদ একজন তাবেঈ। দ্বিতীয়তঃ এর তিনজন বর্ণনাকারী দুর্বল। যেমন, ১. বর্ণনাকারী হাফস ইবনু গিয়াসের স্মরণশক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ২. মুহাম্মাদ ইবনু আবূ ইয়াহইয়া সমালোচিত। ৩. মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক্ব ইবনু ইবরাহীম ইবনু মুহাম্মাদ উক্বাসা হাদীস বানাতো। (দেখুন, তাসহীলুল ক্বারী)।
দশঃ আলী (রাঃ)-এর মাওকূফ বর্ণনাঃ আবূ বাকর আন-নাহশালী থেকে ‘আসিম ইবনু কুলাইব থেকে তার পিতার মাধ্যমে বর্ণিতঃ ‘আলী (রাঃ) সালাতে প্রথমে তাক্ববীরে তাহরীমাহর সময়ে দু’ হাত উঠাতেন। এরপর হাত উঠাতেন না। (ত্বাহাবী)।
ইমাম ত্বাহাবী বলেনঃ এ আসারটি সহীহ। কিন্তু শায়খ ‘আল-ইমাম’ গ্রন্থে বলেনঃ ‘উসমান ইবনু সাঈদ আত-দারিমী বলেনঃ ‘এটি দুর্বল বর্ণনা। এর সনদ সূত্র নিকৃষ্ট। আর ‘আলী (রাঃ) সম্পর্কে এরূপ ধারণা করা যায় না যে, তিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কর্মের উপর নিজের কর্মকে প্রাধান্য দিবেন। কেননা ‘আলী (রাঃ) নিজেই বর্ণনা করেছেন যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকু‘র সময় এবং রুকু‘ থেকে উঠার সময় রফ‘উল ইয়াদাইন করতেন।’ ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেনঃ এ বিষয়ে আলী (রাঃ)-এর সূত্রে উবাইদুল্লাহ ইবনু আবূ রাফী‘র হাদীসটি অধিক সহীহ। তা হচ্ছেঃ ‘আলী ইবনু আবূ তালিব (রাঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফারয সালাতে দাঁড়িয়ে তাক্ববীর বলে তাঁর দু’ হাত কাঁধ পর্যন্ত উঠাতেন। তিনি ক্বিরাআত শেষে রুকু‘তে গমনকালে এবং রুকু‘ থেকে উঠার সময়ও অনুরূপ করতেন। তবে বসে সালাত আদায়কালে তিনি এরূপ হাত তুলতেন না। তিনি দু’ সিজদার পর (অর্থাৎ দু’ রাক‘আত শেষে) দাঁড়ারে হাত উঠিয়ে তাক্ববীর বলতেন।’’ (আবূ দাঊদ- অধ্যায়ঃ সালাত, হাঃ ৭৪৪, তিরমিযী- অধ্যায়ঃ দা‘ওয়াত, হাঃ ৩৪২৩, ইবনু মাজাহ- অধ্যায়ঃ সালাত ক্বায়িম, অনুঃ রফ‘উল ইয়াদাইন, হাঃ ৮৬৪, আহমাদ ১/৯৩, সকলে সুলাইমান ইবনু দাঊদ সূত্রে। ইমাম তিরমিযী বলেনঃ হাদীসটি হাসান সহীহ। শায়খ আলবানী (রহঃ)ও হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন। আহমাদ মুহাম্মাদ শাকির বলেনঃ এর সনদ সহীহ। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রহঃ)-কে ‘আলীর এ হাদীস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেনঃ হাদীসটি সহীহ)।
* উল্লেখ্য কতিপয় নির্বোধ লোকের উক্তি আছে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে নতুন ঈমান আনা লোকেরা না কি সালাতে বোগলে পুতুল বা অস্ত্র রাখতেন, সেজন্য নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে রফ‘উল ইয়াদাইন করার হুকুম করেন। পরে তাদের ঈমান মজবুত হলে রফ‘উল ইয়াদাইন রহিত হয়ে যায়। এরূপ উক্তি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আর এ ধরণের কথা তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণের ঈমানের প্রতি সন্দেহ পোষণ ও সহাবায়ি কিরামের উপর মিথ্যা অপবাদেরই নামান্তর। আল্লাহ আমাদের এরূপ মিথ্যা থেকে হিফাযাত করুন- আমীন!
সারকথাঃ উপরোল্লিখিত আলোচনায় এটাই প্রতিয়মান হলো যে, রফ‘উল ইয়াদাইন না করার কোনো মজবুত দলীল নেই। বরং এ সম্পর্কিত হাদীসসমূহ দোষযুক্ত। সেহেতু এগুলো বর্জন করা শ্রেয়।