পরিচ্ছেদঃ ১২৩. তায়াম্মুমের বর্ণনা
৩১৭। ’আয়িশাহ্ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ’আয়িশাহ্ (রাঃ) এর হারানো হার অনুসন্ধানের জন্য উসাইদ ইবনু হুদাইর এবং তার সাথে আরো কয়েকজনকে পাঠালেন। পথিমধ্যে সালাতের ওয়াক্ত হলে লোকেরা বিনা অযুতেই সালাত আদায় করেন। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে তাঁরা বিষয়টি তাঁকে জানান। তখনই তায়াম্মুমের আয়াত নাযিল হয়। নুফাইলের বর্ণনায় আরো রয়েছেঃ উসাইদ ইবনু হুদাইর (রাঃ) ’আয়িশাহ্ (রাঃ)-কে বললেন, আল্লাহ আপনার প্রতি রহম করুন। আপনার নিকট অপছন্দনীয় একটি বিষয়ের উপলক্ষেই আল্লাহ মুসলিমদের জন্য এবং আপনার জন্য সহজ একটি বিধান নাযিল করেছেন।[1]
সহীহ : বুখারী ও মুসলিম।
[1] বুখারী (অধ্যায়ঃ তায়াম্মুম, হাঃ ৩৩৪, এবং অনুঃ যখন পানি ও মাটি কোনটিই পাওয়া যাবে না, হাঃ ৩৩৬), মুসলিম (অধ্যায়ঃ হায়িয, অনুঃ তায়াম্মুম সম্পর্কে) একাধিক সনদে হিশাম ইবনু ‘উরওয়াহ থেকে তার পিতার সূত্রে।
-
তায়াম্মুম সম্পর্কে যা জানা জরূরীঃ
(ক) তায়াম্মুম পরিচিতিঃ তায়াম্মুম অর্থ সংকল্প করা। ইসলামী পরিভাষায়ঃ পানি না পাওয়া গেলে উযু ও গোসলের পরিবর্তে শারঈ পদ্ধতিতে পাক মাটি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করাকে তায়াম্মুম বলা হয়।
মহান আল্লাহ বলেনঃ যদি তোমরা অসুস্থ হও, কিংবা সফরে থাকো, কিংবা পায়খানা থেকে আসো, অথবা স্ত্রী সহবাস করে থাকো, অতঃপর পানি না পাও, তাহলে তোমরা পাক মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করো এবং তোমাদের মুখমণ্ডল
ও দু’ হাত মাসাহ্ করো। (সূরা মায়িদাহ, আয়াত ৬)
(খ) তায়াম্মুমের কারণঃ (১) উযু বা গোসলের জন্য পবিত্র পানি না পাওয়া গেলে (২) পানি পেতে গেলে সালাতের ওয়াক্ত ছুটে যাওয়ার আশংকা হলে (৩) পানি ব্যবহারে রোগ বৃদ্ধির ভয় বা মৃত্যুর আশংকা থাকলে (৪) পানি পেতে গেলে শত্রুর ভয় বা জীবনের ঝুঁকি থাকলে (৫) পিপাসার পানি ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় থাকলে ইত্যাদি। এ সকল কারণে উযু ও ফরয গোসলের পরিবর্তে প্রয়োজনে দীর্ঘদিন পর্যন্ত তায়াম্মুম করা যাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিশ্চয় পাক মাটি মুসলিমদের জন্য উযু স্বরূপ। যদিও দশ বছর পর্যন্ত পানি না পাওয়া যায়। (আহমাদ, আবূ দাঊদ, তিরমিযী)
(গ) এক নজরে তায়াম্মুম সম্পর্কিত কতিপয় মাসআলাহঃ
(১) মাটি, বালি, পাথুরে মাটি ইত্যাদি মাটি জাতীয় সব ধরণের জিনিসের দ্বারা তায়াম্মুম করা জায়িয, যদিও তাতে ধূলাবলি না থাকে। কিন্তু ধূলা-মাটিহীন স্বচ্ছ পাথর, কয়লা, কাঠ, মোজাইক, চুন ইত্যাদি দ্বারা তায়াম্মুম করা জায়িয কি না এ নিয়ে মতভেদ আছে। দেয়াল বা অন্য পাক স্থানে যেখানে ধূলাবালি লেগে আছে, সেখানে তাত মেরে তায়াম্মুম করা যায়। কিন্তু দেয়ালে যদি তৈলাক্ত পদার্থ থাকে তবে তাতে তায়াম্মুম করা যাবে না। আর যদি মাটিতে, দেয়ালে বা অন্যত্র ধূলা না পাওয়া যায়, তাহলে কোনো পাত্রে বা রুমালে ধূলা নিয়ে তাতে হাত মেরে তায়াম্মুম করা যাবে।
(২) পানির দ্বারা পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে যেসব কাজ করা যয় তায়াম্মুম দ্বারাও সেসব কাজ করা যাবে। যেমন, সালাত আদায়, কুরআন পড়া ও স্পর্শ করা, মসজিদে প্রবেশ ইত্যাদি। (নায়লুল আওত্বার, ১/৩১১)।
(৩) যেসব কারণে উযু ভঙ্গ হয় সেসব কারণে তায়াম্মুমও ভঙ্গ হয়। তায়াম্মুম অবস্থায় পানি পাওয়া গেলে তায়াম্মুম ভঙ্গ হয়ে যাবে। উযু ও গোসলের পরিবর্তে যে তায়াম্মুম করতে হয় তার নিয়ম একই। এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। (আইনী তুহফা)।
(৪) তায়াম্মুম করে সালাত আদায়ের পর ওয়াক্তের মধ্যে পানি পাওয়া গেলে পুনরায় ঐ সালাত আদায় করতে হবে না। (আবূ দাঊদ, নাসায়ী, দারিমী)।
(৫) তায়াম্মুম করে ইমামতি করা যাবে। যেমন ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) করেছেন- (সহীহুল বুখারী)। অধিকাংশ ‘আলিমের (জমহুর ‘উলামার) মতেও তায়াম্মুম করে উযু কারীদের সালাতে ইমামতি করা জায়িয। (‘উমদাতুল ক্বারী)।
(৬) পাক মাটি বা পানি কিছুই না পাওয়া গেলে বিনা উযুতেই সালাত আদায় করবে- (সহীহুল বুখারী)। তবে এ সালাতের ক্বাযা করতে হবে কি না এ নিয়ে মতভেদ আছে।
(৭) তায়াম্মুম নষ্ট না হলেও প্রতি ওয়াক্ত সালাতের জন্য তায়াম্মুম করা জায়িয। এরূপ করাকে কেউ ওয়াজিব এবং কেউ মুস্তাহাব বলেছেন।
(৮) জুনুবী ব্যক্তি যখমী হলে যদি ক্ষত বৃদ্ধির ভয় থাকে কিংবা প্রচন্ড শীতে ঠান্ডা লাগার আশংকা থাকে তাহলে গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করবে। (আবূ দাঊদ, দারাকুতনী, আহমাদ, নায়লুল আওত্বার, ই‘লাউস সুনান)।
(৯) যে ব্যক্তির কাছে পানি নেই তার জন্যও সহবাস করার অনুমতি আছে। (ত্বাবারানী, ইবনু হিব্বান, দারাকুতনী, নায়লুল আওত্বার)।
(১০) যে ব্যক্তি আখিরী ওয়াক্তে পানি পাওয়ার আশাবাদী, তার জন্য আওয়াল ওয়াক্তে তায়াম্মুম করা জায়িয। (মালিক, ই‘লাউস সুনান)।
(১১) যে ব্যক্তি ওয়াক্তের মধ্যেই পানি পাওয়ার আশাবাদী, তার জন্য বিলম্বে তায়াম্মুম করা উত্তম। (দারাকুতনী, ‘আলীর মাওকূফ বর্ণনা, ই‘লাউস সুনান)।
(১২) উযু করতে যাওয়ার কারণে যদি জানাযার সালাত ছুটে যাওয়ার আশংকা হয়, তাহলে এ অবস্থায় তায়াম্মুম করা জায়িয আছে কি না এ সম্পর্কে ফাক্বীহদের মধ্যে মতভেদ আছে। ইমাম আবূ হানিফা, সুফিয়ান, আওযাঈ ও একদল ফাক্বীহদের মত হচ্ছে, এ অবস্থায় তায়াম্মুম করা জায়িয আছে। কিন্তু ইমাম মালিক, ইমাম শাফিঈ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল ও একদল ফাক্বীহের মত হচ্ছে, এ অবস্থায় তায়াম্মুম করা যাবে না। (বিদায়াতুল মুজতাহিদ, অনুচ্ছেদ-জানাযার সালাত, এং অন্যান্য)।
(১৩) কেউ অসুস্থতার কারণে নিজে নিজে উযু বা তায়াম্মুম করতে অসমর্থ হলে অন্য কেউ তাকে উযু বা তায়াম্মুম করিয়ে দিবে।
(ঘ) তায়াম্মুমের পদ্ধতিঃ পবিত্রতা অর্জনের নিয়্যাতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে পবিত্র মাটির উপর একবার দু’ হাত মেরে তাতে ফুঁক দিয়ে মুখমণ্ডল
ও দু’ হাতের কব্জি পর্যন্ত একবার মাসাহ্ করতে হবে। (দেখুন, সহীহুল বুখারী, সহীহ মুসলিম, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, সহীহ আবূ দাঊদ, মিশকাত ও অন্যান্য)
উল্লেখ্য তায়াম্মুমে মাটিতে দু’ বার হাত মারা এবং দু’ হাতের কনুই বা বগল পর্যন্ত মাসাহ্ করা সম্পর্কে যেসব বর্ণনা এসেছে সেগুলো সহীহ নয়। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে এবং ইমাম শাওকানী (রহঃ) ‘আস-সায়লুল জাররার’ গ্রন্থে বলেনঃ "তায়াম্মুম সম্পর্কে সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত দু’টি সহীহ হাদীস ছাড়া বাকী সমস্ত হাদীসগুলোই হয় যঈফ (দুর্বল) না হয় গাইরে মারফূ (যার সানাদ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছায় না।) সুতরাং ঐ হাদীসগুলোর উপর ‘আমল করা ঠিক নয়।" (দেখুন, মির‘আতুল মাফাতীহ ১/৩৪৬)।
ইমাম ইবনু হায্ম (রহঃ) বলেন, তায়াম্মুমে দু’ বার হাত মারা সংক্রান্ত সমস্ত হাদীসগুলোই অচল। তাই ঐগুলোর দ্বারা দলীল পেশ করা জায়িয নয়। (দেখুন, আল-মুহাল্লা ২/১৪৯)।
‘আম্মার ইবনু ইয়াসার বর্ণিত হাদীসটির ব্যাখ্যায় হানাফী মুহাদ্দিস আহমাদ ‘আলী সাহারানপুরী (রহঃ) বলেন, এ হাদীস প্রমাণ করে, তায়াম্মুমের মার চেহারা ও দু’ কব্জির জন্য মাত্র একবার। (দেখুন, বুখারীর ৫০ পৃষ্ঠায় ২নং টীকা)।
‘আল্লামা ‘আবদুল হাই লাখনৌভী হানাফী (রহঃ) বলেন, তায়াম্মুমে মাটিতে দু’ বার হাত মারা ও তাতে কনুই পর্যন্ত মাসাহ্ করা সম্পর্কে হাকিম ইবনু আদী, দারাকুতনী ও বাযযার প্রমূখ যা বর্ণনা করেছেন তার অধিকাংশ সূত্রই যঈফ। (দেখুন, শারহু বিক্বায়্যাহ, ৫৯ পৃষ্ঠা ৩নং টীকা)।
ইমাম হাসান (রহঃ) ইমাম আবূ হানিফা (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তায়াম্মুমের হাত মাসাহ্ কব্জি পর্যন্ত হবে (কনুই পর্যন্ত নয়)। সাহাবী ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকেও এটাই বর্ণিত আছে। (দেখুন, হিদায়া ১/৩৪, ৩নং টীকা)।
হানাফী মাযহাবের দ্বিতীয় ইমাম হিসেবে খ্যাত ইমাম আবূ ইউসূফ (রহঃ)ও মাটিতে একবার হাত মারার পক্ষে।
অতএব তায়াম্মুমে মাটিতে হাত মারা দু’ বার নয় বরং একবার এবং হাত মাসাহ্ কনুই বা বগল পর্যন্ত নয় বরং কব্জি পর্যন্ত। এটাই সহীহ।
তায়াম্মুমের পদ্ধতি সম্পর্কে তিনটি মত ও সেসব মতের পক্ষে দলীলঃ
প্রথম পক্ষের অভিমতঃ একবার হাত মেরে চেহারা ও হাতের কব্জিদ্বয় মাসাহ্ করা। এর দলীলঃ ‘আম্মার ইবনু ইয়াসির (রাঃ) বর্ণনা করেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়াম্মুম সম্পর্কে বলেনঃ ‘‘চেহারা ও হস্তদ্বয়ের জন্য একবার হাত মারবে।’’ (আহমাদ, আবূ দাঊদ) অন্য শব্দে রয়েছেঃ ‘‘নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে মুখমণ্ডল
ও উভয় হাতের কব্জি পর্যন্ত তায়াম্মুম করার নির্দেশ দিয়েছেন।’’ (তিরমিযী, তিনি একে সহীহ বলেছেন, আহমাদ, দারিমী, তিনি এর সানাদকে সহীহ বলেছেন, দারাকুতনী, ত্বাহাভী, বায়হাক্বী, আবূ দাঊদ, আলবানীও একে সহীহ বলেছেন)।
সহীহুল বুখারী ও মুসলিমে রয়েছেঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার জন্য এটুকুই যথেষ্ট... এ বলে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’ হাত মাটিতে মারলেন এবং দু’ হাতে ফুঁ দিয়ে তাঁর চেহারা ও উভয় হাত মাসাহ্ করলেন।
দারাকুতনীতে রয়েছেঃ ‘‘তুমি তোমার হস্তদ্বয় মাটিতে মেরে তাতে ফুঁ দিবে। অতঃপর তোমার চেহারা ও উভয় হাতের কব্জি পর্যন্ত মাসাহ্ করবে।’’
আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন, জেনে রাখুন, হাদীসটি ‘আম্মার সূত্রে ‘দু’ বার হাত মারা’ শব্দেও বর্ণিত হয়েছে, যেমন এর কতিপয় সূত্রে ‘কনুই পর্যন্ত’ কথাটি রয়েছে। কিন্তু এ সবের প্রত্যেকটিই ত্রুটিযুক্ত, এর কোনটিই সহীহ নয়। হাফিয ‘আত-তালখীস’ গ্রন্থে বলেনঃ ‘‘ইবনু ‘আব্দুল বার (রহঃ) বলেন, ‘আম্মার সূত্রের অধিকাংশ মারফূ হাদীসেই একবার হাত মারার কথা বর্ণিত হয়েছে।’’ এছাড়া তার সূত্রে দু’ বার হাত মারা সম্পর্কে যেসব বর্ণনা এসেছে সেগুলোর প্রত্যেকটিই মুযতারিব...।’’ আর ত্বাবারানী আওসাতে বর্ণিত হাদীস। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আম্মারকে বললেন, ‘‘তোমার জন্য এটুকু যথেষ্ট যে, তুমি একবার চেহারার জন্য এবং আরেকবার দু’ কব্জির জন্য হাত মারবে।’’ এর সনদে ইবরাহীম ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আবূ ইয়াহইয়া রয়েছে। তিনি দুর্বল। যদিও তা ইমাম শাফিঈর নিকট একটি দলীল ছিলো। সুতরাং প্রমাণিত হলো, চেহারা ও উভয় কব্জির জন্য তায়াম্মুমে একবার হাত মারতে হবে। এ মত গ্রহণ করেছেন, ‘আত্বা, আওযাঈ, আহমাদ ইবনু হাম্বাল, সাদিক ও অন্যান্যরা। হাফিয ফাতহুল বারীতে বলেনঃ ইবনুল মুনযির এ মতটি জমহুর ‘উলামা থেকে নাক্বল করেছেন এবং একেই গ্রহণ করেছেন, আর এটাই হচ্ছে অধিকাংশ হাদীস বিশারদগণের অভিমত।
দ্বিতীয় পক্ষের অভিমতঃ দু’ বার হাত মেরে উভয় হাত কনুই পর্যন্ত মাসাহ্ করা। একে সমর্থন করেছেন আবূ হানিফা, মালিক, সুফিয়ান সাওরী ও আরো অনেকে। এর পক্ষে পেশকৃত দলীলসমূহঃ (১) ইবনু ‘উমার (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত মারফূ হাদীসঃ ‘‘তায়াম্মুমে দু’ মার, একবার চেহারার জন্য, আরেকবা দু’ হাতের কনুই পর্যন্ত (মাসাহ্ করার) জন্য।’’ এটি বর্ণনা করেছেন দারাকুতনী, হাকিম ও বায়হাক্বী। এর সনদের ‘আলী ইবনু যাবইয়ান রয়েছে। তার সম্পর্কে ইমাম দারাকুতনী বলেন, তাকে ইয়াহইয়া কাত্তান, হুশাইম ও অন্যরা সিক্বাহ বলেছেন। হাফিয বলেন, তিনি দুর্বল, তাকে ইবনু কাত্তান, ইবনু মাঈন ও একাধিক ইমাম দুর্বল বলেছেন। (২) ইবনু ‘উমার (রাঃ) সূত্রে আরেকটি হাদীসঃ আমরা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তায়াম্মুম করেছি। আমরা পবিত্র মাটির উপর একবার হাত মেরে তাতে ফুঁ দিয়ে তদ্বারা আমাদের চেহারা মাসাহ্ করেছি। অতঃপর আরেকবার হাত মেরে কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত মাসাহ করেছি।’’ এর সনদে সুলায়মান ইবনু আরকাম হাদীস বর্ণনায় মাতরূক।
(৩) ইবনু উমার (রাঃ) সূত্রে ভিন্ন সনদে বর্ণিত আরেকটি হাদীস রয়েছে। আর শব্দাবলী যাবইয়ানের বর্ণনার অনুরূপ। ইমাম আবূ যুর‘আহ বলেন, হাদীসটি বাতিল। (৪) দারাকুতনী ও হাকিমে বর্ণিত জাবির সূত্রের হাদীস। ইবনুল জাওযী বলেন, এর সনদে ‘উসমান ইবনু মুহাম্মাদ সমালোচিত ব্যক্তি। হাফিয ইবনু হাজার ‘আত-তালখীস’ গ্রন্থে বলেন, ইবনুল জাওযী এতে ভুলে পতিত হয়েছেন। ইবনু দাক্বীকুল ঈদ বলেন, ‘উসমান ইবনু মুহাম্মাদ সম্পর্কে কেউ আপত্তি করেননি, তবে তার বর্ণনাটি শায। ইমাম দারাকুতনী জাবিরের হাদীস বর্ণনার পর বলেন, প্রত্যেক বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য, তবে সহীহ মতে বর্ণনাটি মাওকূফ (মারফূ নয়)। [উল্লেখ্য হাকিম ও যাহাবী এ হাদীস বর্ণনার পর চুপ থেকেছেন। অথচ ই‘লাউস সুনানে রয়েছে, হাকিম ও যাহাবী এর সানাদকে সহীহ বলেছেন, যা একটি ভুল তথ্য।] (৫) অন্য অনুচ্ছেদে আসলা ইবনু শুরাইক সূত্রের বর্ণনা। যা বর্ণনা করেছেন ত্বাবারানী ও দারাকুতনী। এর সনদে রাবী‘ ইবনু বাদর রয়েছে। তিনি দুর্বল। ইমাম বায়হাক্বী বলেছেন, তিনি দুর্বল। ইমাম নাসায়ী ও ইমাম দারাকুতনী তাকে মাতরূক বলেছেন।
(৬) ত্বাবারানীতে বর্ণিত আবূ উমামাহ্ সূত্রের হাদীস। হাফিয বলেন, এর সানাদ দুর্বল। (৭) ‘আয়িশাহ সূত্রে মারফূ হাদীস। যা বর্ণনা করেছেন বাযযার ও ইবনু ‘আদী। এতে হারীশ ইবনু খিররিত একক হয়ে গেছেন। তার হাদীস দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যাবে না। আবূ হাতিম বলেন, তার হাদীসটি মুনকার। (৮) বাযযারে বর্ণিত ‘আম্মার সূত্রের হাদীস। ইতিপূর্বে জেনেছেন যে, তার সূত্রে বর্ণিত সহীহ হাদীসসমূহে একবার হাত মারার কথা রয়েছে। (৯) অন্য অনুচ্ছেদে ইবনু ‘উমার সূত্রে বর্ণিত আরেকটি মারফূ হাদীসঃ ‘‘নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়াম্মুমে দু’ বার হাত মেরেছেন। যার একবারের দ্বারা চেহারা মাসাহ্ করেছেন।’’ এটি আবূ দাঊদ দুর্বল সনদে বর্ণনা করেছেন। কেননা এর মূল বিষয় বর্তায় মুহাম্মাদ ইবনু সাবিতের উপর। তাকে ইবনু মাঈন, আবূ হাতিম, ইমাম বুখারী ও আহমাদ দুর্বল বলেছেন। অতএব এতে স্পষ্ট প্রতিয়মান হলো যে, তায়াম্মুমে দু’ বার হাত মারার হাদীসগুলোর সমস্ত সূত্রই সমালোচিত। যার কোনটিই সমালোচনা মুক্ত নয়। যদি সহীহ হতো তাহলে তাতে বর্ণিত বর্ধিতাংশ গ্রহণ করা যেতো। সুতরাং হক হচ্ছে, সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে প্রমাণিত ‘আম্মার (রাঃ)-এর হাদীসে বর্ণিত সংক্ষেপে ‘একবার হাত মারা’ এর উপর সীমাবদ্ধ থাকা, যতক্ষণ না ঐ বর্ধিতাংশ সহীহভাবে প্রমাণিত হয়। আর তারা কনুই পর্যন্ত মাসাহ্ করার দলীলও ইবনু উমারের হাদীস থেকে গ্রহণ করেছেন। এ সংক্রান্ত বর্ণনা যে দলীলযোগ্য নয় তা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া কেউ কেউ তায়াম্মুমকে উযুর উপর কিয়াস করেও দলীল পেশ করেন। কিন্তু এরূপ কিয়াস বাতিল ও অকেজো।
তৃতীয় পক্ষের অভিমতঃ মাটিতে তিনবার হাত মারা ওয়াজিব। একবার মুখের জন্য, একবার কব্জিদ্বয়ের জন্য, আরেকবার দু’ হাতের কনুইয়ের জন্য। ইবনু সীরীন ও ইবনুল মুসাইয়্যিব এ মতের সমর্থক। কিন্তু তারা কিভাবে একে ওয়াজিব বলবেন তা বোধগম্য নয়। বরং ইমাম ইয়াহইয়া বলেন, এমন কোনো দলীল নেই যা দ্বারা তায়াম্মুমে তিনবার হাত মারা মুস্তাহাব হওয়া প্রমাণ করবে (ওয়াজিব হওয়া তো দূরের কথা)। আল্লামা শাওকানী বলেন, এ কথাই সঠিক।
হাফিয ইবনু হাজার (রহঃ) ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে বলেনঃ ‘‘কতই না সুন্দর কথা, যিনি বলেছেন, তায়াম্মুমের পদ্ধতি সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসসমূহের মধ্যে ‘আম্মার ও আবূ জুহাইমের হাদীস ছাড়া কোনটিই সহীহ নয়। তাঁদের দু’ জন ব্যতীত অন্য সকল বর্ণনা হয় দুর্বল, নতুবা মারফূ ও মাওকূফ হওয়ার ব্যাপারে মতভেদপূর্ণ। প্রাধান্যযোগ্য কথা হচ্ছে, ঐ বর্ণনাগুলো মারফূ নয়। আবূ জুহাইমের হাদীসে সংক্ষেপে হাতের কথা উল্লেখ রয়েছে। আর ‘আম্মার বর্ণিত হাদীসে সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় উভয় হাতের কব্জির কথা, সুনান গ্রন্থে কনুইদ্বয়ের কথা, এবং কোনো বর্ণনায় বাহুর অর্ধেক ও কোনো বর্ণনায় বগল পর্যন্ত মাসাহের কথা এসেছে। এগুলোর মধ্যে উভয় হাতের কনুই এবং বাহুর অর্ধেক পর্যন্ত মাসাহ্ করা- এ উভয় বর্ণনা সমালোচিত ও মতবিরোধপূর্ণ। আর বগল পর্যন্ত মাসাহ্ সংক্রান্ত বর্ণনার ব্যাপারে ইমাম শাফিঈ ও অন্যরা বলেছেন, তা মানসূখ। যদি এরূপ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ হয়ে থাকে তাহলে পরবর্তীতে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তায়াম্মুমের পদ্ধতি সম্পর্কে সহীহভাবে যেসব বর্ণনা এসেছে সেগুলো এর রহিতকারী। আর যদি এরূপ অন্য কারো নির্দেশে হয়ে থাকে তাহলে অন্যের চেয়ে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশই দলীল হিসেবে অগ্রগণ্য। আর সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত সংক্ষেপে মুখমণ্ডল
ও উভয় হাতের কব্জি পর্যন্ত মাসাহ করা সংক্রান্ত বর্ণনাকে আরো মজবুত করছে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তিকালের পর স্বয়ং ‘আম্মার কর্তৃক এ বিষয়ে অনুরূপ ‘মুখমণ্ডল
ও উভয় হাতের কব্জি পর্যন্ত’ মাসাহ্ করার ফাতাওয়াহ প্রদান। হাদীসের বর্ণনাকারীই অন্যদের চেয়ে হাদীসের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। বিশেষ করে তিনি ছিলেন একজন মুজতাহিদ সাহাবী (রাঃ)।’’
সুতরাং হক প্রথম পক্ষের অনুরূপ। আর এতে সন্দেহ নেই যে, বর্ধিত অংশ সম্বলিত হাদীস গ্রহণযোগ্য হবে, তবে শর্ত হচ্ছে, যদি তা দলীলের উপযুক্ত হয় ও তার দ্বারা দলীল নেয়া নিরাপদ হয়। কিন্তু বর্ণিত অংশ সম্বলিত বর্ণনায় তেমন কিছুই নেই যা একে দলীলযোগ্য করবে। (দেখুন, নায়লুল আওত্বার, ফাতহুল বারী, ইরওয়া ও অন্যান্য)।
সতর্কীকরণঃ অন্যতম প্রসিদ্ধ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘ইসলামিক সেন্টার’ কর্তৃক প্রকাশিত তিরমিযীর প্রথম খন্ডের ১৩৯ নং হাদীসটি সঠিকভাবে অনুবাদ করার পর হাদীস বর্ণনার শেষে ইমাম তিরমিযীর উপস্থাপিত ভাষ্য অনুবাদের ক্ষেত্রে তিন জায়গায় ভুল করা হয়েছে। তাতে অনুবাদ করা হয়েছেঃ (১) ইসহাক ইবনু ইবরাহীম বলেন, ‘চেহারা ও উভয় হাতের কনুই পর্যন্ত, তায়াম্মুম করার হাদীসটি সহীহ। (২) ‘আম্মার নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে তায়াম্মুম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখমণ্ডল
ও উভয় হাতের কনুই পর্যন্ত তায়াম্মুম করার নির্দেশ দিলেন। (৩) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তিকালের পর ‘আম্মার ‘মুখমণ্ডল
ও উভয় হাতের কনুই পর্যন্ত’ তায়াম্মুম করার ফতোয়াই দিয়েছেন।’ এটা ভুল অনুবাদ। কেননা ইমাম তিরমিযী এসব স্থানে (مرفقين) ‘‘কনুই পর্যন্ত’’ শব্দ উল্লেখ করেননি বরং উল্লেখ করেছেন (كفين) ‘‘কব্জি পর্যন্ত’’ শব্দ। সকল অভিধানেই (كف) এর অর্থ করা হয়েছে ‘কব্জি।’ কিন্তু তারা তো মূল হাদীস অনুবাদে (كفين) শব্দের অর্থ ‘কব্জি’ পর্যন্ত করেছেন। তাহলে এসব স্থানে কেন বিপরীত করলেন! আশা করছি পরবর্তী সংস্করণে ইসলামিক সেন্টার কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সংশোধন করবেন। অতএব তিরমিযীতে বর্ণিত ঐ ভাষ্যগুলোর সঠিক অনুবাদ হবে এভাবেঃ ইসহাক ইবনু ইবরাহীম বলেন, ‘চেহারা ও উভয় হাতের কব্জি পর্যন্ত’ তায়াম্মুম করার হাদীসটি হাসান সহীহ। (২) ‘আম্মার (রাঃ) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে তায়াম্মুম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে মুখমণ্ডল
ও উভয় হাতের কব্জি পর্যন্ত তায়াম্মুম করার নির্দেশ দিলেন। (৩) রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তিকালের পর ‘আম্মার (রাঃ) ‘মুখমণ্ডল
ও উভয় হাতের কব্জি পর্যন্ত’ তায়াম্মুম করার ফতোয়াই দিয়েছেন। আর এতে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, তিনি শেষ পর্যন্ত নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক অবিচল থেকেছেন।