হাদিসটি ইমেইলে পাঠাতে অনুগ্রহ করে নিচের ফর্মটি পুরন করুন
security code
২৩৭১

পরিচ্ছেদঃ ৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - আল্লাহ তা‘আলার রহমতের ব্যাপকতা

২৩৭১-[৮] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কাউকেই তার ’আমল (’ইবাদাত-বন্দেগী) মুক্তি দিতে পারবে না। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনাকেও না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমাকেও নয়। অবশ্য যদি আল্লাহ তা’আলা তাঁর রহমত দিয়ে আমাকে ঢেকে নেন। তবুও তোমরা সঠিকভাবে ’আমল করতে থাকবে ও মধ্যমপন্থা অবলম্বন করবে। সকাল-সন্ধ্যায় ও রাতে কিছু ’আমল করবে। সাবধান! তোমরা (’ইবাদাতে) মধ্যমপন্থা অবলম্বন করবে, মধ্যমপন্থা অবলম্বন করবে। তাতে তোমরা তোমাদের মঞ্জীলে মাকসূদে পৌঁছে যাবে। (বুখারী, মুসলিম)[1]

بَابُ سَعْةِ رَحْمَةِ اللهِ

وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَنْ يُنْجِيَ أَحَدًا مِنْكُمْ عَمَلُهُ» قَالُوا: وَلَا أَنْتَ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: «وَلَا أَنَا إِلَّا أَنْ يَتَغَمَّدَنِي اللَّهُ مِنْهُ بِرَحْمَتِهِ فَسَدِّدُوا وَقَارِبُوا واغْدُوا وروحوا وشيءٌ من الدُّلْجَةِ والقَصدَ القصدَ تبلغوا»

ব্যাখ্যা: (لَنْ يُنْجِىَ أَحَدًا مِنْكُمْ عَمَلُه) আবূ দাঊদ আত্ ত্বয়ালিসী এর বর্ণনাতে আছে, তোমাদের মাঝে এমন কেউ নেই যে, তার ‘আমল তাকে মুক্তি দিবে। বুখারী ও মুসলিম উভয়ের বর্ণনাতে আছে, তোমাদের কারো ‘আমল কখনো তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না। মুসলিমের বর্ণনাতে আছে, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে, তার ‘আমল তাকে মুক্তি দিবে। মুসলিমের অন্য বর্ণনাতে আছে, তোমাদের কেউ কখনো তার বিদ্যার মাধ্যমে মুক্তি পাবে না। এ হাদীস এবং অনুরূপ হাদীস আল্লাহর وَتِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِيْ أُورِثْتُمُوْهَا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ [অর্থাৎ- ‘‘আর ঐ জান্নাত যার উত্তরাধিকারী তোমাদেরকে করা হয়েছে তা তোমাদের কর্মের বিনিময়ে’’- (সূরা আয্ যুখরুফ ৪৩ : ৭২)] এ বাণীর কারণে জটিলতা সৃষ্টি করছে। এর উত্তরে বলা হয়েছে, আয়াতটি ঐ ব্যাপারে উৎসাহিত করছে যে, জান্নাতের মাঝে স্তরসমূহ ‘আমলের বিনিময়ে অর্জন করা হবে। কেননা ‘আমলের বিভিন্নতা অনুযায়ী জান্নাতের স্তরসমূহও বিভিন্ন হয়ে থাকে। হাদীসটি জান্নাতে প্রবেশের মৌলিকতা এবং তাতে স্থায়ী হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করছে। অতঃপর যদি কেউ বলে নিশ্চয়ই আল্লাহর [অর্থাৎ- ‘‘তোমাদের ওপর শান্তি বর্ণিত হোক, তোমরা যে ‘আমল করতে তার বিনিময়ে জান্নাতে প্রবেশ কর’’- (সূরা আন্ নাহল ১৬ : ৩২)] এ বাণীটি ঐ ব্যাপারে স্পষ্ট যে, জান্নাতে প্রবেশ করাও ‘আমলের মাধ্যমে সাব্যস্ত। উত্তরে বলা হবে আল্লাহর বাণীটি সংক্ষিপ্ত হাদীস তাকে স্পষ্ট করে দিয়েছে। ‘উহ্য’ বাক্যটি এভাবে হবে, তোমরা তোমাদের ‘আমলের মাধ্যমে জান্নাতের স্তরসমূহে ও তার প্রাসাদসমূহে প্রবেশ কর, এর দ্বারা প্রবেশের মৌলিকতা উদ্দেশ্য নয়। হাদীসটি আয়াতের তাফসীরকারী হওয়াও সম্ভব। ‘উহ্য’ বাক্য হল, তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর রহমাতে ও তোমাদের প্রতি আল্লাহর কৃপার দরুন তোমাদের কর্মের বিনিময়ে জান্নাতে প্রবেশ কর। কেননা জান্নাতের স্তরসমূহের বিভক্তি তার রহমাত অনুসারে। এভাবে জান্নাতে প্রবেশের মৌলিকতাও তাঁর রহমাত অনুসারে যেমন আল্লাহর বাণী ‘আমলকারীদেরকে উৎসাহিত করেছে, যার কারণে তারা তা অর্জন করেছে এবং বান্দাদের প্রতি তাঁর পুরস্কারসমূহ থেকে কোন কিছু তাঁর রহমাত ও কৃপা মুক্ত নয়। শুরুতেই আল্লাহ তাদেরকে তাদের সৃষ্টি করার মাধ্যমে অনুগ্রহ করেছেন, অতঃপর তাদেরকে রিযক দেয়ার মাধ্যমে, এরপর তাদেরকে জ্ঞান দান করার মাধ্যমে। এটি হল হাদীসদ্বয় এবং অধ্যায়ের হাদীসের মাঝে সমন্বয় সাধনে ইবনু বাত্ত্বাল-এর কথার সারাংশ।

কাযী ‘ইয়ায বলেন, সমন্বয়ের দিক হল নিশ্চয়ই হাদীসটি আয়াতের মাঝে যা সংক্ষেপিত তার ব্যাখ্যা করেছে। আর নিশ্চয়ই ‘আমলের তাওফীক পাওয়া, আনুগত্যের দিক নির্দেশনা পাওয়া আল্লাহর রহমাতের অন্তর্ভুক্ত। এ প্রতিটি ক্ষেত্রকে ‘আমলকারী তার ‘আমলের মাধ্যমে লাভ করতে পারেনি।

ইবনুল জাওযী বলেন, এ থেকে চারটি উত্তর অর্জন হচ্ছে।

প্রথমত ‘আমল করার তাওফীক লাভ আল্লাহর রহমাতের অন্তর্ভুক্ত। যদি আল্লাহর পূর্বোক্ত রহমাত না থাকত তাহলে ঈমান এবং ঐ আনুগত্য অর্জন হত না যার মাধ্যমে মুক্তি অর্জন হয়।

দ্বিতীয়ত নিশ্চয়ই মুনীবের প্রতি বান্দার কল্যাণ হচ্ছে, বান্দার ‘আমল তার মুনীবকে লাভ করবে। সুতরাং তিনি প্রতিদানের মাধ্যমে বান্দার ওপর যাই নিয়ামত দান করেছেন তা তাঁর অনুগ্রহের আওতাভুক্ত।

তৃতীয়ত কতিপয় হাদীসে এসেছে, খোদ জান্নাতে প্রবেশ আল্লাহর রহমাতের মাধ্যমে এবং জান্নাতের স্তরসমূহের বিন্যাস ‘আমলসমূহের মাধ্যমে।

চতুর্থত নিশ্চয়ই আনুগত্যের ‘আমলসমূহ অল্প সময়, পক্ষান্তরে তার পুণ্য শেষ হওয়ার নয়। সুতরাং ঐ পুরস্কার যা বদলার ক্ষেত্রে শেষ হওয়ার না, তা ‘আমলের মুকাবালাতে কৃপাপ্রদর্শনের ক্ষেত্রেও শেষ হওয়ার না।

কিরমানী বলেন,بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ আল্লাহর এ বাণীতে الباء অক্ষর কারণসূচক অর্থ বর্ণনার জন্য নয়, বরং সাথে অথবা সাথী অর্থ বুঝানোর জন্য, অর্থাৎ- তোমাদেরকে যে জান্নাতের অধিকারী করা হয়েছে সঙ্গ বা ঘনিষ্ঠতা স্বরূপ। অথবা মুকাবালার জন্য ব্যবহৃত। যেমন দিরহামের বিনিময়ে আমি বকরী দান করেছি এবং এ শেষটির ব্যাপারে শায়খ জামালুদ্দীন বিন হিশাম আল মুগনী গ্রন্থে দৃঢ়তা প্রকাশ করেছেন। অতঃপর তিনি ১ম খণ্ডে ৯৭ পৃষ্ঠাতে বলেন, الباء অক্ষর মুকাবালার জন্য ব্যবহার আর তা বিনিময়সমূহের উপর প্রবেশ করে যেমন (اشتريته بألف) অর্থাৎ- আমি তা এক হাজার এর বিনিময়ে ক্রয় করেছি এবং (كا فأت احسانه بضعف) অর্থাৎ- আমি তার ইহসানের বিনিময় বহুগুণে দিয়েছি। ‘আরবদের এ কথার সমর্থনে কুরআনের আয়াত ادْخُلُوا الْجَنَّةَ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ অর্থাৎ- ‘‘তোমরা যা করতে তার বিনিময় স্বরূপ জান্নাতে প্রবেশ কর’’- (সূরা আন্ নাহ্ল ১৬ : ৩২)। আমরা এ الباء অক্ষরকে কারণসূচক الباء হিসেবে সাব্যস্ত করিনি, যেমন মু‘তাযিলাহ্ সম্প্রদায় বলেছে (কেননা তারা বলে থাকে সৎ ‘আমল জান্নাতকে ওয়াজিব করার কারণ) যেমন সকল আহলুস্ সুন্নাহগণ বলে থাকেন কেউ কখনো তার ‘আমলের বিনিময়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, কেননা দাতা কখনো বদলার ক্ষেত্রে বিনামূল্যেও কিছু দিয়ে থাকে যা السبب এর বিপরীত যা السبب তথা কারণ ছাড়া পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, باء এর দু’টি সম্ভাবনাময় অর্থের মতানৈক্যের কারণে দলীলসমূহের মাঝে সমন্বয় সাধনকরণে হাদীস ও আয়াতের মাঝে কোন বিরোধ নেই।

‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী বলেন, আমি বলব, এ ব্যাপারে ইবনুল কইয়্যিম পূর্বেই মত ব্যক্ত করেছেন। যেমন হাফেয বলেন, (مفتاح دار السعادة) কিতাব থেকে তার আলোচনা বর্ণনা করা হয়েছে।

হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, আয়াত এবং হাদীসের মাঝে সমন্বয় সাধনে আমার কাছে আরেকটি দিক স্পষ্ট হচ্ছে আর তা হল হাদীসটিকে ঐ দিকে চাপিয়ে দেয়া যে ‘আমল, যেহেতু সেটা এমন ‘আমল যা জান্নাতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ‘আমলকারীর কোন উপকারে আসবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তা গ্রহণযোগ্য ‘আমল না হবে। আর তা যখন এমনই তখন গ্রহণের বিষয় আল্লাহর কাছে ন্যস্ত। আর তা কেবল আল্লাহ যার থেকে ‘আমল গ্রহণ করবেন তার জন্য আল্লাহর রহমাতের মাধ্যমে অর্জন হবে।

এ উত্তরটির সারাংশ হল, হাদীসটিতে গ্রহণযোগ্যতা মুক্ত ‘আমলের মাধ্যমে জান্নাতে প্রবেশ নিষেধ করা হয়েছে পক্ষান্তরে আয়াতে গ্রহণযোগ্য ‘আমলের মাধ্যমে জান্নাতে প্রবেশের কথা বলা হয়েছে। আর ‘আমলের গ্রহযোগ্যতা কেবল আল্লাহর তরফ থেকে অনুগ্রহ স্বরূপ হয়ে থাকে।

ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেনঃ আয়াতসমূহের অর্থ হল জান্নাতে প্রবেশ ‘আমলসমূহের কারণে। আয়াতসমূহ ও হাদীসের মাঝে সমন্বয় সাধন এভাবে যে, ‘আমলসমূহের ক্ষেত্রে ‘আমল করার তাওফীক লাভ, নিষ্ঠার প্রতি দিক নির্দেশনা এবং ‘আমলসমূহের গ্রহণযোগ্যতা কেবল আল্লাহর রহমাত ও করুণাস্বরূপ। সুতরাং এ কথা বিশুদ্ধ যে, শুধুমাত্র ‘আমলসমূহের মাধ্যমে জান্নাতে প্রবেশ করা যাবে না এটিই হাদীসের উদ্দেশ্য এবং এ কথাও বিশুদ্ধ যে ব্যক্তি ‘আমলসমূহের কারণে জান্নাতে প্রবেশ করবে আর তাও আল্লাহর রহমাতের অন্তর্ভুক্ত। তবে শেষ মতটিকে কিরমানী প্রত্যাখ্যান করেছেন কেননা তা স্পষ্ট বিরোধী।

তুরবিশতী বলেন, এ হাদীস থেকে ‘আমল করাকে নিষেধ করা এবং ‘আমলের বিষয়কে শিথিলভাবে দেখা উদ্দেশ্য নয়। বরং বান্দাদেরকে ঐ ব্যাপারে অবহিত করা যে, ‘আমল কেবল আল্লাহর রহমাত ও তার কৃপার মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে আর এটা এ কারণে যে, যাতে তারা ‘আমলের ব্যাপারে ধোঁকা খেয়ে ‘আমলের উপর ভরসা করে বসে না থাকে। কেননা মানুষ স্পষ্ট উদাসীনতা ও বিপদের সম্মুখীন হয়ে ভুলে যায়। তার পক্ষে অসৎ উদ্দেশ্য, বিশৃঙ্খলা নিয়্যাত, সূক্ষ্ম প্রবৃত্তি বা লোক দেখানো ‘আমলের ময়লা থেকে মুক্ত থাকার সুযোগ কমই হয়ে থাকে। অতঃপর যদি তার ‘আমল সমস্ত কিছুর ময়লা থেকে নিরাপদও হয় তথাপিও তা আল্লাহর রহমাতের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। কেননা বান্দার ‘আমলসমূহ থেকে সর্বাধিক আশাপূর্ণ ‘আমল আল্লাহর নিয়ামতসমূহ থেকে নিয়ামতস্বরূপ সর্বনিম্ন কৃতজ্ঞতার মাধ্যমে পূর্ণ হয় না। সুতরাং যে ‘আমলের সে দিক-নির্দেশনাই পায়নি আল্লাহর রহমাত ছাড়া সে ‘আমলের মাধ্যমে তার সাহায্য প্রার্থনা করা কি সম্ভব?

ইমাম ত্বীবী বলেন, অর্থাৎ- শাস্তি থেকে মুক্তি এবং পুণ্যের মাধ্যমে সফল হওয়া আল্লাহর কৃপা ও রহমাতের মাধ্যমে হয়ে থাকে। ‘আমল আবশ্যকীয়ভাবে এগুলোতে কোন প্রভাব ফেলে না। বরং এর চূড়ান্ত পর্যায় হল ‘আমলকারীর উপর করুণাপ্রদর্শন ও রহমাতকে তার নিকটবর্তী করার বিবেচনা করা হয়। আর এজন্যই (فسددوا الخ) অর্থাৎ- ‘‘তোমরা সঠিক পন্থা অবলম্বন কর’’ এ কথা বলেছেন।

সাহাবীদেরকে সম্বোধন করা হলেও এর উদ্দেশ্য আদম সন্তানের দল। মাযুরী বলেন, আহলুস্ সুন্নাহর মত হল, যে আল্লাহর আনুগত্য করবে আল্লাহ অনুগ্রহের মাধ্যমে তাকে সাওয়াব দান করবেন, পক্ষান্তরে যে তার অবাধ্য হবে তিনি ন্যায় ইনসাফস্বরূপ তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। আর আনুগত্যশীলকে শাস্তি দেয়া এবং অবাধ্যের প্রতি অনুগ্রহ করার ক্ষমতা আল্লাহর আছে। কেননা সমগ্র বিশ্বে তার মালিকত্বে, ইহকাল এবং পরকাল তাঁর কর্তৃত্বের মাঝে, উভয় জগতে তিনি যা ইচ্ছা করতে পারেন, সুতরাং তিনি যদি আনুগত্যশীলদেরকে শাস্তি দেন এবং তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করান তাহলে সেটা তার তরফ থেকে ইনসাফস্বরূপ হবে। পক্ষান্তরে যখন তিনি তাদেরকে সম্মানিত করবেন তাদের প্রতি অনুগ্রহ ও তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন তখন তা তার তরফ থেকে অনুগ্রহস্বরূপ হবে। আর যদি তিনি কাফিরদেরকে অনুগ্রহ করেন এবং তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করান তাহলে তাঁর সে অধিকার আছে তবে তিনি সংবাদ দিয়েছেন আর তার সংবাদ সত্য যাতে কোন বৈপরীত্য নেই যে, তিনি এটা করবেন না বরং তিনি মু’মিনদেরকে ক্ষমা করবেন এবং তাদেরকে নিজ রহমাতে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং কাফিরদেরকে শাস্তি দিবেন এবং তাঁর তরফ থেকে ইনসাফস্বরূপ তাদেরকে জাহান্নামে স্থায়ী করবেন।

এ হাদীসটি মু‘তাযিলাহ্ সম্প্রদায়ের কথাকে প্রত্যাখ্যান করছে। যেমন তারা বিবেকের মাধ্যমে বদলা সাব্যস্ত করে থাকে, ‘আমলসমূহের পুণ্য আবশ্যক করে থাকে, সঠিকতর দিককে আবশ্যক করে থাকে, এ ব্যাপারে তাদের অনেক অপ্রকৃতিস্থতা ও দীর্ঘ ব্যাখ্যা আছে।

(وَلَا أَنْتَ يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ؟) অর্থাৎ- মহাসম্মান থাকা সত্ত্বেও আপনার ‘আমল আপনাকে মুক্তি দিবে না। ‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী বলেন, আমি বলব, মুসলিমের এক বর্ণনাতে আছে, এক লোক বলল আপনাকেও না হে আল্লাহর রসূল? কিরমানী বলেন, যখন প্রত্যেক মানুষ আল্লাহর রহমাতে আচ্ছাদিত হওয়া ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না তখন আলোচনাতে রসূলকে খাস করার কারণ হল, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাতে প্রবেশ করবেন- এ বিষয়টি যখন অকাট্য হওয়ার পরও তিনি যদি আল্লাহর রহমাত ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করতে না পারেন তাহলে তিনি ব্যতীত অন্যের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি আরো জটিল হওয়াই স্বাভাবিক। রাফি‘ঈ বলেন, আনুগত্যের ক্ষেত্রে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পারিশ্রমিক যেমন বড়, ‘ইবাদাতে তার ‘আমল যেমন সঠিক তখন এদিকে দৃষ্টি দিয়েই বলা হয়েছে, আপনিও নন হে আল্লাহর রসূল? অর্থাৎ- মহামর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আপনার ‘আমলও কি আপনাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না? তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, (ولا انا) আমিও না। কথাটি (ولا انت) তথা আপনিও না কথাটির অনুকূল। অর্থাৎ- যাকে তার ‘আমল মুক্তি দিবে আমি তার অন্তর্ভুক্ত না। মুসলিমে এক বর্ণনাতে এ বর্ণনার দিকে ইঙ্গিত দেয়া আছে, যেমন- قال و لا إياى অর্থাৎ- তিনি বলেন, আমাকেও না।

(إِلَّا أَنْ يَتَغَمَّدَنِى اللّٰهُ) অর্থাৎ- তবে আল্লাহ যদি আমাকে আচ্ছাদিত করে নেন। মুসলিমের এক বর্ণনাতে আছে, الا ان يتداركنى অর্থাৎ- তবে তিনি যদি আমাকে সংশোধন করে নেন।

(مِنْهُ بِرَحْمَتِه) উভয়ের বর্ণনাতে আছে, بفضل ورحمته তথা তাঁর কৃপা ও তাঁর দয়ার মাধ্যমে। অর্থাৎ- তাঁর দয়া ও তাঁর ক্ষমার মাধ্যমে কথা বলা আছে। আবূ ‘উবায়দ বলেন, التغمد দ্বারা আচ্ছাদিত করা উদ্দেশ্য। আমি মনে করি এটি غمد السيف তথা তরবারিকে আচ্ছাদিত করা- এ কথা থেকে এসেছে।

কারী বলেন, التغمد এর অর্থ আড়াল করা, অর্থাৎ- তিনি আমাকে তার রহমাত দিয়ে আড়াল করবেন এবং আমাকে ঐভাবে সংরক্ষণ করবেন যেভাবে তরবারিকে কোষ বা খাপ দ্বারা সংরক্ষণ করা হয়।

শায়খ দেহলবী বলেন, পৃথকীকরণ এর অর্থ হল, আমার ‘আমল আমাকে মুক্তি দিতে পারবে না তবে আল্লাহ যদি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেন তখন আমার ‘আমল আমাকে মুক্তি এবং আমার মুক্তির ক্ষেত্রে তা কারণ হতে পারবে, ‘আমল ছাড়া তখন কোন কিছু মুক্তির কারণ হতে পারবে না। কেননা প্রকৃতপক্ষে ‘আমল মুক্তিলাভকে আবশ্যক করে দেয়ার মতো কোন কারণ না।

(فَسَدِّدُوْا) উক্তি দ্বারা তিনি ‘আমলের ইতিবাচকের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, অর্থাৎ- তোমরা বিষয়টির সঠিক দিক অবলম্বন কর। আর এটিই হল ‘আরবদের (سدد السهم اذا تحرى الهدف) যখন লক্ষ্যস্থলের ইচ্ছা করল তখন তিরটিকে সোজা করল বা ঠিক করল- এ উক্তির দিক থেকে সঠিক। অর্থাৎ- তোমরা কাজ সম্পাদন কর এবং সঠিক দিক অনুসন্ধান কর এবং ‘আমলে বাড়াবাড়ি ও শিথিলতা প্রদর্শন না করে মধ্যম পন্থা অবলম্বন কর। সুতরাং বেশিও করবে না ও কমও করবে না। মুসলিমের এক বর্ণনাতে আছে, ولكن سددوا অর্থাৎ- তবে সঠিক দিক অবলম্বন কর। হাফেয বলেন, এ استدراك এর অর্থ হল, উল্লেখিত নেতিবাচক থেকে ‘আমলের উপকারিতার নেতিবাচক বুঝা যায়, অতঃপর যেন বলা হয়েছে বরং ‘আমলের উপকারিতা আছে আর তা হল, নিশ্চয়ই ‘আমল রহমাতের অস্তিত্বের ব্যাপারে আলামাত বা চিহ্ন যা ‘আমলকারীকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। সুতরাং তোমরা ‘আমল কর এবং তোমাদের ‘আমলের মাধ্যমে সঠিকতা উদ্দেশ্য কর আর তা হল নিষ্ঠা ও সুন্নাতের অনুসরণ যাতে তোমাদের ‘আমল গ্রহণ করা হয় এবং তোমাদের ওপর রহমাত বর্ষণ করা হয়।

(وقاربوا) অর্থাৎ- তোমরা নৈকট্য অনুসন্ধান কর। আর তা হল কোন বিষয়ে মধ্যম পন্থাবলম্বন কর যাতে কোন বাড়াবাড়ি নেই, ঘাতটিও নেই। একমতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ- তোমরা যদি কোন বিষয়কে পূর্ণাঙ্গভাবে অবলম্বন করতে সক্ষম না হও তাহলে পূর্ণাঙ্গের যা কাছাকাছি সে অনুপাতে ‘আমল কর। অর্থাৎ- তোমরা সোজাভাবে ‘আমল কর, অতঃপর যদি তোমরা তা করতে অক্ষম হয়ে যাও তাহলে তোমরা তার কাছাকাছি ‘আমল কর। হাফেয বলেন, তোমরা বাড়াবাড়ি করবে না, করলে তোমরা নিজেদেরকে ‘ইবাদাতের ক্ষেত্রে কষ্টে পতিত করবে। এটা এ কারণে যে, যাতে এ পরিস্থিতি তোমাদেরকে বিরক্তির দিকে ধাবমান না করে, পরিশেষে যা তোমাদের ‘আমল বর্জন ও বাড়াবাড়ি করার কারণ হয়।

(وَرُوْحُوْا) উল্লেখিত ক্রিয়াটি الروح থেকে এসেছে। আর তা দিনের দ্বিতীয় অর্ধেকের শুরু অংশে চলা। জাযারী বলেনঃ الغدو শব্দের অর্থ সকাল সকাল বের হওয়া আর الروح শব্দের অর্থ বিকাল বেলাতে প্রত্যাবর্তন করা। উদ্দেশ্য দিনের অংশসমূহে সময়ে সময়ে তোমরা ‘আমল কর।

(وَشَىْءٌ مِنَ الدُّلْجَةِ) অর্থাৎ- রাতে চলা, উদ্দেশ্য রাতে ‘আমল করা। এখানে রাতর কিছু সময় বলা হয়েছে তার কারণ হল, সমস্ত রাত চলাচল কঠিন। অতএব এতে সমস্তকে বাদ দিয়ে স্বল্পতার দিকে এবং সহানুভূতির উপর উৎসাহ প্রদানের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। হাদীসটিতে شيئ-কে লক্ষ্য করে কথা বলা হয়েছে আর তার সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা গোপন আছে, অর্থাৎ- তোমরা তাতে ‘আমল কর অথবা তাতে তোমাদের ‘আমলকে উদ্দেশ্য করা হয়। কারো মতে গোপনীয় অংশটুকু হল ‘তবে রাতের কিছু অংশে’। একমতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ- তোমরা সকাল সন্ধায় ‘আমল কর এবং রাত্রের কিছু অংশে অথবা অর্থটি এমন হবে ‘তোমরা রাতের কিছু অংশের মাধ্যমে সাহায্য নাও’।

(والقَصْدَ الْقَصْدَ) অর্থাৎ- তোমরা সমতাপূর্ণ মধ্যম পন্থা অবলম্বন কর। জাযারী বলেন, তোমরা কাজে ও কথায় সমতাপূর্ণ মধ্যম পন্থা অবলম্বন কর।

(تَبْلُغُوْا) অর্থাৎ- তোমরা ঐ স্তরে পৌঁছতে পারবে যা তোমাদের লক্ষ্য। হাদীসে ‘ইবাদাতকারীকে মুসাফির তথা ভ্রমণকারীদের সাথে সাদৃশ্য দেয়ার কারণ হল ‘ইবাদাতকারী ভ্রমণকারীর ন্যায় তার অবস্থানস্থলের দিকে ভ্রমণকারী। আর তা হল জান্নাত। যেন তিনি বলেছেন তোমরা ভ্রমণের মাধ্যমে সমস্ত সময়কে আয়ত্ত করিও না। বরং তোমরা প্রাণবন্ততার সময়সমূহকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাও। আর তা হল দিনের শুরু, শেষ ও রাত্রের কিছু অংশ এবং এ দুয়ের মাঝে যা আছে তাতে তোমরা তোমাদের নিজেদের প্রতি রহম কর যাতে করে তা ‘ইবাদাত ছেড়ে দিয়ে ‘ইবাদাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণ না হয়। মহান আল্লাহ বলেন, অর্থাৎ- ‘‘তোমরা দিনের দু’প্রান্তে এবং রাতের একটি অংশে সালাত প্রতিষ্ঠা কর’’- (সূরা হূদ ১১ : ১১৪)।

ইমাম ত্বীবী বলেন, প্রথমে বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই ‘আমল আবশ্যকীয়ভাবে কাউকে মুক্তি দেয় না, এ বর্ণনার কারণ যাতে মানুষ ‘আমলের উপর ভরসা করে বসে না থাকে। শেষে ‘আমল করার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে যাতে করে মানুষ ‘আমলের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি সমান, এর উপর ভিত্তি করে বাড়াবাড়ি না করে। বরং মুক্তির ক্ষেত্রে ‘আমল সর্বনিম্ন কার্যকরী হিসেবে গণ্য; যদিও তা মুক্তির পথ আবশ্যক না করে।