পরিচ্ছেদঃ ৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - সওম পবিত্র করা
২০০৪-[৬] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা এক সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে বসেছিলাম। হঠাৎ করে এক ব্যক্তি (সালামাহ্ ইবনু সাখর আল বায়াযী) তাঁর কাছে হাযির হলো ও বলতে লাগল, হে আল্লাহর রসূল! আমি ধ্বংস হয়ে গেছি! তিনি বললেন, তোমার কি হয়েছে? সে বলল, আমি সওমরত অবস্থায় স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করে বসেছি। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমার কি কোন গোলাম আছে যাকে তুমি মুক্ত করে দিতে পার? লোকটি বলল, না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তুমি কি একাধারে দু’ মাস সিয়াম পালন করতে পারবে? সে বলল, না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তুমি কি ষাটজন মিসকীনকে খাওয়াতে পারবে? সে বলল, না। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তুমি বসো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও এখানে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। ঠিক এ সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট একটি ’আরাক’ নিয়ে আসা হলো। এতে ছিল খেজুর।
’আরাক’ একটি বড় ভাণ্ড বা গাঁইটকে বলা হয় (যা খেজুরের পাতা দিয়ে তৈরি; এতে ষাট থেকে আশি সের পর্যন্ত খেজুর ধরে)। এটা দেখে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ প্রশ্নকারী কোথায়? লোকটি বলল, এই তো আমি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এটি নিয়ে নাও। এগুলো সাদাকা্ করে দাও। লোকটি বলল, হে আল্লাহর রসূল! আমি কি এগুলো আমার চেয়েও গরীবকে দান করব? আল্লাহর কসম, মদীনার উভয় প্রান্তে এমন কোন পরিবার নেই, যারা আমার পরিবারের চেয়ে বেশী অভাবী। মদীনার উভয় প্রান্ত বলতে সে দু’টি কঙ্করময় এলাকা বুঝিয়েছে। (তার কথা শুনে) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে ফেললেন। এমনকি তাঁর সামনের পাটির দাঁতগুলো দেখা গেল। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আচ্ছা এ খেজুরগুলো তোমার পরিবার-পরিজনকে খাওয়াও। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ تَنْزِيْهِ الصَّوْمِ
وَعَن أبي هُرَيْرَة قَالَ: بَيْنَمَا نَحْنُ جُلُوسٌ عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذْ جَاءَهُ رَجُلٌ فَقَالَ: يَا رَسُول الله هَلَكت. قَالَ: «مَالك؟» قَالَ: وَقَعْتُ عَلَى امْرَأَتِي وَأَنَا صَائِمٌ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «هَلْ تَجِدُ رَقَبَةً تُعْتِقُهَا؟» . قَالَ: لَا قَالَ: «فَهَلْ تَسْتَطِيعُ أَنْ تَصُومَ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ؟» قَالَ: لَا. قَالَ: «هَلْ تَجِدُ إِطْعَامَ سِتِّينَ مِسْكِينًا؟» قَالَ: لَا. قَالَ: «اجْلِسْ» وَمَكَثَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم فَبينا نَحْنُ عَلَى ذَلِكَ أُتِيَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِعَرَقٍ فِيهِ تَمْرٌ وَالْعَرَقُ الْمِكْتَلُ الضَّخْمُ قَالَ: «أَيْنَ السَّائِلُ؟» قَالَ: أَنَا. قَالَ: «خُذْ هَذَا فَتَصَدَّقْ بِهِ» . فَقَالَ الرَّجُلُ: أَعَلَى أَفْقَرَ مِنِّي يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ فَوَاللَّهِ مَا بَيْنَ لَابَتَيْهَا يُرِيدُ الْحَرَّتَيْنِ أَهْلُ بَيْتِ أَفْقَرُ م أَهْلِ بَيْتِي. فَضَحِكَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى بَدَتْ أَنْيَابُهُ ثُمَّ قَالَ: «أَطْعِمْهُ أهلك»
ব্যাখ্যা: (يَا رَسُوْلَ اللهِ هَلَكْتُ) ‘‘হে আল্লাহর রসূল! আমি ধ্বংস হয়ে গিয়েছি’’ হাদীসের এ অংশ দ্বারা প্রমাণ করা হয় যে, লোকটি স্বেচ্ছায় এ কাজ করে ছিল। কেননা هلك শব্দটি অবাধ্যতার রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আর ইচ্ছাকৃত অন্যায়কে অবাধ্যতা বলা যায়। ভুলে কোন অন্যায় করলে তা অবাধ্যতা নয়। এ থেকে বুঝা গেল যে, ভুলে গিয়ে কেউ এ কাজ করলে তার জন্য কাফফারা নেই। এ বিষয়ে মতভেদ পূর্বের হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে।
(هَلْ تَجِدُ رَقَبَةً تُعْتِقُهَا؟) ‘‘তুমি কি দাস আযাদ করতে সক্ষম?’’ যারা বলেন কাফফারার ক্ষেত্রে কাফির দাস আযাদ করা বৈধ তারা হাদীসটিকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যেমন হানাফীগণ এবং ইবনু হাযম। পক্ষান্তরে ইমাম মালিক, শাফি‘ঈ এবং আহমাদ ইবনু হাম্বল-এর মতে অবশ্যই মুসলিম দাস হতে হবে। কেননা হত্যার কাফফারাতে মুসলিম হওয়া শর্ত। এর ভিত্তি এই যে, বিধান যখন একই হয় তখন কারণ ভিন্ন হলেও শর্তমুক্ত বিধানকে শর্তযুক্ত বিধানের আওতাভুক্ত করা হবে কি? যদি শর্তযুক্ত করা হয় তা কি কিয়াম কিয়াসের ভিত্তিতে, না অন্য কিছু দ্বারা? যার বিস্তারিত বর্ণনা উসূলের কিতাবসমূহের মধ্যে বিদ্যমান।
(إِطْعَامَ سِتِّينَ مِسْكِينًا؟) ‘‘ষাটজন মিসকীনকে খাওয়াতে সক্ষম কি?’’ ইবনু দাক্বীক আল ‘ঈদ বলেনঃ হাদীসের এ অংশ প্রমাণ করে উল্লেখিত সংখ্যক মিসকীনকে খাওয়াতে হবে। দশজন মিসকীনকে ছয়দিন খাওয়ালে চলবে না। হানাফীদের প্রসিদ্ধ অভিমত এই যে, একজন মিসকীনকে ষাটদিন খাওয়ালেও চলবে। হাফেয ইবনু হাজার বলেনঃ إِطْعَامَ থেকে উদ্দেশ্য খাদ্য দান করা, খাওয়ানো শর্ত নয়।
হাদীস প্রমাণ করে যে, সিয়াম ভঙ্গের কাফফারা হাদীসে বর্ণিত তিনটি বিষয়ের যে কোন একটি কাফফারা হিসেবে যথেষ্ট জমহূর ‘উলামাগণের অভিমত এটিই।
ইমাম মালিক-এর প্রসিদ্ধ মত এই যে, সহবাসের মাধ্যমে সিয়াম ভঙ্গ হলে তার কাফফারা হবে খাদ্য খাওয়ানো অন্য কিছু নয়। আর পানাহারের মাধ্যমে সিয়াম ভঙ্গ হলে হাদীসে বর্ণিত তিনটির কোন একটি বিষয় কাফফারা হিসেবে যথেষ্ট।
হাদীসে বর্ণিত কাফফারার বিষয়সমূহ হতে যে কোন একটি ইচ্ছামত দেয়া যাবে। নাকি প্রথমে বর্ণিত বিষয় আদায়ে অপারগ হলে ২য়টি আর ২য়টিতে অপারগ হলে ৩য়টি করতে হবে? এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।
১. ইমাম শাফি‘ঈ, আহমাদ ও আবূ হানীফার মতে গোলাম আযাদ করতে অসমর্থ হলে দুই মাস সিয়াম পালন করবে। তা করতে অপারগ হলে ষাটজন মিসকীন খাওয়াবে। অত্র হাদীসটি তাদের দলীল।
২. কাযী ‘ইয়ায-এর মতে ধারাবাহিকতা উদ্দেশ্য নয়। অতএব যে কোন একটি করলেই চলবে।
(خُذْ هٰذَا فَتَصَدَّقْ بِه) ‘‘এটা নিয়ে যাও এবং তা দ্বারা সদাকাহ্ কর’’ প্রমাণিত হয় যে, অসমর্থ হলেই কাফফারা রহিত হয়ে যায় না।
(أَطْعِمْهُ أَهْلَكَ) ‘‘তোমার আহালকে খাওয়াবে’’ অর্থাৎ- যাদের ভরণ-পোষণ তোমার দায়িত্বে তাদের খাওয়াবে।
হাদীসের এ অংশ প্রমাণ করে যে, অসমর্থ ব্যক্তির কাফফারা রহিত হয়ে যায়। ইমাম আওযা‘ঈ এ মতের প্রবক্তা। কেননা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত গ্রাম্য ব্যক্তিতে বললেন, ‘‘তোমার আহালকে খাওয়াবে’’ তিনি তাকে আর অন্য কোন কাফফারা দিতে বলেননি। ইমাম শাফি‘ঈ ও ইমাম আহমাদ হতেও এমন একটি বর্ণনা রয়েছে। ইমাম যুহরী বলেনঃ অবশ্যই কাফফারা দিতে হবে। কেননা ঐ ব্যক্তি যখন তার অক্ষমতার কথা প্রকাশ করলেন তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাফফারা রহিত করেননি। ইমাম আহমাদ হতেও এমন একটি বর্ণনা রয়েছে অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে আবূ হানীফাহ্, সাওরী ও আবূ সাওর থেকে।
ইমাম শাফি‘ঈ থেকে উপরে বর্ণিত দু’ ধরনের মন্তব্যই বর্ণিত আছে। প্রথম অভিমতটিই সঠিক। কেননা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ ঐ গ্রাম্য ব্যক্তিকে কাফফারা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী (أَطْعِمْهُ أَهْلَكَ) এটিই তার প্রমাণ। আল্লাহ অধিক ভাল জানেন। জমহূর ‘উলামাগণের মতে কাফফারা আদায়ের সাথে সাথে উক্ত সিয়ামটিও কাযা করতে হবে। ইমাম চতুষ্টয়ের অভিমতও তাই।