পরিচ্ছেদঃ ১৭. প্রথম অনুচ্ছেদ - তাশাহুদের মধ্যে দু‘আ
তাশাহুদের মধ্যে দু’আ করা- এর অর্থ হচ্ছে সালাতের শেষে দরূদ পাঠ করার পর দু’আ করা। আর তা হবে, সালাম ফিরানোর পূর্বে। এ সময় দু’আ করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।
৯৩৯-[১] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের মধ্যে (সালাম ফিরাবার আগে) দু’আ করতেন। বলতেন,
’’আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিন ’আযা-বিল কবরি, ওয়া আ’ঊযুবিকা মিন ফিতনাতিল মাসীহিদ্ দাজ্জা-লি। ওয়া আ’ঊযুবিকা মিন ফিতনাতিল মাহ্ইয়া- ওয়া ফিতনাতিল মামা-তি। আল্লা-হুমা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিনাল মা’সামি ওয়াল মাগরামি’’
(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট পানাহ চাচ্ছি কবরের ’আযাব থেকে। আমি তোমার নিকট পানাহ চাচ্ছি দাজ্জালের পরীক্ষা হতে। আমি তোমার নিকট পানাহ চাচ্ছি জীবন ও মৃত্যুর পরীক্ষা হতে। হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে পানাহ চাচ্ছি গুনাহ ও দেনার বোঝা হতে।)।
এক ব্যক্তি বলল, হে নবী! আপনি দেনার বোঝা হতে বড় বেশী পানাহ চেয়ে থাকেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ কেউ যখন দেনাদার হয় তখন কথা বলে, মিথ্যা বলে এবং অঙ্গীকার করে তা ভঙ্গ করে। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الدُّعَاءِ فِي التَّشَهُّدِ
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدْعُو فِي الصَّلَاةِ يَقُولُ: «اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَفِتْنَةِ الْمَمَاتِ اللَّهُمَّ إِنِّي أعوذ بك من المأثم والمغرم» فَقَالَ لَهُ قَائِل مَا أَكثر مَا تستعيذ من المغرم يَا رَسُول الله فَقَالَ: «إِنَّ الرَّجُلَ إِذَا غَرِمَ حَدَّثَ فَكَذَبَ وَوَعَدَ فَأَخْلَفَ»
ব্যাখ্যা: (كَانَ يَدْعُو فِي الصَّلَاةِ) সালাতের মধ্যে দু‘আ করতেন। অর্থাৎ- তিনি তাশাহুদের পরে সালামের ফিরানোর পূর্বে দু‘আ করতেন যার প্রমাণ বহন করছে এর পরের হাদীস। আর এ হাদীসের মধ্যে শেষ তাশাহুদের পরে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার স্থান সুনির্দিষ্ট ও নির্ধারিত এবং ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)-এর হাদীস মুত্বলাক বা অনির্দিষ্ট, সুতরাং মুত্বলাক বা অনির্দিষ্টের উপর মুক্বাইয়াদ বা নির্দিষ্ট হাদীস প্রাধান্যময় হবে।
(اَللّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ) হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি কবরের ‘আযাব হতে, উক্ত হাদীসে ক্ববরের শাস্তির প্রমাণ পাওয়া যায় এবং বাতিলপন্থী সম্প্রদায় ‘‘মু‘তাযিলা’’ যারা কবরের ‘আযাবকে অস্বীকার করে তাদেরকে এ হাদীস দ্বারা প্রতিহত করা হয়েছে আর এ সংক্রান্ত হাদীস মুতাওয়াতির যা ইতিপূর্বে আলোচনা হয়ে গেছে।
(وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيْح) আর আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি তোমার নিকট মাসীহ হতে।
ফিতনাহ্ দ্বারা উদ্দেশ্য পরীক্ষা।
ফিতনাহ্ (ফিতনা) দ্বারা হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও ও গীবত হয় এবং অন্যান্য অর্থ বুঝানো হয়।
মাসীহ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
কারো মতে- মাসীহ দ্বারা উদ্দেশ্য দাজ্জাল। আবার কারো মতে ‘ঈসা ইবনু মারইয়াম (আঃ) ।
কিন্তু দাজ্জাল উদ্দেশ্য নিলে নির্দিষ্ট হয়ে যাবে। আর দাজ্জালকে ‘‘মাসীহ’’ উপাধি দেয়ার ক্ষেত্রে মতানৈক্য রয়েছে।
১. কারণ তার এক চোখ কানা হবে।
২. মুখমন্ডলের এক পাশে কোন ভ্রূ থাকবে না ও চোখও থাকবে না।
৩. পৃথিবীতে ভ্রমণকে সে সহজ করে নিবে তথা নিমিষেই বা নির্ধারিত দিনে পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তে বিচরণ করবে তবে মক্কা-মদীনায় প্রবেশ করতে পারবে না, কারণ আল্লাহ তা‘আলা মক্কা মদীনাহ্ বিশেষভাবে প্রোটোকল বা সংরক্ষণ করে রাখবেন বলে।
৪. কেননা তাকে ‘ঈসা (আঃ) মাসীহ বায়তুল আক্বসার কোন দূর্গে হত্যা করবেন।
আর ‘ঈসা (আঃ) -কে ‘‘মাসীহ’’ উপাধি দেয়ার ক্ষেত্রেও মতানৈক্য রয়েছে-
১. কেননা তিনি তাঁর মায়ের পেট হতে তৈল মালিশ করার মাধ্যমে ভূমিষ্ঠ হয়েছেন।
২. কেননা যাকারিয়্যা (রাঃ) তাকে স্পর্শ বা লালন-পালন করেছেন।
৩. কেননা তিনি কোন ব্যাধিগ্রস্ত লোককে স্পর্শ করলেই সুস্থ হয়ে যেত।
৪. তিনি পৃথিবীকে দ্রুত স্পর্শকারী তথা দ্রুত ভ্রমণকারী এবং অনেক স্থান ভ্রমণ করবেন।
৫. কারো মতে তার পায়ে মাটি স্পর্শ করতো না প্রভৃতি। আর মাজদ সিরাজী অভিধান লেখক ‘ঈসা (আঃ) কে মাসীহ উপাধি দেয়ার ক্ষেত্রে (৫০) পঞ্চাশটি কারণ লিখেছেন ‘‘মাশারেক আন্ওয়ার’’ নামক কিতাবের ব্যাখ্যায়।
দাজ্জাল তথা ধোঁকাবাজ মিথ্যুক, প্রতিশ্রত, মিথ্যুক, যে শেষ যামানায় প্রকাশ পাবে, আরেক অর্থ দাঁড়ায় প্রত্যেক বিপর্যয়কারী পথভ্রষ্ট।
আর মাসীহে দাজ্জালের ফিতনাহ্ (ফিতনা) দ্বারা উদ্দেশ্য সে দাজ্জালের হাতে স্বাভাবিকের বাহিরে অলৌকিক বিষয়াদি বা ক্ষমতা প্রকাশ পাবে যা দুর্বল প্রকৃতির ঈমানদারকে ফিতনায় ফেলে দিবে বা পথভ্রষ্ট করবে।
(وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَفِتْنَةِ الْمَمَاتِ) আর আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি দুনিয়া ও আখিরাতের পরীক্ষা হতে।
ইমাম কুরতুবী বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মৃত্যুর উপস্থিতি ও কবরে জিজ্ঞাসাবাদের ফিতনাহ্ (ফিতনা) হতে সে আশ্রয় প্রার্থনা করবে। এ দু’ এর ভয়ানক অবস্থা হতে সে পরিত্রাণ চায় এবং এখানে যাতে সুদৃঢ় অবস্থায় থাকে তার প্রার্থনা করছে।
ইবনু দাক্বীক্ব বলেন, ফিত্বনাহ্ মাহ্ইয়া দুনিয়ার পরীক্ষা যা মানুষের জীবনে আসে বিপদ-আপদ, প্রবৃত্তি, অজ্ঞতা ইত্যাদির মাধ্যমে এবং মৃত্যুর সময় শেষ অবস্থা (তথা ঈমানী অবস্থায় মৃত্যুবরণ না করা)।
ফিতনাতুল মামা-ত তথা মৃত্যুর পরীক্ষা দ্বারা উদ্দেশ্য মৃত্যুর সময়। কবরের পরীক্ষা যেমন আসমার হাদীসে এসেছে বুখারীতে ‘‘নিশ্চয় তোমরা অনুরূপ ক্ববরে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে।’’
ইমাম ত্বীবী বলেন, দুনিয়ার পরীক্ষা দ্বারা উদ্দেশ্য ধৈর্য ও সন্তুষ্টি দূরীভূত হওয়া এবং বিপদাপদে পতিত হওয়া, পাপ কাজে অতিরঞ্জিতভাবে জড়িয়ে থাকা, সঠিক পথকে ছেড়ে দেয়া। আর মৃত্যুর পরীক্ষা দ্বারা উদ্দেশ্য মুনকার নাকীরের প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া ভীত-সন্ত্রস্ত ও হতবদ্ধির সাথে, আর কবরের ‘আযাব এবং সেখানকার কঠিন ও ভীতিকর অবস্থা।
উল্লিখিত হাদীসে একটি প্রশ্ন জাগে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষ্পাপ তো তাঁর আগের ও পরের সকল গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দিয়েছেন, তারপরেও কেন তিনি পাপ হতে দূরে থাকার জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন?
উত্তরে বলা হয়েছে-
* সত্যিকার অর্থে উম্মাতকে শিক্ষা দানের জন্য তিনি এমনটি করেছেন।
* তাঁর দু‘আটি ছিল উম্মাতের জন্য, অর্থাৎ- তখন এর অর্থ হবে ‘‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি আমার উম্মাতের জন্য।’’
* স্বয়ং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটি করতেন বিনয় প্রকাশের জন্যে নিজকে আল্লাহর বান্দা বলে পরিচয়ের জন্যে এবং আল্লাহর ভয়ে ও তাঁর বড়ত্ব প্রকাশের জন্যে তার নিকট নিজকে তুচ্ছ প্রকাশের জন্যে অতি উৎসাহিত হয়ে তার আদেশকে বাস্তবায়নের জন্যে।
আর দু‘আ কবূল হওয়া সত্ত্বেও বারবার আবেদন করাটা নিষেধ না, কেননা এর মাধ্যমে কল্যাণ অর্জিত হয় এবং মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। আর হাদীসটিতে উম্মাতকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এর উপর অবিচল থাকার জন্য তথা দু‘আ যেন নিয়মিত পড়ে।