পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - এ উম্মতের [উম্মতে মুহাম্মাদী (সা.)-এর] সাওয়াবের বিবরণ
অন্য উম্মতের তুলনায় রহমাতপ্রাপ্ত এ উম্মতের আধিক্য, ও সীমাহীন ফযীলত ও নেকীর বর্ণনা প্রমাণিত। এর প্রমাণে আল্লাহ তা’আলা বলেন, (کُنۡتُمۡ خَیۡرَ اُمَّۃٍ اُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ) অর্থাৎ “তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত যাদের উত্থান ঘটেছে মানব জাতির জন্য...”- (সূরা আ-লি ইমরান ৩:১১০)। আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, (وَ کَذٰلِکَ جَعَلۡنٰکُمۡ اُمَّۃً وَّسَطًا لِّتَکُوۡنُوۡا شُهَدَآءَ عَلَی النَّاسِ) “আর এভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত করেছি, যাতে তোমরা লোকেদের ওপর সাক্ষী হও এবং নবী তোমাদের ওপর সাক্ষী হয়...”- (সূরা আল বাক্বারাহ ২: ১৪৩)। অতএব শ্রেষ্ঠ উম্মত বলতে এ উম্মতে মুহাম্মাদী-এর হওয়া এটাই যথেষ্ট। যিনি হলেন সৃষ্টির সেরা, নবী সর্দার ও সর্বশেষ নবী। (মিশকাতুল মাসাবীহ - মুম্বাই ছাপা, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২৯৭)
৬২৮৩-[১] ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: অতীত জাতিসমূহের সাথে তোমাদের জীবনের তুলনা হলো, ’আসরের সালাতের সময় হতে সূর্যাস্ত অবধি। প্রকৃতপক্ষে তোমাদের এবং ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের উপমা হলো ঐ লোকেদের মত, যে শ্রমিকদেরকে কাজে নিযুক্ত করে বলল, তোমাদের মধ্যে কে এক এক কীরাত্বের (বিশেষ মুদ্রা) বিনিময়ে দ্বিপ্রহর অবধি আমরা কাজ করব? ফলে ইয়াহূদীরা দ্বিপ্রহর অবধি এক এক কীরাত্বের শর্তে কাজ করল। অতঃপর ঐ লোক আবার বলল, তোমাদের মধ্যে কে এক এক কীরাত্বের বিনিময়ে দ্বিপ্রহর হতে ’আসর অবধি আমার কাজ করবে? এবার খ্রিস্টানরা দ্বিপ্রহর হতে ’আসর অবধি এক এক কীরাকের বিনিময়ে কাজ করল। লোকটি অতঃপর বলল, তোমাদের কে ’আসর হতে সূর্যাস্ত অবধি দুই দুই কীরাত্বের বিনিময়ে আমার কাজ করবে? জেনে রাখ! লোক তোমরাই, যারা আসরের সালাত হতে সূর্যাস্ত অবধি কাজ করবে এবং জেনে রাখ! পারিশ্রমিক তোমাদের জন্য দ্বিগুণ। এতে ইয়াহুদী এবং খ্রিষ্টান উভয় দল ভীষণভাবে রাগান্বিত হলো এবং বলল, আমাদের কাজ বেশি এবং পারিশ্রমিক কম। তখন আল্লাহ তা’আলা বললেন, আমি কি তোমাদের পাওনা হক সম্পর্কে সামান্যটুকুও যুলম করেছি? তারা বলল, না। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা বললেন, এটা আমার অনুকম্পা যাকে ইচ্ছা দান করি। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب ثَوَاب هَذِه)
عَنِ ابْنِ عُمَرَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِنَّمَا أَجَلُكُمْ فِي أَجَلِ مَنْ خَلَا مِنَ الْأُمَمِ مَا بَيْنَ صَلَاةِ الْعَصْرِ إِلَى مَغْرِبِ الشَّمْسِ وَإِنَّمَا مَثَلُكُمْ وَمَثَلُ الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى كَرَجُلٍ اسْتَعْمَلَ عُمَّالًا فَقَالَ: من يعْمل إِلَى نِصْفِ النَّهَارِ عَلَى قِيرَاطٍ قِيرَاطٍ فَعَمِلَتِ الْيَهُودُ إِلَى نِصْفِ النَّهَارِ عَلَى قِيرَاطٍ قِيرَاطٍ ثُمَّ قَالَ: مَنْ يَعْمَلُ لِي مِنْ نِصْفِ النَّهَارِ إِلَى صَلَاةِ الْعَصْرِ عَلَى قِيرَاطٍ قِيرَاطٍ فَعَمِلَتِ النَّصَارَى مِنْ نِصْفِ النَّهَارِ إِلَى صَلَاةِ الْعَصْرِ عَلَى قِيرَاطٍ قِيرَاطٍ. ثُمَّ قَالَ: مَنْ يَعْمَلُ لِي مِنْ صَلَاةِ الْعَصْرِ إِلَى مَغْرِبِ الشَّمْسِ عَلَى قِيرَاطَيْنِ قِيرَاطَيْنِ؟ أَلَا فَأَنْتُمُ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ مِنْ صَلَاةِ الْعَصْرِ إِلَى مَغْرِبِ الشَّمْسِ أَلَا لَكُمُ الْأَجْرُ مَرَّتَيْنِ فَغَضِبَتِ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى فَقَالُوا: نَحْنُ أَكْثَرُ عَمَلًا وَأَقَلُّ عَطَاءً قَالَ الله تَعَالَى: هَل ظَلَمْتُكُمْ مِنْ حَقِّكُمْ شَيْئًا؟ قَالُوا: لَا. قَالَ اللَّهُ تَعَالَى: فَإِنَّهُ فَضْلِي أُعْطِيهِ مَنْ شِئْتُ . رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (3459) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: (نَحْنُ أَكْثَرُ عَمَلًا وَأَقَلُّ عَطَاءً) উদ্দেশ্য হলো এই যে, ইয়াহুদী ও নাসারার প্রত্যেক দলের বয়স অধিক ছিল এবং ‘ইবাদাতও ছিল অনেক। কিন্তু উম্মতে মুহাম্মাদীর বয়স কম হওয়ার কারণে ও স্বল্প “ইবাদাতে তাদের সাওয়াব দ্বিগুণ, এটা আল্লাহ তা'আলার অনুগ্রহ। এ হাদীসের মতো বর্ণনা ইঞ্জীলেও রয়েছে। যেমন মাত্তার ইঞ্জীলের বিশতম অধ্যায়ে এক আয়াতে ‘ঈসা (আঃ) বলেন, এক মালিক সকালে একজন দিনমজুরকে এক দীনারের বিনিময়ে নিয়োগ করে স্বীয় বাগানে প্রেরণ করেন। কিছুক্ষণ পরে আবার আরো এক শ্রমিককে একই পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিয়োগ করেন।
প্রথম শ্রমিক অভিযোগ করে বলল, আমাদের সারা দিনের শ্রম ও এ ব্যক্তির অল্প শ্রমের বিনিময় সমান হয়ে গেল না? মালিক জবাবে বললেন, আমি কি তোমাদের ওপর যুলম করেছি, যে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তোমাদেরকে নির্ধারণ করেছি তাতে তোমাদের পাওনা কম হয়েছে কি? নিজের সম্পদে আমার স্বাধীনতা রয়েছে। যাকে যেমন ইচ্ছা তেমন দেয়। এর ভিত্তিতে অগ্রবর্তীরা পেছনে পড়ে যায় এবং পূর্ববর্তীরা পশ্চাৎভাগে চলে আসে। মানুষ তো অনেক কিন্তু গ্রহণযোগ্য ও পুণ্যবান কমই থাকে। শুধু ইঞ্জীলের আলোচনা থেকে এ কথা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত যে, উম্মতে মূসা ও ‘ঈসা (আঃ) থেকে উম্মতি মুহাম্মাদী সম্মানে ও সাওয়াবে শ্রেষ্ঠ। সর্বশেষ উম্মত কিন্তু এটা আল্লাহর তা'আলার মহা অনুগ্রহ। ইয়াহূদী ও নাসারাদের শোরগোলে কী হবে? (মিশকাতুল মাসাবীহ - মুম্বাই ছাপা, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২৯৮)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - এ উম্মতের [উম্মতে মুহাম্মাদী (সা.)-এর] সাওয়াবের বিবরণ
৬২৮৪-[২] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আমার উম্মতের মাঝে আমার প্রতি অত্যধিক ভালোবাসা পোষণকারী লোক তারা হবে, যারা আমার পরে জন্মগ্রহণ করবে। তাদের কেউ এই আকাক্ষা রাখবে, যদি সে আমাকে দেখতে পায়, তাহলে আমার জন্য নিজেদের পরিবার-পরিজন ও ধনসম্পদ কুরবান করে দেবে। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب ثَوَاب هَذِه)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «إِنَّ مِنْ أَشَدِّ أمتِي لي حُبَّاً نَاسا يَكُونُونَ بَعْدِي يَوَدُّ أَحَدُهُمْ لَوْ رَآنِي بِأَهْلِهِ وَمَاله» . رَوَاهُ مُسلم
رواہ مسلم (12 / 2832)، (7145) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: (إِنَّ مِنْ أَشَدِّ أمتِي لي حُبَّاً) অথাৎ নবী (সা.) -কে দর্শনের আকাঙ্ক্ষায় স্বীয় পরিবার-পরিজন ও সহায় সম্পদকে উৎসর্গ করার আগ্রহ ব্যক্ত করবে। (মিশকাতুল মাসাবীহ - মুম্বাই ছাপা, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২৯৮) সেকালে অন্যদের তুলনায় তারা তাঁর প্রতি অসামান্য ভালোবাসা দেখানোর মতো মানুষ।
(يَوَدُّ أَحَدُهُمْ لَوْ رَآنِي بِأَهْلِهِ وَمَاله) মুযহির (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এর অর্থ হলো, যদি আমার সাথে তাদের দর্শন ও মিলিত হওয়ার সময় আসে তবে তারা পরিবার ও সম্পদকে কুরবান করার আকাক্ষা পোষণ করবে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - এ উম্মতের [উম্মতে মুহাম্মাদী (সা.)-এর] সাওয়াবের বিবরণ
৬২৮৫-[৩] মু’আবিয়াহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী (সা.) -কে বলতে শুনেছি, আমার উম্মতের একদল লোক সর্বদা আল্লাহর হুকুমের উপর অটল থাকবে। যারা তাদেরকে অপমানিত করতে চাইবে এবং যারা তাদের বিরুদ্ধাচরণ করবে, এরা তাঁদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না, এমনকি তাঁরা কিয়ামত অবধি এ অবস্থায় বিদ্যমান থাকবেন। (বুখারী ও মুসলিম)
আনাস (রাঃ)-এর হাদীস (إِنَّ مِنْ عِبَادِ الله) “আল্লাহর বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত” “কিসাস’ অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে।
الفصل الاول (بَاب ثَوَاب هَذِه)
وَعَن مُعَاوِيَة قَالَ: سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «لَا يَزَالُ مِنْ أُمَّتِي أُمَّةٌ قَائِمَةٌ بِأَمْرِ اللَّهِ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ وَلَا مَنْ خَالَفَهُمْ حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللَّهِ وَهُمْ عَلَى ذَلِكَ» . مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ وَذُكِرَ حَدِيثُ أَنَسٍ «إِنَّ مِنْ عِبَادِ الله» فِي «كتاب الْقصاص»
متفق علیہ ، رواہ البخاری (3641) و مسلم (174 / 1037)، (4955) و حدیث انس :’’ ان من عباد اللہ ‘‘ تقدم (3460) ۔
(مُتَّفق عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: (أُمَّةٌ قَائِمَةٌ بِأَمْرِ اللَّهِ) এ দল থেকে হাদীসের অনুসারীকে বুঝানো হয়েছে। যেমন ‘আলী ইবনু মাদীনী (রহিমাহুল্লাহ) তিরমিযী (রহিমাহুল্লাহ)-এর হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন যে, এ দল হচ্ছে আসহাবুল হাদীস তথা হাদীসের অনুসারীর দল। (মিশকাতুল মাসাবীহ - মুম্বাই ছাপা, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২৯৮)।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বাণীর অর্থ হলো আমার উম্মত সব একেবারে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে এমনটি নয়। বরং একটি দল তখনো অবশ্যই হাকের উপর কায়েম থাকবে। আর এটা হাদীসের অনুসারী দল। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রহিমাহুল্লাহ) এ কথা খুবই সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। অনেক ‘আলিম পরিষ্কারভাবে লিখেছেন যে, উপরোক্ত আলোচনার প্রমাণিত দল বলতে এমন লোকেদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা মানুষের মতামত ও অসার বলাবলি থেকে দূরে থেকে শুধু কিতাব ও সুন্নাতের প্রকাশ্য অর্থকে নিজেদের ‘আমলের ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং সাহাবা, তাবিঈ, তাবি তাবি'ঈন, মুহাদ্দিসীন ও আয়িমায়ে মুজতাহিদীনদের ‘আমলকে স্বীয় ‘আমলরূপে পরিগ্রহণ করেন। দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, উল্লেখিত ইসলামী বুযুর্গরা বর্তমানের অন্ধ তাক্বলীদকে মানতেন না। না তাদের মাযহাবের নামে আলাদা আলাদা কোন দল ছিল, যেমন পরবর্তীতে কা'বা ঘরের চারপাশে চার মুসল্লার মতো নিন্দনীয় ভাগে বিভক্তির সৃষ্টি হয়েছিল। আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া যে, হাদীসের অনুসারীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে আজ মুসলিম আবার কিতাব ও সুন্নাতের এক ও অভিন্ন পথে অগ্রসর হচ্ছে। (সহীহুল বুখারী - ৫ম খণ্ড, হা. ৩৬৪১, দারুল ইলম, মুম্বাই)