পরিচ্ছেদঃ ১৪. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯২৫-[১৫] সাওবান হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দু’আ ব্যতীত আর কিছুই ভাগ্যকে পরিবর্তন করে না, পুণ্য ব্যতীত আর কিছুই আয়ু বাড়ায় না এবং কৃত পাপ ব্যতীত আর কিছুই মানুষকে জীবিকা থেকে বঞ্চিত করে না। (ইবনু মাজাহ)[1]
عَنْ ثَوْبَانَ
قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَرُدُّ الْقَدَرَ إِلَّا الدُّعَاءُ وَلَا يَزِيدُ فِي الْعُمْرِ إِلَّا الْبِرُّ وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيُحْرَمُ الرِّزْقَ بِالذَّنْبِ يُصِيبُهُ» . رَوَاهُ ابْنُ مَاجَهْ
ব্যাখ্যাঃ সাওবান (রাঃ) তিনি ছিলেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আযাদকৃত গোলাম। তার বর্ণিত এ হাদীসটি একটি বহুল আলোচিত হাদীস। হাদীসটিতে বলা হয়েছে তাকদীর পরিবর্তনের কথা। তাকদীর দুই প্রকার- (১) তাকদীরে মু‘আল্লাক যা পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। (২) তাকদীরে মুবরাম যা কখনো পরিবর্তন হয় না। অত্র হাদীসে দু‘আর মাধ্যমে যে তাকদীর পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে, সেটি হলো তাক্বীদীরে মু‘আল্লাক এবং দু‘আও এমন দু‘আ যা নিশ্চিতভাবে কবুল করা হয়।
‘আল্লামা তূরিবিশ্তী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ এখানে তাকদীর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর আদেশ। হাদীসের দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, ভালো কাজ মানুষের হায়াত বৃদ্ধি করে, তাই যদি দু‘আ না করে তাহলে তাকদীরে মু‘আল্লাক যেভাবে ছিল ঠিক সেভাবে অপরিবর্তিত থেকে যায়। যদি কল্যাণকর কাজ না করা হয় তাহলে হায়াত খাটো হয়ে যায়। তাকদীরে মু‘আল্লাক যেটা লাওহে মাহফূযে সংরক্ষেত কতিপয় মালাক (ফেরেশতা) এবং নবীগণ ও আল্লাহর কিছু বান্দার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। অন্যদিকে তাকদীরে মুবরাম যা আল্লাহর ‘ইল্মের সাথে সংশ্লিষ্ট, যা রয়েছে উম্মুল কিতাবে। মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘‘আল্লাহ যা ইচ্ছা মুছে ফেলেন, আর যা ইচ্ছা দৃঢ় রাখেন। তার কাছে রয়েছে উম্মুল কিতাব।’’ (সূরাহ্ আর্ রা‘দ ১৩ : ৩৯)
অতএব দু‘আ এবং সৎকর্ম খুবই জরুরী দু’টি বিষয়। যেগুলো তাকদীরের পরিবর্তন সাধন করতে পারে আর হায়াত বৃদ্ধি করতে পারে।
তবে এ দু’টি বিষয়ও তাকদীরে লিপিবদ্ধ থাকে, যেমন সৎকর্ম করা অসৎকর্ম করা যা সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য হওয়ার কারণ, এ দু’টিই তাকদীরে লিপিবদ্ধ থাকে। অত্র হাদীসের তাকদীর পরিবর্তনের দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তাকদীরে নির্ধারিত বিষয় সম্পাদন করতে সহজ করে দেয়া, এমন সহজ মনে হবে যেন তাকদীর পরিবর্তন হয়ে গেছে। হায়াত বৃদ্ধি দ্বারা উদ্দেশ্য হলো হায়াতে বারাকাত দান করা।
শারহুস্ সুন্নাহতে আবূ হাতিম সিজিস্তানী (রহিমাহুল্লাহ) অত্র হাদীসের অর্থ বিশ্লেষণে বলেনঃ মানুষ সর্বদা দু‘আ করতে থাকবে, এটা তাকে তাকদীরের সঠিক পথে পরিচালনা করবে। যেন মনে হবে তার তাকদীরের খারাপ বিষয়গুলো পরিবর্তিত হয়ে ভালো হয়ে গেছে। কল্যাণকর কাজ তার জীবনকে সুন্দর করে তুলবে, মনে হবে যেন তার হায়াত বৃদ্ধি করে দেয়া হয়েছে। অপরদিকে পাপ সুন্দর, উত্তম রিয্ক্বের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আর তার শেষ পরিণাম খুবই জঘন্য হয়। মুযহির (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ হাদীসের শব্দ রিজিক দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আখিরাতের কল্যাণ। কেউ কেউ বলেছেন, এর দ্বারা দুনিয়ার সম্পদ ও সুস্থতাও উদ্দেশ্য হতে পারে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯২৬-[১৬] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম এবং এতে কুরআন পাঠ করতে শুনলাম। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ এ ব্যক্তি কে? মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) বললেনঃ হারিসাহ্ ইবনু নু’মান (রাঃ)। এটা শুনে সাহাবায়ি কিরামের মনে প্রশ্ন জাগল, হারিসাহ্ কিভাবে এত মর্যাদা লাভ করল? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ পুণ্যের প্রতিফল এরূপই, পুণ্যের প্রতিফল এরূপই। সে তার মায়ের সাথে সকল মানুষের তুলনায় সর্বোত্তম সদাচরণ করত। (শারহুস্ সুন্নাহ্ ও বায়হাক্বী’র ’’শু’আবুল ঈমানে’’ বর্ণনা করেছেন)[1]
অপর এক বর্ণনায় আছে, ’’আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম’’-এর স্থলে ’’আমি ঘুমালাম এবং নিজেকে জান্নাতে দেখলাম’’। এখানে فَرَأَيْتُنِيْ فِي الْجَنَّةِ বাক্যটি دَخَلْتُ الْجَنَّةَ-এর পরিবর্তে নেয়া হয়েছে।
وَعَنْ عَائِشَةَ
قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: دَخَلْتُ الْجَنَّةَ فَسَمِعْتُ فِيهَا قِرَاءَةً فَقُلْتُ: مَنْ هَذَا؟ قَالُوا: حَارِثَةُ بْنُ النُّعْمَانِ كَذَلِكُمُ الْبِرُّ كَذَلِكُمُ الْبِرُّ «. وَكَانَ أَبَرَّ النَّاسِ بِأُمِّهِ. رَوَاهُ فِي» شَرْحِ السُّنَّةِ «. وَالْبَيْهَقِيُّ فِي» شعب الْإِيمَان
وَفِي رِوَايَة: قَالَ: «نِمْتُ فرأيتني فِي الْجنَّة» بدل «دخلت الْجنَّة»
ব্যাখ্যাঃ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা, ‘‘আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম’’। এটা তার স্বপ্নযোগে জান্নাতে প্রবেশের কথা, যা অত্র হাদীসের শেষাংশে উদ্ধৃত হয়েছে।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে কারো কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ শুনলেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, এই তিলাওয়াত কার? উত্তরে মালায়িকাহ্ বললেন, হারিসাহ্ ইবনু নু‘মান-এর।
হারিসাহ্ ইবনু নু‘মান (রাঃ) ছিলেন জালীলুল কদর (অতীব মর্যাদাসম্পন্ন) সাহাবীগণের একজন, তিনি বাদ্র, উহুদসহ সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তার এই উন্নত মর্যাদার কথা শুনে সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, কেন তার এ মর্যাদা? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেনঃ সে তার মায়ের সাথে সর্বোত্তম আচরণ করত, সেজন্যই তার এ মর্যাদা।
(كَذَلِكُمُ الْبِرُّ) ‘পুণ্যের প্রতিফল এরূপই’ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাটি দু’বার উচ্চারণ করেছেন তাক্বীদ হিসেবে এবং কথাটির অধিক গুরুত্ব বুঝানোর জন্য। অর্থাৎ মায়ের খিদমাতের কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাকে এভাবে কবুল করেছেন যে, জান্নাতের মধ্যে তার কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ তার নবীকে শুনিয়েছেন। এখানে একবচনের স্থলে বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে সম্মানের জন্য।
হাদীসটি সামান্য শব্দের পরিবর্তনে শারহুস্ সুন্নাহ্, বায়হাক্বী, হাকিম প্রভৃতি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। ইমাম হাক্বীম এটা বুখারী, মুসলিমের শর্তে বর্ণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯২৭-[১৭] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রতিপালক আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টিতে এবং প্রতিপালকের অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টিতে। (তিরমিযী)[1]
وَعَنْ عَبْدِ
اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «رَضِيَ الربِّ فِي رضى الْوَالِدِ وَسُخْطُ الرَّبِّ فِي سُخْطِ الْوَالِدِ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ
ব্যাখ্যাঃ অত্র হাদীসে বলা হয়েছে রবের সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টিতে, অনুরূপভাবে রবের অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টিতে। ‘উলামায়ে কিরাম বলেন, ঠিক এরূপ কথাই মাতার সম্পর্কে প্রযোজ্য, বরং তার অধিকার আরো বেশি। অত্র হাদীসটির বিভিন্ন সানাদ রয়েছে, এক এক সনদে এক এক ধরনের শব্দ বিদ্যমান।
ইমাম ত্ববারানী (রহিমাহুল্লাহ)-এর এক বর্ণনায় এমন রয়েছে, رِضَا الرَّبِّ فِي رِضَا الْوَالِدَيْنِ وَسُخْطُهٗ فِي سُخْطِهِمَا অর্থাৎ পিতামাতার সন্তুষ্টিতে রবের সন্তুষ্টি, পিতা-মাতার অসন্তুষ্টিতে রবের অসন্তুষ্টি। কেননা আল্লাহ তা‘আলা আদেশ করেছেন পিতামাতার সেবা করতে, তাদের আনুগত্য করতে, তাই তাদের আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্যেরই নামান্তর।
অত্র হাদীসে পিতা-মাতার অবাধ্যতার জন্য চরম হুশিয়ারী দেয়া হয়েছে, পিতা-মাতার অবাধ্যতা কাবীরাহ্ গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। (মিরকাতুল মাফাতীহ, তুহফাতুল আহওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ১৯০০)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯২৮-[১৮] আবুদ্ দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন জনৈক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বলল : আমার স্ত্রী আছে। আমার মা চান যে, আমি আমার স্ত্রীকে ত্বলাক (তালাক) দেই। তখন আবুদ্ দারদা(রাঃ) বললেনঃ আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ পিতা হলেন জান্নাতের দরজাসমূহের মধ্যবর্তী দরজা। যদি তুমি ভালো মনে করো, তবে এ দরজাকে রক্ষণাবেক্ষণ করো; আর যদি ইচ্ছে করো, তবে বিনষ্ট করো। (তিরমিযী ও ইবনু মাজাহ)[1]
وَعَن أبي
الدَّرْدَاء أَنَّ رَجُلًا أَتَاهُ فَقَالَ: إِنَّ لِي امْرَأَةً وَإِن لي أُمِّي تَأْمُرُنِي بِطَلَاقِهَا؟ فَقَالَ لَهُ أَبُو الدَّرْدَاءِ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْوَالِدُ أَوْسَطُ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ فَإِنْ شِئْتَ فَحَافِظْ عَلَى الْبَابِ أَوْ ضَيِّعْ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَابْنُ مَاجَه
ব্যাখ্যাঃ মা যদি স্ত্রীকে ত্বলাক দিতে বলে তখন তার কারণ অনুসন্ধান করে দেখবে, যদি আল্লাহ ও তার রসূলের নাফরমানীমূলক না হয় তবে তার নির্দেশ মান্য করবে, তা না হলে তাকে বুঝিয়ে সমন্বয় করতে হবে। অত্র হাদীসে বলা হচ্ছে পিতার সেবা হলো জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। ‘আল্লামা কাযী ‘ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ জান্নাতে যাওয়ার উত্তম ‘আমল হলো পিতার সেবা, এর মাধ্যমে জান্নাতের উত্তম সিঁড়িতে আরোহণ সম্ভব। অনেকে বলেন, জান্নাতের অনেকগুলো দরজা আছে, প্রবেশের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত দরজা হলো মাঝখানের দরজা, আর পিতার সেবা করার মাধ্যমে এ দরজা দিয়ে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এখানে পিতা দ্বারা উদ্দেশ্য শুধু পিতাই নন, মাতাও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ১৮৯৯)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯২৯-[১৯] বাহয ইবনু হাকীম (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর পিতার মাধ্যমে তাঁর পিতামহ হতে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁর পিতামহ বলেছেনঃ আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রসূল! আমি কার সাথে উত্তম আচরণ করব? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তোমার মায়ের সাথে। আমি বললামঃ অতঃপর কার সাথে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তোমার মায়ের সাথে। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ তারপর কার সাথে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তোমার মায়ের সাথে। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ তারপর কার সাথে? এবার তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তোমার বাবার সাথে, তারপর তোমার নিকটতম আত্মীয়-স্বজনের সাথে, তারপর তাদের নিকটতম আত্মীয়দের সাথে। (তিরমিযী ও আবূ দাঊদ)[1]
وَعَنْ
بَهْزِ بْنِ حَكِيمٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جدَّه قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ مَنْ أَبَرُّ؟ قَالَ: «أُمَّكَ» قُلْتُ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: «أُمَّكَ» قُلْتُ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: «أُمَّكَ» قُلْتُ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: «أَبَاكَ ثُمَّ الْأَقْرَبَ فَالْأَقْرَبَ» رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ وَأَبُو دَاوُد
ব্যাখ্যাঃ অত্র হাদীস থেকে প্রমাণিত, মায়ের প্রতি সদয় হওয়া, সৎ ব্যবহার করা- এটা সন্তানের কাছ থেকে মায়ের অধিকার। অধুনা সমাজে নারী অধিকার নিয়ে চলছে নানা দাবী, কিন্তু সত্যিকার অর্থে সেগুলো নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে অধিকার ক্ষুণ্ণ করার পায়তারা। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় অত্র হাদীসটি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। (‘আওনুল মা‘বূদ ৮ম খন্ড, হাঃ ৫১৩০)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯৩০-[২০] ’আবদুর রহমান ইবনু ’আওফ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, কল্যাণময় মহান আল্লাহ বলেছেনঃ ’’আমি আল্লাহ’’, ’’আমিই রহমান’’, আমি ’’রহিম’’-কে সৃষ্টি করেছি। ’’রহিম’’ নামটি আমি আমার ’’রহমান’’ নাম থেকে অনুসৃত। সুতরাং যে ব্যক্তি আত্মীয়তাকে সংযোজিত করবে অর্থাৎ- আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল রাখবে, আমি তাকে আমার রহমতের সাথে সংযুক্ত করব। আর যে ব্যক্তি আত্মীয়তাকে ছিন্ন করবে, আমি তাকে আমার রহমত থেকে ছিন্ন করব। (আবূ দাঊদ)[1]
وَعَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ عَوْفٍ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم يَقُول: قَالَ الله تبَارك: أَنَا اللَّهُ وَأَنَا الرَّحْمَنُ خَلَقْتُ الرَّحِمَ وَشَقَقْتُ لَهَا مِنِ اسْمِي فَمَنْ وَصَلَهَا وَصَلْتُهُ وَمَنْ قطعهَا بتته . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد
ব্যাখ্যাঃ (رَحِمٌ) ‘রহিম’ শব্দটি (رَحْمٰنُ) ‘রহমা-ন’ শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। রহমান আল্লাহর একটি সিফাতি বা গুণবাচক নাম, অর্থ দয়ালু। আল্লাহর দয়ার ক্ষেত্রে এটি মৌলিক নাম। আল্লাহ বলেন, আমি আল্লাহ্, আমিই রহমান, ‘রহিম’ বা আত্মীয়তার সম্পর্ক শব্দটি আমি আমার রহমান বা দয়ালু নামক উত্তম গুণবিশিষ্ট নাম শব্দ থেকে চয়ন করেছি। সুতরাং এর সাথে দয়া, মুহাববাত ও ভালবাসার মূল উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। যে ব্যক্তি এই সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখবে আমি তার সাথে আমার রহমত বা দয়ার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখব। আর যে এ সম্পর্ক ছিন্ন করবে আমিও তার সাথে আমার দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করব।
‘রহিম’ নামের উৎসগত ভিত্তি যেহেতু ‘রহমান’, যা দয়ায় পরিপূর্ণ, সুতরাং রহিম-এর সম্পর্কেও এই দয়া আবশ্যক।
রহমান যেহেতু আল্লাহর অতি উত্তম একটি গুণ, মু’মিনের জন্য আল্লাহর এই উত্তম গুণ অর্জন নির্ধারণ করা হয়েছে এবং আল্লাহর নাম ও সিফাতসমূহের সাথে সম্পর্ক তৈরি আবশ্যক করা হয়েছে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯৩১-[২১] ’আবদুল্লাহ ইবনু আবূ আওফা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, সে সম্প্রদায়ের ওপর আল্লাহ তা’আলার রহমত নাযিল হবে না, যারা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী। [ইমাম বায়হাক্বী (রহিমাহুল্লাহ) ’’শু’আবুল ঈমানে’’ বর্ণনা করেছেন।][1]
হাদীসটি য‘ঈফ হওয়ার কারণ, এর সনদে ‘‘সুলায়মান’’ নামক একজন বর্ণনাকারী আছে, ইবনু মা‘ঈন যাকে বিশ্বস্ত নয়, বাযযার বা মিথ্যুক বলে উল্লেখ করেছেন। দেখুন- সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ ১৪৫৬।
وَعَنْ عَبْدُ
اللَّهِ بْنِ أَبِي أَوْفَى قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «لَا تَنْزِلُ الرَّحْمَةُ عَلَى قَوْمٍ فِيهِمْ قَاطِعُ الرَّحِمِ» رَوَاهُ الْبَيْهَقِيُّ فِي «شُعَبِ الْإِيمَان»
ব্যাখ্যাঃ ‘আল্লামা তূরিবিশতী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ যে কওম বা সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী থাকবে তাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষণ হয় না। এ হাদীসে ঐ কত্তম বা সম্প্রদায়ের এ শান্তির কারণ হলো যারা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নের কাজে বাধা না দিয়ে বরং সাহায্য করবে। তিনি আরো বলেন, এখানে রহমত দ্বারা উদ্দেশ্য দুর্ভাগ্যজনক অনাবৃষ্টির ক্ষরদাহ বিদীর্ণ করে প্রাণ সঞ্চয়ী বৃষ্টিপাত না হওয়া। অর্থাৎ তাদের ওপর কল্যাণের বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে যাওয়া। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯৩২-[২২] আবূ বকরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন পাপই এতটা যোগ্য নয় যে, পাপীকে আল্লাহ তা’আলা খুব শীঘ্র এ দুনিয়াতেই তার বিনিময় দেবেন এবং আখিরাতেও তার জন্য শাস্তি জমা করে রাখবেন। তবে হ্যাঁ, এরূপ দু’টো পাপ রয়েছে- ১. সমসাময়িক নেতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা এবং ২. আত্মীয়তার বন্ধনকে ছিন্ন করা। (তিরমিযী ও আবূ দাঊদ)[1]
وَعَنْ
أَبِي بَكْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا مِنْ ذَنْبٍ أَحْرَى أَنْ يُعَجِّلَ اللَّهُ لصَاحبه الْعقُوبَة فِي الدُّنْيَا مَعَ مايدخر لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْبَغْيِ وَقَطِيعَةِ الرَّحِمِ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ وَأَبُو دَاوُد
ব্যাখ্যাঃ হাদীসের বাক্য (مَا مِنْ ذَنْبٍ أَحْرٰى) এর মধ্যে مَا নাফী বা নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।مِنْ অব্যয়টি অতিরিক্তি হিসেবে ইস্তিগফার বা সামগ্রিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। أَحْرٰى শব্দটি أَحَقُّ وَأَوْلٰى অধিক হকদার উত্তম অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ, দু’টো পাপ ছাড়া আর অন্য কোন পাপই এত অধিক যোগ্য নয় যার অধিকারীকে দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর ‘আযাবে নিপতিত করতে পারে। হ্যাঁ! যে দু’টি পাপ বান্দাকে দুনিয়া এবং আখিরাত উভয় জগতে আল্লাহর শাস্তিতে অধিকভাবে নিপতিত করতে পারে তার প্রথমটি হলো : বিদ্রোহী হওয়া, এটি একটি জুলুম। সমকালের স্থিতিশীল সুলতান শাসক বা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তোলা এবং সরকারকে বিব্রত করে তোলা ভয়াবহ অপরাধ। আল্লাহ তা‘আলা এ অপরাধের শাস্তি তাকে দুনিয়াতেও দিবেন এবং তাওবাহ্ না করে মৃত্যুবরণ করলে আখিরাতেও তার জন্য তৈরি করে রেখেছেন ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। দ্বিতীয় অপরাধ বা পাপটি হলো আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার বিস্তারিত বিবরণ পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯৩৩-[২৩] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ উপকার করে খোঁটাদাতা, পিতা-মাতার অবাধ্য ও সর্বদা মদ পানকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (নাসায়ী ও দারিমী)[1]
وَعَنْ عَبْدِ
اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنَّانٌ وَلَا عَاقٌّ وَلَا مُدْمِنُ خمر» . رَوَاهُ النَّسَائِيّ والدارمي
ব্যাখ্যাঃ ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ)-এর বর্ণিত এ হাদীসটিতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনটি জঘন্য কাজ থেকে নিষেধ করেছেন। ১। দান করে খোঁটা দেয়া। ২। পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া। ৩। মদ পান করা।
দান করে খোটা দেয়া প্রসঙ্গে কুরআনে মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ لَا تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُمْ بِالْمَنِّ وَالْأَذٰى ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের দানকে খোঁটা ও কষ্টদানের মাধ্যমে বিনষ্ট করো না’’- (সূরাহ্ আল বাকারাহ্ ২ : ২৬৪)। দান করে খোঁটা দেয়া আরবী শব্দ হলো من এ শব্দের বিশেস্নষণ করতে গিয়ে ব্যাখ্যাকারীগণ বলেন, শব্দ অনুপাতে হাদীসের অর্থ এ রকম হওয়ারও সম্ভাবনা আছে, তা হলো তোমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে দান করে যাও, দান করা কখনো বন্ধ করো না।
অত্র হাদীসে মদ পান হারাম করা হয়েছে। কম হোক বেশী হোক, কিছু সময়ের জন্য হোক আর স্থায়ীভাবে পান করা হোক, সবই হারাম। যারা বলেন, মদ হারাম শুধু স্থায়ীভাবে পান করা হলে, কিছু সময়ের জন্য পান করলে তা হারাম হবে না বরং জায়িয, তাদের এ কথা ভুল।
‘আল্লামা তূরিবিশতী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ ‘‘যারা এ ধরনের পাপের সাথে জড়িত থাকবে তারা জান্নাতে যাবে না- এর অর্থ হলো প্রথম সারীর সফলকামদের সাথে জান্নাতে যাবে না অথবা জান্নাতে যাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত এ জঘন্য পাপের শাস্তি ভোগ না করবে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯৩৪-[২৪] আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা তোমাদের বংশ পরিচয় শিক্ষা করো, তাহলে আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতে পারবে। কেননা আত্মীয়তার সম্পর্ক আপনজনের মধ্যে সম্প্রীতি, ধন-সম্পদের প্রবৃদ্ধি এবং আয়ুতে দীর্ঘজীবী হওয়ার উপলক্ষ হয়। [তিরমিযী; আর ইমাম তিরমিযী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ এ হাদীসটি গরীব।][1]
وَعَنْ أَبِي
هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «تَعَلَّمُوا مِنْ أَنْسَابِكُمْ مَا تَصِلُونَ بِهِ أَرْحَامَكُمْ فَإِنَّ صِلَةَ الرَّحِمِ مَحَبَّةٌ فِي الْأَهْلِ مَثْرَاةٌ فِي الْمَالِ مَنْسَأَةٌ فِي الْأَثَرِ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَقَالَ: هَذَا حَدِيثٌ غَرِيب
ব্যাখ্যাঃ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী ‘‘তোমরা বংশ পরিচয় শিক্ষা কর’’-এর অর্থ হলো তোমার বংশের পূর্বপুরুষ, যেমন- বাপ, দাদা, চাচা, মামা ইত্যাদি এবং তাদের শাখা-প্রশাখার নামগুলো শিক্ষা কর। এতে পরস্পরের চেনা জানার ভিত্তিতে মুহাব্বাত ও দয়ার্দ্রতা সৃষ্টি হবে এবং দু’জনের মাঝের ঝগড়ার সম্ভাবনা দূর হবে। এ হাদীস এটাও করে যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক সকল যবীলে আরহামের (মায়ের আত্মীয়তার সম্পর্কীয়দের) সাথে সম্পৃক্ত শুধুমাত্র পিতা-মাতার সাথে সম্পৃক্ত নয়, যেমন কতিপয় ‘আলিম ও বিজ্ঞজনের ধারণা। আরো ব্যাখ্যা হলো নিম্নের হাদীস, تَعَرَّفُوا أَقَارِبَكُمْ مِنْ ذَوِي الْأَرْحَامِ
অর্থাৎ তোমরা যবীলে আরহাম বা নিকটাত্মীয়দের পরিচয় শিক্ষা কর, যাতে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হয় এবং তাদের প্রতি মুহাববাত সৃষ্টি হয় ফলে ইহসান করা সম্ভব হয়।
বংশ-পরিচয় লাভ করা এবং তাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক সুরক্ষার যতগুলো সুফল রয়েছে তন্মধ্যে সম্পদের প্রবৃদ্ধি ও দীর্ঘায়ু লাভ অন্যতম সুফল। সম্পদের প্রবৃদ্ধি হলো আয় উপার্জন বেড়ে যাওয়া এবং তাতে বারাকাত লাভ করা। আর আয়ু বৃদ্ধির অর্থ হলো অল্প জীবনেই দীর্ঘ জীবনের ‘ইবাদাতের তাওফীক লাভ করা এবং বেশী বেশী ‘ইবাদাতের সুযোগ লাভ করা। সর্বোপরি স্বাস্থ্য ও মানাসিকভাবে ‘ইবাদাতের যোগ্যতার লাভ করা এবং শির্ক ও বিদ্‘আতমুক্ত সঠিক ‘আমলের রাস্তা পাওয়া।
কেউ কেউ বলেছেন, মৃত্যু দেরিতে হওয়া বা হায়াত বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ হলো বাস্তবেই বৃদ্ধি পাওয়া, যা আল্লাহর একক ‘ইল্মের মধ্যেই রয়েছে। কেউ বলেন, এর অর্থ হলো তার বংশ ও ভালো প্রজন্মের মধ্যে তার সুনাম সুখ্যাতি চিরদিন অবশিষ্ট থাকা। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯৩৫-[২৫] ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমাতে উপস্থিত হয়ে বললঃ হে আল্লাহর রসূল! আমি এক বড় পাপ করেছি। আমার তওবা্ কি কবুল হতে পারে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তোমার কি মা আছে? সে বলল : জ্বী না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তোমার কি কোন খালা আছে? লোকটি বলল : জ্বী হ্যাঁ। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তবে তার সাথে উত্তম আচরণ করো। (তিরমিযী)[1]
وَعَن ابْن
عمر أَنَّ رَجُلًا أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي أَصَبْتُ ذَنْبًا عَظِيمًا فَهَلْ لِي مِنْ تَوْبَةٍ؟ قَالَ: «هَلْ لَكَ مِنْ أُمٍّ؟» قَالَ: لَا. قَالَ: «وَهَلْ لَكَ مِنْ خَالَةٍ؟» . قَالَ: نَعَمْ. قَالَ: «فبرها» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ
ব্যাখ্যাঃ অত্র হাদীসে খালাকে মায়ের মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। হাদীসের শব্দ الْخَالَةُ بِمَنْزِلَةِ الْأُمِّ অর্থাৎ ‘‘খালা মায়ের সমতুল্য’’ এর অর্থ মায়ের অবর্তমানে ছেলে মেয়ে লালন পালনে তাদের খালাই উপযুক্ত। অতএব খালা মায়ের স্থলাভিষিক্ত। তাই মায়ের অবর্তমানে খালাকে মায়ের মতো সেবা করবে।
অত্র হাদীসকে কেন্দ্র করে একটি লম্বা ঘটনা আছে। ইমাম বুখারী এবং ইমাম মুসলিম (রহিমাহুল্লাহ) ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন : রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদায়বিয়ার দিন তিনটি বিষয়ে কাফিরদের সাথে সন্ধি করেন।
১। যে সমস্ত মুশরিক মদীনায় চলে আসবে তাদেরকে মক্কায় ফেরত পাঠাতে হবে।
২। আর কাফিরদের কাছে যদি কোন মুসলিম যায় তাহলে তারা ফেরত পাঠাবে না।
৩। আগামী বছর তারা মক্কায় যাবেন এবং সেখানে তিনদিন অবস্থান করবেন।
পরবর্তী বছর শর্তানুসারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় প্রবেশ করলেন। তিনদিন পর সেখান থেকে বের হয়ে চলে আসার সময় হামযাহ্ -এর কন্যা, তাঁকে পিছন থেকে হে চাচা! হে চাচা! বলে ডাক শুরু করলেন। ইতোমধ্যে তাকে ‘আলী ধরে ফেলেন; তাকে নিয়ে ‘আলী, যায়দ ও জা‘ফার (রাঃ) বাক-বিতিন্ডা শুরু করেন। ‘আলী (রাঃ) বলেন, আমি তাকে ধরেছি যেহেতু সে আমার চাচাতো বোন। জা‘ফার (রাঃ) বলেন, যেহেতু সে আমার চাচাতো বোন এবং তার খালা আমার স্ত্রী। যায়দ (রাঃ) বলেন, আমি তাকে ধরেছি যে আমার ভাতিজী। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জা‘ফার (রাঃ)-এর কাছে দিলেন কারণ সেখানে তার সাথে তার খালা আছেন, তাই সেখানে তার লালন পালন ভালো হবে। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, الْخَالَةُ بِمَنْزِلَةِ الْأُمِّ খালা মায়ের স্থলাভিষিক্ত।
এদিকে ‘আলী (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তো আমার বংশের। জা‘ফারকে বললেনঃ তুমি আকৃতি ও চরিত্রে আমার মতই। যায়দকে বললেন, তুমি আমাদের ভাই ও আযাদকৃত গোলাম। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ১৯০৪)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯৩৬-[২৬] আবূ উসায়দ আস্ সা’ইদী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে বসেছিলাম। বানী সালামাহ্ গোত্রের এক ব্যক্তি এসে বলল : হে আল্লাহর রসূল! আমার পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও কি তাদের প্রতি সদাচরণ করার মতো কোনকিছু অবশিষ্ট থাকে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ হ্যাঁ আছে। তা হলো, তাঁদের জন্য দু’আ করা, তাঁদের ওয়া’দা পূরণ করা, তাঁদের আত্মীয়দের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা এবং তাঁদের বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। (আবূ দাঊদ ও ইবনু মাজাহ)[1]
হাদীসটি য‘ঈফ হওয়ার কারণ, এর সনদে ‘‘আবূ আসীদ’’-এর মুক্ত দাস ‘আলী নামক একজন বর্ণনাকারী আছে, যে ব্যক্তি বিশ্বাসী নয়। এছাড়া বাকী সকল বর্ণনাকারী বিশ্বস্ত। দেখুন- য‘ঈফাহ্ ৫৯৭, য‘ঈফ আত্ তারগীব ১৪৮২।
وَعَن
أبي أسيد السَّاعِدِيّ قَالَ: بَيْنَا نَحْنُ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذْ جَاءَ رَجُلٌ مِنْ بَنِي سَلَمَةَ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ هَلْ بَقِي من برِّ أبويِّ شيءٌ أَبَرُّهُمَا بِهِ بَعْدَ مَوْتِهِمَا؟ قَالَ: «نَعَمْ الصَّلَاةُ عَلَيْهِمَا وَالِاسْتِغْفَارُ لَهُمَا وَإِنْفَاذُ عَهْدِهِمَا مِنْ بَعْدِهِمَا وَصِلَةُ الرَّحِمِ الَّتِي لَا تُوصَلُ إِلَّا بِهِمَا وَإِكْرَامُ صَدِيقِهِمَا» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ وَابْنُ مَاجَهْ
ব্যাখ্যাঃ পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও তাদের প্রতি সদাচরণের কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে। পিতা-মাতার মৃত্যুর পর করণীয় হলো তাদের জানাযার সালাত আদায় করা, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, তাদের মৃত্যুর পর তাদের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা, তাদের মাধ্যমে সৃষ্ট আত্মীয় সম্পর্ক বজায় রাখা এবং তাদের প্রিয় মানুষদের শ্রদ্ধা করা। ‘সালাত’ দ্বারা উদ্দেশ্য জানাযার সালাত অথবা দু‘আ করা।
‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সালাত’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তাদের জন্য আল্লাহর রহমাতের দু‘আ করা। ইসতিগফার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। তাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করা অর্থ হলো তাদের ওয়াসিয়্যাত বাস্তবায়ন করা। তাদের কারণে সৃষ্ট আত্মীয়ের বন্ধন অটুট রাখার অর্থ হলো নিকটাত্মীয়ের প্রতি ইহসান করা।
‘মিরকাতুস্ সউদ’ গ্রন্থে ইমাম বায়হাক্বী (রহিমাহুল্লাহ)-এর এক বর্ণনার শব্দগুলো নিম্নরূপ :
وَصِلَةُ رَحِمِهِمَا الَّتِي لَا رَحِمَ لَكَ إِلَّا مِنْ قِبَلِهِمَا
অর্থাৎ তুমি তাদের সাথে বন্ধন অটুট রাখ যাদের সাথে তোমার পিতা-মাতার বন্ধন রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা শুনে লোকটি বললেন, হে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি অনেক ভালো ‘আমলের কথা বললেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে এখন থেকে এগুলো ‘আমল কর তাহলে এর মাধ্যমে মৃত্যুর পরও তোমার পিতামাতার সেবা করতে পারবে। (‘আওনুল মা‘বূদ ৮ম খন্ড, হাঃ ২৫১৩৩)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - অনুগ্রহ ও স্বজনে সদাচার
৪৯৩৭-[২৭] আবুত্ব তুফায়ল (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ’’জি’রানাহ্’’ নামক স্থানে আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মাংস বণ্টন করতে দেখলাম। এমন সময় এক মহিলা আগমন করলেন, যখন তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটবর্তী হলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জন্য নিজের চাদর বিছিয়ে দিলেন। তখন তিনি (মহিলা) সেই চাদরের উপর বসলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ মহিলা কে? তাঁরা বলল, ইনি সেই মহিলা, যিনি তাঁকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শৈশবে স্তন্য পান করিয়েছিলেন। (আবূ দাঊদ)[1]
হাদীসটি য‘ঈফ হওয়ার কারণ, এর সনদে ‘‘জা‘ফার ইবনু ইয়াহ্ইয়া’’-কে ‘আলী ইবনুল মাদানী ও ইমাম যাহাবী মাজহূল বলেছেন।
وَعَن
أبي الطُّفَيْل قَالَ: رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْسِمُ لَحْمًا بِالْجِعْرَانَةِ إِذْ أَقْبَلَتِ امْرَأَةٌ حَتَّى دَنَتْ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَبَسَطَ لَهَا رِدَاءَهُ فَجَلَسَتْ عَلَيْهِ. فَقُلْتُ: مَنْ هِيَ؟ فَقَالُوا: هِيَ أُمُّهُ الَّتِي أَرْضَعَتْهُ. رَوَاهُ أَبُو دَاوُد
ব্যাখ্যাঃ অত্র হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মায়ের প্রতি যে সম্মান দেখালেন তা পৃথিবীবাসীর জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দুধ মায়ের শ্রদ্ধায় নিজের চাদর বিছিয়ে দিলেন। গর্ভধারিণী আপন মায়ের সম্মান আরো কমবেশী হতে পারে।
হাফিয ইবনু হাজার ‘আসক্বালানী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ হালিমাতুস্ সা‘দিয়াহ্ (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দুধ মা ছিলেন। তিনি ছিলেন আবূ যু‘আয়ব-এর কন্যা, আবূ যু‘আয়ব-এর প্রকৃত নাম হলো ‘আবদুল্লাহ ইবনু আল-হারিস ইবনু সা‘দ ইবনু বকর ইবনু হাওয়াযিন। ইবনু ‘আবদুল বার বলেনঃ তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে শিশুকালে বুকের দুধ পান করানো অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভবিষ্যত নুবুওয়াত প্রাপ্তির অনেক নিদর্শন অবলোকন করেছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই দুধ মা একবার তার সাথে দেখা করতে আসলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলেন আর নিজের চাদর বিছিয়ে দিলেন। বিবি হালিমা ঐ চাদরের উপর বসলেন। এ হাদীস নারীর সম্মানে ইসলামের শাশ্বত বিধানের উজ্জ্বল নমুনা। (‘আওনুল মা‘বূদ ৮ম খন্ড, হাঃ ৫১৩৫)