পরিচ্ছেদঃ ১৫. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - ‘ইদ্দত
৩৩৩২-[৯] যায়নাব বিনতু কা’ব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবূ সা’ঈদ আল খুদরী (রাঃ)-এর বোন ফুরয়’আহ্ বিনতু মালিক ইবনু সিনান (রাঃ)আমাকে বলেছেন যে, ’ইদ্দত পালনকালে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে নিজের পিতৃবংশীয় খুদরীর লোকজনের নিকট ফিরে যেতে পারেন কিনা জানতে চাইলেন? কেননা, তাঁর স্বামী তার কয়েকজন পলাতক দাসদের সন্ধানে বের হলে তারা তাকে হত্যা করে ফেলে। যায়নাব (রাঃ) বলেন, ফুরয়’আহ্ (রাঃ)রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট পিত্রালয়ে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। কারণ, তার স্বামী ঘরে কোনো প্রকার খোরপোষের ব্যবস্থা করে যায়নি। এমতাবস্থায় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্মতি দিলে ফুরয়’আহ্ (রাঃ) রওয়ানা হলেন। কিন্তু হুজরা বা মসজিদ পর্যন্ত তখনও অতিক্রম করেননি, এ সময়ে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পুনরায় ডাক দিয়ে বললেন, তুমি যে ঘরে আছ তথায় ’ইদ্দত শেষ হওয়া পর্যন্ত থাক। ফুরয়’আহ্ (রাঃ) বলেন, অতঃপর আমি উক্ত ঘরেই ৪ মাস ১০ দিন ’ইদ্দত পালন করলাম। (মালিক, তিরমিযী, আবূ দাঊদ, নাসায়ী, ইবনু মাজাহ, দারিমী)[1]
عَن زَيْنَب بنت كَعْب: أَنَّ الْفُرَيْعَةَ بِنْتَ مَالِكِ بْنِ سِنَانٍ وَهِيَ أُخْتُ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ أَخْبَرَتْهَا أَنَّهَا جَاءَتْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَسْأَلُهُ أَنْ تَرْجِعَ إِلَى أَهْلِهَا فِي بَنِي خُدْرَةَ فَإِنَّ زَوْجَهَا خَرَجَ فِي طَلَبِ أَعْبُدٍ لَهُ أَبَقُوا فَقَتَلُوهُ قَالَتْ: فَسَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ أَرْجِعَ إِلَى أَهْلِي فَإِنَّ زَوْجِي لَمْ يَتْرُكْنِي فِي مَنْزِلٍ يَمْلِكُهُ وَلَا نَفَقَةٍ فَقَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «نَعَمْ» . فَانْصَرَفْتُ حَتَّى إِذَا كُنْتُ فِي الْحُجْرَةِ أَوْ فِي الْمَسْجِدِ دَعَانِي فَقَالَ: «امْكُثِي فِي بَيْتِكِ حَتَّى يَبْلُغَ الْكِتَابُ أَجَلَهُ» . قَالَتْ: فَأَعْتَدَدْتُ فِيهِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا. رَوَاهُ مَالِكٌ وَالتِّرْمِذِيُّ وَأَبُو دَاوُدَ وَالنَّسَائِيُّ وَابْنُ مَاجَهْ وَالدَّارِمِيُّ
ব্যাখ্যা: (اُمْكُثِىْ فِىْ بَيْتِكِ حَتّٰى يَبْلُغَ الْكِتَابُ أَجَلَه) অর্থাৎ ‘ইদ্দত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার বাড়িতেই অবস্থান করো।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে তাকে তার পরিবারে চলে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। পরক্ষনেই আবার বারণ করে তার ঘরেই ‘ইদ্দত শেষ হওয়া পর্যন্ত থাকতে বলেছেন। হতে পারে প্রথম হুকুমটি ইজতিহাদের মাধ্যমে দিয়েছিলেন। সাথে সাথে ওয়াহীর মাধ্যমে তাকে হুকুম জানানো হলে তিনি ফুরয়‘আহ্-কে এই হুকুম দেন। অনেকে মনে করেন, প্রথম হুকুমটি পরবর্তী হুকুমের মাধ্যমে রহিত হয়েছে।
‘আল্লামা শাওকানী নায়লুল আওত্বারে লিখেন, ফুরায়‘আহ্ এর হাদীসটি এই মাসআলার উপর দলীল যে, স্বামী মারা গেছে এমন মহিলা ‘ইদ্দত ঐ বাড়িতে পালন করবে যে বাড়িতে থাকাবস্থায় তার কাছে স্বামীর মৃত্যুর খবর এসেছে। এই বাড়ি থেকে বের হয়ে অন্য কোথায় যাবে না। সহাবা, তাবি‘ঈন এবং তাদের পরবর্তী এক দল এই মত পোষণ করেন। ‘আল্লামা ‘আবদুর রাযযাক, ‘উমার, ‘উসমান, ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে এই মতের বর্ণনা নিয়ে আসেন। সা‘ঈদ ইবনু মানসূর ইবনু মাস্‘ঊদ -এর অধিকাংশ ছাত্র থেকে এবং কাসিম ইবনু মুহাম্মদ, সালিম বিন ‘আবদুল্লাহ, সা‘ঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব এবং আতা থেকে এই মতের বর্ণনা করেন এবং হাম্মাদ ইবনু সীরীন থেকে এই মতের বর্ণনা করেন। আর এই মতই পোষণ করেন ইমাম মালিক, আবূ হানীফাহ্, শাফি‘ঈ ও তাদের ছাত্ররা এবং আওযা‘ঈ, ইসহক, আবূ ‘উবায়দ। শাওকানী বলেন, যিনি এই মতের বিপরীত মত পোষণ করেন তাদের দলীল ফুরয়‘আহ্-এর হাদীসের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো নয়। অতএব এ হাদীসের উপর ‘আমল নির্ধারিত। (‘আওনুল মা‘বূদ ৪র্থ খন্ড, হাঃ ২২৯৭)
পরিচ্ছেদঃ ১৫. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - ‘ইদ্দত
৩৩৩৩-[১০] উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার স্বামী আবূ সালামার মৃত্যুর পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকটে (সান্তবনা দিতে) এসে দেখলেন যে, আমি মুখে ’সাবির’ মেখেছি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, হে উম্মু সালামাহ্! এটা কী (মেখেছ)? আমি বললাম, এটা ’সাবির’ যার সুগন্ধি নেই। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এটা মুখকে উজ্জ্বল করে, তাই তুমি রাতে ব্যবহার কর, দিনে মুছে ফেল। আর সুগন্ধি ও মেহেদী মেখে চুল পরিপাটি করো না। কেননা মেহেদী হলো খিযাব (রং)। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তবে কী দিয়ে চুল আঁচড়াব, হে আল্লাহর রসূল? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, বরই পাতা দিয়ে তোমার মাথায় প্রলেপ দাও। (আবূ দাঊদ, নাসায়ী)[1]
وَعَن أُمِّ سلمَةَ قَالَتْ: دَخَلَ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حِينَ تُوُفِّيَ أَبُو سَلَمَةَ وَقَدْ جعلتُ عليَّ صَبِراً فَقَالَ: «مَا هَذَا يَا أُمَّ سَلَمَةَ؟» . قُلْتُ: إِنَّمَا هُوَ صَبِرٌ لَيْسَ فِيهِ طِيبٌ فَقَالَ: «إِنَّهُ يَشُبُّ الْوَجْهَ فَلَا تَجْعَلِيهِ إِلَّا بِاللَّيْلِ وَتَنْزِعِيهِ بِالنَّهَارِ وَلَا تَمْتَشِطِي بِالطِّيبِ وَلَا بِالْحِنَّاءِ فَإِنَّهُ خضاب» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد وَالنَّسَائِيّ
ব্যাখ্যা: (وَقَدْ جَعَلْتُ عَلَىَّ صَبِرًا) অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে প্রবেশ করলেন যখন আমি আমার চেহারায় ‘সাবির’ লাগিয়ে ছিলাম। صَبِرٌ বা صَبْرٌ শব্দটির অর্থ হলো: ঔষধরূপে ব্যবহৃত তিক্ত উদ্ভিদ বিশেষ। এই উদ্ভিদের রস যা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয় তাকেও ‘صَبِر’ বলা হয়। এটা মূলত সজ্জার বস্তু নয় বরং ওষুধী বস্তু। তথাপি রসূল এটাকে বারণ করলেন এবং তার কারণ বলে দিলেন। অর্থাৎ এটা মূলত ঔষধ হলেও তা চেহারার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার কারণে সজ্জা অবলম্বনের সাথে সাদৃশ্য রাখে। তাই কেউ তা সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করতেই পারে। তাই ঔষধ হিসেবে যদি ব্যবহার করতেই হয় তবে রাত্রি বেলায় ব্যবহার করার নির্দেশ দিলেন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। রাতে লাগালে আবার দিনের বেলায় তা তুলে ফেলার নির্দেশ দেন। এ থেকে শোকাবস্থায় সজ্জা জাতীয় কোনো কিছু ব্যবহারের ব্যাপারে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোরতা অবশ্যই উপলব্ধি করা যায়। হাদীসে ‘সাবির’ এর সাথে আরো দু’টি জিনিস নিষেধ করা হয়েছে।
এক. সুগন্ধি দ্বারা চিরুনী করা। অর্থাৎ সুগন্ধি জাতীয় তেল মাথায় ব্যবহার করে মাথার পরিপাটি করা।
দুই. মেহেদী ব্যবহার। উভয়টাই সজ্জা।
তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শোকাবস্থায় মেহেদী ও সুগন্ধি তেল মাথায় ব্যবহার নিষেধ করেন। তেল অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাথার চুল পরিপাটির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। তাই সুগন্ধি দিয়ে মাথা চিরুনীর কথা বলা হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, মাথা ছাড়া অন্যস্থানে সুগন্ধি তেল ব্যবহার করা যাবে। বরং সুগন্ধি জাতীয় যে কোনো কিছু শরীরের যে কোনো অঙ্গে ব্যবহার নিষেধ। কেননা মূল হলে সজ্জা থেকে বিরত থাকা। তবে সুগন্ধি ছাড়া সাধারণ তেল শরীরে যেমন ব্যবহার করা যাবে তেমনি মাথায়ও ব্যবহার করা যাবে। হাদীসের শব্দ ‘সুগন্ধি দিয়ে চিরুনী করো না’ এ থেকে সুগন্ধিবিহীন তেলের ব্যবহারের অনুমোদন বুঝা যায়। সুগন্ধিযুক্ত তেল ব্যবহার নিষেধের বেলায় ‘আলিমদের কোনো মতানৈক্য নেই। কিন্তু সুগন্ধি নেই এমন তেল ব্যবহার জায়িযের অনুমোদন হাদীস থেকে বুঝা গেলেও কেউ কেউ এতে দ্বিমত পোষণ করেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১৫. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - ‘ইদ্দত
৩৩৩৪-[১১] উক্ত রাবী [উম্মু সালামাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে রমণীর স্বামী মারা গেছে, সে (’ইদ্দতকালে লাল বা) হলুদ রংয়ের কাপড় এবং গেরুয়া রঙের কাপড় পরবে না, অলঙ্কার পরবে না, চুলে বা হাতে মেহেদী লাগাবে না এবং চোখে সুরমা লাগাবে না। (আবূ দাঊদ, নাসায়ী)[1]
وَعَنْهَا عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «المُتوَفّى عَنْهَا زوجُها لَا تَلبسُ المُعَصفَرَ مِنَ الثِّيَابِ وَلَا الْمُمَشَّقَةَ وَلَا الْحُلِيَّ وَلَا تَخْتَضِبُ وَلَا تَكْتَحِلُ» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ وَالنَّسَائِيُّ
ব্যাখ্যা: শোক পালনকারিণী নারীর জন্য সাধারণভাবে রঙিন কাপড় এবং সজ্জা অবলম্বন নিষেধের সাথে সাথে কিছু রঙের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে। বর্ণিত হাদীসে বিশেষ রঙের যে কাপড় নিষেধ করা হয়েছে তার মাঝে একটি মু‘আস্ফার অর্থাৎ ‘উসফুর’ দ্বারা রঙিন করা কাপড়। উসফুর রঞ্জক উদ্ভিদ বিশেষ। যা থেকে হলুদ রঞ্জক বের করা হয় এবং এর দ্বার রঞ্জিত কাপড় টকটকে হলুদ হয়। অতিরিক্ত সজ্জার ক্ষেত্রে হলুদ রঙের প্রচলন বেশি থাকায় হয়ত রসূল বিশেষভাবে এটার উল্লেখ করেন।
বিশেষভাবে উল্লেখিত আরেকটি রঙ হলো, ‘মুমাশ্শাকাহ’ অর্থাৎ মিশ্ক দ্বারা রঞ্জক। মিশক হচ্ছে লাল মাটি যা লাল রঞ্জক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সে সময়কার বিশেষ প্রচলন হিসেবে হয়ত বিশেষভাবে এগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে। সাজ-সজ্জার জন্য অলঙ্কারের ব্যবহার অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। বর্ণিত হাদীসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অলঙ্কারের কথা পৃথক উল্লেখ করে তা নিষেধ করেন। এর খিযাব অর্থাৎ চুলে রঙ ব্যবহার এবং সুরমা নিষেধ করেন। ইতোপূর্বে আমরা বিভিন্ন হাদীসে এর নিষেধাজ্ঞা দেখেছি। (মিরকাতুল মাফাতীহ)