• হজের রুকন চারটি। সেগুলো হলো: ইহরাম, বাইতুল্লাহর তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়ায় সা‘ঈ ও ‘আরাফায় অবস্থান। এ চারটি রুকনের কোনো একটি ছুটে গেলে হজ বাতিল হয়ে যাবে।
  • উমরার রুকন তিনটি। সেগুলো হলো: ইহরাম, তাওয়াফ ও সা‘ঈ। অতএব, এগুলো আদায় না করলে উমরা আদায় হবে না। এ সব রুকনের বিস্তারিত বিবরণ নিচে দেওয়া হলো:

প্রথম রুকন: ইহরাম

ইহরাম হলো: হজ বা উমরা পালনের নিয়াতে হজ বা উমরার কাজে প্রবেশের নিয়ত করা এবং সাধারণ সেলাই করা কাপড় ছেড়ে ইহরামের পোশাক পরিধান করা।

ইহরামের ওয়াজিবসমূহ:

ইহরামের ওয়াজিব তিনটি। সেগুলো হচ্ছে:

১- মিকাত থেকে ইহরাম বাঁধা:

শরী‘আত প্রণেতা যেসব জায়গা থেকে হজ ও উমরার জন্য ইহরাম বাঁধতে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। সুতরাং হজ বা উমরা পালনকারীকে ইহরামের নিয়ত ব্যতীত এ সব স্থান অতিক্রম করা জায়েয নেই।

২- সেলাইবিহীন কাপড় পরিধান করা:

পুরুষ মুহরিম সেলাইকৃত জামা, কামিছ, টুপিওয়ালা জামা, পাগড়ি পরবে না। কোনো কিছু দিয়ে মাথা ঢেকে রাখবে না। জুতো পরবে, চামড়ার মোজা বা কাপড়ের মোজা পরবে না, তবে জুতো না পেলে চামড়ার মোজা বা কাপড়ের মোজা পরতে পারবে। নারী নিকাব ও হাতমোজা পরবে না।

৩- তালবিয়া পাঠ করা। তালবিয়া হলো নিম্নোক্ত এ দো‘আ পড়া।

«لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالمُلْكَ، لاَ شَرِيكَ لَكَ»

“আমি উপস্থিত, হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত। আপনার কোনো শরীক নেই। নিশ্চয় প্রশংসা ও নি‘আমত আপনার এবং রাজত্বও, আপনার কোনো শরীক নেই”।

মুহরিম মিকাত থেকে ইহরাম পরিধান করার সময় তালবিয়া পড়বে এবং এ দো‘আ পাঠ না করে মিকাত অতিক্রম করবে না। পুরুষ উচ্চস্বরে এবং (নারীরা আস্তে আস্তে) বেশি বেশি পরিমাণে ও বার বার প্রত্যেক উঠা, বসা, চলা, ফেরা, সালাতের আগে-পরে ও কারো সাক্ষাতে তালবিয়া পাঠ করবে। উমরা আদায়কারী উমরার তাওয়াফ শেষ করলে তালবিয়া পাঠ শেষ করবে এবং হজ আদায়কারী জামরায়ে ‘আকাবাতে পাথর নিক্ষেপ শেষে তালবিয়া পাঠ সমাপ্ত করবে।

দ্বিতীয় রুকন: তাওয়াফ

তাওয়াফ হলো কা‘বা ঘরের চারপাশে সাতবার ঘোরা। এর সাতটি শর্ত। সেগুলো হচ্ছে:

১- তাওয়াফ শুরু করার নিয়ত করা।

২- ছোট বড় সব ধরণের অপবিত্রতা থেকে পবিত্র থাকা।

৩- সতর ঢেকে রাখা। যেহেতু তাওয়াফ সালাতের মতোই।

৪- মসজিদের ভিতর দিয়ে বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করা, যদিও বাইতুল্লাহ থেকে দুর দিয়ে হয়।

৫- তাওয়াফের সময় বাইতুল্লাহ যেন তাওয়াফকারীর বাম দিকে থাকে।

৬- তাওয়াফে সাতটি চক্কর দেওয়া।

৭- ধারাবাহিকভাবে ও বিরতিহীন তাওয়াফ করা। ওযর ব্যতীত বিলম্ব করবে না।

তাওয়াফের সুন্নাতসমূহ:

১- রমল করা: পুরুষদের জন্য তাওয়াফে কুদূম তথা আগমনি তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রমল করা সুন্নাত। রমল হলো তাওয়াফের সময় দ্রুত পদে চলা। নারীরা রমল করবে না।[1]

২- ইযতিবা করা: তাওয়াফে কুদূমের সময় ইযতিবা করা। ইযতিবা হলো ডান বগলের নিচে চাদর রেখে ডান কাঁধ উন্মুক্ত রাখা। এটা শুধু পুরুষের জন্য প্রযোজ্য, নারীদের জন্য নয়। সাত বার তাওয়াফের পুরো সময়ই ইযতিবা করবে।

৩- হাজরে আসওয়াদ চুম্বন: তাওয়াফ শুরু করার সময় ও সম্ভব হলে প্রতি চক্করে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করা। সম্ভব হলে রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করা।

৪- প্রথম চক্কর তাওয়াফ শুরু করার সময় এ দো‘আ পড়া:

«بسم اللّه واللّه أكبر. اللهم إيمانا بك وتصديقا بكتابك ووفاءً بعهدك واتباعا لسنة نبيك r».

“বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর, হে আল্লাহ আপনার ওপর ঈমান, আপনার কিতাবের ওপর সত্যায়ন, আপনার ওয়াদা পূরণ ও আপনার নবীর অনুসরণে (আমি তাওয়াফ শুরু করছি)।”

৫- তাওয়াফের সময় দো‘আ করা: তাওয়াফের সময় আল্লাহর কাছে যে কোনো দো‘আ করতে পারে, তবে প্রত্যেক চক্কর শেষ করার সময় এ দো‘আ পড়া সুন্নাত:

﴿رَبَّنَآ ءَاتِنَا فِي ٱلدُّنۡيَا حَسَنَةٗ وَفِي ٱلۡأٓخِرَةِ حَسَنَةٗ وَقِنَا عَذَابَ ٱلنَّارِ ٢٠١﴾ [البقرة: ٢٠١]

“হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন। আর আখিরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে আগুনের ‘আযাব থেকে রক্ষা করুন”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২০১]

৬- তাওয়াফের সময় মুলতাযিমে দো‘আ করা। আর মুলতাযিম হলো হাজরে আসওয়াদ ও বাইতুল্লাহর দরজার মধ্যবর্তী জায়গা।

৭- সাত তাওয়াফ শেষে মাকামে ইবরাহীমে দু’রাকা‘আত সালাত আদায় করবে। এ সময় মাকামে ইবরাহীম তার ও কা‘বার মাঝখানে রেখে এর পিছনে দু রাকা‘আত সালাত আদায় করবে। প্রথম রাকা‘আতে সূরা আল-ফাতিহার পরে ‘সূরা আল-কাফিরূন’ এবং দ্বিতীয় রাকা‘আতে সূরা আল-ফাতিহার পরে সূরা আহাদ তথা কুল হুআল্লাহু আহাদ পড়বে।

৮- এ দু’রাকাত সালাত শেষে যমযমের পানি পান করবে।

৯- সা‘ঈ করার আগে হাজরে আসওয়াদের কাছে গিয়ে তা স্পর্শ করবে।

তৃতীয় রুকন: সা‘ঈ:

সা‘ঈ হলো সাফা ও মারওয়ার মাঝে ইবাদতের নিয়াতে হাঁটা। এটি হজ ও উমরার রুকন।

ক- সা‘ঈর শর্তাবলী:

সা‘ঈর শর্তাবলী নিম্নরূপ:

১- নিয়ত করা: কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ»

“প্রত্যেক কাজ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল”[2]

২- তাওয়াফ ও সা‘ঈর মধ্যে তারতীব ঠিক রাখা। আগে তাওয়াফ করা, পরে সা‘ঈ করা।

৩- সা‘ঈর সাত চক্করের মাঝে ধারাবাহিকতা ও বিলম্ব না করা, তবে সামান্য বিলম্বে কোনো অসুবিধে হবে না, বিশেষ করে তা যদি প্রয়োজনে করা হয়।

৪- সাত চক্কর পূর্ণ করা। সাতের কম করলে বা কোনটি আংশিক করলে সা‘ঈ আদায় হবে না। যেহেতু সা‘ঈ মূলত সাত চক্কর পূর্ণ করার সাথে শর্তযুক্ত।

৫- বিশুদ্ধ তাওয়াফের পরে হওয়া, চাই তা ওয়াজিব তাওয়াফ হোক বা সুন্নাত তাওয়াফ।

খ- সা‘ঈর সুন্নাতসমূহ:

সা‘ঈর সুন্নাতসমূহ নিম্নরূপ:

১- পুরুষের জন্য দুই সবুজ চিহ্নিত জায়গা যেখানে ইসমাঈল আলাইহিস সালামের মা হাজের আলাইহাস সালাম পায়ের দ্বারা আঘাত করে চলেছেন সে জায়গা সাধ্যানুযায়ী দ্রুত অতিক্রম করা সুন্নাত। দুর্বল ও মহিলারা স্বাভাবিক গতিতে হাঁটবে।

২- দো‘আর জন্য সাফা ও মারওয়ায় উঠা।

৩- সাফা ও মারওয়ায় সাতবার সা‘ঈ করার সময় বেশি বেশি দো‘আ পড়া।

৪- সাফা ও মারওয়ায় তিনবার “আল্লাহু আকবর” ও এ দো‘আ পড়া:

«لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ، أَنْجَزَ وَعْدَهُ، وَنَصَرَ عَبْدَهُ، وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ»

“আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য ইলাহ নেই, তিনি এক। তাঁর কোনো অংশীদার নেই। রাজত্ব তাঁরই। প্রশংসাও তাঁর। সকল বিষয়ের ওপর তিনি ক্ষমতাবান। আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য ইলাহ নেই, তিনি এক। আল্লাহ তাঁর অঙ্গীকার পূর্ণ করেছেন ও তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং একাই শত্রুদেরকে পরাজিত করেছেন”।[3]

৫- তাওয়াফের সাথে সাথেই সা‘ঈ করা। তবে কোনো শর‘ঈ ওযর থাকলে ভিন্ন কথা।

চতুর্থ রুকন: ‘আরাফাতের ময়দানে অবস্থান

‘আরাফাতের ময়দানে অবস্থান বলতে ৯ যিলহজ যোহরের পর থেকে ১০ই যিলহজ ঈদের দিন ফজরের সালাতের পূর্ব পর্যন্ত সেখানে অবস্থানের নিয়াতে কিছুক্ষণ থাকা। কেউ ঈদের দিনের ফজরের সালাতের আগে অবস্থান করতে না পারলে তার ‘আরাফাতের ময়দানে অবস্থান শুদ্ধ হবে না এবং তার হজ বাতিল বলে গণ্য হবে। তখন সে উমরা করে হালাল হয়ে যাবে। পরের বছর সে উক্ত হজ পালন করবে। হজের ইহরাম বাঁধার সময় বাধাপ্রাপ্ত হলে হালাল হয়ে যাওয়ার শর্ত না করে থাকলে হাদীও প্রদান করতে হবে। কেউ বাইতুল্লায় যেতে শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে হাদী পাঠাবে এবং যেখানে বাধা পাবে সেখানেই হালাল হয়ে যাবে। কেউ অসুস্থ বা অর্থ হারিয়ে যাওয়ার কারণে হজে আসতে বাধাগ্রস্ত হলে তখন সে শর্তকারী হলে (সময় এ কথা বলা: আমার গন্তব্য সেখানেই শেষ যেখানে আমি বাধাগ্রস্ত হবো) তখন সেখানে হালাল হয়ে যাবে, তাকে কিছু হাদী হিসেবে দিতে হবে না। আর যদি শর্ত না করে থাকে তাহলে হালাল হবে এবং তার সাধ্যমত হাদী পাঠাতে হবে।

>
[1] ইমাম মুসলিম ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাজরে আসওয়াদ থেকে প্রথম তিন চক্কর রমল করেছেন এবং বাকী চারবার স্বাভাবিক হেঁটেছেন।

[2] সহীহ বুখারী, বাদউল অহী, হাদীস নং ১; সহীহ মুসলিম, আল-ইমারাহ, হাদীস নং ১৯০৭; তিরমিযী, ফাদাইলুল জিহাদ, হাদীস নং ১৬৪৭; নাসাঈ, ত্বাহারাত, হাদীস নং ৭৫; আবু দাউদ, ত্বলাক, হাদীস নং ২২০১; ইবন মাজাহ, যুহুদ, হাদীস নং ৪২২৭; আহমদ, ১/৪৩।

[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২১৮।