১১. পারস্পরিক যুলুমের বিচার ও বদলা

এরপর ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) কিয়ামত বিষয়ক আরেকটি বিশ্বাস উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন: ‘‘কিয়ামাতের দিন বিবাদকারীদের মধ্যে পুণ্যকর্মের মাধ্যমে বদলার ব্যবস্থা করা সত্য। যদি তাদের সাওয়াব বা নেককর্ম না থাকে তবে পাওনাদারের পাপ তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়টিও সত্য ও সম্ভব।’’

কিয়ামাতের একটি দিক সৃষ্টির পারস্পরিক অধিকার ও পাওনা বিষয়ক বিচার, প্রতিশোধ ও বদলা। কিয়ামাত দিবসে মানুষের প্রত্যেক কর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে এবং কোনো যুলম থাকবে না। এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:


الْيَوْمَ تُجْزَى كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ لا ظُلْمَ الْيَوْمَ...وَاللَّهُ يَقْضِي بِالْحَقِّ


‘‘আজ প্রত্যেক প্রাণ যা কিছু অর্জন করেছে তার প্রতিফল পাবে; কোনো যুলম নেই আজ।.... আল্লাহ হক্ক বিচার করেন।’’[1]

এ অর্থের বিভিন্ন আয়াত থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, কিয়ামাতের দিবসে মানুষদের পারস্পরিক পাওনা ও জুলুম ইনসাফের সাথে বিচার করা হবে এবং মাজলুমের অধিকার আদায় করে জুলুমের চির-নিষ্পত্তি করা হবে। হাদীস শরীফে এ বিষয়ক বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিয়ামাতের দিন মানুষদের মধ্যকার সকল জুলুম, পাওনা, ঋণ ও লেনদেনের বিচার নিষ্পত্তি করা হবে। হত্যা, রক্তপাত, মারধর, গীবত, কর্মদাতার কর্মের আমানত নষ্ট, কর্মচারীর অধিকার নষ্ট ইত্যাদি সকল প্রকারের অপরাধের ক্ষেত্রে মাজলুমকে তার ন্যায্য পাওনা বুঝে দেওয়া হবে।

আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


اتَّقُوا الظُّلْمَ فَإِنَّ الظُّلْمَ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ


‘‘তোমরা কাউকে জুলুম করা থেকে আত্মরক্ষা করবে; কারণ জুলুম কিয়ামাতের দিন ভয়াবহ অন্ধকারে পরিণত হবে।’’[2]

অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


أَوَّلُ مَا يُقْضَى بَيْنَ النَّاسِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِي الدِّمَاءِ


‘‘কিয়ামাতের দিন প্রথম যে বিষয়টি মানুষের মধ্যে বিচার করা হবে তা হলো রক্ত বা খুন-হত্যার বিষয়।’’[3]

আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


مَنْ كَانَتْ لَهُ مَظْلَمَةٌ لأَحَدٍ مِنْ عِرْضِهِ أَوْ شَىْءٍ فَلْيَتَحَلَّلْهُ مِنْهُ الْيَوْمَ، قَبْلَ أَنْ لاَ يَكُونَ دِينَارٌ وَلاَ دِرْهَمٌ، إِنْ كَانَ لَهُ عَمَلٌ صَالِحٌ أُخِذَ مِنْهُ بِقَدْرِ مَظْلَمَتِهِ، وَإِنْ لَمْ تَكُنْ لَهُ حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ سَيِّئَاتِ صَاحِبِهِ فَحُمِلَ عَلَيْهِ


‘‘যদি কারো যিম্মায় অন্য কারো সম্মান-মর্যাদা বা অন্য কোনো বিষয়ক অন্যায়-জুলুম থাকে তাহলে সে যেন আজই তার থেকে তা মুক্ত করে নেয়; সে দিবস আগমনের আগেই, যে দিবসে কোনো টাকা-পয়সা থাকবে না। যদি তার কোনো নেক আমল থাকে তাহলে তার অন্যায়ের পরিমাণে নেক আমল গ্রহণ করা হবে। আর যদি নেক আমল না থাকে তবে মাজলুমের পাপ থেকে নিয়ে তার ঘাড়ে চাপানো হবে।’’[4]

আবূ হুরাইরা (রা) বর্ণিত অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


أَتَدْرُونَ مَا (مَنِ) الْمُفْلِسُ قَالُوا الْمُفْلِسُ فِينَا مَنْ لا دِرْهَمَ لَهُ وَلا مَتَاعَ فَقَالَ إِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمَّتِي يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلاةٍ وَصِيَامٍ وَزَكَاةٍ وَيَأْتِي قَدْ شَتَمَ هَذَا وَقَذَفَ هَذَا وَأَكَلَ مَالَ هَذَا وَسَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْضَى مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ


‘‘তোমরা কি জান কপর্দকহীন দরিদ্র কে? সাহাবীগণ বলেন: আমাদের মধ্যে দরিদ্র তো সেই যার কোনো অর্থ-সম্পদ নেই। তিনি বলেন: আমার উম্মাতের অসহায় দরিদ্র সে ব্যক্তি যে কিয়ামাতের দিন সালাত, সিয়াম, যাকাত ইত্যাদি নিয়ে আগমন করবে। কিন্তু সে কাউকে গালি দিয়েছিল, কাউকে অপবাদ দিয়েছিল, কারো সম্পদ ভক্ষণ করেছিল, কারো রক্তপাত করেছিল, কাউকে প্রহার করেছিল। তখন একে একে এ সকল মাযলূমকে তার পুণ্য থেকে প্রদান করা হবে। তার যিম্মায় বিদ্যমান অপরাধ শেষ হওয়ার আগেই যদি তার পুণ্য শেষ হয়ে যায় তবে মাযলূমদের পাপ নিয়ে তার উপর নিক্ষেপ করা হবে, অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’’[5]

আব্দুল্লাহ ইবন উমার বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:


مَنْ مَاتَ وَعَلَيْهِ دِينَارٌ أَوْ دِرْهَمٌ قُضِيَ مِنْ حَسَنَاتِهِ لَيْسَ ثَمَّ دِينَارٌ وَلا دِرْهَمٌ


‘‘ঋণগ্রস্ত অবস্থায় যে মৃত্যুবরণ করবে যে দিন কোনো টাকা-পয়সা থাকবে না সেদিন তার পুণ্য থেকে তার ঋণ পরিশোধ করা হবে।’’[6]

[1] সূরা (৪০) গাফির (মুমিন): ১৭ ও ২০ আয়াত।

[2] বুখারী, আস-সহীহ ২/৮৬৩-৮৬৪ (কিতাবুল মাযালিম, বাবুয যুলম যুলুমাত), মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৯৯৬ (কিতাবুল বির্রি ওয়াস সিলাহ, বাবু তাহরীমিয যুলম)।

[3] বুখারী, আস-সহীহ (কিতাবুদ দিয়্যাত, বাবু মান কাতালা...); মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৩০৪ (কিতাবুল কাসামা, বাবুল মুজাযাত বিদ-দিমা)।

[4] বুখারী, আস-সহীহ ২/৮৬৫ (কিতাবুল মাযালিম, বাব মান কানাত লাহু মাযলামাতুন্...)

[5] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৯৯৭ (কিতাবুল বির্রি ওয়াস সিলাহ, বাবু তাহরীমিয যুলম)

[6] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান, ২/৮০৭ (কিতাবুস সাদাকাত, বাবুত তাশদীদি ফিদ দাইনি); আলবানী, সহীহুত তারগীব ২/১৬৭। হাদীসটির সনদ সহীহ।