(১) প্রথমেই উল্লেখ করা আবশ্যক যে, রাসূল আগমনের উদ্দেশ্য হ’ল, মানুষকে সৃষ্টির দাসত্ব ছেড়ে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে আনা এবং অহীর বিধান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সকলের সমানাধিকার নিশ্চিত করা (যারিয়াত ৫১/৫৬)। সেই সাথে এর ফলাফল হিসাবে দুনিয়াবাসীকে জান্নাতের সুসংবাদ শুনানো এবং ব্যর্থতায় জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন করা। বহুত্ববাদ ছেড়ে মানুষকে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী করা (আ‘রাফ ৭/৬৫) এবং এর মাধ্যমে মানবতার সর্বোত্তম বিকাশ ঘটানো। মক্কার ইবরাহীম সন্তানেরা উক্ত আক্বীদায় বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু পরে তারা তা থেকে বিচ্যুত হয়। যদিও তাদের দাবী বাকী ছিল। নবুঅত লাভের পর রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দেন এবং ইবরাহীমী পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। মক্কাতে রাসূল (ছাঃ) সেই দাওয়াতই শুরু করেছিলেন। কিন্তু আত্মগর্বী কুরায়েশ নেতারা রাসূল (ছাঃ)-এর এ দাওয়াতের মধ্যে নিজেদের দুনিয়াবী ক্ষতি বুঝতে পেরে প্রচন্ড বিরোধিতা করে এবং অবশেষে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। পরে তিনি মদীনায় হিজরত করলেন। কিন্তু সেখানেও তারা লুটতরাজ, হামলা ও নানাবিধ চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র চালাতে লাগল। ফলে তাদের হামলা প্রতিরোধের জন্য এবং অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য রাসূল (ছাঃ)-কে যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয় (হজ্জ ২২/৩৯)। ফলে এটাই প্রমাণিত সত্য যে, হামলাকারীদের প্রতিরোধ ও তাদের অনিষ্ট থেকে আত্মরক্ষার জন্যই প্রধানতঃ যুদ্ধগুলি সংঘটিত হয়েছিল।
(২) সমস্ত যুদ্ধই ছিল মূলতঃ কুরায়েশদের হিংসা ও হঠকারিতার ফল। বনু কুরায়েশ, বনু গাত্বফান, বনু সুলায়েম, বনু ছা‘লাবাহ, বনু ফাযারাহ, বনু কেলাব, বনু ‘আযল ও ক্বারাহ, বনু আসাদ, বনু যাকওয়ান, বনু লেহিয়ান, বনু সা‘দ, বনু তামীম, বনু হাওয়াযেন, বনু ছাক্বীফ প্রভৃতি যে গোত্রগুলির সাথে যুদ্ধ হয়েছিল, এরা সবাই ছিল কুরায়েশদের পিতামহ ইলিয়াস বিন মুযারের বংশধর (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/২০৭-০৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজেও ছিলেন কুরায়েশ বংশের বনু হাশেম গোত্রের। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে এদের যত লড়াই হয়েছে, সবই ছিল মূলতঃ গোত্রীয় হিংসার কারণে। এইসব গোত্রের নেতারা রাসূল (ছাঃ)-এর নেতৃত্ব ও প্রাধান্যকে মেনে নিতে পারেনি। বদরের যুদ্ধে বনু হাশেম গোত্র চাপের মুখে অন্যান্যদের সাথে থাকলেও তারা রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি। কিন্তু আবু জাহল সহ বাকীরা সবাই ছিল অন্যান্য গোত্রের।
(৩) রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনকালে আরব উপদ্বীপের অন্য কোন গোত্রের সাথে তাঁর কোন যুদ্ধ বা সংঘাত হয়নি। তিনি সারা আরবে লড়াই ছড়িয়ে দেননি।
(৪) রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে ইহূদী ও মুনাফিকদের শত্রুতার প্রধান কারণ ছিল তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব হারানো। বাকীগুলি ছিল অজুহাত মাত্র। এজন্য তারা ছিল কুরায়েশদের সঙ্গে একাত্ম অথবা গোপনে চুক্তিবদ্ধ।
(৫) নবুঅতের পুরা সময়কালে একজন লোকও এমন পাওয়া যাবে না, যে কেবলমাত্র ধর্মীয় কারণে মুসলমানদের হাতে নিগৃহীত হয়েছে। যতক্ষণ না সে মুসলমানদের উপরে চড়াও হয়েছে কিংবা ষড়যন্ত্র করেছে। চাই সে মূর্তিপূজারী হৌক বা ইহূদী-নাছারা হৌক বা অগ্নিপূজারী হৌক।
(৬) মুশরিকদের হামলা ঠেকাতে গিয়ে দারিদ্র্য জর্জরিত ও ক্ষুৎ পিপাসায় কাতর অথচ ঈমানের বলে বলীয়ান মুসলিম বাহিনী ক্রমে এমন শক্তিশালী এক অপরাজেয় বাহিনীতে পরিণত হয় যে, রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় তারা কোন যুদ্ধেই পরাজিত হননি। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরেও খেলাফতে রাশেদাহর যুগে এই বিজয়াভিযান অব্যাহত থাকে। যার সামনে তৎকালীন বিশ্বশক্তি রোমক ও পারসিক বাহিনী মুসলিম বাহিনীর হাতে নীস্ত ও নাবূদ হয়ে যায়।
(৭) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যুদ্ধকে পবিত্র জিহাদে পরিণত করেন। কেননা জিহাদ হ’ল অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। সে যুগের যুদ্ধনীতিতে সকল প্রকার স্বেচ্ছাচার ও পাপাচার সিদ্ধ ছিল। কিন্তু ইসলামী জিহাদের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান কঠোরভাবে অনুসৃত হয়। যা মানবতাকে সর্বদা সমুন্নত রাখে। ফলে তা প্রতিপক্ষের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। যে কারণে সারা আরবে ও আরবের বাইরে দ্রুত ইসলাম বিস্তার লাভ করে।
(৮) যুদ্ধবন্দীর উপরে বিজয়ী পক্ষের অধিকার সর্বযুগে স্বীকৃত। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উদার নীতি এক্ষেত্রে নবযুগের সূচনা করে। প্রতিপক্ষ বনু হাওয়াযেন গোত্রের ১৪ জন নেতা ইসলাম কবুল করে এলে তাদের সম্মানে ও অনুরোধে হোনায়েন যুদ্ধের ছয় হাযার যুদ্ধবন্দীর সবাইকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিনা শর্তে মুক্তি দেন। এমনকি বিদায়ের সময়ে তাদের প্রত্যেককে একটি করে মূল্যবান ক্বিবতী চাদর উপহার দেন।
(৯) যুদ্ধরত কাফের অথবা বিচারে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত ব্যক্তি ব্যতীত কাউকে হত্যা করার বিধান ইসলামে নেই। সেকারণ মাদানী রাষ্ট্রের অধীনে চুক্তিবদ্ধ অসংখ্য অমুসলিম পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে শান্তির সাথে বসবাস করত।
(১০) রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ অর্থাৎ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনুমতি বা আদেশ ব্যতীত কাউকে হত্যা করা নিষিদ্ধ ছিল। সেকারণ মক্কা বিজয়ের পূর্বরাতে মক্কার নেতা আবু সুফিয়ান হযরত ওমরের হাতে ধরা পড়া সত্ত্বেও তাঁর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি ওমর (রাঃ)-এর অটুট আনুগত্য প্রদর্শনের কারণে। অতএব রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বাইরে এককভাবে বা দলবদ্ধভাবে কেউ কাউকে হত্যা বা যখম করতে পারে না। এতে বুঝা যায় যে, জিহাদ ফরয হ’লেও সশস্ত্র জিহাদ পরিচালনার দায়িত্ব এককভাবে মুসলিম সরকারের হাতে ন্যস্ত, পৃথকভাবে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের হাতে নয়। রাসূল (ছাঃ)-এর পরে খেলাফতে রাশেদাহর সময়েও একই নীতি অনুসৃত হয়।