ক্বাছওয়া উটনীর পিঠে সওয়ার হয়ে আনছার ও মুহাজির পরিবেষ্টিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কায় প্রবেশ করেন। এদিন তিনি আল্লাহর প্রতি বিনয়ী ও তাঁর নে‘মতের শুকরিয়া আদায়কারী হিসাবে মক্কায় প্রবেশ করেন। বিজয়ী সেনাপতির ন্যায় অহংকারীভাবে নয়। এ সময় তিনি সওয়ারীর উপরে বসে সূরা ফাৎহ বা তার কিছু অংশ ধীর কণ্ঠে বারবার পাঠ করছিলেন’ (বুখারী হা/৪২৮১, ৫০৪৭)। যুদ্ধের প্রস্ত্ততি থাকার কারণে রাসূল (ছাঃ) এ দিন মুহরিম ছিলেন না। এ সময় তাঁর মাথায় লৌহ শিরস্ত্রাণের উপর কালো পাগড়ী ছিল’।[1]
অতঃপর তিনি মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন এবং হাতের মাথা বাঁকানো লাঠি দ্বারা হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করেন। অতঃপর বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করেন।[2] এ সময় কা‘বাগৃহের ভিতরে ও বাইরে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হাতের লাঠি দ্বারা এগুলি ভাঙতে থাকেন এবং কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি পড়তে থাকেন।وَقُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوْقًا ‘তুমি বল, হক এসে গেছে, বাতিল দূরীভূত হয়েছে। নিশ্চয়ই বাতিল দূরীভূত হয়েই থাকে’ (বনু ইসরাঈল ১৭/৮১)। তিনি আরও পড়েন,قُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَمَا يُبْدِئُ الْبَاطِلُ وَمَا يُعِيْدُ ‘তুমি বল হক এসে গেছে এবং বাতিল আর না শুরু হবে, না ফিরে আসবে’ (সাবা ৩৪/৪৯)। অর্থাৎ সত্যের মুকাবিলায় মিথ্যা এমনভাবে পর্যুদস্ত হয় যে, তা কোন বিষয়ের সূচনা বা পুনরাবৃত্তির যোগ্য থাকে না’ (বুখারী হা/৪২৮৭)।
ইবনু আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণনা অনুযায়ী অতঃপর তিনি ওছমান বিন ত্বালহাকে ডেকে তাকে ভিতর থেকে সমস্ত মূর্তি-প্রতিকৃতি বের করার নির্দেশ দেন। এসময় তিনি তার মধ্যে ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ)-এর দু’টি প্রতিকৃতি দেখেন। যাদের হাতে ভাগ্য নির্ধারণী তীর দেখে তিনি বলে ওঠেন,قَاتَلَهُمُ اللهُ لَقَدْ عَلِمُوا مَا اسْتَقْسَمَا بِهَا قَطُّ ‘মুশরিকদের আল্লাহ ধ্বংস করুন। আল্লাহর কসম! তারা জানে যে, তাঁরা কখনোই এ ধরনের ভাগ্যতীর ব্যবহার করেননি’। তিনি বলেন,مَا كانَ إِبْراهِيمُ يَهُودِيًّا وَلا نَصْرانِيًّا، وَلكِنْ كانَ حَنِيفاً مُسْلِماً، وَما كانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ‘ইবরাহীম কখনো ইহূদী বা নাছারা ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম। আর তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না’ (আলে ইমরান ৩/৬৭)। ইবনু আববাসের অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, সেখানে মারিয়ামের ছবিও ছিল (বুখারী হা/৩৩৫১)। এভাবে সমস্ত ছবি-মূর্তি দূর হওয়ার পর তিনি কা‘বাগৃহে প্রবেশ করেন ও ঘরের চারিদিকে তাকবীর দেন (বুখারী হা/৪২৮৮)।
ইবনু ওমরের বর্ণনায় এসেছে যে, অতঃপর তিনি ভিতরে প্রবেশ করেন ও দরজা বন্ধ করে দেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন উসামা, বেলাল এবং ওছমান বিন তালহা (রাঃ)। এরপর তিনি কা‘বার দরজা পিছনে রেখে সম্মুখ দেওয়ালের তিন হাত পিছনে দুই খাম্বার মাঝে দাঁড়িয়ে বাম দিকে এক খাম্বা ও ডান দিকে দুই খাম্বা এবং পিছনে তিন খাম্বা রেখে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেন। এ সময় কা‘বাগৃহে মোট ছয়টি খাম্বা ছিল’।[3] কোন কোন বিদ্বান একে ‘তাহিইয়াতুল মসজিদ’ দু’রাক‘আত ছালাত বলেছেন।[4]
ঐদিন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কা‘বা গৃহের মধ্যে ছালাত আদায় করেছিলেন কি-না, এ নিয়ে বেলাল ও উসামাহর দু’ধরনের বক্তব্য থাকায় বিদ্বানগণ একমত হ’তে পারেননি। বেলাল বলেছেন, ‘পড়েছেন দুই ইয়ামানী খাম্বার মাঝে’ (বুখারী হা/১৫৯৮, ৪২৮৯)। অন্যদিকে উসামা বলেছেন, ‘পড়েননি, বরং ঘরের চারদিকে হেটে তাকবীর দিয়েছেন’ (মুসলিম হা/১৩৩০, ফাৎহ ৩/৫৪৩)। এর সমন্বয় দু’ভাবে হ’তে পারে। ১. বেলালের বর্ণনা হ্যাঁ বোধক (مُثْبِتٌ)। তাছাড়া এ বিষয়ে কোন মতভেদ নেই। অতএব সেটাই অগ্রাধিকারযোগ্য। ২. উসামা বালতি ভরে পানি নিয়ে যখন প্রবেশ করেন, তখন তিনি তাকে (ছালাত শেষে) দাঁড়িয়ে দো‘আ পাঠ ও তাকবীর দিতে দেখেন। উপরন্তু ঘরে ছিল অন্ধকার। অতএব বাহির থেকে ঢুকে ছালাত দেখতে না পাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয় (ফাৎহ ৩/৫৪৭)। এটা নিশ্চিত যে, ঐ সময় রাসূল (ছাঃ) ‘মুহরিম’ ছিলেন না (বুখারী হা/৪২৮৬)। অতএব মসজিদ হিসাবে সেখানে ‘তাহিইয়াতুল মাসজিদ’ দু’রাক‘আত নফল ছালাত পড়াটাই স্বাভাবিক। পরবর্তীতে বিদায় হজ্জের সময় তিনি কা‘বার মধ্যে ছালাত আদায় করেননি। বরং বাইরে মাক্বামে ইবরাহীমে দাঁড়িয়ে কা‘বাকে সামনে রেখে ছালাত আদায় করেছেন। কেননা এভাবে আদায়ের নির্দেশ রয়েছে কুরআনে (বাক্বারাহ ২/১২৫)।[5] অতঃপর তিনি দরজা খুলে দেন। এসময় শত শত মানুষ কা‘বাগৃহের সম্মুখে দন্ডায়মান ছিল’ (মুসলিম হা/১৩২৯)। অতঃপর ত্বাওয়াফ শেষে উষ্ট্রীকে বসানোর জায়গা না পেয়ে বাতনে ওয়াদীতে সরিয়ে দেন (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩৮২৮)।
এসময় আবুবকর (রাঃ) তাঁর বৃদ্ধ ও অন্ধ পিতা আবু কুহাফাকে নিয়ে আসেন। তাকে দেখে রাসূল (ছাঃ) বললেন, কেন তুমি তাকে বাড়ীতে রেখে এলে না? আমিই তাঁর কাছে যেতাম। আবুবকর (রাঃ) বললেন, আপনি যাওয়ার চাইতে তাঁরই আসার হক বেশী। অতঃপর তিনি পিতাকে সামনে বসিয়ে দিলেন। তখন রাসূল (ছাঃ) তাঁর বুকে হাত রেখে বললেন, ইসলাম কবুল করুন! নিরাপদ থাকুন’। তিনি ইসলাম কবুল করলেন।[6]
[2]. আবুদাঊদ হা/১৮৭৮। প্রসিদ্ধ আছে যে, এসময় মক্কার একজন দুঃসাহসী পুরুষ ‘ফাযালাহ বিন ওমায়ের’ (فَضالة بن عُمَير) রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার উদ্দেশ্যে ত্বাওয়াফের সময় তাঁর কাছাকাছি হয় এবং তাঁকে হত্যার উদ্যোগ নেয়। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হেসে উঠে বলেন, কি মতলব হে ফাযালাহ! সে বলল, কিছু না। আমি আল্লাহর যিকির করছিলাম। তখন রাসূল (ছাঃ) তার বুকে হাত রেখে বলেন, আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাও। এতে তার হৃদয় শীতল হয়ে যায়। ফাযালাহ বলেন, এটি আমার নিকটে দুনিয়ার সবচেয়ে প্রিয়তর ছিল’। এরপর সে মুসলমান হয়ে যায় (ইবনু হিশাম ২/৪১৭; আর-রাহীক্ব ৪০৭ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/৩৬৩)। ঘটনাটি বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয় (মা শা-‘আ ১৯২ পৃঃ; আলবানী, দিফা‘ ‘আনিল হাদীছ, পৃঃ ১/৩৩, সনদ যঈফ)।
[3]. মুসলিম হা/১৩২৯; বুখারী হা/৫০৫।
[4]. ফাৎহুল বারী ৩/৫৪৪, হা/১৫৯৮-এর আলোচনা ‘হজ্জ’ অধ্যায়-২৫, অনুচ্ছেদ-৫১।
[5]. বিস্তারিত দ্রঃ ফাৎহুল বারী ৩/৫৪৫, ৫৪৭, হা/১৫৯৮ ও ১৬০১-এর ব্যাখ্যা, ‘হজ্জ’ অধ্যায়, ৫১ ও ৫৪ অনুচ্ছেদ।
[6]. ইবনু হিশাম ২/৪০৬।