৮টি দুর্গের মধ্যে সেরা ছিল না‘এম দুর্গ। যা ইহূদী বীর ‘মারহাব’ (مَرْحَب)-এর নেতৃত্বাধীন ছিল। যাকে এক হাযার বীরের সমকক্ষ বলা হ’ত। কৌশলগত দিক দিয়ে এটার স্থান ছিল সবার উপরে। সেজন্য রাসূল (ছাঃ) প্রথমেই এটাকে জয় করার দিকে মনোযোগ দেন।
রাতের বেলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,لأُعْطِيَنَّ الرَّايَةَ غَدًا رَجُلاً يُفْتَحُ عَلَى يَدَيْهِ، يُحِبُّ اللهَ وَرَسُولَهُ، وَيُحِبُّهُ اللهُ وَرَسُولُهُ ‘কাল সকালে আমি এমন একজনের হাতে পতাকা দেব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে এবং যাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালবাসেন’। সকালে সবাই রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে হাযির হ’লেন। নেতৃস্থানীয় প্রত্যেকের ধারণা পতাকা তার হাতে আসবে। এমন সময় রাসূল (ছাঃ) বললেন,أَيْنَ عَلِىُّ بْنُ أَبِى طَالِبٍ؟ ‘আলী ইবনু আবী ত্বালেব কোথায়’? সবাই বলল, চোখের অসুখের কারণে তিনি পিছনে পড়েছেন। রাসূল (ছাঃ) বললেন,فَأَرْسِلُوا إِلَيْهِ فَأْتُونِى بِهِ ‘তার কাছে লোক পাঠাও এবং তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো’। অতঃপর তাকে আনা হ’ল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ মুখের লালা তার চোখে লাগিয়ে দিলেন এবং তার জন্য সুস্থতার দো‘আ করলেন। ফলে তিনি এমনভাবে সুস্থ হ’লেন যেন ইতিপূর্বে তার চোখে কোন অসুখ ছিল না। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তার হাতে পতাকা দিয়ে বললেন,اُنْفُذْ عَلَى رِسْلِكَ حَتَّى تَنْزِلَ بِسَاحَتِهِمْ ‘ধীরে-সুস্থে এগিয়ে যাও, যতক্ষণ না তাদের এলাকায় অবতরণ কর’। অতঃপর তাদেরকে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দাও এবং জানিয়ে দাও আল্লাহর হক হিসাবে তাদের উপরে কি কি বিষয় ওয়াজিব রয়েছে।فَوَاللهِ لَأَن يَّهْدِيَ اللهُ بِكَ رَجُلاً وَاحِدًا خَيْرٌ لَّكَ مِنْ حُمْرِ النَّعَمِ ‘আল্লাহর কসম! যদি আল্লাহ তোমার দ্বারা একজন লোককেও হেদায়াত দান করেন, তবে সেটি তোমার জন্য মূল্যবান লাল উটের (কুরবানীর) চাইতে উত্তম হবে’।[1] যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর এই বক্তব্যের মাধ্যমে তাঁর শান্তিবাদী নীতি ফুটে ওঠে।
অতঃপর আলী (রাঃ) সেনাদল নিয়ে ‘না‘এম’ (نَاعِمٌ) দুর্গের সম্মুখে উপস্থিত হ’লেন ও দুর্গবাসীদের প্রথমে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। ইহূদীরা এই দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল এবং তাদের নেতা ‘মারহাব’ দর্পভরে কবিতা বলে এগিয়ে এসে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহবান জানালো। মারহাবের দর্পিত আহবানে সাড়া দিয়ে পাল্টা কবিতা বলে ‘আমের ইবনুল আকওয়া‘ ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কিন্তু তাঁর তরবারি আকারে ছোট থাকায় তার আঘাত মারহাবের পায়ের গোছায় না লেগে উল্টা নিজের হাঁটুতে এসে লাগে। যাতে তিনি আহত হন ও পরে মৃত্যুবরণ করেন। নিজের আঘাতে শহীদ হওয়ায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন যে, তিনি দ্বিগুণ ছওয়াবের অধিকারী হবেন।[2]
এরপর মারহাব পুনরায় গর্বভরে কবিতা আওড়াতে থাকে ও মুসলিম বাহিনীর প্রতি দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহবান জানাতে থাকে। তখন সেনাপতি আলী (রাঃ) তার দর্প চূর্ণ করার জন্য নিজেই এগিয়ে গেলেন এবং গর্বভরে কবিতা বলে সিংহের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে এক আঘাতেই শেষ করে দিলেন। এভাবে তাঁর হাতেই মূলতঃ না‘এম দুর্গ জয় হয়ে গেল।
হযরত আলী (রাঃ) তাঁর পঠিত উক্ত কবিতায় নিজের সম্পর্কে বলেন,
أَنَا الَّذِى سَمَّتْنِى أُمِّى حَيْدَرَهْ + كَلَيْثِ غَابَاتٍ كَرِيهِ الْمَنْظَرَهْ
أُوفِيهِم بِالصَّاعِ كَيْلَ السَّنْدَرَهْ
‘আমি সেই ব্যক্তি আমার মা যার নাম রেখেছিলেন হায়দার (বাঘ)। তাই বনের বাঘের মত ভয়ংকর আমি’। ‘আমি তাদেরকে অতি দ্রুত অধিক সংখ্যায় হত্যা করব’।[3] একারণে হযরত আলীকে ‘আলী হায়দার’ বলা হয়।
‘মারহাব’ নিহত হওয়ার পরে তার ভাই ‘ইয়াসের’ (يَاسِر) এগিয়ে আসে। সে যুবায়ের (রাঃ)-এর হাতে নিহত হয়। তারপর উভয়পক্ষে কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলে। তাদের নেতৃস্থানীয় ইহূদীদের অনেকে নিহত হয়। ফলে যুদ্ধ দ্রুত শেষ হয়ে যায় এবং না‘এম দুর্গ বিজয় সমাপ্ত হয়।[4]
[2]. বুখারী হা/৩৮৭৫, ৫৬৮২, ৬৩৮৩; মুসলিম হা/৩৩৮৩।
[3]. মুসলিম হা/১৮০৭। ‘সানদারাহ’ একটি প্রশস্ত পরিমাপের নাম যা দিয়ে অধিক পরিমাণ বস্ত্ত দ্রুত পরিমাপ করা যায় (মুসলিম, শরহ নববী)।
প্রসিদ্ধ আছে যে, এদিন আলী (রাঃ) দুর্গের একটি দরজা উপড়ে ফেলে সেটাকে হাতের ঢাল বানিয়ে যুদ্ধ করেন। অবশেষে যখন আল্লাহ তাকে বিজয় দান করেন, তখন তিনি সেটা ছুঁড়ে ফেলে দেন। রাবী আবু রাফে‘ বলেন, পরে আমরা আটজনে মিলেও সেটা নাড়াতে পারিনি (ইবনু হিশাম ২/৩৩৫; তারীখ ত্বাবারী ৩/১৩)। বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ বা ‘ছিন্নসূত্র’ (মা শা-‘আ ১৮০ পৃঃ)। আলী (রাঃ)-এর মর্যাদা প্রমাণের জন্য অসংখ্য ছহীহ হাদীছ রয়েছে। অতএব এরূপ যঈফ বর্ণনার আশ্রয় নেওয়া আদৌ সমীচীন নয়।
[4]. ইবনু হিশাম ২/৩৩৪।
প্রসিদ্ধ আছে যে, হযরত যুবায়ের (রাঃ) যখন ময়দানে অবতরণ করেন, তখন তার মা রাসূল (ছাঃ)-এর ফুফু হযরত ছাফিয়া (রাঃ) বলে ওঠেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার ছেলে কি নিহত হবে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, না। بَلْ ابْنُكَ يَقْتُلُهُ إنْ شَاءَ اللهُ ‘বরং আপনার ছেলে তার প্রতিপক্ষকে হত্যা করবে ইনশাআল্লাহ’। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা বাস্তবায়িত হয়’ (ইবনু হিশাম ২/৩৩৪; যাদুল মা‘আদ ৩/২৮৭; আর-রাহীক্ব ৩৭০ পৃঃ)। বক্তব্যটির সনদ ‘যঈফ’ (আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব ১৬৫ পৃঃ)।