হোদায়বিয়ার সন্ধিকে ‘গাযওয়া’ বা যুদ্ধ(غزوة الحديبية) বলা হয় এ কারণে যে, কুরায়েশরা রাসূল (ছাঃ)-কে এখানে ওমরার জন্য মক্কায় প্রবেশে বাধা দিয়েছিল’ (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৩৪)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ১লা যুলক্বা‘দাহ সোমবার স্ত্রী উম্মে সালামাহ সহ ১৪০০ (মতান্তরে ১৫০০) সাথী নিয়ে ওমরাহর উদ্দেশ্যে মদীনা হ’তে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হন। এই সময় কোষবদ্ধ তরবারি ব্যতীত তাদের সাথে অন্য কোন অস্ত্র ছিল না। কিন্তু মক্কার অদূরে হোদায়বিয়া নামক স্থানে পৌঁছলে তাঁরা কুরায়েশ নেতাদের বাধার সম্মুখীন হন। অবশেষে তাদের সঙ্গে দশ বছরের জন্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে চুক্তির শর্তানুযায়ী তিনি মদীনায় ফিরে আসেন এবং পরের বছর ওমরা করেন। বিস্তারিত নিম্নরূপ।-
‘হোদায়বিয়া’ (الْحُدَيْبِيَة) একটি কূয়ার নাম। যা মক্কা থেকে উত্তর-পশ্চিমে ২২ কি.মি. দূরে অবস্থিত। এটি বর্তমানে ‘শুমাইসী’ (الشُمَيْسِى) নামে পরিচিত। এখানে হোদায়বিয়ার বাগিচাসমূহ এবং ‘রিযওয়ান মসজিদ’(مسجد الرِضْوَان) অবস্থিত।
খন্দকের যুদ্ধে ভূমিধস বিজয়ের পরেও কুরায়েশদের শত্রুতা থেকে রাসূল (ছাঃ) নিশ্চিন্ত ছিলেন না। সেকারণ অধিক সংখ্যক ছাহাবী নিয়ে তিনি ওমরায় এসেছিলেন এবং সাথে অস্ত্রও ছিল। ফলে যুদ্ধ হবে মনে করে দুর্বলচেতা ও বেদুঈন মুসলমানরা বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে সরে পড়ে। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,
سَيَقُولُ لَكَ الْمُخَلَّفُونَ مِنَ الْأَعْرَابِ شَغَلَتْنَا أَمْوَالُنَا وَأَهْلُونَا فَاسْتَغْفِرْ لَنَا يَقُولُونَ بِأَلْسِنَتِهِمْ مَا لَيْسَ فِي قُلُوبِهِمْ قُلْ فَمَنْ يَمْلِكُ لَكُمْ مِنَ اللهِ شَيْئًا إِنْ أَرَادَ بِكُمْ ضَرًّا أَوْ أَرَادَ بِكُمْ نَفْعًا بَلْ كَانَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا- بَلْ ظَنَنْتُمْ أَنْ لَنْ يَنْقَلِبَ الرَّسُولُ وَالْمُؤْمِنُونَ إِلَى أَهْلِيهِمْ أَبَدًا وَزُيِّنَ ذَلِكَ فِي قُلُوبِكُمْ وَظَنَنْتُمْ ظَنَّ السَّوْءِ وَكُنْتُمْ قَوْمًا بُورًا- (الفتح 11-12)-
‘পিছনে পড়ে থাকা বেদুঈনরা সত্বর তোমাকে বলবে, আমাদের মাল-সম্পদ ও পরিবার আমাদেরকে ব্যস্ত রেখেছিল। অতএব আপনি আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তারা মুখে একথা বলবে, যা তাদের অন্তরে নেই। বল, আল্লাহ তোমাদের কোন ক্ষতি বা উপকার করতে চাইলে কে তাকে বিরত রাখতে পারে? বরং তোমরা যা কিছু কর সবই আল্লাহ খবর রাখেন’। ‘বরং তোমরা ধারণা করেছিলে যে, রাসূল ও মুমিনগণ তাদের পরিবারের কাছে আর কখনই ফিরে আসতে পারবে না এবং এই ধারণা তোমাদের অন্তরগুলিকে সুশোভিত করে রেখেছিল। আর তোমরা মন্দ ধারণা করেছিলে। বস্ত্ততঃ তোমরা ছিলে ধ্বংসমুখী এক সম্প্রদায়’ (ফাৎহ ৪৮/১১-১২)। এখানে বেদুঈন (الْأَعْرَابُ) বলতে মদীনার জুহাইনা ও মুযাইনা গোত্র দ্বয়কে বুঝানো হয়েছে (তাফসীর ত্বাবারী)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে এক রাতে স্বপ্ন দেখানো হ’ল যে, তিনি স্বীয় ছাহাবীদের সাথে নিয়ে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করছেন এবং ওমরাহ করছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,لَقَدْ صَدَقَ اللهُ رَسُولَهُ الرُّؤْيَا بِالْحَقِّ لَتَدْخُلُنَّ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ إِنْ شَاءَ اللهُ آمِنِينَ مُحَلِّقِينَ رُءُوسَكُمْ وَمُقَصِّرِينَ لاَ تَخَافُونَ فَعَلِمَ مَا لَمْ تَعْلَمُوا فَجَعَلَ مِنْ دُونِ ذَلِكَ فَتْحًا قَرِيبًا ‘আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সত্য স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আল্লাহ চাহেন তো তোমরা অবশ্যই মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে মস্তক মুন্ডিত অবস্থায় এবং কেশ কর্তিত অবস্থায়। এমনভাবে যে, তোমরা কাউকে ভয় করবে না। অতঃপর তিনি জানেন, যা তোমরা জানো না। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে একটি নিকটবর্তী বিজয় দান করবেন’ (ফাৎহ ৪৮/২৭)। অর্থাৎ তোমাদেরকে মক্কায় প্রবেশ না করিয়ে হোদায়বিয়া থেকে ফেরৎ আনার মধ্যে তোমাদের জন্য কি কল্যাণ নিহিত থাকবে, তা তোমরা জানো না। অতঃপর সেই প্রত্যাবর্তনের বিনিময়ে তোমাদেরকে তিনি দান করবেন একটি ‘নিকটবর্তী বিজয়’। অর্থাৎ হোদায়বিয়ার সন্ধি। অতঃপর সেখান থেকে ফিরেই হবে খায়বর বিজয় ও বিপুল গণীমত লাভ।
এ স্বপ্ন দেখার পরে তিনি ওমরাহ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ছাহাবীদের প্রস্ত্তত হ’তে বলেন। ইতিপূর্বে খন্দক যুদ্ধে বিজয় লাভের পর সমগ্র আরবে মুসলিম শক্তিকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসাবে গণ্য করা হ’তে থাকে। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কিছুটা স্বস্তির মধ্যে ছিলেন।