ক্বারনুল মানাযিলে মালাকুল জিবালের আগমন ও তার বক্তব্যে রাসূল (ছাঃ)-এর মন থেকে ত্বায়েফের সকল দুঃখ-বেদনা মুছে যায়। তিনি পুনরায় মক্কায় ফিরে গিয়ে পূর্ণোদ্যমে দাওয়াতের কাজ শুরু করার সংকল্প করলেন। তখন যায়েদ বিন হারেছাহ (রাঃ) বললেন, كَيْفَ تَدْخُلُ عَلَيْهِمْ وَقَدْ أَخْرَجُوك؟ ‘যে মক্কাবাসীরা আপনাকে বের করে দিয়েছে, সেখানে আপনি কিভাবে প্রবেশ করবেন? জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, يَا زَيْدُ إنَّ اللهَ جَاعِلٌ لِمَا تَرَى فَرْجًا وَمَخْرَجًا وَإِنَّ اللهَ نَاصِرٌ دِينَهُ وَمُظْهِرٌ نَبِيَّهُ ‘হে যায়েদ! তুমি যে অবস্থা দেখছ, নিশ্চয়ই আল্লাহ এ থেকে পরিত্রাণের একটা পথ বের করে দেবেন এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ তার দ্বীনকে সাহায্য করবেন ও তার নবীকে বিজয়ী করবেন’।[1]
কুরায়েশদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ত্বায়েফের ছাক্বীফ গোত্রের নিকটে সাহায্য প্রার্থনা ও সেখানে দাওয়াতের নতুন কেন্দ্র স্থাপনের আশা নিয়ে রাসূল (ছাঃ) এ সফর করেছিলেন। কিন্তু তারা সে দাওয়াত কবুল করেনি। বরং সেখান থেকে চরম নির্যাতিত হয়ে তাঁকে ফিরতে হয়।
ত্বায়েফের দিনকে সর্বাধিক দুঃখময় দিন বলার কারণ সম্ভবতঃ এই ছিল যে, ওহোদের ঘটনায় দান্দান মুবারক শহীদ হ’লেও সেদিন তাঁর সাথী মুজাহিদ ছিলেন অনেক, যারা তাঁর দাওয়াত চালিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু ওহোদের ঘটনার প্রায় ছয় বছর পূর্বে ত্বায়েফের সেই মর্মান্তিক ঘটনার দিন তাঁর সাথী কেউ ছিল না যায়েদ বিন হারেছাহ ব্যতীত। অতএব ত্বায়েফের ঘটনা ওহোদের ঘটনার চাইতে নিঃসন্দেহে অধিক কষ্টদায়ক ও অধিক হৃদয় বিদারক ছিল।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নাখলা উপত্যকা হ’তে মক্কাভিমুখে রওয়ানা করে হেরা গুহার পাদদেশে পৌঁছে মক্কায় প্রবেশের জন্য কিছু হিতাকাংখীর নিকটে খবর পাঠালেন। কিন্তু কেউ ঝুঁকি নিতে চায়নি। অবশেষে মুত্ব‘ইম বিন ‘আদী রাযী হন এবং তার সম্মতিক্রমে যায়েদ বিন হারেছাহকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কায় এসে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন ও হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করেন। অতঃপর দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেন। এ সময় মুত্ব‘ইম ও তার পুত্র এবং কওমের লোকেরা সশস্ত্র অবস্থায় তাঁকে পাহারা দেন এবং পরে তাঁকে বাড়ীতে পৌঁছে দেন। আবু জাহল মুত্ব‘ইমকে প্রশ্ন করেন أمجير أو تَابِعٌ؟ ‘আশ্রয়দাতা না অনুসারী’? মুত্ব‘ইম জবাবে বলেন, بَلْ مُجِيرٌ ‘বরং আশ্রয়দাতা’। তখন আবু জাহল বলেন, قَدْ أَجَرْنَا مَنْ أَجَرْتَ ‘আমরাও তাকে আশ্রয় দিলাম, যাকে তুমি আশ্রয় দিয়েছ’। মূলতঃ এটি ছিল বংশীয় টান মাত্র। এভাবে মাসাধিককালের কষ্টকর সফর শেষে ১০ম নববী বর্ষের যুলক্বা‘দাহ মোতাবেক ৬১৯ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসের প্রথম দিকে তিনি মক্কায় ফিরে এলেন’।[2]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুত্ব‘ইম বিন ‘আদীর এই সৌজন্যের কথা কখনো ভুলেননি। এই ঘটনার প্রায় পাঁচ বছর পর সংঘটিত বদরের যুদ্ধে বন্দী কাফেরদের মুক্তির ব্যাপারে তিনি বলেন, لَوْ كَانَ الْمُطْعِمُ بْنُ عَدِىٍّ حَيًّا، ثُمَّ كَلَّمَنِى فِى هَؤُلاَءِ النَّتْنَى، لَتَرَكْتُهُمْ لَهُ ‘যদি মুত্ব‘ইম বিন ‘আদী বেঁচে থাকত এবং এইসব দুর্গন্ধময় মানুষগুলোর জন্য সুফারিশ করত, তাহ’লে তার খাতিরে আমি এদের সবাইকে ছেড়ে দিতাম’।[3] মুত্ব‘ইম বিন ‘আদী ৯০-এর অধিক বয়সে বদর যুদ্ধের পূর্বে মক্কায় মৃত্যুবরণ করেন (সিয়ারু আ‘লাম ৩/৯৮)।
[2]. আর-রাহীক্ব ১২৯-৩০ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/৩০; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/১৩৭।
[3]. বুখারী হা/৩১৩৯; মিশকাত হা/৩৯৬৫; ‘জিহাদ’ অধ্যায় ‘বন্দীদের হুকুম’ অনুচ্ছেদ-৫।