(ক) নবুঅত প্রাপ্তির পর থেকেই ছালাত ফরয হয়। তবে তখন ছালাত ছিল কেবল ফজরে ও আছরে দু’ দু’ রাক‘আত করে (কুরতুবী)। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন,وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ بِالْعَشِيِّ وَالْإِبْكَارِ ‘তুমি তোমার প্রভুর প্রশংসা জ্ঞাপন কর সন্ধ্যায় ও সকালে (অর্থাৎ সূর্যাস্তের পূর্বে ও সূর্যোদয়ের পূর্বে)’।[1] আয়েশা (রাঃ) বলেন, শুরুতে ছালাত বাড়ীতে ও সফরে ছিল দু’ দু’ রাক‘আত করে।[2] এছাড়া রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য ‘অতিরিক্ত’ (نَافِلَةً) ছিল তাহাজ্জুদের ছালাত (ইসরা/বনু ইস্রাঈল ১৭/৭৯)। সেই সাথে ছাহাবীগণও নিয়মিতভাবে রাত্রির নফল ছালাত আদায় করতেন।[3]
প্রথম দিকে সবাই সেটা গোপনে আদায় করতেন। পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এটা প্রকাশ্যে কা‘বাগৃহে আদায় করতে থাকেন। একদিন তিনি ছালাত আদায় করছেন। এমন সময় আবু জাহ্ল গিয়ে তাঁকে ধমকের সুরে বলল,يَا مُحَمَّدُ، أَلَمْ أَنْهَكَ عَنْ هَذَا؟ ‘হে মুহাম্মাদ! আমি কি তোমাকে এসব থেকে নিষেধ করিনি?’
তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে পাল্টা ধমক দেন। এতে সে বলে,يَا مُحَمَّدُ بِأَيِّ شَيْءٍ تُهَدِّدُنِي؟ أَمَا وَاللهِ إِنِّي لَأَكْثَرُ هَذَا الْوَادِي نَادِيًا ‘কিসের জোরে তুমি আমাকে ধমকাচ্ছ হে মুহাম্মাদ? আল্লাহর কসম! মক্কার এই উপত্যকায় আমার বৈঠক সবচেয়ে বড়’। অর্থাৎ আমার দল সবচেয়ে ভারি। তখন আল্লাহ সূরা ‘আলাক্ব-এর নিম্নোক্ত আয়াতগুলি নাযিল করেন।[4]
كَلاَّ إِنَّ الْإِنسَانَ لَيَطْغَى- أَن رَّآهُ اسْتَغْنَى- إِنَّ إِلَى رَبِّكَ الرُّجْعَى- أَرَأَيْتَ الَّذِي يَنْهَى- عَبْداً إِذَا صَلَّى- أَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ عَلَى الْهُدَى- أَوْ أَمَرَ بِالتَّقْوَى- أَرَأَيْتَ إِنْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى- أَلَمْ يَعْلَمْ بِأَنَّ اللهَ يَرَى- كَلاَّ لَئِن لَّمْ يَنتَهِ لَنَسْفَعاً بِالنَّاصِيَةِ- نَاصِيَةٍ كَاذِبَةٍ خَاطِئَةٍ- فَلْيَدْعُ نَادِيَه- سَنَدْعُ الزَّبَانِيَةَ- كَلاَّ لاَ تُطِعْهُ وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ- (العلق ৬-১৯)-
‘কখনোই না। নিশ্চয়ই মানুষ সীমালংঘন করে’ (৬)। ‘এ কারণে যে, সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে’ (৭)। ‘নিশ্চয় তোমার প্রতিপালকের নিকটেই প্রত্যাবর্তন স্থল’ (৮)। ‘তুমি কি দেখেছ ঐ ব্যক্তিকে (আবু জাহলকে) যে নিষেধ করে?’ (৯)। ‘এক বান্দাকে (রাসূলকে), যখন সে ছালাত আদায় করে’ (১০)। ‘তুমি কি দেখেছ যদি সে সৎপথে থাকে’ (১১)। ‘অথবা আল্লাহভীতির আদেশ দেয়’ (১২)। ‘তুমি কি দেখেছ যদি সে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়’ (১৩)। ‘সে কি জানেনা যে, আল্লাহ তার সবকিছুই দেখেন’ (১৪)। ‘কখনোই না। যদি সে বিরত না হয়, তবে আমরা অবশ্যই তার মাথার সামনের কেশগুচ্ছ ধরে সজোরে টান দেব’(১৫)। ‘মিথ্যুক পাপিষ্ঠের কেশগুচ্ছ’ (১৬)। ‘অতএব সে তার পারিষদবর্গকে ডাকুক’ (১৭)। ‘আমরাও অচিরে ডাকব আযাবের ফেরেশতাদের’ (১৮)। ‘কখনোই না। তুমি তার কথা শুনবে না। তুমি সিজদা কর এবং আল্লাহর নৈকট্য তালাশ কর’ (‘আলাক্ব ৯৬/৬-১৯)।
আবু জাহ্ল ও রাসূল (ছাঃ)-এর মধ্যকার এই ঘটনা স্মরণ করে এই আয়াত পাঠের পর পাঠক ও শ্রোতাকে একটি সিজদা করার বিধান দেওয়া হয়েছে’।[5] আর এটাই হ’ল কুরআনের ১৫তম ও সর্বশেষ সিজদার আয়াত’ (দারাকুৎনী হা/১৫০৭)। উল্লেখ্য যে, এই সিজদার জন্য ওযূ, কিবলা বা সালাম করা শর্ত নয়।
উপরোক্ত ঘটনায় শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, দূরদর্শী কাফের-মুশরিক ও ধর্মনিরপেক্ষ নেতারা মুসলমানদের ব্যক্তিগত ইবাদতকেই বেশী ভয় পায়। যদিও তারা মুখে বলে যে, ধর্মের ব্যাপারে আমাদের কোন আপত্তি নেই। কেননা তাদের মতে ধর্ম হ’ল আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার ব্যক্তিগত সম্পর্কের নাম। অথচ নেতারা ভালভাবেই জানেন যে, ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতেই মানুষের জীবন পরিচালিত হয়। ব্যক্তির রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সবকিছু তার বিশ্বাসকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। আবু জাহ্ল ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী নেতা। তাই তিনি মূল জায়গাতেই বাধা সৃষ্টি করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, কা‘বাতে একবার আল্লাহর জন্য সিজদা চালু হ’লে পাশেই রক্ষিত দেব-দেবীর সম্মুখে কেউ আর মাথা নীচু করবে না। তাদের অসীলায় কেউ আর মুক্তি চাইবে না এবং সেখানে কেউ আর নযর-নেয়ায দিবে না। অথচ অসীলাপূজার এই শিরকের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাদের অর্থবল, জনবল, সামাজিক সম্মান সবকিছুর চাবিকাঠি। বর্তমান যুগের কবরপূজারী ও ওরস ব্যবসায়ী মুসলমানদের অবস্থা সেযুগের আবু জাহ্লদের চাইতে ভিন্ন কিছুই নয়। সেদিন যেমন কা‘বার পাশেই মূর্তিপূজা হ’ত, এখন তেমনি মসজিদের পাশেই কবরপূজা হয় ও সেখানে নযর-নেয়ায দেওয়া হয়। ধর্মের নামে এইসব ধর্মনেতারা ধার্মিক মুসলমানদের তাওহীদ থেকে ফিরিয়ে শিরকমুখী করে। একইভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও বস্ত্তবাদী নেতারা চাকুরী, ব্যবসা, শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে সুকৌশলে দ্বীনদার মুসলিম নর-নারীকে তাদের ব্যক্তিগত ধর্ম পালনে বাধার সৃষ্টি করে থাকে।
(খ) সূরা ‘আলাক্ব-এর উপরোক্ত আয়াতসমূহ নাযিল হওয়ার পর আবু জাহ্ল মনে মনে ভীত হ’লেও বাইরে ঠাট বজায় রেখেই চলেন। একদিন তিনি কুরায়েশ নেতাদের সামনে বলে বসেন, লাত ও উয্যার কসম! যদি মুহাম্মাদকে পুনরায় সেখানে ছালাতরত দেখি, তাহ’লে নিশ্চিতভাবেই আমি তার ঘাড়ের উপরে পা দিয়ে তার নাকমুখ মাটিতে আচ্ছামত থেৎলে দেব’ (মুসলিম)। পরে একদিন তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে সেখানে ছালাতরত অবস্থায় দেখলেন। তখন নেতারা তাকে তার প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উসকে দিল। ফলে তিনি খুব আস্ফালন করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু না। হঠাৎ দেখা গেল যে, তিনি ভয়ে পিছিয়ে আসছেন। আর দুই হাত শূন্যে উঁচু করে কি যেন এড়াতে চেষ্টা করছেন’। পিছিয়ে এসে তিনি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, আমার ও তার মধ্যে একটা বিরাট অগ্নিকুন্ড দেখলাম, যা আমার দিকে ধেয়ে আসছিল’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لَوْ دَنَا مِنِّى لاَخْتَطَفَتْهُ الْمَلاَئِكَةُ عُضْوًا عُضْوًا ‘যদি সে আমার কাছে পৌঁছত, তাহ’লে ফেরেশতারা তার এক একটা অঙ্গ ছিন্ন করে উঠিয়ে নিয়ে যেত’।[6] আশ্চর্যের বিষয়, এতবড় দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেও এবং রাসূল (ছাঃ)-এর উপর আল্লাহর সরাসরি সাহায্য প্রত্যক্ষ করেও আবু জাহ্ল তার হঠকারিতা থেকে পিছিয়ে আসেননি কেবলমাত্র নেতৃত্বের অহংকারে স্ফীত হওয়ার কারণে। নমরূদ, ফেরাঊন ও আবু জাহল সহ যুগে যুগে সকল হঠকারী নেতাদের চরিত্র একই।
(গ) শিস দেওয়া ও তালি বাজানো(المكاء والةصدية عند الصلاة فى الكعبة) : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন কা‘বায় গিয়ে ছালাত আদায় করতেন, তখন কাফের নেতারা তাদের লোকজন নিয়ে কা‘বাগৃহে আসত। অতঃপর ইবাদতের নাম করে তারা সেখানে জোরে জোরে তালি বাজাত ও শিস্ দিত। যাতে রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত ও ইবাদতে বিঘ্ন ঘটানো যায়। এ বিষয়টি উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন,وَمَا كَانَ صَلاَتُهُمْ عِنْدَ الْبَيْتِ إِلاَّ مُكَاءً وَّتَصْدِيَةً فَذُوْقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُوْنَ ‘আর বায়তুল্লাহ্র নিকটে তাদের ইবাদত বলতে শিস দেওয়া ও তালি বাজানো ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অতএব (ক্বিয়ামতের দিন তাদের বলা হবে) তোমরা অবিশ্বাসের শাস্তি আস্বাদন কর’ (আনফাল ৮/৩৫)।
(ঘ) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এতদ্ব্যতীত আবু জাহ্ল অন্যান্যদেরকে প্ররোচিত করেছিলেন যে, মুহাম্মাদ যখন কুরআন তেলাওয়াত করে তখন তোমরা হৈ-হুল্লোড় ও হট্টগোল করবে, যাতে কেউ তার তেলাওয়াত শুনতে না পায়। এ প্রসঙ্গে আয়াত নাযিল হয়-
وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لاَ تَسْمَعُوْا لِهَذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيْهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُوْنَ- فَلَنُذِيْقَنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا عَذَاباً شَدِيْداً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَسْوَأَ الَّذِيْ كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ- (فصلت ২৬-২৭)-
‘আর কাফেররা বলে, তোমরা এ কুরআন শুনোনা এবং এর তেলাওয়াত কালে হট্টগোল কর, যাতে তোমরা বিজয়ী হও’। ‘আমরা অবশ্যই কাফিরদের কঠিন শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাব এবং আমরা অবশ্যই তাদের কৃতকর্মের নিকৃষ্টতম বদলা দেব’ (ফুছসালাত/হা-মীম সাজদাহ ৪১/২৬-২৭)। এছাড়াও তারা নানাবিধ গালি দিত। তখন নাযিল হয়-وَلاَ تَجْهَرْ بِصَلاَتِكَ وَلاَ تُخَافِتْ بِهَا وَابْتَغِ بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيْلاً ‘আর তুমি তোমার ছালাতের ক্বিরাআতে স্বর অধিক উঁচু করো না বা একেবারে নীচু করো না। বরং দু’য়ের মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন কর’ (ইসরা ১৭/১১০)।[7]
[2]. মুসলিম হা/৬৮৫; আবুদাঊদ হা/১১৯৮; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/২১১।
[3]. মুযযাম্মিল ৭৩/২০; তাফসীরে কুরতুবী।
[4]. ত্বাবারী, তাফসীর ‘আলাক্ব ১৮ আয়াত; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭৫; তিরমিযী হা/৩৩৪৯।
[5]. মুসলিম হা/৫৭৮; বুখারী হা/১০৭৪; মিশকাত হা/১০২৪ ‘সুজূদুল কুরআন’ অনুচ্ছেদ।
[6]. ইবনু হিশাম ১/২৯৯ টীকা -৪; মুসলিম হা/২৭৯৭, মিশকাত হা/৫৮৫৬।
ইবনু ইসহাকের অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূল (ছাঃ) সিজদায় গেলে আবু জাহ্ল পাথর উঠিয়ে এগিয়ে গেল। কিন্তু কিছু দূর এগোতেই দ্রুত ভয়ে পিছিয়ে এল। এ সময় তার হাতের পাথরখন্ডটা এমনভাবে চিমটি লেগে গেল যে, সে তা হাত থেকে ছাড়াতে পারছিল না। লোকেরা তার অবস্থা কি জিজ্ঞেস করলে সে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, একটা ভয়ংকর উট আমাকে খেতে আসছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, জিব্রীল স্বয়ং উষ্ট্রের রূপ ধারণ করে তাকে ভয় দেখিয়েছিল। কাছে এলে তাকে ধরে নিত’ (ইবনু হিশাম ১/২৯৮; বায়হাক্বী দালায়েল ৪/১৩; আর-রাহীক্ব পৃঃ ৯৯)। বর্ণনাটি যঈফ (মা শা-‘আ পৃঃ ৪৮-৪৯)। এ ব্যাপারে ছহীহ বর্ণনা সেটাই যা উপরে বর্ণিত হয়েছে।
[7]. বুখারী হা/৭৪৯০; মুসলিম হা/৪৪৬; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বনু ইস্রাঈল ১১০ আয়াত।