হাদীসের নামে যে সকল বানোয়াট ‘আমল’ বা ‘তদবীর’ আমাদের দেশে প্রচলিত কোনো কোনো গ্রন্থে পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. লা হাওলা .... দারিদ্র্য বিমোচনের আমল
(লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ) এ যিক্রটির ফযীলতে অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্ন হাদীসে এ বাক্যটিকে বেশিবেশি করে বলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বাক্যটি জান্নাতের অন্যতম ধনভান্ডার, গোনাহ মাফের ও অফুরন্ত সাওয়াব লাভের অসীলা বলে বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছে। এ বিষয়ক কিছু সহীহ হাদীস আমি ‘রাহে বেলায়াত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছি। কিন্তু আমাদের দেশে প্রচলিত বিভিন্ন গ্রন্থে হাদীস হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘যে ব্যক্তি এ বাক্যটি প্রত্যহ ১০০ বার পাঠ করবে সে কখনো দরিদ্র থাকবে না।’ কথাটি দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন সনদে বর্ণিত।[1]
অনুরূপভাবে অন্য একটি দুর্বল সনদের হাদীসে বলা হয়েছে যে, ‘লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আযীম’ ৯৯ টি রোগের প্রতিষেধক, সেগুলোর সহজতম রোগ দুশ্চিন্তা।’’[2]
২. ঋণমুক্তির আমল
আলী (রা) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, নিম্নের বাক্যটি বললে পাহাড় পরিমাণ ঋণ থাকলেও আল্লাহ তা পরিশোধ করাবেন:
اللَّهُمَّ اكْفِنِي بِحَلَالِكَ عَنْ حَرَامِكَ وَأَغْنِنِي بِفَضْلِكَ عَمَّنْ سِوَاكَ
‘‘হে আল্লাহ, আপনি আপনার হালাল প্রদান করে আমাকে হারাম থেকে রক্ষা করুন এবং আপনার দয়া ও বরকত প্রদান করে আমাকে আপনি ছাড়া অন্য সকলের অনুগ্রহ থেকে বিমুক্ত করে দিন।’’ হাদীসটি সহীহ।[3]
কিন্তু কোনো বিশেষ দিনে বা বিশেষ সংখ্যায় দোয়াটি পাঠ করার বিষয়ে কোনো নির্দেশ কোনো হাদীসে দেওয়া হয় নি। প্রচলিত কোনো কোনো গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে: ‘‘হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি শুক্রবার দিনে ৭০ বার এ দোয়া পড়বে, অল্প দিনের মধ্যে আল্লাহ তাকে ধনী ও সৌভাগ্যশালী করে দিবেন। হযরত আলী (রা) বলেছেন: শুক্রবার দিন জুমুয়ার নামাযের পূর্বে ও পরে ১০০ বার করে দরুদ পড়ে এ দোয়া ৫৭০ বার পাঠ করলে পাহাড় পরিমান ঋণ থাকলেও তাহা অল্প দিনের মধ্যে পরিশোধ হয়ে যাবে...।’’ এ বর্ণনাগুলো ভিত্তিহীন ও বানোয়াট বলে প্রতীয়মান হয়।
৩. সূরা ফাতিহার আমল
সূরা ফাতিহার ফযীলতে বলা হয় :
اَلْفَاتِحَةُ لِمَا قُرِئَتْ لَهُ
‘‘ফাতিহা যে নিয়েতে পাঠ করা হবে তা পুরণ হবে।’’
এ কথাটি ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। আরেকটি কথা বলা হয়:
فَاتِحَةُ الْكِتَابِ شِفَاءٌ مِنْ كُلِّ دَاءٍ
‘‘সূরা ফাতিহা সকল রোগের আরোগ্য বা শেফা।’’
এ কথাটি একটি যয়ীফ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।[4]
৪. বিভিন্ন প্রকারের খতম
বিভিন্ন প্রকারের ‘খতম’ প্রচলিত আছে। সাধারণত, দুটি কারণে ‘খতম’ পাঠ করা হয়: (১) বিভিন্ন বিপদাপদ কাটানো বা জাগতিক ফল লাভ ও (২) মৃতের জন্য সাওয়াব পাঠানো। উভয় প্রকারের খতমই ‘বানোয়াট’ ও ভিত্তিহীন। এ সকল খতমের জন্য পঠিত বাক্যগুলো অধিকাংশই খুবই ভাল বাক্য। এগুলো কুরআনের আয়াত বা সুন্নাত সম্মত দোয়া ও যিক্র। কিন্তু এগুলো এক লক্ষ বা সোয়া লক্ষ বার পাঠের কোনো নির্ধারিত ফযীলত, গুরুত্ব বা নির্দেশনা কিছুই কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীসে বলা হয় নি। এ সকল ‘খতম’ সবই বানোয়াট। উপরন্তু এগুলোকে কেন্দ্র করে কিছু হাদীসও বানানো হয়েছে।
‘বিসমিল্লাহ’ খতম, দোয়া ইউনুস খতম, কালেমা খতম ইত্যাদি সবই এ পর্যায়ের। বলা হয় ‘সোয়া লাখ বার বিসমিল্লাহ পড়লে অমুক ফল লাভ করা যায়’ বা ‘সোয়া লাখ বার দোয়া ইউনূস পাঠ করলে অমুক ফল পাওয়া যায়’ ইত্যাদি। এগুলো সবই বুযুর্গদের অভিজ্ঞতার আলোকে বানানো এবং কোনোটিই হাদীস নয়। তাসমিয়া বা (বিসমিল্লাহ), তাহলীল বা (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও দোয়া ইউনুস-এর ফযীলত ও সাওয়াবের বিষয়ে সহীহ হাদীস রয়েছে।[5] তবে এগুলি ১ লক্ষ, সোয়া লক্ষ ইত্যাদি নির্ধারিত সংখ্যায় পাঠ করার বিষয়ে কোনো হাদীস বর্ণিত হয় নি। খতমে খাজেগানের মধ্যে পঠিত কিছু দোয়া মাসনূন ও কিছু দোয়া বানানো। তবে পদ্ধিতিটি পুরোটাই বানানো।
এখানে আরো লক্ষণীয় যে, এ সকল খতমের কারণে সমাজে এ ধরনের ‘‘পুরোহিততন্ত্র’’ চালু হয়েছে। ইসলামের নির্দেশনা হলো, বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি ইউনূস (আঃ)-এর মতই নিজে ‘‘দুআ ইউনূস’’ বা অন্যান্য সুন্নাত সম্মত দুআ পড়ে মনের আবেগে আল্লাহর কাছে কাঁদবেন এবং বিপদমুক্তি প্রার্থনা করবেন। একজনের বিপদে অন্যজন কাঁদবেন, এমনটি নয়। বিপদগ্রস্ত মানুষ অন্য কোনো নেককার আলিম বা বুজুর্গের কাছে দুআ চাইতে পারেন। তবে এখানে কয়েকটি বিষয় মনে রাখতে হবে:
(১) অনেকে মনে করেন, জাগতিক রাজা বা মন্ত্রীর কাছে আবেদন করতে যেমন মধ্যস্থতাকারী বা সুপারিশকারীর প্রয়োজন, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেও অনুরূপ কিছুর প্রয়োজন। আলিম-বুজুর্গের সুপারিশ বা মধ্যস্থতা ছাড়া আল্লাহর কাছে দুআ বোধহয় কবুল হবে না। এ ধরনের চিন্তা সুস্পষ্ট শিরক। আমি ‘‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’’ গ্রন্থে বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করেছি। জাগতিক সম্রাট, মন্ত্রী, বিচারক বা নেতা আমাকে ভালভাবে চিনেন না বা আমার প্রতি তার মমতা কম এ কারণে তিনি হয়ত আমার আবেদন রাখবেন না বা পক্ষপাতিত্ব করবেন। কিন্তু মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে কি এরূপ চিন্তা করা যায়? ইসলামের বিধিবিধান শিখতে, আত্মশুদ্ধির কর্ম শিখতে, কর্মের প্রেরণা ও উদ্দীপনা পেতে বা আল্লাহর জন্য মহববত নিয়ে আলিম ও বুজুর্গগণের কাছে যেতে হয়। প্রার্থনা, বিপদমুক্তি ইত্যাদির জন্য একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইতে হয়।
(২) কুরআন কারীম ও বিভিন্ন সহীহ হাদীসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, যে কোনো মুমিন নারী বা পুরুষ যে কোনো অবস্থায় আল্লাহর কাছে নিজের মনের আবেগ প্রকাশ করে দুআ করলে ইবাদত করার সাওয়াব লাভ করবেন। এছাড়া আল্লাহ তার দুআ কবুল করবেন। তিনি তাকে তার প্রার্থিত বিষয় দান করবেন, অথবা এ প্রার্থনার বিনিময়ে তার কোনো বিপদ কাটিয়ে দিবেন অথবা তার জন্য জান্নাতে কোনো বড় নিয়ামত জমা করবেন। ‘‘রাহে বেলায়াত’’ গ্রন্থে আমি এ বিষয়ক হাদীসগুলো সনদ-সহ আলোচনা করেছি।
(৩) নিজে দুআ করার পাশাপাশি জীবিত কোনো আলিম-বুজুর্গের কাছে দুআ চাওয়াতে অসুবিধা নেই। তবে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, নিজের জন্য নিজের দুআই সর্বোত্তম দুআ। এছাড়া দুআর ক্ষেত্রে মনের আবেগ ও অসহায়ত্বই দুআ কবুলের সবচেয়ে বড় অসীলা। আর বিপদগ্রস্ত মানুষ যতটুকু আবেগ নিয়ে নিজের জন্য কাঁদতে পারেন, অন্য কেউ তা পারে না।
(৪) অনেকে মনে করেন, আমি পাপী মানুষ আমার দুআ হয়ত আল্লাহ শুনবেন না। এ চিন্তুা খুবই আপত্তিকর ও আল্লাহর রহমত থেকে হতাশার মত পাপের পথ। কুরআনে একাধিক স্থানে বলা হয়েছে যে, কাফির-মুশরিকগণও যখন অসহায় হয়ে মনের আবেগে আল্লাহর কাছে দুআ করত, তখন আল্লাহ তাদের দুআ কবুল করতেন। কুরআন ও হাদীসে বারংবার বলা হয়েছে যে, পাপ-অন্যায়ের কারণেই মানুষ বিপদগ্রস্ত হয় এবং বিপদগ্রস্ত পাপী ব্যক্তির মনের আবেগময় দুআর কারণেই আল্লাহ বিপদ কাটিয়ে দেন।
(৫) হাদীস শরীফে বলা হয়েছে যে, ‘‘দুআ ইউনূস’’ পাঠ করে দুআ করলে আল্লাহ কবুল করবেন। (লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুহানাকা ইন্নী কুনতু মিনায যালিমীন) অর্থ- আপনি ছাড়া কোনো মাবূদ নেই, আপনি মহা-পবিত্র, নিশ্চয় আমি অত্যাচারীদের অন্তর্ভূক্ত হয়েছি। এর মর্মার্থ হলো: ‘‘বিপদে ডাকার মত, বিপদ থেকে উদ্ধার করার মত বা বিপদে আমার ডাক শুনার মত আপনি ছাড়া কেউ নেই। আমি অপরাধ করে ফেলেছি, যে কারণে এ বিপদ। আপনি এ অপরাধ ক্ষমা করে বিপদ কাটিয়ে দিন।’’ আল্লাহর একত্বের ও নিজের অপরাধের এ আন্তরিক স্বীকারোক্তি আল্লাহ এত পছন্দ করেন যে, এর কারণে আল্লাহ বিপদ কাটিয়ে দেন।
(৬) ‘‘খতম’’ ব্যবস্থা চালু করার কারণে এখন আর বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি নিজে দুআ ইউনূস পাঠ বা খতম করে কাঁদেন না। বরং তিনি নির্দিষ্ট সংখ্যক আলিম-বুজুর্গকে দাওয়াত দেন। যারা সকলেই বলেন: ‘‘নিশ্চয় আমি যালিম বা অপরাধী’’। আর যার অপরাধে আল্লাহ তাকে বিপদ দিয়েছেন তিনি কিছুই বলেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, দাওয়াতকৃত আলিমগণ প্রত্যেকেই যালিম বা অপরাধী, শুধু দাওয়াতকারী বা বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিই নিরপরাধ! মহান আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা অনুধাবনের তাওফীক প্রদান করুন।
[2] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/২৭২; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়ায়িদ ১০/১২০; আলবানী, যায়ীফুত তারগীব ১/২৪৩, ২৮৬; সাহীহাহ ৪/১০২ (নং ১৫২৮ প্রসঙ্গে)
[3] সুনানুত তিরমিযী ৫/৫৬০, নং ৩৫৬৩, মুসতাদরাক হাকিম ১/৭২১।
[4] সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ৩০৫, নং ৭৩৪, মুল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ: ১৬৫, নং ৬৩৩, ৬৩৪, আলবানী, যায়ীফুল জামিয়িস সাগীর, পৃ: ৫৭৬, নং ৩৯৫১।
[5] দেখুন, লেখকের অন্য বই: রাহে বেলায়াত, পৃ. ৮১-৯৩, ১৩৩-১৩৪।