(ক) সহীহ হাদীসের আলোকে শাওয়াল মাস
শাওয়াল মাস হজ্জের মাসগুলোর প্রথম মাস। এ মাস থেকে হজ্জের কার্যক্রম শুরু হয়। এছাড়া সহীহ হাদীস দ্বারা এ মাসের একটি ফযীলত প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمَّ أَتْبَعَهُ سِتًّا مِنْ شَوَّالٍ كَانَ كَصِيَامِ الدَّهْرِ
‘‘যে ব্যক্তি রামাদান মাসের সিয়াম পালন করবে। এরপর সে শাওয়াল মাসে ৬টি সিয়াম পালন করবে, তার সারা বছর সিয়াম পালনের মত হবে।’’[1]
কোনো কোনো যয়ীফ হাদীসে পুরো শাওয়াল মাস সিয়াম পালনের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। একটি যয়ীফ হাদীসে বলা হয়েছে: ‘‘যে ব্যক্তি রামাদান এবং শাওয়াল মাস এবং (সপ্তাহে) বুধবার ও বৃহস্পতিবার সিয়াম পালন করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’[2]
এ ছাড়া শাওয়াল মাসের আর কোনো ফযীলত প্রমাণিত নয়। মুমিন এ মাসে তার তাহাজ্জুদ, চাশত, যিক্র ওযীফা ইত্যাদি সাধারণ ইবাদত নিয়মিত পালন করবেন। সাপ্তাহিক ও মাসিক নফল সিয়াম নিয়মিত পালন করবেন। অতিরিক্ত এই ছয়টি সিয়াম পালন করবেন। এছাড়া এ মাসের জন্য বিশেষ সালাত, সিয়াম, যিক্র, দোয়া, দান বা অন্য কোনো নেক আমল, অথবা এ মাসে কোনো নেক আমল করলে বিশেষ সাওয়াবের বিষয়ে যা কিছু প্রচলিত বা কথিত সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। এগুলোর অনেক কথা সাধারণভাবে শাওয়াল মাসের ফযীলত ও ছয় রোযার বিষয়ে বানানো হয়েছে। আর কিছু কথা শাওয়াল মাসের প্রথম দিন বা ঈদুল ফিতরের দিনের বিশেষ নামায বা আমলের বিষয়ে বানানো হয়েছে।
(খ) শাওয়াল মাস বিষয়ক কিছু জাল হাদীস
১. ৬ রোযা ও অন্যান্য ফযীলত
এ সকল বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছে: ‘‘হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফরমাইয়াছেন : যেই ব্যক্তি শাওয়াল মাসে নিজেকে গুনাহের কার্য হইতে বিরত রাখিতে সক্ষম হইবে আল্লাহ তা‘আলা তাহাকে বেহেশতের মধ্যে মনোরম বালাখানা দান করিবেন। অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করিয়াছেন, যেই ব্যক্তি শাওয়াল মাসের প্রথম রাত্রিতে বা দিনে দুই রাকয়াতের নিয়তে চার রাকয়াত নামায আদায় করিবে এবং উহার প্রতি রাকয়াতে সূরা ফাতিহার পর ২১ বার করিয়া সূরা ইখলাছ পাঠ করিবে; করুণাময় আল্লাহ তা‘আলা তাহার জন্য জাহান্নামের ৭টি দরজা বন্ধ করিয়া দিবেন এবং জান্নাতের ৮টি দরজা উন্মুক্ত করিয়া দিবেন। আর মৃত্যুর পূর্বে সে তাহার বেহেশতের নির্দিষ্ট স্থান দর্শন করিয়া লইবে।... অন্য আর এক হাদীসে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফরমাইয়াছেন, যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসে মৃত্যুবরণ করিবে সে ব্যক্তি শহীদানের মর্যাদায় ভূষিত হইবে।...’’[3]
এ সবই হাদীসের নামে কথিত বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা।
শাওয়াল মাসে ৬টি সিয়ামের ফযীলত সহীহ হাদীসের আলোকে আমরা জেনেছি। এ বিষয়ে অতিরঞ্জিত অনেক জাল কথাও প্রচলন করা হয়েছে। যেমন: ‘‘হযরত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফরমাইয়াছেন, যেই ব্যক্তি শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখিবে, আল্লাহ তায়ালা তাহাকে শাস্তির শৃংখল ও কঠোর জিঞ্জিরের আবেষ্টনী হইতে নাজাত দিবেন.. অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে, হযরত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফরমাইয়াছেন, যেই ব্যক্তি শাউয়াল মাসের ৬টি রোজা রাখিবে, তাহার আমলনামায় প্রত্যেক রোজার পরিবর্তে সহস্র রোজার সাওয়াব লিখা হইবে।’’... ‘‘রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ...যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসে রোজা রাখেন আল্লাহ পাক তার জন্য দোজখের আগুন হারাম করে দেন।...যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখে, আল্লা-তায়ালা তার আমল নামায় সমস্ত মুহাম্মদী নেককার লোকের সাওয়াব লিখেন এবং সে হযরত সিদ্দিক আকবার (রা)-এর সঙ্গে বেহেস্তে স্থান পাবে।...যে ব্যক্তি শাওয়াল মাসে রোজা রাখে আল্লাহ তায়ালা তাকে লাল-ইয়াকুত পাথরের বাড়ী দান করবেন এবং প্রত্যেক বাড়ীর সম্মুখে দুধ ও মধুর নহর প্রবাহিত হতে থাকবে। ফেরেশতারা তাকে আসমান হতে ডেকে বলবেন, হে আল্লাহর খাস-বান্দা, আল্লাহ তোমাকে মাফ করে দিয়েছেন। শাওয়াল মাসে লূতের (আঃ) কওম ধ্বংস হয়েছিল, নূহের (আঃ)কওম ডুবেছিল, হুদের (আঃ) কওম ধ্বংস হয়েছিল....’’[4]
এরূপ অসংখ্য মিথ্যা কথা দুঃসাহসের সাথে নিঃসঙ্কোচে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বলা হয়েছে। আমাদের সম্মানিত লেখকগণ একটুও চিন্তা ও যাচাই না করেই সেগুলো তাঁদের পুস্তকে লিখেন। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন।
২. ঈদুল ফিতরের দিনের বা রাতের বিশেষ সালাত
শাওয়ালের ১ম তারিখ ঈদুল ফিতর। একাধিক যয়ীফ হাদীসে ঈদুল ফিতরের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকতে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু ইবাদতের কোনো নির্ধারিত পদ্ধতি, রাক‘আত, সূরা ইত্যাদি বলা হয় নি। ঈদের দিনে সালাতুল ঈদ ছাড়া অন্য কোনো বিশেষ নফল সালাতের কোনো নির্দেশনা কোনো সহীহ হাদীসে নেই।
অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় এ বিষয়েও জালিয়াতগণ এ বিষয়ে কিছু হাদীস রচনা করেছে। শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখের দিনের বা রাতের ৪ রাক‘আত সালাত বিষয়ক একটি জাল হাদীস পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছি। এ বিষয়ক আরো একটি প্রচলিত জাল হাদীস উল্লেখ করছি: ‘‘যিনি আমাকে নবীরূপে প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ, জিবরাঈল আমাকে ঈসরাফীলের মাধ্যমে আল্লাহর কাছ থেকে বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতরের রাত্রে ১০০ রাক‘আত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাক‘আতে ১ বার সূরা ফাতিহা এবং ১১ বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে, এরপর রুকতে এবং সাজদায় ... অমুক দোয়া ১০ বার পাঠ করবে, এরপর সালাত শেষে ১০০ বার ইসতিগফার পাঠ করবে। এরপর সাজদায় যেয়ে বলবে....। যদি কেউ এইরূপ করে তাহলে সাজদা থেকে ওঠার আগেই তার পাপ ক্ষমা করা হবে, রামাদানের সিয়াম কবুল করা হবে.... ইত্যাদি ইত্যাদি।’’[5]
৩. ঈদুল ফিতরের পরে ৪ রাক‘আত সালাত
ঈদুল ফিতরের দিনে কোনো বিশেষ সালাতের বিশেষ সাওয়াব বা বৈশিষ্ট্য নেই। কিন্তু জালিয়াতগণ সালাতুল ঈদ আদায়ের পরে ৪ রাক‘আত সালাতের বিশেষ ফযীলতের কাল্পনিক কাহিনী বানিয়েছে। যেমন: ‘‘যদি কেউ সালাতুল ঈদ আদায় করার পরে ৪ রাক‘আত সালাত আদায় করে, প্রত্যেক রাকা‘আতে অমুক অমুক সূরা পাঠ করে, তবে সে যেন আল্লাহর নাযিল করা সকল কিতাব পাঠ করল, সকল এতিমকে পেটভরে খাওয়াল, তেল মাখালো, পরিষ্কার করল। তার ৫০ বছরের পাপ ক্ষমা করা হবে, তাকে এত এত পুরস্কার দেওয়া হবে...।’’[6]
[2] আহমাদ, আল-মুসনদা ৩/৪১৬; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/১৯০; ইবনু রাজাব, লাতাইফ ২/৩৬০-৩৬১।
[3] মুফতী ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, ৩৯; অধ্যাপিকা দুলাল, নেক কানুন, ৩১৯-৩২০।
[4] মুফতী ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, ৪২-৪৩; অধ্যাপিকা দুলাল, নেক কানুন, ৩২০।
[5] ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূ‘আত ২/৫২; যাহাবী, তারতীবুল মাউদূ‘আত, পৃ. ১৬৩; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৬০-৬১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৯৪; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৭৭; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ৪৭; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, ৮৬।
[6] ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূ‘আত ২/৫৩-৫৪; যাহাবী, তারতীবুল মাউদূ‘আত, পৃ. ১৬৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৬১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৯৫; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৭৭; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ৪৭; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, ৮৭।