আমাদের সমাজে ধার্মিক মানুষদের মধ্যে বহুল প্রচলিত পরিভাষার মধ্যে রয়েছে, গওস, কুতুব, আবদাল, আওতাদ, আকতাব ইত্যাদি শব্দ। আমরা সাধারণভাবে আওলিয়ায়ে কেরামকে বুঝাতে এ সকল শব্দ ব্যবহার করি। এছাড়া এ সকল পরিভাষার বিশেষ অর্থ ও বিশেষ বিশেষ পদবীর কথাও প্রচলিত। আরো প্রচলিত আছে যে, দুনিয়াতে এতজন আওতাদ, এতজন আবদাল, এতজন কুতুব, এতজন গাওস ইত্যাদি সর্বদা বিরাজমান...। এগুলো সবই ভিত্তিহীন কথা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) নামে বানোয়াট কথা। একমাত্র ‘আবদাল’ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি।
‘গওস’ কুতুব, আওতাদ... ইত্যাদি সকল পরিভাষা, পদ-পদবী ও সংখ্যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এ সকল বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কেনো কিছুই সহীহ বা গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি। শুধুমাত্র ‘আবদাল’ শব্দটি একাধিক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
‘আবদাল’ শব্দটি ‘বদল’ শব্দের বহুবচন। আবদাল অর্থ বদলগণ। একাধিক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, কিছু সংখ্যক নেককার মানুষ আছেন যাদের কেউ মৃত্যু বরণ করলে তার ‘বদলে’ অন্যকে আল্লাহ তার স্থলাভিষিক্ত করেন। এজন্য তাদেরকে ‘আবদাল’ বা ‘বদলগণ’ বলা হয়। এ বিষয়ে বর্ণিত প্রতিটি হাদীসেরই সনদ দুর্বল। কোনো সনদে মিথ্যাবাদী রাবী রয়েছে। কোনো সনদ বিচ্ছিন্ন। কোনো সনদে দুর্বল রাবী রয়েছেন। এজন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস ‘আবদাল’ বিষয়ক সকল হাদীসকে এককথায় ও ঢালাওভাবে মুনকার, বাতিল বা মাউযূ বলে উল্লেখ করেছেন।
অন্য অনেক মুহাদ্দিস একাধিক সনদের কারণে এগুলোকে সামগ্রিকভাবে গ্রহণযোগ্য বলেছেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন মুহাদ্দিসের বিস্তারিত আলোচনা ও বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হাদীসগুলোর পর্যালোচনা করে আমার কাছে দ্বিতীয় মতটিই সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। দুটি বিষয় ‘আবদাল’ শব্দটির ভিত্তি প্রমাণ করে: (ক) এ বিষয়ক বিভিন্ন হাদীস এবং (খ) দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর অনেক তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ী, মুহাদ্দিস, ইমাম ও ফকীহ এ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এতে বুঝা যায় যে, এ শব্দটির ভিত্তি ও উৎস রয়েছে।
অন্যান্য সকল বিষয়ের মত ‘আবদাল’ বিষয়েও অনেক মিথ্যা কথা ‘হাদীস’ বলে প্রচারিত হয়েছে। এগুলোর পাশাপাশি এ বিষয়ক নিম্নের তিনটি হাদীসকে কোনো কোনো মুহাদ্দিস মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন।
প্রথম হাদীস: শুরাইহ ইবনু উবাইদ (১০১হি) নামক একজন তাবিয়ী বলেন, আলী (রা)-এর সাথে যখন মুয়াবিয়া (রা)-এর যুদ্ধ চলছিল, তখন আলীর (রা) অনুসারী ইরাকবাসীগণ বলেন, হে আমীরুল মুমিনীন, আপনি মুয়াবিয়ার অনুসারী সিরিয়াবাসীগণের জন্য লানত বা অভিশাপ করুন। তখন তিনি বলেন, না। কারণ আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি:
الأَبْدَالُ (البْدَلاءُ) (يَكُونُونَ) بِالشَّامِ، وَهُمْ أَرْبَعُونَ رَجُلاً، كُلَّمَا مَاتَ رَجُلٌ أَبْدَلَ اللَّهُ مَكَانَهُ رَجُلاً يُسْقَى بِهِمُ الْغَيْثُ، وَيُنْتَصَرُ بِهِمْ عَلَى الأَعْدَاءِ، وَيُصْرَفُ عَنْ أَهْلِ الشَّامِ بِهِمُ الْعَذَابُ.
‘‘আবদাল (বদল-গণ) সিরিয়ায় থাকবেন। তাঁরা ৪০ ব্যক্তি। যখনই তাঁদের কেউ মৃত্যু বরণ করেন তখনই আল্লাহ তাঁর বদলে অন্য ব্যক্তিকে স্থলাভিষিক্ত করেন। তাদের কারণে আল্লাহ বৃষ্টি প্রদান করেন। তাঁদের কারণে শত্রুর উপর বিজয় দান করেন। তাদের কারণে সিরিয়ার অধিবাসীদের থেকে তিনি আযাব দূরীভুত করবেন।’’
এ হাদীসের সনদের সকল রাবীই নির্ভরযোগ্য এবং বুখারী ও মুসলিম কর্তৃক গৃহীত। শুধুমাত্র শুরাইহ ইবনু উবাইদ ব্যতিক্রম। তাঁর হাদীস বুখারী ও মুসলিমে নেই। তবে তিনিও বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য রাবী হিসাবে স্বীকৃত। কাজেই হাদীসটির সনদ সহীহ। কোনো কোনা মুহাদ্দিস সনদটি বিচ্ছিন্ন বলে মনে করেছেন। তাঁরা বলেন, শুরাইহ বলেন নি যে, আলীর মুখ থেকে তিনি কথাটি শুনেছেন। বরং তিনি শুধু ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন এতে মনে হয়, শুরাইহ সম্ভবত অন্য কারো মাধ্যমে ঘটনাটি শুনেছেন, যার নাম তিনি উল্লেখ করেন নি। তবে বিষয়টি নিশ্চিত নয়। সিফ্ফীনের যুদ্ধের সময় শুরাইহ কমবেশি ৩০ বছর বয়সী ছিলেন। কাজেই তাঁর পক্ষে আলী (রা) থেকে হাদীস শ্রবণ করা বা এ ঘটনার সময় উপস্থিত থাকা অসম্ভব ছিল না। এজন্য বাহ্যত হাদীসটির সনদ অবিচ্ছিন্ন বলেই মনে হয়।
যিয়া মাকদিসী উল্লেখ করেছেন যে, অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী সনদে এ হাদীসটি আলীর (রা) নিজের বক্তব্য হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। কাজেই এ হাদীসটি আলীর (রা) বক্তব্য বা মাউকূফ হাদীস হিসেবে সহীহ।[1]
দ্বিতীয় হাদীস: তাবিয়ী আব্দুল ওয়াহিদ ইবনু কাইস বলেন, উবাদা ইবনুস সামিত (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
الأَبْدَالُ فِى هَذِهِ الأُمَّةِ ثَلاثُونَ مِثْلُ إِبْرَاهِيمَ خَلِيلِ الرَّحْمَنِ، عَزَّ وَجَلَّ، كُلَّمَا مَاتَ رَجُلٌ أَبْدَلَ اللَّهُ، تَعَالَى، مَكَانَهُ رَجُلاً.
‘‘এ উম্মাতের মধ্যে ‘বদল’গণ (আবদাল) ত্রিশ ব্যক্তি। এরা দয়ালু আল্লাহর খলীল ইবরাহীম (আঃ)-এর মত। যখন এদের কেউ মৃত্যু বরণ করেন, তখন আল্লাহ তা’লা তার বদলে অন্য ব্যক্তিকে স্থলাভিষিক্ত করেন।’’
এ হাদীসটির বর্ণনাকারী আব্দুল ওয়াহিদ ইবনু কাইসের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের মতভেদ আছে। ইজলী ও আবূ যুর‘আ তাঁকে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে দুর্বল বলে গণ্য করেছেন। ইমাম আহমাদ হাদীসটিকে মুনকার, অর্থাৎ আপত্তিকর বা অত্যন্ত দুর্বল বলেছেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে হাসান পর্যায়ের বলে গণ্য করেছেন।[2]
তৃতীয় হাদীস: আনাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
لَنْ تَخْلُوَ الأَرْضُ مِنْ أَرْبَعِينَ رَجُلاً مِثْلَ خَلِيلِ الرَّحْمنِ فَبِهِمْ تُسْقَوْنَ وَبِهِمْ تُنْصَرُونَ مَا مَاتَ مِنْهُمْ أَحَدٌ إِلاَّ أَبْدَلَ الله مَكانَهُ آخَرَ
‘‘যমীন কখনো ৪০ ব্যক্তি থেকে শূন্য হবে না, যাঁরা দয়ালু আল্লাহর খলীল ইবরাহীমের মত হবেন। তাঁদের কারণেই তোমরা বৃষ্টিপ্রাপ্ত হও, এবং তাঁদের কারণেই তোমরা বিজয় লাভ কর। তাঁদের মধ্য থেকে কেউ মৃত্যু বরণ করলে আল্লাহ তাঁর বদলে অন্য ব্যক্তিকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন।’’
হাদীসটি তাবারানী সংকলন করেছেন। সনদের একাধিক বর্ণনাকারীর গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে আপত্তি আছে। এজন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে দুর্বল বলে গণ্য করেছেন। তবে আল্লামা হাইসামী হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলে গণ্য করেছেন।[3]
উপরের তিনটি হাদীস ছাড়াও ‘আবদাল’ বিষয়ে আরো কয়েকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। প্রতিটি হাদীস পৃথকভাবে যয়ীফ বা অত্যন্ত যয়ীফ হলেও সামগ্রিকভাবে আবদালের অস্তিত্ব প্রমাণিত। স্বভাবতই এ প্রমাণিত বিষয়কে কেন্দ্র করে অনেক জাল ও বানোয়াট কথাও বলা হয়েছে। আবদাল বা বদলগণের দায়িত্ব, পদমর্যাদা ইত্যাদি সম্পর্কে অনেক বানোয়াট কথা রয়েছে।
‘আবদাল’ বা বদলগণের নিচের পদে ও উপরে অনেক বানোয়াট পদ-পদবীর নাম বলা হয়েছে। যেমন ৩০০ জন নকীব/ নুকাবা, ৭০ জন নাজীব/ নুজাবা, ৪০ জন বদল/আবদাল, ৪ জন আমীদ/উমুদ, ১ জন কুতুব বা গাউস... ইত্যাদি। ‘আবদাল’ ছাড়া বাকী সকল নাম বা পদ-পদবী ও সংখ্যা সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)- থেকে বর্ণিত কেনো একটি সহীহ বা যয়ীফ সনদেও কুতুব, গাওস, নজীব, নকীব ইত্যাদির কথা কোনোভাবে বর্ণিত হয় নি। এছাড়া এদের দেশ, পদ মর্যাদা, দায়িত্ব, কর্ম ইত্যাদি যা কিছু বলা হয়েছে সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। এ সকল বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সহীহ বা যয়ীফ সনদে কিছুই বর্ণিত হয় নি, যদিও গত কয়েক শতাব্দীতে কোনো কোনো আলিম এ বিষয়ে অনেক কিছু লিখেছেন।[4]
এখানে এ সম্পর্কিত দুটি বিষয়ের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি: (১) আবদালের পরিচয় ও (২) আবদালের দায়িত্ব।
ক. আবদালের পরিচয়
আবদালের পরিচয় সম্পর্কে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। আবদাল বা বদলগণ নিজেদেরকে বদল বলে চিনতে বা বুঝতে পারেন বলেও কোনো হাদীসে কোনোভাবে উল্লেখ করা হয় নি। তবে বাহ্যিক নেক আমল দেখে দ্বিতীয় শতক থেকে নেককার মানুষকে আবদালের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হতো। কোনো কোনো যয়ীফ হাদীসে এ বিষক কিছু বাহ্যিক আমলের কথা বলা হয়েছে। একটি দুর্বল হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
إِنَّهُمْ لَمْ يُدْرِكُوْهَا بِصَلاَةٍ وَلاَ بِصَوْمٍ وَلاَ صَدَقَةٍ (بِكَثْرَةِ صَوْمٍ وَلاَ صَلاَةٍ)... وَلَكِنْ ... بِالسَّخَاءِ وَالنَّصِيْحَةِ لِلْمُسْلِمِيْنَ (سَلاَمَةِ الصُّدُوْرِ وَسَخَاوَةِ الأَنْفُسِ وَالرّحْمَةِ لِجَمِيْعِ الْمُسْلِمِيْنَ
‘‘তাঁরা এ মর্যাদা বেশি বেশি (নফল) সালাত, সিয়াম বা দান-সাদকা করে লাভ করেন নি.. বরং বদান্যতা, হৃদয়ের প্রশস্ততা ও সকল মুসলিমের প্রতি দয়া, ভালবাসা ও নসীহতের দ্বারা তা লাভ করেছেন।’’ হাদীসটির সনদ দুর্বল।[5]
বিভিন্ন যয়ীফ হাদীস এবং তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ীগণের বক্তব্যের আলোকে আল্লামা সাখাবী, সুয়ূতী, আজলূনী প্রমুখ আলিম বদলগণের কিছু আলামত উল্লেখ করেছেন: অন্তরের প্রশস্ততা, বদান্যতা, ভাগ্যের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, হারাম থেকে বিরত থাকা, আল্লাহর দীনের জন্য ক্রোধান্বিত হওয়া, কাউকে আঘাত না করা, কেউ ক্ষতি করলে তার উপকার করা, কেউ কষ্ট দিলে তাকে ক্ষমা করা, উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য প্রতিদিন দোয়া করা, নিঃসন্তান হওয়া, কাউকে অভিশাপ না দেয়া... ইত্যাদি।[6]
খ. আবদালের দায়িত্ব
আমাদের মধ্যে আরো প্রচলিত যে, গাওসের অমুক দায়িত্ব, কুতুবের অমুক দায়িত্ব, আবদালের অমুক দায়িত্ব... ইত্যাদি। এগুলোও ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। অগণিত বুযুর্গ ও নেককার মানুষ সরল বিশ্বাসে এ সকল ভিত্তিহীন শোনা কথা সঠিক মনে করেন এবং বলেন। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি যে, আবদাল ব্যতীত বাকি সকল পদ-পদবী ও পরিভাষাই ভিত্তিহীন। আর আবদালের ক্ষেত্রে কোনো কোনো হাদীসে বলা হয়েছে ‘তাঁদের কারণে বা তাঁদের জন্য আল্লাহ বৃষ্টি দেন ইত্যাদি।’’ এ কথাটির দুটি অর্থ রয়েছে:
প্রথম অর্থ: তাদের নেক আমলের বরকত লাভ
নেককার মানুষের নেক আমলের কারণে আল্লাহ জাগতিক বরকত প্রদান করেন। সহীহ হাদীসে আনাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে দু ভাই ছিলেন। এক ভাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে আগমন করতেন এবং অন্য ভাই অর্থোপার্জনের কর্মে নিয়োজিত থাকতেন। উপার্জনকারী ভাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে আগমন করে তার অন্য ভাই সম্পর্কে অভিযোগ করেন যে, সে তাকে কর্মে সাহায্য করে না। তখন তিনি বলেন:
لَعَلَّكَ تُرْزَقُ بِهِ
‘‘হতে পারে যে, তুমি তার কারণে রিয্ক প্রাপ্ত হচ্ছ।’’[7]
দ্বিতীয় অর্থ: তাঁদের দোয়া লাভ
দ্বিতীয় অর্থ হলো, তাদের দোয়ার কারণে আল্লাহ রহমত ও বরকত প্রদান করবেন। আল্লাহর তাঁর প্রিয় নেককার বান্দাদের দোয়া কবুল করেন বলে বিভিন্ন হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। আবদাল বিষয়ক একাধিক যয়ীফ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এদের দোয়ার বরকত মানুষ লাভ করবে। নেককার মানুষদের প্রকৃতিই হলো যে, তাঁরা সদা-সর্বদা সকল মুসলিমের ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। এ দোয়ার বরকত মুসলিম উম্মাহ লাভ করে।
এখানে তিনটি ভুল ও বিকৃত অর্থ সমাজে প্রচলিত:
প্রথম ভুল: দোয়া কবুলের বাধ্যবাধকতা
অনেকে ধারণা করেন ‘আবদাল’ বা এ প্রকারের কোনো নেককার মানুষ দোয়া করলে আল্লাহ শুনবেনই। কাজেই আল্লাহ খুশি থাকুন আর বেজার থাকুন, আমি কোনো প্রকারে অমুক ব্যক্তির কাছে থেকে দোয়া আদায় করে নিতে পারলেই আমার উদ্দেশ্য সফল হয়ে যাবে। এই ধারণা শুধু ভুলই নয়, উপরন্তু ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক ও শির্কমূলক।
প্রথম, কে বদল বা আবদাল তা আমরা কেউই জানি না। এ বিষয়ে সবই ধারণা ও কল্পনা। দ্বিতীয়ত, কারো দোয়া কবুল করা বা না করা একান্তই আল্লাহর ইচ্ছা। কুরআন কারীম থেকে আমরা জানতে পারি আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম হাবীব ও খালীল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ﷺ) মনের অব্যক্ত আশাটিও পূরণ করেছেন। আবার তিনি তাঁর মুখের দোয়াও কবুল করেন নি। তিনি একজন মুনাফিকের জন্য ক্ষমার দোয়া করেছিলেন, কিন্তু আল্লাহ কবুল করেন নি। উপরন্তু বলেছেন, ৭০ বার এভাবে দোয়া করলেও তা কবুল হবে না। একজন কারামতপ্রাপ্ত-ওলী, আল্লাহর মর্যির বাইরে দোয়া করেছিলেন বলে তাকে কঠিনভাবে শাস্তি দেওয়া হয়।[8]
দ্বিতীয় ভুল: দোয়া কবুলের মাধ্যম বা ওসীলা
‘তাঁর কারণে বা মাধ্যমে তুমি রিযিক পাও’, ‘তাদের কারণে বা মাধ্যমে তোমরা বৃষ্টি পাও...’ ইত্যাদি কথার একটি বিকৃত ব্যাখ্যা হলো, এ ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণের দোয়া বা সুপারিশ ছাড়া বোধহয় আল্লাহ এগুলো দিবেন না। এরা বোধহয় রাজা-বাদশাহের মন্ত্রীদের মত, তাঁদের সুপারিশ ছাড়া চলবে না। পৃথীবিতে রাজা, শাসক ও মন্ত্রীদের কাছে কোনো আবেদন পেশ করতে হলে তাদের একান্ত আপনজনদের মাধ্যমে তা পেশ করলে তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে আল্লাহর কাছে সরাসরি চাওয়ার চেয়ে এদের মাধ্যমে চাওয়া হলে কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এ ধারণাগুলো সুস্পষ্ট শির্ক। পৃথিবীর বাদশা আমাকে চেনেন না, আমার সততা ও আন্তরিকতার কথা তাঁর জানা নেই। কিন্তু তাঁর কোনো প্রিয়পাত্র হয়ত আমাকে চেনেন। তার সুপারিশ পেলে বাদশাহর মনে নিশ্চয়তা আসবে যে, আমি তাঁর দয়া পাওয়ার উপযুক্ত মানুষ। আল্লাহ তা’আলার বিষয় কি তদ্রূপ? তিনি কি আমাকে চেনেন-না? আল্লাহর কোনো ওলী, কোনো প্রিয় বান্দা কি আমাকে আল্লাহর চেয়ে বেশি চেনেন? না বেশি ভালবাসেন? অথবা বেশি করুণা করতে চান? এছাড়া পৃথিবীর বাদশাহ বা বিচারকের মানবীয় দুর্বলতার কারণে পক্ষপাতিত্বের বা ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভয় আছে, সুপারিশের মাধ্যমে যা দূরীভুত হয়। আল্লাহর ক্ষেত্রে কি এমন কোনো ভয় আছে?
কে আল্লাহর কাছে মাকবূল ও প্রিয় তা কেউই বলতে পারে না। আমরা আগেই দেখেছি, নেককার মানুষদের প্রকৃতিই হলো যে, তাঁরা সদা সর্বদা সকল মুসলিমের ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। এ দোয়ার বরকত মুসলিমগণ লাভ করেন। এছাড়া কোনো মুসলিমকে ব্যক্তিগতভাবে, অথবা মুসলিম সমাজকে সমষ্টিগতভাবে কোনো নির্ধারিত নেককার ব্যক্তির কাছে যেয়ে দোয়া চাইতে হবে, এ কথা কখনোই এ সকল হাদীসের নির্দেশনা নয়। ইসলামের বরকতময় যুগগুলোতে সাহাবী, তাবিয়ী,তাবি-তাবিয়ী বা তৎকালীণ মানুষেরা কখনোই এরূপ করেন নি।
তৃতীয় ভুল: দায়িত্ব বা ক্ষমতা
অনেকে মনে করেন, আবদাল বা আউলিয়ায়ে কেরামকে আল্লাহ বৃষ্টি, বিজয় ইত্যাদির দায়িত্ব ও ক্ষমতা দিয়েছেন। এরা নিজেদের সুবিধামত তা প্রদান করেন। এ ধারণাটি হিন্দু ও মুশরিকদের দেব-দেবতায় বিশ্বাসেরই মত শিরক। এ বিশ্ব পরিচালনায় আল্লাহ কোনো জীবিত বা মৃত কোনো নবী, ওলী বা কোনো মানুষকেই কোনো দায়িত্ব বা অধিকার প্রদান করেন নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় বা মনে করা হয় সবই জঘন্য মিথ্যা কথা ও কুরআন ও হাদীসের অগণিত সুস্পষ্ট কথার বিপরীত কথা। আল্লাহ ফিরিশতাগণকে বিশ্ব পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দায়িত্ব দিয়েছেন, কিন্তু কোনো ক্ষমতা দেন নি। কোনো জীবিত বা মৃত মানুষকে কোনোরূপ কোনো দায়িত্ব প্রদান করেন নি।
মুসলিম সমাজের অনেকেই সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনভাবে মনের আন্দাযে ধারণা করেন যে, অমুক ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয় বান্দা। এরপর মনের আন্দাযে ধারণা করেন যে, আল্লাহ তাকে হয়ত কোনো ক্ষমতা দিয়েছেন। এরপর মনগড়াভাবে এদের কাছে চাইতে থাকেন। আর এ সকল জঘন্য শির্ককে সমর্থন করার জন্য কোনো কোনো জ্ঞানপাপী উপরের ‘আবাদল’ বিষয়ক হাদীসগুলো বিকৃত করে ব্যবহার করেন।
[2] আহমাদ, আল-মুসনাদ ৫/৩২২; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৬২-৬৪; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৩২-৩৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৩৩০-৩৩২; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৩০৬-৩০৭; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১৯৩-১৯৫।
[3] তাবারানী, আল-মু’জামুল আউসাত ৪/২৪৭; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৬৩; আলবানী, যায়ীফাহ ৯/৩২৫-৩২৭; যায়ীফুল জামি, পৃ. ৬৮৯।
[4] হাকিম তিরমিযী, নাওয়াদিরুল উসূল ১/২৬১-২৬৩; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদু‘আত ২/৩৩৫-৩৩৭; ইবনুল কাইয়িম, আল-মানার, পৃ. ১৩৬; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/৬৪; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৬১-৬৩; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৪/১৫০; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৩২-৩৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৩৩০-৩৩২; আল-হাবী ২/২৯১-৩০৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৩০৬-৩০৭; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১৯৩-১৯৫; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ৪৮, ৩৫৪; মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইয়ামানী, আন-নাওয়াফিহ, পৃ. ১৫; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ৬৩; আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ২০৩, ৩৩৪, ৩৬৭; যায়ীফাহ ২/৩৩৯-৩৪১, ৩/৬৬৬-৬৭১, ৫/৫১৯-৫২১।
[5] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৬৩; আজলূনী, কাশফুল খাফা ১/২৪-২৫।
[6] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদু‘আত ২/৩৩৫-৩৩৭; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৩২-৩৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৩৩০-৩৩২; আল-হাবী ২/২৯১-৩০৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৩০৬-৩০৭; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১৯৩-১৯৫।
[7] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৫৭৪; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/১৭২; মাকদিসী, আল-মুখতারাহ ৫/৪৯-৫০।
[8] সূরা : ৯ তাওবা, ৮০ আয়াত; সূরা : ৭ আ’রাফ, ১৭৫-১৭৭। দেখুন, ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/২৬৫-২৬৯।