ইসলামের ইতিহাসের প্রথম অর্ধ শতকের মধ্যে ইসলামী বিজয়ের মাধ্যমে এশিয়া ও আফ্রিকার বিস্থির্ণ এলাকা ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে প্রবেশ করে। এসব দেশের অনেক অমুসলিম নাগরিক স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেন। অনেকে তাদের পূর্ব ধর্ম অনুসরণ করতে থাকেন। ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাঁদের নিরাপত্তা প্রদান করা হয়। পক্ষান্তরে কিছু মানুষ তাদের পূর্বের ধর্ম ও মতবাদের প্রতি আনুগত্য ও ভালবাসা সত্ত্বেও প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণের কথা বলেন। তারা সমাজে মুসলিম বলে গণ্য হলেও প্রকৃতপক্ষে মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ানো ও তথ্য সন্ত্রাসের মাধ্যমে মুসলিমগণের বিশ্বাস ও কর্ম নষ্ট করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ শ্রেণীর মানুষদেরকে ‘যিনদীক’ বলা হতো। এরা তাদের ঘৃণ্য উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য অগণিত মিথ্যা কথা সমাজে হাদীস হিসাবে প্রচার করতো। আমার দেখেছি যে, আব্দুল্লাহ ইবনু সাবার নেতৃত্বে এ শ্রেণির মানুষেরাই প্রথম বানোয়াট হাদীস প্রচার শুরু করে।
এসকল ভন্ড যিনদীক কখনো আলীর (রা) ভক্ত সেজে তাঁর ও তাঁর বংশের পক্ষে বানোয়াট হাদীস প্রচার করতো। কখনো বা সূফী-দরবেশ সেজে মানুষদের ধোঁকা দিত এবং পারসিক বা ইহুদী-খৃস্টানদের বৈরাগ্য ও সন্ন্যাস-মার্কা দরবেশীর পক্ষে হাদীস বানাতো। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসলামী বিশ্বাস নষ্ট করা ও তাকে হাস্যাষ্পদ ও অযৌক্তিক হিসাবে পেশ করা।
এখানে লক্ষণীয় যে, তারা সনদসহ হাদীস বানাতো। তৎকালীন সময়ে সনদ ছাড়া হাদীস বলার কোনো উপায় ছিল না। তারা প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও নির্ভরযোগ্য রাবীগণের নাম জানতো। বিভিন্ন সহীহ হাদীসের সনদ তাদের মুখস্থ ছিল। এসকল সনদের নামে তারা হাদীস বানাতো।
এগুলো দিয়ে সাধারণ মানুষদের ধোঁকা দেয়া খুবই সহজ ছিল। তবে ‘নাকিদ’ মুহাদ্দিসদের কাছে এ ধোঁকার কোনো কার্যকরিতা ছিল না। তাঁরা উপরে বর্ণিত নিরীক্ষার মাধ্যমে এদের জালিয়াতি ধরে ফেলতেন। যেমন একজন বলল যে, আমাকে ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ আল-কাত্তান বলেছেন, তিনি সুফিয়ান সাওরী থেকে, তিনি ইবনু সিরীন থেকে, তিনি আনাস ইবনু মালিক থেকে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে...। তখন তাঁরা উপরের পদ্ধতিতে সনদে বর্ণিত সকল রাবীর অন্যান্য ছাত্রদের বর্ণিত হাদীসের সাথে এর তুলনা করতেন। পাশাপাশি এ ব্যক্তির অন্যান্য বর্ণনা ও তার কর্ম বিচার করে অতি সহজেই জালিয়াতি ধরে ফেলতেন।
এদের বানানো একটি হাদীস দেখুন। মুহাম্মাদ ইবনু শুজা’ নামক একব্যক্তি বলছে, আমাকে হিববান ইবনু হিলাল, তিনি হাম্মাদ ইবনু সালামা থেকে, তিনি আবুল মাহযাম থেকে তিনি আবু হুরাইরা থেকে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের প্রভুর সৃষ্টি কী থেকে? তিনি বলেন: তিনি একটি ঘোড়া সৃষ্টি করেন, এরপর ঘোড়াটিকে দাবড়ান। ঘোড়াটির দেহ থেকে যে ঘাম নির্গত হয় সে ঘাম থেকে তিনি নিজেকে সৃষ্টি করেন।[1]
আমরা সুস্পষ্টত বুঝতে পারছি যে, মহান আল্লাহ সম্পর্কে মুসলিম বিশ্বাসকে হাস্যাষ্পদরূপে তুলে ধরা ও মুসলিম বিশ্বাসকে তামাশার বিষয়ে পরিণত করাই এরূপ জালিয়াতির উদ্দেশ্য।
এসকল জালিয়াত অনেক সময় তাদের জালিয়াতির কথা বলে বড়াই করত। আব্দুল করীম ইবনু আবীল আরজা দ্বিতীয় হিজরী শতকের এরূপ একজন জালিয়াত। ধর্মদ্রোহিতা, জালিয়াতি ইত্যাদি অপরাধে তার মৃত্যুদন্ড প্রদানের নিদের্শ দেন তৎকালীন প্রশাসক মুহাম্মাদ ইবনু সুলাইমান ইবনু আলী। শাস্তির পূর্বে সে বলে, আল্লাহর কসম, আমি চার হাজার বানোয়াট হাদীস জালিয়াতি করে মুসলমানদের মধ্যে প্রচার করে দিয়েছি।[2]
তৃতীয় আববাসীয় খলীফা মাহদী (শাসনকাল ১৫৮-১৬৯ হি) বলেন, আমার কাছে একজন যিনদীক স্বীকার করেছে যে, সে ৪০০ হাদীস বানোয়াট করেছে, যেগুলো এখন মানুষের মধ্যে প্রচারিত হচ্ছে।[3]
[2] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত ১/১৫।
[3] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত ১/১৫।