নাবী (সাঃ) এর মদীনায় হিজরতের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট

নাবী (ﷺ) এর মদ্বীনায় হিজরত এমন একটি ঘটনা, যার মাধ্যমে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর বন্ধু ও শত্রুদের মধ্যে পার্থক্য করেছেন এবং তাঁর একনিষ্ঠ বান্দাদেরকে পরীক্ষা করেছেন। এর মাধ্যমেই তাঁর দ্বীনকে সম্মানিত করেছেন এবং তাঁর রসূলকে সাহায্য করেছেন।

ইমাম যুহরী (রহঃ) বলেন- মুহাম্মাদ বিন সালেহ আসেম বিন উমার ও ইয়াযিদ বিন রুমান এবং অন্যান্য রাবীর মাধ্যমে আমাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, রসূল (ﷺ) মক্কাতে নবুওয়াতের প্রথম তিন বছর গোপনে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন। চতুর্থ বছর প্রকাশ্যে দাওয়াতের ঘোষণা দিয়েছেন। এরপর থেকে দশ বছর পর্যন্ত মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করেছেন। প্রতি বছর হজ্জের মৌসুমে হাজীদের তাঁবুতে গমণ করতেন। এমনি উকায, মাজিন্নাহ এবং যুল মাজাযের বাজারে ও বিভিন্ন মেলার মৌসুমেও লোকদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন এবং তাঁকে হেফাজত করার আবেদন করতেন। যাতে তিনি আল্লাহর পয়গাম নির্ভিগ্নে পৌঁছাতে পারেন। এর বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। কিন্তু তিনি কোন সাহায্যকারী ও সাড়াদানকারী পেলেন না। পরিশেষে তিনি প্রত্যেক কবীলার (গোত্রের) কাছে এবং তাদের বাসস্থানে যেতে লাগলেন। তিনি বলতেন- হে লোক সকল! তোমরা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ বল। তাহলেই তোমরা সফলতা অর্জন করতে পারবে এবং এর মাধ্যমে তোমরা আরবদের শাসক হতে পারবে। অনারবরা তোমাদের বশ্যতা স্বীকার করবে। আর মৃত্যুর পর তোমরা জান্নাতে রাজকীয় জীবন যাপন করতে পারবে। আবু লাহাব তাঁর পিছনে পিছনে চলত এবং লোকদেরকে বলতঃ তোমরা এর অনুসরণ করোনা। সে বেদ্বীন ও মিথ্যুক। ফলে লোকেরা মুহাম্মাদ (ﷺ) এর কথা কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করত এবং তাঁকে কষ্ট দিত। লোকেরা বলতঃ তোমার গোত্রের লোকেরাই তোমার সম্পর্কে অধিক অবগত। তারা তো তোমার অনুসরণ করেনি। তারপরও তিনি দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যেতেন এবং বলতেন- হে আল্লাহ্! তুমি চাইলে এরূপ হতনা। বর্ণনাকারী বলেন- তিনি যে সমস্ত গোত্রের কাছে নিজেকে পেশ করেছিলেন তার মধ্যে রয়েছে বনী আমের বিন সা’সাআ, বনী মুহারিব বিন খাসফাহ, বনী ফাযারাহ, বনী গাস্সান, বনী মুর্রা, বনী হানীফাহ, বনী সুলাইম, বনী আব্স, বনী নযর, বনী আল-বুকা, বনী কেনদাহ, বনী কালব, বনী হারিছ, বনী উযরাহ এবং বনী হাযারেমাহ অন্যতম। কিন্তু এ সমস্ত গোত্রের কেউ তাঁর আহবানে সাড়া দেয় নি।

তবে খুশীর সংবাদ হল, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর নাবীর জন্য যা আগে থেকেই তৈরী করে রেখেছিলেন, তা হচ্ছে মদ্বীনার আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় মদ্বীনার ইহুদী সম্প্রদায়ের নিকট থেকে দীর্ঘ দিন যাবৎ শুনে আসছিল যে, অচিরেই একজন নাবী আসবেন। ইহুদীরা বলতঃ আমরা সেই নাবীর অনুসরণ করব এবং তার সাথে যোগ দিয়ে আমরা আদ ও ইরাম জাতির ন্যায় তোমাদেরকে (আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোকদেরকে) অকাতরে হত্যা করব। মদ্বীনার আনসারগণ[1] আরবের অন্যান্য গোত্রের ন্যায় কা’বা ঘরের হাজ্জ করত। তবে ইহুদীরা তা করতনা। হজ্জের মৌসুমে আনসারগণ যখন দেখলেন আল্লাহর রসূল (ﷺ) মানুষদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান করছেন তখন তারা তাঁর ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা-গবেষণা করল এবং পরস্পর প্রশ্ন করল- আল্লাহর কসম! হে লোক সকল! তোমরা কি জান এই ব্যক্তিই কি তিনি যার মাধ্যমে ইহুদীরা তোমাদেরকে ভয় দেখিয়ে থাকে? এ রকম যেন না হয় যে, তারা তোমাদের পূর্বেই তাঁর অনুসারী হয়ে যায়।

আওস গোত্রের সুয়ায়েদ ইবনুস সামেত নামক একজন লোক মক্কায় আগমণ করেছিল। রসূল (ﷺ) তাঁকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। কিন্তু সে ইসলাম কবুল করেনি এবং সরসূরি তা প্রত্যাখ্যানও করে নি। ইতিমধ্যেই আনাস বিন রাফে আবুল হাইস বিন আব্দুল আশহাল গোত্রের একদল যুবকসহ কোন একটি বিষয়ে চুক্তি করার জন্য আগমণ করল। নাবী (ﷺ) তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান জানালেন। তখন তাদের মধ্যকার ইয়াস বিন মুআয নামক এক যুবক ব্যক্তি বলতে লাগল- হে আমার গোত্রীয় লোক সকল! আল্লাহর শপথ! আমরা যেই উদ্দেশ্যে আগমণ করেছি তার চেয়ে এটিই (ইসলাম কবুলই) আমাদের জন্য অনেক উত্তম। এ কথা শুনে আনাস তাকে প্রহার করল এবং ধমকাল। এতে সে চুপ হয়ে গেল। অতঃপর তারা সন্ধি চুক্তি পরিপূর্ণ না করেই মদ্বীনায় ফেরত গেল।

[1]. তখন তারা মুসলিম ছিলনা, কিন্তু মদীনাবাসীরাই যেহেতু পরবর্তীতে মুসলমান হওয়ার মাধ্যমে আনসার হয়েছিল, তাই তাদেরকে সাধারণভাবে আনসার বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।