সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ ওযূ আবূ মালিক কামাল বিন আস-সাইয়্যিদ সালিম

মাথার আবরণীর উপর মাসাহ

১। ওযূর সময় পাগড়ীর উপর মাসাহ:

সাধারণ ভাবে ওযূতে মাথার পরিবর্তে পাগড়ীর উপর মাসাহ বৈধ। এটা আহমাদ, ইসহাক্ব, আবূ সাওর, আওযায়ী, ইবনু হাযম, ইবনে তাইমিয়াহ এবং সাহাবীদের মধ্য হতে আবূ বকর, উমার, আনাস প্রমুখ এর অভিমত।[1] এটা রাসূল (ﷺ) থেকে সাব্যাস্ত।

যেমন আমর ইবনে উমাইয়া আয-যামেরী বলেন,রرَأَيْتُ النَّبِيَّ ﷺ يَمْسَحُ عَلَى عِمَامَتِهِ وَخُفَّيْهِগ্ধ ‘‘আমি রাসূল (ﷺ) কে খাফ (চামড়ার মোজা) ও পাগড়ীর উপর মাসাহ করতে দেখেছি’’।[2] অনুরূপ মুগীরা বিন শু’বা (রাঃ) থেকেও বর্ণিত হয়েছে।[3] বিলাল (রা.) বলেন, عَنْ بِلَالٍ:্রأَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَسَحَ عَلَى الْخُفَّيْنِ وَالْخِمَارِগ্ধ ‘‘রাসূল (ﷺ) খাফ (চামড়ার মোজা) ও আচ্ছাদনী উপর মাসাহ করতেন’’।[4] এখানে الْخِمَار হলো, মাথার আচ্ছাদন যা দ্বারা পাগড়ী উদ্দেশ্য।

অপর দিকে আবূ হানীফা ও তার মতাবলম্বী বিদ্বানগণ, মালিক ও শাফেঈ (রাহি.) এর মতে,[5] শুধু গাপড়ীর উপর মাসাহ বৈধ নয়। বরং নাসিয়াহ তথা মাথার অগ্রভাগ সহ মাসাহ বৈধ। এ ক্ষেত্রে মাথার অগ্রভাগ মাসাহ ফরয এবং পাগড়ীর উপর মাসাহ অতিরিক্ত। যেহেতু তারা মাথার কিছু অংশ মাসাহ করা বৈধ করেন!! কিন্তু ইমাম শাফেঈ বলেন, ‘‘যদি পাগড়ীর উপর মাসাহ করার হাদীসটি সহীহ হয় তাহলে আমার মতে, শুধু পাগড়ীর মাসাহ করা বৈধ’’। যেহেতু পাগড়ীর উপর মাসাহ করার হাদীসটি সহীহ, সুতরাং শুধু পাগড়ীর মাসাহ করা বৈধ হওয়াটা তারই অভিমত।

যারা পাগড়ীর উপর মাসাহ করার বিরোধি তারা যাবের বিন আবদুলস্নাহ থেকে বর্ণিত হাদীসটি উল্লেখ করে থাকেন। তিনি বলেন, আমি রাসূল (ﷺ) কে মাথা থেকে পাগড়ী খুলে নাসিয়াহ বা মাথার অগ্রভাগ পরিমাণ মাসাহ করতে দেখেছি’’।[6] আমি (লেখক) এ হাদীসটির সনদ কোন হাদীস গ্রন্থে খুঁজে পাইনি’’!!

মুগিরাহ বিন শু‘বা থেকে বর্ণিত-أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ:تَوَضَّأَ فمَسَحَ عَلَى خُفَّيْه، وَمُقَدَّمِ رَأْسِهِ وَعَلَى عِمَامَتِهِ রাসূল (ﷺ) একদা ওযূ করলেন, অতঃপর মোজার উপর, মাথার অগ্রভাগে এবং পাগড়ির উপর মাসাহ করলেন।[7]

আমার বক্তব্য: অধিক যুক্তিযুক্ত মত হল, নাবী কারীম (ﷺ) এবং তার পর দু’জন বিশিষ্ট খলীফা থেকে স্পষ্ট, হাদীস বর্ণিত হওয়ার কারণে সাধারণ ভাবে পাগড়ীর উপর মাসাহ বৈধ। আর এর বিরোধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য কোন দলীল বিদ্যমান নেই।[8] অবশ্য দ্বন্ধ নিরসনের ক্ষেত্রে বলা যায়, মাথার অগ্রভাগসহ পাগড়ীর উপর মাসাহ উত্তম। আল্লাহ্‌ই অধিক অবগত আছেন।

২। মহিলাদের ঘোমটার উপর মাসাহ:

শাইখুল ইসলাম বলেন: মহিলারা যদি ঠান্ডা বা অনুরূপ কিছুর ভয় করে তাহলে ঘোমটার উপর মাসাহ করবে। কেননা উম্মে সালমা (রা.) তার ঘোমটার উপর মাসাহ করতেন। তবে মাথার কিছু চুলসহ মাসাহ করতে হবে। আর যদি এরূপ প্রয়োজন না দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে মাসাহ বৈধ হওয়ার ব্যাপারে উলামাদের মাঝে মতানৈক্য বিদ্যমান।[9]

আমার বক্তব্য: একটা বর্ণনেইুযায়ী আবূ হানীফা, মালিক, শাফেঈ ও হাম্বলী মতাবালম্বীদের মতে,[10] ঘোমটার উপর মাসাহ বৈধ নয়। যেমনটি আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, যে, তিনি ঘোমটার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে তাতে মাসাহ করতেন এবং তিনি বলতেন, এভাবেই রাসূল (স:) আমাকে আদেশ করেছেন’’।[11]

তারা বলেন: যেহেতু ঘোমটা মহিলাদের মাথার একটি পরিধেয় বস্ত্ত এবং তা খুলে ফেলা কঠিন নয়। সুতরাং তার উপর মাসাহ বৈধ হবে না।

অপর পক্ষে হাসান বসরী ঘোমটার উপর মাসাহ বৈধ মনে করেন। এটা হাম্বলী মাযহাবের অভিমত। তবে তারা শর্তারোপ করেন যে, মহিলাদের ঘোমটা টা গলা পর্যন্ত হতে হবে (!!) পাগড়ীর উপর কিয়াস করে, যেহেতু ঘোমটা নিত্য অভ্যাসগত পরিধেয় পোষাক।

আমার বক্তব্য: যদি আয়িশা (রা.) বর্ণিত হাদীসটি সহীহ হত, তাহলে ঘোমটার উপর মাসাহ নাজায়েয হওয়ার জন্যে এটাই যথেষ্ট হত। আর পাগড়ীর উপর কিয়াস করাটা অগ্রহণযোগ্য। তবে সতর্কতা মূলক খিমারসহ মাথার অগ্রভাগ মাসাহ করা ভাল। আল্লাহ্‌ই ভাল জানেন।

৩। ওযূতে টুপির উপর মাসাহ:

জমহুর উলামার মতে, ওযূতে মাথার পরিবর্তে টুপির উপর মাসাহ বৈধ নয়। কেননা মাথা মাসাহ ফরয। মূলতঃ জমহুরের নিকট পাগড়ীর উপর মাসাহ করার হুকুম দেয়া হয়েছে, তা খোলা কষ্টকর হওয়ার কারণে। আর আহমাদের নিকট দলীলের ভিত্তিতে এ হুকুম দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে ইবনু হাযম, ইবনু তাইমিয়া[12] ও মুহাক্কিক একদল বিদ্বানের মতে, টুপির উপর মাসাহ জায়েয। যেহেতু রাসূল (ﷺ) পাগড়ীর বা অনুরূপ পোষাক বিশেষের উপর মাসাহ করেছেন। সুতরাং এ থেকে বুঝা যায় যে,, সরাসরি মাথায় পানি স্পর্শ করানো ফরয নয়। যে কোন বস্ত্ত বিশেষ মাথায় পরিধান করা হলে তার উপর মাসাহ বৈধ। যদিও তা ফরযের স্থানকে আচ্ছাদনকারী নাও হয় এবং তা খোলে ফেলাও কষ্টকর না হয়। আর এটাই অধিক বিশুদ্ধ মত। (আল্লাহ্‌ই অধিক অবগত আছেন)।

উপকারিতা: মাসাহ জায়েয হওয়ার জন্য মাথার আচ্ছাদন পবিত্র অবস্থায় পরিধান করা শর্ত নয়। এ ক্ষেত্রে মোজার উপর কিয়াস করা যাবে না। যেহেতু এ দু’টির মাঝে একত্রিত হওয়ার কোন কারণ নেই। রাসুল (ﷺ) মোজা পরিধানের ব্যাপারে পবিত্রতাকে শর্ত করেছেন। যা পাগড়ী পরিধানের ব্যাপারে করেননি। যদি তা আবশ্যক হত অবশ্যই বর্ণনা করতেন।[13]

আমার বক্তব্য: এখানে মোজা পরিধানের স্থানটি ধৌত করা ফরয আর মাথাতে ফরয হল মাসাহ করা। মাথার ব্যাপারে এমন কোন বিষয় নেই যার দ্বারা এর উপর মোজার হুকুমের ন্যায় হুকুম আরোপ করা যায়। বরং এটা আলাদা বিষয়। আল্লাহ্‌ই অধিক অবগত আছেন।

মাথার আবরণের উপর মাসাহ করার ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন সময়সীমা বা সীমারেখা নেই:

কারণ মোজার উপর মাসাহ এর কিয়াস বিশুদ্ধ নয়। অথচ রাসূল (ﷺ) পাগড়ীর উপর মাসাহ করেছেন কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোন সময়সীমা বেঁধে দেননি। এটা উমার বিন খাত্তাব থেকে বর্ণিত হয়েছে।[14]


৪। ব্যান্ডেজের উপর মাসাহ:

جبيره (জাবীরাহ) হলো, কাষ্টফলক দ্বারা ভাঙ্গা হাড়কে জোড়া লাগানোর জন্য ব্যান্ডেজ করা এবং সুস্থ্য হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময় ব্যান্ডেজ করা।

জমহুর উলামা, চার ইমামসহ অনেকের মতে, ওযূর অঙ্গ-প্রত্যেঙ্গর মধ্যে হাতের কব্জি, পা প্রভৃতিতে যে কাঠের ফলক ব্যবহার করা হয়, এর উপর মাসাহ করা জায়েয।[15]

তাদের দলীল গুলো নিমণরূপ:

(১) জনৈক ব্যক্তির শরীরে আঘাত লাগা মর্মে বর্ণিত জাবেরের হাদীস। তার ব্যাপারে রাসূলের উক্তি

»إِنَّمَا كَانَ يَكْفِيهِ أَنْ يَعْصِبَ َعلَى جُرْحِهِ خِرْقَةً، ثُمَّ يَمْسَحَ عَلَيْهَا «

অর্থাৎ: ‘‘তার জন্যে যখমের উপর ব্যান্ডেজ ব্যবহার করাই যথেষ্ট হতো এবং সে তার উপর মাসাহ করলেই চলতো’’।[16] এ হাদীসটি যঈফ।

(২) ইবনু উমারের উক্তি: من كان له جرح معصوب عليه توضأ ومسح على العصائب ويغسل ما حول العصائب ‘‘যে ব্যক্তির ব্যান্ডেজযুক্ত যখম থাকবে, সে ওযূর সময়ে যখমের উপর শুধু মাসাহ করবে এবং ব্যান্ডেজের আশেপাশের জায়গা ধৌত করবে’’।[17] এ ক্ষেত্রে সাহাবাদের কেউ ইবনে উমারের বিরোধিতা করেছেন বলে জানা যায় না।

(৩) মোজার মাসাহ এর উপর কিয়াস বা অনুমান করেও এর দলীল দেয়া যায়। যেহেতু কোন প্রয়োজন ছাড়াই মোজার উপর মাসাহ জায়েয, অতএব প্রয়োজনের তাগিদে কাষ্ট ফলকের উপর মাসাহ জায়েয হওয়া আরও অধিক যুক্তিযুক্ত।

তবে হাযমের মতে, কাষ্ট ফলকের উপর মাসাহ করার কোন প্রয়োজন নেই। বরং এ স্থানের হুকুম অতীত হয়ে গেছে।[18]

আমার বক্তব্য: যেহেতু ব্যান্ডেজের উপর মাসাহ সংক্রান্ত হাদীসগুলোকে যঈফ আখ্যা দেয়া হয়েছে, সেহেতু কিয়াসকে প্রমাণ হিসাবে দাঁড় করানোর কোন সুযোগ নেই (!!) এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, যখন তার রুকন ও শর্তগুলো ঠিক থাকবে তখন কিয়াসকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করা যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মূল থেকে শাখার হুকুমটি ভিন্ন হওয়ার কারণে কিয়াস বাতিল হিসাবে গণ্য হবে। এটা (জমহুরের নিকট কাষ্ট ফলকের উপর মাসাহ করা) ওয়াজিবকে (মোজার উপর মাসাহ করা) বৈধ এর উপর কিয়াস করা হচ্ছে। সুতরাং, এ ক্ষেত্রে ইবনু হাযমের মতটিই প্রাধান্য পাবে।।

উপকারিতা:

১। জাবীরা বা ব্যন্ডেজের উপর মাসাহ করা ওযূ ও গোসল উভয় অবস্থায় বৈধ:

কেননা ব্যন্ডেজ প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। ছোট বা বড় নাপাকী কোন অবস্থায় খোলার প্রয়োজন নেই। যা মোজা মাসাহ এর হুকুম থেকে আলাদা। এটা এক ধরনের ছাড়।

২। ব্যান্ডেজের ক্ষেত্রে পবিত্র অবস্থা ও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যবহারের কোন শর্ত আরোপ করা যাবেনা:

পবিত্রতাবস্থায় ব্যান্ডেজ পরিধান করতে হবে এমন কোন শর্ত আরোপ করা যাবেনা। কেননা শরীয়াত প্রণেতা মাসাহ বৈধ করার মাধ্যমে ক্ষতি ও কষ্ট লাঘবের যে উদ্দেশ্য করেছেন এটা তার বিপরীত। এছাড়া ব্যান্ডেজের বিষয়টি বাধ্যতামূলক যা আকষ্মিক চাপিয়ে দেয়া হয়, যা মোজার বিপরীত। উপরন্ত কুরআন-হাদীস ও ইজমা থেকে এর কোন দলীলও নেই। অনুরূপ ভাবে ব্যন্ডেজের উপর মাসাহ এর কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। বরং যখন তা খোলে ফেলা হবে অথবা আক্রান্ত অংশ আরোগ্য পাবে তখন মাসাহ বৈধ হবে না।

৩।ওযূর অঙ্গে যদি চিকিৎসার দরূণ কোন ব্যন্ডেজ করা হয়, তাহলে তার হুকুম জাবীরার হুকুমের ন্যায়। যেমনটি শাইখুল ইসলাম বলেছেন।[19]

[1] মাসায়িলু আবী দাউদ (৮), আল-মুগনী (১/৩০০), আল-মাজমু’ (১/৪০৬), আল-আওসাত্ব (১/৪৬৮), আল-মুহালস্না (২/৫৮), মাজমূ’আল ফাতাওয়া (২১/১৮৪)।

[2] সহীহ; বুখারী (২০৫)।

[3] সহীহ; মুসলিম (২৭৫)।

[4] সহীহ; মুসলিম (২৮৫)।

[5] ইবনু আবেদীন এর হাশিয়া (১/১৮১), আলস্নামা দাসূকীর হাশিয়া (১/১৬৪), আল-মাজমু’ (১/৪০৭)।

[6] আমার নিকট যত হাদীস গ্রন্থ তার কোনটিতেও এর কোন সূত্র পাইনি; তবে ইবনে মুনযির (১/৪৬৯) সনদ ছাড়া উল্লেখ করেছেন।

[7] সহীহ এ হাদীস ওজুর অধ্যায়ে চলে গেছে।

[8] আল-মুহালস্না (২/৬১) -গ্রন্থে তাদের দলীল এবং এর প্রত্যাখ্যান দেখুন!

[9] মাজমূ’ আল-ফাতাওয়া (২১/২১৮)।

[10] আল-মাদূনাহ (১/৪২), আল-উম্ম (১/২৬), আল-বাদাঈ (১/৫), আল-মুগনী (১/৩০৫)।

[11] আমি এ সম্পর্কে অবগত হতে পারিনি; এ হাদীসটি আলস্নামা কাসানী তাঁর আল-বাদাঈ (১/৫) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। অথচ হাদীসের কোন কিতাবেই এ হাদীসটি আমি অবগত হতে পারিনি (!!)।

[12] আল-মুহালস্না (২/৫৮), মাজমূ’ আল ফাতাওয়া (২১/১৮৪-১৮৭, ২১৪)।

[13] আল-মুহালস্না (২/৬৪)।

[14] আল-মুহালস্না (২/৬৫)।

[15] শারহু ফাতহুল ক্বাদীর (১/১৪০), আল মাদূনাহ (১/২৩), আল-মুগনী (১/২০৩), আল-মাজমূ’ (২/৩২৭)।

[16] যঈফ; আবূ দাউদ (২৩৬), প্রভৃতি। ইরওয়াউল গালীল (১০৫)।

[17] এ হাদীসের সনদ সহীহ; ইবনু আবী শাইবাহ (১/১২৬), বায়হাকী (১/২২৮)।

[18] আল-মুহালস্না (২/৭৪)।

[19] মাজমূ’ আল-ফাতাওয়া (২১/১৮৫)।