সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য খাসভাবে সম্পন্ন করাকে توحيد الألوهية বলা হয়। উলুহীয়াত অর্থ ইবাদত। الإله অর্থ মাবুদ। এ জন্যই এ প্রকার তাওহীদকে توحيد العبادة বলেও নামকরণ করা হয়।
العبادة শব্দের আভিধানিক অর্থ নত হওয়া, বশীভুত হওয়া, পদদলিত হওয়া ইত্যাদি। যখন কোনো রাস্তার উপর দিয়ে পদচারণ করা হয়, তখন তাকে طريق معبد বলা হয়। অর্থাৎ পদদলিত ও বশীভুত রাস্তা। আলেমগণ ইবাদতের পারিভাষিক অর্থ আলোচনা করতে গিয়ে বিভিন্ন বাক্য ব্যবহার করেছেন। তবে তার মূল অর্থে সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
একদল আলেমের মতে প্রচলিত সামাজিক প্রথা ও বিবেক-বুদ্ধির দাবি ছাড়াই যা বাস্তবায়ন করার জন্য শরী‘আতের পক্ষ হতে আদেশ করা হয়েছে, তাই ইবাদত। আরেক দল আলেমের মতে পরিপূর্ণ বিনয় মিশ্রিত পরিপূর্ণ ভালোবাসাকে ইবাদত বলা হয়।
শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ ইবাদতের পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
العبادة اسم جامع لكل ما يحبه الله ويرضاه من الأقوال والأعمال الظاهرة والباطنة
আল্লাহ তা‘আলা বান্দার যেসব প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কথা ও কাজকে ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন, তার নামই ইবাদত।
ইবাদতের এ সংজ্ঞাটিই সর্বাধিক সূক্ষ্ম ও অধিকতর ব্যাপক। কেননা দীনের সবকিছুই ইবাদতের মধ্যে গণ্য। যারা বিনয় মিশ্রিত ভয়কে ইবাদত বলে নামকরণ করেছেন, তাদের কথা হলো পরিপূর্ণ বিনয়ের সাথে পরিপূর্ণ ভালোবাসা প্রিয়পাত্রের আনুগত্য করা ও তার সামনে নত হওয়ার দাবি জানায়। বান্দাকে কেবল ভালোবাসা ও বিনয়ই প্রিয়পাত্রের জন্য নত করে। সুতরাং বান্দার পক্ষ হতে আল্লাহ তা‘আলার জন্য ভালোবাসা ও তার সামনে নত হওয়া অনুপাতেই বান্দার আনুগত্য হয়ে থাকে। বান্দার তরফ থেকে তার রবের প্রতি ভালোবাসা এবং তার রবের সামনে বিনয়ী ও নত হওয়া একমাত্র তারই ইবাদতের দাবি জানায়। তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তার কোনো শরীক নেই।
ইসলামী শরী‘আতে যেসব ইবাদতের আদেশ এসেছে, তাতে একই সঙ্গে বিনয়-নম্রতা ও ভালোবাসা থাকা আবশ্যক। এতে তিনটি রুকন থাকা জরুরী। ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্খা এবং ভয়-ভীতি। ইবাদতের মধ্যে এসব বিষয় একসাথে বিদ্যমান থাকা আবশ্যক। যে ব্যক্তির মধ্যে এগুলো থেকে শুধু একটি পাওয়া যাবে, সে পরিপূর্ণরূপে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতকারী নয়। অন্তরে শুধু ভালোবাসা নিয়ে ইবাদত করা সুফীদের তরীকা, শুধু আশা-আকাঙ্খা নিয়ে ইবাদত করা মুরজিয়াদের তরীকা, আর শুধু ভয় নিয়ে ইবাদত করা খারেজীদের তরীকা।
বিনয়হীন ভালোবাসা ইবাদতের মধ্যে গণ্য নয়। সুতরাং যে ব্যক্তি কোনো জিনিসকে ভালোবাসে ঠিকই; কিন্তু তার সামনে নত হয় না, সে তার ইবাদতকারী হিসাবে গণ্য নয়। যেমন কোনো মানুষ তার সন্তান ও বন্ধুবান্ধবকে ভালোবাসে। এ ভালোবাসা ইবাদত নয়। এমনি ভালোবাসাবিহীন নতি স্বীকারও ইবাদত নয়। যেমন রাজা-বাদশা কিংবা যালেম ও সন্ত্রাসীর ক্ষতি থেকে বাচার জন্য মানুষ তাদের সামনে নত হয়। এ নতি স্বীকারও ইবাদত নয়। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের ক্ষেত্রে এ দু’টি বিষয়ের একটি অন্যটি থেকে আলাদা হলে ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে না। বরং বান্দার নিকট আল্লাহ তা‘আলা সর্বাধিক প্রিয় হওয়া আবশ্যক। সে সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার সামনে বান্দা সর্বাধিক বিনয়ী হওয়া ও নতি স্বীকার করা আবশ্যক।
সুতরাং বান্দার ইবাদত আল্লাহ তা‘আলার কাছে খুব প্রিয় এবং এটা তার সন্তুষ্টি পাওয়ার মাধ্যম। ইবাদতের জন্যই আল্লাহ তা‘আলা মাখলুক সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ (৫৭) إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ﴾
‘‘আমি জিন এবং মানবকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে কোনো রিযিক চাই না কিংবা তারা আমাকে খাওয়াবে তাও চাই না। আল্লাহ নিজেই রিযিকদাতা এবং প্রবল শক্তিধর ও পরাক্রমশালী’’। (সূরা যারিয়াত: ৫৬-৫৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন.
﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾
‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রসূল পাঠিয়েছি। তার মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো’’। (সূরা আন নাহল: ৩৬)