সালাফী বা আহলে হাদীসদের বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোগ ও ভুল ধারণা এবং তার নিরসন

১। সালাফীরা শাফেয়ী বা শাফেয়ীদের মতো।

আসলে অনেক মাসআলায় শাফেয়ীদের সাথে সালাফীদের মিল দেখে কোন কোন অর্বাচীন এমন কথা বলে থাকে।

২। সালাফীরা মযহাব মানে না। ইমাম মানে না।

হ্যাঁ, সালাফীরা বানাওয়াট মযহাব মানে না। কারণ প্রসিদ্ধ মযহাবের চার ইমাম কখনোই বলে যাননি যে, তোমরা আমাদের অন্ধানুকরণ কর। বরং তারা বলে গেছেন, কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ করতে। আর কুরআন-হাদীসে মযহাব মানার কথা বলা হয়নি।

সালাফীরাই সকল ইমামকে মান্য করে থাকেন। যেহেতু সকল ইমাম সালাফীই ছিলেন। তাঁদের কোন নির্দিষ্ট মযহাব ছিল না। পরন্তু সবাই বলে গেছেন, হাদীস সহীহ হলে, সেটাই আমার মযহাব। সুতরাং তাদের এই নির্দেশ মান্য করে সালাফীরাই ১০০% হানাফী, ১০০% মালেকী, ১০০% শাফেয়ী এবং ১০০% হাম্বলী।

৩। সালাফীরা দরূদ পড়ে না।

হ্যাঁ, তারা কোন নকল দরূদ পড়ে না এবং কোন বানাওয়াটি পদ্ধতিতে দরূদ পড়ে না। যেহেতু তা বিদআত।

৪। সালাফীরা আওলিয়াদের সম্মান করে না।

এটা ভুল ধারণা। অবশ্য তারা তাদেরকে সিজদা করে না, প্রণাম করে না এবং মরণের পর তাদের কবরের উপর মাযার তৈরি করে না। যেহেতু এ সকল কর্ম সম্মানে বাড়াবাড়ি ও শরীয়ত-বিরোধী।

৫। সালাফীরা আহলে বায়তের সম্মান করে না, তাদেরকে ভালোবাসে না।

এটাও পূর্বানুরূপ ভুল ধারণা। তবে তারা তাদের জন্ম-মৃত্যদিন। পালন করে না। মাতম করে না, তাজিয়া করে না---এ কথা ঠিক। কারণ তা শরীয়ত-পরিপন্থী।

৬। আহলে হাদীস আয়েম্মা ও ফুক্বাহা (রাহিমাহুমুল্লাহ)দেরকে গালাগালি দেয়।

সত্যপক্ষে আহলে হাদীস যারা, তারা কোন দিনই তাদেরকে গালি দিতে পারে না। অবশ্য এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রত্যেক দলেই এক শ্রেণীর গোড়া মানুষ থাকে, তারাই পরস্পরকে গালাগালি করে। তাছাড়া আহলে হাদীসের আক্বীদা হল, সকল ইমামই আহলে সুন্নাহ বা হাদীস ছিলেন। আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অনুসরণকে তাঁরা ওয়াজেব জানতেন এবং সবাই এতে একমত ছিলেন। তারা এ কথাও জানতেন যে, রসূলের কথা ছাড়া বাকী অন্য কোন সাহাবী, তাবেয়ী ইমাম বা আলেমের কথা মান্যও হতে পারে এবং অমান্যও। কিন্তু তাঁরা মাসুম ছিলেন না, মুজতাহিদ ছিলেন। তাদের কোন ফায়সালা ভুল হলে একটি এবং ঠিক হলে দু’টি নেকীর তারা হকদার হন। সুতরাং যারা নেকীর হকদার, তাদেরকে গালি দেওয়ার কোন প্রসঙ্গই আসে না।

তাছাড়া মহানবী কি বলেছেন, “মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকী (আল্লাহর অবাধ্যাচরণ) এবং তার সাথে লড়াই ঝগড়া করা কুফরী।” (বুখারী ৪৮, মুসলিম ২৩০নং)

৭। আহলে হাদীসদের অনেক মাসায়েল কুরআন-হাদীস বিরোধী।

আসলে আহলে হাদীসদের মাসায়েল কুরআন-হাদীস বিরোধী নয়, বরং মযহাবীদের মযহাব বিরোধী অথবা যয়ীফ বা জাল হাদীসবিরোধী। অথবা পরস্পরবিরোধী দুই হাদীসের অপ্রাধান্যপ্রাপ্ত হাদীস বিরোধী। যারা সহীহ হাদীস মেনে চলার শতভাগ চেষ্টা করে, তারা কি কুরআন-হাদীসের বিরোধী সমাধান দিতে পারে?

৮। আহলে হাদীস বুখারীর মুক্বাল্লিদ, আলবানীর মুকাল্লিদ.... ।

আসলে তাকলীদের মৌলিক অর্থ এবং অন্ধ অনুকরণ ও ইত্তিবা বা অনুসরণের অর্থ না বুঝে অনেকে এই শ্রেণীর মন্তব্য করে থাকে। বলা। বাহুল্য, গায়র মুকাল্লিদ নির্দিষ্ট কারো মুকাল্লিদ নয়। গায়র মক্কাল্লিদ কুরআন-হাদীস বুঝতে ও মানতে নির্দিষ্ট কারো তাকলীদ করে না। বরং আহলে হাদীস সে ব্যাপারে সাহাবা, তাবেঈন, আয়িম্মা ও ফুক্বাহার অনুসরণ করে। অতঃপর যেটি সহীহ দলীলের অধিক নিকটবর্তী পায়, তার অনুসরণ করে। মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَالَّذِينَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوتَ أَن يَعْبُدُوهَا وَأَنَابُوا إِلَى اللَّهِ لَهُمُ الْبُشْرَىٰ ۚ فَبَشِّرْ عِبَادِ * الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ ۚ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللَّهُ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمْ أُولُو الْأَلْبَابِ

অর্থাৎ, যারা তাগুতের পূজা হতে দূরে থাকে এবং আল্লাহর অনুরাগী হয়, তাদের জন্য আছে সুসংবাদ। অতএব সুসংবাদ দাও আমার দাসদেরকে---যারা মনোযোগ সহকারে কথা শোনে এবং যা উত্তম তার অনুসরণ করে। ওই তারা, যাদেরকে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেন এবং ওরাই বুদ্ধিমান। (যুমারঃ ১৭-১৮)

আহলে হাদীস যে ইমাম বুখারীর মুক্বাল্লিদ নয়, সে কথা স্বীকার করে খোদ মযহাবীরাই উদাহরণ দিয়ে থাকেন।

অনেকে এ কথাও উল্লেখ করে থাকেন যে, আহলে হাদীস আল্লামা আলবানীর অন্ধানুকরণ করে না। যেহেতু বহু মাসায়েলে তারা তার ফতোয়ার বিপরীত মত অনুসরণ করে থাকে।

৯। 'আসহাবুল হাদীস’ মানে কেবল মুহাদ্দিসীনকে বুঝানো হয়। তথাকথিত আহলে হাদীসকে নয়।

অর্থাৎ, যাদের কাছে হাদীসের ইলম আছে কেবল তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত দল, কেবল তারাই ফিকাহ নাজিয়াহ। আশা করি, জ্ঞানিগণ মানবেন যে, যারা তাদের অনুসরণ করে সহীহ হাদীস ভিত্তিক আমল করে, তারাও তাদেরই দলভুক্ত। আম জনসাধারণ মুহাদ্দিসীন না হলেও তারা তাদের আদর্শ অনুসারে চলে। তাই তারাও ‘আহলে হাদীস’। যেমন আহলে কিতাব (ইয়াহুদী-খ্রিস্টান) বলতে তাদের উলামা ও আম জনসাধারণ উভয় শ্রেণীর মানুষকে বুঝানো হয়।

১০। সালাফীরা ইজমা মানে না।

ভুল ধারণা। ইজমা সঠিক হলে অবশ্যই মানে। আর সঠিক ইজমা কুরআন ও সহীহ হাদীস-বিরোধী হয় না। কোন ভুলের উপর উম্মাহর ইজমা হতে পারে না। আর কোন বিষয়ে সঠিক ইজমা ও সর্ববাদিসম্মতি হওয়া বিশাল কঠিন ব্যাপার।

১১। আহলে হাদীস কিয়াস মানে না।

যে সমস্যার সমাধানে কুরআন-হাদীসের স্পষ্ট উক্তি নেই, অনেক অনভিজ্ঞ ব্যক্তি উক্ত কথা বলে, সে সমস্যার কথা উল্লেখ করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে হাদীস পেশ করতে বলে। অথচ অভিজ্ঞ মযহাবীরাও জানেন যে, আহলে হাদীসরাও কিয়াস মানে। তবে সহীহ হাদীসের ওপর কিয়াসকে প্রাধান্য দেয় না। পানি না পাওয়া গেলে ওযুর জায়গায় তায়াম্মুম ব্যবহার করে, কিন্তু পানি সামনে এলে তায়াম্মুম বাতিল মনে করে।

১২। আহলে হাদীস নফসের ইত্তিবা করে!

এটিও একটি গায়ের ঝাল-ঝাড়া অপবাদ। আহলে হাদীস নির্দিষ্ট কোন মযহাবের তাক্বলীদ করে না বলে, তারা সুবিধাবাদী নফসের পূজারী নয়। একই বিষয়ে উলামাগণের বহুমত থাকলে সেই মতকেই তারা গ্রহণ করে, যা সহীহ দলীল ভিত্তিক এবং বলিষ্ঠ। কক্ষনোই সে মত গ্রহণ করে, যা নিজেদের মনঃপুত ও যাতে নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধা রক্ষা হয়। কার মত গ্রহণ করা হবে, তা নিয়েও তারা নিজেদের বিবেক-বিবেচনাকে কাজে লাগায়। কোন আলেম ইলম ও আমলে বড়, তা নির্বাচন করে সুস্থ। মন-মস্তিষ্কের মাপকাঠিতে। যেহেতু মহানবী (সা.) বলেন,

استفت نفسك وان افتاك المفتون

“তুমি তোমার হৃদয়ের কাছে ফতোয়া নাও, যদিও মুফতীরা তোমাকে ফতোয়া দিয়েছে।” (আহমাদ ১৮০০৬, দারেমী ২৫৩৩ বুখারীর তারীখ, সহীহুল জামে ৯৪৮, ২৮৮ ১নং)

১৩। আহলে হাদীস উলামাদের মাঝে নানা মতভেদ কেন?

এমন মতভেদ অস্বাভাবিক নয়। একটি মযহাবের ভিতরেও অনেক মতভেদ পরিদৃষ্ট হয়। জেনে রাখা ভালো যে,

১। আহলে হাদীস কোন ব্যক্তি বিশেষের অন্ধানুকরণের জামাআত নয়। কেবল কুরআন ও সহীহ হাদীস-ভিত্তিক একটি মতাদর্শের নাম, যা ইসলামের মূল স্রোতধারা ও রাজপথ।

২। তার মানে হাদীস সহীহ হলে সেটাই আহলে হাদীসের মযহাব হয়। যেমন সকল মুহাদ্দিসীন ও আয়েম্মায়ে কিরাম (রাহিমাহুমুল্লাহ)গণের মযহাব তাই ছিল। তারা সকলেই আহলে হাদীস ছিলেন।

৩। এতত্সত্ত্বেও মতভেদের কারণ কী? কারণ পরস্পর-বিরোধী বর্ণিত হাদীস।

আহলে হাদীস তাহকীক করে যে হাদীসটি সহীহ পর্যায়ের, কেবল সেই হাদীসটির উপর আমল করে এবং দুর্বল হাদীস বর্জন করে।

পরস্পর-বিরোধী উভয় হাদীস সহীহ হওয়ার ক্ষেত্রে নাসেখ-মনসুখ নির্ণয় করে। তা সম্ভব না হলে উভয় হাদীসের মাঝে সমন্বয় সাধন। করে আমল করার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত মাসআলাই তাদের মযহাব হয়। তারা কোন নির্ধারিত ব্যক্তির অন্ধানুকরণ করে তারই মযহাবকে (সবার চেয়ে সঠিক) প্রমাণ করার মানসে যয়ীফ হাদীসকে সহীহ করার পায়তারা করে না অথবা কোন সহীহ হাদীসের অপব্যাখ্যা বা তাবীল করে না।

তাছাড়া কোন হাদীসের সহীহ-যয়ীফ নিয়ে অথবা কুরআনের হাদীসের বক্তব্য বোঝা নিয়ে মতভেদ স্বাভাবিক।

১৪। সালাফীরা রাজনীতি করে না, ইসলামে কি রাজনীতি নেই?

হ্যাঁ, সালাফীরা রাজনীতি করে, আর তাদের রাজনীতি হল রাজনীতি না করা। আর ইসলামে আছে ইসলামী রাজনীতি, পাশ্চাত্যের রাজনীতি নয়।

১৫। আহলে হাদীস বুখারী ছাড়া অন্য হাদীস মানে না।

এ মন্তব্যও কোন অর্বাচীন ব্যক্তি বিশেষের। সবচেয়ে বেশি শুদ্ধ ও সহীহ হাদীসগ্রন্থ বুখারী। তা বলে তা আহলে হাদীসের একমাত্র হাদীসগ্রন্থ নয়। বরং অন্য গ্রন্থের হাদীস সহীহ সনদে পেলে তা গ্রহণ করে এবং বুখারীতে তার বিপরীত থাকলে পরস্পর-বিরোধী হাদীসের মাঝে সমন্বয় সাধন করে আমল করে।

হাদীসটির সনদ সহীহ, নাকি যয়ীফ---তা নিয়ে মতভেদ থাকার ফলে যেমন ইসলামে বিভিন্ন মযহাব সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি আহলে। হাদীস উলামাগণের মাঝেও একই মাসআলায় ভিন্ন ভিন্ন মত বর্তমান। থাকা অস্বাভাবিক নয়। যেমন একই মযহাবের ভিতরে একাধিক মত বা বিভিন্ন উপ-মহাব সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

সুতরাং মতভেদ থাকতে পারে, থাকবে। কিন্তু তা নিয়ে কলহ-দ্বন্দ্ব বা কাদা ছুঁড়াছুঁড়ি করা মোটেই উচিত নয়।

উদার মানুষ যেটাকে সবচেয়ে সঠিক বলে বিশ্বাস করবে, সেটার অনুসরণ করবে এবং কোন ব্যক্তি বিশেষের অন্ধানুকরণ করবে না। এটাই তো হিদায়াতের পথ। মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَالَّذِينَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوتَ أَن يَعْبُدُوهَا وَأَنَابُوا إِلَى اللَّهِ لَهُمُ الْبُشْرَىٰ ۚ فَبَشِّرْ عِبَادِ * الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ ۚ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللَّهُ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمْ أُولُو الْأَلْبَابِ

অর্থাৎ, যারা তাগুতের পূজা হতে দূরে থাকে এবং আল্লাহর অনুরাগী হয়, তাদের জন্য আছে সুসংবাদ। অতএব সুসংবাদ দাও আমার বান্দাগণকে---যারা মনোযোগ সহকারে কথা শোনে এবং যা উত্তম তার অনুসরণ করে। ওরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেন এবং ওরাই বুদ্ধিমান। (সুরা যুমার ১৭- ১৮ আয়াত)

وصلى الله وسلم وبارك على رسول الله وعلى آله وصحبه ومن تبعهم بإحسان إلى يوم الدين، والحمد لله رب العالمين

সমাপ্ত