আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ أَوَ لَمۡ يَرَوۡاْ أَنَّا خَلَقۡنَا لَهُم مِّمَّا عَمِلَتۡ أَيۡدِينَآ أَنۡعَٰمٗا فَهُمۡ لَهَا مَٰلِكُونَ ٧١ ﴾ [يس: ٧١]

তারা কি দেখেনি, আমার হাতের কৃত বস্তুসমূহের মধ্যে আমি তাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছি। (সূরা ইয়াসীন: ৩৬: ৭১)

আমরা এ আয়াতের উত্তর দেব প্রথমে জিজ্ঞাসা করে যে, এ আয়াতের প্রকাশ্য ও প্রকৃত অর্থ কি? প্রকাশ্য ও প্রকৃত অর্থ নির্ধারিত হওয়ার পরেই তো এটা বলা শুদ্ধ হতে পারে যে তা প্রকাশ্য ও প্রকৃত অর্থ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

এটা কি বলা হবে যে এ আয়াতের বাহ্যিক ও প্রকৃত অর্থ এই যে, আল্লাহ তা‘আলা চতুষ্পদ জন্তু তাঁর নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন ঠিক সেভাবে যেভাবে তিনি আদম আ. কে সৃষ্টি করেছেন?

না কি বলা হবে যে, এ আয়াতের বাহ্যিক অর্থ এই যে, আল্লাহ তা‘আলা চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন ঠিক সেভাবে যেভাবে তিনি অন্যান্য সৃষ্টিবস্তুকে সৃষ্টি করেছেন, অর্থাৎ তিনি তার হাত দিয়ে তা সরাসরি সৃষ্টি করেননি, বরং হাতকে এখানে কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে এটা বুঝানোর জন্য যে হাতের যিনি মালিক তিনিই তা সৃষ্টি করেছেন। আর এটা আরবী ভাষায় একটি স্বীকৃত একটি বিষয়।

প্রথম কথাটি আয়াতের বাহ্যিক ও প্রকৃত অর্থ হতে পারে না দু’ কারণে:

প্রথমত: আরবী ভাষার দাবি অনুযায়ী প্রথম কথাটি আয়াতের শব্দমালার দাবি হতে পারে না। আপনি যদি নিম্নবর্ণিত কয়েকটি আয়াত অনুধাবন করে দেখেন তবে বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে যাবে:

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَمَآ أَصَٰبَكُم مِّن مُّصِيبَةٖ فَبِمَا كَسَبَتۡ أَيۡدِيكُمۡ وَيَعۡفُواْ عَن كَثِيرٖ ٣٠ ﴾ [الشورا: ٣٠]

আর তোমাদের প্রতি যে মুসীবত আপতিত হয়, তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল। আর অনেক কিছুই তিনি ক্ষমা করে দেন। (আশ্শুরা: ৪২: ৩০)

﴿ ظَهَرَ ٱلۡفَسَادُ فِي ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِ بِمَا كَسَبَتۡ أَيۡدِي ٱلنَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعۡضَ ٱلَّذِي عَمِلُواْ لَعَلَّهُمۡ يَرۡجِعُونَ ٤١ ﴾ [الروم: ٤١]

মানুষের হাতের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সমুদ্রে ফাসাদ প্রকাশ পায়। যার ফলে আল্লাহ তাদের কতিপয় কৃতকর্মের স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে। (সূরা আররুম: ৩০: ৪১)

﴿ ذَٰلِكَ بِمَا قَدَّمَتۡ أَيۡدِيكُمۡ﴾ [ال عمران: ١٨٢]

এ হল তোমাদের হাত যা আগাম পেশ করেছে। (সূরা আলে ইমরান: ৩: ১৮২)

এসব আয়াতে মানুষের হাত যা উপার্জন করেছে বা হাত যা আগাম পেশ করেছে দ্বারা স্বয়ং মানুষ যা উপার্জন করেছে বা আগাম পেশ করেছে বুঝানো হয়েছে। হোক তা হাত দ্বারা অথবা অন্যভাবে। এর বিপরীতে যদি বলা হয় যে, এ কাজটি আমি আমার দু’হাত ব্যবহার করে করেছি, তাহলে এর অর্থ হবে কেবল ওই কাজ যা হাত ব্যবহার করে করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণীতে:

﴿ فَوَيۡلٞ لِّلَّذِينَ يَكۡتُبُونَ ٱلۡكِتَٰبَ بِأَيۡدِيهِمۡ ثُمَّ يَقُولُونَ هَٰذَا مِنۡ عِندِ ٱللَّهِ﴾ [البقرة: ٧٩]

সুতরাং ধ্বংস তাদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব লিখে। তারপর বলে, ‘এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে’, যাতে তা তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করতে পারে। (সূরা আল বাকারা: ২: ৭৯)

এখানে ‘নিজ হাতে কিতাব লিখে’ দ্বারা সরাসরি হাত ব্যবহার করে কিতাব লিখাকে বুঝানো হয়েছে।

দ্বিতীয়ত: এখানে যদি উদ্দেশ্য এটাই হত যে, আল্লাহ তা‘আলা সরাসরি তাঁর হাত দ্বারাই চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন, তাহলে বাক্যটি এমন হতো : خلقنا لهم بأيدينا أنعاما (অর্থাৎ আমি তাদের জন্য সৃষ্টি করেছি আমার হাত দ্বারা চতুষ্পদ জন্তু) যেমন আল্লাহ তা‘আলা আদম আ. এর ব্যাপারে বলেছেন:

﴿ قَالَ يَٰٓإِبۡلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَن تَسۡجُدَ لِمَا خَلَقۡتُ بِيَدَيَّۖ﴾ [ص: ٧٥]

আল্লাহ বললেন, ‘হে ইবলীস, আমার দু’হাতে আমি যাকে সৃষ্টি করেছি তার প্রতি সিজদাবনত হতে কিসে তোমাকে বাধা দিল? (সূরা সাদ: ৩৮: ৭৫)

কারণ আল কুরআন অস্পষ্ট নয় বরং সুষ্পষ্ট বর্ণনা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে:

﴿وَنَزَّلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ تِبۡيَٰنٗا لِّكُلِّ شَيۡءٖ﴾ [النحل: ٨٩]

আর আমি তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি প্রতিটি বিষয়ের স্পষ্ট বর্ণনাস্বরূপ। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ৮৯)

অতএব এ আলোচনার দ্বারা প্রথম কথাটির বাতুলতা প্রকাশিত হয়ে গেল, দ্বিতীয় কথাটি যে সঠিক তা প্রমাণিত হয়ে যায়। আর তা হলো: আলোচ্য আয়াতের বাহ্যিক অর্থ হলো, আল্লাহ তা‘আলা চতুষ্পদ জন্তুকে ঠিক সেভাবেই সৃষ্টি করেছেন যেভাবে তিনি সৃষ্টি করেছেন অন্য মাখলুকাতকে। অর্থাৎ তিনি তাঁর হাত দিয়ে সরাসরি সৃষ্টি করেননি। তবে কর্মকে হাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা কর্মকে সত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার মতোই। অতএব আল্লাহ তা‘আলার বাণী, ‘আমার হাতের কৃত বস্তুসমূহের মধ্যে আমি তাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছি’ এর অর্থ ‘আমার সৃষ্ট বস্তুসমূহের মধ্যে আমি তাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছি’। আরবী ভাষার ব্যবহাররীতি এটাই দাবি করে। তবে যদি আরবী ভাষায় يد (হাত) শব্দের পূর্বে بـ অব্যয় থাকে তবে সে সময় সরাসরি হাতই অর্থ হয়ে থাকে। এই পার্থক্যকে জেনে রাখুন। কারণ, এ সাদৃশ্যময় বিষয়সমূহের মধ্যে থাকা পার্থক্য জানা উত্তম ইলমের মধ্যে শামিল। এর দ্বারা অনেক প্রশ্ন সমাধান হয়ে যায়।