দ্বিতীয় মূলনীতি: আল্লাহর নামসমূহ একই মুহূর্তে নাম ও গুণ

নাম এ হিসেবে যে তা আল্লাহ তা‘আলার সত্তাকে বুঝায়। এর পাশাপাশি প্রতিটি নাম যে অর্থ ও ভাবকে নির্দেশ করে, তার নিরিখে প্রতিটি নাম গুণ হিসেবেও বিবেচিত। প্রথমোক্ত বিষয়টির বিবেচনায় যেহেতু প্রতিটি নাম অভিন্ন সত্তা অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলাকে নির্দেশ করছে অতএব তা সমার্থবোধক। আর দ্বিতীয়োক্ত বিষয়টি বিবেচনায় যেহেতু প্রতিটি নাম সুনির্দিষ্ট অর্থবোধক অতএব তা একটি থেকে অন্যটি ভিন্ন। অতএব (الحي - চিরঞ্জীব, العليم - সর্বজ্ঞ, - القديرসর্বশক্তিমান, السميع- সর্বশ্রোতা, البصير - সর্বদ্রষ্টা, الرحمن - পরম করুণাময়, الرحيم - পরম দয়ালু, العزير - সর্বশক্তিমান, الحكيم - প্রজ্ঞাময় ) সবগুলো একই সত্তার নাম। আর সে সত্তা হলেন আল্লাহ তা‘আলা। কিন্তু যেহেতু ‘চিরঞ্জীব’ এর অর্থ ‘সর্বজ্ঞ’ এর অর্থ থেকে ভিন্ন এবং ‘সর্বজ্ঞ’ এর ‘সর্বশক্তিমান’ এর অর্থ থেকে ভিন্ন। অন্যান্য নামের বেলায় একই কথা প্রযোজ্য।

আল্লাহ তা‘আলার নামসমূহ একই মুহূর্তে নাম ও গুণ এ কথার পক্ষে আল কুরআনে প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَهُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ ١٠٧ ﴾ [يونس: ١٠٧]

আর তিনি পরম ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু’। (সূরা ইউনুস: ১০: ১০৭)

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:

﴿ وَرَبُّكَ ٱلۡغَفُورُ ذُو ٱلرَّحۡمَةِۖ﴾ [الكهف: ٥٨]

আর তোমার রব ক্ষমাশীল, দয়াময়। (সূরা আল কাহাফ: ১৮: ৫৮ )

দ্বিতীয় আয়াতটি এ কথা বুঝাচ্ছে যে, ‘আররাহীম’ (পরম দয়ালু ) হলেন তিনি যিনি দয়ার গুণে গুণান্বিত। আরবী ভাষাবিদদের এ ব্যাপারে ঐক্যমত্য রয়েছে যে, যার জ্ঞান রয়েছে কেবল তাকেই জ্ঞানী বলা হবে, যার শ্রবনশক্তি রয়েছে কেবল তাকেই শ্রোতা বলা হবে, যার দৃষ্টিশক্তি রয়েছে কেবল তাকেই দ্রষ্টা বলা হবে। এ কথাটি অত্যন্ত স্পষ্ট, এর পক্ষে কোনো প্রমাণ পেশ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

আল্লাহর নামসমূহ থেকে তার অর্থগুলো যারা সরিয়ে দেয় এ আলোচনার দ্বারা তাদের বাতুলতা ও গোমরাহীর ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা অর্জিত হলো। তাদের বক্তব্য হলো: আল্লাহ তা‘আলা শ্রবনশক্তি ছাড়াই সর্বশ্রোতা, দৃষ্টিশক্তি ছাড়াই সর্বদ্রষ্টা, শক্তি ছাড়াই তিনি শক্তিমান ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা তাদের বক্তব্যের পক্ষে যে যুক্তি পেশ করে তা হলো আল্লাহর জন্য গুণসমগ্র প্রমাণ করলে একই সত্তার জন্য বহুত্বকে প্রমাণিত করা হয়। এটি একটি খোঁড়া যুক্তি, তা বরং নিঃপ্রাণ মৃত যুক্তি; কেননা খোদ আল কুরআনই এ যুক্তিকে বাতিল করে দিয়েছে। মানুষের বুদ্ধি বিবেচনাও এ যুক্তির বিপক্ষে।

আল কুরআন থেকে দলিল: যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা অদ্বিতীয় হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে বহুগুণে গুণান্বিত করে পেশ করেছেন এতএব আল্লাহ তা‘আলার জন্য সিফাত বা গুণ যে প্রমাণিত তা নিঃসন্দেহ। ইরশাদ হয়েছে:

﴿ إِنَّ بَطۡشَ رَبِّكَ لَشَدِيدٌ ١٢ إِنَّهُۥ هُوَ يُبۡدِئُ وَيُعِيدُ ١٣ وَهُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلۡوَدُودُ ١٤ ذُو ٱلۡعَرۡشِ ٱلۡمَجِيدُ ١٥ فَعَّالٞ لِّمَا يُرِيدُ ١٦ ﴾ [البروج: ١٢، ١٦]

নিশ্চয় তোমার রবের পাকড়াও বড়ই কঠিন। নিশ্চয় তিনি সৃষ্টির সূচনা করেন এবং তিনিই পুনরায় সৃষ্টি করবেন। আর তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়াময়। আরশের অধিপতি, মহান। তিনি তা-ই করেন যা চান । (সূরা আল বুরুজ: ৮৫: ১২-১৬ )

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে:

﴿ سَبِّحِ ٱسۡمَ رَبِّكَ ٱلۡأَعۡلَى ١ ٱلَّذِي خَلَقَ فَسَوَّىٰ ٢ وَٱلَّذِي قَدَّرَ فَهَدَىٰ ٣ وَٱلَّذِيٓ أَخۡرَجَ ٱلۡمَرۡعَىٰ ٤ فَجَعَلَهُۥ غُثَآءً أَحۡوَىٰ ٥ ﴾ [الاعلى: ١، ٥]

তুমি তোমার সুমহান রবের নামের পবিত্রতা বর্ণনা কর, যিনি সৃষ্টি করেন। অতঃপর সুসম করেন। আর যিনি নিরূপণ করেন অতঃপর পথ নির্দেশ দেন। আর যিনি তৃণ-লতা বের করেন। তারপর তা কালো খড়-কুটায় পরিণত করেন। (সূরা আল আলা: ১৯: ১-৫)

উল্লিখিত আয়াতসমূহে অদ্বিতীয় সত্তার বহু গুণের কথা রয়েছে, কিন্তু গুণের বহুত্বের কারণে খোদ সত্তার বহুত্ব বহুত্বকে দাবি করে না।

যুক্তিবুদ্ধির দলিল: যেহেতু গুণগুলো গুণান্বিত থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো সত্তা নয়। গুণগুলো বিচ্ছিন্ন সত্তা হলে গুণান্বিত সত্তার বহুত্ব হওয়া দাবি করত; তা বরং গুণধারী সত্তার গুণাবলি যা তাঁর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে কায়েম রয়েছে। শুধু তাই নয়, বরং অস্তিত্বশীল এমন কোনো বিষয় নেই যা বহু গুণ-বিশিষ্ট নয়।

উল্লিখিত আলোচনা থেকে এটাও পরিষ্কার হলো যে ‘আদ-দাহর’ (কাল) আল্লাহর নামসমূহের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়। কেননা আদ-দাহর হলো নামবাচক একটি জমাট শব্দ; যাতে এমন কোনো অর্থ নেই যার কারণে একে আল্লাহর সুন্দর নামসমূহের সঙ্গে যুক্ত করা যাবে। যেহেতু উক্ত শব্দটি কাল ও সময়ের নাম সে হিসেবে আল্লাহ তা‘আলা আখিরাত অস্বিকারকারীদের সম্পর্কে বলেছেন:

﴿ وَقَالُواْ مَا هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا ٱلدُّنۡيَا نَمُوتُ وَنَحۡيَا وَمَا يُهۡلِكُنَآ إِلَّا ٱلدَّهۡرُۚ ﴾ [الجاثية: ٢٤]

আর তারা বলে, ‘দুনিয়ার জীবনই আমাদের একমাত্র জীবন। আমরা মরি ও বাঁচি এখানেই। আর কাল-ই কেবল আমাদেরকে ধ্বংস করে।’ (আল জাছিয়া: ৪৫: ২৪)

এর দ্বারা তারা রাত ও দিনের অতিক্রমকে বুঝিয়েছে।

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন: আদম সন্তান আমাকে কষ্ট দেয়, কারণ সে আদ্দাহার (কাল) কে গালি দেয়। অথচ আমিই কাল, আমার হাতেই সব কিছু, আমি রাত ও দিনের পরিবর্তন ঘটাই।’[1]
এ হাদীসটি আদ-দাহার শব্দটিকে আল্লাহর নাম হিসেবে সাব্যস্ত করছে না; কেননা যারা কালকে গালি দেয়, তাদের উদ্দেশ্য মূলত কালের গর্ভে সংঘটিত ঘটনাসমগ্র। তারা আল্লাহ তা‘আলাকে উদ্দেশ্য করে না। অতএব ‘আমিই কাল’ এ কথাটির ব্যাখ্যা হাদীসের পরবর্তী অংশ থেকেই বুঝা যায় যেখানে বলা হয়েছে, ‘আমার হাতেই সব কিছু, আমি রাত ও দিনের পরিবর্তন ঘটাই’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলাই কাল এবং কালের গর্ভে যা আছে সবকিছুর স্রষ্টা। আর এটা তিনি সুষ্টভাবেই বলেছেন যে তিনি রাত ও দিনের পরিবর্তন ঘটান, আর এ দুটোই হলো কাল। আর এটা সম্ভব নয় যে পরিবর্তনকারী ও পরিবর্তনগ্রহণকারী একই জিনিস হবে। এতএব উক্ত হাদীসে উল্লিখিত ‘আদ-দাহার’ শব্দটির দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা কে বুঝায় না।

>
[1] - বর্ণনায় বুখারী, তাফসীরুল কুরআন অধ্যায়, অনুচ্ছেদ : আমাদের তো কালই ধ্বংস করে, হাদীস নয় ৪৮২৭); মুসলিম, অধ্যায় : শব্দ আদবের অংশ, অনুচ্ছেদ : কালকে গালি দেয়া নিষিদ্ধ, হাদীস নং (২২৪৬)