শারহু মাসাইলিল জাহিলিয়্যাহ শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান ১১৭ টি
শারহু মাসাইলিল জাহিলিয়্যাহ শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান ১১৭ টি

بسم الله الرحمن الرحيم
الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على نبينا محمد وعلى آله وأصحابه أجمعين

সকল প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার জন্য। নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর দরূদ, সালাম ও বরকত বর্ষিত হোক, তার পরিবারবর্গ ও ছাহাবীগণের উপরও শান্তি বর্ষিত হোক।

শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব রহিমাহুল্লাহ তার ‘মাসাইলুল জাহিলিয়্যাহ’ নামীয় পুস্তিকার ভূমিকায় বলেন, ‘এ মাস‘আলাগুলোতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহিল (অজ্ঞ) আহলে কিতাব ও উম্মি (নিরক্ষর) লোকদের বিরোধিতা করেছেন। সুতরাং এসব বিষয়ে কোন মুসলিম অজ্ঞ থাকতে পারে না।

মন্দের বিপরীত বিষয় দ্বারা ভালোটা প্রকাশ পায় এবং বিপরীতমুখী বিষয় দ্বারা বিভিন্ন বিষয় স্পষ্ট হয়।

জাহিলী বিষয়সমূহের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ও মারাত্মক বিষয়

সবচেয়ে ভয়াবহ ও মারাত্মক জাহিলিয়্যাত হচ্ছে, অন্তরে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর নাযিলকৃত ওহীর প্রতি বিশ্বাস না রাখা। এর সাথে যদি জাহিলরা যে নীতি অবলম্বন করতো, তা যুক্ত হয়, তাহলে ক্ষতি পূর্ণতা লাভ করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَالَّذِينَ آمَنُوا بِالْبَاطِلِ وَكَفَرُوا بِاللَّهِ أُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ﴾

‘যারা বাতিলে বিশ্বাস করে ও আল্লাহকে অস্বীকার করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত’ (সূরা আল আনকাবূত ২৯:৫২)।

.............................................

ব্যাখ্যা: এটি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব রহিমাহুল্লাহ এর একটি গবেষণা কর্ম, যার নাম মাসাইলুল জাহিলিয়্যাহ, যে ব্যাপারে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহিলদের বিরোধিতা করেছেন। মাসাইলুল জাহিলিয়্যাহ গ্রন্থে ১২৮ (একশত আটাশ) টি বিষয় উল্লেখ আছে। লেখক কুরআন-সুন্নাহ ও বিদ্বানদের কথা থেকে সেগুলো চয়ন করেছেন।

মাসাইলুল জাহিলিয়্যাহ দ্বারা উদ্দেশ্য

জাহিলী সমস্যা সম্পর্কে মুসলিমদের সতর্ক করা, যাতে তারা সেগুলো থেকে বিরত থাকতে পারে। কেননা সেগুলো মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। যে সব বিষয় বা সমস্যার ব্যাপারে জাহিল কিতাবধারী ও উম্মি বা নিরক্ষরদের রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিরোধিতা করেছেন, তা লেখক রহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেছেন।

কিতাবী দ্বারা আহলে কিতাব তথা ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টান উদ্দেশ্য। কেননা, ইয়াহূদীদের নিকট ছিল তাওরাত, যা মূসা আলাইহিস সালাম-এর উপর নাযিল হয়। আর খ্রিষ্টানদের নিকট ছিল ইনজীল, যা ঈসা আলাইহিস সালাম সালাম-এর উপর নাযিল হয়। এ কারণে তারা আহলে কিতাব নামে অভিহিত। তারা বর্তমানে তাওরাতকে প্রাচীন অঙ্গিকার (ওল্ডটেস্টামেন্ট) অথবা প্রাচীন গ্রন্থ বলে থাকে। আর ইনজিলকে বলে নতুন অঙ্গিকারের পুস্তক (নিউটেস্টামেন্ট)। এসব তাদের পরিভাষা মাত্র।

এ দু’টি মর্যাদা সম্পন্ন মহাগ্রন্থ, আল্লাহ তা‘আলা দু’জন সম্মানিত নাবীর উপর নাযিল করেন; তারা হলেন ঈসা ও মূসা আলাইহিমাস সালাম। বিশেষ করে তাওরাত একটি বড় আসমানী কিতাব আর ইনজিল হলো তাওরাতের পরিপূরক ও সত্যায়নকারী গ্রন্থ। এজন্য তাদেরকে আহলে কিতাব বলা হয়। সুতরাং আহলে কিতাব ও অন্যদের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে অন্যদের কিতাব দেয়া হয়নি।

আরবের যে সব লোক দীনের (তাওরাত বা ইনজিল) উপর ছিল না, তারা উম্মি (أميين) নামে পরিচিত। (الأُمِّيُّون) উম্মিউনা শব্দটি (أمّي) উম্মি এর বহুবচন। শব্দটি (الأم) আল-উম্ম এর দিকে সম্বন্ধিত। আর উম্মি তারা, যারা লিখতে ও পড়তে জানে না। কারণ, তারা (আরবরা) এমন সম্প্রদায়, যাদের অধিকাংশই লেখা পড়া জানতো না। পবিত্র কুরআন নাযিল হওয়ার পূর্বে তাদের নিকট কোন কিতাব ছিল না। একারণে তাদেরকে উম্মি বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولاً مِنْهُمْ﴾ [الجمعة: 2]

তিনিই উম্মীদের মাঝে একজন রসূল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে (সূরা আল জুমু‘আহ ৬২:২)। তিনি আরো বলেন,

﴿وَمَا آتَيْنَاهُمْ مِنْ كُتُبٍ يَدْرُسُونَهَا وَمَا أَرْسَلْنَا إِلَيْهِمْ قَبْلَكَ مِنْ نَذِيرٍ﴾ [سبأ: 44]

আমি তাদেরকে কোন কিতাব দেইনি যা তারা অধ্যয়ন করত এবং তোমার পূর্বে তাদের প্রতি আর কোন সতর্ককারীও প্রেরণ করিনি (সূরা সাবা ৩৪:৪৪)। তিনি আরোও বলেন,

﴿لِتُنْذِرَ قَوْماً مَا أُنْذِرَ آبَاؤُهُمْ فَهُمْ غَافِلُونَ﴾ [يس: 6]

যাতে তুমি এমন এক সম্প্রদায়কে সতর্ক কর, যাদের পিতৃপুরুষদেরকে সতর্ক করা হয়নি, কাজেই তারা উদাসীন (সূরা ইয়াসিন ৩৬:৬)।

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তা’আলা উম্মি বলেছেন। যেমন-

﴿الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوباً عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْأِنْجِيلِ يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ﴾ [الأعراف: 157]

যারা অনুসরণ করে রসূলের যে উম্মী নাবী; যার গুণাবলী তারা নিজেদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়, যে তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করে (সূরা আল ‘আরাফ ৭:১৫৭)।

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে উম্মি বলার কারণ হলো, তিনি পড়তে ও লিখতে জানতেন না। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লেখাপড়া না জানা সত্ত্বেও এ মহাগ্রন্থ নিয়ে আসাই প্রমাণ করে, তার রিসালাত (অহী বার্তা) সত্য এবং এতে তার জন্য মু’জিযাও রয়েছে। অতএব, আরবরা ছিল উম্মি, তাদের নাবীও ছিলেন উম্মি, এটাই উম্মির অর্থ।

(الجاهلية) আল-জাহিলিয়্যাহ শব্দটি (الجهل) আল-জাহ্‌ল থেকে এসেছে। জাহ্‌ল অর্থ হলো জ্ঞানহীনতা, জ্ঞানশূন্যতা। আর জাহিলিয়্যাহ বলা হয় সেই সময়কে, যখন কোন রসূল ও কিতাব ছিল না। এখানে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হওয়ার পূর্বের অবস্থাকে জাহিলিয়্যাহ বলা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى

তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না (সূরা আল আহযাব ৩৩:৩৩)।

এখানে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হওয়ার পূর্বের অবস্থাকে বুঝানো হয়েছে। কেননা তখন গোটা মানবজাতি ভ্রষ্টতা, কুফরী ও নাস্তিকতায় ডুবে ছিল। কারণ কুরআনের পূর্বের রিসালাত বা আসমানী কিতাব নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। ইয়াহূদীরা তাদের কিতাব তাওরাতকে বিকৃত করে। তারা তাতে অনেক কুফরী, ভ্রষ্টতা ও নোংরা কথা সংযোজন করে। এমনিভাবে খ্রিষ্টানরাও ঈসা আলাইহিস সালাম-এর উপর ইনজিল নাযিল হওয়ার সময় তা যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থা থেকে পরিবর্তন করে। ইনজিল পরিবর্তনকারী ব্যক্তির নাম (بلس) বালাস/বুলাস অথবা (شاول) শাবিল। সে ছিল ইয়াহূদী এবং নাবী ঈসা আলাইহিস সালাম এর প্রতি বিদ্বেষী। এ লোক ষড়যন্ত্র ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ঈসা আলাইহিস সালাম এর দীনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। সে ঈসা আলাইহিস সালাম এর উপর ঈমান আনার ভাব দেখায়। সে প্রকাশ করে যে, সে ঈসা আলাইহিস সালাম এর সাথে পূর্ব শত্রুতার জন্য অনুতপ্ত। তার দাবী অনুযায়ী সে একটি স্বপ্ন দেখার পর ঈসা আলাইহিস সালাম এর উপর ঈমান আনে। খ্রিষ্টানরা তার কথাকে সত্যায়ন করল। অতঃপর সে ঈসা আলাইহিস সালাম এর উপর অবতীর্ণ ইনজিল নিল। তারপর সে ইনজিল কিতাবে পৌত্তলিকতা, শিরক ও কুফরী ঢুকিয়ে দেয়।

এমনকি তাতে ত্রিত্ববাদও উল্লেখ করে অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তিন উপাস্যের একজন (না‘ঊযুবিল্লাহ)। আর ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর পুত্র অথবা তিনি আল্লাহ (নাউযুবিল্লাহ)। সে তাতে ক্রুশের ইবাদতের বিষয়টি প্রবেশ করায়। এছাড়া আরো অন্যান্য ঘৃণ্য কুফরী সে তাতে প্রবেশ করায়। আর খ্রিষ্টানরা তাকে আলিম এবং ইনজীলে বিশ্বাসী মনে করে এসব ব্যাপারে তার কথার সত্যায়ন করে। তাদের দাবি অনুযায়ী, তারা তাকে বালাস অথবা ঈসা আলাইহিস সালাম এর দূত (রসূল) বলে গণ্য করে । ঈসা আলাইহিস সালাম এর দীনে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়াই তার লক্ষ্য ছিল। তার ইচ্ছা পূরণ হয়। পৌত্তলিকতা, ত্রিত্ববাদ এবং ঈসা আলাইহিস সালাম কে আল্লাহর পুত্র সাব্যস্ত করার আক্বীদা অথবা তিনি তিন জনের একজন, এসবের মাধ্যমে সে ঈসা আলাইহিস সালাম এর দীনকে নষ্ট করে। সে তাতে অনেক পৌত্তলিকতার অনুপ্রবেশ ঘটায় এবং খ্রিষ্টানরাও তাকে মেনে নেয়। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হওয়ার পূর্বে এটা ছিল আহলে কিতাবদের অবস্থা। তবে তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক সঠিক দীনের উপর ছিল। তাদের অধিকাংশই কুফরী ও আল্লাহর দীনের পরিবর্তনের উপর ছিল।

আরবরা দু’ভাগে বিভক্ত:

(১) পূর্ববর্তী দীনের অনুসারী। যেমন-ইয়াহুদী, খ্রিষ্টান ও অগ্নিপূজক

(২) একনিষ্ঠ দীনে বিশ্বাসী। ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমাস সালাম এর দীনে বিশ্বাসীরা। বিশেষত হিজায ও মক্কা অঞ্চলে।

তাদের মাঝে একজন লোক ছিল, তার নাম আমর ইবনু লুহাই আল-খুযাঈ। তিনি হিজাযের শাসক ছিলেন। তিনি ইবাদত, ন্যায়নিষ্ঠতা ও যথাযথ ধার্মিকতা প্রকাশ করতো। তিনি চিকিৎসার জন্য সিরিয়া গমন করেন। সেখানে সিরিয়াবাসীকে মূর্তিপূজায় লিপ্ত দেখে তা ভাল মনে করেন। এ কারণে চিকিৎসা শেষে সিরিয়া থেকে কিছু মূর্তি নিয়ে ফিরে আসেন। তিনি ঐসব মূর্তি খুঁজতে থাকেন, যা নুহ আলাইহিস সালাম এর যুগের পর ভেঙ্গে মাটির সাথে মিশে যায়।

মূর্তিগুলো হলো: ওয়াদ, সূয়া, ইয়াগূস, ইয়াউক্ব, নাসর ইত্যাদি। তুফানে মূর্তিগুলো ভেঙ্গে যায়। তারপর শয়তান এসে ঐ সব মূর্তির জায়গাসমূহ দেখিয়ে দেয়। এরপর সে মূর্তি খুঁজে বের করে। তারপর আরবের বিভিন্নণ গোত্রের মাঝে মূর্তিগুলো বণ্টন করে দেয় এবং সেগুলোর ইবাদতের আদেশ করে। আরববাসীরা তার নিকট থেকে মূর্তিগুলো গ্রহণ করে। এভাবে হিজায ও আরবের অন্যান্য এলাকায় শিরকের বিস্তার ঘটে। তারা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর দীনকে পরিবর্তন করে। আর তারা ঐ সব মূর্তিগুলোর নামে চতুষ্পদ জন্তু ছেড়ে দেয়।

এজন্য নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমরকে জাহান্নামে হাড় টানাটানি করতে দেখেন অর্থাৎ সে তার নাড়িভূড়ি টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে মানুষ স্পষ্ট ভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত ছিল। কিতাবধারী, উম্মি (নিরক্ষর) ও অন্যান্য সবাই পথভ্রষ্ট ছিল। তবে কতিপয় আহলে কিতাব সঠিক দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু তারা নবুওয়াতের পূর্বে শেষ হয়েছে। ফলে, যমীনে অন্ধকার ভরে যায়। হাদীসে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীবাসীর প্রতি দৃষ্টি ফিরালেন। অতঃপর আরব-অনারব সবার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করলেন অর্থাৎ ক্রোধ দেখালেন। তবে কতিপয় আহলে কিতাব ব্যতীত।[1]


এই ঘোর অমানিশা, চূড়ান্ত জাহিলিয়্যাত, পথহারা পরিবেশ এবং আসমানী রিসালাত ও কিতাবের অনুপস্থিতিতে মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে পথ দেখানোর জন্য আল্লাহ তা‘আলা নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولاً مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلالٍ مُبِينٍ

অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের প্রতি একজন রসূল পাঠিয়েছেন, যে তাদের কাছে তার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে আর তাদেরকে কিতাব ও হিক্বমাত শিক্ষা দেয়। যদিও তারা ইতঃপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল। (সূরা আলে ইমরান ৩:১৬৪)।


তারা পূর্বে স্পষ্ট ভ্রষ্টতায় ছিল অর্থাৎ নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে ভ্রষ্ট ছিল

পূর্বে জাহিলিয়্যাহ (الجاهلية) শব্দের বিশ্লেষণ করা হয়েছে যে, এটি (الجهل) থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো জ্ঞানশূন্যতা, মূর্খতা। আর যা কিছু জাহিলিয়্যাতের দিকে সম্বন্ধিত, তা-ই নিন্দনীয়। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى

তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না (সূরা আল আহযাব ৩৩:৩৩)।

আল্লাহ তা‘আলা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্ত্রীদেরকে সৌন্দর্য প্রকাশ করতে নিষেধ করেন। এখানে সৌন্দর্য প্রকাশের অর্থ হলো, হাট-বাজার ও মানুষের সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ করা। কেননা, জাহিলী যুগের মহিলারা সৌন্দর্য প্রকাশ করতো; বরং গোপন অঙ্গও প্রকাশ করে দিতো। যেমন-কাবা তাওয়াফের সময়ও মহিলারা অহংকারবশত সৌন্দর্য প্রকাশ করতো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِذْ جَعَلَ الَّذِينَ كَفَرُوا فِي قُلُوبِهِمُ الْحَمِيَّةَ حَمِيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ

যখন কাফিররা তাদের অন্তরে আত্ম-অহমিকা পোষণ করেছিল, জাহেলী যুগের আহমিকা (সূরা আল ফাতাহ ৪৮:২৬)।

এখানে নিন্দা অর্থে এটি ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ জাহিলী অহমিকা প্রদর্শন নিকৃষ্ট কাজের অন্তর্ভুক্ত। কোন এক যুদ্ধে আনসার ও মুহাজির দু’জন লোকের মাঝে দ্বন্দ্ব হয়। তারা উভয়ে নিজ নিজ গোত্রের লোকদেরকে সাহায্যের জন্য ডাকতে থাকেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ পেয়ে তাদেরকে বললেন,

أبدعوى الجاهلية وأنا بين أظهركم؟! دعوها فإنها منتنة

‘তোমরা কি জাহিলদের মত ডাকাডাকি শুরু করেছ? অথচ আমি তোমাদের মাঝে বিদ্যমান। এ ধরণের হাঁকডাক ছেড়ে দাও, কেননা তা নিকৃষ্ট কাজ।[2]

অর্থাৎ গোত্র নিয়ে দ্বন্দ্ব খারাপ কাজ। মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। আনসার ও মুহাজিরের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। বিভিন্ন গোত্রের মাঝেও কোন পার্থক্য নেই। বিশ্বাসগতভাবে তারা ভাই ভাই এবং একটি দেহ ও নির্মিত ভবনের মত, যার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরস্পর সম্পৃক্ত। মুসলিমদের উপর আবশ্যক হলো, আরব ও অনারব এবং বিভিন্ন বর্ণ গোত্রের মাঝে তাক্বওয়া (আল্লাহ ভীরুতা) ছাড়া পার্থক্য সৃষ্টি না করা। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ

আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন (সূরা আল হুজরাত ৪৯:১৩)। তিনি আরো বলেন,

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ

নিশ্চয় মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপোষ মীমাংসা করে দাও (সূরা আল হুজরাত ৪৯:১০)।

অতএব, বংশ ও গোত্রের অহমিকা জাহিলী কাজ। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

من مات وليس في عنقه بيعة مات ميتة جاهلية

‘যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলো, অথচ তার কাঁধে আনুগত্যের বাই‘আত নেই, সে জাহিলিয়্যাতের উপর মৃত্যুবরণ করলো’।[3]

কারণ, জাহিল জাতি হলো নৈরাজ্যবাদী। তারা কোন আমীর-শাসক বা সুলতান-সম্রাটকে পরোয়া করে না। এ হলো জাহিলীদের অবস্থা।

সারকথা হলো, জাহিলী সব কর্মকাণ্ড নিকৃষ্ট ও নিন্দনীয়। জাহিলদের মতো কর্মকাণ্ড করতে আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর জাহিলী যুগের সমাপ্তি হয়। নবুওয়াতের পর সাধারণ জাহিলিয়্যাতের অবসান হয়। মানুষের মাঝে দীনের জ্ঞান চর্চা ও ঈমান ফিরে আসে। কুরআন-সুন্নাহ নাযিল হয়, জ্ঞানচর্চা চলতে থাকে। ফলে জাহিলিয়্যাত তথা অজ্ঞতা দূরীভূত হয়। কেননা যতক্ষণ কুরআন, হাদীছ এবং বিদ্বানদের কথা চর্চা হয়, ততক্ষণ জাহিলিয়্যাত থাকতে পারে না। ঐ সময় সাধারণ জাহিলিয়্যাতের অবসান হয়। তবে কিছু মানুষ অথবা গোত্র অথবা কিছু অঞ্চলে জাহিলিয়্যাত থাকতে পারে অর্থাৎ আংশিক জাহিলিয়্যাত থাকতে পারে।

এক ব্যক্তি তার ভাইকে ‘হে কালোর বেটা!’ বলে গালমন্দ করছিলেন, তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন,

أعيّرته بأمه؟ إنك امرؤ فيك جاهلية

‘তুমি কি তার মায়ের নাম ধরে গালি দিলে? তুমিতো এমন লোক, যার মাঝে এখনও জাহিলিয়্যাত আছে’।[4]


নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

أربع في أمتي من أمور الجاهلية لا يتركونهن: الطعن في الأنساب، والفخر بالأحساب، والنياحة على الميت، والاستسقاء بالنجوم

আমার উম্মাতের মাঝে চারটি জাহিলিয়্যাতের রীতি চালু থাকবে, যা তারা পরিত্যাগ করবে না: গোত্রের গৌরব করা। বংশ মর্যাদার খোঁটা দেয়া। মৃতের জন্য কান্না-বিলাপ করা। তারকারাজীর মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করা’।[5]

হাদীছটি প্রমাণ করে, কিছু মানুষের মাঝে এ নিকৃষ্ট জাহিলী রীতি চালু থাকবে। তবে এসবের মাধ্যমে তারা কাফির হবে না। আল্লাহর রহমতে সাধারণ জাহিলিয়্যাত দূরীভূত হয়েছে। এ জন্য বলা বৈধ নয় যে, মানুষ জাহিলিয়্যাতের মধ্যে আছে অথবা জাহিলী জগত। কেননা এভাবে বলা রিসালাত ও কুরআন-সুন্নাহকে অস্বীকার করার অন্তর্ভুক্ত। তাই এটা বলা বৈধ নয়।

বরং এভাবে বলতে হবে যে, কিছু মানুষের মাঝে জাহিলিয়্যাত আছে অথবা কিছু ব্যক্তি জাহিলী স্বভাবের। অথবা জাহিলী স্বভাবের কিছু অংশ বিদ্যমান। এভাবে বললে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়াত লাভের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যুগের মাঝে পার্থক্য সূচিত হবে।

কিছু মানুষ বলতে পারে, জাহিলিয়্যাত যেহেতু শেষ হয়েছে, তাহলে জাহিলী বিষয়সমূহ আলোচনার প্রয়োজন কি? আমরা তো মুসলিম। প্রশংসা আল্লাহরই।

জবাব হলো, জাহিলী সমস্যা থেকে বেঁচে থাকা। এ বিষয়ে জ্ঞানার্জন করে মানুষ সতর্ক হবে। তা না হলে মানুষ বুঝবে না। তখন সে তাতে জড়িয়ে যেতে পারে। জাহিলী কর্ম থেকে সতর্ক ও বিরত থাকার জন্য এ সম্পর্কে আলোচনা ও গবেষণা হওয়া দরকার।

কবি বলেন: আমি জেনেছি মন্দ, প্রয়োগের জন্য নয়, যেন তাতে সদা সতর্কতা রয়, যে জানেনি তাহা, ডুবে রবে সেথায়।

জাহিলী সমস্যা সম্পর্কে জানার এটি প্রথম দিক। আর দ্বিতীয় দিক হলো যখন জাহিলিয়্যাত সম্পর্কে জ্ঞানার্জন হবে তখন ইসলামের মর্যাদা বুঝা যাবে। কবি বলেন:

মন্দের বিপরীতে ভাল প্রকাশ পায়। বিপরীতমুখী বিষয় দ্বারা অনেক কিছু জানা যায়।

উমার ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন:

يوشك أن تنقض عرى الإسلام عروة عروة، إذا نشأ في الإسلام من لا يعرف الجاهلية

‘ইসলামের রশি একটা একটা করে ছিড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তখনই, যখন কেউ ইসলামের ছায়ায় বড় হয়েও জাহিলিয়্যাত সম্পর্কে জানবে না’। সুতরাং জাহিলী বিষয়ে মানুষ অজ্ঞ হলে জাহিলী কর্মে লিপ্ত হতে পারে। কেননা শয়তান জাহিলী কর্ম ভুলে যায়নি এবং সে অসচেতনও নয়, বরং সে জাহিলী কাজ কর্মের দিকেই মানুষকে ডাকে।

শয়তান ও তার অনুসারীরা ভ্রষ্টতার দিকে আহবানকারী, জাহিলী কর্ম উজ্জীবিত করা, শিরক, বিদ‘আত, কুসংস্কার ও প্রাচীনত্বের দিকে তারা ডাকতেই থাকে। এসবের উদ্দেশ্য হলো: ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা ও মানুষকে জাহিলিয়্যাতের দিকে ডাকা। সুতরাং জাহিলিয়্যাত থেকে বিরত ও দূরে থাকার জন্য এ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানার্জন আবশ্যক।

শাইখ রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘সবচেয়ে ভয়াবহ ও মারাত্মক জাহিলিয়্যাত হচ্ছে, অন্তরে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর নাযিলকৃত ওহীর প্রতি বিশ্বাস না রাখা’। কেননা জাহিলরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে এবং তাকে বিশ্বাস করে না। আর তারা আল্লাহ তা‘আলার পথ নির্দেশনা গ্রহণ করে না, যা তিনি নিয়ে এসেছেন। শাইখ রহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘এর সাথে যদি জাহিলরা যে নীতি অবলম্বন করতো, তা যুক্ত হয়, তাহলে ক্ষতি পূর্ণতা লাভ করবে’। অর্থাৎ প্রকাশ্য ও গোপনে ফাসাদ (বিশৃঙ্খলা) ছড়িয়ে পড়বে।

গোপন ফাসাদ হচ্ছে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন, তার প্রতি বিশ্বাস না থাকা। আর প্রকাশ্য ফাসাদ হচ্ছে জাহিলী বিষয়সমূহকে ভাল মনে করে পালন করা। এভাবে প্রকাশ্য ও গোপন বিষয় ধ্বংস হলে তখন ক্ষতি পূর্ণতা পায়। আমরা এ থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

এটাই হলো জাহিলিয়্যাত সম্পর্কে না জানার কুফল। সুতরাং জাহিলরা যেসব কুনীতির উপর ছিল, তাকে ভাল মনে করা বৈধ নয়। বরং আবশ্যক হলো, এটাকে অস্বীকার করা ও তা জঘন্য মনে করা। সেজন্য, যারা জাহিলী কর্মকে ভাল মনে করে, তারা তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে শাইখের দলীল:

وَالَّذِينَ آمَنُوا بِالْبَاطِلِ وَكَفَرُوا بِاللَّهِ أُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ

যারা বাতিলে বিশ্বাস করে ও আল্লাহকে অস্বীকার করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত (সূরা আল আনকাবূত ২৯:৫২)।

বাতিলের প্রতি ঈমান এনেছে অর্থাৎ বাতিলকে বিশ্বাস করেছে। বাতিল হলো হক্বের বিপরীত। কোন বিষয় হক্বের বিরোধী হলে তা বাতিল বলে গণ্য। বাতিল হলো উদ্ভূত ধ্বংসশীল বিষয়, যাতে কোন উপকার নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَمَاذَا بَعْدَ الْحَقِّ إِلَّا الضَّلالُ فَأَنَّى تُصْرَفُونَ

অতঃপর সত্যের পর ভ্রষ্টতা ছাড়া কী থাকে? অতএব কোথায় তোমাদেরকে ফেরানো হচ্ছে? (সূরা ইউনূস ১০:৩২)।

[1]. ছ্বহীহ: মুসনাদে আহমাদ ১৭৪৮৪।

[2].ছ্বহীহ বুখারী ৩৫১৮, ৪৯০৫; মুসলিম ২৫৮৪।

[3]. ছ্বহীহ মুসলিম ১৮৫০।

[4]. ছ্বহীহ বুখারী ৩০, ২৫৪৫, ৬০৫০।

[5]. ছ্বহীহ বুখারী, ছ্বহীহ মুসলিম হা/৯৩৪।

 জাহেলী যুগে আরবের লোকেরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা এবং ইবাদত করার সময় নেককার লোকদের শরীক করতো। এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর নিকট তাদের সুপারিশ (শাফা‘আত) কামনা করতো। তারা ধারণা করতো যে, আল্লাহ তা‘আলা এমনটি পছন্দ করেন এবং নেককার লোকেরাও তা পছন্দ করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لا يَضُرُّهُمْ وَلا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ) [يونس: 18]

আর তারা আল্লাহ ব্যতীত এমন কিছুর ইবাদত করছে, যা তাদের ক্ষতি করতে পারে না এবং উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, এরা আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী (সূরা ইউনুছ ১০:১৮)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

(وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى) [الزمر: 3]

আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা কেবল এজন্যই তাদের ‘ইবাদত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে’ (সূরা আয যুমার ৩৯:৩)।

এটিই ছিল সব চেয়ে বড় বিষয়, যে ব্যাপারে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাফিরদের বিরোধিতা করেছেন। তিনি একনিষ্ঠতা (ইখলাস) বর্ণনা করলেন এবং লোকদের জানিয়ে দিলেন যে, এটাই হচ্ছে আল্লাহর দীন, যে দীন দিয়ে তিনি সকল রসূলকে পাঠিয়েছেন এবং তিনি একনিষ্ঠ আমল ছাড়া অন্য কোন আমল গ্রহণ করেন না। তিনি আরো বললেন যে, যারা তাদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী আমল করবে, আল্লাহ তাদের উপর জান্নাতকে হারাম করে দিবেন এবং তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম।

এ বিষয়টার কারণেই মানব জাতি ‘মুসলিম’ ও ‘কাফির’ দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এর কারণেই শত্রুতা সৃষ্টি হয়েছে এবং জিহাদ বিধিবদ্ধ হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ) [الأنفال: 39]

আর তোমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর যতক্ষণ না ফিতনার অবসান হয় এবং দীন পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায় (সূরা আল আনফাল ৮:৩৯)।

ব্যাখ্যা: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْأِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ

আর আমি জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার ‘ইবাদত করবে (সূরা আয যারিয়াত ৫১:৫৬)।

‘ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার অধিকার। তার সাথে অন্য কাউকে অংশীদার স্থাপন করে তার ইবাদত করা বৈধ নয়, সে যেই হোক না কেন। জাহিলরা এ নির্দেশটি উল্টিয়ে দেয়। তারা আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত ছেড়ে দেয় অথচ এজন্যই তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তারা আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে মূর্তি, গাছ, পাথর, ফেরেশতা, জিন, আওলীয়া ও নেককার লোকদের ইবাদত করে। এভাবে তারা আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যের জন্য ইবাদত করে।

জাহিলদের মধ্যে কেউ কেউ আদৌ আল্লাহর ইবাদত করে না; আর তারা হচ্ছে, কাফির ও বস্তুবাদী নাস্তিক। আবার কেউ কেউ আল্লাহ্‌র ইবাদত করে, তবে তার সাথে অন্যের ইবাদতও করে। মূলতঃ তাদের বিধানও কাফির-নাস্তিকদের মতই। যারা আল্লাহর সাথে অন্যের ইবাদত করে, তারা ঐ লোকদের মত, যারা আদৌ আল্লাহর ইবাদত করে না। কেননা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত বাতিল। আর আল্লাহ তা‘আলা তার সাথে অংশীদারিত্ব পছন্দ করেন না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমল শরী‘আত সম্মত হওয়া আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা বিদ‘আতী আমল কবুল করেন না, অনুরূপভাবে তিনি শিরকযুক্ত আমলও গ্রহণ করেন না। সেজন্য, সবচেয়ে মারাত্মক ও ভয়াবহ জাহিলিয়্যাত হচ্ছে, আল্লাহর সাথে শরীক করা এবং বিদ‘ধাতী কাজ করা।

শাইখ রহিমাহুল্লাহ এ বিষয় দিয়ে তার আলোচনা শুরু করেছেন। কেননা জাহিলী বিষয়সমূহের মধ্যে তা সবচেয়ে মারাত্মক। এজন্য রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়কে অস্বীকার করা এবং তা মানুষকে ছেড়ে দেয়ার আহবান জানাতেন। অন্যান্য নাবী-রসূলগণের মত রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের নির্দেশ দিতেন। আর আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত ছেড়ে দিতে বলতেন। এটা ছিল রসূলগণের দাওয়াতের সূচনা। কেননা তাওহীদ সকল আমলের মূল ভিত্তি। এটা বিনষ্ট হলে আমল মূল্যহীন বলে গণ্য হয়। তাওহীদ ব্যতীত ছ্বলাত, সিয়াম, হাজ্জ, যাকাত ও অন্যান্য সকল প্রকার ইবাদত মূল্যহীন। যেহেতু মূলভিত্তি তথা তাওহীদ বিনষ্ট হয়েছে, তাই কোন আমলই মূল্যায়ন যোগ্য নয়। শিরকের কারণে আমল বিনষ্ট ও বাতিল বলে গণ্য হয়।

জাহিলীযুগে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের সাথে বিভিন্ন বস্তুর ইবাদত করা হতো। যেমন- আওলীয়া ও নেক লোকদের ইবাদত করা: নূহ আলাইহিস সালাম এর জাতি সৎ লোকদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে- যেমন-ওয়াদ, সূয়া, ইয়াগুস ও নসর আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত ব্যতীত তারা এসব লোকদের কবর পূজা করতো। তারা মনে করতো এসকল ব্যক্তি সৎ, তারা আমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার নিকটবর্তী করে দিবে এবং আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবে। তারা এর উপর ভিত্তি করে আওলীয়া, নেকলোক ও ফিরিশতাদের ইবাদত করতো। তারা বলে: তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দিবে এ কারণে তাদের ইবাদত করি। তাদের কথা: তারাই আল্লাহর নিকট আমাদের জন্য সুপারিশ করবে। তারা আওলীয়া, নেকলোক ও ফিরিশতাদেরকে আল্লাহর শরীক মনে করতো না। বরং তারা বলতো, আমাদের জন্য তারা আল্লাহর নিকটে পৌছার মাধ্যম এবং তারা আল্লাহর নিকট আমাদের জন্য সুপারিশ করবে। তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম। তাদের কাজকর্মকে তারা শিরক মনে করে না। কেননা শয়তান এভাবে তাদের কর্মকে সৌন্দর্য মন্ডিত করে যে, এটা শিরক নয়। বরং এটা নেক লোকদের ওসীলা বা মাধ্যম ও সুপারিশ মাত্র। তারা বলে যে, নাম দিয়ে উপকার পাওয়া হয় না। বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে উপকার লাভ করতে হয়। যদিও তারা সুপারিশ ও নৈকট্য লাভ করার জন্য নাম ব্যবহার করে তবুও তা শিরক। কেননা নাম দিয়ে কখনো বাস্তব অবস্থার পরিবর্তন করা যায় না। আল্লাহ তা‘আলা তার ইবাদতে কাউকে অংশীদার করা পছন্দ করেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(فَمَنْ كَانَ يَرْجُوا لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلاً صَالِحاً وَلا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَداً) [الكهف: 110]

সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে (সূরা আল কাহাফ ১৮:১১০)। তিনি আরো বলেন,

(فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصاً لَهُ الدِّينَ) [الزمر: 2]

অতএব আল্লাহর ‘ইবাদত কর তারই আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে (সূরা আয যুমার ৩৯:২)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

(وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ [سورة البينة: 5]

আর তাদেরকে কেবল এ নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদত করে তারই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে(সূরা আল বায়্যিনাহ ৯৮:৫)।

তিনি আরো বলেন,

فَادْعُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ

সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ডাক, তার উদ্দেশ্যে দীনকে একনিষ্ঠভাবে নিবেদিত করে (সূরা গাফির ৪০:১৪)।

ইখলাস (একনিষ্ঠতা) ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ অনুসরণ ছাড়া ইবাদত মূল্যহীন। জাহিলিয়্যাতের বড় সমস্যা হচ্ছে আওলীয়া ও নেক লোকদের ইবাদত করা, মৃত ও অস্তিত্বহীনদের নিকট সাহায্য কামনা ও আশ্রয় প্রার্থনা করা, তাদের কাছে অভাব-অভিযোগ পেশ করা। যেমনভাবে বর্তমানে এসবকে কেন্দ্র করে কবর পূজা করা হয়। কবর পূজা, মৃতদের কাছে নৈকট্য লাভ করা ও আল্লাহ ব্যতীত তাদেরকে ডাকা ও তাদের কাছে সাহায্য কামনা করা বর্তমান চালু আছে যা জাহিলী কর্ম বলে গণ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لا يَضُرُّهُمْ وَلا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ) [يونس:18]

আর তারা আল্লাহ ব্যতীত এমন কিছুর ইবাদত করছে, যা তাদের ক্ষতি করতে পারে না এবং উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, এরা আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী (সূরা ইউনূস ১০:১৮)।

অনুরূপভাবে বস্তু পূজাও বর্তমান চালু আছে। ঐ সব কবর পূজারীদেরকে কবর পূজার বৈধতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ ও তা থেকে নিষেধ করা হলে তারা বলে, আমরা কবর পূজা করি না, আর ইবাদততো আল্লাহর জন্যই হয়। আমাদের জন্য তারা আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভ ও সুপারিশের মাধ্যম। জাহিলদের এ বিষয়কে আল্লাহ তা‘আলা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لا يَضُرُّهُمْ وَلا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ) [يونس:18]

আর তারা আল্লাহ ব্যতীত এমন কিছুর ইবাদত করছে, যা তাদের ক্ষতি করতে পারে না এবং উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, এরা আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী (সূরা ইউনূস ১০:১৮)।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

(وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى) [الزمر: 3]

আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা কেবল এজন্যই তাদের ‘ইবাদত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে’ (সূরা আয যুমার ৩৯:৩)।

তারা তাদের ইবাদত করে না কিন্তু তারা মনে করে যে, সৃষ্টি করা, রিযিক দেয়া ও জীবন-মৃত্যুতে তারা আল্লাহর অংশীদার (নাউযুবিল্লাহ) অথচ তারা জানে একমাত্র আল্লাহই সব কিছুর মালিক। তারা আওলীয়া ও নেক লোকদের ইবাদত করে যাতে তারা আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। তারা বলে থাকে, আমরা পাপী বান্দা। যেহেতু তারা নেক লোক, এ হিসাবে আল্লাহর নিকট তাদের মর্যাদা আছে। তাই আমাদের তাওবা ও ইবাদত আল্লাহর নিকট কবুল হওয়ার জন্য তাদের মাধ্যম অবলম্বন করি। এ জন্য শয়তান জিন ও মানবজাতিকে এ কাজটি তাদের জন্য সৌন্দর্য মন্ডিত করে। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো তারা কুরআন পাঠ করে, এ সম্পর্কিত আয়াতও জানে কিন্তু তারা সতর্ক হয় না। এ সত্ত্বেও তারা কবর পূজায় অবিচল থাকে। আর কবর পূজা জাহিলী কর্ম। জাহিলিয়্যাত, জাহিলী কাজকর্ম ও তার কুফল সম্পর্কে তারা অবগত নয়।

শাইখ রহিমাহুল্লাহ বলেন, এটা হলো বড় সমস্যা যে বিষয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিরোধিতা করেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একনিষ্ঠতার কথা বর্ণনা করেন। আর আল্লাহর যে দীনের উপর রসূলগণ প্রেরিত, তা তিনি প্রচার করেন। একনিষ্ঠতা ছাড়া আমল কবুল হয় না তা মানুষকে অবহিত করেন। তিনি আরোও বলেন, ইখলাস ব্যতীত উত্তম মনে করে যারা কোন আমল করে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য জান্নাত হারাম করেন, তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম। এটা এমন সমস্যা যার কারণে মুসলিম ও কাফিরের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি হয়। আর কাফিরদের শত্রুতার কারণে জিহাদ বিধিবদ্ধ হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ) [الأنفال: 39]

আর তোমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর যতক্ষণ না ফিতনার অবসান হয় এবং দীন পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায় (সূরা আল আনফাল ৮:৩৯)।

আল্লাহ তা‘আলার নিকট অভাব-অভিযোগ পেশ করতে বান্দাকে মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করার প্রয়োজন আছে কি অথচ আল্লাহ তা‘আলা বান্দার নিকটে থেকে সাড়াদানকারী? তিনি বান্দার কথা শুনেন, তাদেরকে দেখেন, দয়া করেন ও তাদের তাওবা কবুল করেন। তিনি আমাদেরকে দু‘আয় কোন মাধ্যম অবলম্বন করার নির্দেশ দেননি। বরং তিনি আমাদেরকে সরাসরি তার নিকট দু‘আ করতে বলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(فَادْعُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ) [غافر: 14]

সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ডাক, তার উদ্দেশ্যে দীনকে একনিষ্ঠভাবে নিবেদিত করে (সূরা গাফির ৪০:১৪)।

(وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُنِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ) [غافر:60]

আর তোমাদের রব বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের জন্য সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা অহঙ্কার বশতঃ আমার ইবাদত হতে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে’ (সূরা গাফির ৪০:৬০)।

আল্লাহ তা‘আলা কোন মাধ্যম ছাড়া সরাসরি তার কাছে দু‘আ করার নির্দেশ দেন। শিরক হলো মারাত্নক সমস্যা যে ব্যাপারে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহিলদের বিরোধিতা করেন। কেননা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের মাঝে প্রেরিত হয়ে প্রথমে আল্লাহ তা‘আলার একত্বের দিকে দাওয়াত দেন এবং শিরক পরিত্যাগ করতে বলেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

قولوا: لا إله إلا الله؛ تفلحوا

তোমরা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বল, অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন প্রকৃত উপাস্য নেই, তাহলে তোমরা সফলতা লাভ করবে।[1] তিনি আরো বলেন,

أُمرت أن أقاتل الناس حتى يقولوا: لا إله إلا الله، فإذا قالوها عصموا مني دماءهم وأموالهم

অর্থাৎ আমি মানুষের সাথে সংগ্রাম করতে আদিষ্ট হয়েছি যতক্ষণ না তারা বলে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন প্রকৃত উপাস্য নেই। তারা এটা স্বীকার করলে আমার পক্ষ থেকে তাদের জীবন ও ধনসম্পদের নিরাপত্তা থাকবে।[2]

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাবেশে, আবাসস্থলে, আর হাজ্জের মৌসুমে তাদের মাঝে উপস্থিত হয়ে আল্লাহর একত্বের দাওয়াত দিতেন এবং দাওয়াতী কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় যেতেন। যেমন তিনি তায়েফবাসীদেরকে আল্লাহর একত্বের দাওয়াত দেন। ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার একত্ব প্রকাশ করা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমেই একত্বের দিকে মানুষকে দাওয়াত দেন। এজন্য দা‘ঈর উপর আবশ্যক হলো দাওয়াতী কাজে তাওহীদের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইখলাস (একনিষ্ঠতা) ও একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদতের দিকে দাওয়াত দেন এবং আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আওলীয়া, নেকলোক ও অন্যান্যের ইবাদত পরিত্যাগ করতে বলেন। এটাই ছিল রসূলগণের দীন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ [الأنبياء:25]

আর তোমার পূর্বে এমন কোন রসূল আমি পাঠাইনি যার প্রতি আমি এই ওহী অবতরণ করিনি যে, ‘আমি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই; সুতরাং তোমরা আমার ইবাদত কর’ (সূরা আল আম্বিয়া ২১:২৫)।

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولاً أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ) [النحل: 36]

আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতিতে একজন রসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং পরিহার কর ত্বাগূতকে (সূরা আন নাহাল ১৬:৩২)।

এটাই ছিল রসূলগণের দাওয়াতী পদ্ধতি যার মাধ্যমে তারা আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান করেন। আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত সব কিছুকে পরিত্যাগ করতে বলেন এবং ধারাবাহিকভাবে মানুষকে সংশোধনের আহবান জানান। আর আল্লাহ তা‘আলা তার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে শিরকমুক্ত আমল ও ইখলাস (একনিষ্ঠতা) ব্যতীত কোন কিছু কবুল করেন না। আর আমল কবুল হওয়ার জন্য তা শরীয়ত সম্মত হওয়া আবশ্যক। তাই বিদ‘আতী আমল আল্লাহ তা‘আলা কবুল করেন না, আর শিরকযুক্ত আমলও গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَمَنْ كَانَ يَرْجُوا لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلاً صَالِحاً وَلا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَداً) [الكهف: 110]

সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে (সূরা আল কাহাফ ১৮:১১০)।

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئاً

তোমরা ইবাদত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না (সূরা আন নিসা ৪:৩৬)।

আল্লাহ তা‘আলা তার ইবাদতের নির্দেশ দিয়ে ক্ষান্ত হননি, তিনি শিরক থেকেও বান্দাকে বিরত থাকতে বলেন। কারণ শিরক মিশ্রিত আমল আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। আর ঈমান আনয়নের পূর্বে ত্বাগুতকে অস্বীকার করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لا انْفِصَامَ لَهَا [البقرة: 256]

অতএব, যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয় (সূরা আল বাক্বারাহ ২:২৫৬)।

এটিই হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর অর্থ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন উপাস্য নেই। আর কালিমার মাঝে ইতিবাচক ও নেতিবাচক এবং শিরক পরিত্যাগ ও আল্লাহর একত্বের স্বীকৃতি দেয়ার অর্থ নিহিত আছে। (لا إله) তথা কোন প্রকৃত উপাস্য নেই। এ অংশটুকুর মাধ্যমে সকল বাতিল কৃত্রিম উপাস্যসমূহকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। (إلا الله) তথা আল্লাহ ব্যতীত। কালিমার এ অংশের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করার নির্দেশ সাব্যস্ত হয়েছে। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইখলাস (একনিষ্ঠতা) ছাড়া কোন আমল তার নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। আর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পদ্ধতি অনুসরণ ছাড়া বিদ‘আতী আমলও তিনি কবুল করেন না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

من عمل عملاً ليس عليه أمرنا فهو رد

যে আমাদের নির্দেশ ব্যতিরেকে আমল করলো তা প্রত্যাখ্যাত।[3]

অন্য রেওয়ায়েতে তিনি আরোও বলেন:

من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد

যে আমাদের দীনে নতুন কিছু উদ্ভাবন করলো যা দীন নয় তা প্রত্যাখ্যাত।[4]

এ কারণে আলেমগণ বলেন, দু’টি শর্ত ছাড়া আমল গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রথমত: আল্লাহ তা‘আলার জন্যই একনিষ্ঠভাবে আমল করা।

দ্বিতীয়ত: রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পদ্ধতি অনুসারে আমল করা।

দু’টি শর্তের কোন একটি ভঙ্গ হলে আমল কবুল হবে না এবং তাকে সৎআমল বলে গণ্য করা হবে না।

মূর্তি, আওলীয়া, গাছ, পাথর ও কবর ইত্যাদির পূজা করা যারা ভালমনে করে এবং আল্লাহর বিধান ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পদ্ধতি অনুসারে ইবাদত করে না, এরূপ ইবাদতকারী ও কুপ্রবৃত্তির উপর নির্ভরশীলদেরকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করেছেন। কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কর্মের কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন এবং জাহান্নাম হবে তাদের আবাস স্থল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ) [المائدة: 72]

নিশ্চয় যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার উপর অবশ্যই আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন (সূরা আল মায়িদা ৫:৭২)।

অর্থাৎ চুড়ান্ত ভাবে তাদের জন্য জান্নাতে প্রবেশ নিষিদ্ধ। আর (التحريم) শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো নিষিদ্ধ। মুশরিকদের জন্য জান্নাত চুড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ। তাদের জন্য জান্নাতের প্রত্যাশা নেই এবং জাহান্নামই তাদের আবাসস্থল। এটা হলো আল্লাহর সাথে শিরক করার মন্দ পরিনাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى) [الزمر: 3]

যদিও তারা বলে থাকে, আমরাতো তাদের ইবাদত করি না কিন্তু তারাতো আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দিবে। তারা এর উপরই মৃত্যু বরণ করে, তারা ফিরে আসে না। আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য জান্নাত হারাম করে দেন। আর জাহান্নামকে তাদের জন্য চিরস্থায়ী আবাস স্থল নির্ধারণ করেন। যে মুক্তি পেতে চায় সে এ ব্যাপারে সতর্ক হয়। আর জাহিলী কাজকর্ম ও অন্যান্য অবাধ্যতা ছেড়ে দেয়।

শাইখ রহিমাহুল্লাহ বলেন, এ সমস্যার কারণে মানুষ মুসলিম ও কাফিরে বিভক্ত অর্থাৎ তাওহীদ ও শিরকে বিভক্ত। একদল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সত্যবাদী জেনে তার প্রতি ঈমান আনয়ন করে এবং একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য একনিষ্ঠভাবে ইবাদত করে, তারাই মু’মিন। আর আরেক দল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিরোধিতা বশতঃ শিরকের উপর ও তাদের ইবাদতের উপর অবিচল থাকে। আর তাদের পূর্ব পুরুষরা ইতিপূর্বে যেভাবে ইবাদত করতো। পূর্ববর্তী জাতিরা শিরকের উপর ছিল। তারা রসূলগণের বিরোধিতা করতো। কেননা তাদের পূর্ব পুরুষদের রীতিনীতির উপর তারা অবিচল থাকতে চায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَكَذَلِكَ مَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ فِي قَرْيَةٍ مِنْ نَذِيرٍ إِلَّا قَالَ مُتْرَفُوهَا إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِمْ مُقْتَدُونَ) [الزخرف:23]

আর এভাবেই তোমাদের পূর্বে যখনই আমি কোন জনপদে সতর্ককারী পাঠিয়েছি, তখনই সেখানকার বিলাসপ্রিয়রা বলেছে, নিশ্চয় আমরা তো আমাদের পূর্ব পুরুষদেরকে এক মতাদর্শের ওপর পেয়েছি তাই আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি (সূরা আয যুখরুফ ৪৩:২৩)। তারা বলে,

أَتَنْهَانَا أَنْ نَعْبُدَ مَا يَعْبُدُ آبَاؤُنَا) [هود: 62]

তুমি কি আমাদেরকে নিষেধ করছ তাদের উপাসনা করতে আমাদের পিতৃপুরুষরা যাদের উপাসনা করত? (সূরা হুদ ১১:৬২)।

এটা তাদের মুখের কথা ও তাদের যুক্তি। তারা পূর্বপুরুষদের রীতিকে আঁকড়ে ধরে থাকে। তা ছিল আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত।

এর কথা: শত্রুতার সময় অর্থাৎ তাওহীদ পন্থী ও মুশরিকের মাঝে, মু’মিন ও কাফিরের মাঝের শত্রুতা। সুতরাং কাফিরদের সাথে শত্রুতা রাখা মু’মিনদের উপর আবশ্যক। তাই কাফিরদের প্রতি ভালবাসা রাখা বৈধ নয় যদিও তারা নিকটতম (প্রতিবেশী, বন্ধু, আত্মীয়) হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

لا تَجِدُ قَوْماً يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ أُولَئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْأِيمَانَ وَأَيَّدَهُمْ بِرُوحٍ مِنْهُ

যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান আনে তুমি পাবে না এমন জাতিকে তাদেরকে পাবে না এমন লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করতে বন্ধু হিসাবে যারা আল্লাহ ও তার রসূলের বিরোধীতা করে, যদি সেই বিরুদ্ধবাদীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা জ্ঞাতি গোষ্ঠী হয় তবুও। এদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তার পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা তাদের শক্তিশালী করেছেন। (সূরা মুজাদালাহ ৫৮:২২)।

আল্লাহ ও তার রসূল এবং মু’মিনদের সাথে বন্ধুত্ব করা আবশ্যক। কুফরী ও কাফির এবং শিরক ও মুশরিকদের থেকে বিরত থাকা অত্যাবশ্যক।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَداً حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ

আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করি; এবং উদ্রেক হল আমাদের তোমাদের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য; যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আন (সূরা মুমতাহানাহ ৬০:৪)।

তাহলেই তারা হবে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর দলের অন্তর্ভুক্ত। যারা বর্তমানে দীন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা-পর্যালোচনা করে, আর মানুষকে সে দিকে ডাকে এবং বলে যে, এগুলো আসমানী ধর্ম। তাদের কতিপয় স্পর্ধার সাথে বলে যে, ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা কাফির বলে গণ্য হবে না। এ কথাটি যা নিয়ে এসেছেন তার বিপরীত ও আল কুরআন বিরোধী এবং আমাদের জন্য অনুসরণীয় ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর আদর্শও বিরোধী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لا تَتَّخِذُوا آبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَاءَ إِنِ اسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ عَلَى الْأِيمَانِ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ) [التوبة:23]

হে ইমানদারগণ, তোমরা নিজেদের পিতা ও ভাইদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরিকে প্রিয় মনে করে। তোমাদের মধ্য হতে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারাই যালিম (সূরা আত-তাওবাহ ৯:২৩)।

ঐ সব বিতর্ককারীরা বলে, ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা আহলে কিতাব ও বিশশ্বাসী। আর তাদের প্রত্যেকের ধর্ম আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। আমাদের সাথে তাদের যোগসূত্র রয়েছে। আমরা পরস্পরকে সাহায্য করতে পারি। তারা ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদেরকে কাফির মনে করে না। বর্তমানে মানুষকে এ বিষয়ের দিকে দৃঢ়তার সাথে ডাকা হয়। এ ধরণের আহবান আল্লাহর সাথে মু’মিনদের বন্ধুত্বকে ধ্বংস করে। তাই কাফির ও মু’মিনদের মাঝে কোন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে না। যারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ঈমান আনবে না, তারা কাফির। হোক সে কিতাবী অথবা কিতাববিহীন। কেননা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হওয়ার পর তার প্রতিই ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক, অন্য কাউকে সমর্থন করা যাবে না। তাই তার প্রতি যে বিশ্বাস রাখে না সে কাফির। ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি বিশ্বাস রাখে না, এজন্য তারা কাফির।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

والَّذي نَفْسُ محمَّدٍ بيَدِه لا يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هذه الأُمَّةِ وَلاَ نَصرانيٌّ، ثم يَمُوتُ ولم يُؤمِن بالذي أُرْسِلْتُ به إلا كان من أصحاب النَّار

সে সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ! ইয়াহুদী হোক আর খ্রিষ্টান হোক, যে ব্যক্তি আমার রিসালাতের খবর শুনেছে অথচ আমার রিসালাতের উপর ঈমান না এনে মৃত্যু বরণ করবে, অবশ্যই সে জাহান্নামী হবে।[5]

সুতরাং নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুয়াত প্রাপ্তির পর তার আদর্শ হতে কেউ বের হতে পারবে না। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,

والله لو كان أخي موسى حياً ما وسعه إلا اتباعي

আল্লাহর কসম! যদি মূসা আলাইহিস সালাম বেঁচে থাকতেন তাহলে আমাকে অনুসরণ করা ছাড়া তার কোন উপায় থাকতো না।[6]

তাই নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর দীন ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন সঠিক দীনের অস্তিত্ব নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْأِسْلامِ دِيناً فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ) [آل عمران:85]

আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দীন চায় তবে তার কাছ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত (সূরা আলে-ইমরান ৩:৮৫)।

ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের এ ধরণের আহবান বাতিল বা প্রত্যাখ্যাত। এ বাতিল দাওয়াত প্রচারের জন্য অনেক সভা সমাবেশ করা হয়ে থাকে। ধর্মসমূহকে একীভূত করার জন্য তা প্রচারের উদ্দেশে তারা অর্থসম্পদও ব্যয় করে। আর তারা তাদের বিষয়বস্তুর নামকরণ করেছে (الحوار بين الأديان) অর্থাৎ ধর্মসমূহের বিতর্ক। সুবহানাল্লাহ! ঈমান ও কুফর নিয়ে বিতর্ক! শিরক ও তাওহীদ নিয়ে বিতর্ক! আল্লাহর বন্ধুদের সাথে শত্রুদের বিতর্ক!?

অতঃপর শাইখ রহিমাহুল্লাহ বলেন, এ কারণে জিহাদকে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ) [الأنفال: 39]

আর তোমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর যতক্ষণ না ফিতনার অবসান হয় এবং দীন পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায় (সূরা আল আনফাল ৮:৩৯)।


[1]. ছ্বহীহ: মুসনাদে আহমাদ, ছ্বহীহ ইবনে হিব্বান, ত্ববারানী ক্বাবীর, সুনানে দ্বারাকুতনী, মুসতাদরাক হাকীম।

[2]. ছ্বহীহ বুখারী ১৩৯৯, ২৯৪৬, ছ্বহীহ মুসলিম ২০,২১।

[3]. ছ্বহীহ মুসলিম ১৭১৮।

[4]. ছ্বহীহ বুখারী ২৬৯৭, ছ্বহীহ মুসলিম ১৭১৮।

[5]. ছ্বহীহ মুসলিম হা/১৫৩।

[6]. হাসান: মিশকাতুল মাসাবিহ হা/১৭৭, শুয়াবুল ঈমান, শারহুস সুন্নাহ,
কাফিরদের সাথে আমাদের আবশ্যকীয় নীতি তিনটি

প্রথম: তাদের সাথে শত্রুতা রাখা। কেননা তারা আল্লাহ ও তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শত্রু।

দ্বিতীয়: তাদেরকে ঈমান ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনুগত্যের দাওয়াত দেয়া। এটা মুসলিমদের উপর ওয়াজিব-আবশ্যক।

তৃতীয়: কাফিরদেরকে দাওয়াত দেয়ার পর তারা ইসলাম গ্রহণ না করলে তাদের সাথে জিহাদ করা। এক্ষেত্রে জিহাদ আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ) [الأنفال: 39]

তোমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর যতক্ষণ না ফিতনার অবসান হয় এবং দীন পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায় (সূরা আল আনফাল ৮:৩৯)।

মুসলিমদের শক্তি সামর্থ থাকলে তারা শেষ পর্যায়ে তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ) [التوبة: 5]

তোমরা মুশরিকদেরকে যেখানেই পাও হত্যা কর এবং তাদেরকে পাকড়াও কর, তাদেরকে অবরোধ কর এবং তাদের জন্য প্রতিটি ঘাঁটিতে বসে থাক (সূরা আত তাওবাহ ৯:৫)।

এ আয়াতে ইসলামে জিহাদের কৌশল বর্ণনা করা হয়েছে। আর তা হলো শিরক দূরীভূত করা যতক্ষণ না ফিতনার মূলৎপাটন হয়। যে ফিতনার মাধ্যমে মুরতাদ (দীন ত্যাগ করা) হয় তা হচ্ছে শিরক। এজন্য সম্পূর্ণভাবে শিরকী ফিতনা দূরীভূত করতে হবে। আর যুদ্ধ করতে হবে যতক্ষণ না দীন পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই জিহাদের উদ্দেশ্য। কর্তৃত্ব গ্রহণ ও প্রভাব বিস্তার করা জিহাদের উদ্দেশ্য নয়। আর জিহাদের মাধ্যমে ধনসম্পদ অর্জনও উদ্দেশ্য নয়, বরং উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর কালিমাকে উড্ডীন করা ও শিরকের মূলৎপাটন করা।

সুতরাং কাউকে প্রতিহত করা ইসলামে জিহাদের উদ্দেশ্য নয়। যেমন কতিপয় জ্ঞানপাপী বলেন, প্রতিহত করার জন্যই দীন ইসলাম সাব্যস্ত। অর্থাৎ তারা যখন আমাদের সাথে বাড়াবাড়ি করবে তখন তাদের শত্রুতা রুখে দেয়ার জন্য কেবল যুদ্ধ করবো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, (فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ) তোমরা মুশরিকদেরকে যেখানেই পাও হত্যা কর (সূরা আত তাওবাহ ৯:৫)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ

আর তোমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর যতক্ষণ না ফিতনার অবসান হয় এবং দীন পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায় (সূরা আল আনফাল ৮:৩৯)।

ইসলামে দাওয়াত-প্রচার (نشر الدعوة) ও দীনের প্রসারতা (نشر الدين) এবং শিরকের মূলৎপাটন (إزالة الشرك) করাই যুদ্ধের উদ্দেশ্য। সূরা আনফালের উপরোক্ত (৮:৩৯) আয়াত থেকে উক্ত উদ্দেশ্য সাব্যস্ত হয়।

ইসলামে যুদ্ধ দু’প্রকার:

(১) প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ যা মুসলিমদের নিরুপায় অবস্থায় প্রযোজ্য

(২) প্রভাব বিস্তারমূলক যা মুসলিমদের শক্তি সামর্থ থাকলে প্রযোজ্য হয়।

জাহিল সম্প্রদায় তাদের ইবাদত ও দীনের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ নয় - ১

জাহিল সম্প্রদায় তাদের দীনের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি করেছে। যেমন-আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ) [الروم: 32]

প্রত্যেক দলই নিজেদের যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত (সূরা আর রূম ৩০:৩২)।

অনুরূপভাবে তারা দুনিয়ার ব্যাপারেও পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। তারা মনে করতো, এধরণের কর্মকান্ডই সঠিক। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে দীনে একতাবদ্ধ থাকার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحاً وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ) [الشورى: 13]

তিনি তোমাদের জন্য দীন বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন যে নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন, আর যা আমি তোমার কাছে ওহী পাঠিয়েছি এবং ইব্রাহিম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হলো: তোমরা দীন কায়েম করবে এবং এতে বিছিন্ন হবে না (সূরা আশ শূরা ৪২:১৩)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

(إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعاً لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ) [الأنعام: 159]

নিশ্চয় যারা তাদের দীনকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের কোন ব্যাপারে তোমার দায়িত্ব নেই (সূরা আল আন‘আম ৬:১৫৯)।

আল্লাহ তা‘আলা তাদের অনুকরণ করতে নিষেধ করে বলেন,

وَلا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ) [آل عمران: 105]

আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা বিভক্ত হয়েছে এবং মতবিরোধ করেছে তাদের নিকট স্পষ্ট নির্দশনসমূহ আসার পর। আর তাদের জন্যই রয়েছে কঠোর আযাব (সূরা আলে ইমরান ৩:১০৫)।

দুনিয়ায় বিভক্তি সৃষ্টি করা থেকে তিনি আমাদেরকে নিষেধ করে বলেন:

وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعاً وَلا تَفَرَّقُوا

আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভক্ত হয়ো না (সূরা আলে ইমরান ৩:১০৩)।

................................................

ব্যাখ্যা: এ দ্বিতীয় প্রকার বিষয়ের ব্যাপারে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহিলদের বিরোধিতা করেন। দীন ও দুনিয়া উভয় ব্যাপারে জাহিলরা বিভক্তি সৃষ্টি করে। তাদের স্বভাবই ছিল অনৈক্য থাকা ও বিভক্ত হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَلا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعاً كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ) [الروم: 31،32]

আর মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। যারা নিজেদের দীনকে বিভক্ত করেছে এবং যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে (তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না)। প্রত্যেক দলই নিজেদের যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত (সূরা আর রূম ৩০:৩১-৩২)।

এটা ইয়াহুদী, খ্রিষ্টান ও মূর্তিপূজক জাহিলদের বৈশিষ্ট্য। সমস্ত জাহিলী দল এভাবে তাদের দীনের বিভক্তি ঘটায়। প্রত্যেকের স্বকীয় দীন ছিল, যার দিকে তারা ডাকতো ও আর ঐ দীনে সম্পৃক্ত হতো। খ্রিষ্টানরা তাদের খ্রিষ্টীয় ধর্মের দিকে আহবান জানায় ও ইয়াহুদীরা তাদের ইহুদী ধর্মের দিকে ডাকে। তারা প্রত্যেকে অন্যের দীনকে অস্বীকার করে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَقَالَتِ الْيَهُودُ لَيْسَتِ النَّصَارَى عَلَى شَيْءٍ وَقَالَتِ النَّصَارَى لَيْسَتِ الْيَهُودُ عَلَى شَيْءٍ وَهُمْ يَتْلُونَ الْكِتَابَ كَذَلِكَ قَالَ الَّذِينَ لا يَعْلَمُونَ) [البقرة: 113]

আর ইয়াহূদীরা বলে, নাসারাদের কোন ভিত্তি নেই এবং নাসারারা বলে ইয়াহূদীদের কোন ভিত্তি নেই। অথচ তারা কিতাব পাঠ করে। এভাবেই, যারা কিছু জানে না, তারা তাদের কথার মত কথা বলে (সূরা আল বাক্বারাহ ২:১১৩)।

যারা (দীন সম্পর্কে) জানে না তারা মুশরিক। কেননা তাদের কোন কিতাব নেই, আর আসমানী কোন দীনও নেই। তারা পরস্পরকে কাফির বলে আখ্যা দেয় এবং পরস্পরে বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(فَاللَّهُ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ) [البقرة: 113]

সুতরাং আল্লাহ কিয়ামত দিবসে যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করত সে বিষয়ে তাদের মধ্যে ফায়সালা করবেন (সূরা আল বাক্বারাহ ২:১১৩)।

আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন কে হক্বের উপর এবং কে বাতিলের উপর রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার দীন একটিই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْأِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ) [الذاريات:56]

আর আমি জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার ‘ইবাদত করবে (সূরা আয যারিয়াত ৫১:৫৬) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

(يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ) [البقرة:21]

হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবের ইবাদাত কর, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর (সূরা আল বাক্বারাহ ২:২১)।

ইয়াহুদী, খ্রিষ্টান, মূর্তিপূজক, আরব জাতি ও অনারব জাতি সকল সৃষ্টির জন্য দীন একটিই। ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্যই নির্ধারিত, যার কোন শরীক নেই। ঐ সব জাহিলরা তাদের দীনকে বিভক্ত করে। তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে একদল অপরের দীনের বিরোধিতা করে। ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা নিজেদের মাঝে মতবিরোধে লিপ্ত হয় তারা সবাই ভিন্ন ভিন্ন মতে বিভক্ত, এমনকি বর্তমানেও তারা মতবিরোধের উপর প্রতিষ্ঠিত।

অনুরূপভাবে আরবের মূর্তিপূজকরাও তাদের ইবাদতে মতোপার্থক্য সৃষ্টি করে। তাদের মধ্যে কেউ সূর্য ও চন্দ্রপূজা করে, আবার কেউ করে মূর্তিপূজা, কেউ ফেরেশতা, আওলীয়া ও নেক লোকদের পূজা করে এবং কেউ গাছ ও পাথর পূজা করে, এটাই কিতাবী (কিতাব প্রাপ্ত) ও উম্মি (নিরক্ষর) জাহিলদের অবস্থা। তাদের দীন তাদেরকে একীভূত করতে পারেনি। তাদের অনেক দল রয়েছে। আল্লাহর তা‘আলার বাণী,

( كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ) [الروم: 32]

প্রত্যেক দলই নিজেদের যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত (সূরা আর রূম ৩০:৩২)।

এটা তাদের শাস্তি ও পরীক্ষা। মানুষ যে বাতিলের উপর রয়েছে তা নিয়েই সে আনন্দবোধ করে। মানুষের উপর আবশ্যক এর বিপরীত অবস্থানে থাকা। মানুষের উচিত ভ্রষ্টতাকে এড়িয়ে চলা, সঠিক দীন থেকে বিমুখ না হওয়া ও ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে শঙ্কিত থাকা। কিন্তু তারা এগুলোর বিপরীত কাজ করে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

( كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ) [الروم: 32]

প্রত্যেক দলই নিজেদের যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত (সূরা আর রূম ৩০:৩২)।

মানুষ চিন্তাই করে না সে কি হক্বের উপর আছে নাকি বাতিলের উপর। বাপদাদা, পূর্ব-পুরুষ, আত্নীয়-স্বজন ও জাতি গোত্রের রীতিনীতিই যেন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাতিল নিয়েই তারা আনন্দিত, এটাই তাদের শাস্তি। যখন মানুষ এভাবে আনন্দবোধ করে তখন সে এ থেকে মুখ ফিরাতে পারে না। এটা জাহিলদের স্বভাব। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এ থেকে নিষেধ করে বলেন,

(وَلا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعاً) [الروم: 31- 32]

আর মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। যারা নিজেদের দীনকে বিভক্ত করেছে এবং যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে (তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না) (সূরা আর রূম ৩০: ৩১-৩২)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

(إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعاً لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ إِنَّمَا أَمْرُهُمْ إِلَى اللَّهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوا يَفْعَلُونَ) [الأنعام : 159]

নিশ্চয় যারা তাদের দীনকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের কোন ব্যাপারে তোমার দায়িত্ব নেই। তাদের বিষয়টি তো আল্লাহর নিকট। অতঃপর তারা যা করত, তিনি তাদেরকে সে বিষয়ে অবগত করবেন (সূরা আল আন‘আম ৬:১৬৯)।

তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর আয়াত নাযিল করে বলেন,

( شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحاً وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ) [الشورى: 13]

তিনি তোমাদের জন্য দীন বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন যে নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন, আর যা আমি তোমার কাছে ওহী পাঠিয়েছি এবং ইব্রাহিম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম- তা হল: তোমরা দীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না। (সূরা আশ শূরা ৪২:১৩)

দীন প্রতিষ্ঠা করাকে আল্লাহ তা‘আলা বিধিবদ্ধ করেছেন, যা নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা আলাইহিমুস সালাম এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ সকল নাবী রসূলগণের দায়িত্ব ছিল। এ সকল নাবী রসূলগণের নাম উল্লেখের কারণ হলো তারা অধিক মর্যাদাসম্পন্ন ও দৃঢ় সংকল্পের অধিকারী ছিলেন। পাঁচজন নাবী হলেন: নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা আলাইহিমুস সালাম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যারা রসূলগণের মধ্যে সর্বোত্তম, আল্লাহ তা‘আলা তাদের মনোনিত করেছেন। সকল নাবী রসূলগণের নিকট থেকে আল্লাহ তা‘আলা ওয়াদা গ্রহণ করেন, এ পাঁচজন তাদের মধ্যে অন্যতম। তাদের নিকট থেকে আল্লাহ তা‘আলা অঙ্গিকার গ্রহণ করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَإِذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّينَ مِيثَاقَهُمْ وَمِنْكَ وَمِنْ نُوحٍ وَإِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ وَأَخَذْنَا مِنْهُمْ مِيثَاقاً غَلِيظاً) [الأحزاب:7]

আর স্মরণ কর, যখন আমি অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম নাবীদের থেকে এবং তোমার থেকে, নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মারইয়াম পুত্র ঈসা থেকে। আর আমি তাদের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম। (সূরা আল আহযাব ৩৩:৭)

সমস্ত নাবী-রসূলগণের দীন এক। তাহলো একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা যার কোন শরীক নেই। সাধারণভাবে তা ছিল সকল রসূলের দীন, বিশেষতঃ ঐ পাঁচজনের। এব্যাপারে কোন মতানৈক্য ও মতপার্থক্য গ্রহণযোগ্য নয়। এ দীন এককভাবে কোন নাবীর নয়, কোন জাতিরও নয়। বরং সকলের দীন এক। সকল সৃষ্টির উপরই আল্লাহ তা‘আলার একক দীন সাব্যস্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْأِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ) [الذاريات:56]

আর আমি জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার ইবাদত করবে’ (সূরা আয যারিয়াত ৫১:৫৬)।

সকল সৃষ্টি বলতে জিন ও মানব জাতি উদ্দেশ্য, তাদের দীন এক হওয়ার আবশ্যকতা প্রমাণিত হয়। আর তা হলো তাওহীদ। যাতে ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহর একত্ব প্রকাশ করা হয়। রসূলগণের ভাষায় মানুষের জন্য স্পষ্টভাবে ইবাদতের পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা মানুষের নিকট নাবী-রসূল প্রেরণ করে তাদের উপর কিতাব নাযিল করেন। আর বলা হয় এটাই দীন ও এটাই ইবাদত, এটাই সমন্বয়সাধন ও দীনের সমাপ্তি। মানুষের অধিকার নেই যে, তারা দীন তৈরি করে নিজেদের জন্য তা বিধিবদ্ধ করে নিবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ

নাকি তাদের জন্য এমন কিছু শরীক আছে, যারা তাদের জন্য দীনের বিধান দিয়েছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেন নি? (সূরা আশ শূরা ৪২:২১)।

এটা আল্লাহ তা‘আলাকে অস্বীকার করা বুঝায়। আল্লাহ তা‘আলা যা তাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন তা পালন করা তাদের উপর আবশ্যক। তার কিতাব সমূহে ও রসূলগণের ভাষায় আল্লাহ তা‘আলা দীনের বর্ণনা দিয়েছেন, দীনের সমাপ্তি টেনেছেন। আর রসূলগণ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দীনের প্রচারক। বান্দার জন্য আল্লাহ তা‘আলা যা বিধিবদ্ধ করেছেন তারা তা প্রচার করতেন। এটা ছিল রসূলগণের দায়িত্ব। দীনের পদ্ধতি অনুসারে তারা ইবাদত করতেন। জাতির জন্য নির্ধারিত দীনের বিধিবদ্ধ নিয়মানুসারে আল্লাহর বান্দারা তার ইবাদত করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَلا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ) [آل عمران:105]

আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা বিভক্ত হয়েছে এবং মতবিরোধ করেছে তাদের নিকট স্পষ্ট নির্দশনসমূহ আসার পর। আর তাদের জন্যই রয়েছে কঠোর আযাব (সূরা আলে-ইমরান ৩:১০৫)।

জাহিলদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা আমাদের জন্য নিষিদ্ধ। তাদের দীনে তারা বিভক্তি ও মতপার্থক্য সৃষ্টি করেছে। এটা তাদের অজ্ঞতার কারণে হয়নি বরং তাদের কুপ্রবৃত্তির কারণে তা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ)

তাদের নিকট স্পষ্ট নির্দশনসমূহ আসার পর (সূরা আলে ইমরান ৩:১০৫)

তারা স্পষ্ট দলীল পরিত্যাগ করে কু-প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে। তাদের বিভক্তির মূল কারণ কু-প্রবৃত্তির অনুসরণ। (নাউযুবিল্লাহ) তারা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত নিজেদের কু-প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেকের জন্য প্রমাণ পেশ করেছেন। তিনি রসূলগণকে প্রেরণ করে কিতাবসমূহ নাযিল করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(قُلْنَا اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعاً فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدىً فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلا هُمْ يَحْزَنُونَ وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ) [البقرة: 38،39]

আমি বললাম, তোমরা সবাই তা থেকে নেমে যাও। অতঃপর যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে কোন হিদায়াত আসবে, তখন যারা আমার হিদায়াত অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না (সূরা আল বাক্বারাহ ৩:৩৮-৩৯)।

জাহিল সম্প্রদায় তাদের ইবাদত ও দীনের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ নয় - ২

আল্লাহ তা‘আলা আদম আলাইহিস সালাম-কে পৃথিবীতে পাঠানোর পর হতে মানুষের জন্য তিনি দীন নির্ধারণ করেছেন। তিনি মানুষকে নাবী ও দীনবিহীনভাবে পৃথিবীতে পাঠাননি বরং তিনি ধারাবাহিকভাবে রসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। আর মানুষের জন্য তিনি দীনকে বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন এবং তা স্পষ্টভাবে তাদের জন্য বর্ণনা করেছেন। আর সর্বশেষ নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দীন ইসলাম দেয়া হয়েছে যা কিয়ামত অবধি চালু থাকবে, তা রহিত হবে না। আর এ দীনের মাপকাঠি হলো কুরআন ও সুন্নাহ। সবযুগেই রসূলগণ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে দীন নিয়ে এসেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَإِنْ مِنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلا فِيهَا نَذِيرٌ) [فاطر: 24]

আর এমন কোন জাতি নেই যার কাছে সতর্ককারী আসেনি (সূরা ফাতির ৩৫:২৪)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

(رُسُلاً مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ) [النساء: 165]

আর (পাঠিয়েছি) রসূলগণকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, যাতে আল্লাহর বিপক্ষে রসূলগণের পর মানুষের জন্য কোন অজুহাত না থাকে (সূরা আন নিসা ৪:১৬৫)।

সুতরাং সকলেই দলীল নিয়ে এসেছেন। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

أَنْ تَقُولُوا مَا جَاءَنَا مِنْ بَشِيرٍ وَلا نَذِيرٍ فَقَدْ جَاءَكُمْ بَشِيرٌ وَنَذِيرٌ

যেন তোমরা না বল যে, আমাদের নিকট কোন সুসংবাদদাতা কিংবা সতর্ককারী আসেনি। অবশ্যই তোমাদের নিকট সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী এসেছে। আর আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান (সূরা আল মায়িদা ৫:১৯)।

আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির উপর দলীল বহাল রাখেন। কিন্তু রসূলগণ যা নিয়ে আসেন জাহিলরা জেনে-বুঝে হঠকারিতা ও কু-প্রবৃত্তির অনুসরণের কারণে রসূলগণের বিরোধিতা করে। বিশেষত ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা রিসালাত সম্পর্কে জানতো। এজন্য তাদের নামকরণ করা হয়েছে আহলুল ইলম বা আহলে কিতাব। তারা অপরাধী, কারণ তারা আহলে কিতাব এবং আহলুল ইলম অর্থাৎ রিসালাত সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশের বিরোধিতা ও কু-প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। আল্লাহ তা‘আলা উম্মতকে জাহিলদের রীতিনীতি ধারণ করতে নিষেধ করেছেন। বরং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর অর্পিত দীন আঁকড়ে ধরতে তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ছাহাবীগণ ও খুলাফায়ে রাশিদীন যার উপর পরিচালিত সেটাই হলো দীন, যা কিয়ামত অবধি আঁকড়ে ধরা উম্মতের উপর ওয়াজীব। যদি তাতে কোন মতভেদ দেখা দেয় তাহলে কিতাব ও সুন্নাহর দিকে তাদের প্রত্যাবর্তন করা ওয়াজীব-আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ) [النساء:59]

অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন কর যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর (সূরা আন নিসা ৪:৫৯)।

মতানৈক্য করা মানুষের স্বভাব। কিন্তু যখন মতানৈক্য দেখা দিবে আর আমরা সঠিক সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারবো না তখন আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে কিতাব ও সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে বলেছেন। যার কাছে কুরআন ও সুন্নাহর সঠিক দলীল পাওয়া যাবে তার নিকট থেকে তা গ্রহণ করতে হবে। আর কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী হলে তা পরিত্যাগ করতে হবে। কেননা আমাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হলো হকের অনুসরণ করা। রায় বা সিদ্ধান্ত সমর্থন করা অথবা বাপদাদা, পূর্বপুরুষ ও ব্যক্তি প্রধানদের রীতিকে সম্মান দেখানো মুসলিমদের উদ্দেশ্য নয়। এটা মুসলিমদের কাজ হতে পারে না। হক্ব গ্রহণ করাই মু’মিনের উদ্দেশ্য। হক্ব যেখানেই পাওয়া যাবে তা গ্রহণ করবে, কারণ হক্বই মূল উদ্দেশ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ) [النساء:59]

যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম (সূরা আন নিসা ৪:৫৯)। আমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে যেতে হবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً) [النساء:59]

এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর (সূরা আন নিসা ৪:৫৯)। অর্থাৎ এটা পরিনামে উৎকৃষ্টতর। দীন আল্লাহ তা‘আলার রহমত। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের মাঝে তার বিধান দিয়েছেন যা হক্ব বলে প্রমাণিত। আর তা হলো তার কিতাব-আল কুরআন। এজন্য তিনি বলেন,

(وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ) [آل عمران: 103]

আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভক্ত হয়ো না (সূরা আলে-ইমরান ৩:১০৩)।

এখানে (بِحَبْلِ اللَّهِ) বলতে আল-কুরআন উদ্দেশ্য। আর (جَمِيعاً) এর অর্থ হলো সকলেই, কতিপয় নয়। ব্যাপক অর্থে সব সৃষ্টি তথা মানব ও জিন জাতি উভয় উদ্দেশ্য। বিশেষতঃ এ উম্মতকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَلا تَفَرَّقُوا وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَاناً وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا) [آل عمران: 103]

তোমরা বিভক্ত হয়ো না। আর তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর নিয়ামতকে স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। তারপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালবাসার সঞ্চার করেছেন। অতঃপর তার অনুগ্রহে তোমরা হয়ে গেলে ভাই-ভাই। আর তোমরা ছিলে আগুনের গর্তের কিনারায়, অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন (সূরা আলে-ইমরান ৩:১০৩)।

(شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّار) এখানে জাহিলী দীনকে বুঝানো হয়েছে।

(فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا) এ আয়াতাংশ দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা ইসলামের মাধ্যমে আমাদের মুক্তির পথ উম্মুক্ত করেছেন। আর তা হচ্ছে আল-কুরআন। তাই তার নে‘আমতের শুকরিয়া আদায় করতে হবে এবং তার রজ্জু আল কুরআনকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। কেননা কিতাব হলো আল্লাহর প্রসারিত রজ্জু। যে তা শক্তভাবে আঁকড়ে ধরবে সে মুক্তি পাবে। আর যে তা ছেড়ে দিবে সে ধ্বংস হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের কাছে জাহিলদের অবস্থার কাহিনী বর্ণনা করে বলেন:

فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعاً كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ

যারা নিজেদের দীনকে বিভক্ত করেছে এবং যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে (তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না)। প্রত্যেক দলই নিজেদের যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত (সূরা আর রূম ৩০:৩২)।

জাহিলী কর্ম-কান্ড ও জাহিলদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা থেকে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে নিষেধ করেছেন। অতঃপর তিনি আমাদেরকে তার কিতাব আঁকড়ে ধরতে নির্দেশ দেন, যা মতভেদ, ধ্বংস ও বিতর্ক থেকে নিরাপদ। আল্লাহর কিতাব ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত শক্তভাবে ধারণ করা ছাড়া কোন মুক্তি নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعاً وَلا تَفَرَّقُوا) [آل عمران: 103]

আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভক্ত হয়ো না (সূরা আলে-ইমরান ৩:১০৩)।

জাহিলরা তাদের দীনে মতভেদ সৃষ্টিকারী হিসাবে গণ্য। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ) [الروم: 32]

প্রত্যেক দলই নিজেদের যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত (সূরা আর রূম ৩০:৩২)।

তাদের মতভেদ বাতিল হওয়া সত্বেও তা নিয়ে তারা আনন্দিত হয়। এরূপভাবে তারা দুনিয়া নিয়েও মতপার্থক্য সৃষ্টি করে। কেননা দীন বিনষ্ট হওয়ায় দুনিয়াও নষ্ট হয়। দুনিয়া নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে তারা জামা‘আতবদ্ধ হতে পারে না। বরং প্রত্যেক গোত্র নিজ নিজ শাসন কর্তৃত্বের উপর বহাল থাকে। আর প্রত্যেক গোত্র অন্য গোত্রের লোকদের জীবন ও ধনসম্পদের উপর জবরদস্তি করে। এটা হলো নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে আরবদের অবস্থা। তারা তাদের দীন ধ্বংসের মাধ্যমে দুনিয়া ধ্বংস করে। ভীতি, উৎকণ্ঠা ও দারিদ্রতা তাদের জন্য স্থায়ী হয়ে যায়। জাহিলদের প্রত্যেকেই যুদ্ধবাজ। তাদের প্রত্যেকেই অপরকে আক্রমণ ও অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে। জাহিলী যুগে ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ হতো। যেমন মদিনার আউস ও খাযরাজ গোত্র বংশগত দিক থেকে ভাই ভাই সম্পর্ক। তারা কাহতান নামক একই গোত্রীয় লোক ছিল। কিন্তু তাদের মাঝে এক ধ্বংসাত্নক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যা একশত বছরের অধিক সময় ধরে চলতে থাকে। আউস ও খাযরাজ গোত্রের মাঝে সংঘটিত এ যুদ্ধের নাম দেয়া হয়েছে (حرب بعاث) হারবুন বুআ‘ছ।

ইয়াহুদীরা অগ্নিপূজা করতো। আল্লাহ তা‘আলা তার নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেন। তিনি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। তার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদেরকে জামা‘আতবদ্ধ করেন। যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ হলো, মুসলিমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেল, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে তারা একতাবদ্ধ হয়। তাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার এ অনুগ্রহ তার রসূলের মাধ্যমে স্মরণ করিয়ে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَاناً) [آل عمران: 103]

আর তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর নিয়ামতকে স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রুছিলে। তারপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালবাসার সঞ্চার করেছেন। অতঃপর তার অনুগ্রহে তোমরা হয়ে গেলে ভাই-ভাই (সূরা আলে-ইমরান ৩:১০৩)।

ইসলামের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদের মাঝে আন্তরিকতা সৃষ্টি করে দেন। তাদের মাঝে যুদ্ধ-বিগ্রহ থেমে যায়। তারা ও আরবের অন্যান্য গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করলে দুনিয়া শান্তিময় হয়ে যায়। তারা জীবন ও ধনসম্পদের নিরাপত্তা লাভ করে, জমিনে নিরাপদে চলাফেরা করে। আরবের একগোত্র অন্যগোত্রের সাথে মিশে যায়, কেউ অনিষ্টের আশ্রয় নিতো না। তাদের মাঝে ভালবাসার বন্ধন সৃষ্টি হয় এবং তারা পরস্পর দীনি ভাই হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলে,

(إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعاً لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ) [الأنعام: 159]

নিশ্চয় যারা তাদের দীনকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের কোন ব্যাপারে তোমার দায়িত্ব নেই (সূরা আল আন‘আম ৬:১৬৯)।

যারা তাদের দীনে বিভক্তি সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয় তারা দীন বহির্ভূত। কেননা দীন একটিই। আর দীনের উপর মানুষের জামা‘আতও একটি। আল্লাহ তা‘আলা এ বিষয়েরই নির্দেশ দিয়েছেন। যিনি এ নির্দেশ মেনে চলবেন তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সমর্থন লাভ করবেন ও তার বন্ধু হবেন। আর যে দীনের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করে সে বিশৃঙ্খলা ও জাহিলী কর্মের উপরই টিকে থাকে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার থেকে মুক্ত।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১১৭ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 · · · 9 10 11 12 পরের পাতা »