রাহে বেলায়াত ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১৪১ টি
রাহে বেলায়াত ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১৪১ টি

আরবী (الوِلايَة، الوَلايَة بكسرة الواو وفتحها) বিলায়াত, বেলায়াত বা ওয়ালায়াত অর্থ নৈকট্য, বন্ধুত্ব বা অভিভাবকত্ব (closeness, friendship, guardianship)। ‘বেলায়াত’ অর্জনকারীকে ‘ওলী’ বা ‘ওয়ালী’ (الولى) বলা হয়। ওলী অর্থ নিকটবর্তী, বন্ধু, সাহায্যকারী, অভিভাবক ইত্যাদি। বেলায়াত ধাতু থেকে নির্গত ‘ওলী’ অথের্রই আরেকটি সুপরিচিত শব্দ ‘মাওলা’ (مولى)। ‘মাওলা’ অর্থও অভিভাবক, বন্ধু, সঙ্গী ইত্যাদি (master, protector, friend, companion)।


ইসলামী পরিভাষায় ‘বেলায়াত’ ‘ওলী’ ও ‘মাওলা’ শব্দের বিভিন্ন প্রকারের ব্যবহার রয়েছে। উত্তরাধিকার আইনের পরিভাষায় ও রাজনৈতিক পরিভাষায় এ সকল শব্দ বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত। তবে বেলায়াত বা ওলী শব্দদ্বয় সর্বাধিক ব্যবহৃত (ولاية الله) ‘আল্লাহর বন্ধুত্ব’ ও (ولى الله) ‘আল্লাহর বন্ধু’ অর্থে। এই পুস্তকে আমরা ‘বেলায়াত’ বলতে এই অর্থই বুঝাচ্ছি।


আরবী ‘তরীক’, ‘তরীকাহ’ ব ‘তরিকত’ শব্দের অর্থ ‘রাস্তা বা পথ। ফার্সীতে এই অর্থে ‘রাহ’ শব্দটি ব্যবহৃত। আমরা এই পুস্তকে আল্লাহর বন্ধুত্ব লাভের পথ সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই।


ওলীদের পরিচয় প্রদান করে কুরআনে ইরশাদ করা হয়েছেঃ

أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ


“জেনে রাখ! নিশ্চয় আল্লাহর ওলীগণের কোনো ভয় নেই এবং তাঁরা চিন্তাগ্রস্থ হবেন না- যারা ঈমান এনেছেন এবং যারা আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে আত্মরক্ষা করে চলেন বা তাকওয়ার পথ অনুসরণ করেন।”[1]


ঈমান অর্থ তাওহীদ ও রিসালাতের প্রতি বিশুদ্ধ, শিরক ও কুফর মুক্ত বিশ্বাস। “তাকওয়া” শব্দের অর্থ আত্মরক্ষা করা। যে কর্ম বা চিন্তা করলে মহান আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন সেই কর্ম বা চিন্তা বর্জনের নাম তাকওয়া। মূলত সকল হারাম, নিষিদ্ধ ও পাপ বর্জনকে তাকওয়া বলা হয়।

এখানে আমরা দেখছি যে, দুটি গুণের মধ্যে ওলীর পরিচয় সীমাবদ্ধ। ঈমান ও তাকওয়া। এই দু’টি গুণ যার মধ্যে যত বেশি ও যত পরিপূর্ণ হবে তিনি বেলায়াতের পথে তত বেশি অগ্রসর ও আল্লাহর তত বেশি ওলী বা প্রিয় বলে বিবেচিত হবেন।


এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, প্রত্যেক মুসলিমই আল্লাহর ওলী। ইমান ও তাকওয়ার গুণ যার মধ্যে যত বেশি থাকবে তিনি তত বেশি ওলী। প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ ইমাম আবু জা’ফর তাহাবী (৩২১হি) ইমাম আবু হানীফা, মুহাম্মাদ, আবু ইউসূফ (রহঃ) ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা বা বিশ্বাস বর্ণনা করে বলেনঃ

المؤمنون كلهم أولياء الرحمن وأكرمهم عند الله أطوعهم وأتبعهم للقران


“সকল মুমিন করুণাময় আল্লাহর ওলী। তাঁদের মধ্য থেকে যে যত বেশি আল্লাহর অনুগত ও কুরআনের অনুসরণকারী সে ততবেশি আল্লাহর নিকট সম্মানিত (ততবেশি বেলায়াতের অধিকারী)।[2]


রাসূলুল্লাহ (সা.) ওলীর বা বেলায়াতের পথের কর্মকে দুইভাগে ভাগ করেছেন: ফরয ও নফল। সকল ফরয পালনের পরে অনবরত নফল ইবাদত পালনের মাধমে বান্দা বেলায়াত অর্জন করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ বলেছেনঃ

مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ وَمَا تَقَرَّبَ إِلَيَّ عَبْدِي بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ وَمَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ وَبَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ وَيَدَهُ الَّتِي يَبْطِشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِي يَمْشِي بِهَا وَإِنْ سَأَلَنِي لَأُعْطِيَنَّهُ وَلَئِنْ اسْتَعَاذَنِي لَأُعِيذَنَّهُ

“যে ব্যক্তি আমার কোনো ওলীর সাথে শত্রুতা করে আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার নৈকট্য অর্জন বা ওলী হওয়ার জন্য বান্দা যত কাজ করে তন্মধ্যে সবচেয়ে আমি বেশি ভালবাসি যে কাজ আমি ফরয করেছি। (ফরয কাজ পালন করাই আমার নৈকট্যে অর্জনের জন্য সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে প্রিয় কাজ)। এরপর বান্দা যখন সর্বদা নফল ইবাদত পালনের মাধ্যমে আমার বেলায়তের পথে অগ্রসর হতে থাকে তখন আমি তাকে ভালবাসি। আর যখন আমি তাকে ভালবাসি তখন আমি তার শ্রবণযন্ত্রে পরিণত হই, যা দিয়ে সে শুনতে পায়, আমি তার দর্শনেন্দ্রিয় হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখতে পায়, আমি তার হাত হয়ে যাই, যদ্দ্বারা সে ধরে বা আঘাত করে এবং আমি তার পা হয়ে যাই, যদ্দ্বারা সে হাঁটে। সে যদি আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করে তাহলে আমি অবশ্যই তাকে তা প্রদান করি। সে যদি আমার কাছে আশ্রয় চায় তাহলে আমি অবশ্যই তাকে আশ্রয় প্রদান করি।”[3]

তাহলে ওলী ও বেলায়েতের মানদন্ড ঈমান ও তাকওয়া। আর ‘তরিকতে বেলায়াত’ বা ‘রাহে বেলায়াত’ অর্থাৎ বেলায়াতের রাস্তা সকল ফরয কাজ আদায় এবং বেশি বেশি নফল ইবাদত করা। যদি কোনো মুসলিম পরিপূর্ণ সুন্নাত অনুসারে সঠিক ঈমান সংরক্ষণ করেন, সকল প্রকারের হারাম ও নিষেধ বর্জনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করেন, তাঁর উপর ফরয যাবতীয় দায়িত্ব তিনি আদায় করেন এবং সর্বশেষে যথাসম্ভব বেশি বেশি নফল ইবাদত আদায় করেন তিনিই আল্লাহর ওলী বা প্রিয় মানুষ। এ পথে যিনি যতুটুকু অগ্রসর হবেন তিনি ততটুকু আল্লাহর নৈকট্য বা বেলায়াত অর্জন করবেন।

আল্লাহর নিষেধ বর্জনকে মূলত তাকওয়া বলা হয়। এজন্য বেলায়াতের পথে নফল মুস্তাহাব পালনের চেয়ে হারাম-মাকরূহ বর্জনের গুরুত্ব বেশি। এ বিষয়ে মুজাদ্দিদ- ই- আলফি সানী বলেন: আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য প্রদানকারী আমলসমূহ দুই প্রকার। প্রথম প্রকার ফরয কার্যসমূহ, দ্বিতীয় প্রকার নফল কার্যাবলী। নফল আমলসমূহের ফরযের সহিত কোনোই তুলনা হয় না। নামায, রোযা, যাকাত, যিকর, মোরাকাবা ইত্যাদি যে কোনো নফল ইবাদত হউক না কেন এবং তাহা খালেছ বা বিশুদ্ধভাবে প্রতিপালিত হউক না কেন, একটি ফরয ইবাদত তাহার সময় মতো যদি সম্পাদিত হয়, তবে সহস্র বৎসরের উক্তরূপ নফল ইবাদত হইতে তাহা শ্রেষ্ঠতর। বরং ফরয ইবাদতের মধ্যে যে সুন্নাত, নফল ইত্যাদি আছে, অন্য নফলাদির তুলনায় উহারাও উক্ত প্রকার শ্রেষ্ঠতব রাখে। ... অতএব, মুস্তাহাবের প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং মাকরূহ যদিও উহা ‘তানজিহী’ হয় তাহা হইতে বিরত থাকা যিকর মোরাকাবা ইত্যাদি হইতে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ, মাকরূহে তাহরীমির কথা কী আর বলিব ! অবশ্য উক্ত কার্যসমূহ (যিকর মোরাকাবা) যদি উক্ত আমলসমূহের (ফরয, মুস্তাহাব পালন ও সকল মাকরূহ বর্জনের) সহিত একত্রিত করা যায়, তবে তাহার উচ্চ-মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে, অন্যথায় মেহনত বরবাদ।”[4]


এভাবে কুরআন-সুন্নাহের আলোকে আমরা দেখি যে, বেলায়াতের পথের কর্মগুলির পর্যায়, তথা মুমিন জীবনের সকল কর্মের গুরুত্ব ও পর্যায়গুলি নিম্নরূপঃ


প্রথমত, ঈমান : সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সবকিছুর মূল বিশুদ্ধ ঈমান। ঈমানের ক্ষেত্রে ত্রুটিসহ পরবর্তী সকল নেক কর্ম ও ধার্মিকতা পন্ডশ্রম ও বাতুলতা মাত্র।


দ্বিতীয়ত, বৈধ উপার্জন : ঈমানের পরে সর্বপ্রথম দায়িত্ব বৈধভাবে উপার্জিত জীবিকার উপর নির্ভর করা। সুদ, ঘুষ, ফাঁকি,

ধোঁকা, জুলুম ইত্যাদি সকল প্রকার উপার্জন অবৈধ। অবৈধ উপার্জন দ্বারা জীবিকা নির্বাহকারীর ইবাদত আল্লাহর নিকট গ্রহণীয় নয়।


তৃতীয়ত, বান্দার হক সংশ্লিষ্ট হারাম বর্জন : কর্মের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম ও সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ফরয কর্ম। ফরয কর্ম দুই প্রকার: প্রথম প্রকার যা করা ফরয ও দ্বিতীয় প্রকার যা বর্জন করা ফরয, যা “হারাম” নামে অভিহিত। হারাম দুই প্রকার: এক প্রকার পৃথিবীর অন্যান্য মানুষ ও সৃষ্টির অধিকার বা পাওনা নষ্ট বা তাদের কোনো ক্ষতি করা বিষয়ক হারাম। এগুলি বর্জন করা সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ।


চতুর্থত, আল্লাহর অন্যান্য আদেশ নিষেধ বিষয়ক হারাম বর্জন।

পঞ্চমত, ফরয কর্মগুলি পালন।

ষষ্ঠত, মাকরূহ তাহরীমি বর্জন ও সুন্নাতে মু‘আক্কাদা কর্ম পালন।

সপ্তমত, মানুষ ও সৃষ্টির সেবা ও কল্যাণমূলক সুন্নাত-নফল ইবাদত পালন।

অষ্টমত, ব্যক্তিগত সুন্নাত-নফল ইবাদত পালন।


আমি এই বইয়ে কিছু ফরয-ওয়াজিব বিষয়ের আলোচনা করলেও, মূলত অষ্টম পর্যায়ের ইবাদতই এই বইয়ের মূল আলোচ্য বিষয়। উপরের সাতটি পর্যায়ের কর্ম যদি আমাদের জীবনে না থাকে তাহলে এই অষ্টম পর্যায়ের কর্ম অর্থহীন হতে পারে বা ভন্ডামীতে পরিণত হতে পারে। আমরা অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার সাথে লক্ষ্য করি যে, আমাদের সমাজের ধার্মিক মানুষেরা প্রায়শ এই অষ্টম পর্যায়ের কাজগুলিকে অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব দেন, অথচ পূর্ববর্তী বিষয়গুলির প্রকৃত গুরুত্ব আলোচনা বা অনুধাবনে ব্যর্থ হন। মহান রাব্বুল ‘আলামীন ও তাঁর প্রিয়তম রাসূল (সা.) যে কর্মের যতটুকু গুরুত্ব প্রদান করেছেন তাকে তার চেয়ে কম গুরুত্ব প্রদান করা যেমন কঠিন অপরাধ ও তাঁদের শিক্ষার বিরোধিতা, বেশি গুরুত্ব প্রদানও একই প্রকার অপরাধ।

এক্ষেত্রে আমরা কয়েক প্রকারের কঠিন ভুল ও অপরাধে লিপ্ত হচ্ছি :


প্রথমত, ফরয, ওয়াজিব বা সুন্নাতে মু‘আক্কাদা ছেড়ে অন্যান্য সুন্নাত- নফলের গুরুত্ব দেওয়া। নফল ইবাদতের ফযীলত বলতে যেয়ে আমরা ফরযের কথা অবহেলা করে ফেলি। ফলে সমাজের অনেক ধার্মিক মানুষ অনেক ফরয ইবাদত বাদ দিয়ে নফলে লিপ্ত হন। যেমন, ফরয যাকাত না দিয়ে নফল দান, ফরয হজ্ব না করে নফল ইবাদত, ফরয ইলম অর্জন না করে নফল তাহাজ্জুদ, ফরয সৎকাজে আদেশ প্রদান না করে নফল যিকর, ফরয স্ত্রী-সন্তান প্রতিপালন বাদ দিয়ে নফল ইবাদত ইত্যাদি।


দ্বিতীয়ত, হারাম বর্জন ও হালাল উপার্জন থেকে সুন্নাত-নফল পালনকে গুরুত্ব দেওয়া। ফরয পালনের চেয়ে হারাম বর্জন বেশি

গুরুত্বপূর্ণ, যদিও দুটিই একইভাবে ফরয। কিন্তু আমরা সুন্নাত ও নফল বা সপ্তম ও অষ্টম পর্যায়ের ইবাদতের গুরুত্ব বুঝাতে যেয়ে অনেক সময় উপরের বিষয়গুলি ভুলে যায়। ফলে অগণিত মানুষকে আমরা দেখি হারাম উপার্জন, হারাম কর্ম ইত্যাদিতে লিপ্ত রয়েছেন, অথচ বিভিন্ন সুন্নাত-নফল ইবাদত আগ্রহের সাথে পালন করছেন। বিশেষত, অনেকে বান্দার হক সংক্রান্ত হারামে লিপ্ত থেকে নফল ইবাদত পালন করছেন অতীব আগ্রহের সাথে।


তৃতীয়ত, নফল ইবাদতের ক্ষেত্রে সৃষ্টির সেবার চেয়ে ব্যক্তিগত সুন্নাত-নফলকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। কুরআন ও হাদীসে মানুষের বা যে কোনো প্রাণীর উপকার করা, সাহায্য করা, সেবা করা, চিকিৎসা করা, কারো সাহায্যের উদ্দেশ্যে সামান্য একটু পথচলা, এমনকি শুধুমাত্র নিজেকে অন্য কারো ক্ষতি করা বা কষ্ট প্রদান থেকে বিরত রাখাকে অন্য সকল প্রকার সুন্নাত-নফল ইবাদতের চেয়ে অনেক বেশি সাওয়াব ও মর্যাদার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া আল্লাহর রহমত, বরকত, ক্ষমা ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সৃষ্টির সেবাকে সবচেয়ে বেশী ফলদায়ক বলে বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, আমরা কুরআন ও হাদীসের এই স্পষ্টতম বিষয়টি একেবারেই অবহেলা করছি। একজন ধার্মিক মানুষ যিকর ওযীফাকে যতটুকু গুরুত্ব দেন মানুষের সাহায্য, উপকার বা সেবাকে সেই গুরত্ব দেন না, বরং এগুলিকে ইবাদতই মনে করেন না।


চতুর্থত, অষ্টম পর্যায়ের কর্মসমূহের মধ্যেও পর্যায় রয়েছে। সাধারণত সে সকল কাজ রাসূলুল্লাহ (সা.) করেছেন বা করতে উৎসাহ প্রদান করেছেন কিন্তু না করলে কোনো আপত্তি করেননি সেই কাজগুলিই অষ্টম পর্যায়ের। এই পর্যায়ের কাজের মধ্যে গুরুত্বের কম-বেশি হয় সুন্নাতের আলোকে। যে কাজ রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বদা করেছেন বা অধিকাংশ সময় করেছেন তবে না করলে আপত্তি করেননি তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পক্ষান্তরে যা তিনি মাঝে মধ্যে করেছেন তার গুরুত্ব তার চেয়ে কম। অপরদিকে যা তিনি করেছেন ও করতে উৎসাহ দিয়েছেন তার গুরুত্ব যা তিনি করেছেন কিন্তু করতে উৎসাহ দেননি তার চেযে বেশি।


আমরা এই পর্যায়ের কাজগুলিকেও উল্টাভাবে গ্রহণ করি। একটিমাত্র উদাহরণ দেব। রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বদা কম খাদ্য খাওয়ায় অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি কম খেতে, খুধার্ত থাকতে ও মানুষকে খাওয়াতে পছন্দ করতেন ও উৎসাহ দিতেন। এছাড়া তিনি খাওয়ার সময় দস্তরখান ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। তবে সর্বদা তা ব্যবহার করতেন না বলেই বুঝা যায়। এছাড়া দস্তরখান ব্যবহার করতে তিনি উৎসাহ প্রদান করেননি। সাহাবীগণ হেঁটে হেঁটে, দাঁড়িয়ে বা পাত্রে রেখেও খেয়েছেন। এখন আমরা দ্বিতীয় কর্মটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করি, অথচ প্রথম কাজটিকে গুরুত্ব প্রদান করি না।

এছাড়া অনেকেই এক্ষেত্রে সুন্নাতের অনুসরণ করতে যেয়ে সুন্নাতের বিরোধিতা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) যা মাঝে মাঝে করেছেন তা সর্বদা করলে তাঁর সুন্নাতের বিরোধিতা হয়। কারণ, তিনি মাঝে মাঝে অন্য যে কাজটি করতেন তা বর্জিত হয়। যেমন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকারের ও বিভিন্ন রঙের পোশাক পরতেন, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকার খাদ্য বিভিন্নভাবে গ্রহণ করতেন। কখনো পাগড়ি পরতেন, কখনো রুমাল পরতেন, কখনো শুধু টুপি পরতেন। কখনো জামা পরতেন, কখনো লুঙ্গি ও চাদর পরতেন ... ইত্যাদি। এখন শুধুমাত্র এক প্রকারকে সর্বদা পালন করা তাঁর রীতির বিরুদ্ধতা করা।


পঞ্চমত, বেলায়াত ও তাকওয়ার ধারণার বিকৃতি। উপরের বিষয়গুলি আমাদের মনে এমনভাবে আসন গেড়ে বসেছে যে, প্রকৃত মুসলিমের ব্যক্তিত্ব, তাকওয়া, বেলায়েত ও বুজুর্গী সম্পর্কে আমাদের ধারণা একেবারেই উল্টো হয়ে গিয়েছে। আমরা পাগড়ি, টুপি, যিকর, দস্তরখান ইত্যাদি বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন। কিন্তু ঈমান, বান্দার হক, হালাল উপার্জন, মানব সেবা সম্পর্কে উদাসীন। কেউ হয়ত গীবত, অহঙ্কার, বান্দার হক নষ্ট, হারাম উপার্জন ইত্যাদিতে লিপ্ত, কিন্তু টুপি, পাগড়ি, তাহাজ্জুদ, যিকর ইত্যাদি অষ্টম পর্যায়ের ইবাদতে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। আমরা এই ব্যক্তিকে মুত্তাকী পরহেযগার বা ধার্মিক মুসলিম বলে মনে করি। এমনকি আল্লাহর ওলী বা পীর মাশায়েখ বলেও বিশ্বাস করি। অপর দিকে যদি কেউ মানব সেবা, সমাজ কল্যাণ ইত্যাদিতে লিপ্ত থাকেন তাকে আমরা আল্লাহর ওলী বলা তো দূরের কথা ধার্মিক বলেই মানতে রাজি হব না।

অনেক ধার্মিক মানুষ দস্তরখান বা পাগড়ী নিয়ে অতি ব্যস্ত হলেও হালাল মালের খাদ্য ও পোশাক কি-না তা বিবেচনা করছেন না। লোকটির টুপি, পাগড়ি বা জামা কোন্ কাটিং এর তা খুব যত্ন সহকারে বিবেচনা করলেও তিনি বান্দার হক নষ্ট করছেন কিনা, ফরযসমূহ পালন করছেন কিনা, মানুষের ক্ষতি বা অকল্যাণ থেকে বিরত আছেন কিনা, কবীরা গোনাহগুলি থেকে বিরত আছেন কিনা ইত্যাদি বিষয় আমরা বিবেচনায় আনছি না।


ষষ্ঠত, আমরা সর্বশেষ পর্যায়ের নফল মুস্তাহাব কাজগুলিকে দলাদলি ও ভ্রাতৃত্বেবর মানদন্ড হিসাবে গ্রহণ করেছি। মূলত সকল মুমিন মুসলমান একে অপরকে ভালবাসবেন। বিশেষত যাঁদের মধ্যে প্রথম ছয়টি পর্যায় পাওয়া যায় তাঁদেরকে আমরা আল্লাহর ওলী ও মুত্তাকী বান্দা হিসাবে আল্লাহর ওয়াস্তে বিশেষভাবে ভালবাসব। নফল মুস্তাহাব বিষয় কম-বেশি যে যেভাবে পারেন করবেন। এ সকল বিষয়ে প্রতিযোগিতা হবে, কিন্তু দলাদলি হবে না। কিন্তু বাস্তব জীবনে আমরা দেখতে পাই যে, আমরা টুপি, জামা, পাগড়ি, দস্তরখান ইত্যাদির আকৃতি, প্রকৃতি রঙ, যিকর, দু‘আ, সালাত, সালাম ইত্যাদির পদ্ধতি ও প্রকরণ ইত্যাদিকেই দলাদলির ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করি। ফলে প্রথম ছয়টি পর্যায় যার মধ্যে সঠিকভাবে বিরাজমান নেই, অথচ অষ্টম পর্যায়ে আমাদের সাথে মিল রাখেন তাকে আমরা আপন মনে করে দ্বীনি ভাই বা মহব্বতের ভাই বলে মনে করি। আর যার মধ্যে প্রথম ছয়টি পর্যায় বিরাজমান, অথচ অষ্টম পর্যায়ে আমার সাথে ভিন্নতা রয়েছে তাকে আমরা কাফির মুশরিকের মতো ঘৃণা করি বা বর্জন করি। এভাবে আমরা ইসলামের মূল মানদন্ড উল্টে ফেলেছি। আমরা ইসলামের জামা উল্টে পরেছি।

[1] সূরা ইউনুসঃ ৬২ ও ৬৩।

[2] ইমাম তাহাবী, আল আকীদাহ (শারহ সহ), পৃঃ ৩৫৭–৩৬২।

[3] সহীহ বুখারী, কিতাবুর রিকাক, নং ৬৫০২।

[4] মাকতুবাত শরীফ ১/১ মাকতুব ২৯, পৃষ্ঠা ৫৭–৫৮।

কুরআন কারীমে বারংবার ইরশাদ করা হয়েছে যে, উম্মাতের ‘তাযকিয়া’ই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মূল মিশন এবং ‘তাযকিয়ায়ে নাফস’-ই সফলতার মূল। মহান আল্লাহ বলেন: “আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের নিকট রাসুল প্রেরণ করেছেন, তিনি আল্লাহর আয়াত তাদের নিকট আবৃত্তি করেন, তাদেরকে ‘তাযকিয়া’ (পরিশোধন) করেন এবং কিতাব ও প্রজ্ঞা (সুন্নাত) শিক্ষা দেন।”[1]


অনুরূপভাবে বিভিন্ন স্থানে বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে যে উম্মাতকে আল্লাহর আয়াত পাঠ করা, কিতাব ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেওয়া ও ‘তাযকিয়া’ বা পরিশোধন করাই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মূল মিশন। অন্যত্র ইরশাদ করা হয়েছে: “সেই সফলকাম হবে, যে নিজেকে ‘তাযকিয়া’ (পবিত্র) করবে এবং সেই ব্যর্থ হবে, যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে।”[2] আরো বলা হয়েছে: “নিশ্চয় সাফল্য লাভ


করবে যে ‘যাকাত’ (পবিত্রতা) অর্জন করে। এবং তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করে ও সালাত আদায় করে।”[3]


‘তাযকিয়া’-র ব্যাখ্যায় ইমাম তাবারী বলেন, তাযকিয়া শব্দটি ‘যাকাত’ থেকে গৃহীত। যাকাত অর্থ পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। এ সকল আয়াতে ‘তাযকিয়া’ অর্থও পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। রাসূলুল্লাহ (সা.) মুমিনগণকে শিরক ও গাইরুল্লাহর ইবাদত থেকে পবিত্র করেন এবং আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের মাধ্যমে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। সাহাবী-তাবিয়ীগণও এভাবেই আয়াতগুলির ব্যাখ্যা করেছেন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর আনুগত্য, ইখলাস ও নির্ভেজাল তাওহীদের মাধ্যমে তাদের তাযকিয়া করেন। তাবিয়ী ইবনু জুরাইজ বলেন, তিনি তাদেরকে শিরক থেকে পবিত্র করেন।[4]


এভাবে আমরা দেখছি যে, দীনের সকল কর্মই ‘তাযকিয়া’-র অন্তভর্ক্তু ; কারণ সকল কমর্ই মুমিনকে কোনো না কোনোভাবে পবিত্র

করে এবং তার সাওয়াব, মর্যাদা ও পবিত্রতা বৃদ্ধি করে। তবে এক্ষেত্রে হার্দিক বা মানসিক বিষয়গুলির প্রতি কুরআন ও হাদীসে বিশেষ

গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কুরআনকে সকল মনোরোগের চিকিৎসা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছেঃ “হে মানব জাতি, তোমাদের প্রতি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে এসেছে উপদেশ এবং তোমাদের অন্তরে যা আছে তার চিকিৎসা।”[5]

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: “জেনে রাখ! দেহের মধ্যে একটি মাংসপিন্ড রয়েছে, যদি তা সংশোধিত হয় তবে পুরো দেহই সংশোধিত হয় আর যদি তা নষ্ট হয় তবে পুরো দেহই নষ্ট হয়। জেনে রাখ তা অন্তঃকরণ।”[6]
এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, উপরে বেলায়াতের পথের যে ৮ পর্যায়ের কর্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলিই তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধির পর্যায় ও কর্ম। আত্মশুদ্ধির ক্ষেত্রেও ফরয ও নফল এবং করণীয় ও বর্জনীয় কর্ম রয়েছে। মনকে শিরক, কুফর, আত্মপ্রেম, কুরআন-সুন্নাহের বিপরীতে নিজের পছনদকে গুরুত্ব প্রদান, হিংসা, অহঙ্কার, লোভ, রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি থেকে হৃদয়কে মুক্ত ও পবিত্র করতে হবে। এগুলি বর্জনীয় মানসিক কর্ম। মনকে ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা, আল্লাহ-ভীতি, আল্লাহর রহমতের আশা, আল্লাহর ফয়সালার প্রতি সন্তুষ্টি, নির্লোভতা, সকলের প্রতি ভালবাসা, কল্যাণকামনা ইত্যাদি বিষয় দিয়ে পরিপূর্ণ করতে হবে। এগুলি করণীয় মানসিক কর্ম। এগুলির ফরয ও নফল পর্যায় আছে। এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, শির্ক, আত্মপ্রেম ইত্যাদিতে মন ভরে রেখে পাশাপাশি সবর, শোকর, ক্রন্দন ইত্যাদি গুণ অর্জনের চেষ্টা করা বিভ্রান্তি ও ভন্ডামি ছাড়া কিছুই নয়।

[1] সূরা আলে ইমরানঃ ১৬৪।

[2] সূরা শামসঃ ৯–১০।

[3] সূরা আ’লাঃ ১৪–১৫।

[4] তাবারী, তাফসীরে তাবারী (জামিউল বাইয়ান) ১/৫৫৮।

[5] সূরা ইউনুস ৫৭। আরো দেখুন সূরা বানী ইসরাঈল ৮২ ও সূরা ফুসসিলাত ৪৪ নং আয়াত।

[6] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৮; মুসলিম আস-সহীহ ৩/১২১৯।

যিকর আরবী শব্দ। বাংলায় এর অর্থ স্মরণ করা বা স্মরণ করানো। পরবর্তী আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাব যে, যে

কোনো প্রকারে মনে, মুখে, অন্তরে, কর্মের মাধ্যমে, চিন্তার মাধ্যমে, আদেশ পালন করে বা নিষেধ মান্য করার মাধ্যমে আল্লাহর নাম,

গুণাবলী, বিধিবিধান, তাঁর পুরস্কার, শাস্তি ইত্যাদি স্মরণ করা বা করানোকে ইসলামের পরিভাষায় যিকর বা আল্লাহর যিকর বলা হয়। তবে কুরআন ও সুন্নাহে ‘যিকর’ বলতে সাধারণভাবে কোনো না কোনোভাবে মুখের ভাষায় ‘আল্লাহর স্মরণ’ করাকে বুঝানো হয়। মুখের সাথে মনের ও কর্মের স্মরণ থাকতে হবে। শুধু কর্মের স্মরণ বা শুধু মনের স্মরণও যিকর। তবে কুরআন ও হাদীসে যিকরের নির্দেশের ক্ষেত্রে, যিকরের ফযীলত বর্ণনার ক্ষেত্রে বা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যিকর বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বত্র মূলত মুখের উচ্চারণের মাধ্যমে আল্লাহর স্মরণ বুঝানো হয়েছে। আমরা পরবর্তী আলোচনায় তা বিস্তারিত দেখতে পাব।

উপর্যুক্ত ব্যাপক অর্থে ঈমান ও নেককর্ম সবই ‘যিকর’ বলে গণ্য। এ জন্য প্রশস্ত অর্থে বেলায়াতের পথের উপরোল্লিখিত আট

পর্যায়ের সকল কর্মকেই এক কথায় ‘যিকর’ বলে অভিহিত করা যায়। এভাবে যিকর ও বেলায়াত পরস্পরে অবিচ্ছেদ্য বা প্রায় সমার্থক। উপরের হাদীসে আমরা দেখেছি যে, বেলায়াতের পথের কর্ম দুই পর্যায়ের: ফরয ও নফল। নফল পর্যায়ের যিকরকে বেলায়াতের পথে অন্য সকল নফল ইবাদতের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে হাদীস শরীফে। সর্বোপরি, আত্মশুদ্ধির জন্য কুরআন-হাদীসে যিকরের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এজন্য আমরা এই গ্রন্থে বেলায়াতের পথের বর্ণনায় ‘যিকর’ বিষয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনা করব। আল্লাহর কাছে তাওফীক ও কবুলিয়্যত প্রার্থনা করছি।

অনেক সময় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত ও সাহাবীগণের সুন্নাতের উপর নির্ভর না করে শুধুমাত্র শাব্দিক অর্থ বা ব্যক্তিগত প্রজ্ঞা, অভিরুচি ইত্যাদির উপর নির্ভর করে কুরআনের আয়াত বা হাদীসের অর্থ বা ব্যাখ্যা করতে যেয়ে আমরা বিভিন্ন প্রকারের বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হই। এধরনের অজ্ঞতা বা মনগড়া ব্যাখ্যার কারণে আমরা যিকরের ক্ষেত্রে তিন প্রকার বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হই :

প্রথমত, অনেক সময় অনেক আবেগী ধার্মিক মানুষ তাসবীহ, তাহলীল ইত্যাদি শাব্দিক যিকরের প্রতি অবজ্ঞা করে বলেন

যে, ‘আল্লাহর হুকুম মানাই তো বড় যিকর ... ’ ইত্যাদি।


দ্বিতীয়ত, অনেক সময় অনেক ধার্মিক মানুষ যিকর বলতে শুধুমাত্র তাসবীহ, তাহলীল ইত্যাদি শাব্দিক যিকরই বুঝেন। তিনি মনে করেন এ সকল যিকর না করে যিনি আল্লাহর বিধানাবলী সাধ্যমত পালন করেন তিনি কখনই যাকির নন। উপরন্তু অনেকে আল্লাহর ফরয বিধানাবলী - সালাত, সিয়াম, যাকাত, ইত্যাদি যথাযথ পালন না করে শুধুমাত্র কিছু সুন্নাত-সম্মত অথবা বিদ’আত পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত ‘যিকর’ নামক কর্ম করে নিজেকে যাকির বলে দাবি করেন বা মনে করেন।


তৃতীয়ত, অনেক ধার্মিক ও যাকির মানুষ ‘আল্লাহর যিকর’ বা ‘আল্লাহর নামের যিকর’ বলতে সুন্নাত সম্মত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণের আচরিত যিকর না বুঝে সমাজে প্রচিলত বিভিন্ন বানোয়াট পদ্ধতির বানোয়াট যিকর বুঝেন। তাঁরা আল্লাহর যিকরের ফযীলতের আয়াত ও হাদীসগুলি গ্রহণ করেন। কিন্তু এগুলির পালনের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণের সুন্নাত নিয়ে মাথা ঘামান না।


এসকল বিভ্রান্তির মূল কুরআন, হাদীস ও সাহাবীগণের শিক্ষা, কর্ম ও ব্যবহার না জেনে, দুই একটি আয়াত বা হাদীস পড়ে মনোমতো ব্যাখ্যা করা। ইসলামের অন্যতম রুকন ‘সালাত’। ‘সালাত’ অর্থ প্রার্থনা। আমরা বাংলা ভাষায় ফারসি ‘নামায’ শব্দ ব্যবহার করি। কিন্তু ইংরেজিতে সালাতকে প্রার্থনা বা prayer-ই বলা হয়। এখন কল্পনা করুন, একজন নতুন ইংরেজি ভাষাভাষী মুসলিম আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে prayer বা প্রার্থনা কায়েম করতে চায়। এজন্য সে দাঁড়িয়ে বা বসে আবেগের সাথে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছে। তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সে বলে যে, আল্লাহর নির্দেশমতো সে prayer বা প্রার্থনা প্রতিষ্ঠা করছে বা সালাত কায়েম করছে। আপনি তাকে এভাবে প্রার্থনা বা সালাত কায়েম করতে নিষেধ করলে বিরক্ত হয়ে আপনাকে ইসলাম বিরোধী ও সালাত বা প্রার্থনা বিরোধী বলে আখ্যায়িত করল।

জাপানি ও অন্যান্য বিদেশী সাক্ষাৎ হলে তাদের ‘সালাম’ হিসাবে Bow (বাউ) করে বা মাথা নিচু করে সম্ভাষণ জানায়। এখন একজন জাপানি ইসলাম গ্রহণ করে ‘ইসলামী সালাম’ শিখেছেন। তিনি অনুরূপ Bow (বাউ) করে বা মাথা ঝুঁকিয়ে আপনাকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বললেন। আপনি তাকে Bow (বাউ) করতে নিষেধ করলে তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনি আমাকে সালাম করতে নিষেধ করছেন? সালাম সুন্নাত, সালামে এত ফযীলত, ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনি কী করবেন? আপনি কি তাকে বুঝাতে পারবেন যে, আপনি সালাম করতে নিষেধ করছেন না, আপনি শুধুমাত্র Bow (বাউ) করে সালাম করতে নিষেধ করছেন। আপনি কি তাকে বুঝাতে পারবেন যে, আপনি তাকে সুন্নাত শব্দে ও সুন্নাত পদ্ধতিতে সালাম করতে বলছেন?


আমাদের দেশের যাকিরগণ অবিকল একই সমস্যায় নিপতিত। আল্লাহর যিকর, যিকর, আল্লাহর নামের যিকর ইত্যাদি শব্দ বিকৃত ও সুন্নাত বিরোধী অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। আপনি যদি রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণের পদ্ধতিতে যিকর করতে অনুরোধ করেন তাহলে তারা আপনার কথাকে ভুল অর্থ করে আপনি যিকর করতে নিষেধ করছেন বলে আপনার বিরোধিতা করবেন।


এজন্য আমরা শুরুতে দুটি বিষয় আলোচনা করতে চাই। প্রথমত, কুরআন ও হাদীসের আলোকে যিকর শব্দের অর্থ ও ব্যবহার জানতে চাই। দ্বিতীয়ত, কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফে আল্লাহর যিকরের যে অগণিত নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে এবং যিকরের যে অতুলনীয় পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে সেই নির্দেশনা পালনের জন্য পুরস্কার অর্জনের জন্য আমরা কি মনগড়াভাবে প্রয়োজন, ইচ্ছা বা রুচি অভিরুচিমতো যিকর বানিয়ে নিতে পারব? নাকি আমাদের এ সকল বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণের অনুসরণ করতে হবে? যিকর মানেই তো স্মরণ। আমরা কি তাহলে দেশ, যুগ, ভাষা, রুচি, প্রয়োজন ও সুবিধা অনুসারে ইচ্ছামতো শব্দে ও ইচ্ছামতো পদ্ধতিতে যিকর বা স্মরণ করতে পারব? না শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণ যখন, যেভাবে, যে শব্দে ও যে পদ্ধতিতে যিকর করেছেন অবিকল সেভাবেই আমাদের যিকর করতে হবে?

ঙ. কুরআন-হাদীসের আলোকে যিকরের পরিচয়

কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফের আলোকে আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহর যিকর বা মহান রাব্বুল আ’লামীনের স্মরণই মূলত ইসলাম। মুমিনের সকল কর্মই তো তার প্রতিপালক রাব্বুল আ’লামীনকে কেন্দ্র করে ও তাঁকেই স্মরণ করে। কাজেই, তার সকল কর্মই যিকর। কুরআন ও হাদীসে এভাবে আমরা যিকরকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত দেখতে পাই। ঈমান, কুরআন, সালাত, সিয়াম, হজ্ব ইত্যাদি সকল প্রকার ইবাদতকেই যিকর বলা হয়েছে। আবার এগুলির অতিরিক্ত তাকবীর, তাহলীল, তাসবীহ, দু‘আ ইত্যাদিকেও যিকর নামে অভিহিত করা হয়েছে।

কুরআন ও হাদীসের এ সকল ব্যবহারের আলোকে আমরা যিকরকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করতে পারিঃ ১. যে সকল ফরয বা নফল ইবাদতের ইসলামে অন্য ব্যবহারিক নাম রয়েছে, তবে যেহেতু সকল ইবাদতের মূলই আল্লাহর স্মরণ, এজন্য সেগুলিকেও যিকর নামে অভিহিত করা হয়েছে। ২. যে সকল ফরয বা নফল ইবাদত শুধুমাত্র যিকর নামেই অভিহিত এবং অন্যান্য সকল ইবাদতের অতিরিক্ত শুধুমাত্র আল্লাহর স্মরণের জন্য পালন করা হয়। নিম্নে যিকর শব্দের বিভিন্ন ব্যবহার আলোচনা করা হলোঃ

ঙ. কুরআন-হাদীসের আলোকে যিকরের পরিচয় - (১) আল্লাহর আনুগত্যমূলক সকল কর্ম ও বর্জনই যিকর

মহান আল্লাহ বলেন: (فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ) “তোমরা আমার যিকর (স্মরণ) কর, আমি তোমাদের যিকর (স্মরণ) করব”।[1]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় সাহাবী-তাবেয়ীগণ বলেছেনঃ এখানে যিকর বলতে সকল প্রকার ইবাদত ও আল্লাহর আনুগত্যমূলক কাজকে বুঝান হয়েছে। আল্লাহর আনুগত্য করাই বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর যিকর করা। আর বান্দাকে প্রতিদানে পুরস্কার, করুণা, শান্তি ও বরকত প্রদানই আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাকে যিকর করা।[2]

ইমাম তাবারী এই আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ “হে মুমিনগণ, আমি তোমাদেরকে যে সকল আদেশ প্রদান করেছি তা পালন করে এবং যা নিষেধ করেছি তা বর্জন করে তোমরা আমার আনুগত্যের মাধ্যমে আমার যিকর কর, তাহলে আমি তোমাদেরকে আমার রহমত, দয়া ও ক্ষমা প্রদানের মাধ্যমে তোমাদের যিকর করব।”[3]


তাবেয়ী আব্দুল্লাহ ইবনু রাবীয়াহ সাহাবী ইবনু আব্বাসকে (রাঃ) বলেন: “আল্লাহর যিকর তাঁর তাসবীহ, তাহলীল, প্রশংসা জ্ঞাপন, কুরআন তিলাওয়াত, তিনি যা নিষেধ করেছেন তাঁর কথা স্মরণ করে তা থেকে বিরত থাকা - এ সবই আল্লাহর যিকর।” ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “সালাত, সিয়াম ইত্যাদি সবই আল্লাহর যিকর।”[4]

প্রখ্যাত মহিলা সাহাবী উম্মে দারদা (রাঃ) বলেনঃ

فإن صليت فهو من ذكر الله وإن صمت فهو من ذكر الله وكلّ خير تعمله فهو من ذكر الله وكل شرّ تجتنبه فهو من ذكر الله وأفضل ذلك تسبيحُ الله


“তুমি যদি সলাত আদায় কর তাও আল্লাহর যিকর, তুমি যদি সিয়াম পালন কর তবে তাও আল্লাহর যিকর। তুমি যা কিছু ভালো কাজ

কর সবই আল্লাহর যিকর। যত প্রকার মন্দ কাজ তুমি পরিত্যাগ করবে সবই আল্লাহর যিকরের অন্তর্ভুক্ত। তবে সবচেয়ে উত্তম যিকর আল্লাহর তাসবীহ (‘সুবহানাল্লাহ’ বলা)।”[5]


কুরআন করীমে ইরশাদ করা হয়েছেঃ

رِجَالٌ لَّا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَن ذِكْرِ


“(আল্লার ঘরে আল্লাহর যিকরকারী মানুষগণকে) কোনো ব্যবসা বা কেনাবেচা আল্লাহর যিকর থেকে অমনোযোগী করতে পারে না।”[6]

এই আয়াতে ‘আল্লাহর যিকরের’ ব্যাখ্যায় তাবেয়ী কাতাদা বলেনঃ “এ সকল যাকির বান্দাগণ বেচাকেনা ও ব্যবসায়ে লিপ্ত থাকতেন। কিন্তু যখনই আল্লাহর কোনো পাওনা বা তাঁর প্রদত্ত কোনো দায়িত্ব এসে যেত তাঁরা তৎক্ষণাৎ তা আদায় করতেন। কোনো ব্যবসা বা বেচাকেনা তাঁদেরকে আল্লাহর যিকর থেকে বিরত রাখত না।”[7]


তাবেয়ীগণ মুখের যিকরের গুরুত্ব দিতেন। তাসবীহ, তাহলীল, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদিকে তাঁরা মুখের যিকর হিসাবে পালন করতেন। তবে এগুলি নফল যিকর। যদি কেউ কর্মে আল্লাহর বিধিবিধান মেনে না চলে তাহলে তার এসকল যিকরের

কোনো মূল্য নেই বলে তাঁরা বলতেন। তাবেয়ী সাঈদ বিন জুবাঈর (৯৫ হি) বলেনঃ

والذكر طاعة الله فمن أطاع الله فقد ذكره ومن لم يطعه فليس بذاكر له وإن كثر منه التسبيح وتلاوة القرآن


“আল্লাহর আনুগত্যই আল্লাহর যিকর। যে তাঁর আনুগত্য করল সে তাঁর যিকর করল। আর যে আল্লাহর আনুগত্য করল না বা তাঁর বিধিনিষেধ পালন করল না, সে যত বেশিই তাসবীহ পাঠ করুক আর কুরআন তিলাওয়াত করুক সে ‘যাকির’ হিসাবে গণ্য হবে না।”[8]


এই অর্থে মুরাসাল সনদে একটি হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। তাবেয়ী খালিদ ইবনু আবী ঈমরান (১২৫ হি) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)

বলেছেনঃ

مَنْ أَطَاعَ اللَّهَ فَقَدْ ذَكَرَ اللَّهَ وَإِنْ قَلَّتْ صَلاتُهُ وَصِيَامُهُ وَتِلاوَةُ الْقُرْآنِ وَمَنْ عَصَى اللَّهَ فَقَدْ نَسِيَ اللَّهَ وَإِنْ كَثُرَتْ صَلاتُهُ وَصِيَامُهُ وَتِلاوَةُ الْقُرْآنِ


“যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য করল সেই আল্লাহর যিকর করল, যদিও তার সালাত, সিয়াম ও কুরআন তিলওয়াত কম হয়। আর যে আল্লাহর অবাধ্যতা করল সেই আল্লাহকে ভুলে গেল, যদিও তার সালাত, সিয়াম ও কুরআন তিলাওয়াত বেশি হয়।”[9]

তাবেয়ী খালিদ পর্যন্ত সনদ সহীহ। কিন্তু তিনি কার নিকট থেকে হাদীসটি শুনলেন তা বলেননি। বিশেষত তিনি শেষ যুগের তাবেয়ী। তিনি সাধারণত তাবেয়ীগণের থেকে হাদীস শুনে বর্ণনা করেছেন। এতে মনে হয় অন্তত দুইজন রাবী তার পরে বাদ পড়েছেন, একজন সাহাবী ও একজন তাবেয়ী। যেহেতু তাবেয়ীর পরিচয় জানা যাচ্ছে না, সেহেতু হাদীসটি বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল বলে গণ্য হয়। তবে ঠিক এই শব্দে ও অর্থে অন্য সনদে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খাদেম ওয়াকিদ থেকে একটি হাদীস ইমাম তাবারানী বর্ণনা করেছেন। এই সনদটিতে কোনো বিচ্ছিন্নতা নেই, কিন্তু সনদটি দুর্বল। তবে দুটি পৃথক সনদে একই অর্থের হাদীস বর্ণিত হওয়াতে হাদীসটির নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত এ কারণে ইমাম সুয়ূতী হাদীসটিকে হাসান বা গ্রহণযোগ্য বলেছেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে যয়ীফ বা দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন।[10]

আল্লামা আব্দুর রাঊফ মুনাবী এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেনঃ ‘এ থেকে বুঝা যায় যে, যিকরের হাকীকত আল্লাহর আনুগত্য করা, তাঁর আদেশ পালন করা ও নিষেধ বর্জন করা।’ এজন্য কোনো কোনো ওলী বলেছেনঃ ‘যিকরের মূল আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়া। যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যতা বা পাপের মধ্যে লিপ্ত থেকেও মুখে আল্লাহর যিকর করে সে মূলত আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে মসকরায় লিপ্ত এবং আল্লাহর আয়াত ও বিধানকে তামাশার বস্তু হিসাবে গ্রহণ করেছে।’[11]

তাবেয়ী হাসান বসরী বলেনঃ ‘আল্লাহর যিকর দুই প্রকার। প্রথম প্রকার যিকর- তোমার নিজের ও তোমার প্রভুর মাঝে মুখে জপের মাধ্যমে তাঁর যিকর করবে। এই যিকর খুবই ভালো এবং এর সাওয়াবও সীমাহীন। দ্বিতীয় প্রকার যিকর আরো উত্তম; আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তার কাছে তাঁর যিকর করা। অর্থাৎ, আল্লাহর কথা স্মরণ করে তাঁর নিষেধ করা কর্ম থেকে বিরত থাকা।’[12]

তাবেয়ী বিলাল ইবনু সা’দ বলেন : ‘যিকর দুই প্রকার। প্রথম প্রকার জিহ্বার যিকর - এই যিকর ভালো। দ্বিতীয় প্রকার যিকর - হালাল-হারাম ও বিধিনিষেধের যিকর। সকল কর্মের সময় আল্লাহর আদেশ নিষেধ মনে রাখা। এই যিকর সর্বোত্তম।’[13]

তাবেয়ী মাসরূক বলেনঃ ‘যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তির কলব আল্লাহর স্মরণে রত আছে, ততক্ষণ সে মূলত সালাতের মধ্যে রয়েছে, যদিওসে বাজারের মধ্যে থাকে।’[14] অন্য তাবেয়ী আবু উবাইদাহ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ বলেনঃ ‘যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তির অন্তর আল্লাহর স্মরণে রত থাকে, ততক্ষণ সে মূলত সালাতের মধ্যেই রয়েছে। যদি এর সাথে তার জিহ্বা ও দুই ঠোঁট নড়াচড়া করে (অর্থাৎ, মনের স্মরণের সাথে সাথে যদি মুখেও উচ্চারণ করে) তাহলে তা হবে খুবই ভালো, বেশি কল্যাণময়।’[15]

[1] সূরা বাকারাঃ ১৫২।

[2] তাবারী, তাফসীরে তাবারী ২/৩৭।

[3] তাবারী, তাফসীরে তাবারী ২/৩৭।

[4] তাবারী, তাফসীরে তাবারী ২০/১৫৬।

[5] তাবারী, তাফসীরে তাবারী ২০/১৫৭।

[6] সূরা নূরঃ ৩৭।

[7] বুখারী, আস-সহীহ ২/৭২৬, ২৭৮।

[8] যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৪/৩২৬।

[9] বাইহাকী, শু’আবুল ঈমান ১/৪৫২, ইবনুল মুবারাক, কিতাবুয যুহদ ১/১৭, আব্দুর রাউফ মুনাবী, ফাইযুল কাদীর ৬/৭০, আলবানী যয়ীফুল জামিয়িস সগীর, পৃঃ ৭৮৫।

[10] তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ২২/১৫৪, মাযমাউয যাওয়াইদ ২/২৫৮, মানাবী, ফাইযুল কাদীর ৬/৭০।

[11] মুনাবী, ফাইযুল কাদীর ৬/৭০।

[12] গাযালী, এহইয়াউ উলুমুদ্দীন ১/৩৫১।

[13] বাইহাকী, শু’আবুল ঈমান ১/৪৫২।

[14] বাইহাকী, শু’আবুল ঈমান ১/৪৫৩।

[15] বাইহাকী, শু’আবুল ঈমান ১/৪৫৩।
ঙ. কুরআন-হাদীসের আলোকে যিকরের পরিচয় - (২) সালাত আল্লাহর যিকর

সকল প্রকার ইবাদতের মধ্য থেকে সালাতকে বিশেষভাবে যিকর হিসাবে কুরআন করীমে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেনঃ (وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي) “এবং আমার যিকরের জন্য সালাত প্রতিষ্ঠা কর।”[1]


হজ্বের কর্মকান্ডের বর্ণনার সময় কুরআন করীমে ইরশাদ করা হয়েছেঃ

فَإِذَا أَفَضْتُم مِّنْ عَرَفَاتٍ فَاذْكُرُوا اللَّهَ عِندَ الْمَشْعَرِ الْحَرَامِ


“তোমরা আরাফাত থেকে ফিরে আসার পরে মাশআরুল হারামের নিকট (মুযদালিফায়) আল্লাহর যিকর করবে।”[2]


আমরা জানি, মুযদালিফায় হাজীগণের জন্য প্রচলিত তাসবীহ, তাহলীল ইত্যাদি কোনো যিকর করা ফরয-ওয়াজিব নয়। শুধুমাত্র মাগরিব ও ঈশা’র সালাত একত্রে আদায় করা ও ফজরের সালাত আদায় করাই হাজীগণের হজব সংক্রান্ত বিধান। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, এখানে ‘আল্লাহর যিকর’ বলতে সালাত বুঝান হয়েছে। ইমাম তাবারী বলেনঃ “তোমরা যখন আরাফাত থেকে ফিরে মুযদালিফায় চলে আসবে তখন আল্লাহর যিকর করবে, এখানে যিকর বলতে মাশআরুল হারামের নিকট সালাত ও দু‘আ করাকে বুঝান হয়েছে।”[3]

আবু সাঈদ খুদরী ও আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

مَنِ اسْتَيْقَظَ مِنَ اللَّيْلِ وَأَيْقَظَ امْرَأَتَهُ فَصَلَّيَا رَكْعَتَيْنِ جَمِيعًا كُتِبَا مِنَ الذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ


“যে ব্যক্তি রাত্রে ঘুম থেকে উঠে তার স্ত্রীকে জাগাবে এবং দু’জনেই দুই রাক’আত তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করবে আল্লাহর

দরবারে তারা আল্লাহর শ্রেষ্ঠ যাকিরীন বা সর্বাধিক যিকরকারী ও যিকরকারিণীগণের অন্তভর্ক্তু হবেন।”[4]

তাহলে দেখনু তাহাজ্জুদের সালাত সর্বশ্রেষ্ঠ যিকর। দুই রাক’আত তাহাজ্জদ আদায়কারী কিভাবে আল্লাহর দরবারে শ্রেষ্ঠ যাকির হওয়ার মযার্দা পেলেন।

[1] সূরা ত্বহাঃ ১৪।

[2] সূরা বাকারাঃ ১৯৮।

[3] তাবারী, তাফসীরে তাবারী ২/২৮৭।

[4] সুনানে আবী দাউদ, কিতাবুস সালাত, নং ১৪৫১, সহীহুত তারগীব ১/৩২৮–৩২৯।
ঙ. কুরআন-হাদীসের আলোকে যিকরের পরিচয় - (৩) সকাল-বিকালে আল্লাহর নামের যিকর অর্থ সালাত আদায় করা

কুরআন করীমে ইরশাদ করা হয়েছেঃ

وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ بُكْرَةً وَأَصِيلًا


“এবং সকালে ও বিকালে তোমার প্রভুর নাম যিকর কর।”[1]

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু যাইদ বলেনঃ “সকালের যিকর ফজরের সালাত এবং বিকালের যিকর যোহরের সালাত।[2] ইমাম তাবারী এর ব্যাখ্যায় বলেনঃ ‘হে মুহাম্মাদ, আপনি আপনার প্রভুর নামের যিকর করুন। সকালে ফজরের সালাতে এবং বিকালে যোহর ও আসরের সালাতের মধ্যে আপনি তাঁকে তাঁর নাম ধরে ডাকুন।”[3]


আল্লামা কুরতুবী এই আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ ‘সকালে ও বিকালে আপনার প্রভুর নামের যিকর করুন, অর্থাৎ দিনের প্রথমে ফজরের সালাত ও দিনের শেষে যোহর ও আসরের সালাত আপনার প্রভুর জন্য আদায় করুন। আর রাত্রে তাঁর জন্য সাজদা করুন অর্থ মাগরিব ও ঈশা’র সালাত আদায় করুন। আর দীর্ঘ রাত্র তাঁর তাসবীহ করুন অর্থ রাত্রে নফল সালাত আদায় করুন।’[4]


উপরিউক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে জালালাইনে বলা হয়েছেঃ “আপনি আপনার প্রভুর নাম যিকর করুন সালাতের মধ্যে সকালে ও বিকালে অর্থাৎ ফজর, যোহর ও আসরের সালাতে।”[5]

[1] সূরা ইনসানঃ ২৫।

[2] তাবারী, তাফসীরে তাবারী ২৯/২২৫।

[3] তাবারী, তাফসীরে তাবারী ২৯/২২৫।

[4] তাফসীরে কুরতুবী ১৯/১৫০।

[5] তাফসীরে জালালাইন ১/৭৮৩।
ঙ. কুরআন-হাদীসের আলোকে যিকরের পরিচয় - (৪) হজ্বও আল্লাহর যিকর

আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

إِنَّمَا جُعِلَ رَمْيُ الْجِمَارِ وَالسَّعْيُ بَيْنَ الصَّفَا وَالْمَرْوَةِ لِإِقَامَةِ ذِكْرِ اللَّه


‘জামারা কঙ্কর নিক্ষেপ করা ও সাফা মারওয়ার মধ্যে সাঈ করার বিধান দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র আল্লাহর যিকর প্রতিষ্ঠার জন্য। [1]

[1] সুনানে তিরমিযী, কিতাবুল হজ্জ, নং ৯০২। তিরমিযী বলেন, হাসান সহীহ।
ঙ. কুরআন-হাদীসের আলোকে যিকরের পরিচয় - (৫) ওয়ায-নসীহত আল্লাহর যিকর

আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি যে, যিকর শব্দের অর্থ স্মরণ করা বা করানো। কাউকে কোনোভাবে আল্লাহর নাম, গুণাবলী, বিধান বা আল্লাহর সহিত সম্পর্কিত যে কোনো বিষয় স্মরণ করানোকে বিশেষভাবে কুরআন করীম ও হাদীস শরীফে যিকর নামে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহ ইরশাদ করেছেনঃ

مَا يَأْتِيهِم مِّن ذِكْرٍ مِّن رَّبِّهِم مُّحْدَثٍ إِلَّا اسْتَمَعُوهُ وَهُمْ يَلْعَبُونَ


“যখনই তাদের কাছে তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে কোনো নতুন যিকর আসে, তখনই তারা খেলাচ্ছলে তা শ্রবণ করে।”[1]


অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে :

وَمَا يَأْتِيهِم مِّن ذِكْرٍ مِّنَ الرَّحْمَٰنِ مُحْدَثٍ إِلَّا كَانُوا عَنْهُ مُعْرِضِينَ


“যখনই তাদের কাছে দয়াময়ের নিকট থেকে কোনো নতুন যিকর আসে তখনই তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”[2]


এই দুই স্থানে এবং এরূপ আরো অনেক স্থানে যিকর বলতে ওয়ায ও উপদেশ বুঝানো হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেনঃ

إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِن يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ


“যখন শুক্রবারের দিন সালাতের জন্য আহবান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহর যিকরের দিকে ধাবিত হও।”[3]


এখানে আল্লাহর যিকর বলতে জুমু’আর সালাতের খুতবা বা ওয়াযকে বুঝান হয়েছে বলে অধিকাংশ মুফাসসির ও ফকীহ মত প্রকাশ করেছেন। ইমাম আবু হানীফা (রহ) এই মতের উপরেই নির্ভর করেছেন। কোনো কোনো মুফাসসির বলেছেন যে, এখানে ‘আল্লাহর যিকর’ অর্থ জুমু’আর সালাত। ইমাম তাবারী (রহ) বলেনঃ ‘আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাগণকে যে যিকরের দিকে দৌড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন সেই যিকর খুতবার মধ্যে ইমামের ওয়ায নসীহত ...।’ ইমাম মুজাহিদ, সাঈদ ইবনুল মুসাইইব প্রমুখ তাবেয়ী মুফাসসির এইরূপ বলেছেন।[4]


আল্লামা কুরতুবী বলেনঃ ‘আল্লাহর যিকর অর্থাৎ সালাত।’ সাঈদ ইবনু জুবাইর প্রমুখ বলেছেনঃ ‘আল্লাহর যিকর অর্থ খুতবা ও ওয়ায।’[5]


হানাফী মযহাবের অন্যতম ফকীহ ও মুফাসসির আল্লামা আবু বকর আহমদ ইবনু আলী আল-জাসসাস (৩৭০ হি) বলেনঃ ‘এই

আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, আল্লাহর যিকর অর্থাৎ ইমামের খুতবা ও ওয়ায শোনার জন্য গমন করা ফরয।’[6]

সাহাবী-তাবেয়ীগণের যুগে বিশেষভাবে ওয়ায নসীহতকে যিকর হিসাবে চিহ্নিত করা হতো। ওয়ায নসীহতের মাজলিসকে যিকরের মাজলিস বলা হতো।[7]

[1] সূরা আম্বিয়াঃ ২।

[2] সূরা শু’আরাঃ ৫।

[3] সূরা জুম’আহ ৯।

[4] তাবারী, তাফসীর ২৮/১০২।

[5] তাফসীরে কুরতুবী ১৮/১০৭।

[6] আবু বকর জাসসাস, আহকামুল কুরআন ৩/৪৪৬।

[7] তাফসীরে তাবারী ৯/১৬৩, তাফসীর ইবনু কাসীর ২/২৮২।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১৪১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 · · · 12 13 14 15 পরের পাতা »