হজ সফরে সহজ গাইড মুহাম্মাদ মোশফিকুর রহমান ৯৩ টি
হজ সফরে সহজ গাইড মুহাম্মাদ মোশফিকুর রহমান ৯৩ টি
  • যাবতীয় প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার। অসংখ্য সালাত ও সালাম তাঁর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাযিল হোক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনো মা‘বুদ নেই এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রেরিত বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তা‘আলার একমাত্র মনোনীত দীন ‘ইসলাম’ এবং তাঁর দীনের অনুসারীদের আদর্শ পরিচয় ‘মুসলিম’।
  • একটি হজ প্রশিক্ষণ উপস্থাপনা (প্রেজেন্টেশন) তৈরি করা ছিল আমার মূল লক্ষ্য। ইচ্ছা ছিল বিভিন্ন হজ প্রশিক্ষণে তা উপস্থাপন করবো। আলহামদু লিল্লাহ! বেশ কিছু হজ প্রশিক্ষণে এ উপস্থাপনাটি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু পরবর্তীতে এটিকে বইয়ে রূপ দেওয়াটা আমার মতো একজন নবীণ লেখকের জন্য ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহর ইচ্ছা ও সাহায্যে হজযাত্রীদের শিক্ষা ও সেবার উদ্দেশ্যে দীর্ঘ ১১ মাস পরিশ্রমের পর ২০১৩ ইং সালে এ হজ নির্দেশিকার প্রথম সংস্করণ বের করতে সক্ষম হয়েছিলাম। এরপর কিছু পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে দ্বিতীয় ও পরবর্তীতে তৃতীয় সংস্করণ বের করতে সচেষ্ট হই, যার ফল এ বইটি।
  • আমি হজ করার সময় একটি পরিপূর্ণ, সমসাময়িক ও সহীহ হজ গাইডের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলাম, সেই অনুভব থেকেই এ বই লেখা। আমি যখন বুঝতে পারলাম, হজযাত্রীরা সাধারণত দুই একটা বই পড়ে অথবা মানুষের মুখের কথা শুনে হজ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন; কিন্তু এর মধ্যে কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল সেটা যাচাই করেন না! কেউ কেউ আবার শুদ্ধতা যাচাই করার কথা মাথাতেই আনেন না! এ উপলব্ধি থেকেই আমি স্ব-প্রণোদিত হয়ে এ হজ গাইড লেখার কাজ শুরু করি।
  • আমার লক্ষ্য ছিল ইসলামী শরী‘আহ্ নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করে একটি নির্ভরযোগ্য ও সহীহ গাইড তৈরি করা। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এ নির্দেশিকায় আমি সঠিক ও বিশুদ্ধ তথ্যসূত্র/রেফারেন্স ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছি এবং সুপরিচিত ও সুবিজ্ঞ আলেমগণের দ্বারা পর্যবেক্ষণ ও পরিমার্জন করিয়েছি। একটি কাঠামোগত উপায়ে ও ধারাবাহিকভাবে এ গাইড তৈরি করার চেষ্টা করেছি এবং এর বিষয়বস্তুকে সহজ ও সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করেছি। বুলেট পয়েন্ট ও পর্যাপ্ত ছবি ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছি। গতানুগতিক বইয়ের ভাষা পরিহার করে গল্পের মতো ভাষা ব্যবহার করতে সচেষ্ট হয়েছি যেন সকল শ্রেণীর পাঠকের জন্য তা সহজবোধ্য হয়। বাংলাদেশের হজ প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আমি এ গাইড বা নির্দেশিকা তৈরি করেছি। তবে হজের কিছু ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়া বছরান্তে পরিবর্তন হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমি নতুন তথ্য সম্বলিত নতুন সংস্করণ দেওয়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
  • বইটিতে হজের নিয়ম-কানুনসহ হজের পূর্বপ্রস্তুতি, হজ যাত্রার বিবরণ, হারামাইনের পারিপার্শ্বিক বিবরণ, মক্কা ও মদীনার দর্শনীয় স্থান এবং হজ ও উমরাহতে সম্পাদিত ভুল ত্রুটি ও বিদ‘আত বিষয়গুলো যতটুকু সম্ভব আলোচনা করতে চেষ্টা করেছি। গাইডে আলোচ্য কোনো বিষয় আপনার জন্য ব্যতিক্রম হতে পারে, এটি সম্পূর্ণ পরিস্থিতি-প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করে।
  • মানুষ ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে নয়। এ বইয়ের যে কোনো প্রমাদ কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে উপস্থাপন করলে সে মতামত আমি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করবো ইনশাআল্লাহ। যারা আমাকে এ গাইড লেখার জন্য অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন, সার্বিক সহযোগিতা করেছেন, পরিমার্জনে অবদান রেখেছেন সর্বোপরি যারা অর্থানুদান দিয়ে প্রকাশনায় সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি, বিশেষতঃ আমার পরিবারের প্রতি। হে দয়াময় আল্লাহ! আপনি তাঁদের সকলকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!

হে আল্লাহ! আপনি এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে কবুল করুন এবং এটি প্রচার প্রসারের জন্য আমাকে সাহায্য করুন। অনাকাংক্ষিত মুদ্রণ প্রমাদের জন্য আমাকে ক্ষমা করুন এবং সুনাম অর্জন, গর্ব ও রিয়া (লোক দেখানো) থেকে হিফাযত করুন। নিশ্চয় আপনি আমার মনের উদ্দেশ্য জানেন, আপনি সর্বজ্ঞ, পরম করুণাময় ও ক্ষমাশীল। আমীন! ইয়া রব্বাল আলামীন।

  • বাংলাদেশ থেকে সরকারি অথবা বেসরকারীভাবে যারা হজে যাবেন তারা এ গাইডে তাদের প্রয়োজনীয় যাবতীয় তথ্যাদি সংক্ষিপ্তাকারে পাবেন।
  • হজ ইসলামের সর্বোৎকৃষ্ট ইবাদাতগুলোর অন্যতম। কোনো ইবাদত কবুলের জন্য ৩টি শর্ত পূরণ প্রযোজ্য –

(১) আল ঈমান: ঈমানের সকল বিষয়ের ওপর সঠিক বিশ্বাস (সহীহ আকীদা) স্থাপন করা।

(২) আল ইখলাস: নিয়ত ও ইবাদত একমাত্র একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আনুগত্যের জন্য করা।

(৩) ইত্তিবাউস সুন্নাহ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ প্রদত্ত যে শরী‘আত নিয়ে এসেছেন তার অনুসরণের মাধ্যমে করা।

  • বর্তমানে আমাদের দেশে বিভিন্ন মাযহাব, দল ও মতের অনুসারীরা হজ পালনের ক্ষেত্রে কিছু ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করলেও হজের মৌলিক বিধি-বিধান প্রায় সকলেরই এক।
  • এদের মধ্যে কে সঠিক আর কে সঠিক নয় সেটি নিরুপণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কুরআন ও সহীহ হাদীসের তথ্যসূত্র দিয়ে আমি এমন একটা পন্থা দেখিয়ে দিতে চেষ্টা করবো যে উপায়ে স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ করেছেন এবং তাঁর সাহাবীগণ হজ পালন করেছেন। দীনের জ্ঞান শিক্ষা করা সকলের ওপর ফরয। তাই আমি আমার বইটি পড়ার অনুরোধ করবো এবং পাশাপাশি অন্য লেখকের আরো বই পড়ার পরামর্শ দিব। এরপর আপনার নিজস্ব জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা দিয়ে যাচাই বাছাই করে যেটি সঠিক মনে হবে আপনি সেটিকে অনুসরণ করুন। কারো জ্ঞানের ওপর নির্ভর না করে আপনি নিজে জ্ঞান অর্জন করুন এবং তারপর আমল করুন। যতই অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোকের সাথে আপনি হজে যান না কেন কেউ আপনাকে ত্রুটিহীন হজ করার বা মাকবূল হজের নিশ্চয়তা দিবে না। তাই নিজ হজ নিজ জ্ঞানের ভিত্তিতে করুন এবং নিজে আল্লাহর কাছে দায়বদ্ধ থাকুন।

আমার প্রত্যাশা -বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও বিভিন্ন হজ এজেন্সিগুলো তাদের হজ প্রশিক্ষণ গাইড হিসেবে এ গাইডটি ব্যবহার করবেন।

  • হজ ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বুনিয়াদি স্তম্ভ।
  • হজ শব্দের আভিধানিক অর্থ; সংকল্প করা বা ইচ্ছা করা।
  • আল্লাহর নির্দেশ মেনে ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্য সৌদি আরবের নির্দিষ্ট কিছু স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে সফর করা এবং ইসলামী শরী‘আহ অনুসারে নির্দিষ্ট কিছু কর্মকাণ্ড সম্পাদন করার নামই হজ।
  • মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১০ম হিজরীতে একবার স্বপরিবারে হজ পালন করেন।
  • ৯ম বা ১০ম হিজরীতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে হজকে ফরয করা হয়।
  • হজ সম্পন্ন করতে জিলহজের ৮ থেকে ১৩ তারিখে মধ্যে আরবের মক্কা, মিনা, আরাফা ও মুযদালিফায় নির্দিষ্ট কিছু কর্মকাণ্ড সম্পাদন করতে হয়।
  • হজ সম্পাদনের অন্যতম একটি অংশ হলো ৯ যিলহজ আরাফা ময়দানে অবস্থান করা। এ আরাফা ময়দান হাশরের ময়দানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যেখানে সমগ্র মানবজাতি একত্রিত হবে সুবিস্তৃত এক ময়দানে।
  • হাদীসে হজযাত্রীদের আল্লাহর মেহমান হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
  • কুরআন মাজীদে সূরা আল-হাজ (২২ নং সূরা) নামে একটি সূরা রয়েছে, যেখানে হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচিত হয়েছে।
  • নারীদের জন্য হজ হলো জিহাদের সমতুল্য। আর এটি জান্নাত লাভের একটি অবলম্বনস্বরূপ।
  • হজ একজন মুসলিমের মাঝে শান্তি ও শুদ্ধি আনয়ন করে এবং অতীতের সকল পাপ মোচন করে দেয়।
  • হজ সফরে ইহরামের (কাফন) কাপড় পরে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে পরকালের পথে রওয়ানা হওয়াকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
  • হজের সফরে আল্লাহর বিধি-নিষেধ মেনে চলা স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে যে মুমিনের জীবন লাগামহীন নয়। মুমিনের জীবন আল্লাহর রশিতে বাঁধা।
  • হজের সফরে পাথেয় সঙ্গে নেওয়া আখেরাতের সফরে পাথেয় সঙ্গে নেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
  • হজ মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী মহাজাতিতে পরিণত হতে উদ্বুদ্ধ করে।
  • এখন বাংলাদেশ থেকে হজ সফর সম্পাদন করতে ১৫-৪০ দিন সময় লাগে।

বর্তমানে সমগ্র পৃথিবী থেকে প্রতি বছর প্রায় ২৫-৩০ লক্ষাধিক মুসলিম হজ পালন করেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿إِنَّ أَوَّلَ بَيۡتٖ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكٗا وَهُدٗى لِّلۡعَٰلَمِينَ ٩٦﴾ [ال عمران: ٩٦]

‘‘নিশ্চয় মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ইবাদত গৃহটি (কা‘বা) নির্মিত হয় সেটি বাক্কায় (মক্কায়) অবস্থিত। একে কল্যাণ ও বরকতময় করা হয়েছে এবং সৃষ্টিকুলের জন্য পথপ্রদর্শক করা হয়েছে’’। [সূরা-আলে ইমরান, আয়াত: ৯৬]

বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর বা কা‘বাকে বাইতুল আতীকও বলা হয়। কারণ, আল্লাহ এ ঘরকে কাফের শাসকদের থেকে স্বাধীন করেছেন। অথবা আতীক অর্থ প্রাচীন। কারণ এ ঘরটি সর্ব প্রাচীন ইবাদত ঘর। আশ্চর্যের বিষয় হলো -এ ঘরের স্থানটি পৃথিবীর ভৌগলিক মানচিত্রের কেন্দ্রে অবস্থিত।

কা‘বা ঘর নির্মাণ ও সংস্কার হয়েছে একাধিকবার। কারও কারও মতে পাঁচবার: (১) ফিরিশতা কর্তৃক (২) আদম আলাইহিস সালাম কর্তৃক (৩) ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কর্তৃক (৪) জাহেলী যুগে কুরাইশ সম্প্রদায় কর্তৃক (৫) ইবন যুবায়ের কর্তৃক। তবে বিশুদ্ধ মতে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সর্বপ্রথম কা‘বা ঘর নির্মাণ করেন।

আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে বলেন,

﴿جَعَلَ ٱللَّهُ ٱلۡكَعۡبَةَ ٱلۡبَيۡتَ ٱلۡحَرَامَ قِيَٰمٗا لِّلنَّاسِ﴾ [المائ‍دة: ٩٧]

‘‘আল্লাহ কা‘বাকে সম্মানিত ঘর করেছেন, মানুষের স্থীতিশীলতার কারণ করেছেন’’। [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৯৭]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَعَهِدۡنَآ إِلَىٰٓ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ أَن طَهِّرَا بَيۡتِيَ لِلطَّآئِفِينَ وَٱلۡعَٰكِفِينَ وَٱلرُّكَّعِ ٱلسُّجُودِ﴾ [البقرة: ١٢٥]

‘‘এবং আমরা ইবরাহীম ও ইসমা‘ঈল-কে আদেশ দিয়েছিলাম যেন তারা আমার ঘরকে তাওয়াফকারীদের, ই‘তিকাফকারীদের, রুকু ও সাজদাহকারীদের জন্য পবিত্র করে রাখে’’। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১২৫]

কা‘বা ও হজের ইতিহাসে রয়েছে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের মহৎ ইসলামী আখ্যান। আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে তার স্ত্রী হাজের ও পুত্র ইসমা‘ঈল আলাইহিস সালামকে মরুময়, পাথুরে ও জনশূন্য মক্কা উপত্যকায় রেখে আসার নির্দেশ দেন -এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষাস্বরূপ।

প্রচণ্ড পানির পিপাসায় ইসমা‘ঈল আলাইহিস সালামের প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত, তাঁর মা ‘হাজের’ পানির সন্ধানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে ৭ বার ছুটাছুটি করেন। অতঃপর জিবরীল আলাইহিস সালাম এসে শিশু ইসমাঈলের জন্য সৃষ্টি করলেন সুপেয় পানির কূপ -যমযম। আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহীম ও ইসমা‘ঈল আলাইহিস সালাম দু’জনে যমযম কূপের পাশে ইবাদতের লক্ষে কা‘বার পুণঃনির্মাণ কাজ শুরু করলেন।

আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের আনুগত্য দেখার জন্য আরেকটি পরীক্ষা নিলেন। তিনি ইবরাহীম আলাইহিসকে সালাম স্বপ্নে দেখালেন যে, তিনি তার পুত্রকে কুরবানি করছেন। আর এ স্বপ্নানুসারে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন বাস্তবে তার পুত্রকে জবাই করতে উদ্যত হলেন তখন আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গেলেন এবং ইবরাহীমের পুত্রের স্থলে একটি পশু কুরবানি করিয়ে দিলেন। সেই থেকে হজের সাথে সাথে চলে আসছে এ নিয়ম, মুসলিম বিশ্বে যা ঈদুল আযহা (কুরবানী ঈদ বা বকরা ঈদ) নামে পরিচিত।

ইসমা‘ঈল আলাইহিস সালামের মৃত্যুর পর পবিত্র কা‘বা বিভিন্ন জাতি-উপজাতির দখলে চলে আসে এবং তারা একে মুর্তি পূজার জন্য ব্যবহার করতে থাকে এবং এ সময়ে উপত্যকা এলাকায় মৌসুমী বন্যার কবলে পড়ে কা‘বা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।

অতঃপর ৬৩০ খৃষ্টাব্দে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে মুসলিমগণ কা‘বার মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলেন এবং কা‘বাকে পুনরায় আল্লাহর নামে উৎসর্গ করেন।

কুরাইশরা যখন কা‘বা পুণঃনির্মাণ করেন, তখন জান্নাত থেকে আসা পাথর ‘হাজারে আসওয়াদ’কে কা‘বার এক কোণে স্থাপন করা হয় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে। কা‘বার এক পার্শ্বে একটি স্থান রয়েছে যার নাম ‘মাকামে ইবরাহীম’; এখানে দাঁড়িয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কা‘বার নির্মাণ কাজ পর্যবেক্ষণ করতেন, এখানে একটি পাথরে তাঁর পদছাপ রয়েছে। কা‘বা ঘরের উত্তর দিকে কা‘বা সংলগ্ন অর্ধ-বৃত্তাকার একটি উচু দেওয়াল আছে যা কা‘বা ঘরেরই অংশ যার নাম ‘হাতিম’ বা হিজর। হাজরে আসওয়াদ ও কা‘বা ঘরের দরজার মাঝের স্থানকে ‘মুলতাযাম’ বলা হয়। কা‘বা ঘরকে বৃষ্টি ও ধুলাবালীর থেকে রক্ষার জন্য একটি চাদর দ্বারা আবৃত করে রাখা হয় যা ‘গিলাফ’ নামে পরিচিত।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার অনুসারীরা যেসব পথে ঘুরে হজ পালন করেছেন এর মধ্যে রয়েছে; কা‘বা তাওয়াফ করা, সাফা ও মারওয়া পর্বতের মধ্যে সা‘ঈ করা, মিনায় অবস্থান করা ও আরাফায় উকুফ করা এবং মুযদালিফায় রাত্রিযাপন করা, জামারাতে কংকর নিক্ষেপ করা এবং ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ত্যাগের স্মৃতিচারণ ও আল্লাহর স্মরণকে বুলন্দ করার জন্য পশু যবেহ করা।

একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার; আল্লাহ তা‘আলা কা‘বার ভিতরে অবস্থান করেন না বা আমরা মুসলিমরা কা‘বার উপাসনা করি না বা কা‘বা থেকে কোনো বরকত হাসিল করা যায় না। কা‘বা হচ্ছে ‘কিবলা’ - যা মুসলিমদের জন্য দিক নির্ণায়ক ও ঐক্কের লক্ষ্য। আমরা মুসলিমরা সম্মিলিতভাবে কা‘বার দিকে মুখ করে আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করি।

কা‘বার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ও উচ্চতা:

উচ্চতা

মুলতাযেমের দিকে দৈর্ঘ্য

হাতিমের দিকে দৈর্ঘ্য

রুকনে ইয়েমানি ও হাতিমের মাঝে দৈর্ঘ্য

হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়েমানি মাঝে দৈর্ঘ্য

১৪ মি.

১২.৮৪মি.

১১.২৮মি.

১২.১১মি.

১১.৫২মি.

 

কা‘বা ও মক্কার ইতিহাস বিস্তারিত জানতে ‘পবিত্র মক্কার ইতিহাস: শাইখ ছফীউর রহমান মোবারকপুরী’ বইটি পড়ুন।

  • আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَأَذِّن فِي ٱلنَّاسِ بِٱلۡحَجِّ يَأۡتُوكَ رِجَالٗا وَعَلَىٰ كُلِّ ضَامِرٖ يَأۡتِينَ مِن كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٖ ٢٧﴾ [الحج: ٢٧]

‘‘এবং মানষের মাঝে হজের কথা ঘোষণা করে দাও; তারা পায়ে হেঁটে ও শীর্ণ উটের পিঠে করে তোমার কাছে আসবে, তারা দুর-দুরান্তের পথ অতিক্রম করে আসবে (হজ এর উদ্দেশ্যে)’’। [সুরা আল-হাজ, আয়াত: ২৭]

  • আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فِيهِ ءَايَٰتُۢ بَيِّنَٰتٞ مَّقَامُ إِبۡرَٰهِيمَۖ وَمَن دَخَلَهُۥ كَانَ ءَامِنٗاۗ وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلٗاۚ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٩٧﴾ [ال عمران: ٩٧]

‘‘আর এতে রয়েছে স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ, যে মাকামে ইবরাহীমে প্রবেশ করবে সে নিরাপত্তা লাভ করবে। আর যার সামর্থ্য রয়েছে (শারীরিক ও আর্থিক) তার এ কা‘বায় এসে হজ করা আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরয বা অবশ্য কর্তব্য, আর যদি কেউ এ বিধান (হজ) কে অস্বীকার করে তবে; (তার জেনে রাখা উচিত) আল্লাহ সৃষ্টিকুলের কারো মুখাপেক্ষী নন’’। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭]

  • আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ ٱلصَّفَا وَٱلۡمَرۡوَةَ مِن شَعَآئِرِ ٱللَّهِۖ فَمَنۡ حَجَّ ٱلۡبَيۡتَ أَوِ ٱعۡتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡهِ أَن يَطَّوَّفَ بِهِمَاۚ وَمَن تَطَوَّعَ خَيۡرٗا فَإِنَّ ٱللَّهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ ١٥٨﴾ [البقرة: ١٥٨]

‘‘নিশ্চয় সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহে‎র অর্ন্তগত। যে ব্যক্তি (এ গৃহে) হজ ও উমরাহ করে তার জন্যে এ উভয় পাহাড়ের মাঝে প্রদক্ষিণ করা দোষণীয় নয় এবং কোনো ব্যক্তি নিষ্ঠার সাথে স্বেচ্ছায় সৎকর্ম করলে আল্লাহ কৃতজ্ঞতাপরায়ণ ও সর্বজ্ঞাত’’। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৮]

  • আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَأَتِمُّواْ ٱلۡحَجَّ وَٱلۡعُمۡرَةَ لِلَّهِۚ﴾ [البقرة: ١٩٦]

‘‘এবং তোমরা আল্লাহর জন্য হজ ও উমরাহ পালন কর’’। সূরা আল-বাকারা:আয়াত: ১৯৬]

  • আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَتَزَوَّدُواْ فَإِنَّ خَيۡرَ ٱلزَّادِ ٱلتَّقۡوَىٰۖ وَٱتَّقُونِ يَٰٓأُوْلِي ٱلۡأَلۡبَٰبِ﴾ [البقرة: ١٩٧]

‘‘আর তোমরা পাথেয় সঞ্চয় করে নাও (হজ যাত্রার জন্য), বস্তুতঃ সর্বোৎকৃষ্ট পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া (আল্লাহভীতি) এবং হে জ্ঞানীরা, তোমরা আমারই তাকওয়া অবলম্বন কর’’। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৭]

  • বিদায় হজে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘হে জনগণ! তোমরা আমার কাছ থেকে হজের নিয়ম-কানুন শিখে নাও’’।[1]
  • রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি হজের সংকল্প করে, সে যেন দ্রুত সেটা সম্পাদন করে’’।[2]
  • রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘হজ একবার, যে ব্যক্তি একাধিকবার করবে তা (তার জন্য) নফল হবে’’।[3]
  • রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তিনটি দল আল্লাহর মেহমান; আল্লাহর পথে জিহাদকারী, হজকারী ও উমরাহ পালনকারী’’।[4]
  • এক হাদীসে এসেছে, ‘‘উত্তম আমল কী -এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞসা করা হলো। উত্তরে তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান। বলা হলো, ‘‘তারপর কী?’’, তিনি বললেন, আল্লাহ পথে জিহাদ। বলা হলো, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, মাবরুর হজ।[5]
  • বুরাইদাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘হজ পালনে অর্থ ব্যয় করা আল্লাহর পথে ব্যয় করার সমতুল্য। এক দিরহাম ব্যয় করলে তাকে সাতশত পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়’’।[6]
  • আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ ও জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আগুন যেভাবে স্বর্ণ, রৌপ্য ও লোহা থেকে খাঁদ দূর করে, তেমনি যদি তোমরা তোমাদের দারিদ্রতা ও পাপ মোচন করতে চাও তাহলে তোমরা পর পর হজ ও উমরাহ পালন কর’’।[7]
  • আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যদি কেউ হজ, উমরাহ পালন অথবা জিহাদের জন্য যাত্রা করে এবং পথিমধ্যে যদি তার মৃত্যু হয় তাহলে আল্লাহ এর জন্য তাকে পূর্ণ প্রতিদান দিয়ে দেবেন’’।[8]
  • একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করে আয়েশা বললেন, ‘‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা কি আপনাদের সাথে জিহাদ ও অভিযানে যাব না? তিনি বললেন, তোমাদের জন্য উত্তম জিহাদ হলো হজ (তথা মাবরুর হজ)’’।[9]
  • হাদীসে আরও এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘কারো ইসলাম গ্রহণ পূর্বকৃত সকল পাপকে মুছে দেয়। হিজরত তার পূর্বের সকল গুনাহ মুছে দেয়, ও হজ তার পূর্বের সকল পাপ মুছে দেয়’’।[10]
  • আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ পালন করল এবং নিজেকে গর্হিত পাপ কাজ ও সকল ধরনের পাপ কথা থেকে বিরত রাখল তাহলে সে হজ থেকে এমন নিষ্পাপ ও নিষ্কলঙ্ক হয়ে ফিরে আসবে যেমন সে তার জন্মের সময় ছিল’’।[11]
  • রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘মাবরুর হজের (কবুল হজের) পুরষ্কার বা প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত আর কিছুই নয়’’।[12]
[1] সহীহ মুসলিম, নাসাঈ, আবু দাউদ

[2] আবু দাউদ; মিশকাত, হাদীস নং ২৫২৩

[3] আবু দাউদ, হাদীস নং ১৭২১

[4] নাসাঈ, মিশকাত, হাদীস নং ২৫৩৭

[5] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪২২

[6] আহমদ, বায়হাকী

[7] তিরমিযী, নাসাঈ

[8] মিশকাত, হাদীস নং ২৫৩৯; মুসনাদে আবী ইয়া‘লা, হাদীস নং ৯১৬ (আল-মাকসাদুল ‘আলী); সহীহ আত-তারগীব আত-তারহীব, হাদীস নং ১২৬৭।

[9] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৬১

[10] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৭৩

[11] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪২৪

[12] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৭৭৩/১৬৫০
  • অনেক সাধারণ মানুষই সামর্থ্য হওয়ার পরও মনে করেন -কেন কম বয়সে হজ করবো? হজ করলে তো আমাকে হজ ধরে রাখতে হবে! পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলাম অনুসরণ না করা পর্যন্ত তো হজে যাওয়া ঠিক হবে না! হজ করলে তো আর টিভি, গান-বাজনা দেখা যাবে না! সহজ পন্থায় (অবৈধ) অর্থ উপার্জন করতে পারব না! হজ করার পর যদি আমি খারাপ কাজে লিপ্ত হই তাহলে লোকেই বা কী বলবে!.. সুতরাং এখন জীবনকে উপভোগ করি, আর কিছু টাকা পয়সা উপার্জন করে নেই। আর তারপর বৃদ্ধ বয়সে যখন কোনো কিছু করার থাকবে না তখন গিয়ে হজ করে আসব!! তখন আল্লাহ অবশ্যই আমার অতীতের সকল পাপ মাফ করে দেবেন এবং আমি ইনশা-আল্লাহ জান্নাতে যেতে পারবো!! কি যুক্তি আর বুদ্ধিমান আমরা চিন্তা করেছেন!

-হে আল্লাহ তুমি আমাদের দয়া ও হিদায়াত দান কর। আমরা যদি মনে করি, আমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহর সঙ্গে চালাকি করব, তাহলে মনে রাখবেন এর মাধ্যমে আমরা আসলে আমাদের নিজেদেরকেই বোকা বানাচ্ছি, দোষী করছি এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবো।

  • যারা সামর্থ্য হওয়ার পরও হজকে মুলতবি করে রেখেছেন তাদের জন্য বড় সতর্কবাণী হলো, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি হজের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ পরিত্যাগ করল, সে ইয়াহূদী হয়ে মরুক অথবা নাসারা হয়ে মরুক -তাতে কিছু যায় আসে না’’।[1]
  • উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন, ‘‘আমার ইচ্ছা হয় যে, কিছু লোককে রাজ্জ্যের শহরগুলোতে প্রেরণ করি এবং তারা খুঁজে দেখুক ঐ সমস্ত লোককে যাদের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ পালন করে না তাদের ওপর জিযিয়া কর আরোপ করা হোক। কেননা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা হজ পালন করে না তারা মুসলিম নয়, তারা মুসলিম নয়’’।
  • ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে হজ পালন করতে চায় সে যেন দ্রুত তা পালন করে। কেননা সে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে অথবা কোনো সমস্যায় জর্জরিত হয়ে হজ করার সুযোগ হারাতে পারে”।[2]

হজের সামর্থ্য হওয়ার সাথে সাথেই হজ পালন করা উচিত। কারণ মৃত্যু কখন চলে আসতে পারে তা জানা নেই। অলসতার কারণে একটি ফরয ইবাদত বাকি রেখে মারা গেলে তো আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

[1] সুনানুল কুবরা, হাদীস নং ৮৯২৩

[2] আবু দাউদ, হাদীস নং ১৭৩২
  • হজ একটি অবশ্য পালনীয় ইবাদত, তবে কিছু শর্ত সাপেক্ষে।
  • নিম্নোক্ত ৭/৮টি মৌলিক শর্ত পূরণ সাপেক্ষে হজ প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরয, যা জীবনে অন্তত একবার পালন করতে হবে।

শর্তগুলো হলো:

  1. মুসলিম হওয়া।
  2. প্রাপ্তবয়স্ক/বালিগ হওয়া (১৫ বছর)।
  3. স্বাধীন বা মুক্ত হওয়া (কৃতদাস না হওয়া)।
  4. শারীরিকভাবে সুস্থ ও মানসিক ভারসাম্য থাকা।
  5. হজে গমনের ও সম্পূর্ণ খরচ বহনের সামর্থ্য থাকা।
  6. হজ পালনের জন্য যাত্রাপথের নিরাপত্তা থাকা।
  7. মহিলার সঙ্গে মাহরাম থাকা।

* হজে থাকাকালীন সময়কাল পরিবারের ভরণপোষণের নিশ্চয়তা করা।

  • একজন মহিলার মাহরাম হলেন তার স্বামী অথবা তার পরিবার ও আত্মীয়ের মধ্যে এমন একজন পুরুষ যার সাথে ইসলামী শরী‘আহ্ মোতাবেক বিবাহ বৈধ নয়। (যথা -পিতা, ভাই, ছেলে, চাচা, মামা, ভাইয়ের/বোনের ছেলে)
  • যদি কেউ আপনাকে হজ করার জন্য খরচ বা অর্থ (হালাল অর্থ) প্রদান করেন তবে তা বৈধ। আপনি যদি এ টাকায় হজ পালন করেন তাহলে পরবর্তীতে আপনার ওপর হজ আর বাধ্যতামূলক হবে না; এমনকি পরবর্তীতে আপনি যদি আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হনও।
  • আপনি যদি আপনার সন্তানকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই হজে নিয়ে যান তাহলে সেই হজ সেবামূলক হজ হিসেবে গণ্য হবে ও এ হজের সাওয়াব আপনি লাভ করবেন এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর যদি সে আর্থিক সামর্থ্যবান হয়, তবে আপনার সন্তানের ওপর পুনরায় হজ ফরয হবে।
  • যে নারীর হজ সফর সম্পন্ন করার অর্থমূল্যের নিজস্ব অলঙ্কার রয়েছে তার ওপর হজ ফরয। সে এ অলঙ্কার বিক্রি করেই হজে যেতে পারবে তবে অবশ্যই মাহরাম সঙ্গে নিতে হবে। কোনো মহিলার যদি মাহরাম না থাকে তবে হজ তার জন্য প্রযোজ্য নয়। সে কাউকে দিয়ে তার বদলি হজ করিয়ে নিবে। যদি কোনো মহিলা মাহরাম ছাড়াই হজে যায় তাহলে বড় ধরনের গোনাহে লিপ্ত হলো বলে আলেমগণ মত প্রকাশ করেছেন।
  • একজন ব্যক্তি টাকা ধার/কর্জ করেও হজ পালন করতে পারবেন, যদি তিনি এ টাকা ভবিষ্যতে পরিশোধ করার সামর্থ্য রাখেন, তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, ধার করে হজ করা জরুরি নয়।
  • যদি কোনো ব্যক্তি সামর্থ্য থাকার পরও হজ পালন না করেই মারা যায়, তাহলে অন্য কেউ তার পক্ষে বদলী হজ করতে পারবেন। তবে একটি জিনিস মনে রাখতে হবে, তা হচ্ছে, বদলী হজকারীকে সর্বপ্রথম তার নিজের হজ পালন করেছেন এমন হতে হবে।
  • অনেক লোক ভুল করে প্রচার করে থাকেন যে, যিনি উমরাহ করেছেন তার ওপর হজ ফরয হয়ে যায়। হজ তার ওপর ফরয নয় যার এটা পালন করার মতো যথেষ্ট সামর্থ্য নেই, এমনকি সে যদি হজের মাসেও উমরাহ পালন করে।

একটি ধারণা প্রচলিত আছে, যার ঘরে অবিবাহিত কন্যা রয়েছে সেই কন্যার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তার ওপর হজ ফরয নয়। এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত কথা।

  • প্রথমেই ঈমানকে নবায়ন ও আকীদাকে শুদ্ধ করুন। যত দ্রুত সম্ভব সুস্থ ও বলিষ্ঠ থাকা অবস্থায় হজ পালন করুন, হজ পালনে বিলম্ব করা উচিৎ নয়।
  • অন্তরের নিয়তকে পরিশুদ্ধ করুন, কারণ ‘‘নিয়তের ওপর আমল নির্ভরশীল’’। সকল প্রকার শির্ক ও বিদ‘আত সম্পর্কে জানুন ও তা থেকে মুক্ত হয়ে চলুন।
  • হজের যাত্রা জীবনে একবারই মনে করুন। সুতরাং এ যাত্রাকে নিজের জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তনে কাজে লাগানোর চেষ্টা করুন।
  • সুখ্যাতি, ব্যবসা, ভ্রমণ বা শুধু মাহরাম হওয়ার উদ্দেশ্যে হজ করবেন না।
  • আন্তরিকভাবে অতীতের সকল পাপের জন্য আল্লাহর কাছে তাওবা করুন ও ক্ষমা চান এবং ভবিষ্যতে পাপ কাজ না করার দৃঢ় সংকল্প নিন।
  • দেনমাহরসহ আপনার অন্যান্য সকল পাওনা ও ক্ষতিপুরণ পরিশোধ করুন।
  • আপনার হজের জন্য অর্থ সংগ্রহ করুন এবং নিশ্চিত করুন তা হালাল পথে উপার্জিত হয়েছে। অবৈধ বা সুদ মিশ্রিত টাকা হজ কবুল হওয়ার অন্তরায়।
  • ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে এমন গুরুত্বপূর্ণ অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করুন।
  • বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতজনদের কাছে মিথ্যা বলা, খারাপ আচরণ, হক নষ্ট করা ও তাদের কষ্ট দেওয়ার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিন।
  • এটিই আপনার জীবনের সর্বশেষ যাত্রা হতে পারে, সুতরাং আপনার পরিবারের জন্য একটি উইল বা অসীয়তনামা করে রেখে যান।
  • হজ ও উমরাহ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ও সহীহ বই থেকে জানুন এবং হজের কিছু দো‘আ মুখস্থ করুন।
  • আগে হজ করেছেন এমন ব্যক্তির কাছ থেকে হজ সম্পর্কে জানুন।
  • নিজেকে শারীরিকভাবে সুস্থ রাখুন। (পাঁচ ওয়াক্ত সালাত মসজিদে গিয়ে আদায় করুন, বেশি বেশি হাটাহাটি করুন, ব্যায়াম করুন ও নিয়মিত চিকিৎসা নিন)
  • মানসিকভাবে প্রস্তুত হোন। (ধৈর্যশীল হতে শিখুন, নিজেকে মানিয়ে নিতে, রাগকে দমন করতে ও ত্যাগ শিকার করতে শিখুন)
  • আপনার মাঝে পরিবর্তন আনুন -আপনার মুখ, চোখ, হাত, পা ও কান নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করুন। নিজকে সংযত করুন।
  • ধার্মিক, সহায়ক ও বিশ্বস্ত এরকম ২/১ জনকে সঙ্গী হিসেবে হজ যাত্রার জন্য খুঁজে নিন এবং তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখুন।
  • সম্ভব হলে দরকারী কিছু ইংরেজী, আরবী ও হিন্দি শব্দের অর্থ শিখে নিন।
  • আপনার হজের যাত্রার পরিকল্পনা করুন, প্রথমে মক্কা না মদীনা গেলে উত্তম হয় -তা ভেবে দেখুন।
  • দাঁড়ি রেখে দেওয়ার ব্যাপারে ভাবুন; কারণ তা রাখা ওয়াজিব, কাটা হরাম, দাঁড়ি না রাখলে কবিরা গুনাহ হয় এবং ধুমপান, জর্দা ও গুল-এর মতো হারাম অভ্যাসগুলো পরিহার করুন।
  • সদা আল্লাহর যিকিরের মাধ্যমে আন্তরকে আন্দোলিত রাখার অভ্যাস করুন।
  • হজ সফরে আবেগ তাড়িত হয়ে কোনো কিছু না করার বিষয়ে সজাগ থাকুন।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো হজে যাওয়ার পূর্বে আপনার মনে তাকওয়া অর্থাৎ আল্লাহভীতি ও ধর্মনিষ্ঠা আনতে হবে। আপনার তাকওয়াকে জাগ্রত করুন।

  • হজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া মাত্রই মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট করে নিন।
  • হজ সংক্রান্ত সরকারের বিভিন্ন সার্কুলার ও নির্দেশনার খোঁজ খবর রাখুন এ ওয়েব সাইট থেকে www.hajj.gov.bd
  • বিগত হাজীদের কাছ থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনা ও বেসরকারি হজ এজেন্সির সেবা সম্পর্কে মতামত নিন (ঢাকায় হজ মেলায় যেতে পারেন)।
  • বেসরকারি বিভিন্ন হজ এজেন্সির খোঁজ নিন এবং প্যাকেজ সম্পর্কে জানুন।
  • নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবার থেকে যারা হজে যাবেন তারা কম দামি হজ প্যাকেজে প্রলুব্ধ হবেন না, কারণ সস্তার তিন অবস্থা।
  • আর ধনীরাও ৫/৪ তারকা হোটেলের হজ প্যাকেজে প্রলুব্ধ হবেন না। কারণ, এটা হলিডে ট্যুর নয়।
  • অঅনুমোদিত হজ এজেন্সি থেকে সতর্ক থাকুন। কারণ, এতে আপনি প্রতারিত হতে পারেন।
  • সরকারি ব্যবস্থাপনা অথবা সরকার অনুমোদিত কোনো একটি বেসরকারি হজ এজেন্সি যারা গোড়ামি ও ভ্রান্ত আকীদা মুক্ত বিজ্ঞ হকপন্থী আলেম দ্বারা পরিচালিত তাদের হজ প্যাকেজ বেছে নিন। আপনার হজ শুদ্ধ হওয়ার জন্য এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
  • তাদের হজ সেবা সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন ও সেবার লিখিত বিবরণ রাখুন এবং তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলুন।
  • সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে ১৫ কপি পাসপোর্ট সাইজ ও ১০ কপি স্ট্যাম্প সাইজের রঙ্গিন ছবি করুন।
  • হজ ফরম পূরণ করুন এবং হজ চুক্তি স্বাক্ষর করে এর মূল কপি ও একটি করে ফটোকপি রেখে দিন।
  • সরকারি অথবা বেসরকারি হজ এজেন্সির ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা দিয়ে এজেন্সির অফিস থেকে পাকা জমা রশিদ সংগ্রহ করুন।
  • সবচেয়ে ভালো হয় আগেভাগেই কম দামে কিছু সৌদি রিয়াল কিনে নেওয়া।
  • জানাযা সালাত কিভাবে পড়তে হয় ও জানাযার সালাত-এর দো‘আ শিখে নিন।
  • হজে যাওয়ার আগে মহিলাদের মসজিদে সালাত আদায়ের নিয়ম-কানুন শিখে নেওয়া ভালো।
  • আপনি যদি চাকুরিজীবি হন, তাহলে আপনার প্রতিষ্ঠান থেকে অনাপত্তিপত্র সংগ্রহ করুন।
  • লিফট ও এস্কেলেটরে চড়ার অভ্যাস করুন।
  • হজে যাওয়ার জন্য প্রত্যেককে অবশ্যই জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে মেডিকেল বোর্ডে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে।
  • মনিংজাইটিস টিকা নিতে হবে, ঢাকার হজ ক্যাম্প থেকেও নেওয়া যাবে।
  • বয়স ৪০/৪৫ এর নিচে হলে পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়ে থাকে সাধারণত।
  • কিছু হজ প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নিন এবং হজ প্রশিক্ষণ ভিডিও দেখুন।
  • ভালো হজ এজেন্সি পছন্দ করার জন্য টিপস: নন-হিলটপ বাড়ি (পাহাড়ের উপর বাড়ি না), মসজিদের নিকটবর্তী বাড়ী, তিন বেলা খাবার ব্যবস্থা, আরাফা ও মিনায় খাবারের ব্যবস্থা, হাদীর ব্যবস্থা, ভালো বাস সার্ভিস, দর্শনীয় স্থানসমূহ যিয়ারত সুবিধা ইত্যাদি।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলো হজের সময় হাজীদের কেমন সেবা দেন। তাদের কাছে প্রত্যাশা কম করবেন। তাদেরকে সত্য বলার পরামর্শ দেবেন। তারা ন্যূনতম কী কী সেবা দিতে পারবে আর কী কী পারবেন না, তা যেন তারা পরিষ্কার লিখিত ভাবে জানিয়ে দেন। কোনো লুকোচুরি যেন না থাকে। তারা যেন এমন কোনো বিষয় গোপন না করেন যা হজের সময় আপনার কষ্ট বা ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির কারণে অনেক সময় আপনার হজ এজেন্সি প্রত্যাশিত কিছু সেবা নাও দিতে পারেন, সেক্ষেত্রে এজেন্সির লোকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করবেন না। এক্ষেত্রে ধৈর্যের পরিচয় দিন।

হতে

পর্যন্ত

দূরত্ব (আনুমানিক)

সময় (আনুমানিক)

ঢাকা বিমানবন্দর

জেদ্দা বিমানবন্দর

৩২৫৩ মাইল/৫২৩৪ কি.মি

৬-৭ ঘণ্টা (বিমানে)

জেদ্দা বিমান বন্দর

মক্কা

৫৫ মাইল/৯০ কি.মি

১-২ ঘণ্টা (বাসে)

জেদ্দা বিমানবন্দর

মদীনা

২৮০ মাইল/৪৫০ কি.মি

৬-৭ ঘণ্টা (বাসে)

মক্কা

মদীনা

৩০৫ মাইল/৪৯০ কি.মি

৭-৮ ঘণ্টা (বাসে)

মক্কা

আরাফা

১৪ মাইল/২২ কি.মি

-

মক্কা

মিনা

৫ মাইল/৮কি.মি

১-২ ঘণ্টা (বাসে)

মিনা

আরাফা

৯ মাইল/১৪ কি.মি

২-৩ ঘণ্টা (বাসে)

আরাফা

মুযদালিফা

৮ মাইল/১৩ কি.মি

২-৩ ঘণ্টা (বাসে)

মুযদালিফা

মিনা

১.৬ মাইল/২.৫ কি.মি

১-২ ঘণ্টা (বাসে)

  • ভ্রমণের রুট: ভারত, আরব সাগর, মাস্কট/দুবাই হয়ে সৌদি আরব।
  • আবহাওয়া: মক্কা (২২-৪০ ডিগ্রি), মদীনা (২০-৪২ ডিগ্রি)।
  • আদ্রতা: মক্কা (৬০-৭২%), মদীনা (২০-৪৩%)।
  • সময়ের ব্যবধান: তিন ঘণ্টা (ঢাকায় সকাল ৯টা, মক্কায় তখন সকাল ৬টা)
  • সৌদি রিয়াল রেট: ১ সৌদি রিয়াল=২১-২২টাকা। (বাজার দর সাপেক্ষে)
  • বিদ্যুৎ: ১১০/২২০ ভোল্ট
  • সৌদি ফোন কোড: +৯৬৬ XXXXXXXXX
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৯৩ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 পরের পাতা »