রূহ সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত মাসআলাসমূহ ইসলামহাউজ.কম ২১ টি
রূহ সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত মাসআলাসমূহ ইসলামহাউজ.কম ২১ টি
একাদশতম মাসআলা: কবরের প্রশ্ন কি মুসলিম, মুনাফিক ও কাফির সকলের জন্য সমান? নাকি মুসলিম ও মুনাফিকের জন্য আলাদা?

উত্তর: কবরে সকলের জন্যই একই প্রশ্ন করা হবে। বারা ইবন ‘আযিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,

«فإذا كان كافراً جاءه ملك الموت فجلس عند رأسه».

“অতঃপর কাফির ব্যক্তির মৃত্যুর সময় মালাকুল মাউত এসে তার মাথার কাছে বসবে।” এ হাদীসে এরপরে এসেছে,

«وَيَأْتِيهِ مَلَكَانِ شَدِيدَا الِانْتِهَارِ فَيَنْتَهِرَانِهِ وَيُجْلِسَانِهِ، فَيَقُولَانِ: مَنْ رَبُّكَ».

“তার কাছে ভয়ংকর চেহারার ধমকদানকারী দুজন ফিরিশতা আসবে, তারা ভর্ৎসনা করবে, তারা তাকে বসাবে, অতঃপর বলবে, তোমার রব কে?”[1]

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে বলেছেন যে, তিনি কিয়ামতের দিনে কাফিরদেরকে জিজ্ঞেস করবেন,

﴿وَيَوۡمَ يُنَادِيهِمۡ فَيَقُولُ مَاذَآ أَجَبۡتُمُ ٱلۡمُرۡسَلِينَ٦٥﴾ [القصص: ٦٥]

“আর সেদিন আল্লাহ তাদেরকে ডেকে বলবেন, তোমরা রাসূলদেরকে কী জবাব দিয়েছিলে?” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৬৫]

﴿فَوَرَبِّكَ لَنَسۡ‍َٔلَنَّهُمۡ أَجۡمَعِينَ٩٢ عَمَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ٩٣﴾ [الحجر: ٩٢، ٩٣]

“অতএব তোমার রবের কসম, আমি তাদের সকলকে অবশ্যই জেরা করব, তারা যা করত, সে সম্পর্কে”। [সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৯২-৯৩]

কিয়ামতের দিনে যেহেতু আল্লাহ কাফিরদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, সেহেতু কবরে কীভাবে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে না? (অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা হবে)

[1] ইসবাতু আযাবিল কবর, বাইহাকী, পৃষ্ঠা ৩৭; মুসনাদ আবু দাউদ ত্বয়ালিসী, হাদীস নং ৭৮৯।
দ্বাদশতম মাসআলা: মুনকার ও নাকীরের প্রশ্ন কি এ উম্মতের জন্যই খাস নাকি অন্যান্য উম্মতেও জিজ্ঞাসা করে হয়েছিল?

উত্তর: আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত। প্রত্যেক জাতিই তাদের নবী সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। তাদেরকে প্রশ্ন করে ও তাদের বিরুদ্ধে দলীল প্রমাণিত হওয়ার পরেই কবরে শাস্তি দেওয়া হবে, যেভাবে কিয়ামতের দিনে তাদেরকে জেরা করা ও দলীল-প্রমাণ সাব্যস্ত করার পরে শাস্তি দেওয়া হবে।

ত্রয়োদশতম মাসআলা: শিশুরা কি কবরে জিজ্ঞাসিত হবে?

উত্তর: না, শিশুরা কবরে জিজ্ঞাসিত হবে না। কেননা যাদের রাসূল ও রাসূলের আনিত জিনিস সম্পর্কে জ্ঞান আছে তাদেরকে প্রশ্ন করা হবে। ফলে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে, তারা কি রাসূলের অনুসরণ করেছে, নাকি তার বিরুদ্ধাচরণ করেছে? পক্ষান্তরে শিশু ভালো-মন্দ কিছুই পার্থক্য করতে পারে না, তাহলে তাদেরকে কীভাবে জিজ্ঞেস করা হবে?

অন্য দিকে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি শিশুর জানাযার সালাত আদায় করলেন, তাকে এ দো‘আ পড়তে শোনা গেছে,

«اللَّهُمَّ قِهِ عَذَابَ الْقَبْرِ».

“হে আল্লাহ আপনি তাকে কবরের ‘আযাব থেকে রক্ষা করুন।”[1] এখানে কবরের ‘আযাব দ্বারা শিশুকে আনুগত্য না করা বা গুনাহের কাজে লিপ্ত থাকার কারণে কবরে শাস্তি দেওয়া উদ্দেশ্য নয়; কেননা আল্লাহ কাউকে গুনাহ ব্যতীত শাস্তি দিবেন না। বরং এখানে কবরের ‘আযাব বলতে অন্যের কারণে মৃত ব্যক্তির যে কষ্ট হবে সে কষ্টের কথা বুঝানো হয়েছে; যদিও তার কর্মের কারণে কবরে শাস্তি হবে না।

এ ধরণের ‘আযাবের বর্ণনা অন্য হাদীসেও বর্ণিত আছে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«إِنَّ المَيِّتَ لَيُعَذَّبُ بِبُكَاءِ أَهْلِهِ عَلَيْهِ».

“মৃত ব্যক্তিকে তার জন্য বিলাপের কারণে কবরে ‘আযাব দেওয়া হয়”।[2] অর্থাৎ সে জীবিত ব্যক্তির কান্নার কারণে ব্যথিত হয় ও কষ্ট পায়, জীবিত ব্যক্তির গুনাহের কারণে তাকে শাস্তি দেওয়া হয় না। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٞ وِزۡرَ أُخۡرَىٰ١٦٤﴾ [الانعام: ١٦٤]

“আর কোনো ভারবহনকারী অন্যের ভার বহন করবে না।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৬৪]

এমনিভাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«السَّفَرُ قِطْعَةٌ مِنَ العَذَابِ».

“সফর ‘আযাবের অংশ বিশেষ।”[3] সুতরাং ‘আযাব শাস্তির চেয়ে ব্যাপক। নিঃসন্দেহে কবরে অনেক দুঃখ-কষ্ট, দুঃশ্চিন্তা, হতাশা থাকবে যার প্রভাব শিশুর মধ্যে পরিলক্ষিত হবে। অতএব আল্লাহর কাছে কবরের ‘আযাব থেকে শিশুর জন্য পানাহ চাওয়া মুসল্লির জন্য শরী‘আতসম্মত। আল্লাহই অধিক জ্ঞাত।

[1] দো‘আ, ত্বাবরানী, পৃষ্ঠা ৩৫৮, হাদীস নং ১১৮৭; মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং ৭৭৬।

[2] মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১২৮৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯২৭।

[3] মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯২৭।
চতুর্দশতম মাসআলা: কবরের ‘আযাব কি সর্বদা চলতে থাকবে নাকি তা মাঝে মাঝে হবে?

উত্তর: কবরের ‘আযাব দু’ধরণের।

১- সার্বক্ষণিক ‘আযাব। এর প্রমাণ আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

﴿ٱلنَّارُ يُعۡرَضُونَ عَلَيۡهَا غُدُوّٗا وَعَشِيّٗا٤٦﴾ [غافر: ٤٦]

“আগুন, তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় তার সামনে উপস্থিত করা হয়।” [সূরা গাফের, আয়াত: ৪৬]

সামুরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরে ‘আযাবপ্রাপ্ত ব্যক্তি সম্পর্কে বলেছেন,

«فهو يُفْعَلُ بِهِ إِلَى يَوْمِ القِيَامَةِ».

“তার সাথে এভাবে কিয়ামত পর্যন্ত করা হবে।”[1]

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরে ‘আযাবপ্রাপ্ত দু’জনের কবরে খেজুরের ডাল পুঁতে রেখেছেন। সেখানে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«لَعَلَّهُ يُخَفِّفُ عَنْهُمَا مَا لَمْ يَيْبَسَا».

“হয়ত এ ডালগুলো শুকনো থাকা পর্যন্ত তাদের কবরের ‘আযাব হালকা করা হবে।”[2] এ হাদীসে ‘আযাব হালকা হওয়া নির্দিষ্ট সময়ের সাথে নির্ধারণ করা হয়েছে, আর তা হলো সেগুলো যতক্ষণ ভিজা থাকবে। তাহলে মূল হলো, কবরের ‘আযাব সর্বদা চলতে থাকবে।

তবে কিছু হাদীসে বর্ণিত আছে যে, দু ফুঁৎকারের মাঝে তাদের কবরের ‘আযাব হালকা করা হবে। যেহেতু তারা যখন কবর থেকে উঠবে তখন তারা বলবে,

﴿قَالُواْ يَٰوَيۡلَنَا مَنۢ بَعَثَنَا مِن مَّرۡقَدِنَا ٥٢﴾ [يس: ٥٢]

“তারা বলবে, হায় আমাদের দুর্ভোগ! কে আমাদেরকে আমাদের নিদ্রাস্থল থেকে উঠালো?” [সূরা ইয়াসীন, আয়াত: ৫২]

২- দ্বিতীয় প্রকারের কবরের ‘আযাব নির্দিষ্ট কিছু দিনের জন্য হয়ে বন্ধ হয়ে যাবে। আর তা হবে কতিপয় গুনাহগারের ‘আযাব; যাদের কিছু পাপ ছিল, সে অনুপাতে শাস্তি ভোগ করে তাদের ‘আযাব বন্ধ রাখা হবে।

[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৩৮৬।

[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২১৮।
পঞ্চদশতম মাসআলা: মৃত্যুর পরে কিয়ামত পর্যন্ত রূহসমূহ কোথায় অবস্থান করে?

উত্তর: আলিমগণ এ ব্যাপারে অনেক মতানৈক্য করেছেন। তাদের প্রত্যেকেরই দলীল রয়েছে। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, মৃত্যুর পরে রূহ জান্নাতে থাকে। আবার কেউ বলেছেন, রূহ জান্নাতের দরজায় থাকে। আবার অন্য একদল বলেছেন, রূহ কবরে থাকে। আবার আরেকদল বলেছেন, রূহসমূহকে ছেড়ে দেওয়া হয়, সেগুলো যেভাবে ইচ্ছা ঘুরে বেড়ায়। কেউ কেউ বলেছেন, এগুলো আল্লাহর কাছে থাকে। আরেকদলের মত হলো, মুমিনের রূহ আদম ‘আলাইহিস সালামের ডান হাতে এবং কাফিরের রূহ আদম ‘আলাইহিস সালামের বাম হাতে থাকে।

মূলকথা হলো, রূহসমূহ স্তর অনুসারে বরযাখে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করে। কোনো রূহ ঊর্ধ্ব জগতের সর্বোচ্চ ‘ইল্লীয়ীনে অবস্থান করে। এগুলো হলো নবীদের রূহ। তাদের রূহও পরস্পর মর্যাদা অনুসারে বিভিন্ন অবস্থানে থাকে। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি‘রাজের রাতে দেখেছেন।

আবার কিছু রূহ সবুজ পাখির পাকস্থলিতে করে জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা সেখানে উড়ে বেড়ায়। এগুলো শহীদের আত্মা, তবে সব শহীদের আত্মা এভাবে উড়তে পারে না, কেননা কিছু শহীদের আত্মা ঋণ বা অন্যের হকের কারণে জান্নাতের দরজায় আটকে যায়। যেমন মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হলে আমার জন্য কী রয়েছে?

«قَالَ: الْجَنَّةُ فَلَمَّا وَلَّى قَالَ: إِلَّا الدَّيْنُ، سَارَّنِي بِهِ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلَامُ آنِفًا».

“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, জান্নাত। লোকটি যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তবে ঋণ ব্যতীত। জিবরীল আলাইহিস সালাম এইমাত্র আমাকে এ কথা গোপনে জানিয়ে গেলেন।”[1]

আবার কারো রূহ জান্নাতের দরজায় আটকা থাকবে। যেমন অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তি মারা গেলে তার সম্পর্কে বলেন,

«إِنَّ صَاحِبَكُمْ مَحْبُوسٌ عَنِ الْجَنَّةِ بِدَيْنِهِ».

“নিশ্চয় তোমার ভাই ঋণের কারণে জান্নাতে প্রবেশ করা থেকে আটকে আছে।”[2]

আবার কারো কারো রূহ কবরে আটকা থাকবে:

«كَلَّا وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، إِنَّ الشَّمْلَةَ الَّتِي أَخَذَهَا يَوْمَ خَيْبَرَ مِنَ المَغَانِمِ لَمْ تُصِبْهَا الْمَقَاسِمُ لَتَشْتَعِلُ عَلَيْهِ نَارًا».

“কখনও নয়। যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম! ঐ কম্বল যা সে খাইবরের দিন গনীমতের মাল বন্টন হওয়ার পূর্বে আত্মসাৎ করেছিল, তা তার উপর আগুন হয়ে জ্বলছে।”[3]

আবার কারো রূহ জান্নাতের দরজায় অবস্থান করবে। যেমন ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,

«الشُّهَدَاءُ عَلَى بَارِقٍ - نَهْرٍ بِبَابِ الْجَنَّةِ - فِي قُبَّةٍ خَضْرَاءَ، يَخْرُجُ عَلَيْهِمْ رِزْقُهُمْ مِنَ الجَنَّةِ بُكْرَةً وَعَشِيًّا».

“শহীদগণ জান্নাতের দরজায় দীপ্তমান নহরে সবুজ গম্বুজ বিশিষ্ট স্থানে থাকবে, সকাল-সন্ধ্যা তাদের জন্য জান্নাত থেকে খাবার আসবে।”[4] তবে জা‘ফর ইবন আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ক্ষেত্রে এটি ভিন্ন হবে। কেননা আল্লাহ তার দুহাতের বিনিময়ে দুটি ডানা দিয়েছেন, যা দ্বারা তিনি ইচ্ছামত জান্নাতের যেখানে খুশি সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারেন।

আবার কারো রূহ জমিনে আবদ্ধ থাকে। তার রূহ ঊর্ধ্ব আসমানে যাবে না। কেননা এসব রূহ জমিনের নিম্নে থাকার রূহ। জমিনে অবস্থানরত রূহগুলো আসমানে অবস্থানরত রূহের সাথে মিলিত হবে না। যেমন, আসমানে অবস্থানরত রূহগুলো জমিনে অবস্থানরত রূহের সাথে মিলিত হবে না। যেসব রূহ দুনিয়াতে রবের পরিচয় লাভ করে নি, তাঁর ভালোবাসা অর্জন করে নি, তাঁর যিকর করে নি, তাঁর সাথে বন্ধুত্ব অর্জন করে নি, তাঁর নৈকট্য লাভ করে নি ইত্যাদি রূহ হলো জমিনে অবস্থানরত রূহ। মৃত্যুর পরে শরীর থেকে তাদের রূহ বের হলে তা জমিনেই অবস্থান করবে।

এমনিভাবে ঊর্ধ্বমুখী নফসসমূহ যা দুনিয়াতে আল্লাহর ভালোবাসা, যিকর, নৈকট্য লাভ ও বন্ধুত্ব স্থাপনে সর্বদা ব্যস্ত ছিলো সেগুলো শরীর থেকে আলাদা হওয়ার পরে তার উপযোগী ঊর্ধ্বজগতের রূহের সাথে মিলিত হবে। ব্যক্তি যাকে ভালোবাসে তার সাথে বারযাখে ও কিয়ামতে থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা বারযাখে ও কিয়ামতের দিনে রূহসমূহকে একে অন্যের সাথে মিলিত করে দিবেন, যা ইতোপূর্বে বর্ণিত হাদীসে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি মুমিনের রূহ তার অনুরূপ মুমিনের রূহের মধ্যে প্রবেশ করাবেন। অতএব, মৃত্যুর পরে রূহ শরীর থেকে আলাদা হলে তার আমল অনুযায়ী তার আকৃতির উপযোগী ও সমজাতীয় রূহের সাথেই থাকবে। তখন সেখানে তাদের সাথেই থাকবে।

আবার কিছু রূহ যিনাকারী ও যিনাকারীনির সাথে থাকবে, কিছু রূহ রক্তের নদীতে সাঁতার কাটবে, কিছু রূহকে পাথর গ্রাস করবে। অতএব, সব রূহ একই স্থানে সুখে বা দুঃখে থাকবে না; বরং কিছু রূহ ‘ইল্লীয়ীনের সর্বোচ্চ ঊর্ধ্বজগতে থাকবে, আর জমিনের নিম্ন স্তরের রূহসমূহ জমিন থেকে উপরে উঠতে পারবে না বরং জমিনের নিম্নস্তরে থাকবে।

[1] মুসনাদ আহমাদ, ২৮/৪৯১, হাদীস নং ১৭২৫৩। হাদীসের সনদটি সহীহ লিগাইরিহি। হাদীসটি মুসলিমে অন্য বর্ণনাকারী থেকে বর্ণিত আছে, হাদীস নং ১৮৮৫।

[2] মুসনাদ আহমাদ, ৩৩/৩৭৫, হাদীস নং ২০২২২। হাদীসের সনদটি সহীহ, এর বর্ণনাকারীগণ বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনাকারী।

[3] মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৭০৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৫।

[4] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২৩৯০, হাদীসের সনদটি হাসান; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৪৬৫৮, আলবানী রহ. হাদীসটির সনদকে হাসান বলেছেন (আত্ব-তা‘লীক আত্ব-তারগীব, ২/১৯৬।
ষষ্ঠদশতম মাসআলা: জীবিত মানুষের আমলের দ্বারা কি মৃত ব্যক্তির রূহ উপকৃত হয়?

উত্তর: হ্যাঁ, জীবিত মানুষের দুটি আমলের দ্বারা মৃত ব্যক্তির রূহ উপকৃত হয়, এ দুটি আমলের ব্যাপাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত একমত। সেগুলো হচ্ছে:

প্রথমত: ব্যক্তি জীবিত থাকাকালীন যেসব আমল তার মৃত্যুর পরে তার আমলনামায় সাওয়াব পাওয়ার কারণ, সেসব আমল করলে মৃত ব্যক্তির উপকারে আসে।

দ্বিতীয়ত: মুসলিমগণ তার জন্য যেসব দো‘আ, ইসতিগফার, সাদকা ও হজ আদায় করে তা তার উপকারে আসে।

তাছাড়া অন্যান্য শারীরিক আমল যেমন, সাওম, সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, যিকর ইত্যাদির সাওয়াব মৃত ব্যক্তির কবরে পৌঁছে কি-না সে ব্যাপারে আলিমগণ মতানৈক্য করেছেন। সব ধরণের আমলের সাওয়াব মৃত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে, এ মতকে ইবনুল কাইয়্যেম রহ. অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “হজ, সাদকা ও গোলাম আযাদের সাওয়াব যে কারণে পৌঁছে সেভাবেই অন্যান্য ইবাদত যেমন সাওম, সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, ‘ইতিকাফ ইত্যাদির সাওয়াবও পৌঁছে। এটি তার জন্য জীবিত মানুষের হাদিয়া, আর কারো হাদিয়া তার কাছে পৌঁছানো তার জন্য এক ধরণের ইহসান।”[1]

অতঃপর ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেছেন, “মাইয়্যেতের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ হাদিয়া হলো গোলাম আযাদ, সাদকা, তার জন্য ইস্তিগফার, দো‘আ ও তার পক্ষ থেকে হজ আদায়।”[2]

[1] রূহ, ইবনুল কাইয়্যিম রহ. পৃষ্ঠা ৩৩৪।

[2] রূহ, পৃষ্ঠা ৩৪৫।
সপ্তদশতম মাসআলা: রূহ কি কাদীম (সর্বদা ছিল, আছে, থাকবে এমন) নাকি হাদীস তথা সৃষ্ট?

উত্তর: সমস্ত নবী-রাসূল একমত যে, রূহ আল্লাহর সৃষ্টি, তৈরি, তাঁর প্রতিপালিত ও তাঁরই হুকুমে পরিচালিত। এটি দীনের অত্যাবশ্যকীয় জ্ঞাতব্য বিষয়, যা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। সাহাবী, তাবে‘ঈ ও তাবে-তাবে‘ঈদের যুগে এ ব্যাপারে কোন মতানৈক্য ছিলো না, আর এ তিনটি যুগ ছিলো সর্বোত্তম যুগ। এরপরে পথভ্রষ্ট ও বিদ‘আতীরা বলতে শুরু করল যে, রূহ আল্লাহর সৃষ্টি নয়; বরং কাদীম তথা সর্বদা ছিলো।

অষ্টাদশতম মাসআলা: রূহ কি শরীর সৃষ্টির আগে সৃষ্টি করা হয়েছে নাকি শরীর আগে সৃষ্টি করা হয়েছে?

উত্তর: এ প্রশ্নের উত্তরে আলিমগণ কয়েকটি মত পেশ করেছেন। সেগুলো হলো:

১- একদল বলেছেন, রূহ শরীর সৃষ্টির আগে সৃষ্টি করা হয়েছে।

২- আরেকদল বলেছেন, শরীর রূহ সৃষ্টির আগে সৃষ্টি করা হয়েছে।

সঠিক মত হলো, দ্বিতীয় মতটিই অধিকতর সঠিক। অর্থাৎ শরীর আগে সৃষ্টি করা হয়েছে, অতঃপর রূহ সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কথার দলীল হলো আল্লাহ তা‘আলা আদম আলাইহিস সালামকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তার মধ্যে রূহ ফুঁৎকার করেছেন। ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেছেন, কুরআন, হাদীস ও সাহাবীদের আসার বা বাণী প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা শরীর সৃষ্টি করার পরে এর মধ্যে রূহ ফুঁৎকার করেছেন।[1]

[1] রূহ, ইবনুল কাইয়্যিম রহ. পৃষ্ঠা ৪১০।
উনবিংশতম মাসআলা: নসফের (আত্মার) হাকীকত কী?

উত্তর: এ মাসআলার ব্যাপারে আলিমগণ নানা দিক থেকে কথা বলেছেন, তাদের এক একজনের কথা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে এবং ভুল-ত্রুটিও বেশি হয়েছে। আল্লাহ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারীদেরকে হিদায়াত দান করেছেন তারা হকের যে বিষয়ে মতানৈক্য করেছিল তাঁর অনুমতিক্রমে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে সরল সঠিক পথের হিদায়াত দান করেন।

সঠিক মত হলো, রূহ এমন একটি আকৃতি (কাঠামো) যা বাহ্যিক শরীরের সত্তা (প্রকৃতি) থেকে আলাদা। রূহ নূরানী আকৃতি, ঊর্ধ্বমুখী, অতিসূক্ষ্ম, জীবিত ও চলনশীল। এটি শরীরের প্রধান কাজ করে, গোলাপের মধ্যে যেমন পানি গোপন থাকে তেমনিভাবে শরীরে রূহ গোপন থাকে; যাইতুনের মধ্যে যেমন তেল বিদ্যমান থাকে তেমনিভাবে শরীরের মধ্যে রূহ বিদ্যমান; কয়লার মধ্যে যেভাবে আগুন সূক্ষভাবে থাকে তেমনিভাবে রূহ শরীরের মধ্যে অতি সূক্ষ্মভাবে বিদ্যমান থাকে। যতক্ষণ শরীর প্রচুর পরিমাণে কাজ করার সামর্থ্য রাখে ততক্ষণ উক্ত সূক্ষ্ম শরীর (রূহ) এ শরীরের সাথে আঁকড়ে থাকে এবং রূহের এ প্রভাব তার অনুভূতি, ইচ্ছাকৃত চলাফেরায় পরিলক্ষিত হয়। আর এ শরীর যখন কঠোর মিশ্রন করার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং শরীরের মধ্যে কাজ করার যোগ্যতা বিলুপ্ত হয়, তখন রূহ শরীর থেকে বেরিয়ে যায় এবং রূহ জগতের সাথে মিলে আলাদা হয়ে যায়।

বিংশতম মাসআলা: নফস ও রূহ কি একই জিনিস নাকি দু’টি দু’জিনিস?

উত্তর: আল-কুরআনে নফস তথা আত্মাকে মানুষের পুরো সত্তাকে বুঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿فَسَلِّمُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِكُمۡ﴾ [النور : ٦١]

“(তবে তোমরা যখন কোন ঘরে প্রবেশ করবে) তখন তোমরা নিজদের ওপর সালাম করবে।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৬১]

আল্লাহ তা‘আলা নফস সম্পর্কে আরও বলেছেন,

﴿وَلَا تَقۡتُلُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ﴾ [النساء : ٢٩]

“আর তোমরা নিজেরা নিজদেরকে হত্যা করো না।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯]

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿يَوۡمَ تَأۡتِي كُلُّ نَفۡسٖ تُجَٰدِلُ عَن نَّفۡسِهَا١١١﴾ [النحل: ١١١]

“(স্মরণ কর সে দিনের কথা) যেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের পক্ষে যুক্তি-তর্ক নিয়ে উপস্থিত হবে।” [সূরা আন-নাহাল, আয়াত: ১১১]

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿كُلُّ نَفۡسِۢ بِمَا كَسَبَتۡ رَهِينَةٌ٣٨﴾ [المدثر: ٣٨]

“প্রতিটি প্রাণ নিজ অর্জনের কারণে দায়বদ্ধ।” [সূরা আল-মুদ্দাসসির, আয়াত: ৩৮]

আবার কুরআনে নফসকে শুধু রূহের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন,

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿يَٰٓأَيَّتُهَا ٱلنَّفۡسُ ٱلۡمُطۡمَئِنَّةُ٢٧﴾ [الفجر: ٢٧]

“হে প্রশান্ত আত্মা!” [সূরা আল-ফাজর, আয়াত: ২৭]

﴿أَخۡرِجُوٓاْ أَنفُسَكُمُ﴾ [الانعام: ٩٣]

“(এমতাবস্থায় ফিরিশতারা তাদের হাত প্রসারিত করে আছে, তারা বলে), তোমাদের জান বের কর।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৯৩]

অন্য দিকে রূহ কখনও শরীরের জন্য ব্যবহৃত হয় নি; একাকিও নয়, আবার নফসের সাথেও নয়। অতএব, নফস ও রূহের মধ্যে পার্থক্য হলো সিফাত তথা গুণের মধ্যে; যাতের মধ্যে পার্থক্য নেই।

দেখানো হচ্ছেঃ ১১ থেকে ২০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 পরের পাতা »