এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, সুদ, সুদের অপকারিতা ও তার ভয়ঙ্কর পরিণতি সম্পর্কে বেশি বেশি আলোচনা হওয়া দরকার। কারণ যে সুদী কারবার করে সে আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করে। আর কোনো মুসলমান এমনটি কল্পনাও করতে পারে না। তাই এ থেকে দূরে থাকতে প্রতিটি মুসলমানের জন্য সুদের বিধান ও তার প্রকার-প্রকরণ জানা অপরিহার্য।
এ গুরুত্ব বিবেচনা করেই আমি নিজের এবং আমার মতো জ্ঞানের দৈন্যতায় ভোগা মুসলিম ভাই-বোনদের জন্য সুদের বিধানাবলির ওপর কুরআন-হাদিসের দলিলাদি একত্রিত করেছি। বর্ণনা করেছি ব্যক্তি ও সমাজের ওপর এর কুপ্রভাবের দিকগুলোও।
আমি প্রথমে ভূমিকা তারপর তিনটি পর্ব এবং সবশেষে উপসংহার তুলে ধরে বইটির বিন্যাস করেছি এভাবে-
প্রথম পর্ব : প্রাক ইসলামি যুগে সুদ। এ পর্বে রয়েছে তিনটি অধ্যায়। যথা-
প্রথম অধ্যায় : রিবা বা সুদের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ।
দ্বিতীয় অধ্যায় : ইহুদি ধর্মে সুদ।
তৃতীয় অধ্যায় : জাহিলি যুগে সুদ।
দ্বিতীয় পর্ব : ইসলাম ধর্মে সুদের অবস্থান। এ পর্বে রয়েছে চারটি অধ্যায়। যথা-
প্রথম অধ্যায় : সুদ সম্পর্কে সতর্কিকরণ।
দ্বিতীয় অধ্যায় : রিবায়ে ফযল- (ক) রিবায়ে ফযল সম্পর্কে বর্ণিত কয়েকটি বক্তব্য। (খ) এর বিধান এবং রিবার সকল প্রকার। এবং (গ) রিবা হারাম হওয়ার কারণ ও হিকমত।
তৃতীয় অধ্যায় : রিবায়ে নাসিয়া। (ক) সংজ্ঞা (খ) রিবায়ে নাসিয়া সম্পর্কে বর্ণিত কয়েকটি বক্তব্য।
চতুর্থ অধ্যায় : বাইয়ে ইনা। (ক) সংজ্ঞা (খ) এর বিধান এবং তার নিন্দায় বর্ণিত কয়েকটি উদ্ধৃতি।
তৃতীয় পর্ব : যে সব ক্ষেত্রে কম-বেশি করা বা বাকি দেয়া জায়িয আছে। এ পর্বে রয়েছে তিনটি অধ্যায়। যথা-
প্রথম অধ্যায় : ওজন বা পরিমাপ করে বিক্রি হয় না এমন জিনিস কম-বেশি করে বেচা-কেনা বৈধ।
দ্বিতীয় অধ্যায় : বাইয়ে সরফ এবং তার বিধান।
তৃতীয় অধ্যায় : সন্দেহ থেকে দূরে থাকার প্রতি উদ্বুদ্ধ করণ।
চতুর্থ পর্ব : সমকালীন রিবার কতিপয় মাসআলার ব্যাপারে ফতোয়া।
পঞ্চম পর্ব : সুদের ক্ষতি ও অপকারিতা এবং তার কুপ্রভাব।
উপসংহার : এতে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল।
‘রিবা’র আভিধানিক অর্থ : বৃদ্ধি করা। যেমন-আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
فَإِذَا أَنْزَلْنَا عَلَيْهَا الْمَاءَ اهْتَزَّتْ وَرَبَتْ
‘অতঃপর যখনই আমি তাতে পানি বর্ষণ করি, তখন তা আন্দোলিত ও স্ফীত (বৃদ্ধি প্রাপ্ত) হয়।’[1] আরও ইরশাদ করেন-
أَنْ تَكُونَ أُمَّةٌ هِيَ أَرْبَىٰ مِنْ أُمَّةٍ
‘একদল অপর দলের চেয়ে বড় হবে।’[2] অর্থাৎ অধিক সংখ্যক। যেমন বলা হয় অমুকে অমুকের চেয়ে বেশি লাভ করেছে।[3]
রিবার আসল অর্থ বৃদ্ধি : তা মূলে নয়তো মূলের বিনিময়ের মাঝে। যেমন এক দিরহামের বিনিময়ে দুই দিরহাম। আবার প্রত্যেক হারাম ও নিষিদ্ধ ব্যবসাকেও রিবা বলা হয়।[4]
রিবার শরয়ি বা পারিভাষিক অর্থ
নির্দিষ্ট কয়েকটি জিনিসে কম-বেশি করা। দুই ধরনের রিবার ক্ষেত্রে এ সংজ্ঞা প্রযোজ্য। যথা- রিবাল-ফযল ও রিবান-নাসিয়া।
[2]. নাহল : ৯২
[3]. মুগনি : ৬/৫১
[4]. শরহুন নাবাবি আলা মুসলিম: ৮/১১, ফাতহুল বারি : ৪/৩১২
ইহুদিরা সেই আদিকাল থেকেই ষড়যন্ত্র ও কূটকৌশল প্রিয় জাতি হিসেবে প্রসিদ্ধ। তারা তাদের কাছে প্রেরিত নবীর বিরুদ্ধে নানা কূটচাল চালত। তাদের সেসব কূটকৌশলের একটি ছিল সুদ খাওয়ার ব্যাপারে কৌশলের আশ্রয় নেয়া। অথচ তাদের নবী এ থেকে তাদের বারণ করেছেন। হারাম ঘোষণা করেছেন সুদ খাওয়া। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
فَبِظُلْمٍ مِنَ الَّذِينَ هَادُوا حَرَّمْنَا عَلَيْهِمْ طَيِّبَاتٍ أُحِلَّتْ لَهُمْ وَبِصَدِّهِمْ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ كَثِيرًا وَأَخْذِهِمُ الرِّبَا وَقَدْ نُهُوا عَنْهُ وَأَكْلِهِمْ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ ۚ وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ مِنْهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا
‘সুতরাং ইয়াহুদীদের যুলুমের কারণে আমি তাদের উপর উত্তম খাবারগুলো হারাম করেছিলাম, যা তাদের জন্য হালাল করা হয়েছিল এবং আল্লাহর রাস্তা থেকে অনেককে তাদের বাধা প্রদানের কারণে। আর তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল।’[1]
হাফেজ ইবনে কাসির রহ. বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তথা ইহুদিদের সুদ খেতে নিষেধ করেন, তারপরও তারা সুদ খাওয়া থেকে বিরত থাকেনি। এজন্য তারা নানা কৌশল গ্রহণ করল। বিষয়টিকে সন্দেহের বাতাবরণে ঢেকে ফেলল আর মানুষের সম্পদ খেতে লাগল অবৈধ পন্থায়।’[2]
ইহুদিরা সুদ হারাম ঘোষণাকারী বক্তব্যকেই বিকৃত করল। তারা সে বক্তব্যের ব্যাখ্যা দাঁড় করাল এভাবে, ইহুদিদের পরস্পরের মাঝে সুদ খাওয়া নিষেধ, তবে অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে ইহুদিদের সুদী কারবার করতে কোনো বারণ নেই। রাব নামক এক ইহুদি যাজক বলে, যখন কোনো খৃস্টানের দরকার পড়বে দিরহামের, ইহুদির উচিৎ হবে সর্বদিক থেকে এ সুযোগে তার ওপর প্রভাব বিস্তার করা। তাকে আটকে ফেলা ব্যাপক লাভের বেড়াজালে। যাতে সে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত হয়। এবং তার সম্পদের মালিকানা খর্ব হয় কিংবা তার সম্পদ এবং ঋণ সমান্তরাল হয়ে যায়। এভাবে ইহুদি খৃষ্টান ব্যক্তির ওপর কর্তৃত্ব লাভ করবে অতপর বিচারকের সহযোগিতায় তার সম্পদের অধিকার কেড়ে নিতে সক্ষম হবে।[3]
সুতরাং আল্লাহর বাণীর আলোকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তিনি তাওরাত গ্রন্থেই ইহুদিদের ওপর সুদ হারাম করেছেন। তারা আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেছে এবং কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে তাঁর বাণীর বিকৃতি সাধন করেছে। তারা মনগড়া ব্যাখ্যা স্থির করেছে যে, হারাম শুধু ইহুদিদের পরস্পরের মাঝে সুদী লেনদেন করা অন্যথায় অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে সুদী কারবার করা হারাম নয়। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে তাদের ভৎর্সনা করেছেন। যেমনটি জানা গেল উপরের আয়াত থেকে।
[2]. তাফসিরে ইবনে কাসির: ১/৫৮৪
[3]. উমর বিন সুলাইমান আল আশকার, সুদ ও মানব সমাজের ওপর তার কুপ্রভাব: ৩১
জাহিলি যুগে সুদের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। এমনকি তারা তাদের ধারণা মতে এটাকে বিশাল লাভ হিসেবে গণ্য করত। ইমাম তাবারি রহ. তদীয় তাফসির গ্রন্থে ইমাম মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন, জাহিলি যুগে তারা এমন ছিল যে, কারও ওপর কারও ঋণ থাকলে সে বলত, ‘আমি তোমার পাওনা অর্থ আরও পরে শোধ করব, বিনিময়ে এ পরিমাণ অর্থ পাবে। এতে সে সম্মত হয়ে যেত।[1]
জাহিলি যুগের লোকদের অভ্যাস ছিল, ঋণ পরিশোধের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে ঋণদাতা ঋণগ্রহীতাকে জিজ্ঞেস করত, তুমি কি এখন ঋণ পরিশোধ করবে নাকি বেশি দেয়ার শর্তে আরও সময় নেবে ? ঋণ পরিশোধ না করলে তার ওপর বৃদ্ধির হার ধার্য করে দিত। আর ঠিক করে দিত নতুন মেয়াদ।
জাহিলি যুগে চক্রবৃদ্ধি সুদ যেমন ছিল নগদ অর্থে, গবাদি পশুর ওপরও তেমনি প্রচলিত ছিল বাৎসরিক সুদ। যদি কারও কাছে কারও ঋণের অতিরিক্ত পাওনা থাকত সে মেয়াদ পূর্ণ হওয়া মাত্র তার কাছে এসে বলত, ‘তুমি কি ঋণ শোধ করে দিবে নাকি অতিরিক্তসহ পরে দেবে ? যদি সে দিতে পারত দিয়ে দিত; নয়তো সে তার কাছে সেই উট দিত যা তার পাওনা উটের চেয়ে এক বছরের বড়। যদি তার পাওনা হত বিনতে মাখায বা এক বছরের উট সে দিত বিনতে লাবুন বা দুই বছরের উট। অতপর তার কাছে দ্বিতীয় বছর পাওনা চাইতে আসলে না দিতে পেরে হিক্কা দিত তৃতীয় বছরে। এ মেয়াদ শেষ হলে সে এলে তাকে জিযআ বা চার বছরের উট দিত। এভাবে ওপরে উঠতে উঠতে ঋণদাতা বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়ে যেত। অষ্টম বছরে তার কাছে এলে যখন সে তাও পরিশোধ না করতে পারত পরের বছর তাকে দ্বিগুণ দিত। সে বছর না দিতে পারলে তারও দ্বিগুণ দিত। যখন একশতটি হত তখন দুইশতটি দিতে হত। এ বছর দিতে না পারলে পরের বছর তাকে চারশ’টি দিতে হত। আল্লাহ তাআলা এদের কথাই বলেছেন কুরআনে কারিমে- ‘হে মুমিনগণ, তোমরা সুদ খাবে না বহুগুণ বৃদ্ধি করে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও।’[2]
সুতরাং জানা গেল জাহিলি যুগে সুদকে ওই সব লাভের মধ্যে গণ্য করা হত সম্পদের মালিক যা ভোগ করে। এ ব্যাপারে সে অন্য ভাইয়ের প্রতি লক্ষ্য করে না যে, সে লাভবান হল নাকি ক্ষতিগ্রস্ত ? সে গরিব হয়ে গেল নাকি ধনী ? দৃষ্টি শুধু এক দিকেই থাকে- বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া। এতে অন্য কেউ ধ্বংসের মুখে পড়লেও তা দেখার বিষয় নয়। তারা এমন করত তাদের অমানবিক আচরণ এবং নষ্ট চরিত্র বলেই। তাদেরকে যে চরিত্র দিয়ে পাঠানো হয়েছে তা বিকৃত হওয়ার ফলেই। এ জন্যই তাদের সমাজে কুকর্ম ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছিল। ছিল না সেখানে অন্যের সম্মান। ছোটরা বড়দের সম্মান দিত না। বড়রাও ছোটদের স্নেহ করত না। ধনীরাও দেখাত না গরিবদের প্রতি কোনো মমতা। সমাজের সবাই ছিল অনাচার ও হট্টগোলে দিশেহারা। আর সবচে’ আফসোসের বিষয় হলো, এ সুদ শুধু জাহিলি যুগেই সীমাবদ্ধ থাকে নি বরং ইসলামি সমাজ বলে দাবিদার পরিমন্ডলেও তা ঢুকে পড়েছে অনায়াসে- যারা দাবি করে যে তারা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করেছে ! এ জন্য প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য আল্লাহর নির্দেশ পালন করা এবং সত্যিকারার্থেই তাঁর আইন প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হওয়া। তবে যারা মুসলমান হিসেবে দাবি করার পরও সুদী কারবার করেন তাদেরকে বিনীত উপদেশ দান ও এ বিশাল অপরাধ থেকে সতর্ক করার সঙ্গে সঙ্গে এও বলব যে, চিন্তা করে দেখুন আপনারা কি প্রাক কুরআন নাজিল যুগে ফিরে যাননি ? প্রত্যাবর্তন করেননি কি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আগমন পূর্ব কালের সেই নির্দয় অসভ্য সমাজে ?
[2]. আলে ইমরান : ১৩০
এ পর্বে রয়েছে চারটি অধ্যায়। যথা-
প্রথম অধ্যায়: সুদ সম্পর্কে সতর্কিকরণ।
দ্বিতীয় অধ্যায়: রিবায়ে ফযল এবং-
(ক) রিবায়ে ফযল সম্পর্কে বর্ণিত কয়েকটি বক্তব্য।
(খ) এর বিধান এবং রিবার সকল প্রকার। ও
(গ) রিবা হারাম হওয়ার কারণ ও রহস্য।
তৃতীয় অধ্যায়: রিবায়ে নাসিয়া। এবং- (ক) সংজ্ঞা এবং (খ) রিবায়ে নাসিয়া সম্পর্কে বর্ণিত কয়েকটি বক্তব্য।
চতুর্থ অধ্যায়: বাইয়ে ইনা। এবং- (ক) সংজ্ঞা এবং (খ) এর বিধান এবং তার নিন্দায় বর্ণিত কয়েকটি উদ্ধৃতি।
রিবা বা সুদ থেকে সতর্ক করে কুরআন ও সুন্নায় অনেক বক্তব্য এসেছে। আর কুরআন-সুন্নাহ যেহেতু শরিয়তের এমন প্রধান দুই উৎস যে, এ দুটোকে যে অবলম্বন করবে; এতদুভয়ের অনুসরণ ও আনুগত্য করবে, সে হবে কামিয়াব; চির সফল। যে মুখ ফিরিয়ে নিবে তার জন্য রয়েছে এক সংকুচিত জীবন তদুপরি কিয়ামতে তাকে উঠানো হবে অন্ধ হিসেবে।
- আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, বেচা-কেনা সুদের মতই। অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, যা গত হয়েছে তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওলায়। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।[1]
- আল্লাহ সুদকে মিটিয়ে দেন এবং সদাকাকে বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ কোন অতি কুফরকারী পাপীকে ভালবাসেন না।[2]
- হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও, আর যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরা যুলম করবে না এবং তোমাদের যুলম করা হবে না।’[3]
ইবনে আববাস রা. বলেন, এটি শেষ আয়াত যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম-এর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল।[4] - আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ, তোমরা সুদ খাবে না বহুগুণ বৃদ্ধি করে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও।’[5]
- আল্লাহ তাআলা সুদ হারাম করেন আর ইহুদিরা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে সুদ বৈধ করার চেষ্টা করে, সেদিকে ইঙ্গিত করে মহান রব বলেন- ‘আর তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল।’[6]
- ‘আর তোমরা যে সুদ দিয়ে থাক, মানুষের সম্পদে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য তা মূলতঃ আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। আর তোমরা যে যাকাত দিয়ে থাক আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে (তাই বৃদ্ধি পায়) এবং তারাই বহুগুণ সম্পদ প্রাপ্ত।’[7]
- জাবির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদদাতা, গ্রহীতা এবং এর লেখক ও সাক্ষীদ্বয়কে অভিশাপ দিয়েছেন।’[8]
- সামুরা বিন জুনদুব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘রাতে আমি দেখলাম, দু’জন লোক এসে আমার কাছে এলো। তারা আমাকে এক পবিত্র ভূমির দিকে নিয়ে গেল। আমরা চলছিলাম, সহসা এক রক্ত নদীর পাড়ে গিয়ে উপস্থিত হলাম যার মাঝে দন্ডায়মান এক ব্যক্তি। নদীর মাঝখানে এক ব্যক্তিকে দেখা গেল। সামনে তার পাথর। মাঝের লোকটি নদী পেরুনোর জন্য যেই সামনে অগ্রসর হয়, পাথর হাতে দাঁড়ানো ব্যক্তি অমনি তার মুখে পাথর মেরে তাকে পূর্বের জায়গায় ফিরিয়ে দেয়। এভাবে যখনই সে নদী পেরিয়ে আসতে চায়, লোকটি তখনই তার মুখে পাথর মেরে পেছনে ঠেলে দেয়। আমি বললাম, ব্যাপার কী ? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম বললেন, আমি যাকে নদীর মধ্যখানে দেখেছি সে সুদখোর।’[9]
- আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘ধ্বংসকারী সাতটি জিনিস থেকে বেঁচে থাক। সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, সেগুলো কী কী? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, শিরক করা, যাদু করা, অনুমোদিত কারণ ছাড়া কাউকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, এতিমের মাল ভক্ষণ করা, জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা এবং সতী সরলা মুমিনা নারীকে ব্যাভিচারের অপবাদ দেয়া।’[10]
- ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘সুদের অর্থ দিয়ে যা-ই বৃদ্ধি করুক না কেন অল্পই কিন্তু তার শেষ পরিণাম।’[11]
- সালমান বিন আমর তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- কে বিদায় হজে আমি বলতে শুনেছি, তিনি বলেন- ‘মনে রেখ জাহিলি যুগের সকল সুদ ভিত্তিহীন। তোমাদের জন্য শুধুই মূলধন। তোমরা জুলুম করবেও না এবং সইবেও না।’[12]
এ হাদিসে জাহিলি যুগের প্রচলিত রীতিগুলোকে ইসলাম প্রত্যাখ্যান করেছে। যদি অমুসলিম ব্যক্তি তার ইসলাম পূর্ব সময়ে লাভ হিসেবে সুদের পাওনাদার হয়। অতপর সে অর্থ গ্রহণের আগেই ইসলামে প্রবেশ করে। তবে শুধু তার মালের মূল অংশ গ্রহণ করবে; লাভটুকু ছেড়ে দিবে। আর ইসলামের আগে এ ধরনের যে কারবারগুলো হয়েছে ইসলাম সে ব্যাপারে ক্ষমা ঘোষণা করেছে। সুতরাং তাদেরকে অতীত কারবার সম্পর্কে কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। ইসলাম অতীত ক্ষমা করে দিয়েছে। কারণ, ইসলাম পূর্বকৃত সকল গুনাহ মাফ করে দেয়।[13]
- আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘এমন এক সময় উপস্থিত হবে যখন লোকেরা পরোয়া করবে না সম্পদ হালাল নাকি হারাম উপায়ে অর্জিত।’[14] নবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন সংবাদ দিয়েছেন মানুষকে সম্পদের ফিতনা থেকে বাঁচানোর জন্য। তিনি এমন সংবাদ দিয়েছেন যা তাঁর যুগে ছিল না। এ ধরনের ভবিষ্যৎবাণী তাঁর নবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণও বটে।[15]
- আবি জুহায়ফা রা. তদীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, ‘নবী সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রক্ত ও কুকুরের মূল্য নিতে এবং দাসীর উপার্জন গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। অভিশাপ দিয়েছেন উল্কি অঙ্কনকারী, উল্কি গ্রহণকারী এবং সুদ গ্রহীতা ও সুদদাতাকে। আরও অভিশাপ দিয়েছেন তিনি চিত্রাঙ্কনকারীকে।’[16]
- আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘সুদের তিয়াত্তরটি স্তর রয়েছে। সর্বনিম্নটি হলো নিজের মায়ের সঙ্গে জেনা করার সমতুল্য। আর অপর ভাইয়ের সম্মান নষ্ট করা সবচে’ নিকৃষ্ট সুদ।[17]
- ফেরেশতা কর্তৃক গোসল করার সৌভাগ্যধন্য হানযালা তনয় আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘জেনে বুঝে এক দিরহাম পরিমাণ সুদ খাওয়া ছত্রিশবার জেনা করার চেয়েও বড় অপরাধ।[18]
- ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘যখন কোনো জনপদে সুদ ও ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়ে তখন তারা নিজেদের ওপর আল্লাহর আজাব বৈধ করে নেয়।[19]
[2]. বাকারা : ২৭৬
[3]. বাকারা : ২৭৮-২৭৯
[4]. ফাতহুল বারি : ৪/৩১৪
[5]. আলে ইমরান : ১৩০
[6]. নিসা : ১৬১
[7]. রুম : ৩৯
[8]. মুসলিম : ৭৫৯৭
[9]. বুখারি : ২০৮৫, ফাতহুল বারি : ৪/৩১৩
[10]. বুখারি : ২০১৫, মুসলিম : ৮৯
[11]. ইবনে মাজা : ২২৭৯। আলবানি সহি জামে সগিরে ৫/১২০ বলেছেন, এটি সহি হাদিস।
[12]. আবু দাউদ : ৩৩৩৪
[13]. আওনুল মাবুদ বি শরহি সুনানে আবি দাউদ : ৯/১৮৩
[14]. বুখারি : ২০৮৩
[15]. ফাতহুল বারি : ৪/২৯৭
[16]. বুখারি : ২২২৮
[17]. মুস্তাদরাকে হাকেম : ২/৩৭
[18]. মুসনাদে আহমদ : ৫/২২৫
[19]. মুস্তাদরাকে হাকেম : ২/৩৭
রিবায়ে ফযল সম্পর্কে বর্ণিত কতিপয় হাদিস-
- আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘তোমরা কমবেশি করে স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ বিক্রি করো না। হ্যা, সমান সমান বিক্রি করতে পার। তোমরা কমবেশি করে রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য বিক্রি করো না। হ্যা, সমান সমান বিক্রি করতে পার। তোমরা এসব জিনিসে বাকির বিনিময়ে নগদে বিক্রি করো না।’ [1]
- উসমান বিন আফ্ফান রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘তোমরা এক দিনারের বিনিময়ে দুই দিনার অথবা এক দিরহাম দুই দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করো না।’[2]
- আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘সোনার বদলে সোনা, রুপার বদলে রুপা, গমের বদলে গম, যবের বদলে যব, খেজুরের বদলে খেজুর এবং লবণের বদলে লবণ বিক্রি করো নগদ নগদ এবং সমান সমান। যে বেশি দিবে অথবা বেশি নিবে সেটা সুদ হিসেবে গণ্য হবে। দাতা -গ্রহীতা এক্ষেত্রে সমান অপরাধী।’[3]
- উবাদা বিন সামেত রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘সোনার বদলে সোনা, রুপার বদলে রুপা, গমের বদলে গম, যবের বদলে যব, খেজুরের বদলে খেজুর এবং লবণের বদলে লবণ বিক্রি করো নগদ নগদ এবং সমান সমান। তবে যখন এসব জিনিসের প্রকার পরিবর্তন করা হবে তো যেভাবে ইচ্ছে বিক্রি করো। যখন তা হবে নগদ নগদ।’[4]
- মা’মার বিন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত যে, তিনি নিজ গোলামের হাতে এক সা পরিমাণ গম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, যাও এটি বিক্রি করো এবং এর বিনিময়ে যব কিনে আনো। গোলাম চলে গেল এবং এক সা’ ও তার অতিরিক্ত কিছু নিল। যখন সে মা’মারের কাছে এসে এ সংবাদ দিল তখন তিনি বললেন, এমন করেছ কেন ? তুমি আবার বাজারে যাও। আর মনে রেখ কমবেশি করে নিবে না। কেননা আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, খাবারের বদলে খাবার বিক্রি করতে হবে সমান সমান। তিনি বলেন, সেদিন আমাদের খাবার ছিল যব। তাকে বলা হলো, এটাতো একই জাতের খাদ্য নয়। তিনি বললেন, আমি এটাতেও সমান হওয়ার আশংকা করছি।[5]
এ হাদিসের ওপর ভিত্তি করে ইমাম মালেক রহ. মনে করেন, গম এবং যব একই জাতের খাদ্য যাতে কম-বেশি করে কেনাবেচা বৈধ নয়। তবে জমহুর উলামার মত অন্যরকম। তারা বলেন, গম এক জাতীয় শস্য আর যব অন্য জাতের শস্য। সুতরাং এদুয়ের মাঝে কমবেশি করে কেনাবেচা জায়িয আছে, যখন তা হবে নগদে। যেমন- গমের বদলে চাল ক্রয় ইত্যাদি। জমহুরের দলিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর উক্তি- ‘যদি এসব জিনিসের মধ্যে জাত পরিবর্তন হয় তবে যেভাবে ইচ্ছে কেনাবেচা করতে পার- যখন তা হবে নগদ মূল্যে।[6]
তেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর উক্তি ‘গমের বদলে যব বিক্রি করতে কোনো সমস্যা নেই এমনকি যব বেশি হলেও; যখন তা হবে নগদে। তবে বাকিতে হলে সেটা ভিন্ন কথা।[7] আর মা’মার বর্ণিত হাদিসের উত্তরে বলা হবে, এতে মালেকের রহ. পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। কারণ এতে তিনি স্পষ্ট বলেন নি যে, যব আর গম একই শ্রেণিভুক্ত শস্য। তদুপরি তিনি ভয় করেছেন- সেটা তার ব্যক্তিগত তাক্ওয়ার ব্যাপার।[8] এরপর আশা করা যায় আর কোনো শংসয় থাকবে না। যব এক স্বতন্ত্র জাত আর গম অন্য এক জাত। সুতরাং এ দুটির মাঝে কমবেশি করে কেনাবেচা বৈধ যখন তা হবে নগদে এবং বিক্রিত দ্রব্য হস্তান্তর হবে চলমান বৈঠক ভাঙ্গার আগেই।
- সাইদ ইবনুল মুসায়্যিব জানান, তাকে আবু হোরায়রা এবং আবু সাইদ রা.বলেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনি আদি আনসারির ভাইকে খায়বরের আমলা হিসেবে প্রেরণ করেন। একবার তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে ‘জানিব’[9] খেজুর নিয়ে আসেন। পয়গাম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, খায়বরের সব খেজুরই কি এমন ? তিনি আরজ করলেন, জি না, হে আল্লাহর নবী, আমরা বরং এক সা’ ‘জানিব’ ক্রয় করি দুই সা’ ‘জামা’[10] খেজুরের বিনিময়ে। এতদশ্রবণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘তোমরা এমনটি করো না। বরং সমান সমান বিক্রি করো নয়তো মন্দ জাতের খেজুর বিক্রি করো তারপর সে মূল্য দিয়ে উন্নত জাতের খেজুর কেনো। এটাই ইনসাফের দাবি।’[11]
- আবু সাইদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন বেলাল রা. কিছু ‘বারনি’ খেজুর নিয়ে এলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা দেখে বললেন, কোত্থেকে নিয়ে এলে এসব ? বেলাল রা. উত্তর দিলেন, আমার কাছে কিছু খারাপ খেজুর ছিল। সেগুলো দুই সা’ দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর জন্য এর এক সা’ কিনেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হায়! একি করেছ ? এটাতো খাঁটি সুদ। তুমি আর এমন করেবে না। যখন কিনতে চাইবে, আলাদাভাবে আগে সেটা বিক্রি করবে। তারপর সেই মূল্য দিয়ে এটা কিনবে।[12]
- আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবদ্দশায় ‘জামা’ খেজুর খেতাম। আর জামা হলো বিভিন্ন মানের মিশ্রিত খেজুর। আমরা সেসবের এক সা’ কিনতাম দুই সা’র বিনিময়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে যখন এ সংবাদ পৌঁছল তিনি বললেন, দুই সা’ খেজুরের বিনিময়ে এক সা’ খেজুর কেনা যাবে না, দুই সা’ গমের বিনিময়ে এক সা’ গম কেনা যাবে না এবং দুই দিরহামের বিনিময়ে এক দিরহাম কেনা যাবে না।[13]|
- ফুযালা বিন উবাইদুল্লাহ আনসারি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, খায়বরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে গনিমতের মাল উপস্থাপনকালে স্বর্ণ ও ছোট দানা খচিত একটি হার সামনে এলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হার থেকে স্বর্ণ আলাদা করার নির্দেশ দিলেন। অতপর তিনি তাদের বললেন, সমান সমান ছাড়া স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ বিক্রি করা না।’[14]
- ফুযালা রা. থেকে আরও বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, খায়বর বিজয়ের দিন আমি বারো দিরহামের বিনিময়ে একটি হার কিনলাম যাতে স্বর্ণ এবং ছোট দানা ছিল। পরে আমি সেগুলো আলাদা করে বারো দিরহামের বেশি পেলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে যখন এ বিবরণ শুনালাম তিনি বললেন, ‘স্বর্ণ ততক্ষণ পর্যন্ত বিক্রি করা উচিৎ নয় যাবৎ না তার থেকে অন্য জিনিস আলাদা করা হয়।’[15]
এ হাদিস থেকে জানা গেল স্বর্ণের বিনিময়ে অন্য জিনিসসহ স্বর্ণ বেচাকেনা জায়িয নেই যতক্ষণ না অন্য জিনিস স্বর্ণ থেকে পৃথক করা হয়। পৃথক করে স্বর্ণের বদলে স্বর্ণ কিনতে হবে একদম সমান সমান। আর অন্য জিনিস যা দিয়ে ইচ্ছে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে। তেমনি রুপাকেও রুপার বিনিময়ে অন্যবস্ত্ত সমেত বিক্রি করা জায়িয নেই, গম বিক্রি করা জায়িয নেই অন্য জিনিসসহ গমের বিনিময়ে এবং লবণ বিক্রি করা জায়িয নেই অন্যকিছুর সঙ্গে লবণের বিনিময়ে। এভাবে সুদ হয় এমন প্রত্যেক বস্ত্তই অন্য জিনিসসহ বিক্রি করা জায়িয নেই; যতক্ষণ না সেটাকে আলাদা করা হয়।
(খ) সুদের বিধান :
ইমাম নাববি রহ. বলেন, ‘সুদ হারামের ব্যাপারে সকল মুসলিম একমত; যদিও এর সংজ্ঞা ও মূলনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে।[16] আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদ হারামের ক্ষেত্রে ছয়টি জিনিসের নাম নির্দিষ্ট করেছেন। সেগুলো হলো, সোনা, রুপা, গম, যব, খেজুর ও লবণ।
আসহাবে জাহিরি বলেছেন, এ ছয়টি জিনিসের বাইরে কোনো কিছুতে সুদ নেই। প্রমাণের ক্ষেত্রে তাদের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণের সনাতন যে নীতি রয়েছে তারই ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্ত তাদের।
আসহাবে জাহিরি বাদে অন্যরা বলেছেন, সুদ এ ছয়টি জিনিসেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এ ছয়টির কারণের মধ্যে যা যা অন্তর্ভুক্ত সবগুলোর হুকুম অভিন্ন। তবে তারা মতবিরোধ করেছেন এ ছয় ধরনের জিনিসে বিদ্যমান হারাম হওয়ার ইল্লত বা কারণ নিয়ে।
ইমাম শাফেয়ি রহ. মনে করেন, সোনা এবং রুপায় ‘ইল্লত’ হলো এদুয়ের মূল্যমান। তাই পরিমাপযোগ্য ও অন্যান্য জিনিস এ দুয়ের মাঝে অন্তর্ভুক্ত হবে না ইল্লত অনুপস্থিত থাকার কারণে। আর বাকি চার জিনিসে ইল্লত হলো, এসবের খাদ্য জাতীয় হওয়া। এ জন্য প্রত্যেক খাদ্যদ্রব্যই সুদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে।
ইমাম মালেক রহ. সোনা ও রুপার ক্ষেত্রে ইমাম শাফেয়ির সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন। তবে অবশিষ্ট চারটির ব্যাপারে বলেছেন এসবের মধ্যে ইল্লত হলো, এসবের সংরক্ষণ এবং খাবারযোগ্য হওয়া।
ইমাম আবু হানিফার রহ. মতে সোনা ও রুপার ইল্লত মওযুনি বা ওজনযোগ্য হওয়া আর বাকি চারটির ইল্লত মাকিলি বা (শস্যের) পরিমাপযোগ্য হওয়া। সুতরাং প্রত্যেক মাকিলি এবং মওযুনি বস্ত্ততেই সুদের এ বিধান প্রযোজ্য।
সাইদ বিন মুসাইয়াব এবং ইমাম আহমদ ও শাফেয়ির পুরাতন মতানুসারে চারটির ইল্লত হলো একই সঙ্গে ওজন ও খাদ্য জাতীয় হওয়া।[17]
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘সকল সাহাবি, তাবেয়ি এবং ইমাম চতুষ্টয় একমত যে, সোনা, রুপা, গম, যব, খেজুর এবং আঙ্গুর সমগোত্রের সামগ্রীর বিনিময়ে কেবল সমান সমান বিক্রি জায়িয। কেননা কমবেশি করা অবৈধ সম্পদ ভক্ষণের নামান্তর।[18]
উলামায়ে কিরাম একমত যে, রেবা জাতীয় দ্রব্যকে তার সমগোত্রীয় দ্রব্যের বিনিময়ে বিক্রি বৈধ নয় যখন এক তরফে বাকি থাকে। তারা আরও একমত যে, একই গোত্রভুক্ত দ্রব্যকে নগদে কমবেশি করে বিক্রি করা বৈধ নয়। যেমন- সোনার বদলে সোনা বিক্রির সময়। তেমনি তারা একমত যে, একই জাতীয় দ্রব্যের বিনিময়ে বিক্রির সময় পণ্য হস্তগত করা পর্যন্ত ক্রয় মজলিস ত্যাগ করা বৈধ নয়। যেমন- সোনার বদলে সোনা, খেজুরের পরিবর্তে খেজুর অথবা অন্য জাতীয় তবে একই ইল্লত বিশিষ্ট জিনিস যেমন- সোনার বিনিময়ে রুপা এবং গমের বিনিময়ে যব। (এমন কেনাবেচার সময় হস্তগত হওয়ার আগে মজলিস ত্যাগ করা বৈধ নয়।)[19]
ইমাম ইবনে কুদামা সুদের বিধান সম্পর্কে বলেছেন, ‘এটি কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমার দ্বারা প্রমাণিত হারাম।[20]
সারকথা, সোনা এবং রুপায় সুদের হুকুম বর্তানোর কারণ এর মূল্যমান সমৃদ্ধ হওয়া আর বাকি চারটি এ জন্যে যে পরিমাপ, ওজন ও ভক্ষণযোগ্য। যেমন-গম, যব, চাল ইত্যাদি। আর যা ওজন, মাপ বা ভক্ষণ কোনো জাতীয়ই নয় তদুপরি বিক্রি হয় অন্য জাতীয় জিনিসের বিনিময়ে সেটাতে কোনো সুদ নেই। এমনটিই বলেছেন অধিকাংশ উলামা। যেমন-(আংটির) পাথর, (খেজুরের) বীচি ইত্যাদি।
সুদ হারাম হওয়ার কারণ এবং হিকমত :
মুমিন মাত্রেই বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তাআলা এমন কিছুর নির্দেশ দেন না বা এমন কিছু থেকে বারণ করেন না যাতে কোনো না কোনো হিকমত বা নিগূঢ় রহস্য লুকায়িত থাকে নেই। আমরা যদি সে রহস্য জানতে পারি তাহলে তা আমাদের জন্য অতিরিক্ত অর্জন। যদি না জানি তবে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। আমাদের কাম্য ও কর্তব্য হচ্ছে, আল্লাহ ও রাসূল সা. যা করতে বলেন তা সম্পাদন করা আর যা বারণ করেন তা থেকে বিরত থাকা। সুদ হারাম হওয়ার পশ্চাতে যেসব কারণ ও হিকমত কার্যকর তার কয়েকটি এই -
- সুদ এক ধরনের জুলুম আর আল্লাহ তাআলা জুলুম হারাম করেছেন।
- অসুস্থ হৃদয়ের মালিকদের প্রতারণার রাস্তা বন্ধ করে দেয়া।
- সুদের মধ্যে প্রতারণা রয়েছে।
- পণ্যের মান ধরে রাখা।
- সুদ আল্লাহ প্রবর্তিত পদ্ধতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।[21]
[2]. মুসলিম : ১৫৮৫
[3]. মুসলিম : ১৫৮৪
[4]. মুসলিম : ১৫৯২
[5]. মুসলিম : ১৫৮৭, শরহুন নাবাবি ১১/১৪
[6]. মুসলিম : ১৫৮৭, দেখুন শরহুন নাবাবি : ১১/১৪
[7]. সুনানে আবি দাউদ : ৩৩৪৯, আউনুল মাবুদ : ৩/১৯৮
[8]. শরহুন নাবাবি : ১১/২০
[9]. এক প্রকারের উন্নত জাতের খেজুর।
[10]. এক ধরনের অনুন্নত জাতের খেজুর। কেউ ব্যাখ্যা করেছেন, কাঁচা-পাকা মিশ্রিত খেজুর।
[11]. মুসলিম : ১৫৯৩
[12]. বুখারি : ২২০২, মুসলিম : ১৫৯৪
[13]. মুসলিম : ১৫৯৫
[14]. মুসলিম : ১৫৯১, শরহুন নাবাবি : ১১/১৭
[15]. মুসলিম : ১৫৯১, শরহুন নাবাবি : ১১/১৮
[16]. শরহুন নাবাবি : ১১/০৯
[17]. শরহুন নাবাবি : ১১/০৯
[18]. ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া : ২০/৩৪৭, আশ শারহুল কাবির : ১২/১১, শরহুয যারাখশি : ৩/৪১৪
[19]. শরহুন নাবাবি : ১১/০৯
[20]. আল মুগনি : ৬/৫১
[21]. মুগনি লি ইবনে কুদামা : ৬/৫৩, নাইলুল আওতার : ৬/৩৪৬-৩৫৮
(ক) রিবায়ে নাসিয়ার সংজ্ঞা:
জাহিলি যুগে এমন প্রচলন ছিল, একজন অপরজনকে নির্দিষ্ট মেয়াদের ওপর অর্থ ঋণ দিত এ শর্তে যে, প্রতি মাসে তাকে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ দিতে হবে। অথচ মূল অর্থ আপনাবস্থায় বহাল থাকবে (কমবে না)। যখন সে মেয়াদ পুরা হবে; ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার কাছে মূল অর্থ ফেরত চাইবে। যদি সে পরিশোধ করতে অক্ষম হয়, তাহলে মেয়াদ পুনঃনির্ধারণ করে মাসিক প্রদেয় অর্থের পরিমাণও বাড়িয়ে দিবে। সুদের এ প্রকার যদিও ‘রিবাল ফযল’ এর সংজ্ঞায় পড়ে তথাপি তার নাম দেয়া হয়েছে নাসিয়া এ জন্য যে, এতে নাসিয়া বা বাকিই মূল উদ্দেশ্য।
ইবনে আববাস রা. রিবায়ে নাসিয়া ছাড়া অন্য কোনো প্রকারকে সুদ বলতেন না এ বলে যে, নাসিয়া-ই তখন সমাজে প্রচলিত ছিল।[1]
অবশ্য একটু পরেই আমরা তাঁর এ মত প্রত্যাহার করে অন্যান্য সাহাবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে নাসিয়া, ফযল- সব রিবা হারামের পক্ষাবলম্বনের প্রমাণাদি তুলে ধরব। তারপর আর এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবে না। (সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য।)
(খ) রিবায়ে নাসিয়া সম্পর্কে বর্ণিত কয়েকটি বক্তব্য :
রিবায়ে নাসিয়া সম্পর্কে সমগ্র উম্মাহ একমত হলেও রিবায়ে ফযল সম্পর্কে ইবনে আববাস রা. এবং অন্যান্য সাহাবির মাঝে মতবিরোধ হয়। পরে তিনিও তাঁর মত থেকে ফিরে আসেন এবং সকল সাহাবির সঙ্গে রিবাল ফযল হারাম হওয়ার ব্যাপারে একমত হন। রিবান নাসিয়া হারাম হওয়াটা কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমা দ্বারা প্রমাণিত।
আবু সালেহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবু সাইদ খুদরি রা. কে বলতে শুনলাম, ‘দিনার দিনারের বিনিময়ে এবং দিরহাম দিরহামের বিনিময়ে সমান সমান বিক্রি করতে হবে। যে কমবেশি করবে সে সুদ খাওয়ার অপরাধ করল। আমি তাঁকে বললাম, ইবনে আববাস রা. অন্য কথা বলছেন। তিনি (আবু সাইদ খুদরি রা.) বললেন, আমি ইবনে আববাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি যা বলছেন তা কি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর মুখ থেকে শুনেছেন নাকি কুরআনে পেয়েছেন ? তিনি উত্তর দিলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর মুখেও শুনি নাই বা কুরআনেও পাইনি। তবে উসামা বিন যায়েদ আমাকে বলেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘রিবা নাসিয়া বা বাকিতেই।’[2]
ইবনে আববাসের অপর বর্ণনায় রয়েছে, উসামা বিন যায়েদ আমাকে শুনিয়েছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘সাবধান, নিশ্চয় সুদ হলো (নাসিয়া) বাকিতে।’[3]
ইমাম নাবাবি রহ. বলেন, ইবনে আববাস এবং ইবনে উমর রা. এর কথার ভিত্তি ছিল উসামা বিন যায়েদ রা. এর হাদিস ‘রিবা নাসিয়া বা বাকিতেই।’ অতপর তাঁরা উভয়ে নিজেদের মত থেকে ফিরে এসেছেন। তাদের কাছে যখন মুসলিম শরিফে বর্ণিত আবু সাইদ খুদরির রা. হাদিস পৌঁছে তখন তাঁরাও আলোচ্য বস্ত্তগুলোকে একই জাতীয় বস্ত্তর বিনিময়ে কমবেশি করে কেনাবেচা হারাম বলে মেনে নেন। ইমাম মুসলিম সংকলিত হাদিসগুলো থেকে বুঝা যায়, তাঁদের কাছে নাসিয়া বা বাকিতে ছাড়া নগদেও যে কমবেশি করে বিক্রি করা নিষেধ সে হাদিস পেঁŠছেনি। যখন পৌঁছেছে তখন তাঁরা নিজেদের মত থেকে ফিরে এসেছেন।
আর উসামা বিন যায়েদের হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এসব হাদিস দ্বারা তার হাদিস মনসুখ (রহিত) হয়ে গেছে। আর মুসলিম উম্মাহ যেহেতু এ হাদিসের ওপর আমল করেন না তাই বুঝা যায় এটি মনসুখ হয়ে গেছে।[4]
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেছেন, ‘উসামা রা. বর্ণিত হাদিসের শুদ্ধতার ব্যাপারে আলেমগণ একমত। তবে অন্যান্য হাদিসের সঙ্গে এর সমন্বয় করতে গিয়ে তাঁরা দ্বিমত করেছেন। বলা হয়েছে, হাদিসটি মনসুখ অথচ সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে কখনো মনসুখ প্রমাণিত হয় না। আবার বলা হয়েছে, হাদিসে ‘لاربا’ বা ‘নাসিয়া ছাড়া বাকিতে রিবা নাই’ বলে বুঝানো হয়েছে নাসিয়ার চেয়ে কঠিন শাস্তিযোগ্য কোনো রিবা নেই। যেমন- আরবরা বলে, ‘জায়েদ ছাড়া শহরে কোনো জ্ঞানী নাই।’ অথচ সে শহরে অনেক বিদ্বান রয়েছেন। কারণ এমন বলার উদ্দেশ্য, এর চেয়ে বড় নেই সেটা বুঝানো; একেবারে নেই তা বুঝানো উদ্দেশ্য নয়। দ্বিতীয়ত উসামা রা. এর হাদিস দ্বারা রিবায়ে ফযল হারাম না হওয়া বুঝা যায় পরোক্ষভাবে। পক্ষান্তরে আবু সাইদ খুদরির রা. হাদিসের বক্তব্য সুস্পষ্ট।[5]
উপরের আলোচনা দ্বারা আমাদের সামনে রিবায়ে নাসিয়া এবং রিবায়ে ফযল উভয়টার হারাম হওয়া প্রমাণিত হয়। সুতরাং কোনো প্রশ্ন বা সংশয়ের অবকাশ নেই।
[2]. মুসলিম : ১৫৯৬, শারহুন নাবাবি : ১১/২৫
[3]. বুখারি : ২১৭৯ এবং ২১৭৯, ফাতহুল বারি : ৪/৩৮১
[4]. শারহুন নাবাবি : ১১/২৫
[5]. ফাতহুল বারি : ৪/৩৮২
(ক) বাইয়ে ইনা’র সংজ্ঞা :
কেউ তার কোনো পণ্য অপরের কাছে বাকিতে বিক্রি করে ক্রেতার হাতে পণ্য তুলে দিল। তারপর সে মূল্য পরিশোধের আগেই তার (ক্রেতার) কাছ থেকে বিক্রেতা ওই একই পণ্য নগদ মূল্যে কিনে নিল তার চেয়ে কম মূল্যে।[1]
যেমন- কেউ তার পণ্য অপর এক ব্যক্তির কাছে এক বছর সময় দিয়ে বাকিতে একশ’ টাকা মূল্যে বিক্রি করল। অতপর একই সময়ে বিক্রেতা তার সদ্য বেচা পণ্য ক্রেতার কাছ থেকে নগদ পঞ্চাশ টাকা মূল্যে কিনে নিল আর প্রথম ক্রেতার কাঁধে পুরো একশ টাকার ঋণ রয়ে গেল!
(খ) বাইয়ে ইনা’র নিন্দায় উচ্চারিত কিছু বক্তব্য :
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- কে ইরশাদ করতে শুনেছি, তিনি বলেন- ‘যখন তোমরা পরস্পর বাইয়ে ইনা’র লেনদেন করবে আর জিহাদ ছেড়ে দিয়ে বলদের লেজ ধরে সন্তুষ্ট থাকবে কৃষিকাজ নিয়ে, আল্লাহ তাআলা তখন তোমাদের ওপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দিবেন। আল্লাহ এ লাঞ্ছনা তুলে নিবেন না যতক্ষণ তোমরা তোমাদের দীনের দিকে ফিরে আসবে।[2] হাদিসটি আরও কয়েকভাবে বর্ণিত হয়েছে।[3]
মালেক বিন আনাস, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আহমদ এবং কতিপয় শাফেয়ি প্রমুখ উলামায়ে কিরাম বাইয়ে ইনা'কে অবৈধ বলেছেন।
ইমাম শাওকানি রহ. বলেন, ‘ইনা’র লেনদেন যারা করে তারা এর নাম দেয় ক্রয়চুক্তি। অথচ আক্দ পুরা হওয়ার আগে এমনটি করা যে সুস্পষ্ট রিবার অন্তর্ভুক্ত সে ব্যাপারে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে একমত। তারপর তারা এ চুক্তির নাম দেয় মোয়ামালা। আর একে রূপ দেয় বিক্রয় চুক্তির। অথচ মোটেও তাদের এ ইচ্ছে নেই। এ হচ্ছে তাদের হিলা-বাহানা আর আল্লাহর সঙ্গে নিষ্ফল প্রতারণা। বাইয়ে ইনা করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি সবচে সহজ যে হিলা আবলম্বন করে তা হলো, সে তাকে (উদাহরণ স্বরূপ) এক টাকা কম এক হাজার টাকা কর্জ দেয়। অতপর তার কাছে এক দিরহাম মূল্যের এক টুকরো কাপড় বিক্রি করে পাঁচশ টাকায়।
এ ধরনের চালাকির মূলে কুঠারাঘাত করেছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর বিখ্যাত সে হাদিস ‘নিশ্চয় প্রত্যেক কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’[4] কারণ সে চায় এক হাজার টাকা দিয়ে দেড় হাজার টাকা কামাতে। তার কর্জ দেয়ার উদ্দেশ্যই হলো, অতিরিক্ত সুদ লাভ করা যেটাকে সে কাপড়ের মূল্য নাম দিয়ে হাসিল করতে চাইছে। প্রকৃতপক্ষে সে তাকে নগদ এক হাজার টাকা দিচ্ছে বাকিতে দেড় হাজার টাকার বিনিময়ে। আর কর্জ ও ক্রয়ের রূপ দিয়ে সে এ হারাম কাজ বৈধ করতে চাচ্ছে। আর এটা জানা কথা যে, এ ধরনের হিলা-বাহানা এর অবৈধতাকে রুখতে পারে না। সুদকে যেসব অকল্যাণের কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাও দূর করতে পারে না। বরং তা বিভিন্নভাবে এর অপকারিতা বাড়িয়ে দেয়।[5]
[2]. আবু দাউদ : ৩৪৬২, আউনুল মাবুদ : ৯/৩৩৫
[3]. দেখুন মুসনাদে ইমাম আহমদ : ২/৮৪
[4]. বুখারি : ০১, মুসলিম : ১৯০৭
[5]. নাইলুল আওতার : ৬/৩৬৩
এ পর্বে রয়েছে তিনটি অধ্যায়। যথা-
প্রথম অধ্যায় : যে সব ক্ষেত্রে কম-বেশি করা বা বাকি দেয়া জায়িয আছে
দ্বিতীয় অধ্যায় : বাইয়ে সরফ এবং তার বিধান।
তৃতীয় অধ্যায় : সন্দেহ থেকে দূরে থাকার প্রতি উদ্বুদ্ধ করণ।
প্রথম অধ্যায় : যে সব ক্ষেত্রে কম-বেশি করা বা বাকি দেয়া জায়িয আছে
(ক) কম-বেশি করা জায়িয যখন ‘ইল্লত’ অনুপস্থিত থাকবে :
ইমাম নাববি রহ. বলেন, আলেমগণ একমত যে, রেবা জাতীয় পণ্যকে রেবা জাতীয় পণ্যের বিনিময়ে কমবেশি করে এবং বাকিতে বিক্রি করা বৈধ যদি উভয়ের ইল্লত ভিন্ন হয়। যেমন- গমের বিনিময়ে সোনা বিক্রি এবং যবের বদলে রুপা ইত্যাদি পরিমাপযোগ্য পণ্য বিক্রি। তেমনি জাত ভিন্ন হলে নগদে কমবেশি করে বেচা-কেনা জায়িয এ ব্যাপারেও তাঁরা একমত। যেমন- এক সা’ গমের বিনিময়ে দুই সা’ যব কেনা ইত্যাদি।[1]
(খ) অপরিমাপযোগ্য জিনিসের মাঝে কমবেশি করে বিক্রি জায়িয :
ফিকাহবিদগণ প্রাণীকে প্রাণীর বদলে বাকিতে বিক্রির বৈধতা সম্পর্কে মতবিরোধ করেছেন। অধিকাংশ উলামার মতে, এটা বৈধ। তাদের দলিল আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস রা. এর হাদিস। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার উটের পালের পিঠে আমাকে একটি সৈন্যদল পাঠানোর নির্দেশ দিলেন। আমি লোকদের উটের পিঠে চড়ালাম। এক পর্যায়ে আমার উট শেষ হয়ে গেল। বাকি রয়ে গেল কয়েকজন- আমি তাদের বাহনের ব্যবস্থা করতে পারলাম না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, তুমি আমার পক্ষে কয়েকটি উট কেন সদকার উট দিয়ে আমি তা পরিশোধ করে দেব। যাতে এ দলটি পূর্ণ হয়ে যায়। আব্দুল্লাহ রা. বলেন, তাঁর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কথা মত আমি একেকটি উট কিনতে থাকি দুটি তিনটি করে উটের বিনিময়ে। এমনকি দল পূর্ণ হয়ে গেল। তিনি বলেন, যখন সদকার উট বাটোয়ারা শুরু হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা পরিশোধ করে দিলেন।[2]
জাবের রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একজন দাস এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাতে হিজরতের বাইয়াত করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম টের পান নি যে সে একজন গোলাম। পরে দাসের মুনিব এসে তাকে চাইল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, একে আমার কাছে বিক্রি করে দাও। অতপর তিনি তাকে দুইজন হাবশি গোলামের বিনিময়ে কিনে নেন। পরবর্তীতে তিনি কাউকে বাইয়াত করতেন না যতক্ষণ না জিজ্ঞেস করেন (সে কারো দাস কি না)।[3]
এ থেকে বুঝা যায়, দুই গোলামের বিনিময়ে এক গোলাম বিক্রি করা জায়িয আছে। চাই এদের মূল্য একই রকম হোক বা ভিন্ন। এটা নগদ হলে সবাই এর বৈধতার ব্যাপারে একমত। মানুষ ছাড়া অন্যান্য পশুর ক্ষেত্রেও একই বিধান।[4]
কেউ যদি এক গোলাম দুই গোলামের বিনিময়ে কিংবা এক উট দুই উটের বিনিময়ে বাকিতে বিক্রি করে তাহলে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মতানুযায়ী তা বৈধ। এটাই ইমাম শাফেয়ি এবং জমহুরের মত।[5]
উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান যে, অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মতানুসারে বাকিতে বা কমবেশি করে প্রাণীর বদলে প্রাণী বিক্রি করা জায়িয। কয়েকজন সাহাবি এবং তাবেয়ির বক্তব্যও প্রমাণ করে এমনটি। ইমাম বুখারি রহ. তদীয় সহি বুখারিতে বলেন-
১-ইবনে উমর রা. একটি সাওয়ারি প্রাণী খরিদ করেছেন নিজের জিম্মায় চারটি উটের দায়িত্ব নেয়ার মাধ্যমে। যা তিনি দিয়ে দিয়েছেন রাবাযা নামক স্থানে।
২-রাফে বিন খাদিজ রা. দুই উটের বিনিময়ে এক উট কেনেন। তাকে একটি উট দেন আর বলেন, অপরটা তোমাকে কাল দেব ইনশাআল্লাহ।
৩-ইবনে আববাস রা. বলেন, ‘এক উট কখনো দুই উটের চেয়ে উত্তম হয়।’
৪-ইবনে মুসাইয়াব বলেন, বাকিতে এক উটের মোকাবেলায় দুই উট কিংবা এক ছাগলের বিনিময়ে দুই ছাগল বেচায় কোনো সুদ নেই।[6]
[2]. মুসনাদে আহমদ : ২/২১৬, আবু দাউদ : ৩৩৫৭
[3]. মুসলিম : ১৬০২, শরহুন নাবাবি : ১১/৩৯
[4]. শরহুন নাবাবি : ১১/৩৯
[5]. শরহুন নাবাবি : ১১/৩৯
[6]. চারটি হাদিসই দেখুন ফাতহুল বারি : ৪/৪১৯